যতীনবাবুর চার হাত
যতীনবাবুর দোষটা কি জানেন?
আজ্ঞে না, দোষটা কী বলুন তো!
যতীনবাবুর সবচেয়ে বড়ো দোষ হল উনি বড্ড ভালোমানুষ।
অ। তা ভালোমানুষিটা দোষের খাতে ধরছেন কেন?
ধরব না মশাই? কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল, ব্যাংকে দিব্যি মোটা টাকার আমানত ছিল, কয়েক লাখ টাকা শেয়ারেও খাটছিল। গাড়ি—বাড়ি—জমিজমায় একপ্রকার ভাসাভাসি কাণ্ড, কিন্তু ওই যে, ভালোমানুষির দোষ। কেবল বলেন আমি একা ভালো থাকলে তো হবে না, অন্যদেরও ভালো রাখতে হবে। আর যেমনি কথা তেমনি কাজ। দু—হাতে আর কতই বা বিলানো যায়। ভগবান যদি চারখানা হাত দিতেন তবে বিলিয়ে সুখ হত।
বটে! তা তার ঠিকানাটা কী বলুন তো!
আহা! আগে সবটা শুনুন, তবে তো!
কিন্তু দেরি করলে সব বিলি হয়ে যাবে যে!
আরে না মশাই, না। বিলি হয়েই যেত, কিন্তু ভগবান যে তাঁর আবদার মঞ্জুর করবেন সেটা যতীনবাবু ভেবে দ্যাখেননি। এখন যে তাঁর বড়ো বিপদ চলছে।
কেন মশাই, বিপদ কীসের?
বলছি মশাই, বলছি। তার আগে একটা কথা শুনে রাখুন। ভগবান মানুষটা কিন্তু বড্ড বেখেয়ালের লোক। বড়ো গলা করে চেয়েচিন্তে দেখবেন, কথাটা ভগবান কানেই তুলবেন না হয়তো। কিন্তু হঠাৎ হয়তো আনমনে ফিসফিস করে কিছু একটা চেয়ে বসলেন, অমনি সেটা মঞ্জুর করে দিলেন। তাতে যে কত বিভ্রান্তি হয় সেটা মোটেই ভেবে দেখলেন না।
তা হলটা কী মশাই?
ওই চারটে হাত চেয়েছিলেন যতীনবাবু, ওইটেই তাঁর কাল হল। রাত্রিবেলা শুয়ে ঘুমোচ্ছেন হঠাৎ বগলের তলায় সুড়সুড়ি। প্রথমটায় তেমন বুঝতে পারেননি। অস্বস্তি বোধ করে এপাশ—ওপাশ করছেন, হঠাৎ দুই বগল ফুঁড়ে ভচাক ভচাক করে আরও দুটো হাত বেরিয়ে এল। প্রথমটায় তো চোরের হাত মনে করে চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন। বাড়ির লোকজনও সব লাঠিসোঁটা নিয়ে দৌড়ে এল। কিন্তু কাণ্ড দেখে সবাই তাজ্জব। চোর—ডাকাতের ব্যাপার নয়। যতীনবাবুর দুই বগলের তলা দিয়ে গায়ের গেঞ্জি ছিঁড়ে—খুঁড়ে আরও দুটো হাত বেরিয়ে এসেছে।
যাঃ, এ আপনি গুল দিচ্ছেন।
আপনি তো গুল বলেই খালাস। যতীনবাবুর অবস্থা দেখলে বুঝতে পারতেন এটা গুল হলেই বরং ভালো ছিল।
কেন মশাই, দু—দুটো বাড়তি হাত থাকলে কাজকর্মের বেশ সুবিধেই হওয়ার কথা।
কাজকর্মের কথা আর বলবেন না মশাই। কাজকর্মের আগে আরও জ্বলন্ত সব সমস্যা রয়েছে। প্রথম কথা যতীনবাবু সব জামারই দুটো করে হাতা। কিন্তু চারটে হাতকে দুটো হাতায় গলানো যাচ্ছে না বলে সকালেই দর্জিদের ডেকে পাঠানো হল। তারাও পড়ল সমস্যায়। জীবনে চার হাতাওয়ালা জামা বানায়নি, প্রথম সমস্যা হল সেটা।
আহা, হাতাগুলো একটু বেশি ঢোলা করে নিলেই তো হয়।
না, হয় না। নতুন হাত দুটো মহা বজ্জাত। তারা পুরোনো হাতের সঙ্গে এক হাতায় ঢুকতেই রাজি নয়। তারা মুঠো পাকিয়ে দর্জিদের দিকে তেড়ে যাওয়ায় সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকা হয়েছে। যাই হোক, শেষ অবধি চার হাতওয়ালা জামা তৈরি করা হল বটে, কিন্তু চার হাতার গেঞ্জি অমিল। যতীনবাবুর আবার গেঞ্জি ছাড়া চলে না, শেষ অবধি হোসিয়ারিতে অর্ডার দিয়ে অনেক কষ্টে গেঞ্জিরও বন্দোবস্ত হল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য ক্ষেত্রে।
সেটা কীরকম?
বলছি। যতীনবাবু এখন একুনে দু—খানা ডান হাত আর দু—খানা বাঁ—হাত, বুঝলেন তো!
দিব্যি বুঝেছি। দুটো ডান, দুটো বাঁ, সোজা হিসেব।
হিসেবটা যদি এত সোজা হত তাহলে আর চিন্তা ছিল কী? প্রথম মুশকিল হল খেতে বসে। যতীনবাবু পুরোনো ডান হাত দিলে জলখাবারের একখানা লুচি আলুর ছেঁচকি সাপ্টে সবে মুখে তুলেছেন অমনি তাঁর নতুন ডান হাত ফস করে আরও দু—খানা লুচি পায়েস মেখে তাঁর মুখে দিল গুঁজে। এখন আপনি বলুন আলুর ছেঁচকি সঙ্গে পায়েস মিশে গেলে সেটা খেতে কেমন হয়।
তাই তো! কথাটা ভেবে দেখার মতো।
দুপুরে সবে ঘি মাখা ভাতের গরাস মুখে তুলতে যাবেন এমন সময় তার বিকল্প ডান হাত একগোছা সজনে ডাঁটার চচ্চচড়ি তার মুখে গুঁজে দিলে যতীনবাবুর মনের অবস্থাটা কী হয় বলতে পারেন।
খুব খারাপ হওয়ার কথা।
আর শুধু কী তাই? টেলিফোন ধরতে যাবেন, সেই ফোন নিয়ে দুই ডান হাতে এমন কাড়াকাড়ি হল যে হাত ফসকে টেলিফোনটাই পড়ে ভেঙে গেল। বাঁ—হাতে ঘড়ি পরবেন সে উপায় নেই, এক হাতে ঘড়ি পরতে গেলেই আর—এক হাত খাবলা মারে। একটু তবলা বাজানোর শখ আছে যতীনবাবুর। কিন্তু এখন দুটো ডান হাত এবং দুটো বাঁ—হাত মিলে তবলা ডুগিতে এমন সব আওয়াজ তোলে যে কহতব্য নয়। বরাবর বাঁ—হাতে চায়ের কাপ ধরার অভ্যাস তাঁর, সবে চুমুক দেবেন অমনি নতুন বাঁ—হাতটা উঠে এসে কাপটা এমন চেপে ধরল যে গরম চা চলকে পড়ে পেটে ফোসকা হওয়ার জোগাড়। বাজার করতে গিয়েও বিপত্তি। পুরোনো হাতে বাছাই বেগুন তুলছেন নতুন হাত টপাটপ কানা বেগুন তুলে ব্যাগে ভরে দিচ্ছে। বুড়ো ঢ্যাঁড়স, পাকা পটল, ধশা আলু কী থাকছে না আজকাল তাঁর বাজারে!
এঃ হেঃ! যতীনবাবুর তো তাহলে খুব বিপদ যাচ্ছে মশাই।
তা আর বলতে। তাই বলছিলুম, ভগবানের কাছে ফস করে কিছু চেয়ে বসবেন না। বেখেয়ালের লোক, কোনটা দিয়ে ফেলেন কে জানে। যা আছে তাই নিয়েই খুশি থাকুন মশাই বুঝলেন?
খুব, খুব।