ময়মনসিংহ জেলা – নেত্রকোণা বিন্যাফৈর কমলপুর খালিয়াজুরি বারোঘর কালীহাতী সাঁকরাইল নাগেরগাতী সাখুয়া

ময়মনসিংহ জেলা

নেত্রকোণা

বর্ষণের আর বিরাম নেই। গায়ে কাপড় চাপা দিয়ে শুনি বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, টিনের ছাদের ওপর ঝম ঝম জল ঝরছে। রাত সাড়ে আটটায় পথঘাট নিশুতি, কারও সাড়া শব্দ নেই। হ্যারিকেনের আলোয় খাটের কোনায় মা বসে উলের প্যাটার্ন তুলছেন। বাড়ির পেছন দিয়ে অন্ধকার বৃষ্টিভরা রাতে সাড়ে আটটার ট্রেন শিস দিয়ে গেল। পাশেই কোর্ট স্টেশনে একটুকরো কোলাহল জেগে আবার মিলিয়ে গেল। সেই বারিবর্ষণের কিন্তু তবু বিরতি নেই!

গারো পাহাড়ের তলায় আমার পাহাড়তলির শহর, মগরা নদীর পাকে পাকে জড়ানো। সারাবছরে আট মাস তার বর্ষার সঙ্গে মিতালি। যখন মগরায় ঢল নামে, মানুষের হাঁস ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মাঝে মাঝে ঘরবাড়ি ভেসে আসে, দু-একটা ছাগল গোরুও আসে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ে, জলের ওপর ফুটকি ওঠে। কালীবাড়ির ঘাটে জল তোলপাড় করে ঝাঁপাই সাঁতরাই। বাংলার উত্তর-পূর্বতম প্রান্তে লাল সুরকির পথে যেখানে দাঁড়ালে গারো পাহাড়ের নীলাঞ্জন রেখা সবুজ হয়ে দেখা দেয় সেইখানে পাখপাখালি আর ফলন্ত ফসলের দেশে আমার ছোট্ট মহকুমা শহর, নেত্রকোণা। মেঠো পথ ভেঙে পাহাড়ি আনারস, কমলালেবু, আর চাল নিয়ে যে গাঁয়ের মানুষেরা আসে শনি-মঙ্গলের হাটে তারা বলে, কালীগঞ্জের শহর। নদীর ঘাটে পাটের বোঝা খালি করে দিয়ে রাত্রে নৌকোর মাঝিরা ভাটির দেশের গান গায়। অন্ধকারে জোনাকির তারার মতো ওদের কেরোসিনের পিদিম জ্বলে–ওরা বলে ‘কুপি’। নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ওদের ‘ব্যাপারী নাও’-এর কাজ-কারবার কত দেখেছি। ওরা আরও ভাটির দেশের গল্প শোনাত, যেখানে আরও জল, আরও ধান আর ‘উড়া হাঁস’। রাত্রে সেই জলের মধ্যে ‘জিনের বাতি জ্বলে, তখন পিরের নাম স্মরণ করতে হয়, পাঁচ আনার সিন্নি মানতে হয়। না হলে ওই জিনের ‘ভুলা বাতি’ ঘুরিয়ে মারে, চোখে দিশা লাগে। আমাদের এই দেশে বর্ষার প্রকোপটা কিছু যখন কমে, আকাশের বর্ষণ থামে আর মাঠে-ঘাটে যখন জল কলকল করে ছোটে তখন পাহাড় ডিঙিয়ে দূর দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো হাঁস আকাশে ছায়া ফেলে আসে। গাঁয়ের মানুষ বলে, ‘উড়া হাঁস’।

তাই যদিও আমাদের ওই শহরে তিনটে ছেলে আর একটা মেয়ে-ইস্কুল আছে, আদালত কাছারি আর দু-দুটো ছোটো রেল স্টেশন আছে–যদিও মিটার গেজ লাইনে দিনে দু-বার আসা যাওয়ার ট্রেনে মাছ আর পাট চালান যায়, তবু নেত্রকোণা শহর হয়ে উঠতে পারেনি।

চেষ্টার অন্ত ছিল না। কে কে সেনের মতো জবরদস্ত আই. সি. এস. অনেক মহৎ উন্নয়ন আন্দোলন করলেন, কিন্তু নেত্রকোণার মানুষের গেঁয়োমি কাটল না। মহকুমা হাকিম বৈদ্যনাথন যেদিন শহরের রাস্তায় প্রথম প্রচন্ড লাল ধুলো উড়িয়ে মোটর চালালেন সেদিন বড়োদের আর বিরক্তির সীমা ছিল না। শহরের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সেদিন উকিল মহলে ঘোরতর দুশ্চিন্তার কারণ ঘটেছিল। অতঃপর এমনতর দুর্বিপাক আর শহরের ধার ঘেঁষতে পারেনি।

এখানকার মানুষের নিত্যদিন চর্চায় দশটা-পাঁচটার বন্ধন ছিল নগণ্য–তার ভারবাহী ছিল অসহায় ছাত্ৰকুল আর আমমোক্তার মুহুরি-উকিলবাহিনী। আদালত আর ফৌজদারি এজলাসে দিন ছিল অফিসি ঢঙ-এ বাঁধা। আর কোনো অফিস-কাছারির স্থান তখন নেত্রকোণায় ছিল না। যুদ্ধ-দেবতার সন্তান হিসেবে সাপ্লাই আর কন্ট্রোল এবং আরও এবম্বিধ অফিস যখন পক্ষ বিস্তার করল, সে অনেক পরের কথা। সেই নগণ্য সংখ্যকের বাইরে আমরা ছিলাম ভোরবেলা ফেন-ভাত-খাওয়া মানুষ, দ্বিপ্রহরের ভোজনপর্ব সমাধা করতে দেড়টার ট্রেন এসে পড়ত, শুরু হত সায়াহ্নের প্রারম্ভকাল। আহার্যের প্রাচুর্যে যেমন অনটন ছিল না, সময়ের বিস্তৃতিকে সুখের আড্ডায় রসিয়ে তোলারও তেমনি কৃপণতার প্রয়োজন হয়নি। ছোটোবেলায় ইস্কুল যাতায়াতের পথে দেখতাম তেরিবাজারের তেমাথায় অভয়দার চায়ের দোকানে বয়স্ক মহলের ভিড়। সাদা পিরিনে সোনালি পানীয় চা-এর সঙ্গে আমাদের তখনও আলাপ হয়নি। সেখানে কখনো কখনো বৃষ্টি পড়তে আশ্রয় নিয়েছি, দেখতাম নুয়ে-পড়া ঘরের আবছায়া কোণে একদিকে কেটলি ধূমায়মান, অন্যদিকে অভয়দার প্রশস্ত তক্তপোশে গুটিসুটি বসে বারোইয়ারি আলাপে মত্ত বয়োজ্যেষ্ঠ দল। তাঁদের আলোচনার অর্থ বুঝতাম না। কিন্তু তখনই, নেত্রকোণার ছেলে আমরা, বুঝতে শিখেছি যে, এ-রসের তুলনা নেই। যে কহে আর যে শোনে সবাই পুণ্যবান। এঁরা কেউ অভয়দার কাঁথা টেনে, কেউ সিগারেট ধরিয়ে বসেছেন বর্ষার প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায়, নিম্নস্বর গুজব-আলাপনে। ঘর গুলজার। এই অভয়দার চায়ের দোকানের সামনে ছিল আমগাছ একটি, তাতে কদাপি ফল ধরেছে। আমের নামে না থোক, আমতলা ছিল অন্য কারণে শহরের সকল জীবনের কেন্দ্রস্থল। এই অভয়দার ঘরের ভেতরে শীতের রাত্রি আর বর্ষায়, গ্রীষ্মে ও শরতে সম্মুখবর্তী আমতলায় বিশ্ব-রাজনীতি ও ঘরোয়া নীতি নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। পরবর্তী বয়সে আমরা আমতলা আর অভয়দার দোকানের উত্তরাধিকার পেয়েছিলাম। কিন্তু তারও পূর্বে আড্ডার অমৃত সুখ আমরা উপভোগ করেছি। কালীবাড়ির দো-মাথার কাছে আমাদের বাড়ির পশ্চিমে রাস্তার পাশেই কাঁঠাল গাছের ছায়ায় ছিল সুখলালের বাঁশের মাচা। আমরা বলতাম,–সুখলালের চাঙাড়ি। সেইখানে নিত্য সকালে আমাদেরও আসর জমত, প্রথম প্রথম সুখলাল তাড়া করত। অবশেষে সেখানে আমাদের অধিকার পাকা হল। সামনের দোকানে পোদ্দার মশাই হাতুড়ি ঠুকতেন, তাঁর ঘর নদীর ঢালু পাড়ে কাত হয়ে পড়েছে। তাঁর ছেলে শ্রীমান রামু ছিল আমাদেরই শাগরেদ। কী যে কথার ভান্ডার ছিল জানি নে, কিন্তু ছুটির দিনে আমাদেরও সেই বেলা একটা। সেখানে খেলার মাঠের দল পাকানো, কাঁচা আম ও লিচু চুরির জল্পনা, সুধীর মুজমদারের গোঁফ, এমনকী যুগান্তরের দাদাদের সেই সব রোমাঞ্চকর আগ্নেয় অভিযানের বিষয়ও ছিল আলোচ্য বস্তুর তালিকায়। রাজনীতি ক্ষেত্রে তখনই আমাদের মতো দশ-বারো বৎসরের অবোধদের প্রবেশাধিকার মিলেছে। সুধীর মজুমদার মশাই হিজলি না বক্সার কোন জেল থেকে সাত-আট বৎসরের সাধনায় বিরাট এবং সামরিক ধরনের একটা গোঁফ নিয়ে ফিরেছেন। তাঁর নেতৃত্বের আর বাধা রইল না। পাড়া জুড়ে সাড়া পড়ল। সাজ, সাজ, সাজ। তখন পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ দর্শনের সৌভাগ্য প্রায় কারুরই হয়নি। কিন্তু হলে কী হবে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র হঠাৎ কোথা থেকে একবার এসে পড়লেন, শহরে সে কী হইহই কান্ড! তখন জানা গেল শ্বেতাঙ্গ নামক একদল রক্তপায়ী পশু সত্যই দেশে আছে। আমার কাকু এবং পাড়ার গণেশদা বিপ্লবীদের দু-একটা সত্যি কাহিনি আমাদের শোনাতে শুরু করেছেন। কোথাও কোনো অপরাধ করলে কিংবা লুকিয়ে পান খেলে অথবা তাস খেললে তাঁদের কাছে বকুনি ও উপদেশের সীমা থাকত না। বাড়ির অভিভাবকেরাও তখন ছেলেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে পাড়ার দাদা তথা রাজনীতির দাদাদের কাছেই নালিশ জানাতেন। সব মিলে আমাদের ছোটো শহরের তিনটি জিনিস ওই বয়সেই প্রধান হয়ে উঠল–আচ্ছা, পাড়া ও রাজনীতি। পাড়ার দাদারা ছিলেন বাড়ির এবং রাজনীতি ক্ষেত্রের অভিভাবক। কিছুদিন পরে আরও আট-দশজন দাদা কারাবন্ধন ঘুচিয়ে বেরিয়ে এলেন–দেখতে দেখতে আমতলার আড্ডা গরম হয়ে উঠল! আমাদের ইস্কুল যাওয়ার পথের পাশে তেরিবাজার ও মেছুয়াবাজারের মাঝামাঝি জায়গায় একটা কংগ্রেসের কার্যালয়ও জেঁকে উঠল। কালীবাড়ির নাটমন্দিরে মেয়েদের একটা সভা ডেকে কীসব প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেল। সে সময়ে লাল সুরকির পথের পাশে একদিকে ছিল নদী, অন্য দিকে একসারি বাড়ি, তার পেছনে ধানখেত। আমাদের শহরটা একপ্রস্থ বাড়ি ছাড়িয়ে আর ঘনত্বে বাড়ল না, কেবলই বিস্তৃত হয়ে চলেছিল! এই বাড়িগুলোর পেছন দিকে ছিল আর একটা শানপাতা ছোটো পথ, ধানখেতের পাশ দিয়ে। সে পথটা মহিলাদের অন্তঃপুর থেকে অন্তঃপুরে গতায়াতের যোগসূত্র। ধীরে ধীরে সে পথ ছেড়ে মহিলারা ক্রমশ বেরোলেন সামনের সদর রাস্তায়।

এতকাল দেখেছি মেয়ে-ইস্কুলের ‘ঝি’ এসে বেলা ন-টায় একবার রাস্তা দিয়ে হাঁক পেড়ে যেত। তারপর খালি পা, ভেজা চুল, গাছকোমর-শাড়ি একপাল মেয়ে তাড়িয়ে সেই ‘ঝি’ তার ছাতা ও ছেঁড়া চটি টানতে টানতে মোক্তারপাড়ার দিকে পথ ধরত। সেখানে দুই মানুষ উঁচু টিনের বেষ্টনী তুলে মেয়ে-ইস্কুল স্তব্ধ। আর তারই উলটো দিকে দত্ত হাই-এর দিলদরিয়া খোলা মাঠে আমাদের দিনভর হইহই। বছরে একটি দিন সন্ধেবেলায় সেই মেয়ে-ইস্কুলের টিনের দরজা খুলত, ছেলে-মেয়েতে মিলে সেদিন হত রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব। দাদাদের কাছে শুনতাম, শান্তিনিকেতনের বাইরে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব প্রথম হয়েছিল আমাদের এই পান্ডববর্জিত দেশে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেসব দিন সরে গেল। এখন ঝি ছাড়াই মেয়েরা চলেন, দু-একটা বিদগ্ধ রাজনীতি আলোচনায়ও ওঁদের অঞ্চলের ছায়াপাত ঘটে। দিন কাটছিল বেশ। শহর জুড়ে রাজনীতি ছাড়া কথা নেই, দেখতে দেখতে আরও চায়ের দোকান বসল তেরিবাজারের পাড়ায়। নদীর ঢালু পাড়ের ওপর তাদের ঝোলানো বারান্দা, বর্ষায় জল এসে নীচে খেলা করে। যুবা, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধের জন্যে বয়ঃক্রমে নির্দিষ্ট হল চায়ের ঘর-তারও মধ্যে কংগ্রেস, আর. সি. পি. আই. ও কম্যুনিস্টদের চা-পান সভা পৃথক হল। আমতলা থেকে শুরু করে নদীর ধারে ধারে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ল রাজনৈতিক দলের আলাপন গৃহ। মাঝখানে অভয়দা আর মানিকের ঘরে চায়ের আড্ডা সর্বজনের। সকল দলের লোক সেখানে আসে। চেঁচিয়ে পাড়া গরম করে তারপর ধীরে সুস্থে নিজের নিজের চা-ঘাঁটির বিবরে গিয়ে ঢোকে। এইসব চায়ের দোকানে একটা কাল্পনিক বিদগ্ধতার ভাব ছিল প্রখর। বড়ো বড়ো লিখিয়েদের নাম শোনা যেত প্রায়শই। তার মধ্যে বিদগ্ধতায় অগ্রণী তরুণ সভাগুলো, সেখানে যোশী, এম. এন. রায়দের উক্তি নিয়ে তক্তপোশ ফাটে। ভাবী সংগ্রামের নীতি ও পথ এবং জার্মান জাতির কখনো রণবল ও ইয়োরোপের ভবিষ্যৎ আলোচনায় কখনো হাতাহাতিরও জোগাড় হত কসমোপলিটান ঘর অভয়দা ও মানিকের দোকানে। তবে তার মধ্যে হঠাৎ হালকা হাওয়ার মতো সলিলদার হাসির কথা ছুটত, বিমলদার রবীন্দ্রগীতির ভান্ডারও ছিল অফুরান। ঠাণ্ডা হতে সময় লাগত না। এই ছোটো শহরে যেমন আট বছরের ছেলেও দল করে, তেমনি কেউ আবার দলাদলিতে নেই। সমস্ত কিছুরই ওপরে আড্ডা আর হো হো করে দিন কাটিয়ে দেবার এমন একটা নেশা ছিল যে, কারুরই নিষ্ঠা সহকারে ঝগড়া করার সময় মিলত না। কম্যুনিস্ট পার্টির যিনি প্রধান দাদা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের ছেলেরাও ঝুলে থাকত। কোনো একটা অন্যায় আচরণের জন্যে আর, এস, পি-র ছেলেকে ডেকে ধমকে দিতেন কংগ্রেসের মুখ্য নেতা। আড্ডার ঘড়ি চলেছে সকাল আটটা থেকে বেলা একটা, তারপর কয়েক ঘণ্টার বিরতি দিয়ে আবার রাত সাড়ে আটটা অবধি। তারও পরে রাত্রির খাওয়া সেরে, বাছাই করা কয়েকটি দলনির্বিশেষে গোষ্ঠী আছে, তাদের আসর জমে নদীর পারে ঘাটলায় ঘাটলায়। কালীবাড়ির ঘাটে আমাদের আসন ছিল নির্দিষ্ট করা। শচীবাবুর বাড়িতে সান্ধ্য আসর জমত সাহিত্য ও সংগীতের। সে বাড়ির মেয়েরা ছিলেন রুচিতা। কলেজ ছুটির অবসরে তাঁদের হত দুষ্প্রাপ্য আবির্ভাব, কিন্তু তবু সুখলভ্য। অনেকদিন আমার পড়ার ঘরটিতে নির্বাচিতদের শুভাগমনে সন্ধ্যা জমে উঠত, বারিবর্ষণ তাকে আরও নিবিড় করত। হয়তো গানের সুর শুনে তেরিবাজারের আড্ডা-শেষের দু-একজন গৃহমুখী পথ ছেড়ে আস্তে এসে আসন নিত। বীরেন্দ্রকিশোরের পৃষ্ঠপোষিত উচ্চাঙ্গের মিউজিক কনফারেন্স ও রবীন্দ্র জয়ন্তী এক দিকে, অন্য দিকে রাজনীতি, অফুরন্ত সময় আর আড্ডা–এই গৌরবে গৌরবান্বিত নেত্রকোণা। এখানকার যুবকেরা বিদ্যার্জনের জন্যে যদি বা যায় বাইরে, বিদ্যাবিক্রয়ের জন্যে নয়। লোকে বলে সকালবেলায় ফেনভাত আর আড্ডার টান,–যাক জগৎ উচ্ছন্নে! থাকুক শুধু এককলি গান, দুটি রাজনীতির কেতাব আর দুর্লভ অমৃতসুধা এককাপ চা।

কিন্তু হঠাৎ একদিন ছেলেরা ইস্কুল যাবার পথ থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এল। দেখতে দেখতে চৌধুরিবাড়ি থেকে সাত পাই পেরিয়ে উকিলপাড়া, মালগুদাম ছাড়িয়ে একদিকে মোক্তারপাড়া, অন্য দিকে নউল্যাপাড়া আর বড়ো পুকুরের পাড়গুলোতে কথাটা ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো। মালগুদামের কুলিরা এল, আই. জি. এন. কোম্পানির মেয়ে-পুরুষ পাটের মুটে, ইস্কুলের ছেলেরা বেরিয়ে পড়ল। মেয়েদের ইস্কুলের বেড়া সরে গেল। ঘরের মেয়েরা পেছনের শানপাতা রাস্তা ছেড়ে সদর রাস্তায় এলেন। অগ্নিশিখার মতো একটি চলমান জনতা এসে থামল থানার বাইরে-ওদের ছাড়তেই হবে। বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন শুরু হল নেত্রকোণা কাঁপিয়ে। কম্যুনিস্ট দাদারা নামলেন না সংগ্রামক্ষেত্রে। তবু যে ঘরের গৃহস্বামীরা গিয়েছেন, সেই ঘরের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁদেরই ঘাড়ে। দেখতে দেখতে পাড়া খালি হয়ে গেল। আদালতের সামনের পিকেটিং পাতলা হল, ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী সব যুবা গেল কারাগারে।

এখন চায়ের দোকান ম্লান। তারপর আবার নেত্রকোণার দিন এসেছিল। হাজংদের পদধ্বনি ভেসে এসেছিল গারো পাহাড়ের সানুদেশ থেকে। কিন্তু বিয়াল্লিশের পাঁচ বছর পর আবার প্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে এল পাহাড়তলির শহর নেত্রকোণায়। নেত্রকোণার জীবনরস শুষে নিল তারই আরাধ্য দেবতা-ব্যভিচারী রাজনীতি।

এখন মাঝে মাঝে বুনো হাঁসের স্বপ্ন দেখি, আকাশ আঁধার-করা মেঘের ছায়া পড়ে মনে। এখনও ঢল নামে মগরায়। টিনের চালে শিশির ঝরে, কাঁঠালপাতা পড়ে টুপটাপ। এখনও এসব শুনি। অভয়দার দোকান, আমতলা–ধবলার পুলের পাড়ের সূর্যাস্ত, গুদারার ঘাটে হাটুরে মানুষের ভিড়। এখনও এসব দেখি। মনের দিগন্তে তারা আছে, দেশের সীমান্তে তারা দুরে।

.

বিন্যাফৈর

জননী আর জন্মভূমি–পৃথিবীর শেষপ্রান্তে বসেও মনে পড়ে, মন ভার হয়ে আসে, প্রাণ বলে যাই-যাই, আর একবার সেই ডোবার জলে ধ্যানী মাছরাঙার ঝাঁপ খাওয়া দেখে আসি।

বাংলাদেশের গ্রাম বলতে শুধু রামধনু রঙের আকাশ, বুনো ঘোড়ার মতো বর্বর বর্ষার নদী, মাঠভরা সবুজ ধানের ঢেউ বোঝায় না–সে-কথা জানার মতো বয়স এখন হয়েছে। অনেক দুঃখ দেখেছি, অনেক কান্না শুনেছি, অনেক মৃত্যু দেখেছি। জানি সেখানে ম্যালেরিয়ার সময় ঠিকমতো কুইনিন মেলে না, সুযোগ বুঝলে মহাজনের গোলায় রাতারাতি চালের বস্তা কাবার হয়ে যায়, ডাকাত পড়লে তোক এগিয়ে আসে না, ভালো একটা ইস্কুল নেই, ঝড়ে ঘরের চালা উড়ে যায়, ঝাঁঝরা টিনের ফাঁক দিয়ে অবিরলধারে বর্ষার জল পড়ে। সবই জানি। মন্বন্তরে আশপাশের কত বাড়ির ভিটে উজাড় হয়ে গেল। ভূতের ভয়ে-ভরা ছেলেবেলা থেকে রোজ রাত্রিতেই ঘুম ভেঙে দুখীরাম দফাদারের বাজখাঁই গলার হাঁক শুনে বুক দুর দুর করে উঠেছে। হাতে টিমটিমে লণ্ঠন, সাপের মতো লিকলিকে সড়কি, দুখীরাম হাঁক দিচ্ছে—’বাবু জাগেন?’ আজও যেন হঠাৎ এক এক রাত্রিতে সেই স্বর শুনতে পাই। গাঁজার টানে ঊর্ধ্বনেত্র হয়ে সন্ধ্যায় গুম হয়ে বারান্দায় বসে থাকত, সময়ে অসময়ে বউটাকে ধরে বেধড়ক পেটাত। নিঃস্ব নিরন্ন সেই ইস্পাতের মতো লোকটাকে পঞ্চাশ সালে খ্যাঁকশিয়ালরা রাতারাতি টেনে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলল। আর আমার মালিবউ মোক্ষদা–অফুরন্ত রূপকথার মায়াপুরী যে খুলে দিয়েছিল–ভাঙা কুঁড়ের নীচে সেকেলে এক নড়বড়ে খাটের তলায় খিদের জ্বালায় ধুঁকতে ধুঁকতে তার প্রাণের ভোমরা চুপ করল। তার গোছাভরা তাগাতাবিজ আর মন্ত্রের শক্তিতে বাঁধা পোষা ভূতের দল বাঁচাতে পারল না তাকে। কলকাতা থেকে সেবার গ্রামে গেলাম। চিরকাল যার বুকেপিঠে মানুষ হয়েছি, নিজে না খেয়ে কলাটা-মুলোটা রেখে দিত আমাদের জন্য সরিয়ে, সেই লোক আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে হাত ধরে কেঁদে বলল-”খোকন, বড়ো দুঃখ। পারিস তো চার আনা পয়সা আমাকে দিয়ে যা।’-এই সবই তো দেখেছি। তবু যেন আর একবার মন বলে যাই-যাই। ঝুমকোলতায় ঢাকা ছ্যাঁচা বাঁশের বেড়ার ধারে সেই শূন্য উঠোনের তুলসীতলায় গিয়ে দাঁড়াই একবার। জননী আর জন্মভূমি–তার চাইতে আপনকরা প্রাণের জিনিস স্বর্গে গেলেও পাব না।

সেই দেশ চিরকালের মতো পর হয়ে গেল? মানচিত্রে একটা রেখার এক টানে নিজের বাড়ি হয়ে গেল বিদেশ?–ভাবতেও পারি না। আমরা রাজ্য চাইনি, রাজত্ব চাইনি, সরকারি খেতাবের গৌরব চাইনি। শিশুকাল থেকে মুসলমান প্রজার দেওয়া সুখ-দুঃখের টাকায় আমরা মানুষ হয়েছি–কিন্তু মনে মনে লজ্জা পেয়েছি সেজন্যে। প্রাণের তেপান্তরের খোঁজে মন্ডল সাহেবের আরবি-ঘোড়ায় চড়ে মাঠের পথে উদ্দাম হয়ে ছুটে বেড়ানোর সুখ এ জীবনে আর কি কখনো হবে?

কত মুখ মনে পড়ে! কচি, কাঁচা, ছেলে, বুড়ো, কার গালে দাড়ি, কার শিরে টিকি; পিঠে জাল কাঁধে লাঙল, মাথায় ঝাঁকা; ছিন্ন লালশাড়ি, গ্রন্থি-দেওয়া আধময়লা থান; কাকা, চাচা, দিদি, বউ-কতরকম সম্পর্ক। দ্যাশে আইলেন?’–একগাল হাসি। কী এক রকম খুশিতে মনটা লাফ দিয়ে উঠত নদীর ঘাটে স্টিমার থেকে নেমেই। মাল আছে না কর্তা? তাইলে ঘোড়া দেই এট্টা। গরম চমচম আছে বাবু, নিয়া যান কিছু। শরীর ভালো আছে ত?’-কে হিন্দু, কে মুসলমান? এরা সবাই আমার আপনজন। তারা আছে, তারা থাকবে। পৃথিবীর কোনো যুদ্ধ, কোনো দাঙ্গা, সে-কথা ভুলিয়ে দিতে পারবে না। তবু যখন দলে দলে নিরাশ্রয়ের দল চিরকালের ভিটে-মাটি ফেলে নিষ্ঠুর প্রবাসের গাঁয়ে প্রাণের মায়ায় ছুটে আসে, অভিমানে মন ভারী হয়ে ওঠে। কিন্তু অভিমান কার ওপর করব? যদি নিশ্চিন্ত মনে সে-কথা জানতুম!

নিজের জন্মভূমি, নিজের গ্রাম যে এত আমাদের প্রিয়, এত গরীয়সী সে কি শুধু অবুঝ মনের ভাবালুতা? সে কী শুধু দশের মুখের শোনা কথা? পৃথিবীর সবচেয়ে হতশ্রী পল্লিতে জন্মের জীর্ণ কুটিরটি নিজের চোখে যে তাজমহলের চেয়েও সুন্দর লাগে-তার মধ্যে ফাঁকি নেই। সেই বাড়িতে একদিন আমি চোখ মেলে অবাক-বিশ্বে প্রথম তাকিয়েছিলাম। বাতাবিলেবু ফুলের ঘ্রাণ চিনতে চিনতে গুনগুন করে মায়ের মুখে সেই বাড়িতে আমার রবীন্দ্রনাথের গান প্রথম শোনা। মালিবউ-এর হাত ধরে শঙ্কিত মনে সেই গ্রামের রাস্তা বেয়ে প্রথম পাঠশালায় যাওয়া। রহস্যে ভরা কলকাতা শহরের প্রথম চিঠি পাওয়া সেই বিন্যাফৈর গ্রামের ডাকপিয়োন আতোয়ার ভাইয়ের হাত থেকে। নদীর পাড়েতে দাঁড়িয়ে ধু-ধু চরের দিকে তাকিয়ে বিরাট বিশ্বের অস্ফুট স্বপ্ন দেখা। এসব কি ভোলা যায়? দু-চোখ ভরে, মন ভরে, হৃদয় ভরে আমার সেই আপন গ্রাম আমাকে অকৃপণভাবে কতই যে দিয়েছে। এই সুয়োরানির দেশ কলকাতা শহরের এত সুখ গলা দিয়ে যেন নামতে চায় না। ধড়ফড় করে এক সময় মন বলে ওঠে, যাই-যাই আমাদের সেই দুয়োরানি দুঃখিনী মায়ের কোলটিতে।

কলকাতা শহর থেকে আড়াইশো মাইল দূরে। ব্রহ্মপুত্রের শাখানদীর শাখানদী ঘুরে ঘুরে এঁকেবেঁকে গেছে। সে বড়ো সহজ ব্যাপার নয়। নদী তো আরও কত দেখলাম, কিন্তু সেরকমটি আর দেখলাম না। ফাল্গুন, চৈত্রে মরুভূমির মতো ধু-ধু করছে বালির চড়া, রোদূরে তাকিয়ে থাকলে মাথা ঝিমিঝিম করে। ওপারে বালির ডাঙা, মুসলমান চাষিদের বাস। কী দুর্দান্ত কষ্ট সহ্য করতে পারে কালো কালো বলিষ্ঠ সেই চাষির দল। তাদের মধ্যে বেঁটেখাটো সর্দার গোছের একটা লোক–”শাহেনশা’ নাম ধারণ করে দোর্দন্ড রাজত্ব চালাচ্ছিল সেই তখনকার ইংরেজ রাজত্বের কালে। প্রকান্ড একটা আস্ত চরের মালিক ছিল সে। রাস্তায় যখন চলত তখন তার সামনে পিছনে থাকত পঁচিশ-ত্রিশটি দেহরক্ষী সর্দার, কোমরে গামছা জড়ানো, মাথায় পাগড়ি, কাঁধে লাঠি। ফি-বছর দু-চারটি করে বিয়ে করত এবং বিয়ে করেই সেই অশিক্ষিত গ্রাম্য চাষির মেয়েদের সে রাইফেল ধরতে শেখাত। তাদের তৈরি করে নিত নিজের মনের মতো করে। কোনো পুলিশ, কোনো আদালতের সে তোয়াক্কা রাখে না। দশটি বছর ছায়ার মতো পিছনে ঘুরেও তার সন্ধান পায়নি সরকারের চরেরা। এই সেদিন শুনলাম পুলিশের শক্ত বেড়াজালে সে আটকা পড়েছে এতকাল পরে–রাইফেলধারী দুজন নতুন বিয়ে-করা স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে। এরা ভয়ংকর, এরা ভীষণ। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ থাকত সাত তল্লাটের লোক। তবু সে স্মৃতি ভালো লাগে।

স্টিমারঘাট থেকে আঁকাবাঁকা পথ–বিধবার সিঁথির মতো ম্লান, ধূসর। তারপরে খেলার মাঠ, তারপরে টিনের আটচালায় গ্রামের ইস্কুল, বাঁধানো-ঘাট পুকুর, কৃষ্ণচূড়ার গাছ, আবার সড়ক, সরু কাঠের পুল, সরষে খেতের ধার দিয়ে ঢুকে আমার গ্রামের গাছের ছায়া। আঃ গ্রীষ্মের বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে সেই ছায়ার শান্তি যেন গলায় গায়ে মাথায় ঝরে ঝরে পড়ে। আর কত পাখি! শহরের লোক চেনে শুধু কাক আর চড়াই। কারও কারও খাঁচায় থাকে শিকল-বাঁধা কোকিল, বিরস সুরে বারোমাসই ডাকে। আর শহরে পাখি আছে আলিপুরের পশুশালায়। কিন্তু পাখি দেখতে, পাখি চিনতে কে বা যায় সেখানে? ওদিকে গ্রামে যখন মনমরা শীতের শেষে একদিন হঠাৎ ঝকঝকে গলায় কোকিল ডেকে ওঠে–আঃ, শত সহস্র প্রাত্যহিক দুঃখে-ভরা পৃথিবী যেন চিৎকার করে ওঠে আনন্দে। গ্রীষ্মের রাতে নির্লজ্জ ‘বউ কথা-কও’ ‘বউ-কথা-কও’ শুনতে শুনতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। সাত সকালেই দোয়েল চুপিচুপি বসে গলা সেধে নিয়ে ফুড়ত করে দিনের কাজে বেরিয়ে পড়ে। ঘুঘু তখন কলমের ডালে বসে রোদকে সাধে—’সুয্যি ঠাকুর ওঠো-ওঠো-ওঠো।’

পূর্ববাংলার কোনো গৌরবই নেই আজ। কিন্তু কোমলে কঠোরে বিচিত্রতায় ভরা তার যে আপনকার রূপটি এই এ-যুগেও আমরা দেখেছি, আর কোথাও তার তুলনা নেই। যদি সম্ভব হত, এখনও যদি সম্ভব হয়, আবার কি তাহলে সেই নিভৃত পল্লিতে ফিরে গিয়ে দিন কাটবে, মন টিকবে? স্বীকার করি–টিকবে না। আরও শিক্ষিত, আমরা শহরের নেশার স্বাদ পেয়েছি। আমাদের জাত গেছে। তাই আমরা আন্তর্জাতিক। কলের জল আর পাউরুটি না হলে আমাদের মুখে রোচে না! বিজলি তারের আলো না জ্বললে আমাদের জীবন অন্ধকার। আমাদের জীবন জটিল হয়েছে। আমাদের প্রয়োজনের সীমা বেড়েছে। তা ছাড়া শহর আমাদের জীবিকা দেয়, শহরের ইস্কুলে আমাদের ছেলেরা পড়ে। পারব না, আবার সেই গ্রামে ফিরে যাওয়ার পথ চিরকালের মতো রুদ্ধ হয়েছে আমাদের জীবনে।

কিন্তু তাতে কী? সে যে আমার নিজের বাড়ি, নিজের ঘর! তারা যে আমার নিজের লোক। জীবিকার ধাঁধায়, জীবনের জটিল পাকে যতই আমরা ঘুরি না কেন, এক সময় তো ইচ্ছে করে ফিরে যাই মিটমিটে প্রদীপ জ্বালানো আপন বাড়ির ঘরটিতে! সেই আমার স্বপ্নে ভরা ছেলেবেলার দেশ। বোমায়, আগুনে, কামানে, বারুদে, যুদ্ধে, দাঙ্গায় পৃথিবীর অর্ধেক যদি ছারখারও হয়, তবু সেখানে থাকবে চুল-এলানো বাঁশবনের লুটোপুটি হাওয়া, কোজাগরী পূর্ণিমার মধুর রাত। টিনের আটচালায় সরসর করে পাতা ঝরবে। হিজলের ফুল ভাসবে পচা ডোবার জলে। সেই রবিবারে হাট বসবে। পাঠশালার বুড়ো মৌলবি সাহেব ওপারের চরের থেকে বেগুন-মুলো বেচতে আসবেন এ পারের গ্রামের বাজারে। কৃষ্ণের জীব বেতো ঘোড়ার পেটে-পিঠে তিনমন বোঝা দিয়ে গঞ্জের হাটে যাবে গাঁয়ের ব্যাপারীরা! বর্ষায় খেত ডুববে, ঝড়ে ভাঙা গাছের ডালে পথ বন্ধ হবে। কেউ তাকিয়ে দেখবে না, তবু সময় এলেই পুকুরের ধারে পলাশের ডাল লাল হয়ে উঠবে। বাবুই পাখিরা দোল খাবে নিপুণ ঠোঁটে-বোনা তাদের তালের পাতার দোলনায়। কিন্তু তারা কোথায়? যারা একদিন এপাড়া ওপড়ায় সাতপুরুষের ভিটে আঁকড়ে পড়েছিল? সেই দলাদলি, নিন্দা, ঈর্ষা, মন্দ আর অফুরন্ত ভাললাতে ভরা তারা

কোথায়?

সময় অস্থির, জীবন অস্থির। যারা গেছে তাদের আর এ জীবনে খুঁজে পাওয়ার সময় হবে না।

.

কমলপুর

আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনাদের সাধারণতন্ত্রের পুরোপুরি নাগরিকও নই। কারণ, নাগরিক-গৌরবের অধিকারী হবার পূর্ণ যোগ্যতা নেই বলেই হয়তো চিনবেন না আমাকে, অন্তত চেনবার মতো সময়, সুযোগ ও প্রয়োজনবোধও নেই হয়তো আপনার। কিন্তু আপনি আমাকে দেখেছেন, শুধু আমাকে নয়, আমার মতো হাজার হাজার গৃহহীন উদবাস্তু ছন্নছাড়াদের কলকাতায় ও তার আশপাশের শরণার্থী শিবিরে কিংবা ভাঙা বস্তির অন্ধ কুটিরে; না দেখলেও কাগজে নিশ্চয় পড়েছেন তাদের খবর।

কলকাতার সঙ্গে নাড়ির যোগ নেই আমার, আছে প্রয়োজনের। বিপর্যয়ের পসরা মাথায় বহন করে যেদিন এসেছিলাম কলকাতায়, তখন এই মহানগরী নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যে আমায় ঠেলে বের করে দিতে চেয়েছিল তার আঙিনা থেকে। দাবি তো আমার বেশি কিছু ছিল না। আট নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িটাও আমি চাইনি, কিংবা পারমিটের জন্যে আবেদন নিবেদনও করিনি রাজ্যসচিবদের কাছে। চেয়েছিলাম একটু মাথা গোঁজবার জায়গা আর সাধারণ সুস্থ নাগরিকের মতো খেয়ে-পরে থাকবার অধিকার। কলকাতায় ধনভান্ডার দিন দিন স্ফীতকায় হয়ে উঠছে ক্লাইভ স্ট্রিট বড়োবাজারের হর্ম্যাভ্যন্তরে। সে ভান্ডারের অংশীদার হতে তো চাইনি আমি। আমি চেয়েছিলাম নেহাৎ জীবনধারণের মতো আয়, কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিনিময়ে। নিষ্ঠুর নগর-লক্ষ্মী রূঢ়ভাবে প্রত্যাখান করেছে আমায় বারবার। তবুও নিরাশ হইনি আমি! জীবিকার জন্যে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম কলকাতাকে। সে আমাকে হারাতে পারেনি। তাই আজও বেঁচে আছি আপনাদের শোনাব বলে আমার ফেলে-আসা জীবনের ইতিহাস, যা জড়িত হয়ে আছে আমার সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে-আসা গ্রামের সঙ্গে।

।মেঘনার কোলঘেঁষা পূর্ববাংলার একটি গ্রাম। পৃথিবীতে প্রথম যে আকাশের নীল আর সূর্যের আলো এসে লেগেছিল আমার চোখে, সেটি সেই গ্রামের। স্বপ্নের মতো লাগত গ্রামের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি মাঠ, প্রতিটি পুকুরের চারধারের প্রকৃতির পরিবেশকে। পশ্চিমবাংলার অনেক গ্রাম দেখেছি। কিন্তু পূর্ববাংলার গ্রামের মতো সবুজ স্নিগ্ধ মাটির স্পর্শ কোথাও পাইনি। যে গ্রামে জন্মেছিলাম, তার আয়তন ক্ষুদ্র, জনবল নগণ্য। হয়তো পাঁচ হাজারের বেশি হবে না। নগণ্য বললাম এইজন্যে যে, পূর্ববাংলার যেকোনো গ্রামে দশ হাজার লোকের বসবাস অত্যন্ত স্বাভাবিক। গ্রাম থেকে একমাইল দূরে উদ্দাম স্রোতোধারায় বয়ে চলেছে দূরন্ত মেঘনা। কালো মেঘের ছায়া বুকে নিয়ে ভরা বর্ষায় সে কী দুর্দাম, দুর্বার তার গতি! একবার মনে আছে ছোটোবেলায় পাড়ি দিয়েছিলাম মেঘনা, ছোট্ট নৌকা করে। ঢেউয়ের ঝাঁপটা লেগে নৌকা প্রায় তলিয়ে যায়। আমার কিশোর মন সেদিন ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেঘনা নদীর মুসলমান মাঝি ঢেউকে ভয় পায় না। দরিয়ার পিরের দোহাই দিয়ে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিয়েছিল সে আমাকে নদীর ওপারে। বিদ্রোহী মেঘনার সেদিনের রূপটি মনের স্লেটে খোদাই করা আছে আজও। সেই মেঘনার স্মৃতি নিয়ে সুবর্ণরেখা, অজয় কিংবা কোপাই নদী দেখলে মনে হয়, এগুলো নদী নয়, নদীর ছায়ারূপ।

যে গ্রামে জন্ম, সেখানে সব সময় থাকতাম না আমি। মাইল ষোলো দূরের একটা আধা শহর বৃহত্তর গ্রামের ইস্কুলে পড়তাম আমি আমার মা-বাবার সঙ্গে থেকে। ছুটিতে চলে আসতাম বাড়িতে। রেলস্টেশন ছিল একমাইল দূরে। পরে অবশ্য গ্রামের মধ্যে স্টেশনটি স্থানান্তরিত হয়ে এসেছিল রেল কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনে। স্টেশন থেকে হেঁটে গ্রামমুখো আসবার সময়টা যেন আর কাটতে চাইত না। কতক্ষণে সুপুরি গাছের সারের তলা দিয়ে বাঁকা পথটি ধরে বাড়ির উঠোনে এসে হাঁক দেব ঠাকুরমাকে, সেজন্যে মনটা উন্মুখ হয়ে থাকত। গ্রীষ্মের ছুটিটাকে আমরা বলতাম আম-কাঁঠালের ছুটি। কাঁচা আমের গন্ধে তখন গ্রামের আকাশ ভরপুর। কিছুদিন পরেই রং ধরতে শুরু করবে গাছগুলোতে। ঘুঘু-ডাকা এক-একটা দুপুর। কত দুরন্ত মধ্যাহ্ন কাটিয়েছি কাঁচামিঠে আমগাছের ওপরে, সেগুলো আজ স্মৃতিমাত্র। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা সামনের ধানখেতের উদার বিস্তারকে মনে হত রাত্রিবেলা ঠাকুরমার কাছে শোনা রূপকথার সেই তেপান্তরের মাঠের মতো। কতদিন যে আশা করেছি, দেখা হয়ে যাবে নীল ঘোড়ায়-চড়া রাজপুত্রের সঙ্গে!

স্নান করতে যেতাম দক্ষিণের বিলে কিংবা কোনো কোনোদিন পঞ্চবটির ঘাটে। ঘাটটিতে পাঁচটি বটগাছ ছিল বলেই নামকরণের এত ঘটা। গ্রীষ্মের শেষে বিল যেত শুকিয়ে, তবু সেই কাদাভরা বিলের জলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। শালুক আর পদ্মলতার অরণ্য ছিল বিলটিতে। সাঁতার কাটতে গিয়ে অনেকবার লতায় জড়িয়ে যেত পা। তবু আমাদের দুরন্তপনার শেষ ছিল না। গ্রামটি ক্ষুদ্রায়তন হলেও এর মধ্যেই নানা পল্লিতে ভাগ করা ছিল তার অধিবাসীদের বাসস্থান। পূর্বদিকে ছিল আচার্যপাড়া, দক্ষিণে ছিল জেলেপাড়া, উত্তরে তাঁতিদের বাসস্থান, তারই পাশে ছিল মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের বাড়ি, পশ্চিমে ছিল মুসলমান চাষিদের পাড়া। প্রতিসন্ধ্যায় এক-একটা পাড়ার এক-একটা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ত। জেলেদের ঘরে জন্মেছিলেন বৃন্দাবন। আমরা তাঁকে দাদা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন কবিয়াল। তারাশঙ্কর বাবুর কবি’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা সেই কবির জীবনীটি মনে করে দেখুন। এ কবিকে আমি চোখে দেখেছি। তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছিল আমার কিশোর মন। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব।

দোল-উৎসবে, ঝুলনযাত্রায় আমরা বহুবার বৃন্দাবনের কণ্ঠে কবিগান শুনেছি। বাংলার লুপ্তপ্রায় কবি-সংস্কৃতির শেষপর্যায়টুকু আমরা শুনেছিলাম তাঁর গানে। তিনি আজ নেই। তাঁর গানের স্মৃতি বেঁচে আছে। দুর্গাপুজোর উৎসবের স্মৃতি আজও অমলিন। বারোয়ারি পুজোয় চাঁপার ডালে ভিড় করত এসে দোয়েল। দুর্গা পুজোর সে কী উদ্যম আর উদ্যোগ। বর্ষ পরিক্রমা করে আশ্বিনের এই দিনগুলোর জন্যে, উৎসব-বিলাসী গ্রামের ধনী-নির্ধন অধিবাসীরা প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকত। শরতের সোনালি আঁচল ছড়িয়ে পড়ত আকাশের গায়। পেঁজা তুলোর মতো নির্জলা মেঘের দল উধাও হয়ে যেত মেঘনার দু-তীরের আকাশে। নদীর চরে একরাশ সাদা কাশবনের ভেতর যেন হারিয়ে যেত মন। রাস্তার দু-ধারে অযত্ন-বর্ধিত কেয়া আর জুইফুলের ঝোপে মন-পাগলকরা গন্ধ ছড়িয়ে থাকত। শিবতলার মন্দিরের গা বেয়ে যে মাধবীলতার মালঞ্চ নুয়ে পড়েছিল মাটিতে তার সৌরভ পথ-চলা হাটুরে লোকদের মনকেও দিত ভরিয়ে। গ্রামের বাড়িতে বারোমাসে তেরো পার্বণের প্রথা প্রচলিত পূর্ববাংলার সবখানেই। সেই উৎসবের আনন্দ শুধুমাত্র হিন্দুদের ছিল না, আমাদের মুসলমান প্রতিবেশীদেরও ভাগ নিতে দেখেছি তাতে সমানভাবে। দুর্গাপুজো কিংবা লক্ষ্মীপুজোর সময়ে মুসলমান ভাইবোনদের জন্যে খাবার আলাদা করে রাখত গৃহকর্তারা। আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের খেত-জমিগুলো ভাগে চাষ করত মুসলমান কৃষকেরা। তাদের বলা হত বর্গাদার। কয়েকজন বর্গাদার কৃষকের নাম আজও মনে আছে আমার। সুন্দর আলি, রহিমউদ্দিন, সুকুর, মামুদ। এরা সবাই আমাদের বাড়িতে আসত। পরমসম্প্রীতি আর প্রতিবেশিত্বের মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ওদের সঙ্গে। আমার ঠাকুরমা ওদের ভালোবাসতেন ছেলের মতো। কোনোদিন ভাবিনি এমনি করে তাদের ছেড়ে চলে আসতে হবে অভাবনীয় ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে।

গ্রামের বাজার ছিল একমাইল দূরে। মেঘনার তীরে সেই বাজারটি পূর্ববাংলার অন্যতম বৃহৎ ব্যবসায়স্থল ও বন্দর। স্থানীয় অধিবাসীদের চেষ্টায় সেখানে স্কুল ও কলেজ দুই-ই স্থাপিত হয়েছে। আজ জানি না সেখানে শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্তরসাধক কারা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে জাপানি-অভিযানের আশঙ্কা ছিল পূর্ববাংলার প্রান্ত দিয়ে। চট্টগ্রামে প্রতিরোধের আয়োজন করেছিল সাউথ-ইস্ট এশিয়া কমাণ্ডের সৈন্যদল। রণসম্ভার ও সৈন্যবাহিনী চলাচলের জন্যে আমাদের গ্রামের স্টেশনটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। বিশেষ করে মেঘনার ওপরে যে সেতুটি আছে তা রক্ষা করবার জন্যে বিমানবিধ্বংসী কামানও সজ্জিত করে রাখা হয়েছিল সেখানে। সেই রণসজ্জার পাশে গ্রামটির নিরাভরণ শান্তশ্রী কী অপূর্বই না লাগত! নির্মেঘ আকাশে তখন সন্ধানী বিমানের আনাগোনা থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে যেত গ্রামের মাটিকে, তার ভাঙা শিবমন্দির আর পঞ্চবটির ঘাটকে।

যুদ্ধের সমাপ্তিতে সে কাঁপনের অবসান ঘটল। আবার বারোয়ারিতলায় দুর্গাপুজোর উৎসবে বসল যাত্রার আসর। স্তব্ধ-কুতূহলী শ্রোতাদের চোখেমুখে তখন নিমাই সন্ন্যাসের করুণতার ছায়া এসে নেমেছে। ছলছল করছে সহস্র জোড়া চক্ষু। তাকিয়ে দেখলাম, কোণে-বসা। রহিমউদ্দিনের চোখেও জল। নিমাই সেদিন জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলকে কাঁদিয়ে দিয়েছিল।

এই ছিল গ্রামের স্বরূপ। এ গ্রামকে ভালোবেসেছি। তার সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি, অজ্ঞতা, কুসংস্কার নিয়েই ভালোবেসেছি। নিরক্ষর কৃষক, তন্তুবায় প্রভৃতি যেমন ছিল সেখানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্তদের সংখ্যাও কম ছিল না। আলো আর অন্ধকার পাশাপাশি হয়েই বাস করছিল সে গ্রামে। কে জানত অকস্মাৎ কালবৈশাখীর ঝড় এমনি করে আলোকে নিভিয়ে দিয়ে নিরন্ধ্র অন্ধকারের কালিমা ছড়িয়ে দেবে সারাআকাশময়। সেই অন্ধকার আকাশের নীচে দুঃস্বপ্নের মতো পড়ে আছে আমার ছেড়ে-আসা গ্রাম, ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণ প্রান্তে মেঘনা নদীর তীরবর্তী সোনার কমলপুর। তার এক মাইল দূরে ভৈরববাজার আর ষোলো মাইল দূরে আধা-শহর বাজিতপুর। হায় রে জন্মদুঃখিনী দেশ, শিশু-ভোলানো প্রবোধ দিয়ে সেদিন তোমাকে ছেড়ে চলে এলাম কলকাতার ফুটপাথকে আশ্রয় করে। কে জানে তোমার আকাশে এখনও চাঁদ আর তারা হাসছে কি না, কে জানে মেঘনার দোলনে কাঁপছে কি না তোমার ঝুমকোলতার দুল আর দোলনচাঁপার কণ্ঠহার।

স্টেশন থেকে বাড়ি আসবার পথে কতজন কুশল প্রশ্ন করত। আর আজ আমি হারিয়ে গেছি কলকাতার জনারণ্যে, হারিয়ে গেছি সুরেন ব্যানার্জি রোডের আস্তানায়। এখানে আমায় কেউ চেনে না, কেউ শুধোয় না–হে বন্ধু, আছ তত ভালো? আমি তো এখানকার অধিবাসী নই, আমি যে শরণার্থী, উদবাস্তু।

.

খালিয়াজুরি

গ্রামহৃদয়া বাংলাদেশ। এ দেশের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার মতো লক্ষজনের আশৈশবের স্মৃতি। এর প্রতিটি ধূলিকণা, এর আকাশের রংফেরা, এর নদী-কল্লোলের পরিচিত সুর একান্ত করে ভালোবেসেছি, ভালোবেসে ধন্য হয়েছি। কতদিন মনে হয়েছে এ দেশের মাটি শুধু মাটি নয়, মায়ের মতোই এ মাটি স্নেহ-স্নিগ্ধ।

এ মাটির স্নেহ-দাক্ষিণ্যে প্রতিপালিত আমার সাতপুরুষ, হয়তো এই মাটিকেই আপন করে নিত আমাদের অনাগত উত্তর-পুরুষেরাও। কিন্তু আজ সে আশা স্বপ্ন বলেই মনে হয়। আমার জননী, আমার জন্মভূমি থেকে আজ আমি বিচ্ছিন্ন। আমি আজ প্রবাসী। কিন্তু দূরান্তরে থেকেও তো সে মাটির স্মৃতিকে ‘বিস্মৃতির মুক্তিপথ দিয়ে বিদায় করে দিতে পারছি না। গভীর রাত্রে যেমন করে ‘নিশি ডাকে’ বলে লোকপ্রসিদ্ধি আছে, তেমনি করে এই বিভুই-বিদেশে দেশের মাটি আমাকে নিশির ডাকের মতোই প্রতিদিন আকুল সুরে ডেকে বলছে, ওরে আয়, আয়, আয়।

গ্রামটি নেহাতই ছোটো। আকারে আয়তনে ছোটো হলেও শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে, যশে গৌরবে, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে পূর্ব-ময়মনসিংহের এই গ্রামটি কিন্তু কোনোক্রমেই নগণ্য নয়।

কবে যে এখানে বাসস্থান গড়ে উঠেছিল তার সঠিক স্মৃতি বা ইতিবৃত্ত নেই। পন্ডিতেরাও এর সাল-তারিখ নিয়ে কোনোদিন তর্ক করেন না। যেটুকু শ্রুতি আছে তাও ক্রমে লোপ পেতে বসেছে। কারণ বহুপুরুষ অতিক্রম করে এসে তার প্রতি আমাদের ঔৎসুক্য কমে আসছে। কিংবদন্তি মতে মোগল রাজত্বের শেষের দিকে দক্ষিণ রাঢ় থেকে দুই ভাই পশুপতি ঠাকুর ও গণপতি ঠাকুর নিজেদের স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা বজায় রাখবার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে রণে ভঙ্গ দিয়ে জলপথে পলায়ন করে এসেছিলেন। বহুদেশ অতিক্রম করে প্রথমে খালিয়াজুরি গ্রামে তাঁরা বাসস্থান নির্মাণ করেন। এই স্থানটি জনবিরল এবং বর্ষায় একটি ছোটো দ্বীপের আকার ধারণ করে বলেই হয়তো তাঁরা এ স্থানটিকে নিরাপদ বলে মনে করেছিলেন। হয়তো বা বাসস্থানের পক্ষে যথেষ্ট মনে না হওয়ায় কিছুকাল মধ্যেই গণপতি ঠাকুর নতুন বাস্তুর সন্ধানে নির্গত হয়ে পাশের গ্রামে এসে আস্তানা গাড়েন। আর পশুপতি খালিয়াজুরিতেই থেকে গেলেন।

এই বাসস্থান নির্বাচনের মূলে নিরাপত্তার প্রশ্নটা যেমন ছিল, তেমনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাচুর্যের আবেদনও যে ছিল, একথা অনুমান করা যেতে পারে। একদিকে কলস্বনা নদী বেত্রবতী, চলতি কথায় যাকে বলে বেতাই’–অপরদিকে বিস্তীর্ণ জলরাশি, মাঝখান দিয়ে সুপরিসর নদীতটরেখা–বাসস্থানের যোগ্য স্থানই বটে। নদীকে পেছনদিকে ফেলে বাড়ি নির্মিত হল–সম্মুখের অঞ্চল জুড়ে আয়োজন হল আবাদের। তারই শেষ প্রান্ত থেকে বিস্তীর্ণ বিলের অপর তীরে সুর্যোদয় এক লোভনীয় প্রাকৃতিক পটভূমি সৃষ্টি করে। নদীর পশ্চিম তীরটি অপেক্ষাকৃত ঢালু এবং বনজঙ্গলময়। কিছুদূরে কয়েক ঘর হদির বাস। হদি’রা এখন আর নেই, কবে কোন অতীতে যে তাদের বাসস্থান শূন্য হয়ে গেছে তার ইতিহাসও কেউ বলতে পারে না। তবে ক্রমে এই গণপতি ঠাকুরের বংশধরেরাই নদীর পশ্চিম তীরেও বসবাস আরম্ভ করেছিল এবং বিরাট জনপদ গড়ে তুলেছিল। কালক্রমে শুধু আদি বাড়িটাই পূর্বতীরে থেকে যায়, আর সবাই পশ্চিম তীরেই পল্লি গড়ে তোলে। এর মাইল দুই দূরেই ‘রোয়াইল বাড়ি’র ভগ্নাবশেষ আজও বিদ্যমান। বিরাট রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ–চতুর্দিকের পরিখা আজও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। বহুভগ্ন বা ভূগর্ভনিমজ্জিত অট্টালিকা আজও পূর্ব পরিচয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে। সিংহদ্বারের দু-পাশে দুটি বিরাট দীঘি। এটি ছাড়াও অন্দরমহলের সংলগ্ন তিনটি পুকুর এবং দু-তিনটি স্ফটিকস্তম্ভও দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় অর্ধমাইল পরিবৃত স্থান ইষ্টক-সমাকীর্ণ। কোনো কোনো ইটের গায়ে ফুল লতাপাতা খোদিত। কোনো কোনো ইট আবার চিনামাটির মতো একপ্রকার জিনিস দিয়ে তৈরি এবং তাতেও অপূর্ব শিল্পকলার নিদর্শন বর্তমান।

কিংবদন্তি মতে বিশ্বকর্মা স্বয়ং ছদ্মবেশে এই বাড়িটি গড়ে তুলছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যাওয়ায় লাফ দিয়ে প্রাসাদ-শীর্ষ থেকে নীচে নেমে আসেন। সেই সময়েই নাকি বাড়িটি ভূতলে প্রবেশ করে। যে স্থানটিতে বিশ্বকর্মা পড়েছিলেন বলে প্রবাদ, সে স্থানটি একটি ছোটোখাটো জলাভূমিতে পরিণত হয়ে আছে এবং চলতি কথায় তাকে বলা হয় ‘কোর’।

অতীতের কথা থাক। সে দিনকাল তো অনেক আগেই গিয়েছে। কোনো এক ভূমিকম্পের পর থেকেই নাকি বেতাই নদীরও অন্তিম দশা দেখা দিয়েছে। যে ব্রহ্মপুত্র থেকে বেতাই নদীর উৎপত্তি, এখানে তার মতোই এই নদীটিও আজ একটি মরা নদী।

পাকিস্তানের বিপাকে পড়ে মুমূর্য গ্রামটিরও আজ অন্তিম অবস্থা। তবু তার কথা বলতে পারছি না। এই গ্রামখানিই যেন আমার সমস্ত সত্তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। বিষয় সম্পত্তির প্রলোভন বা তার ক্ষতির বেদনায় নয়–যে আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছি, যে মধুর পরিবেশের মধ্যে আমার বিকাশ হয়েছে, তার মাধুর্যময় স্মৃতিটুকুই সে মাটির দিকে মনকে টেনে নেয়। বেতাইকে স্মরণ করে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে কিংবা গ্রামখানিকে স্মরণ করে ‘মোদের পিতৃ-পিতামহের চরণধূলি কোথায় রে’ বলতে যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি। মরা নদীর তেমন কোনো আকর্ষণ নেই–বৎসরের বেশির ভাগ সময়ই সে তার স্থির জলরাশি নিয়ে অসাড় হয়ে পড়ে থাকে। বৈশাখ মাসে অনেকটা তো শুকিয়েই যায়। তবে বর্ষায় আবার যৌবন-জোয়ার দেখা দেয়–দেখা দেয় নিস্তরঙ্গ জলরাশিতে স্রোতের প্রবল বেগ। কূল ছাপিয়ে জল বয়ে যায় ধানের খেতে খেতে। কচি ধানের পাতাগুলো যখন সোনালি রোদ্দুরে বাতাসে বাতাসে ঢেউ খেলে যায় তখন কতদিন আপন মনে আবৃত্তি করেছি–এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।

নদীর তীরে হাট, তার পিছনে একটি পুকুর, তার উলটো দিক থেকেই গ্রামের আরম্ভ। একটি বটগাছ কোন অতীতকাল থেকে যে পারঘাটায় হাট-যাত্রীদের বিশ্রামের আয়োজন করে বসে আছে তা কেউ বলতে পারে না। এই বটবৃক্ষের নীচেই বর্ষাকালে ব্যাপারীদের নৌকাও এসে লাগে। গ্রামে সাড়া পড়ে যায়, চাঞ্চল্যের মরসুম পড়ে যায় পাট-ধান-মশলা ইত্যাদি বেচাকেনার। দূরদেশ থেকে আত্মীয়স্বজনের নৌকাও এসে লাগে। ছোটো ছেলের দল তামাশা দেখতে জড়ো হয়–যুবকের দল নিজেরা নৌকা চালিয়ে বেরিয়ে পড়ে আনন্দে। ছোটোবেলায় কতদিন যে নিজেরাও এমনি করে নৌকা নিয়ে মাতামাতি করেছি তার স্মৃতি মন থেকে এখনও মুছে যায়নি।

দীর্ঘকাল হিন্দু-মুসলমান সম্মিলিতভাবেই পাশাপাশি বসবাস করে আসছে এই গ্রামে। তাদের পরস্পরের মধ্যে একটা প্রীতির ভাবের আদান-প্রদান ছিল। খেলাধুলায়, ষাঁড়ের লড়াইয়ে, গানে-বাজনায় সকলে একসঙ্গে আনন্দ করেছে–কোনোদিন ধর্মের গোঁড়ামি কাউকে পেয়ে বসেনি। একবার গ্রামে দাঙ্গার সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দু-মুসলমান মিলিত হয়ে ভ্রাতৃবিরোধ রোধ করেছিল। সে-কথা আজ বারবার মনে পড়ছে।

স্মৃতির প্রেক্ষাপটে অতীত আজ মুখর হয়ে উঠছে। অনেক ভুলে-যাওয়া পরিচিত মানুষকে ফিরে পাচ্ছি। মনে পড়ছে সহরালি মাতব্বরের কথা–এই দীর্ঘাবয়ব, লম্বা ও পাকা চুল-দাড়ি; লোকটির চেহারায় যেমনি একটা সৌষ্ঠব ছিল, তেমনি ছিল ব্যক্তিত্বের ছাপ। তার অমায়িক প্রকৃতি, তার বিনম্র ব্যবহার, তার সুমিষ্ট সদালাপ ভুলে যাবার নয়। মনে পড়ে মনোহর ব্যাপারীর কথা। লাঠিখেলায় সে ছিল ওস্তাদ এবং সাহসও ছিল প্রচুর। সর্বদাই একটি দীর্ঘ লাঠি হাতে নিয়ে চলাফেরা করত এই লোকটি এবং যৌবনের দুঃসাহসিক কাহিনি অভিনব ভঙ্গি সহকারে শুনিয়ে আসর মশগুল করে তুলত। তারপর মনে পড়ে আলম মুনশির কথা। মুনশি হিসেবে এ অঞ্চলে বহুদূর পর্যন্ত তার একটা প্রভাব গড়ে উঠেছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই তা গড়ে উঠেছিল তার চরিত্রমাধুর্যে। আজ এরা কেউ আর জীবিত নেই। এদের উত্তরাধিকারীরাও সেসব সদগুণাবলির উত্তরাধিকার পায়নি কেউ। তা যদি পেত তবে এত সহজে গ্রামের এত পরিবর্তন হতে পারত না। মুনশির ভাইপো মুনশি হয়েছে বটে, কিন্তু এই জামু মুনশি তার চাচার ঠিক বিপরীত। তাকে লোকে সমীহ করে–শ্রদ্ধায় নয়, অন্তরের টানেও নয়–অনেকটা শনির সিন্নি-দেওয়া গোছের ব্যাপার। জামু মুনশিই এ অঞ্চলে লিগের পান্ডা, ইসলামের ধ্বজাবাহক এবং সাম্প্রতিক উস্কানির উৎস। সে কি যেমন তেমন মুনশি? গোটা পাঁচ-ছয় নিকে সে করেছে এবং তার চাচিকেও সে বাদ দেয়নি।

অবিনাশদারও সেদিন আর নেই। তিনি লাঠি হাতে নিলে একাই ছিলেন এক-শো। এত বড়ো শক্তিশালী পুরুষ এ অঞ্চলে আর ছিল না–এখন বৃদ্ধ স্থবির। আর সেই প্রসন্ন চক্রবর্তীর কথা। হাস্য-পরিহাসের জন্যে তিনি সকলের ছিলেন ঠাকুরদা। তাঁর বিরাট দাড়ি দেখে আমরা তাকে ডাকতাম ‘পশম ঠাকুরদা বলে। তারপর মনে পড়ে উল্লাস পন্ডিতের কথা। এই উল্লাস জাতিতে রজক দাস–লেখাপড়ার কোনো ধারই সে ধারেনি, নামটি পর্যন্ত সে লিখতে জানে না। তবুও সে পন্ডিত। লোকটির উপস্থিত বুদ্ধি ও হাস্যরস পরিবেশনের শক্তি অসাধারণ! যে কোনো স্থানে সে আসর জমিয়ে তুলতে পারে। তাকে ছাড়া কোনো গানের আসর জমে না। একদিন জিজ্ঞেস করলাম-‘কী রে উল্লাস, তুই লেখাপড়া জানিস না তো পন্ডিত হলি কি করে?’ সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল—’বাবু! আমি কি লেখাপড়ার পন্ডিত? আমি কথার পন্ডিত, হাসি-তামাশার পন্ডিত।’

প্রায় রোজ রাত্রেই বাউল গানের আসর বসত আমাদেরই বাড়িতে। এতে হিন্দু-মুসলমান সকলেই যোগ দিত। বঙ্গ-বিভাগের কিছুকাল পরেও চলেছিল এই আসর। গ্রাম্য জীবনের সেই বিমল আনন্দময় মুহূর্তগুলো আজ দুঃখের সঙ্গে মনে পড়ে। মনে পড়ে সকাল-বিকালের গল্পের আসরে তারাসুন্দরদার পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা, হুঁকো হাতে বিরাট গোঁফে চাড়া দিয়ে দ্বিজেন ডাক্তারের গল্প বলার অভিনব ভঙ্গি। তাস-পাশা-দাবার আসর–খেলাধুলার বৈকালিক আনন্দোৎসব, সেসব কি আর মন থেকে মুছে যেতে পারে?। আর সেই সঙ্গে মনে পড়ে ছিপ হাতে করে দল বেঁধে বঁড়শিতে মাছ ধরার অভিযানের কথা। ছোটোবেলায় আমরাও গিয়েছি বহুদিন। একালেও ছেলেরা যেত সেই বেতাই নদীতে, গাঁয়ের এ-পুকুর সে-পুকুরে বা ‘বগাউড়া’ বিলে কিংবা জোঁকার হাওরে। এই বগাউড়া বিলের সঙ্গে রায়বংশের একটি কিংবদন্তি জড়িত। বাড়ির ঠিক পিছনের সীমানা থেকেই এ বিল আরম্ভ হয়েছে বলা চলে। অতীতে এই বংশের লোকেরা নাকি অতিকায় ছিলেন–এত বিরাট বলিষ্ঠ চেহারা এ অঞ্চলে নাকি আর ছিল না। কয়েক পুরুষ পূর্বে মুকুন্দ রায়ের সুপ্রশস্ত বক্ষপটের মাপে একখানা ‘পদ্মপুরাণ’ পুস্তকের মলাট তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় পৌনে একহাত লম্বা এই মলাটখানি এখনও তাঁর বিরাট চেহারার সাক্ষ্যস্বরূপ বিদ্যমান। মধ্যাহ্নভোজনের পর রায়েদের সেঁকুরের শব্দে বিশ্রামরত বকগুলো নাকি বিল থেকে যেত উড়ে এবং তাই থেকেই নাকি এর নাম হয়েছে বগাউড়া (বগা = বক) বিল। আর জোঁকার হাওর-বৈশিষ্ট্যে এ বিল বোধ হয় বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। এ বিলে অসংখ্য জোঁক সর্বদা কিলবিল করে বেড়ায়-বর্ষায় নতুন জল যখন আসে তখন সেখানে পা দিলে একমিনিটেই জলের নীচের সমস্ত অংশটি জোঁকে ভরে যায়। এই জোঁকের জন্যেই বোধ হয় এরূপ নামকরণ হয়ে থাকবে এ জলাশয়ের। কিন্তু আসল বৈশিষ্ট্য এর মাটিতে। এত এঁটেল মাটি অন্য কোনো স্থানে পাওয়া দুষ্কর। বর্ষায় এ মাটি পায়ে এমনভাবে জড়িয়ে যাবে যে, সহজে ধুয়ে তোলা যায় না। গ্রীষ্মে পাথরের মতো শক্ত, কোদাল দিয়ে কাটা যায় না। বজ্ৰাদপি কঠোরানি মৃদুনি কুসুমাদপি’ কথাটা যদি মাটির বেলায় প্রয়োগ করা যায়, তাহলে এই জোঁকার হাওর সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা চলে। গ্রীষ্মকালে সমস্ত বিলটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তখন এর মাটি কাটার মজুরও পাওয়া যায় না! মজুররা বলে জীবনে তারা এমন মাটি দেখেনি। ফাটলের ভেতর কোদাল চালিয়ে পাথরের টুকরোর মতো এক-একটি টুকরো বার করতে হয়। এ সবই এখনও তেমনি আছে, শুধু নেই আমরা।

.

বারোঘর

বহুদুঃখের মধ্যেও স্মৃতিঘেরা অতীতকে মনে পড়ে। বিগত দিনের সুখ, আনন্দ উৎসব আজ লাঞ্ছিত জীবনেও কেন মাথা ছুঁড়ে বড়ো হয়ে দেখা দিচ্ছে জানি না। কলকাতা মহানগরীর প্রাসাদের দিকে তাকিয়ে কেন যেন কেবলই আমার গ্রামের চাষিদের ছোটো ছোটো শান্তিনীড় খড়ের ঘরের ছবিই ভেসে উঠছে বারবার। সেই খাল, কে কবে কেটেছিল জানি না, কিন্তু বর্ষার নতুন জলে খালের প্রাণে যে জোয়ার জাগত আজও তা স্পষ্ট মনে রয়েছে। নতুন বর্ষার জলনিকাশের খাল দিয়ে যে দেশের মধ্যে রাজনৈতিক কুমির এসে মানুষকে ঘরছাড়া করবে তা আগে কে ভাবতে পেরেছে! স্বস্তিতে ভরা আমাদের জীবনের দিনগুলোকে এমনভাবে এলোমেলো করে দিয়ে কোন মহাপ্রভু কতটুকু বাজি জিতলেন তার হিসেব আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষরা পাব না। তবে আমাদের রক্তে জয়তিলক কেটে আজ অনেকেই স্ফীত হয়ে উঠেছে তা চোখের সামনেই দেখছি। কিন্তু গরিব হিন্দু বা মুসলমান কতটুকু লাভবান হয়েছেন এই হানাহানিতে?

আমাদের গ্রামের নাম ‘বারোঘর’। এ নামের উৎপত্তি হল কোথা থেকে তার স্পষ্ট কোনো ইতিহাস না থাকলেও যতদূর জানা যায়, পূর্বকালে বারোজন প্রসিদ্ধ মহাপন্ডিতের বাস ছিল এই গ্রামটিতে। মুক্তাগাছা, গৌরীপুর, রামগোপালপুর, কালীপুর প্রভৃতি ময়মনসিং জেলার নামকরা জমিদারদের টোলের পন্ডিত ছিলেন এই বারোজন ব্রাহ্মণ। তাঁদের পান্ডিত্যে নেত্রকোণা মহকুমা এই গ্রামের সম্মান বৃদ্ধি করেছে নানাদিক থেকে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সকলেই তাই আমাদের গ্রামটিকে সম্মান এবং সমীহ করে চলত। এই বারোজন ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করেই ‘বারোঘর’ গ্রামের সূচনা। পাশ্চাত্য শিক্ষা যখন অন্য সব গ্রামকে কবলিত করেছে, তখনও এই গ্রাম সযত্নে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে এড়িয়ে চলে আসছিল, কিন্তু কালের কুটিল গতিতে সবই একদিন ভেসে গেল। টোল ছেড়ে ছেলেরা স্কুল-কলেজে ঢুকতে লাগল। ছোটোবেলায় দেখেছি কত দূর দূর থেকে লোক আসত আমাদের গ্রামে বিধান বা ব্যবস্থা নেবার জন্যে–কেউ শ্রাদ্ধের, কেউ বিয়ের, আর কেউ বা প্রায়শ্চিত্তের।

‘বাবোঘর’ প্রাইমারি স্কুল, কাশতলা মাইনর স্কুল’ এ দুটি বিদ্যায়তন এ অঞ্চলে বহু প্রাচীন। বৃদ্ধদের মুখে শুনেছি এখানে পড়েনি এমন বড়ো কাউকে পাওয়া যাবে না। প্রায় সকলের বাপ-ঠাকুরদাই এই স্কুল দুটির ছাত্র ছিলেন। দূর গ্রাম থেকে খালি গায়ে খালি পায়ে হেঁটে ছেলেরা আসত বিদ্যার্জন করতে। শিক্ষক ছিলেন মাত্র দুজন। বেড়াছাড়া, চালা-দেওয়া ঘরের মাঝখানে বসতেন মাস্টারমশাই আর তাঁকে বেষ্টন করে বসত ছাত্রবৃন্দ। স্কুলের চারপাশের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে সাদা হয়ে ফুটে রয়েছে গন্ধহীন কত শেতকড়ি ফুল। পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ায় স্কুলকে কুঞ্জবন বলে ভুল হলেও কোনো দোষ দেখি না! ভাবতেও বুক ফেটে যায় আজ যে, সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা গ্রামটির কী কদর্য রূপই না হয়েছে। সেই নীরব কুঞ্জ আজ জঙ্গলাকীর্ণ, গ্রামবাসী দেশছাড়া, নির্জন নিভৃত গ্রামে সকাল-সন্ধে আজ কেবলি শেয়াল ডাকছে। সাপের ভয়ও নাকি খুব বেড়ে গেছে শুনেছি। কালসাপের ছোবলে লখিন্দরের মতো আমরাও মৃত্যুপথযাত্রী, এ ছোবল থেকে মুক্তি দেবার মতো শক্ত জবরদস্ত রোজার সন্ধান পাইনি। লখিন্দর শেষে প্রাণ পেয়েছিলেন, সম্পত্তি পেয়েছিলেন বলে জানি, কিন্তু আমরাও কি পাব সেসব কোনোদিন? বিষে বিষে নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেছি! বিষয়ের পন্থা কী তা আমাদের অজানা থেকে যাবে সারাজীবন? ভবিষ্যৎ বংশধরেরা আমাদের মূর্খতাকে ক্ষমা করবে কী করে, জানি না।

জলে ছলছল চোখ-দুটির সামনে কেবলি ভেসে উঠছে গ্রাম্য স্কুলের শান্ত মধুর চিত্র। আমগাছের ছায়ায় জটলা করছে ছেলের দল, কেউ বা ঢিল দিয়ে কচি আম পাড়তেই ব্যস্ত, হঠাৎ শোরগোল উঠল–”হেডমাস্টার আসছেন রে।’ মুহূর্তে সমস্ত লোভ সংবরণ করে ছেলেরা দৌড় মারল যে যেদিকে পারে। হেডমাস্টারমশাইকে বড়ো ভয় করত ছেলেরা তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য–ইংরেজিতে তাঁর জ্ঞানও ছিল অসাধারণ। চমৎকার ইংরেজি বলতে পারতেন তিনি। শুধু বরদাবাবুই নন, এ স্কুলের কথা উঠলেই মনে পড়ে গঙ্গাচরণবাবু, উমেশবাবু প্রভৃতির সহৃদয়তার কথা। পাশের গ্রাম বারহাট্টায় উচ্চ ইংরেজি স্কুল হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের গ্রামের স্কুলের আকর্ষণ কমে আসে। কোনোরকমে আরও কিছুদিন চলার পর এতদিনের ঐতিহ্যময় স্কুলটি শূন্যে মিলিয়ে গেল।

বারহাট্টা স্কুলের নামের সঙ্গে আর দুটি নাম জড়িয়ে রয়েছে। তাঁরা হচ্ছেন তার প্রতিষ্ঠাতা মোহিনী গুণ আর শশী বাগচি। বহুশক্তিক্ষয় করে, অর্থব্যয় করে স্কুলের প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। কতবার কত দুর্যোগ এসে স্কুলটিকে বিপন্ন করে তুলেও উঠিয়ে দিতে পারেনি, জানি না আজ স্কুলের প্রাণশক্তি আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে। একদিনের ভয়াবহ ঘটনা মনে পড়ে। রাত্রে হঠাৎ শত্রুপক্ষীয় কেউ স্কুলের খোঁড়া ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়–সে দৃশ্য ভাবলে আজকে এতদূরে থেকেও রোমাঞ্চ লাগে। শিক্ষাসংস্কৃতির মুখাগ্নি করেই তো দেশব্যাপী সূত্রপাত হয় বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের! সুকুমার বৃত্তির এই নির্বাসন কেমন করে কার উস্কানিতে সম্ভবপর হল তা জেনেও আমরা মিলিতভাবে প্রতিরোধ করতে অগ্রসর হইনি সেই অশুভ শক্তিকে।

বিদ্যালয়-ভবনে ওই অগ্নিকান্ডের স্মৃতি কতৃপক্ষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি,–জিদ এবং উদ্যম আরও যেন বেড়ে গিয়েছিল এরপর থেকে। আমাদের গ্রামে শিক্ষার প্রচলন দেরিতে শুরু হলেও তার অগ্রগতি হয়েছিল খুব দ্রুত। সংস্কারাচ্ছন্ন ব্রাহ্মণ-প্রধান গ্রামে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেননি প্রথমে, কিন্তু হঠাৎ অমূল্যদা, সুধীরকাকা প্রভৃতির চেষ্টায় মেয়েদের স্কুল স্থাপনের প্রস্তাব হল। তখন গ্রামে সে কী প্রাণস্পন্দন! ছোটো ছোটো বঞ্চিত মেয়েদের মুখে সে কী অফুরন্ত হাসি! মহকুমা হাকিম স্বয়ং এসে স্কুল উদ্বোধন করলেন। আর এসেছিলেন শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। গ্রামের মেয়েরা শিক্ষা ও প্রেরণা পেলে কত ভালো কাজ করতে পারে, তার কথা সেদিনের সভায় অনেকেই শুনিয়েছিলেন। গ্রামের লোকেরা সমস্ত গ্রামটিকে ঝকঝকে তকতকে করে ভদ্রমন্ডলীর প্রশংসার্জনে সক্ষম হয়েছিল। আজ আর সে স্কুলে ছাত্রী নেই, তবুও পূর্ব সুখস্মৃতি মুছে যায়নি মন থেকে।

বিপিনের রামায়ণগান আর হেমুর ঢপযাত্রার কথা আমাদের গ্রামের প্রত্যেকটি লোকের মনে থাকার কথা। এদের অনুষ্ঠান সবচেয়ে বড় আকর্ষণীয় ছিল গ্রামে। সমস্ত ময়মনসিংহ জেলায় বিপিনের মতো গাইয়ে ছিল না বললেই হয়। সেই সত্তর বছরের বুড়ো কী করে হনুমানের ভূমিকায় অত জোরে লাফ দিত তা আজ ভেবে পাই না। একাই সব ভূমিকায় অভিনয় করার তার ছিল বিশেষত্ব–একবার হনুমান হয়ে ল্যাজ নাড়িয়ে আকাশ লক্ষ করে লাফ দেয়, পরক্ষণেই প্রভু রাম হয়ে তীরধনুক নিয়ে করে সমুদ্রশাসন, আবার পরমুহূর্তেই মিত্র বিভীষণ সেজে গান শোনায় বিপিন। তার গান লোকদের একাধারে হাসাত এবং কাঁদাত। পাতাল-অধিপতি দুষ্ট মহীরাবণ নানা ছদ্মবেশে প্রতারণা করতে আসছে হনুমানকে, কিন্তু তীক্ষ্ণবুদ্ধি হনুমানের কাছে বারবার মহীরাবণ হচ্ছে পরাজিত। অবশেষে বিভীষণের রূপ ধরে সে দুর্গে ঢুকে রাম-লক্ষ্মণকে চুরি করে পালায় পাতালে। হনুমান প্রকৃত বিভীষণের গলা ল্যাজে বেঁধে চিৎকার করে বলে—’ওরে পাপিষ্ঠ রাক্ষস, তুই মোর প্রভুরে করেছিস হরণ! মারি তোয় দূরিব প্রাণের জ্বালা!’ আবার পরক্ষণেই বিলাপবিধুর সুর শোনা যায়–’ওরে ভক্ত হনুমান, এরই জন্যে কি দাদার সাথে করেছিস কলহ?’ এসব অভিনয় দেখে এমন কোনো শ্রোতা থাকত না, যারা শুকনো চোখে বসে থাকতে পারত। বিশ্বাসঘাতক মহীরাবণ আজ সারাপৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, বিপিনের মতো গলাধাক্কা দিয়ে আজ তাদের কে সরিয়ে দেবে? কে তাদের স্বরূপ প্রকাশ করে সমস্ত মানুষকে সাবধান করে দেবে বিপিনের মতো? সিনেমা-থিয়েটারের চেয়েও আকর্ষণীয় সেই গ্রাম্য যাত্রা শোনা আর কি কোনোদিন ভাগ্যে জুটবে–যেতে পারব কোনোদিন ছেড়ে-আসা গ্রামে, বিপিনের আসরে!

মনে পড়ে যোগেন্দ্রকে–পাগল ভবঘুরে হলেও আজ তাকেই বেশি করে মনে পড়ছে। ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়েও ঘুরে বেড়াত চাষিপল্লির প্রতিটি ঘরে। তাদের সুখদুঃখের খবর নিত, তামাক খেত, গল্প করত প্রাণভরে। এই অমার্জনীয় অপরাধের জন্যে বেচারিকে মাতব্বররা একঘরে করে গ্রামছাড়া করেছিলেন।

আর একটা ঘটনা ভাবলে এখনও হাসি চাপতে পারা যায় না।

যোগেন্দ্রের পাশের বাড়িতে থাকত প্রসন্ন। একদিন প্রসন্ন চুপিচুপি যোগেন্দ্রের খিড়কি বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটছে, টের পেয়ে যোগেন্দ্র বাধা দিতে গেল, ফলে শুরু হল হাতাহাতি। রাগ সামলাতে না পেরে প্রসন্ন হাতের কুড়োলের হাতলি দিয়ে আঘাত করল যোগেন্দ্রের মাথায়, যোগেন্দ্রও ছাড়বার পাত্র নয়, সেও বসিয়ে দিল প্রসন্নের পায়ে এক লাঠি। মামলা হল প্রসন্নের অভিযোগে। নেত্রকোণায় তখন মুন্সেফ ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। হাকিমের প্রশ্নের উত্তরে আসামি জবাব দেয়–”হুজুর, ব্যাপারটা এই যে, প্রসন্নবাবু আমার দাদা হন। দাদা হিসেবে তিনি আমাকে আশীর্বাদ করতে পারেন সে কথা এক-শো বার স্বীকার করব। তাই দাদা যখন ভাইয়ের মাথায় অমানুষিকভাবে আশীর্বাদ করলেন তখন বাধ্য হয়েই আমাকেও দাদার শ্রীচরণে প্রণাম জানাতে হল। তবে সাধারণ নিয়মানুযায়ী প্রণামটা আগে হওয়াই উচিত ছিল! মনে পড়ে সে-দিন সমস্ত কোর্ট ঝলমলিয়ে উঠেছিল হাসির গমকে।

আমাদের গ্রামটি ছিল হিন্দুপ্রধান। দুরে মুসলমানপাড়া থেকে তারা আসত ধান কিনতে, কিংবা দেনাপাওনার ব্যাপার নিয়ে। কিন্তু যার সঙ্গে আন্তরিকতা ছিল সারা গ্রামের সে হচ্ছে দাসু ফকির। মুসলমান হয়েও হিন্দুর আচার-ব্যবহারে সে শ্রদ্ধাশীল। তন্ত্রমন্ত্র, ভূত-তাড়ানো ইত্যাদি ব্যাপারে তার হাত ছিল পাকা। তেলপড়া, জলপড়া দিতে নিত্যই তাকে আসতে হত আমাদের গ্রামে। তার দেওয়া মাদুলি আমার শরীরেও শোভাবর্ধন করছে। ফকিরের অবাধ যাতায়াত ছিল সব বাড়িতেই। ছেলে কেমন আছে গো’ বলে ঢুকত সে বাড়ির মধ্যে–তারপর চলত তুকতাকের মহড়া! বিড়বিড় করে মন্ত্রপাঠ করে ফুঁ দিয়েই সে রোগ তাড়াত; দেখে অবাক হয়ে যেতাম। তার কান্ডকারখানা আজকেও বিস্ময় জাগায়। জিন গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে সে আমাদের বাড়িমুখো এগুতেই তাকে সেবার প্রশ্ন করেছিলাম—’এ বছরটা কেমন যাবে রে দাসু ফকির?’ অসংকোচে গম্ভীর হয়ে সে জবাব দিয়েছিল—’খুব দুর্বছর! তুফান হবে, কলেরা-বসন্তে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। মহামারি লাগবে দেখো কীরকম জোর।‘ অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। সেবারেই গাঁ উজাড় হয়ে গেল–বাংলাদেশে মানুষ পশুর পর্যায়ে নেমে এসে মৃত্যু-বন্যায় ভেসে গেল! তখন ভাবিনি এমনভাবে দেশ ভাগ হয়ে দাসু ফকিরের কথা সত্যি প্রমাণিত হবে।

গ্রামের সবচেয়ে আনন্দের দিন ছিল দুটি–একটি শ্রাবণী সংক্রান্তি, অপরটি চৈত্র সংক্রান্তি। সাপের ভয়ে পূর্ববাংলার গ্রামবাসীরা সর্বদাই ভীত। প্রতিবছর সাপের কামড়ে মারা যায় বহুলোক। তাই মা মনসাকে তুষ্ট করার জন্যেই প্রতিবাড়িতে ব্যবস্থা হয় মনসা পুজোর। সামর্থ্যানুযায়ী পুজোর আয়োজন। হাঁস, পাঁঠা, আর কবুতর বলি থেকে কুমড়ো পর্যন্ত বলি দেওয়া হত। অতিপ্রত্যূষেই ছেলেরা বিছানা ছেড়ে জমা হত খালের ধারে। সূর্যকিরণে খালের জলের ঢেউ চিকচিক করছে, দূরে দেখা যাচ্ছে ছোটো ছোটো নৌকা। ছেলে-বুড়ো খালের জলে ডুব দেয়, ডুব দিয়ে উঠে বসে। হাত চালিয়ে শাপলা ফুল তুলে নৌকো নেয় ভরে। ফিরে এসে সব বাড়িতে বাড়িতে সে ফুল ভাগ করে দেয় তারা। পুজোর ফুলের জন্যে ভাবতে হয় না কাউকেই। যে বাড়িতে পুজো নেই তারাও ফুলের ভাগ থেকে বাদ পড়ে না। শাঁখ, কাঁসর, ঘণ্টা বাজিয়ে আরম্ভ হয় মনসা পুজো। সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি। ছেলেরা মহা উৎসাহে বাজনার মহড়া দেয়, কাউকে ডাকার প্রয়োজন নেই, মান-সম্মানের কোনো বালাই নেই, সকলেই আসে স্বেচ্ছায়। ছেলেদের হাতে দেওয়া হয় না। এরই মধ্যে মিশে রয়েছে আন্তরিকতার সুর। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যেও সেই একই মিলনের সুর বেজে উঠত পল্লিজীবনে। কিন্তু আজ আর সে সুর নেই, বেসুরো জীবন অনির্দিষ্টের পথে এগিয়ে চলেছে।

অদূরে কংস নদীর কূলে কূলে কত প্রান্তর, কত অরণ্য–মাঝে মাঝে এক-একটি পল্লি প্রতিমা। নদীর তীরে নিত্য আসে তরুণ রাখালেরা গোরু-মোষ চরাতে। পাশে অরণ্য, ধু-ধু প্রান্তর–ভয় লাগে তাদের মনে। অজ্ঞাত প্রিয় বান্ধবীর গাওয়া গান সুর ধরে গাইত তারা,

মইষ রাখো মইষাল বন্ধুরে কংস নদীর কূলে,
(অরে) অরণ্য মইষে খাইব তোরে বাইন্ধা নিব মোরে।

নির্জনতা ভেঙে খানখান হয়ে যেত রাখালের সেই গানে, ভয়ডর সব দূর হয়ে যেত মন থেকে। বন্ধুর জন্যে কী আকুলতাই না ফুটে উঠত সে গানে, সে সুরে। আজ আমরা যারা দেশছাড়া হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি, তাদের জন্যে কোনো প্রতিবেশী বন্ধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছে জানতে পারলে এ দুঃখের মধ্যেও কত শান্তি পাওয়া যেত।

কত কথা, কত ব্যথা আজ মনকে ভারাক্রান্ত করছে–সমস্ত আন্তরিকতা, সহৃদয়তার এমন সলিলসমাধি হবে কে জানত! শ্রীদাম ধোপার অকালমৃত্যু বা অনিলদার আকস্মিক জীবনাবসান সমস্ত গ্রামের চোখে জল এনেছিল একদিন, আর আজ সমস্ত বাঙালি জাতির অপমৃত্যুতে কারও ভ্রূক্ষেপই নেই দেখে মন অবশ হয়ে আসছে।

.

কালীহাতী

প্রভাতের আরক্ত তপন পুব আকাশে উঁকি দেন–ধরণীর মুখের উপর হতে অন্ধকারের অবগুণ্ঠন উন্মোচিত হয়ে যায়। তন্দ্রাচ্ছন্ন মহানগরীর বুকে জাগরণের সাড়া পড়ে। শুরু হয় কর্মক্লান্ত জীবনের পথে দিবসের পথচলা। ছন্নছাড়া অভিশপ্ত মানুষের দল ভিড় করে রাস্তার মধ্যে খুঁজে বেড়ায় অন্তহীন তমিস্রার মাঝে সমুখের উদীয়মান পথরেখা।

কোলাহলমুখরিত নগরীর বুকে আমারও আত্মকেন্দ্রিক জীবনের শুরু হয় লক্ষ্যহীন পদক্ষেপে। প্রভাতের নবারুণ আমার জীবনে আনে না কোনো নতুন আশার আলো, শোনায় না কোনো উদ্দীপনার অগ্নিমন্ত্র। সে যে পথভ্রষ্ট জীবনপথে ছন্দহীন পথচলা। কর্মহীন বেকার জীবনে মনের খোরাক নিঃশেষ হয়ে আসে–জীবনীশক্তিও শেষ হতে চায় বুঝি! সীমাহীন দুঃখের মধ্যেও মনের কোণে ঝংকার তোলে শুধু অতীতের গর্ভে বিলীয়মান দিনগুলোর মধুময় স্মৃতি। পশ্চাতের অতিক্রান্ত পথের বুকে ছোটো-বড়ো পদচিহ্নগুলো আমার মিশে আছে সুদূর অতীতের পাতায় পাতায়–ফেলে বুকের পরে। তারা টানে–আমায় নিরন্তরই টানে।

লোকে বলে—’জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।‘ স্বর্গের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ নই আমি। কিন্তু স্বর্গাদপি গরীয়সী পল্লিজননীর স্নেহের আস্বাদ পেয়েছি–খুব বেশি করেই পেয়েছি। তাই তাকে ভুলতে পারি না কল্পনাও করতে পারি না ভুলে যাবার। ভাবতে গিয়ে হৃদয় ব্যথাতুর হয়ে ওঠে–পল্লিমায়ের কোল হতে বিচ্যুত হয়ে যাবার কথায়। বেদনাবিধুর হৃদয়ের বেলায় বেলায় ‘আছাড়ি বিছাড়ি’ পড়ে শত সহস্র বিক্ষুব্ধ তরঙ্গরাশি।

লক্ষ লক্ষ গ্রামে গাঁথা এই বঙ্গভূমি। এরই শতকরা নিরানব্বইটা গ্রামের মতো অতি সাধারণ–অতিনগণ্য আমার পল্লিজননী। ইতিহাসের স্থায়ী আসন করে নেবার মতো মূলধন নেই তার–পারেনি কোনো মহামানবের জন্ম দিয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করতে। তবু তাকে ভালোবাসি–শত দোষত্রুটি, শত দীনতা সত্ত্বেও প্রাণের চাইতে ভালোবাসি আমার পল্লিজননীকে। এর আম্রবীথি-ঘেরা ঝিঁঝি ডাকা ধূলিধূসর পথের প্রত্যেকটি ধূলিকণা আমার পরিচিত, আমার অতীত স্মৃতি রয়েছে বিজড়িত হয়ে পথিপার্শ্বস্থ প্রত্যেকটি বৃক্ষের পত্রপল্লবে। তাই আমার পল্লিমায়ের কথা স্মরণ করে শতযোজন দূরে বসেও আমার হৃদয় হয়ে ওঠে এক অপূর্ব মধুর রসে আপ্লুত।

গ্রামের দু-দিক বেষ্টন করে রেখেছে সমকোণীভাবে ক্ষীণকায়া একটি ছোটো নদী। নদী। বলা চলে না ঠিক–একটা বড়ো খাল বললেই যথেষ্ট। তবু আমরা একে বলে এসেছি নদী। ফটিকজানি। চৈত্র মাসে জল শুকিয়ে যায় হাঁটুজলের বেশি থাকে না। নদীর নামকরণ নিয়ে মাথা ঘামাইনি, ফটিকের মতো স্বচ্ছ জলের অভাবে অনুযোগও করিনি কোনোদিন। বর্ষার দিনে দু-কূলপ্লাবী স্রোতস্বিনীর কর্দমাক্ত জলের বুকেই ঝাঁপিয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গা ভাসিয়ে দিয়ে ভেসে উঠেছি গিয়ে শ্মশানঘাটে, কালীবাড়িতে, কোনোদিন বা খেয়াঘাটে।

উত্তরপাড়ার সেনেদের বাঁধানো ঘাটে দুপুরবেলায় ভিড় জমত পাড়ার মেয়েদের। সত্তর বছরের বুড়ি ঠাকুমা থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের নাতিনাতনি খেদি, পটলা, খুকি পর্যন্ত। স্নান করতে করতে চলত কত হাসি, কত গল্প, কত রং-তামাশা। মায়েরা বাচ্চাদের ধরে ধরে জোর করে সাবান মাখাতে বসত–আর সেই সব ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের সমবেত কান্নায় ঘাটের আকাশ-বাতাস উঠত মুখরিত হয়ে। তারই মধ্যে যত রাজ্যের চলত গল্প। ‘অ দিদি, কী রান্না হল আজ?’ ‘কী যে করি ভাই, ছোটো খুকিটার ক-দিন থেকে জ্বর হচ্ছে। ছাড়ছে না কিছুতেই।’ ‘ও মা! তাই নাকি! পোড়ামুখো কী আবার ষাট বছরে বিয়ে করতে যাচ্ছে নাকি?’ এমনি আরও কত শত কথা।

বর্ষায় স্ফীত ফটিকজানি দুকূল ভাসিয়ে দিত মাঝে মাঝে। মনে পড়ে কী অপরূপ পরিবেশের সৃষ্টি করত জ্যোৎস্নাস্নাত তটিনীর অতুলনীয় রূপমাধুরী। অপূর্ব মোহাবেশের বিস্তার করত ফটিকজানির সেই নৈশ রূপমাধুর্য। কত চাঁদিনি রাতে ডিঙি ভাসিয়ে দিয়েছি আমরা ফটিকজানির সেই শান্ত সমাহিত বুকের পরে! বাঁশির সুরে ভরে দিয়েছি নিশীথ রাত্রির আকাশ-বাতাস। জ্যোৎস্নাবিধৌত পল্লির অপরূপ রূপের তুলনা নেই কোথাও। রূপকথায় শোনা স্বপনপুরীর রূপমাধুর্যও হার মানে তার কাছে। গাঁয়ের মধ্যে আমরা কয়েকজন ছিলাম ডানপিটে। কত নিশুতি রাতে দলবেঁধে আমরা মৎস্যশিকারের উদ্দেশ্যে অভিযান করেছি খ্যাতনামা সাতবিলের দিকে। কত কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল এই বিলের নামে! অভিশপ্ত প্রেতাত্মা, অশরীরী কত আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায় সাতবিলের ওপর দিয়ে। প্রত্যক্ষদর্শী কত মৎস্যশিকারির মুখে শুনেছি এসব কাহিনি–অবাক হয়ে গিয়েছি রামনামের অত্যাশ্চর্য মহিমায়–তখন বিশ্বাস করেছি তাদের সে সমস্ত অতিরঞ্জিত কল্পিত ভয়-কাহিনি। মনে পড়ে রামকান্ত মাঝির কথা। আমাদের প্রজা ছিল সে। আমাদের বাড়ির পাশেই বাড়ি। কত রাত্রি জেগে যে রামকান্তদার কাছে বসে এই সমস্ত মৎস্যলোভী অশরীরীদের গল্প শুনেছি তার হিসেব নেই। জাল বুনতে বুনতে গল্প বলত রামকান্তদা। তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা নাকি সেসব। আমার শিশুমনের ওপর সে কাহিনিগুলো বিস্তার করত এক অপূর্ব মায়াজাল। তারপর বড়া হয়ে কতদিন অভিযান করেছি অপদেবতা অধ্যুষিত সাতবিলে–যোগীমারা দহের স্থির স্তব্ধ জলরাশির ওপর দিয়ে। কিন্তু কোনোদিনই সৌভাগ্য হল না সেই অশরীরী আত্মাদের দর্শন লাভের; কোনো অবগুণ্ঠনবতী রমণী কোনোদিন আমার কাছে এসে আনুনাসিক সুরে প্রার্থনা করল না মাছ। মধুর সে সমস্ত দিনগুলোর স্মৃতি কী করে ভুলব?

গ্রামের প্রধান অংশ মুনশিপাড়া। বনেদি জমিদার এ পাড়ার প্রধানরা। বাড়িগুলো এদের পড়ে আছে আজ পরিত্যক্ত মরুভূমির মতো। আগাছার ঝোঁপঝাড়ে ভরে আছে গ্রামের রাস্তাঘাট। দিনের বেলায়ই ভয় হয় পথ চলতে। এমনটি কিন্তু ছিল না কোনোদিন।

মুনশিদের উদ্যানের ভগ্নাবশেষের পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়েই পৌঁছোতে হয় ভাঙা-পুলের বুকে। সাহাপাড়ার মধ্যে অবস্থিত সে পুলটি। সংকীর্ণ একটি খালের মধ্য দিয়ে গাঙের জলরাশি এসে আছাড়ি-বিছাড়ি পড়ে ওই পুলের তলদেশে। শত শত আবর্তের সৃষ্টি করে বয়ে যায় বাঁশঝাড়ে রচিত তোরণের মধ্য দিয়ে কর্মকার পাড়ার দিকে। আপরাহের পড়ন্ত রোদে গাঁয়ের ছেলেদের আড্ডা বসত পুলের ওপর–গল্পে, উচ্চহাসিতে, হইচইতে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পৃথিবীর বুকে নেমে আসত ক্রমে রাত্রির যবনিকা।

কামারপাড়ার বাঁশঝাড়ে ঢাকা গতিপথে গিয়ে খালটি মোড় ফিরেছে পদ্মিনী বুড়ির বাড়ির কাছে। ফিরে বইতে শুরু করেছে সাতুটিয়ার পুলের দিকে। মনে পড়ে পদ্মিনী বুড়ির কথা। কতদিন স্কুল পালিয়ে হানা দিয়েছি বুড়ির কাশীর কুলগাছে-কাঁচা-মিঠে আম গাছে। কাংস্যকন্ঠ সপ্তমে চড়িয়ে মুড়ো ঝাঁটা নিয়ে দৌড়ে এসেছে বুড়ি-ভগবানের কাছে আবেদন করেছে আমাদের চোদ্দো পুরুষের কায়েমি নরকবাসের জন্যে। পঞ্চাশ সালে গলেপচে মারা গেল পদ্মিনী বুড়ি অশেষ কষ্ট পেয়ে।

মনে পড়ে আজ হেমন্তের অপরাহ্ন পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে বেড়াতে বেরুতাম–সবুজ ঘাসে-ঢাকা মাঠের মধ্য দিয়ে, কোনোদিন মেঘখালির পুলের উদ্দেশ্যে, কোনোদিন বা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক ধরে অনির্দেশের পানে। দু-ধারে প্রসারিত ছিল শ্যামল বঙ্গজননীর এক নয়নাভিরাম রূপ। মেঘশূন্য নীলাকাশের বুকে লাগত বিদায়ী অরুণের রক্তরাঙা অনুলেপন, ঘাটে-মাঠে-বাটে লাগত অস্তরাগের ছোঁয়া। হারিয়ে গেছে সে দিনগুলো, হারিয়ে গেছে চিরতরে। বন্ধুরাই বা কে কোথায় হারিয়ে গেল জীবনস্রোতের কুটিল আবর্তে, কে বলবে?

গ্রামের একটা প্রধান অংশ কালীবাড়ি। নদীর পাড়ের এই কালীমন্দিরটির কথা শুনে এসেছি ছোটোবেলা থেকেই। জাগ্রতা কালীমাতা। কত অলৌকিক কাহিনির জনশ্রুতি প্রচলিত এই কালীপ্রতিমা সম্বন্ধে। নিশুতি রাতে লালপেড়ে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে নাকি দেখা যেত তাঁকে এই কালীবাড়ির বাঁধানো চত্বরে, কিন্তু চরম দুর্দিনে পাষাণী মা পাষাণীই রয়ে গেল।

বেশিদিনের কথা নয়। বছর খানেক আগেও হরিসংকীর্তনে, যাত্রাগানে এই মন্দির-প্রাঙ্গণ হয়ে উঠত মুখরিত। তাতে কুণ্ঠিত হয়নি মুসলমান জনসাধারণ অংশগ্রহণ করতে। কৃষ্ণবিরহ বিধুরা রাধার দুঃখে তারাও হিন্দু শ্রোতাদের মতো সমানভাবে ফেলেছে সমবেদনার অশ্রুরাশি। পদ্মপুরাণের গানে, কথকতার আসরে, রামায়ণগানে, ত্রৈলোক্যঠাকুরের মেলায় এরাও নিয়েছে মুগ্ধ শ্রোতার অংশ। সমানভাবেই পদ্মপুরাণের গানে তারাও ধুয়া ধরেছে—’বেউলা বলে লখিন্দর, পূর্বকথা স্মরণ করো।’ সানন্দেই তারা গ্রহণ করেছে ত্রৈলোক্যঠাকুরের প্রসাদি গঞ্জিকার অংশ, উচ্চকণ্ঠে গান ধরেছে ভক্তবৃন্দের সঙ্গে—’ত্রৈলোকের মেলারে ভাই যে করিবে হেলা। হস্ত যাবে, পদ যাবে, চোখে বেরুবে ঢেলা।’ হস্তপদ যাওয়ার ভয়েই হোক বা হিন্দু ভাইদের সঙ্গে সম্প্রীতির ফলেই হোক ত্রৈলোক্যঠাকুরকে অবহেলা করেনি তারা। সেই দিনগুলোর কথা আজ মনে হয় বুঝি বা স্বপ্ন। কৈশোরের লীলানিকেতন পল্লিমায়ের বুকে যাদের সাহচর্যে শুরু হয়েছিল আমার জীবনের প্রথম পথচলা–তারা সবাই হারিয়ে গেছে আজ। দুর্যোগময়ী রজনীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথমাঝে তারা ছিটকে দূরে গড়িয়ে পড়েছে শত যোজনের ব্যবধানে। কেউ বা তাদের পথ খুঁজে পেয়েছে–কেউ বা পথ খুঁজে মরছে এখনও।

মহেশদাকে মনে পড়ে। একমুখ দাড়িগোঁফে আচ্ছন্ন বেঁটে কালো লোকটি। সদাহাস্যময় মুখ। গ্রামের সব কাজে অগ্রণী। আমাদের সর্বজনীন ‘দাদা’–সকলেরই শ্রদ্ধেয়। বয়স প্রায় ঘাটের কোঠায় পোঁছেছে, দেহের বাঁধন অটুট। কালীবাড়ির বার্ষিক উৎসবে চাঁদা তোলার ব্যাপারে–রাত জেগে পাহারা দেওয়ার জন্যে শখের রক্ষীদলে আমরা মহেশদাকে পেতাম সর্বাগ্রে। খুবই উৎসাহ ছিল বৃদ্ধের। পাহারা দেবার সময় হাঁক দেওয়ার ব্যাপারে জুড়ি ছিল না তাঁর। লাঠিটা সোজা করে তার ওপর ঝুঁকে পড়ে উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিতেন মহেশদা-–’বস্তিওয়ালা জা—গো–রে।’ আমরা বলে উঠতাম সব—‘হেঁ—ই–ও।’ এখনও আছেন মহেশদা। তবে নিশুতি রাতে গ্রামের বুকে তাঁর খড়মের শব্দ এখনও ধ্বনিত হয় কি না তা বলতে পারি না।

মনে পড়ে কালবৈশাখীর চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব মুখরিত দিনগুলোর কথা। রাত জেগে বাবার চোখ এড়িয়ে দেখতে যেতাম গাজনের মেলা। গ্রামের অশিক্ষিত জনসাধারণ সং সেজে করত কত উৎকট আনন্দের পরিবেশন। অনেক সময় শ্লীলতার সীমা যেত ছাড়িয়ে। তবু কী আনন্দই না পেতাম সেই গ্রাম্য উৎসবের মধ্যে। জিহ্বা ফুটো করে লোহার শিক ঢুকিয়ে উৎসব-প্রাঙ্গণে নৃত্য করত সেইসব পূজারির দল। সারারাত জেগে শ্মশানে গিয়ে দেখতাম কালী হাজরার ‘রাতের ভোগে’র উৎসব। ভোরবেলায় জাগরণক্লিষ্ট দেহে চুপি চুপি বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়তাম বিছানায়। অবাক হয়ে যেতাম ‘কেতু সন্ন্যাসী’র দেহে দেবতার আবির্ভাবের উত্তেজনায়। কী মধুর, কী আনন্দময় মনে হত সে কালটা!

বিজয়া দশমীর কথা ভুলব কী করে? ফটিকজানির বুকে আশপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে এসে জড়ো হত প্রতিমা। খেয়াঘাট থেকে শুরু করে এপারের জেলেপাড়ার ঘাট পর্যন্ত ভরে যেত নৌকায়-নৌকায়। তিলধারণের ঠাঁই থাকত না সারানদীতে। নৌকার ওপরে চলত নাচ গান, লাঠিখেলা, সংকীর্তন–আমোদ-উৎসবের হইহুল্লোড়। গাঙের বুক মথিত হয়ে উঠত বাইচ খেলার নৌকার তান্ডব নর্তনে। সে খেলায় বেশির ভাগ অংশই গ্রহণ করত মুসলমানরা।

আশপাশের গ্রামের প্রায় সমস্ত নিরীহ মুসলমান কৃষকদের সঙ্গেই ছিল আমাদের অকৃত্রিম হৃদ্যতা। তারি ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। অশীতিপর বৃদ্ধ তারি ভাইয়ের সঙ্গে যখনই দেখা হত, পথের মাঝে জিজ্ঞাসা করতাম–’কেমন আছ তারি ভাই?’ ভালো করে চোখে দেখত না সে। শব্দ লক্ষ করে কাছে এসে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে ঠাহর করে নিয়ে বলে উঠত-–’কে ভাই? অ, নাতিঠাকুর! এই একরহম আছি। তা তুমি কুঠাই যাবার লাগছ?’ তারপর সেই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েই চলত এ গল্প, সে গল্প, তার ছেলেদের দুর্ব্যবহারের কথা। তারপর ঠকঠক করে আবার চলত সে গন্তব্যস্থলের দিকে। এখনও বেঁচে আছে তারি ভাই। গাঁয়ের বুকে এখনও বোধ হয় তার লাঠি ঠকঠক শব্দে ঘুরে বেড়ায়।

আর একজনের কথা মনে পড়ে। ফজু ঢুলি–গ্রামের চৌকিদার। রাস্তায় যখনই দেখা হত তার সঙ্গে আভূমি নত হয়ে বলে উঠত ‘সেলাম কর্তা সেলাম। হেসে জিজ্ঞাসা করতাম –’ভালো আছ?’ সে আবার সেলাম করে বলে উঠত—’আজ্ঞে, খোদায় রাখছে ভালো।’ মনে পড়ে কত রাত্রে ঘুম ভেঙে যেত তার পরিচিত কণ্ঠের আহ্বানে—’কর্তা, জাগেন।’ তারা তো আজও আছে, আজও বোধ হয় ফজু চৌকিদার তার টিমটিমে লণ্ঠনটি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় নিশুতি রাত্রে পল্লির রাস্তার রাস্তায়–নিশীথের নিস্তব্ধতা ভেদ করে তার কাংস্যকণ্ঠ ধ্বনিত হয়—’বস্তিওয়ালা জা—গো–রে।’ হঠাৎ ঘুম ভেঙে-যাওয়া এক শিশু হয়তো চিৎকার করে কেঁদে ওঠে কোনো বাড়িতে। উৎকট চিৎকারে বিরক্ত হয়ে একটা নিশাচর পাখি হয়তো উড়ে যায় এগাছ থেকে ওগাছে ডানার ঝটপটানিতে অনধিকার প্রবেশের প্রতিবাদ জানিয়ে।

এমনি আরও কত শত পরিচিত মুখ মনের দুয়ারে উঁকি মারে। এরা যে ছিল আমার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

এই আমার পল্লিজননী ময়মনসিংহ জেলার টাঙাইল মহকুমার কালীহাতী গ্রাম। পিতৃপিতামহের ভস্মাবশেষ মিশে রয়েছে ধূলিধূসর এ গাঁয়েরই মাটির সঙ্গে। সপ্তপুরুষ আমার এরই বুকের ওপর হয়েছে লালিত পালিত।

তাই তো এখনও ভালোবাসি, শত মাইল দূরে বসেও স্মরণ করি আমার সেই গ্রামকে, আমার সেই পল্লিজননীকে। পেছনে ফেলে-আসা সেই ধূলিধূসরিত আম্রবীথি-ঘেরা ছায়াসুশীতল বনপথকে কী করে ভুলব? সে পথের বুকে আমার পিতৃপিতামহের চরণধূলি মিশে আছে অণুতে অণুতে। সমুখের পথে পাই না কোনো আলোর হাতছানি, তাই তো পেছনের অতিক্রান্ত পথ আমায় ডাকে–কেবলই ডাকে। অমোঘ আকর্ষণ সেই আহ্বানের। স্বর্গাদপি গরীয়সী পল্লিমায়ের আকুল আহ্বান প্রতিহত হয়ে ফেরে ব্যবধানের প্রাচীন গাত্রে–ফিরে যায় ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে। ভুলতে পারি না তাকে-–ভুলতে পারবও না কোনোদিন! মনে পড়ে নিরন্তরই–‘সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া।’

.

সাঁকরাইল

সূর্যাস্তের পানে তাকিয়ে সূর্যোদয়ের কথা ভাবা ছাড়া আর কী করতে পারি আমরা আজ? জীবন থেকে সূর্যালোক চলে গিয়ে সমস্ত কিছুকে অন্ধকার ব্যর্থতার মধ্যে ঢেকে দিয়েছে। তবু আমরা আলোর পূজারি। আলোকের ঝরনাধারায় জীবনকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াসী। জীবন মধুর হোক, আলোকময় হোক, আনন্দময় হোক, এ কে না চায়! মহামরণকে মহাজীবনে পরিণত করার মন্ত্র আপাতত আমরা ভুলে গেলেও হতাশ হব না। জীবন-যৌবন দিয়ে পূর্বসূরিদের মহামিলনের গান আমরা গেয়ে যাব। জানি না আত্মবিস্মৃত মানুষ কবে মিলনের গান গ্রহণ করতে পারবে আবার!

আমার গ্রামের কথা মনে পড়লেই কবি গোবিন্দদাসের ঘর ছাড়ার কথা মনে পড়ে। তাঁর গৃহত্যাগের কবিতা আমাদের জীবনকেও যথাযথ রূপ দিয়েছে যেন,

কোথা বাড়ি, কোথা ঘর কি শুধাও ভাই,
যে দেশে আমার বাড়ি আমি সে দেশের পর–

সত্যি, আমার যে দেশে বাড়ি আমি সে দেশের অনাত্মীয় আজকে। ঘর আছে, গ্রাম আছে, সম্পত্তি আছে অথচ আজ আমি উদবাস্তু। বাস্তুত্যাগীর দুঃখ হৃদয়বান না হলে উপলব্ধি করা

সহজ নয়। দুঃখের সমুদ্র মন্থন করে আজ যে বিষ উঠেছে দেশময়, আমরা তা পান করে নীলকণ্ঠ হয়েছি! অমৃতের পুত্রদের আর সুখ নেই–সুখ, স্বস্তি, শান্তি, প্রেম-ভালোবাসা দেশত্যাগী হয়েছে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই। চারদিকে কুটিল চক্রান্তের কলুষিত ছবি,–সেই পূর্বদিনের সুখীসচ্ছল মানুষের এবং গ্রামের চিত্র কোথায় অন্তর্হিত হল? মানুষ সুসভ্য হয়েছে শুনতে পাই, কিন্তু এই কি সভ্যতার রূপ? এই জন্যেই কি এত সাধনার প্রয়োজন ঘটেছিল? কোথায় গেল সে প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি, নির্লোভ, নিষ্কলুষতার প্রতীক? কে হরণ করল আমাদের সদগুণগুলো? এই সভ্যতার সংকট থেকে কবে আমরা পরিত্রাণ পাব?

জানি এসব সাময়িক বর্বরতা আমাদের জীবনযাত্রার পথে ছলনা নিয়ে এসে ক্ষণিকের জন্যে আমাদের অগ্রগতি রুদ্ধ করবার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমরা সে মোহের জালে ধরা দিলাম কেন? মানুষের আদি নারী-পুরুষ ‘আদম-ইভের সংকট’ কি আবার দেখা দিল বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে? আবার কি শয়তান-কুটিল সাপের ছোবলে মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনল? কেন এই মতিভ্রম, কেন এই পদস্খলন, কেন এইভাবে মানুষ মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করছে পরের ধার করা পরামর্শ শুনে?

আমাদের গৈরিকধূসর বৈরাগ্যমন তো কখনো আক্রমণাত্মক ছিল না? লোভের হাতধরা হয়ে কখনো তো সে কোনো নিরীহের প্রাণহরণ করেনি! সামান্য তেঁতুলপাতার ঝোল খেয়েই দিনযাপন করেছেন আমাদের পুর্বপুরুষরা, তবুও প্রতিবেশী রাজার রাজত্বের দিকে লোভাত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেননি–তবে সে স্বর্গ থেকে বিদায় নিতে হল কেন আমাদের? কোন পাপে মানুষ আজ হানাহানিতে মত্ত-ভ্রাতৃরক্তে তার কেন এত তৃপ্তি? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো বলে গেছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। গুরুদেব যে মানুষের মধ্যে বাঁচতে চেয়েছিলেন সে মানুষ আজ কোথায়?

বহুদিন মাকে হারিয়েছি কিন্তু আজ হারালাম জননী জন্মভূমিকে। আমার জন্মভূমি আজ আর আমার নয়। তবু তাঁর স্মৃতি মনের মণিকোঠায় জড়িয়ে রয়েছে অচ্ছেদ্য বন্ধনে। মনের ভেতর একটি ছবিই সমস্ত জায়গা জুড়ে আছে–সে ছবি আমার তীর্থভূমির, আমার ছেড়ে আসা গ্রাম সাঁকরাইলের। ময়মনসিংহ জেলার টাঙাইল মহকুমার সাঁকরাইল গ্রামকে আমি কোনোদিন মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। তার সুখ-দুঃখ যে আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। আমি তার কথা ভুলতে চাইলেও সে আমাকে ভুলবে না– নির্জনস্বাক্ষর উজ্জ্বল হয়ে মনকে সততই প্রশ্নজালে জর্জরিত করবে! শহর থেকে দূরে নির্জন গ্রামখানির এত মোহিনীশক্তি একথা আগে কে জানত?

রাত্রের অসতর্ক মন যখন কল্পনার ডানা বিস্তার করে, তখনই মনে পড়ে যায় আমার গ্রামখানির কথা। শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে হায় হায় করে ওঠে মন তার কথা চিন্তা করে! ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই হলেও ছেলেরা মাকে ভাগ করতে পারে জানতাম না, আজ দেখছি সব কিছুই সম্ভব মানুষের স্বার্থের কাছে! মাকেও আজ মূর্খ আমরা ভাগের মা করে ছেড়েছি।

যেখানে বারোমাসে তেরো পার্বণ লেগে থাকত সে গ্রাম আজ খাঁ খাঁ করছে মানুষের অভাবে। জঙ্গলে ভরতি হয়ে গেছে উঠোন, লক্ষ্মী আজ গ্রামছাড়া! শুনেছি দিনদুপুরে শেয়াল ডাকে আমাদের বাড়ির মধ্যে–নির্ভীক তাদের পদক্ষেপ, বিস্তৃত তাদের বিচরণভূমি। মনে পড়ছে অতীত আভিজাত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো তিনপুরুষের চকমিলানো দালান, পুজোমন্ডপ, দিগন্তপ্রসারী আম-কাঁঠালের বাগান,শান্তির নীড় হাতছানি দিয়ে ডাকলেও সেখানে যাবার উপায় নেই আজ। দুঃখ হয় নিজবাসভূমিতে আজ আমরা পরবাসী হয়ে পড়েছি ভেবে! হাসি পায় ভেবে যে, এই আমরাই বিজয়সিংহের বংশধর–আমরাই হেলায় লঙ্কা জয় করেছিলাম। একটা পাগলামিকে যাদের রোধ করার ক্ষমতা নেই তারা দেশজয়ের গর্ব করে কী করে?

মন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে অতীত-বর্তমানের হিসেব-নিকেশে, কিন্তু কী পেয়েছি আর কী পাইনি তার হিসেব করতে মন আর রাজি নয়। সে চায় শান্তি, সে চায় আশ্রয়, সে চায় আশপাশে দরদি মানুষ। কোথায় গেল সেসব মানুষ যারা পরার্থে জীবন বিসর্জনেও পরা’খু ছিল না। নিজের স্বার্থ যাদের কাছে বড়ো ছিল না, বড়ো ছিল অন্যের নিরুপদ্রব জীবন, শ্বাপদসংকুল জনপদে তাই আমরা পদে পদে বিপর্যস্ত, প্রাণ বাঁচালেও মান বাঁচানো চলছে না আর!

সিরাজগঞ্জের ঘাটে নেমে যমুনা নদী পাড়ি দিতে হত ফেরিতে, তারপর নৌকাযোগে যেতে হত আমাদের গ্রামে। নদীর বুকে সূর্যোদয়ের জীবন্ত ছবি আজ অন্ধকারেও স্পষ্ট মনে পড়ে। রাঙাবরণ তরুণ তপন আশা নিয়ে আকাশের গায়ে যখন দেখা দিত তখন আমার মাথা আপনি তার পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। নদীর জলে পেয়েছি জীবনকে আর যৌবনকে পেয়েছি। সূর্যের মধ্যে,জীবনযৌবন সেদিন আমাকে অশ্বমেধের বেপরোয়া ঘোড়ার গতি জুগিয়েছে –অশান্ত মন লাগামহীন হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে যত্রতত্র। আজও তো সবাই আছে, কিন্তু সে গতি শ্লথ হল কেন? ছ্যাকরাগাড়ির মতো ক্লান্ত পায়ে কতদূর এগিয়ে যেতে পারব? তরুণ সূর্যের আলোতে সেদিন মাঝিমাল্লারাও মনের খুশিতে গান ধরত দাঁড় বাইতে বাইতে। সে ভাটিয়ালি গান দেহতত্ত্বের রসে সঞ্জীবিত ছিল। গানের তালে তালে ছোটো ছোটো ঢেউ কেটে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা মনে করলে নিজেকে আর সামলাতে পারি না।

সিরাজগঞ্জের হোটেলে ইলিশমাছের ঝোল-ভাত সেদিন যা খেয়েছি তার স্বাদ যেন আজও মুখে অমৃতের মতো রয়েছে লেগে। হোটেলওয়ালাদের দুষ্টুমির কথা মনে পড়লে হাসি পায়। যাত্রীরা খেতে বসলেই তারা স্টিমার ছেড়ে যাচ্ছে বলে ভয় দেখাত, ফলে কম খরচে তাদের হত বেশি লাভ। মনে পড়ছে সেবার এক যাত্রীকে ওই ধরনের ধাপ্পা দিতে গিয়ে হোটেলওয়ালাই ভীষণ জব্দ হয়ে যায়। সে শেষপর্যন্ত হোটেল ফাঁক করে তবে হোটেল ছাড়ে! কত খুঁটিনাটি কথাই মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে আজ।

দেশে পৌঁছে ছোটো ভাইবোনদের সঙ্গে পুকুরে মাতামাতি করার দৃশ্যটি পর্যন্ত আজ ভুলে থাকবার উপায় নেই। চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত জল থেকে উঠতাম না–কাদাঘোলা জলে পানকৌড়ির মতো ডুব দিয়ে চোর-পুলিশ খেলতাম জলের মধ্যে। সে দিনগুলোই ছিল স্বতন্ত্র ধরনের। আমাদের জীবন থেকে সে দিনগুলি কোথায় গেল?

পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাবার তোড়জোড় চলত মাস দুয়েক আগে থেকেই। প্রতিজনের নতুন জামাকাপড় জুতো কিনে বাড়ি যাবার কথা মনে পড়লে আজও রোমাঞ্চ লাগে শরীরে। রাস্তায় ট্রেন-স্টিমারের পথকষ্ট এবং ক্লান্তি নিমেষেই কেটে যেত ঠাকুমা, মা, জেঠিমা, পিসিমা এবং ছোটো ভাইবোনদের মধ্যে গিয়ে হাজির হলে। মাকে ছেড়ে বিদেশে থাকতে পারতাম না বেশিদিন, মাও পারতেন না। বাড়ির স্নেহবঞ্চিত হয়ে সেদিনকার কষ্ট সীমা অতিক্রম করত, কিন্তু আজ? মাকে ছেড়ে, আত্মীয়স্বজন থেকে দূরে সরে এসে, দেশত্যাগী উদবাস্তু হয়ে পথে ঘাটে আজ রাত্রি কাটাই। কোথায় গেল কষ্টবোধ, কোথায় গেল সেই সুখের জীবন? সেদিন যা পারিনি আজ তো বেশ মুখ বুজেই সেসব সহ্য করছি। যাদের দু-বেলা খাবার কষ্ট হবার কথা নয়, তাদেরই উপবাসী থাকতে হচ্ছে আজ নিষ্ঠুর নিয়তির পরিহাসে। আজ অনাহারে অর্ধাহারে টুকরো কাপড়ের স্তূপ ঘাড়ে ফেলে দুয়ারে দুয়ারে ফিরি করতে হচ্ছে অন্নের আশায়। রাস্তার কলের তপ্ত জলে উদরভরতি করে ভিক্ষাবৃত্তি চালিয়ে যেতে হচ্ছে দিনের পর দিন। এই অসহ্য পরিহাসের শেষ কোথায় জানি না, ভবিষ্যতে আরও কী কষ্টের কবলে পড়ব তার খোঁজও রাখি না। মঙ্গলকাব্যে পড়েছি দেবতার কোপে পড়ে মানুষের নাস্তানাবুদ হওয়ার কাহিনি–আমাদের এই কাহিনিও সেই মনগড়া কাহিনির সমগোত্রীয় নয় কি? মঙ্গলকাব্যের কাহিনিশেষে দুঃখীরা ফিরে পেয়েছে সমস্ত হৃত সম্পত্তি ক্রুদ্ধ দেবতাদের তুষ্টিসাধন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ কি তার সঙ্গে মিলবে না? কষ্ট করে বেঁচে থাকার পরেও কি সুখের মুখ দেখব না কোনোদিন?

দুঃখের মধ্যেও সুখের স্মৃতি এসে পড়ে মাঝে মাঝে। আমারও মনে পড়ছে আমাদের বাড়ির দুর্গা পুজোর কথা। প্রতিমা সাজানো, প্রতিমায় রং দেওয়া, প্রতিমার আঁচলে জরি-চুমকি লাগানোর কাজে নাইবার-খাবার সময় থাকত না আমার! মহাব্যস্ততা এবং হইচই-এর মধ্যে কাটত দিনগুলো। লক্ষ করেছিলাম প্রতিমার রং লাগানোর সময় গ্রামের হিন্দু-মুসলমানেরা আসত আগ্রহভরে হাত ধরাধরি করে। মুসলমান বলে আমার গ্রামবাসীরা দূরে সরে থাকত না কখনো। রং দেওয়ার ব্যাপারে তারাও মাঝে মাঝে পরামর্শ দিত পটুয়াদের! কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল সাধারণ মানুষ ধরতে পারল না, কিন্তু যখন বুঝতে পারল তখন সর্বনাশসাধন হয়ে গেছে। তখন মনের অপমৃত্যু ঘটেছে, বনস্পতিঘন বৃহদারণ্য দাবানল জ্বলছে দাউ দাউ করে।

অনেকের বাড়িতে বেলবরণ হত পুজোর একমাস আগে, কিন্তু আমাদের বাড়িতে হত। ষষ্ঠীর দিন সন্ধেবেলায়। বাজনদাররা এসে হইচই করে ঢাকঢোল সানাই কাঁসির বাজনায় মাতিয়ে তুলত চারদিক, বাজনার সঙ্গে চলত নাচ। হইহুল্লোড়ে কানের পর্দা ফাটবার উপক্রম হত। আমরা সবাই ছুটে এসে বাজনার তালে তালে কোমর দুলিয়ে আরম্ভ করে দিতাম খেয়াল নৃত্য–সেদিনকার নাচ যে প্রলয় নৃত্যের বেশে জীবনে দেখা দেবে তা কে ভেবেছিল? নাচের মুদ্রা ঠিক কি না জানি না, তবে সে উদ্দাম নাচ যে স্বতঃস্ফুর্ত ছিল সে কথা হলপ করেই বলতে পারি। গুরুজনরা পুজোমন্ডপে সমবেত হতেন। কতরকম বাজি যে পোড়ানো হত তার সীমাসংখ্যা ছিল না। এইরকম ধুমধামের মধ্যে মা দুর্গা উঠতেন বেদিতে।

পরদিন সপ্তমী পুজোর প্রত্যূষেই সানাই-এর সুর দিত ঘুম ভাঙিয়ে, চোখ মেলে দেখতাম খুশির প্রস্রবণ। চারদিকে প্রাণের মেলা,-আনন্দের ঢেউ। সেই ভোরবেলাতেই বেরিয়ে পড়তাম শিউলিফুল আহরণে। ফুল কুড়োনোর মধ্যেও ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা–কার সঞ্চয় কত বেশি তার হিসেব নিয়ে কথা কাটাকাটি থেকে সময় সময় যে হুটোপুটির পর্যায়ে পৌঁছোত না তাই বা বলি কী করে! কে পদ্মফুল পেল, কে পেল না, কার ডালায় রকমারি ফুল কত বেশি তা দেখে বাবা-মা পয়সা দিতেন পুরস্কার হিসেবে। সে পয়সা সামান্য হোক তবু তা আমাদের শিশুমনের কাছে ছিল অমূল্য।

মহাস্নানের পর মহাসপ্তমী পুজো হত শুরু। পুরোহিত ঠাকুর চিৎকার করে ডাক দিতেন–‘এসো তোমরা সব্বাই, অঞ্জলি দেবে এসো।’ অঞ্জলি দেওয়ার পর প্রসাদ গ্রহণের পালা। সেদিন দশপ্রহরণধারিণী, সিদ্ধিদাতা গণেশজননী, শত্ৰুবিজয়িনী মা দুর্গার ভক্তিভরেই অঞ্জলি দিয়েছি, প্রণাম করে শত্ৰুদলনের মন্ত্র চেয়ে নিয়েছিলাম ভক্তিভরে, কিন্তু তিনি তো শত্রুবল থেকে রক্ষা করতে পারলেন না আমাদের!

ঠাকুরমার প্রসাদ বিতরণের চিত্রটি জ্বলজ্বল করছে আজও। চারদিকে আমরা ঘিরে ধরতাম তাঁকে,–তিনি নির্বিকারচিত্তে প্রসাদ বিলিয়ে যেতেন। মুসলমান ভাইবোনেরাও সেদিন উদগ্রীব হয়ে থাকত প্রসাদ নেবার জন্যে। সে পুজো ছিল মানবতার পুজো-জাতিধর্মনির্বিশেষে সবাই ভক্তিসহকারে পুজোয় অংশগ্রহণ করত বলেই সেদিন সার্থক হয়ে উঠেছিল শক্তিপুজো। রাত্রে আরতির সময় বাজি ফোঁটানোর ধুম ছিল দেখবার মতো। মা ছিলেন বাজি পোড়ানোর বিপক্ষে, সামান্য শব্দও সহ্য করতে পারতেন না। তাই তাঁকে উদব্যস্ত করার দিকেই ছিল সকলের লক্ষ্য। প্রতিটি বাজির শব্দেই তিনি চমকে উঠতেন। সেদিনকার সেই শব্দ আজ আমাদেরও চমকিত করেছে–সেই বাজির শব্দই আজ প্রাণঘাতী বোমার শব্দে পরিবর্তিত হয়েছে। এখন কোথাও সামান্যতম শব্দ হলেই ভীত হয়ে পড়ি মানব-মারণ অস্ত্রের কথা ভেবে! মায়ের চমক আজ বুঝতে পারছি মনেপ্রাণে।

দশমীর দিন ভোরবেলায় বিদায়বাজনা শুনে মনটা হয়ে উঠত ভারী। বড়ো খারাপ লাগত সমস্ত দিনটা। ফুলতোলা, অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদ খাওয়া, ভাইবোনদের সঙ্গে হুটোপাটি করার দিন শেষ হয়ে গেল ভেবে অস্থির হয়ে উঠত মন। প্রতিমা বিসর্জন দেখে বাড়ি আসতে আর পা উঠত না। প্রণম্যদের প্রণাম সেরে নারকেল নাড়, মোয়া খেয়ে বাড়ি যখন ফিরতাম তখন বেশ রাত। শূন্য মন্ডপের সামনে আসতেই মনটা হু-হুঁ করে উঠত–যেখানে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল কিছুক্ষণ আগেও এখন সেখানে বিরাজ করছে প্রশান্তি। উঃ! সেসব কথা মনে করতেই আজকের শোচনীয় অবস্থার কথা মনে পড়ে যায়। যেখানে প্রাণের সুখে বসবাস করেছি, আনন্দের কোলে বড় হয়েছি, আজ সেখানে মৃত্যুশীতল স্তব্ধতা। জীবনে বিজয়া দেখা দিয়েছে যেন। বছরের পর বছর পুজো আসে, কিন্তু দেশে যাবার কোনো পথ আর নেই।

মনে পড়ে বিজয়ার দিন দুর্গামায়ের কানে কানে আবার আসতে অনুরোধ জানাতাম আগামী বৎসর, কিন্তু আমাদের বিসর্জনের সময় কোনো প্রতিবেশী তো আবার ফেরার অনুরোধ জানায়নি আমাদের! এতদিনের স্নেহভালোবাসার বন্ধন এক নিমেষেই ছিঁড়ে গেল কেন? মানুষ মানুষের সঙ্গ চায় না এমন অশুভ কল্পনা তো আগে কোনোদিন করতে পারিনি আমরা। বাংলা মায়ের তরুণদল আজ দেশে দেশে শতধা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের একত্র হবার দিন এসেছে, কিন্তু কোথায় তারুণ্য? আজ যে আমরা দেশে দেশান্তরে সতীদেহের মতো ছিন্ন হয়ে ছিটিয়ে পড়েছি, এর থেকে কোন পীঠস্থানের জন্ম হবে ভবিষ্যতে? কী লজ্জার ইতিহাসই না গড়ে তুলব আমরা! সংকটের ইতিবৃত্ত সমগ্র জাতিকে আবার মনুষ্যপদবাচ্য করে তুলুক এই শুভকামনাই করি।

আজ আর পুজোয় কোনো আন্তরিক টানই অনুভব করি না। ভোরবেলা ঘুমিয়ে আছি। কাছেই কোনো বাড়িতে রেডিয়ো খুলে দিয়েছে, ঘুমের মধ্যেই কানে বাজছে দেশের পুজোর বাজনা। চন্ডীপাঠ হচ্ছে, সুর করে স্তোত্র পড়ছেন বিরূপাক্ষ। হঠাৎ শুনি মা চিৎকার করে বলছেন—’ওরে ওঠ, আজ যে মহালয়া!’

ফুল তোলার কথা মনে পড়তেই ধড়মড়িয়ে উঠে বুঝতে পারি এ বাজনা রেডিয়োর, এ বাজনা যন্ত্রের! আমার গ্রামের পুজোর পাঠ শেষ হয়ে গেছে–হতাশায় আবার শুয়ে পড়ি। রেডিয়ো তখনও চেঁচাচ্ছে–যা দেবী সর্বভূতেষু…

সত্যি কি দেবী আবার সর্বভূতে বিরাজিতা হবেন? সকলের দুর্মতি ঘুচিয়ে দিয়ে আবার মানুষকে তিনি সুখী সচ্ছল করবেন না? সেদিনেরই প্রতীক্ষা করছি। আজ বেশি করে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মনে পড়ছে, তিনি বলছেন, নিজের ওপর, ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস হারিয়ো না। পুণ্যের জয় হবেই, আর যা পাপ তাকে হাজার চেষ্টাতেও বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তাই হোক, পাপের মৃত্যু হোক, নিষ্পাপ মানুষ আবার প্রাণ ফিরে পাক।

.

নাগেরগাতী

আজ আমরা সচেতনভাবে অনুভব করিব যে, বাংলার পূর্ব-পশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাঁহার বহুপ্রসারিত বাহুপাশে বাঁধিয়াছেন। একই ব্ৰহ্মপুত্র তাঁহার প্রসারিত আলিঙ্গনে গ্রহণ করিয়াছেন এই পূর্ব-পশ্চিম; হৃদপিন্ডের দক্ষিণ-বাম অংশের ন্যায় একই পুরাতন রক্তস্রোত সমস্ত বঙ্গদেশের শিরায় উপশিরায় প্রাণ বিধান করিয়া আসিয়াছে, জননী বাম-দক্ষিণ স্তনের ন্যায় চিরদিন বাঙালির সন্তানকে পালন করিয়াছে।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগেকার কথা। বাংলা ১৩১২ সালের ৩০ শে আশ্বিন। রাখিবন্ধনের পুণ্যমন্ত্র রচনা করে বাংলার কবি বাঙালিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে। কিন্তু রাখিবন্ধনের ফাঁস আজ আলগা হয়ে গেছে, মানুষকে মানবতাবোধ আর সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হচ্ছে না। আজ মানুষের কেন এত অধঃপতন? মহাপুরুষদের বাণীর মূল্য কেন আমাদের হৃদয় জয়ে অক্ষম হচ্ছে? আমরা একপ্রাণ, একমন হয়ে এক বাংলার অধিবাসী হতে কি আর পারব না? ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল–পুণ্য হউক, পুণ্য হইক, পুণ্য হইক, হে ভগবান!’–এ বাণী কি কথা হয়েই থাকবে?

বাংলার মাটি আর বাংলার জল তো আমাদের এক করে রাখতে পারল না! একই ব্রহ্মপুত্র জাহ্নবী আমাদের দৃঢ় আলিঙ্গনে বাঁধলেও আমরা তো মানুষকে সহ্য করতে পারলাম না, কোল দিতে পারলাম না ভাইকে স্বার্থসিদ্ধির কলুষ চক্রান্তে? বাপ-পিতামহের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে আসতে হল কাদের ভয়ে? কাদের হাত থেকে মানসম্ভ্রম বাঁচাবার জন্যে আমরা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে কলোনি আর ক্যাম্পে ঘুরে মরছি মা বোনদের হাত ধরে? কবে জাগবে এই যাযাবরদের ভেতর থেকে সেই মহান জ্যোতি যার আভায় আলোকিত হয়ে উঠবে দিগন্ত, কবে আবার আমরা ফিরে পাব নিজেদের দেশ-বাড়ি ঘর।

আমিও এসেছি গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া হয়ে। যারা পড়ে রয়েছে পেছনে তাদের জন্যে প্রাণ কাঁদে। কত লোক সম্ভ্রম বাঁচাতে পারেনি সামান্য গাড়িভাড়ার পয়সার অভাবে। আজ নির্জনে প্রায়ই মনে হয়, গাড়িভাড়ার পয়সা থাকলে তারাও তো আসত! বিয়োগ-ব্যথায় মন টনটন করে ওঠে সেইসব নিরুপায় মানুষের কথা ভেবে। কিন্তু গাড়িভাড়া সংগ্রহ করে আমরাই বা কী করতে পেরেছি? এ কি বাঁচা? দ্বারে দ্বারে, প্রদেশে প্রদেশে পরিব্রাজকবৃত্তি গ্রহণ করে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে–সংকটের মধ্যে পড়ে চোখের সামনে নিয়ত ভেসে উঠেছে শান্তিঘেরা পল্লিকুটিরের মায়াময় ছবিখানি। গ্রাম আমাদের ছোট্ট হোক, কিন্তু তার স্নেহ-নিবিড় সুশীতল নীড়ের তুলনা নেই। হিন্দু-মুসলমান যেখানে চিরদিন প্রতিবেশী হয়ে বসবাস করেছে তাদের মনকুসুমে কেন কীট প্রবেশ করল অকারণে?

বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে আমরাই একত্রে লড়েছিলাম, আমাদের সংঘবদ্ধ শক্তিই বণিকের রাজদন্ডকে বিপন্ন করে তুলেছে একদিন, অথচ আজ? ভ্রাতৃহত্যার নেশায় আমরা হীনবীর্য। আবার কি রাখিবন্ধন উৎসবে আমরা মেতে উঠতে পারব না কোনোদিন? রাষ্ট্রীয় জীবনে, পারিবারিক জীবনে দ্বন্দ্ব আসেই, তাকে জিইয়ে রেখেছে কোন জাতি কতদিন? আমরাই বা কেন সেই লজ্জাকর দিনের স্মৃতির জের অক্ষয় করে রাখব জীবনব্যাপী? কেন আমরা বলতে পারব না, ‘যা করেছি ভুল করেছি।’ একই জননীর স্তন্যসুধা কেন দুটি পৃথক ধারায় প্রবাহিত হবে বুঝতে পারি না।

আমরা তো কোনোদিন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর অধিবাসী ছিলাম না,মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনান্তের পরিশ্রমের পর সন্ধেবেলায় একত্রে জুটে সুখ-দুঃখের গল্প করেই কালাতিপাত করেছি, তবে কেন আজ পারব না সেই নিরুপদ্রব জীবন ফিরিয়ে আনতে? কেন পারব না আপনজনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে? পারব, সেদিন বেশি দূরে নয়। আজকের অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী। আবার বাংলায় সূর্যের হাসি ফুটবে–বাংলার গ্লানি দূর হবে, বাঙালি আবার যোগ্য স্থান পাবে বিশ্বের দরবারে। রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলা যায়,

বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন—

এক হউক, এক হউক, এক হউক, হে ভগবান।

মনে পড়ছে আমার ছোটো গ্রামটির কথা। ময়মনসিংহ জেলার উত্তর প্রান্তে, নাগেরগাতী আমার জন্মগ্রাম, তার বুকেই কেটেছে আমার শৈশব, আমার যৌবন। সে জননী আজ আমায় বিদায় দিয়েছেন তাঁর কোল থেকে। পূর্ববাংলার সব গ্রামই প্রায় একইরকম। নদী-নালা দিয়ে ঘেরা, গাছপালায় সবুজ, ফুলেফলে সাজানো ছবির মতো। এককালে সাপের উপদ্রব ছিল বলে আমাদের গ্রামের নাম হয়েছিল নাগেরগাতী। সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা বেঁচেছিলাম, প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলাম, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার ফলে কপালে জুটল নির্বাসন!

আমাদের পূর্বপুরুষ দু-শো বছরেরও আগে মোগলদের সময়ে এখানে এসে নাকি বসতি স্থাপন করেন। বারো জাতের গ্রাম এটা। কামার, তাঁতি, ধোপা, নাপিত, কুমোর ইত্যাদি কোনো জাতের অভাব নেই। সবার ওপরে মানুষ সত্য, তার ওপরে আর কিছু নেই– এই ছিল আমাদের আদর্শ। কুলপ্রধান ব্রাহ্মণদের লেখায়-পড়ায় স্থান ছিল অতি উচ্চে। তা হলেও গ্রামের সকলেরই সঙ্গে ছিল তাঁদের প্রাণের যোগ। গ্রামের ভেতর ছোটো বাজার–একটু দূরেই প্রধান হাট, ধান-চালের আড়ত। এখানকার সম্পদ ধান, চাল, পাট ও সর্ষে। দেশে এত শস্যসম্পদ থাকতেও আজ লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনাহারে থাকতে হচ্ছে ভেবে দুঃখই হয়।

আসামের গারোপাহাড়ের পাদদেশে আমার গ্রামখানি যেন সৌন্দর্যের মূর্তিমতী প্রতীক–আজ জনাকীর্ণ শহরে বসে সেই ছবির কথা ভেবে চোখে জল আসছে আমার। সামনে দিয়ে পাহাড়িয়া নদী কুলুকুলু শব্দে বয়ে যাচ্ছে অবিশ্রান্ত অনাবিল গতিতে। এই নদীটিই এ দেশের প্রাণ, এ দেশের সম্পদ। গারোপাহাড় থেকে হিন্দুস্থান হয়ে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে বিজয়িনীর মতো চলেছে সে। স্থানে স্থানে কূল ভেঙে শতধা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে জলদান করতে করতে। অগভীর এই নদীর পূর্ণযৌবন আসে বর্ষাকালে। তখন তার ভয়ংকর রুদ্ররোষ চারদিকে প্লাবিত করে দেশকে করে তোলে উর্বরা,–মাঠে মাঠে চলে ফসল ফলাবার ভূমিকা। শস্যপূর্ণা বসুন্ধরার মূর্তির মোহিনীরূপ আমরা দেখি হেমন্তে। ছোটো-বড়ো নৌকা দেশ-দেশান্তর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসে, নিয়ে যায়–এইভাবেই দেশের সঙ্গে বিদেশের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ব্যাবসাবাণিজ্যের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে সম্পর্ক আজ শিথিল। দেশের জিনিস সব দেশেই পড়ে আছে। পাকিস্তানের ধান-পাট হিন্দুস্থানের কোনো বাজারে নেই, হিন্দুস্থানের সর্ষের তেল, কয়লা, চিনি পাকিস্তানকে চলছে এড়িয়ে! এই লুকোচুরি খেলার শেষ কোথায়? কবে আমরা ফিরে পাব অবাধ বাণিজ্যের সুখকর আবহাওয়া? সেই শুভদিন আসুক এই উপমহাদেশে!

বর্ষাশেষে অগ্রহায়ণ মাস থেকেই চলে ধানকাটার আয়োজন। কামারের বাড়ি থেকে কাস্তে শান দিয়ে সবাই চলে যায় ধান কাটতে–বিস্তীর্ণ মাঠের সোনা এনে ঘরে তোলা হয় তখন। গরিব অনাথিনীরা ধানের শিষ কুড়োতে যায়। বিদেশিরা আসে কত তৈজসপত্র নিয়ে আমাদের দেশে যা পাওয়া যায় না তার বিনিময়ে নিয়ে যায় ধান সওদা করে। ধান দিয়ে মেয়েরা কেনে কাঁচের চুড়ি, গিল্টি সোনার হার, চুল বাঁধার রঙিন ফিতে! বছরের সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভারই কেনাকাটা হয় ওই সময়।

আরম্ভ হয় চারদিকে ধান-চিড়ে কোটার আনন্দ-প্রস্রবণ। ভোর হতে-না-হতেই মেয়েরা শয্যাত্যাগ করে চেঁকিতে চিড়ে কুটছে; শব্দ হচ্ছে তালে তালে, নতুন ধানের ভুরভুর গন্ধ গ্রামকে তুলেছে মাতিয়ে। কতদিন ভেঁকির শব্দে ঘুম গেছে ভেঙে, আজও মাঝে মাঝে আচমকা জেগে উঠি আধাস্বপ্নের অস্পষ্ট শব্দ শুনে! সেসব আনন্দোচ্ছল দিন আবার জীবনে ফিরে আসবে এমন সম্ভাবনা কি নেই? আজও ভোরেই উঠতে হয়, কিন্তু সে ওঠা আর এ ওঠার মধ্যে পার্থক্য অনেক। আজ উঠতে হয় চাকরি অন্বেষণের জন্যে–দোরে দোরে উমেদারির জন্যে অমানুষিক শ্রমকে অভিশপ্ত জীবনে গ্রহণ করতে। যে সময়টা দেশে ব্যয় করতাম ফুল সঞ্চয়ের পেছনে সে সময়টা আজ যাচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে! তবুও আমরা বেঁচে আছি, আমরা তবু বেঁচে থাকব। আমরা আবার খুঁজে আনব সেই ফেলে-আসা দিনগুলোকে। প্রতিবেশীর মুখে হাসি না দেখে মরব কোন আনন্দ নিয়ে?

আমাদের গ্রামবাসীদের চেহারায় কোনোদিন মালিন্য দেখিনি। সুন্দর অটুট স্বাস্থ্য নিয়ে চাষিরা প্রত্যূষে চলে যেত মাঠে। আর মেয়েরা প্রস্তুত করত খাবার–গৃহস্থালি কাজের মধ্যে ঝরে পড়ত তাদের গৃহিণীপনার লালিত্য। জীবনে কি আবার ফিরে আসবে না সেসব দিন আবার কি সেসব মানুষ গান গাইতে গাইতে কাঁধে লাঙল নিয়ে যাবে না মাঠে? গৃহিণীরা তৈরি করবে না পিঠে-পুলি, করবে না গৃহস্থালির খুঁটিনাটি কাজ? জানি না আজ কেন এত করে মনে পড়ছে ছেড়ে-আসা গ্রামকে, নগরজীবনে গ্রামের কথা এত মাথা তুলে কেন দাঁড়াচ্ছে বারবার মনের আয়নায়?

যেসব রীতিনীতিকে কেন্দ্র করে সমাজজীবন গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে গেছে। সবার সঙ্গেই ছিল আমাদের আত্মীয়তা। কেউ কাউকে নাম ধরে ডাকত না-দাদা, মামা, চাচা যোগ না করলে সামাজিক জীবনে হত ক্ষমাহীন অপরাধ। আজ কোথায় সেসব সম্পর্ক তলিয়ে গেল ঘূর্ণির মধ্যে, কে কোথায় বিক্ষিপ্ত হয়ে স্নেহের শ্রদ্ধার সম্বন্ধ হারিয়ে তাচ্ছিল্যের মালা গলায় পরে জীবন বাঁচাচ্ছে কে জানে। শিশুরা মরছে দুধের অভাবে, মায়ের বুক থেকে আজ আর সুধাঁধারা ক্ষরিত হচ্ছে না–দেশজননী এবং মা জননী রক্ষা করতে পারছেন না তাঁদের সন্তানদের। এর চেয়ে দুর্দিন আর কী হতে পারে? কোন দেশের ইতিহাসে রয়েছে এমনি অমানুষিক বর্বরতার দৃষ্টান্ত? কবে মহামিলনের মন্ত্র কার্যকরী হবে তা না জানলেও এমন দুর্দিন মানুষের জীবনে বেশিদিন স্থায়ী হবে না তা জানি।

শারদীয় পুজোয় গ্রামের আনন্দ হত বল্গাহীন, ইতর-ভদ্র সবাই মেতে উঠত আনন্দময়ীর আগমনে। কী অপূর্ব মহামিলনের উৎসব! মনের সকল সংকীর্ণতা মুক্ত হয়ে সবাই যেন উদার মহান হয়ে উঠত। দেখেছি সে স্নেহ-প্রীতি-শ্রদ্ধার আসল চেহারা, দেখেছি সেদিনকার লোকখাওয়ানোর অনাবিল আনন্দ। পুজো, আরতির ধুম, ছেলে-মেয়েদের নাচ, ঢাক-ঢোল বাঁশির বাজনায় ফেটে পড়ত সন্তান গৌরবিনি আমার গ্রাম-জননী। পুজোর চারদিন উৎসব ছেড়ে কেউ কোথাও নড়ত না, ভাব-বিভোরতায় মাতোয়ারা হয়ে থাকত সবাই। বিজয়ার দৃশ্য আজও ভাসছে চোখে। আমাদের নদীর ঘাটেই নানা গ্রামের নানা প্রতিমার নৌকা গান-বাজনা করতে করতে এক জায়গায় এসে জড়ো হত। মাঝে মাঝে ধ্বনি উঠত : বন্দেমাতরম! ভারতমাতার সেইদিনকার বন্দনার প্রতিদানেই কি আমাদের আজকের এই সর্বহারা রূপ? এ কি মায়ের আশীর্বাদ, না জ্বলন্ত অভিশাপ? এ যে অভাবনীয়। সন্তান অন্যায় করলেও মা কী পারেন এমনি কঠোর হতে? হয়তো শক্তিপুজোয় ফাঁকি ছিল আমাদের, যতখানি ভক্তি অর্ঘ্যের প্রয়োজন ছিল তা আমরা দিইনি, তাই জাতীয় যুপকাষ্ঠে বলি হয়ে গেল দেশ।

ত্যাগের মধ্য দিয়েই ভোগের আস্বাদ নিবিড় করে পাওয়া যায়। আমরা আধ্যাত্মিক ভারতের অমৃতের পুত্র। তাই সুখ ত্যাগ করে আজ আমরা তামস তপস্যায় রত। এ তপস্যায় রত হয়েছে হিন্দু, এ তপস্যায় রত হয়েছে মুসলমান। শবসাধনায় শোধিত হয়ে দেশমাতৃকা জ্যোতির্ময়ীরূপে আবির্ভূত হন এ প্রার্থনা কার নয়? ভুক্তভোগী মানুষ মানুষের সপক্ষে; তারা শান্তি চায়, শুধু শান্তি চায়, আবার সুখী-সচ্ছল হয়ে বাঁচার মতো বাঁচতে চায়। সব মানুষের এক প্রার্থনা হলে মা বেশিদিন কিছুতেই থাকতে পারবেন না সন্তানদের পৃথক করে রেখে।

মনে পড়ছে বেশি করে চৈত্র সংক্রান্তির কথা। এই দিনটির কথা কোনোদিন ভোলা সম্ভব নয় নাগেরগাতীর ছেলে-বুড়োদের। ধনী-দরিদ্র, চাষি-জমিদার সবাই তাদের গৃহপালিত গোরু-ঘোড়াকে নদীর জলে স্নান করিয়ে এনে নানা রঙে বিচিত্রিত করে দিত তাদের সর্বশরীর। ধূপ-ধোঁয়া দিয়ে কামনা করা হত তাদের মঙ্গল। চাষিরা দিনে অনাহারে থেকে নতুন কাপড় পরে নতুন আনন্দে বর্ষশেষের এই দিনটিকে জানাত প্রাণের ভক্তি-শ্রদ্ধা। তাদের একমাত্র সম্বল বাঁচবার আশা-ভরসা, তাদের বলদ-গাভীর দীর্ঘজীবন কামনায় ছোটো ছোটো চাষি-বালক-বালিকারাও আনন্দে দিশাহারা হয়ে পথে পথে বেড়াত নৃত্য করে। কিছুদিন আগেও খবর পেয়েছি আর সেদিন নেই,–নিঃশব্দে বছর চলে যায়। লোকজনের অভাবে এখন আর কোনো আড়ম্বরেরই সাড়া নেই অত বড়ো গ্রামে।

চৈত্র সংক্রান্তির বিকেলবেলায় আমাদের গ্রামে হত ষাঁড়ের লড়াই। কী উৎসাহ কী উদ্দীপনা নিয়েই না এই লড়াই দেখেছি একদিন। দূর দূর গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলমান চাষিরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে তাদের ষাঁড়কে নানা রঙে সাজিয়ে, ফুলের মালা দিয়ে, শিং-এ রঙিন রুমাল বেঁধে জারিগান গাইতে গাইতে এসে জড়ো হত নির্দিষ্ট মাঠে। তারপর চলত সেই বহুপ্রতীক্ষিত লড়াই। যে দলের ষাঁড় জয়লাভ করত তারা যুদ্ধজয়ের পুরস্কার হিসেবে পেত জমিদারবাবুদের দেওয়া কত জিনিস। এইদিনের লোক সমাগম হত দেখার মতো–মোড়ল মাতব্বরেরা শান্তিরক্ষা করতে হিমসিম খেয়ে যেত সেদিন। লাঠির জোরে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হত। সেদিনকার সে দৃশ্য মনে পড়লে আজও গুমরে ওঠে মন। আমরা অনেক আগে থেকেই গাছে আশ্রয় নিয়ে নিরাপদ দূরত্ব থেকে লড়াই-এর রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। এক বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষায়, উত্তেজনা-ঔৎসুক্যে ভরপুর হয়ে উঠত মন।

সেদিন গাছের দৃশ্যও যেত পালটে,–গাছে গাছে মানুষ ঝুলছে বাদুড়ের মতো! মাঝে মাঝে দুর্ঘটনাও যে ঘটত না তা নয়,–ভালো করে দেখবার জন্যে এক এক সময় হুটোপুটিও লেগে যেত জায়গা দখল নিয়ে! ডাল ভেঙে সেবার যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছিল তার কথা ভোলা যায় না। অবশ্য রক্তাক্ত প্রতিবেশীর অসাড় দেহ দেখে সেদিন যতটা উতলা হয়েছি, আজ আর তেমন হয় না। মানুষের মৃত্যুতে স্বাভাবিক বেদনাবোধের সে অনুভূতি গেল কোথায়? বিকৃত দেহ সম্বন্ধে সেদিন ধারণা স্পষ্ট ছিল না, আজ স্বচ্ছ হয়েছে। চোখের সামনে কত প্রিয়জনের মৃত্যু যে দেখেছি তা বর্ণনা করে লাভ নেই। ষাঁড়ের লড়াইকে আজ প্রতীক বলেই মনে হচ্ছে আমার, নিরাপদ দূরত্বে বসে নিশ্চয়ই কোনো দর্শক উপভোগ করছে এ দৃশ্য! তারও কি পতন ও মৃত্যু হবে না সমস্ত লাঞ্ছিত অপমানিত মানুষের অভিশাপে?

আজ আমরা যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছি তাতে পূর্ববঙ্গ গীতিকার আয়না বিবির খেদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়,

যেই রে বিরক্কের তলে যাই আরে ছায়া পাওনের আশেরে।
পত্র ছেদ্যা রৌদ্র লাগে দেখ কপালের দোষে রে।।
দইরাতে ডুবিতে গেলে দেখ দইরা শুকায় রে।
গায়ের না বাতাস লাগলে আর ভালা আগুনি ঝিমায় রে।।

কতকাল আগেকার কোন সে অজ্ঞাত প্রাচীন কবি বাঙালি নর-নারীর চিরন্তন প্রেমকাহিনি রচনা করতে বসে দিব্যদৃষ্টিতে পূর্ববাংলার একালের অধিবাসীদের চরম অসহায়তা উপলব্ধি করেই হয়তো এমনি ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ছেড়ে-আসা গ্রামের ভবিষ্যৎ বাঙালির মর্মবেদনা। স্বাধীন দেশের বৃক্ষতলায় শান্তির নীড় বাঁধব, শঙ্কাহীন মনে নবজীবনের বন্দনা গান গাইব, সে সুযোগ আমাদের কবে হবে?

.

সাখুয়া

মেঘে মেঘে আকাশ গেছে ছেয়ে, চারদিকে নিবিড় সন্ধ্যার অকালবোধন। ঘন অন্ধকার যেন গলা চেপে ধরেছে! এ মেঘ রাজনৈতিক মেঘ, এর বৃষ্টি আনে অশ্রুজলের বন্যা! একদিন যা ছিল আমার জন্মভূমি আজ নাম হয়েছে তার ‘ছেড়ে-আসা গ্রাম’। আকাশে কালো মেঘের সারি, পুব থেকে পাড়ি জমিয়েছে পশ্চিমের দিকে। হু-হুঁ করে ছুটে চলেছে দিকবিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে দেশ-দেশান্তরে, দূর-দূরান্তরে অসহায় নিঃসহায়ের মতো। এত মেঘ পুবদিকে ছিল কোথায়? কোথা থেকে জন্ম নিল সর্বনাশা এই কালো মেঘ? মেঘের ডমরুর গুরু গুরু শব্দে আমরা ভীত হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারিনি যে, তার বর্ষণ এত নির্মম হতে পারে, শোনা ছিল ‘যত গর্জে তত বর্ষে না। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে সে মেঘ যত গর্জিয়েছে তার চেয়েও বর্ষিয়েছে বেশি! আজ লজ্জায় মরে যাই সেদিনের সেই আত্মগ্লানির কথা ভেবে! কোথায় গেল আমার সেই জন্মভূমি, সোনার প্রতিমা ‘সাখুয়া গ্রাম? আমার সাখুয়া মা আমাকে চিরদিনের মতো ত্যাগ করেছে। আমার গাঁয়ের মাটি আমাকে ধরে রাখতে পারল না–অথচ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আমাকে বারবার বলেছে ‘যেতে নাহি দিব। উঠোনের মাধবীতলার ফুলগুলো, বাগানের মল্লিকা, জুই, বেলফুল আমাকে গন্ধে মতোয়ারা করে দিয়েছিল চলে আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্তও। যেদিকে তাকিয়েছি সেই দিকেই অনুভব করেছিলাম স্নেহের পরশ; তবু আসতে হল, ভিক্ষাপাত্র সম্বল করে মহানগরীর অবাঞ্ছিত নাগরিক সাজতে হল শত অনিচ্ছাতেও। কেন এমন হল, কেন আমার ওপর কূপিত হলেন আমার পল্লিমা?। কারণ পাই না,কারণ খুঁজতে ইচ্ছেও করে না। শুধু ইচ্ছে করে মায়ের রূপ ধ্যান করতে, চোখের সামনে আমার জীবন্ত গ্রামটিকে ধরে রাখতে। আশা আছে মায়ের কোলে আবার স্থান পাব–উত্তেজনার ঘোরে মায়ের করুণা হারিয়েছি ক্ষণিকের তরে, এটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। হয়তো তিনি বলেছিলেন–’চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে’ অসতর্ক ক্ষণে, কিন্তু মায়ের এই কথা শুনে ভুল করলে চলে না,-এমন অলক্ষুণে কথা কোনোদিন মা বলতে পারেন না মনেপ্রাণে। কথাতেই তো আছে, কুপুত্র যদিও হয় কুমাতা কখনো নয়। আমার সাখুয়া মা আবার আমাকে কোলে স্থান দেবেন, আমি আবার গাইতে পারব—’এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’

পেছন থেকে মগরা নদী যেন আমার গ্রামটিকে সহসা ধরেছে সোহাগ করে চেপে। দুরন্ত ছোট্ট নদী যেন সাখুয়ার আঁচলের তলায় নির্ভয়ে থাকতে চায় দুরন্ত মেয়েটির মতো। তরতর করে তাই তার অমন নেমে চলা গতি! মগরা নদী আমাদের জীবনে এনেছিল স্নিগ্ধতা, গ্রামটিকে করেছিল উন্নত নানা দিক থেকে। মগরার স্রোতে আমাদের জীবনস্রোত একাত্ম হয়ে মিশে পেয়েছিল পরিপূর্ণতার স্বাদ।

আজ কত স্মৃতি এসে ভিড় করছে মনের কোণে–নির্জনতা পেলেই তারা আমাকে উতলা করে বারবার। ভুলতে পারি না, তার কথা না ভেবে শান্তি পাই না। যাকে প্রাণভরে ভালোবাসি তার স্মৃতিই লাগে মিষ্টি। ক্ষীণ স্মৃতি যে পুরোনো কত তথ্যকে উদঘাটিত করে তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। মনে পড়ছে, শান্তিতে ঘেরা সাখুয়ার ভিন্ন ভিন্ন পাড়ার কথা। হিন্দু আর মুসলমান পাড়া। সামনেই বিরাট ফসলের জমি। মাঠের পশ্চিম সীমানায় হিন্দু মুসলমানের পাশাপাশি বসতি-সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাগত সেখানে প্রাণকণিকা, জ্বলজ্বল করত শিশিরভেজা ধানের শিষগুলো! ভোরবেলা দূর্বাদলের মাথায় টলমল করত মুক্তোর মতো স্বচ্ছ শিশিরকণা। মানসচক্ষে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি সেদিনের উধাও হওয়া মনের চেহারাখানি। ভোরে উঠেই বেরিয়ে পড়তাম ভিজে ঘাসের স্নিগ্ধ পরশ নেবার লোভে। চারদিক নিঝুম, আমি বেপরোয়াভাবে শুধু যেতাম এগিয়ে দূরের গ্রামের দিকে চলার নেশায়। সূর্য উঠেছে আর আমি উঠিনি এমন কোনোদিন হয়নি। একদিন মনে পড়ে, মহাবিপদের মধ্যে পড়েছিলাম আলে আলে চলতে গিয়ে। আমি তখন ছোটো, অভ্যাসমতো ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছি ঠাকুরদার সঙ্গে। ঠাকুরদা বুড়োমানুষ, পারবেন কেন আমার চাপল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে! ছুটে ছুটে এগিয়ে গেছি অনেক দূর-হঠাৎ একটা দৃশ্যে আমি হয়ে গেলাম হতভম্ভ। আলের ওপর আড়াআড়ি হয়ে শুয়ে আছে মস্ত এক সাপ। ভয়ে আমি গতিহীন,–নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমরা পূর্ববঙ্গের লোক, সাপ আমাদের ভয় দেখাতে পারে না। আমি ছোটো বলেই হয়তো ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। ঠাকুরদা আমার নির্দেশিত সাপটি দেখে একগাল হেসে শুধু বলেছিলেন–’বোকা কোথাকার, এখনও সাপ চিনিস না? ওটা সাপ নয় রে, সাপের খোলস, বুঝলি,–আসল সাপ বিশ্রাম করছে গর্তের ভেতর!’

সেদিনের ছোটো ছেলেটি আসল-নকলের পার্থক্য ধরতে পারেনি সাপের, আজকেও আমি কি ধরতে পেরেছি মানুষের আসল-নকল রূপ? বারবার প্রশ্ন করেছি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছি কিন্তু পদে পদে ব্যর্থ হয়েছি সমাধান খুঁজতে গিয়ে। তাই আজ সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ছে ঠাকুরদার কথা,–তিনি থাকলে ভাবতে হত না এত খুঁটিয়ে! মানুষ চেনা দেখছি সব চেয়ে কঠিন ব্যাপার! যে মানুষকে বিশ্বাস করেছি, যে মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা করেছি, সুখে সুখী, দুঃখে দুঃখী হয়েছি, আজ কোথায় তারা? ছোটোবেলায় রূপকথা শুনে কতদিন আঁধার রাতে মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখতে চেয়েছি তেপান্তরের মাঠে রূপকথার রাজপুত্তুরকে পক্ষীরাজ ঘোড়ার সোয়ারি বেশে, তারায় ভরা আকাশের নীচে ঝিল্লিমুখর প্রান্তরের বুকে কৈশোরের স্বপ্ন ভেঙে খানখান হয়ে গেছে বারবার, আজকের স্বপ্নেরই মতো।

আঁকাবাঁকা খেতের আলে ছোটো ছোটো পা ফেলে পাঠশালায় যাবার কথা মনে পড়ছে। শিক্ষক ছিলেন দুজন, দুজনই মুসলমান। আজও তাঁরা আছেন কি না জানি না। তাঁদের একজনের কথা আজ বিশেষ করে মনে পড়ে। আমার বি. এ. পাশের সংবাদ পেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন আমার শৈশবের সেই মাস সায়েব–আন্তরিকতায় পূর্ণ সে চিঠি। আমার কাছে তা অমূল্য সম্পদ, তাই সযত্নে রেখে দিয়েছি বাক্সে। বহুমূল্যবান জিনিস ছেড়ে এলেও সে চিঠি হাতছাড়া করিনি। ন্যূজ দেহ, ক্ষীণ দৃষ্টি, বার্ধক্যের ভারে ক্লান্ত, শুভ্র লম্বা দাড়ি নেড়ে তিনি আমাদের পড়াতেন। কত অমূল্য উপদেশ দিতেন গল্পচ্ছলে,-একদিনের পরিচয়েই জানতে পেরেছিলাম তিনি মানবধর্মের পূজারি। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে তিনি বারবার বারণ করেছিলেন আমাকে। বলেছিলেন–”সমস্ত মানুষের শুভবুদ্ধি একদিন জাগবেই। শিহরন লেগেছিল শেষকথাটির ওপর জোর দেওয়াতে। মাস সায়েবে’র কথায় বিশ্বাস আমি হারাইনি, তাঁর কথাই সত্যি হোক এ প্রার্থনা করি। আশায় বুক বেঁধে রয়েছি সেই সুদিনের নবপ্রভাতের জন্যে। জানি না সে সূর্যোদয়ের বিলম্ব কত!

ছোটোবেলাকার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল রউফ। একসঙ্গে পড়তাম, স্কুলে যেতাম, খেলাধুলো, স্নান, সাঁতার ছিল সবই একসঙ্গে। আমাদের দুটিকে একত্রে সর্বদা সব জায়গায় দেখা যেত বলে অনেকে উপহাস করে বলতেন ‘মানিকজোড়’–আর যাঁরা আরও তীব্র রসিকতাপ্রিয় ছিলেন তাঁরা বলতেন রাম-রহিম’। আমরা কান দিতাম না সে-কথায়, বন্ধুত্বে চিড় খাওয়াতে রাজি ছিলাম না। আমাদের বাড়িও ছিল পাশাপাশি, বাড়ির মাঝখানে শুধু একটা ধানখেতের ব্যবধান। তখন তাই মনে হত যেন কত দীর্ঘ। কিন্তু আজকের এই দীর্ঘ ব্যবধান তো কারও মনে তেমন করে দোলা দিতে পারছে না। আমি রউফের কথা ভাবছি। রউফও কি ভাবছে আমার কথা পাকিস্তান থেকে আমারই সুরে সুর মিলিয়ে?

একদিনের এক হাস্যকর ব্যাপার মনে পড়ে! রউফ একদিন আবিষ্কার করে ফেলল হঠাৎ যে, আমাদের সঙ্গে ওদের বাড়ির একটা প্রভেদ আছে মুরগি পোষা নিয়ে। এইজন্যেই হয়তো আমাদের দু-বাড়ির ব্যবধানও একটু বেশি! বাড়ি গিয়েই সে সেই রাত্রেই সব কটি মুরগি চুপি চুপি চালান করে দিয়ে এল আর এক বাড়িতে। সে মুরগি অবশ্য ফিরে এসেছিল রউফদের বাড়িতেই আর তার কীর্তির কথাও রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে সমস্ত প্রভেদ ঘুচিয়ে নিকটতম হওয়ার এই যে ছেলেমানুষি বুদ্ধি এবং আন্তরিকতা তার তুলনা কোথায়? এই যে কাছের মানুষ করে নেবার প্রচেষ্টা, আজ সেই সরল মনের নির্বাসন হল কেন এতদিন একত্রে থাকার পরেও? মনের গড়ন কেন মানুষের বদলাল রাতারাতি! আজকেও সেইদিনকার মতোই ভাবি সময় সময়, রউফ আর আমার মধ্যে ব্যবধান কোথায়? আমরা দুজনে অভিন্নহৃদয় বন্ধু, আমরা মানুষ। তখন কি ভুলেও ভাবতে পেরেছি যে, রউফের সঙ্গে চিরকালের মতো হবে ছাড়াছাড়ি? যে সাখুয়াকে চোখের আড়াল করা দুঃসাধ্য ছিল তাকেও এমনি ছাড়তে হবে, ভেবেছি কি কোনোদিন? কোথায় গেল আমার প্রাণের বন্ধু, কেথায় গেল আমার গ্রাম! আকুল হয়ে ভাবি আর মাথা ঠুকি ভাঙা শান-বাঁধানো মেঝেতে না, এখানে মাটির স্পর্শ নেই। চোখ-ধাঁধানো নির্মম কলকাতা পল্লিমায়ের মধুমিষ্টি শান্তির প্রলেপ দিতে পারে না। যান্ত্রিক শহর, অত্যাশ্চর্য তার আকর্ষণী শক্তি মানুষকে অমানুষ করার দিকে। মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু দেখছি এখানে প্রত্যহ! তবু একে কত আদর, কত সোহাগ! এই প্রাসাদপুরীর ঐশ্বর্যের হিংস্র ঔদ্ধত্যের কাছে মানবতার দোহাই হাস্যকর!

সাখুয়ার মাঠ হিন্দু-মুসলমানের বারোয়ারি সম্পত্তি। খেত চষা, বীজ বোনা থেকে আরম্ভ করে ফসলকাটার দিন পর্যন্ত বিশাল সেই মাঠের বুকে সম্মিলিত শ্রম চলত পাশাপাশি পরস্পরের সুখ-স্বপ্নের অংশীদার হয়ে। সবচেয়ে ভালো লাগত জারি গানের সুরে সুরে। খেতের বুকে অলৌকিক আনন্দের ঢেউ জাগাতে। গলা ছেড়ে তামাক খেতে খেতে গান ধরত তারা সমবেত গলায়,

ওরে অমর কেউ থাকবি না তো, মরতে হবে সবারে,
তবে সংসারে তোর এত ভেদ-জ্ঞান কীসেরি তরে।

এ গান যারা গাইতে পারে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্নেহ-প্রীতি, ভালোবাসা কত অকৃত্রিম ছিল সহজেই বোঝা যায়। এই পরিবেশে কোথা থেকে এল সর্বনাশা এই ভেদজ্ঞান?

সাখুয়ার ‘বড়োঘাট’ও সর্বজনীন। এখানেও গাঁয়ের সকলেরই সমান অধিকার। মনের খুশিতে সবাই স্নান করছে, সাঁতার কাটছে, জল নিচ্ছে বিনা দ্বিধায়। গরমের দিনে ঘাটের কোলে জেলাবোর্ডের রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের ওপর বসত মজলিশ-নিশুতি রাত্রি অবধি চলত আলোচনা। তর্ক হত, কিন্তু সহিষ্ণুতার কোনো অভাববোধ ঘটেনি কোনোদিন। আলোচনায় যোগদান করত তরুণ সমাজ। সেখানে চলত দুঃখের কথা, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা, গ্রাম্য রাজনীতি থেকে শিক্ষাদীক্ষা এমনকী আজকের সংস্কৃতির গতি-প্রগতির কথাও বাদ যেত না। আলোচ্য বিষয় আলোচনার আবহাওয়ার ওপর ওঠানামা করত। বয়স্কদের সব বৈঠক হত মথুর মাস্টারের বৈঠকখানায়। ক্রমাগত তামাক পুড়ত সেখানে, তিনটে হুঁকো হিমসিম খেয়ে যেত বক্তাদের শোষণের ঠেলায়! কল্কে পুড়ে লাল হয়ে উঠত, ফাটবার উপক্রম! মথুর ঠাকুর ছিলেন ভিনগাঁয়ের স্কুল মাস্টার, জ্ঞান ছিল গভীর, মানুষ হিসেবে ছিলেন একেবারে ভোলানাথ। লোকের দুঃখে তিনি বিচলিত হতেন বলেই সকলেই ছুটে আসত পরামর্শ নিত। পরামর্শ বা সাহায্য দিতে কোনোদিন দ্বিধা করতে দেখিনি তাঁকে। গোলমালে পড়লে পাড়ার মাতব্বরেরাও লজ্জা করতেন না তাঁর কাছে আসতে। শুনেছি আজও তিনি দেশ ত্যাগ করেননি,–আঁকড়ে পড়ে আছেন দেশের বাড়িতে। তিনিও আশা করেন একদিন না একদিন জাতীয় কলঙ্কের অবসান হবেই, আবার উন্মত্ত মানুষ দুর্যোগের রাত্রি কাটিয়ে প্রকৃতিস্থ হবে নতুন জীবন-প্রভাতে। ঘুচে যাবে আজকের সংকট, মুছে যাবে লজ্জার ইতিহাস।

প্রতিরবিবার হাট বসত মগরা নদীর তীরে। একদিকে জেলাবোর্ডের বড়ো রাস্তা, অন্যদিকে মগরা নদী। একদিকে গোরুর গাড়ির ভিড়, অন্যদিকে সারি সারি পালতোলা নৌকা। কোলাহলমুখর হাট এনে দিত সপ্তাহান্তে কল্লোলিত প্রাণের আনন্দোচ্ছাসের ঢেউ। প্রতীক্ষা করে থাকতাম রবিবারের জন্যে-লক্ষ করেছি সেদিনকার মানুষে মানুষে সম্প্রীতির সম্বন্ধ। ইসমাইল চাচার চালের গোলার পাশেই ছিল রজনীমামার কাপড়ের দোকান। আমরা হাটে গেলে উত্যক্ত করে ব্যস্ত করে তুলতাম ইসমাইল চাচাকে! খরিদ্দারের সঙ্গে কথা বললে আমরা জোর করে তাঁর মুখ ঘুরিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য করতাম। আমাদের শয়তানি থেকে মুক্তি পাবার জন্যেই হয়তো চাচা বড়ো বড়ো মাছ-লজেঞ্চুস রাখতেন লুকিয়ে,–একটা একটা পেলে তবেই নিষ্কৃতি দিতাম তাঁকে! সেদিনকার এই দুষ্টুমির কথা ভেবে একটু একটু লজ্জা হলেও আনন্দটাই হয় বেশি। আজ রজনীমামা কলকাতার পথে পথে ফিরি করে বেড়ান, অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাঁর।

পুজো-পার্বণ, ইদ-মহরমেই পেতাম মানুষের মনের আসল পরিচয়। বিজয়া দশমী এবং ইদ আমাদের গ্রামে ছিল মিলনের প্রতীক। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রীতি-বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে করতে হত মিষ্টিমুখ। সেই আনন্দমুখর দিন কি আর ফিরে পাব না আমরা। সেদিনকার মানুষরা আজ কোথায়?

আজ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে মহুয়ার গান, গুনাইবিবির পালা, বাউল গান, জারি গান, কবির লড়াই, মনসার ভাসন, গাজির গানের আসরের জনবহুল দৃশ্যের টুকরো টুকরো ছবি। জাতিধর্মনির্বিশেষে নির্বাক শ্রোতার দল গ্রহণ করেছে এসব সংগীতরস। ব্রাহ্মণের ছেলে নদের চাঁদ, আর মুসলমানের মেয়ে মহুয়া; মুসলমান গায়ক ও সাধক গাজি আর হিন্দুর মেয়ে চম্পাবতী–অবাক হয়ে দেখেছি নদের চাঁদ আর মহুয়ার দুঃখে, গাজি আর চম্পার ব্যথায় সমভাবে অশ্রু বিসর্জন করছে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নর-নারীই। সকলেই নাটকবর্ণিত দুঃখকে কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের দুঃখ বলে গ্রহণ করেনি, করেছে সমস্ত মানুষের দুঃখ হিসেবেই। তাই তো সহজেই তারা হতে পারত সবাকার সুখ-দুঃখের অংশীদার।

পৌষ সংক্রান্তিতে আমাদের হাটে বসত মেলা। ঘরে ঘরে তখন চলত নবান্নের উৎসব, সকলের মুখে হাসির ছোঁয়াচ। গ্রামের ওস্তাদ মেঘু শেখ ছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগির, তাঁর সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন আমার জ্যাঠামশায়। জ্যাঠার অকালমৃত্যুতে দেখেছি অমন জোয়ান মেঘু শেখও হয়েছিলেন পাগলের মতো। পুত্রশোক পেয়েছিলেন যেন জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুতে। সেইদিন থেকে আর কেউ তাঁকে কুস্তি লড়তে দেখেনি। সব কিছু ছেড়ে দিয়ে নিঃসন্তান ওস্তাদ আজও বেঁচে আছেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে অবিশ্রান্তভাবে তিনি শুধু জ্যাঠামশায়ের গল্পই বলে যেতেন, আর অশ্রুধারায় তাঁর গন্ডদেশ যেত ভিজে। তেমন স্নেহ আজ পর্যন্ত দেখিনি। আজ সেই স্নেহপ্রবণ মন কোথায় গেল মানুষের!

এই প্রসঙ্গে আর একজনের কথা না বললে আমার স্মৃতিকথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সে আমাদের গ্রামের চারণ কবি-কবীর পাগল। জাতিতে সে মুসলমান হলেও কোনো ধর্মের ওপরই বিরাগ ছিল না তার। সমস্ত ধর্মকেই বিশ্বাস করত কবীর পাগল। সেও আজ বৃদ্ধ। কিছুদিন আগে শুনেছি সে নাকি অন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের এবং জাতির জন্যে একটি ইতিহাসের মালা গেঁথে রেখেছে কবীর গানের সুরের সূত্র দিয়ে। ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি ধর্মের সমন্বয়ের দিকেই তার ঝোঁক। ভিক্ষের অজুহাতে বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়াত সে। রামায়ণ-মহাভারত-কোরান-বাইবেলের গল্প শুনেছি তারই মুখে প্রথম। তাকে কেউ বলত বৈষ্ণব, কেউ বা ভাবত ফকির। আমার সঙ্গে রউফের একবার ঝগড়া হয়ে কথা বন্ধ হয়ে যায়। মনে পড়ে কবীরই করে দিয়েছিল তার মীমাংসা। তার সামনে মনে পড়ে প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম-বন্ধুতে বন্ধুতে, ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হতে দেব না কোনোদিন। আমাদের ঝগড়া মেটাতে গিয়ে সে কেঁদেছিল সেদিন। ছোট্ট ছেলে বলেই সে কান্নার অর্থ বুঝিনি তখন। আজ এক-একদিন রাত্রে কার ডাকে ঘুম ভাঙতেই মনে পড়ে যায় যেন; সকলের আগে মনে পড়ে কবীরের মুখখানি। কবীর নিশ্চয় আমাদের দুঃখ নিয়েও গান রচনা করেছে। আজ সে অন্ধ, কিন্তু মানসচক্ষে তো মানুষের বেদনা দেখতে পাচ্ছে সে। আজ চমকে চমকে উঠি গানের রেশ শুনলে, বাউল-ভাটিয়ালি হলেই কবীর মনের সামনে এসে দাঁড়ায়। মনে পড়ে যায় তার ‘ফিরে আয়, ওরে ফিরে আয়’ গানখানি। মনে পড়ে যায় সে-ই বলেছিল মাস্টার সায়েবের মতো দৃঢ়কণ্ঠে–’ভাইয়ে ভাইয়ে, বন্ধুতে বন্ধুতে আবার মিলন ঘটবেই, পৃথিবী হবে সুন্দর। আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করি কবীর, আমাদের দেশ আবার সকলের হবে, সমস্ত শয়তানের মৃত্যু হবে একদিন। তবে সেদিন তোমায় পাব কি না জানি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *