মৎস্য পুরাণ
এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল এগিয়ে দিয়ে—খাবার জলের গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুকুন্দ এক এক সময় বেঞ্চে এসে বসে। জিরােবে বলে। কিন্তু বসবার উপায় নেই। অফিসে সাহেব আন্দাজে বেয়ারা ভীষণ কম। জল এগিয়ে দিতে না দিতে আরেকজন চা আনতে পাঠায়। চা ঢেলে দিতে না দিতে বাবুরা কেউ সিগারেট কিনতে পাঠায়। মাঝ বিকেলে মুকুন্দর মাথা ঘােরে। অর্ধেক তৈরি বাড়িতে উঠে এসেছে অফিস। লিফ্ট হয়নি এখনাে। তাই ওঠা নামাতেই তার হাঁটু ভেঙে আসে।
তাতেও দুঃখ ছিল না মুকুন্দর। যেমন বাবুরা-সাহেবরা—তেমনি তার কাজের সঙ্গীসাথী অন্য বেয়ারারাও মুকুন্দকে পেলেই হল—ভীষণ ক্ষমাঘেন্নার গলায় ডাকবে—কী রে মুকুন্দ—কলকাতার জল সহ্য হচ্ছে তাে!
মুকুন্দর দেশ কেশেডাঙা। কেষ্টনগর লাইনে পাগলচণ্ডী স্টেশনে নেমে ধানখেতের ভেতর দিয়ে তিন ক্রোশ হেঁটে যেতে হয়। বাওড় বিলের জায়গা। ছােটোবেলা থেকে মাছ ধরে আসা মানুষ। শােল শাল গজাল তাে ধরেছেই কেঁচে গেথে—এমনকি ইটখােলার ব্যোমে বঁড়শি ফেলে বড়াে বড়াে কাতলাও ধরেছে।
কাজে ঢুকে এসব গল্প তােড়ে বলে গেছে মুকুন্দ। বলতে বলতে নিজের দেশের কথায় মুগ্ধ মুকুন্দ এই বলে কথা শেষ করেছে—
সে কী জল বাওড়ের—না-পাতলা না-ভারী—ঝাঝিতে শ্যাওলায় গম্ভীর কালাে—আর তার ভেতর বড়াে বড়াে সফরি মাছের লেজের ঘাই—আশপাশের গাছে মাছরাঙা পাখিটা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে।
সেই কথায় অফিসসুদ্ধ সবাই তাকে থাবড়ে বসিয়ে দেয়। আর বলে—কলকাতার জল সহ্য হচ্ছে তাে!
আপনাদের বিশ্বেস হবে কোত্থেকে! বরফ ঠাসা মাছ খেয়ে আসছেন। আরও কথা তার মুখে আসে। কিন্তু বলে না মুকুন্দ। যেমন—
কেনেন তাে দুশাে গ্রাম তিনশাে গ্রাম কাটাপােনা। নয়তাে বাড়ি তেলাপিয়া কিনে নিয়ে গিয়ে রাঁধেন তাে সর্ষেপাতুড়ি।
আমাদের দেশের মাছগুলাে জ্যান্তদশায় কলকাতার ক্লাস ওয়ান-টুয়ের বাচ্চাদের সাইজ।
এক একটা বাওড়া-বিল দশ হাজার বিঘের।
তাতে পদ্ম ফোটে—পদ্ম গােখরােও থাকে—আবার বিশ-বাইশ কিলাের পাকা রুইও ঘােরে নিঃশব্দে গম্ভীর চালে।
শহর কলকাতায় বর্ষায় জল জমে। নয়তাে সারাটা শহর কেমন কেঠো কেঠো। শুকনাে বেঞ্চে বসে কোনাে কথা পাড়লেই তার সঙ্গীসাথীরা চড়াস করে তার পিঠে থাবড়া কয়।
আরে চুপ কর। তাের আবার কথা কীসের মুকুন্দ! তার পিঠটা যেন হাতের সুখ করার জায়গা। তার গলার শব্দ যেন বেরিয়ে এলেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে চেপে দেবার জিনিস।
সে যা-ই বলুক না কেন—ওই মাছের গল্প—বিল-বাওড়ের জলের কথা বলার পর থেকেই সবাই তাকে কথা বললেই চেপে ধরে—থামিয়ে দেয়—হাসি মশকরায় ডুবিয়ে দেয়।
ওঃ! মুকুন্দ বলেছে? তাহলে তাে না হয়েই যায় না।
সে যদি সূর্য ওঠার কথাও বলে—কিংবা মুসুরির ডালের দাম নিয়ে কথা বলে—তাও তাকে অফিসসুদ্ধ সবাই চেপে বসিয়ে দেয়। ভাবখানা—তুই আবার কী বলিস! চুপ কর।
কাজে ঢুকে বছর দুয়েকের ভেতর মুকুন্দ তাই একদম বােবা হয়ে গেছে। অনেক জিনিস জেনেও সে রা কাড়ে না। বলে কী হবে! তাকে দেখলেই চেপে ধরার নেশা পেয়ে বসে সবার। কী রে মুকুন্দ—এ যে দেখছি নতুন। স্যান্ডেল পায়ে দিয়েছিস—কোথায় পেলি?
মুকুন্দও সেয়ানা। সে মুখের ওপর বলে, রাজভবনে নেমন্তন্ন ছিল! ওঃ! তাই বল
হা। রাজ্যপালের স্যান্ডেলজোড়া পছন্দ হয়ে গেল। চুরি করে পায়ে দিয়ে চলে এলাম।
তাই বুঝি? তা তাের স্যান্ডেলজোড়া? সেই স্যান্ডেল পায়ে রাজ্যপাল ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এসব বলে খোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েও ওদের একটুও থামাতে পারেনি মুকুন্দ। ওকে দেখলে—কী বাবু—কী সাহেব—কী তার কাজের সঙ্গীসাথীরা—তাকে পারলে পিষে ফেলার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে।
অথচ অফিস নামে এই নিষ্ঠুর জায়গাতেই কাজের ফাঁকে বেঞ্চিতে বসে মুকুন্দ কাচের জানলা দিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে একটা গির্জার মাঠে সুন্দর পান্থপাদপ গাছ বেয়ে মাধবীলতার ফুল গায়ে ওপরে ওঠা দেখতে পায়।
এ শহরে এখন ফেমিলি আনা কঠিন। জায়গা নেই। থাকলেও বেদম ভাড়া। তার সাধ্যের বাইরে। দেশের লােকের মােতিহারি তামাকের কারবার। বৈঠকখানায় তার গােলায় শােয় মুকুন্দ। রবিবার পড়লে গােলার বস্তাগুলাে রােদে দেয়। বউকে পােস্টকার্ড ফেলে আর চিটেগুড়ের কলসির কানাত থেকে উঁই পিঁপড়ে তাড়ায়। কোনাে কোনাে শনিবার বিকেলেই কেষ্টনগরের গাড়ি ধরে। সােমবার শেয়ালদায় নেমেই সিধে অফিসে চলে আসে মুকুন্দ।
বর্ষার ভেতরে শুক্রবার কী একটা ছুটি ছিল। কাল বউয়ের চিঠি এসেছে। বেলঘরিয়ায় দিদির বাড়ি একবার ঘুরে এসাে।
কলকাতায় এসে কারও বাড়ি কোনােদিন যায়নি মুকুন্দ। তার বড়াে শালি বড়াে ভায়রা থাকে বেলঘরিয়া। ছুটির দিন বলে লেবেলক্রসিং পার হয়ে বাস থেকে বেলঘরিয়ায় গিয়ে নামল মুকুন্দ। এখন সকালবেলা। আগেকার ছােটো জায়গা লােক বেড়ে এখন বড়াে জায়গা।
সেই বিয়ের সময় দেখা হয়েছিল একবার। মুকুন্দ তবু খুব মাখামাখি গলায় বলল, কী বড়দা, চিনতে পারেন? | সুরকি ঘেঁষের পুরনাে বাড়ির বারান্দা। মােটা দেওয়াল। বুড়াে মতাে একজন। রুগ্ন লােক—একগাল সাদা দাড়ি ভুলভুল করছে—বাড়ির গায়েই কঁচা ড্রেনে থকথকে পাক-পচা ময়লার গন্ধ—চোখ কুঁচকে তাকাল—ইজিচেয়ারে শােয়া অবস্থাতেই। সরু রাস্তায় অবিরাম সাইকেল রিকশা। দাঁড়াবারও উপায় নেই। মনে পড়ছে না তাে
মুকুন্দ নিভে গেল। ভুল ঠিকানায় আসিনি তাে। ঠিক এই সময় বড়াে শালি বারান্দায় বেরিয়ে এল। ও মা! কী ভাগ্যি!
যাক। মুকুন্দ সাহস করে বারান্দায় উঠল।
তােমার বড়দা তাে জ্বর বাধিয়ে হপ্তা দুই ঘরে বসে। ছুটি পেলেই এ দিঘি সে দিঘিতে ছিপ ফেলতে চলে যায়। কোত্থেকে আবার হারপিস বাধিয়েছে পিঠে—
সেটা কী জিনিস? মুকুন্দর বড়াে শালি তার পিঠের দিকটার ফতুয়া তুলে ধরল। ওই ফোসকা মতন? হুঁ। কোন গাছের নীচে বসেছে তার ঠিক নেই। সারছেই না।
গােড়ায় যাকে খিটকেল লেগেছিল মুকুন্দর—সেই বড়াে ভায়রাকে বিকেলের দিকে বড়াে ভালাে লাগল মুকুন্দর। জ্বরে হারপিসের ব্যথায় কুথে কুথে কথা বললেও—আটকুড়ে মানুষটা তাকে দু-হাত ধরে বলল, রাতটা থেকে যাও
ভাই। আমরা তাে মােটে দুটি প্রাণী। ভালােই কাটবে। কেউ আসে না এদানি
উপায় নেই বড়দা। আবার আসব আমি। পরের গােলায় শুই। না ফিরলে দোর খুলে বসে থাকবে।
বেরােবার সময় ঘরের কোণে দাঁড় করানাে গুচ্ছের ছিপ থেকে একখানা তাকে উপহার দিল তার বড়াে ভায়রা। আর বউকে ডেকে বলল, মুকুন্দ যদি পারে তাে ধরবে গিয়ে মাছ—দাওনা টিকিটখানা—
কীসের টিকিট দাদা?
বড়াে শালি এগিয়ে দিয়ে বলল, তােমার বড়দার শখ। যেখানে পারে ছিপ ফেলার টিকিট কেটে রাখে আগাম—
আমি তাে ওভাবে টিকিট কেটে ছিপ ফেলিনি কোনােদিন দাদা। চার জানি । কলকাতায় এসে ইস্তক কোনাে ছিপও নেই আমার।
এইতাে ছিপ দিলাম। টিকিট পেলে। লালদিঘির টিকিট। কালই গিয়ে বসবে। কালই তাে শনিবার।
এ ছিপ নিয়ে বাসে উঠতে দেবে ? ভাঁজ করা যায় ভাই। জাপানি ছিপ। সতেও জাপানি—
বড়াে শালি বলল, আয়ােজনে কোনাে ত্রুটি নেই ভাই! এখন বয়সটা বেড়ে গিয়ে কিছু অসুবিধায় পড়েছেন তােমার দাদা।
সন্ধেবেলা এক অপরিচিত তৃপ্তির স্বাদ মনের ভেতর টের পেতে পেতে শেয়ালদায় এসে নামল মুকুন্দ। কলকাতায় এসে ইস্তক এমন আদর আপ্যায়ন কোনােদিন পায়নি মুকুন্দ।
বৈঠকখানার মােড়ে গিয়ে দেখল—কয়েকটা দোকানে বড়শি, সুতাে, ছিপ আর নানান চারের আয়ােজন। মুকুন্দ প্রথমে টিকিটখানা বেচার চেষ্টা করল।
সুবিধা হল না। এক দোকানি এগিয়ে বলল, কাল তাে লালদিঘিতে গিয়েই বেচে দিতে পারেন। খদ্দের পেয়ে যাবেন।
তিরিশ টাকার টিকিট। কম করেও বিশটা টাকা তাে পাওয়া যাবেই। বড়াে ভায়রা তাে আর দেখতে আসছে না।
তখন সে ছিপটা বেচতে গেল। পর পর চারজন দোকানি বলল, কেনে যারা তারা নতুন কেনে।
নালশে পিঁপড়ের থলথলে জ্যান্ত বাসার চার, ভাজা মেথি, বােলতার চাক মিশে এক অদ্ভুত গন্ধ বেরােচ্ছিল দোকানগুলাে থেকে। বঁড়শি তিরিশ রকমের। তাদের খদ্দেরও হরেক কিসিমের। সেই সঙ্গে সুতাে হুইল লাগানাে বাহারি সব ছিপ। মুকুন্দর নিজেকে বড়াে দীন-হীন লাগল। সে তাে কেঁচো দিয়ে মাছ গেঁথেছে দেশে। নয়তাে স্রেফ কেঁচোর টোপ গেঁথে মাছ তুলেছে। কিন্তু এ যে অন্য জগৎ। এমনকি এক দোকানে একটা পাঁচ-ছ কেজির রুই মাছের ফটো টাঙানাে রয়েছে। প্রমাণ সাইজের। একদম জ্যান্ত। যেন তাকেই দেখছে।
এক দোকানি বলল, শুধু শুধু দামি ছিপটা বেচবেন কেন? টিকিট রয়েছে যখন—কালকের জন্যে চার নিয়ে যান। বানিয়ে দিচ্ছি এমন জিনিস-গন্ধে গন্ধে মাছ মানুষ সবাই ফিরে তাকাবে দেখবেন।
রীতিমতাে অনিচ্ছায় গাদাগুচ্ছের চার কিনে গােলায় ফিরল মুকুন্দ। তখন গােলার ভেতরটা লােডশেডিংয়ে অন্ধকার। তােলা উনুনে ভুগ ভুগ করে ভাত ফুটছে।
পরদিন সকালে রীতিমতাে আনাড়ির কায়দায় সবার আগে লালদিঘির ঘাসে ঢাকা ঘাটে গিয়ে বসল মুকুন্দ। না আছে চৌকি-না আছে হাত দা কিংবা কোন নাকাল। সামনে টেলিফোন ভবন। পেছনে রাইটার্স। ডানপাশে জি পি ও। মাথার ওপর ভাদ্র মাসের মেঘলা আকাশ। দশ বারাে হাত অন্তর আরও সব নেশাডু মাছমারা এসে একে একে বসল। আজ আর অফিস যাওয়া হবে
মুকুন্দর। ভেতরে একটা খুঁতুথুতুনি থেকেই গেল তার।
ভাগ্যিস গােলার ফাইফরমাশ খাটা ছেলে নবকে সঙ্গে এনেছিল মুকুন্দ। নবই দাঁতে কেটে ফাতনার ঝুল হেঁটে দিল। চার মাখল গােল্লা গােল্লা করে। তামাকের বস্তা এনেছিল কয়েকটা। তারই একটা ভাঁজ করে বসতে দিল মুকুন্দকে। পাশে মেলে ধরল মুড়ির ঠোঙা। উল্টোদিকে টেলিফোন বাড়ির ঘাটলায় জলের ফোয়ারায় আলাদা একটা ছবি হয়ে আছে। পুকুরের চারদিক দিয়ে বাস মিনিবাসের চক্কর চলছে তাে চলছেই। তারপর মানুষ। ট্রাম। মােটরগাড়ি। কত কী।
জলের দিকে তাকাল মুকুন্দ। বেশ ভারী। কালাে আর গম্ভীর। হাত তিনেক ডুব দিলেই ঝঝি শ্যাওলার মাথা হাতে পাবে মনে হল মুকুন্দর। দিঘির কানাত ঘেঁষে টোকা পানার ছাট।
ফাতনা ডুবতেই টান দিল মুকুন্দ। ভাগ্যিস হুইলের গাঁট খােলা ছিল। ঝাকুনি দিয়ে গলগল করে সুতাে টানতেই লাগল মাছটা। উঠে দাঁড়াল মুকুন্দ। অন্তত
পাঁচ ছ-কেজির পাকা মাছ হবে। সুতাে কেটে বেরিয়েও যেতে পারে।
দিঘির চারদিকে থেকে সবাই তার বেঁকে যাওয়া ছিপের মুখে তাকিয়ে। নব তাে লাফাচ্ছে।
ধমকে উঠল মুকুন্দ। একটা বস্তার মুখ খুলে নাকাল বানা তাে—নাকাল ? তাও জানে না। শুধু লাফালেই চলবে?—এবার সুতােয় একটু টান রেখে অদেখা মাছটাকে দিঘির বুকে শুয়ে শুয়ে জিরােতে দিল মুকুন্দ। তারপর নবকে বলল বস্তার খােলা মুখে নারকেল দড়ির জালি বানিয়ে দুধারে করে বাঁধে। তারপর মাছটাকে তুলে ওর ভেতর ভরে জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে না ! কতক্ষণ বসতে হয় তার ঠিক কী।
প্রায় ঘণ্টাখানেক কসরতের পর মাছটাকে তুলল মুকুন্দ। শ্যাওলা পড়া আট ন-কেজির এক কাতলা। গাঁথা বঁড়শির কষে মুখে খানিকটা মাটি। গোঁত্তা খেয়ে মাছটা যে দিঘির বুকে গিয়ে যন্ত্রণায় মুখ ঘষেছে—তাতে আর কোনাে সন্দেহ থাকল না মুকুন্দর।
এখন ঘাট ভেঙে পড়েছে মানুষে। ভবঘুরে, ফিরিঅলা, দাঁড়ানাে গাড়ির ড্রাইভার, পানউলি—কে নয়? এমনকি সাহেবসুবাে প্যাটার্নের কিছু ভদ্দরলােকও তাকে আর মাছটাকে খুব সন্ত্রমভরে দেখছে।
মুকুন্দ অন্যরকম হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। যেন কতকাল ধরে সে দুনিয়ার ঘাটে ঘাটে স্রেফ রাঘববােয়ালই ধরে আসছে। এ মাছটা তাে সে আন্দাজে নেহাতই পুঁটি। হাতের আঙুলে ফাঁদ বানিয়ে নারকেল দড়ির জালি ফেঁদে নব বস্তার মুখে তা ভালাে করে বসিয়েছে। এবারে তার ভেতরে দুজনে ঠেলে ঠুলে মাছটাকে ভরল। ভরা কি যায়। যেন জ্যান্ত এক খােকা! হাজার হােক সরকারি লালদিঘিতে চরে বেড়ানাে মাছ। বাস মিনিবাসের ঘর্ঘর শুনে বেড়ে উঠেছে। একেবারে বাবুর বাড়ির ছেলে। বস্তা সুদ্ধ জলে ডুবিয়ে দিয়ে বস্তার মুখ শক্ত দড়িতে বেঁধে একটা মুখ ঘাটের গায়ে পড়ে থাকা এক লােহার চাকায় কষে বেঁধে দিল নব।
ফিরে বলল, মেসাে আর তাে বস্তা অনিনি—
বেশ করেছ। এবার চার মাখাে। মেথিটা বেশি দিস—
ছিপের মাথা ঝাকিয়ে বেশ দূরে ফাতনা ভাসাল মুকুন্দ এবার। ভাসিয়ে দিয়ে চিন্তা হল—আবার যদি এমন মাছ পড়ে তাে রাখবে কোথায়? নাকাল
বানাবার আর তাে বস্তা নেই। মাছ ধরার সরঞ্জাম আর তাে কিছুই নেই। বড়ােজোর আর একটা মাছ ওই মাছটার সঙ্গে বস্তায় ভরা চলতে পারে।
ভাবতে না ভাবতেই আবার ফাতনা ডুবল। যা ভেবেছে। এবারাে তেমনি টান সুতােয়। তবে আগেরবারের মতাে অত সময় নিল না এবারের মাছটা। পােয়া ঘণ্টার ভেতর মুকুন্দ সমান সাইজের একটা পাকা মৃগেলকে ঝটাপটির ভেতর এক ঝটকায় একদম ঘাসের ওপরে তুলে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়া মানুষের ভিড়টা ভেঙে গিয়ে ফের গােল্লা পাকিয়ে ঝটাপটি যাওয়া মাছটাকে ঘিরে ধরল।
সবুজ ঘাসে মৃগেলটার মুখ থেকে লাল রক্ত ঝরে পড়ে মেখে যাচ্ছিল। মাছের চোখে ভাঙা ঘাসের মাথা, মাটি। মতলব করেই মাছটাকে পাড়ে তুলেছে মুকুন্দ। আর তাে ডুবিয়ে রাখার জায়গা নেই। ডাঙায় ঝাপাঝাপি করে মারা গেলে তবে মৃগেলটাকে ঘাসের সিড়িতে শুইয়ে রাখবে ভেবেছে।
কড়কড়ে রােদ উঠল। ঘেমে জামা খুলে ফেলল মুকুন্দ। খালি গা। হাতে ছিপ। পরনে একটা প্যান্ট। তাকে ঘিরে অন্তত শখানেক মানুষ। এমনকি রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দোতলায় রেলিং ধরে মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। তাকে দেখবে বলে।
মুকুন্দ সারা ভিড়টাকে চমকে দিয়ে নবকে এক দাবড়ি দিল। চার মাখবে কে? মৃগেল নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে!
সে দাবড়িতে সবাই তটস্থ হয়ে গেল। কারাে দিকে না তাকিয়ে মুকুন্দ ছােটো খােকা কোলে নেবার কায়দায় মৃগেলটাকে দুহাতে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বুঝল, আর দাপাবে না—মরে এসেছে—
এখন যদি এই ভিড়ে তার অফিসের কেউ থাকত তাে কী ভালােই হত। দেখে যেত কেশেডাঙার মুকুন্দ রানা একজন কেউকেটা লােক। ছিপ ফেলছে—আর মাছ তুলছে। মাছ বলে মাছ। সব ক্লাস ওয়ান টুয়ের বাচ্চা। ঠিকের বাস বােঝাই দিয়ে যেমন কিনা গুড়ােগাড়া স্কুলে যায় সকালে।
বেলা বারােটা বাজতে না বাজতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল ঝমঝম করে। মৃগেলটা এখন নিথর ঠান্ডা। ডুবিয়ে রাখা বস্তাসুদ্ধ কাতলাটা দাপিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে। এখন মুকুন্দকে ঘিরে হৈ হৈ হচ্ছে। জমাট ভিড়ে কথা একটাই। না জানি কী মাছ ওঠে এবারে—ভাজা মেথির সঙ্গে পাউরুটি, কচি বােলতা, থকথকে পিপড়ের ডিম সব এক করে মেখে গােল্লা পাকাচ্ছে মুকুন্দ নিজেই। খােলা গায়ে জায়গায় জায়গায় ঘামের ফোঁটা। বিড়ি আনতে গেল নব এইমাত্র—
এরপরেই যা শুরু হয়ে গেল তাকে কী বলবে মুকুন্দ। একেবারে কেলেঙ্কারি। স্রেফ কেলেঙ্কারি। ছিপ ফেলে আর ফাতনা ডােবে। সুতােয় ঢিলে। খানিকক্ষণ খেলানাে। তারপর টান রেখে রেখে ছাড়া। শেষে নব জলে ঝাপিয়ে পড়ে কোলে তুলে নিয়ে ঘাটে উঠে আসে। পাছে সুতাে ছিড়ে পালায়।
বেলা চারটে নাগাদ পুলিশ এসে ঘাটে দাঁড়াল। দুজন পুলিশ মিলেও ভিড় সামলাতে পারছে না। হাতের রুল চালিয়ে ভিড়ের কেঁপে ওঠা জায়গাগুলাে ঠেসে চেপে দিতে লাগল পুলিশ।
বিড়ি ধরাবার জন্যে একবার মুকুনদ পেছন ফিরে দলা পাকিয়ে রাখা শার্টের পকেট হাতড়াতে গিয়ে ওপর দিকে চাইল। রাইটার্স বাড়ির দোতলায় রেলিং ধরে মানুষের গাদি। নিজের অফিসে যেসব ভদ্দরলােককে সে মনে মনে বড়বাবু কিংবা সাহেব বলে—তারাই কাতার দিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ানাে। তখন ঘাটের সিঁড়িতেও মাছের গাদি। একটার গায়ে আরেকটা! রুই, কাতল, মৃগেল। সব ছ, সাত, আট কেজি সাইজের।
ইস্, আজ যদি অফিসের সঙ্গীসাথীরা—বাবুরা তাকে এ অবস্থায় দেখতে পেত। তাহলে?
জি পি ও-র মাথায় একখানা চ্যাপটা মেঘ। কোথায় যে বৃষ্টি ঝরাবে বুঝতে পারল না মুকুন্দ। সূর্যের আলাে গঙ্গার দিকটায় আর সাদা নেই। রীতিমতাে রঙিন। লম্বা দিন। সন্ধে হতে অনেক দেরি। দাবড়ে উঠল মুকুন্দ। চার কোথায় ? মাখিসনি ?
নব এক গাল হেসে তাকাল। সেও যে এই বিজয় উৎসবের একজন ছােটোখাটো বরকন্দাজ। আর কোথায় ?
মানে? ফুইরে গেল যে মেসাে ! | ফুরিয়ে গেছে? আর নেই?
নাঃ!
ঘাটে বসে পড়ল মুকুন্দ। আধখানা চাঁদ হয়ে তাকে ঘেরা উপছে পড়া ভিড় থেকে আফশােসের হা হুতাশ উঠল।
ইস্ এখনাে ঘণ্টা দুই ছিপ ফেলা যায়।
কেউ বলল, এই ছেলেটাই যত্ত নষ্টের গােড়া। বেশি বেশি করে চার ছড়িয়েছে এতক্ষণ।
মুকুন্দ পরিষ্কার শুনল, একজন লােক তার পাশের সবাইকে শুনিয়ে বলছ—উনি তাে কম্পিটিশনে মাছ ধরেন। ইন্ডিয়ার হয়ে যত কান্ট্রিতে গেছেন—কাগজে ছবিও থাকে বাকি কথাগুলাের সব শুনেও বুঝতে পারল না মুকুন্দ। চোখ তুলে তাকাল লােকটার দিকে। অল্পবয়সি। রােগভােগা তার অফিসে ক্যাশের ভাউচার বাবুর মতাে দেখতে অনেকটা। মুকুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে লােকটা চোখ নামিয়ে নিল। সম্রমে। সােজাসুজি তার চোখে তাকিয়ে থাকতে পারল না।
সঙ্গে সঙ্গে খুব রুক্ষ গলায় হাঁক দিল মুকুন্দ। এই নবা নবও চমকে উঠল। মুকুন্দ মেসাে তাে তাকে কোনােদিন এই গলায় ডাকে । নবর মুখ শুকিয়ে গেল। সে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে বস্তায় ডােবানাে কাতলাটার আন্দাজ নিচ্ছিল। বকের মতাে টক করে উঠে এসে সিঁড়িতে দাঁড়াতেই মুকুন্দ বলল, কেঁচো তােল—
কেঁচো? হা, কেঁচো। কেঁচো গেঁথেই মাছ লাগাব— ভিড়ের ভেতর থেকে একটা চাপা ধন্য ধন্য রব উঠল! রবের ভাষাটা অবিশ্যি অন্যরকম। এই যেমন
কত বড়াে মাছমারা দেখেছ। শেষে হুইল ছিপে কেঁচো গেঁথেই— বড়াে প্লেয়ার তাে। ওদের বসিয়ে দিলেই হল। এ দিঘি ওদের কাছে চৌবাচ্চা। একটা লাঠি। কিছু কেঁচো। আর একটা আলপিন বাঁকিয়ে দিলেই হল। নব বলল, দা শাবল—কিছুই যে আনিনি মেসাে— হাত দিয়ে তােল বাবা। জলের গা ঘেঁষে-মাটি তাে নরম এখন।
এমনই কপাল—কেঁচোতেও কে জি দেড়েকের একটা রুই উঠে এল। সবে লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ততক্ষণে দুজন পুলিশের পক্ষে ভিড় সামলে রাখা আর সম্ভব হচ্ছিল না।
সদ্য সদ্য অক্কা পাওয়া বাড়ি বাড়ি মাছগুলাের মাঝখানে পড়ে দেড় কেজির রুইটা সামান্য ঝটপট করেই ঠান্ডা মেরে গেল।
তখন মাছমারাদের প্রায় সবাই মুকুন্দর ঘাটে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল। বড়াে ডাকঘরের গােল টাকে গঙ্গার ওপার থেকে সূর্য আলাে ফেলছে। মুকুন্দ হুইলে ঢিলে দিয়ে এক্ষুনি কেঁচোর টোপ সমতে বঁড়শিটা যতদূরে পারে ফেলবে। লালবাড়িতে তাে মুখ্যমন্ত্রী বসেন। এইটুকু পথ মাত্র। নেমে এসে একবার যদি বলতেন—একী করেছ মুকুন্দ!
বলার মতাে একজন সাক্ষী থাকত তাহলে। এইসব ভাবতে ভাবতে তন্ময় মুকুন্দর কানের কাছে কে যেন খুব চাপা গলায় কী বলে উঠল।
মুকুন্দ চমকে উঠল। সে ভাবতেই পারেনি—লালবাড়ি থেকে সত্যি সত্যিই মুখ্যমন্ত্রী নেমে আসবেন। হাত থেকে ছিপখানা খসে পড়ে যাচ্ছিল। মুখখানা যতটা বিনীত করা যায়—তাই করে কোনােরকমে পেছনে ফিরে তাকাল মুকুন্দ।
কোথায় !
কাঁচা পাকা দাড়ি ভর্তি একটা লােক। মুখ ভর্তি হাসি। এত মাছ নিয়ে ফিরবে কী করে ভাই। অফিসটাইম। এখন তাে গাড়ি পাবে না—
ঠিক তাে। এটা তাে ভাবা হয়নি। মুখে বলল, তাহলে খানিকবাদে অন্ধকার হয়ে যাবে ভাই—
শুনতে শুনতে মুকুন্দ ভাবল, একথা বলতেও লােকটা হাসে কেন? এমনকি চোখ অব্দি হাসছে।
কোনাে গাড়িও তাে কাছাকাছি দাঁড়াতে দেবে না পুলিশ। অফিস ছুটির পর এদিকটায় ট্যাক্সিও কমে আসে।
নব সব শুনছিল। সে ফস করে বলল, আমি আর মেসাে মাথায় করে নে যাব।
লােকটা বলল, পারলে ভালাে!—বলেই পিঠ ফিরে চলে যাচ্ছিল। মুকুন্দ নবকে ধমকাল। একই সঙ্গে লােকটাকে বলল, তাহলে?
এবারে সেই লােকটা আবার ফিরে তাকাল। মুকুন্দ ভিড়ের গায়ে যতটুকু একবারে দেখল—তা হল—গায়ে খাকি হাফসার্ট—নীচে পাজামা-পায়ে নাগরা—কঁাধে ঝাড়ন মতাে।
তাড়াতাড়ি মাছ তােলাে দুজনে। আমার ট্যাক্সি মিনিবাসগুলাের ঠিক উল্টোদিকে—-বলেই পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে লােকটা চলতে শুরু করে দিল।।
মুকুন্দ হুইলে সুতাে গােটাতে গােটাতে জানতে চাইল, হারে নবা—টাকা আছে তাের কাছে?
গােলায় গিয়ে চেয়ে দিয়াে ড্রাইভারসাহেবকে— যদি কেউ দেবার না থাকে। ছােটো রুইটাই দিয়ে দিয়াে মেসাে। ড্রাইভারসাহেব নাচতে নাচতে নে যাবে।
মুকুন্দ দেখল ছেলেটার হাসির ভেতরেও সূর্যের লালচে আলাের কুচি ঢুকে পড়ছে।