ম্যানিকুইন
আত্মার নাকি বিনাশ নেই! তাকে ছুরি দিয়ে কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে ফেলা যায় না—তবে, সবকিছুর মতো, আত্মারও বয়স আছে৷ এবং যত দিন যাচ্ছে, সেই বয়স বেড়েই চলেছে৷ এখন ভাবুন, আজ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে যে নিয়ানডারথাল মানুষ মারা গেছিল, সেও পরিণত হয়েছে আত্মায়৷ এবং, জন্ম-মৃত্যুর মাঝের দোলায় সে এখনও দুলে চলেছে৷
অতি সুপ্রাচীন এমন বহু প্রাণীও তো পৃথিবীর বুকে ছিল, যাদের কথা আমরা এখনও জানিই না৷ হয়তো মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার আগে, অন্য কোনও সভ্যতা বাস করত পৃথিবীর বুকে! কয়েক হাজার বছর পার করেও, এখনও সেই প্রাণীদের আত্মা কিছু খুঁজে চলেছে!
তবে, শপিং মলের নাইট গার্ড বিনুর এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই৷ আচ্ছা, একটা খসখস আওয়াজ কি শুনতে পাচ্ছেন? জামাকাপড়ের আলমারির মাঝে কিছু যেন নড়ে উঠছে! চলুন তো দেখি, কী আছে ওখানে৷
তবে যাওয়ার আগে, আরেকটা কথা একটু শুনে যান৷ বেশ কিছুদিন আগে, একটা হিন্দি সিনেমার গান শুনেছিলাম৷ তাতে একটি মেয়ে বলছে যে, যতক্ষণ না তার নিঃশ্বাসের সাথে তার প্রেমিকের নিঃশ্বাস মিলে গেছে, ততক্ষণ সে নাকি নিঃশ্বাস নিতে পারেনি৷ আপনি যদি তলিয়ে ভেবে দেখেন, তাহলে একটা সহজ প্রশ্ন সামনে আসবে৷ এবং, আতঙ্কে আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে৷
তার মানে কি প্রেমিকের সাথে দেখা হওয়ার আগে অবধি, মেয়েটি নিঃশ্বাস ছাড়াই বেঁচে ছিল!!!
জামাকাপড়ের হ্যাঙার থেকে খচমচ শব্দ শুনে সেইদিকে এগিয়ে গেল বিনু৷ টর্চটা শক্ত করে ধরল হাতে৷ অন্তত ঘণ্টা তিনেক হল মল বন্ধ হয়ে গেছে৷ এখন আওয়াজ আসছে মানে, হয় বিড়াল জাতীয় কোনও প্রাণী না হয় ইঁদুর৷ কিন্তু তারাই বা ঢুকবে কী করে? চারিদিক এয়ারটাইট করে বন্ধ করা৷ বন্ধ করার আগে রোজ আঁতিপাতি করে দেখে নেওয়া হয়৷ তাহলে?
বিনুর ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল৷ এতক্ষণে অন্ধকারটা তার চোখ সয়ে গেছে৷ আওয়াজের উৎস লক্ষ্য করে টর্চ ফেলে দেখল হ্যাঙারের মাঝখানটা জামাকাপড় সরে গিয়ে খানিকটা ফাঁক হয়ে আছে৷ একটু অবাক হল বিনু, এই শপিং মলে সে নাইটগার্ডের চাকরি নিয়েছে তাও একসপ্তাহ হতে চলল৷ তার মধ্যে এতটুকু বেনিয়ম চোখে পড়েনি, সামান্যতম গাফিলতিও এখানে সহ্য করা হয় না৷
সাড়ে দশটা বাজলে শপিংমল বন্ধ হয়ে যায়, দোকানের মালিকরা একে- একে নিজস্ব দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে যায়, যাদের ওপেন স্পেসে দোকান তারা স্টলগুলোকে একধারে সরিয়ে রেখে যায়, যাতে মাঝরাতে হাঁটতে-হাঁটতে নাইটগার্ডের হোঁচট না লাগে৷ যেমন এই হ্যাঙারটা৷ এখনও তার গা থেকে জামাকাপড় ঝুলছে, শুধু মাঝখানে একখানা ছোট ফাঁক৷ যেন এইমাত্র হাত দিয়ে ঝুলন্ত জামাকাপড় সরিয়ে কেউ ভিতরে ঢুকেছে৷
বিনু আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে ফাঁকটার ভিতরে আলো ফেলল, ওপাশে সাদা দেওয়াল৷ এদিক-ওদিক আলো ঘুরিয়েও বিড়াল বা ইঁদুর চোখে পড়ল না৷ একটা ছোটখাটো দীর্ঘশ্বাস ফেলল বিনু, তাহলে এমনিই হয়তো কাপড়গুলোর মাঝে ফাঁক হয়েছিল৷ আওয়াজটা আসছিল অন্য কোথাও থেকে৷ এখন আর সেটা আসছে না৷ টর্চ নিভিয়ে ফিরে আসতে গিয়েও বিনু থমকে গেল, আওয়াজটা আবার শুরু হয়েছে৷
এবার খানিকটা জেদ চেপে গেল বিনুর মাথায়, এগিয়ে এসে একটানে জামাকাপড়গুলো একদিকে সরিয়ে দিল সে৷ হাতের টর্চটা জ্বালতেই এক মুহূর্তের জন্য তার শরীরটা কেঁপে উঠে দু-পা পিছিয়ে এল৷ অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে৷
টর্চের হলদে আলো এসে পড়েছে একটা মুখের উপরে—মানুষের মুখ; তবে একবার দেখেই বোঝা যায় কোনও জীবিত প্রাণীর মুখ নয় সেটা৷
মসৃণ মখমলের মতো ফ্যাকাসে চামড়া, মুখের বেশিরভাগটা চুল দিয়ে ঢাকা, বাকি অংশটা একটা হাত দিয়ে আড়াল করে আছে সে৷ চামড়াটা দেখে মনে হয় যেন মানুষের গায়ের উপরে শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে চকচকে মসৃণ করে দিয়েছে কেউ৷
টর্চের আলোতে একবার যেন কেঁপে উঠল শরীরটা৷ স্কার্টের নীচ থেকে বেরিয়ে থাকা পা দুটো চোখে পড়ল বিনুর৷ ঠিক যেন প্লাস্টিকের রক্তমাংসহীন পা৷ এ প্রাণীটা মানুষের মতো দেখতে হলেও ঠিক মানুষ না৷
পালাতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিনু৷ নাঃ, যেভাবে প্রাণীটা মুখ আড়াল করে আছে তাতে সে ভয়ানক কিছু করতে চলেছে বা করতে পারে বলে মনে হয় না৷ আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল বিনু৷ তারপর গলায় জোর এনে জিজ্ঞেস করল, ‘কে তুই?’
প্রাণীটা কিন্তু মুখের উপর থেকে হাত সরাল না৷ হাতের আঙুলগুলোর উপরে আলো এসে পড়েছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আঙুলগুলো প্লাস্টিকের, ঠিক জামাকাপড়ের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যানিকুইনের মতো৷
‘আ… আমাকে একটু সাহায্য করবেন প্লিজ, খুব অসুবিধায় পড়েছি৷’
এতক্ষণে বিনুর ভয় কেটে গেছে; মানুষকে সে ভয় পায় না৷ কিন্তু এই মহিলার গা-হাত-পা এমন প্লাস্টিকের মতো কেন? কোনও রোগ হয়েছে নাকি? যাই হোক, সে ভয় ঝেড়ে ফেলে বলে, ‘সাহায্য পরের কথা, আগে বল কে তুমি?’
‘আলোটা নেভান আগে, না হলে ভয় লাগবে৷’
‘কেন? চোখের রোগ আছে নাকি?’
‘আমার ভয়ের কথা বলিনি, আপনার ভয় লাগবে৷’
‘কেন? ভয় লাগবে কেন?’
‘আসলে আমার চোখের মণিদুটো এখনও লাগানো হয়নি৷’
কথাটা কানে যেতেই বিনুর একটু আগের ভয়টা আবার ফিরে এল৷ চোখ লাগানো হয়নি মানে চোখ দুটো খোলা আছে? এটা মানুষ নাকি রোবট? মলের ভিতরে রোবটের ফ্যাক্টরি আছে বলে তো জানা নেই৷
‘লাগানো হয়নি মানে কী!’
এবারে একটু-একটু করে উঠে দাঁড়ায় মানুষটা৷ বা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে৷ বিনুর চোখে পড়ে তার হাঁটুর নীচটায় অনেকটা কাটা৷ অথচ রক্ত পড়ছে না৷ যেন কোথাও ঘষা লেগে খানিকটা চিরে গেছে৷ অবাক হয়ে বিনু দেখে প্রাণীটা ঠিক মানুষ নয়, বরঞ্চ একটু আগে যেটা মনে হয়েছিল সেটাই ঠিক৷ জামাকাপড়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ম্যানিকুইন৷ কিন্তু সে মানুষের মতো কথা বলেছে কী করে?
একটু-একটু করে উঠে দাঁড়ায় সে৷ মুখের সামনে থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিতেই বিনুর বুকটা একবারের জন্যে কেঁপে ওঠে৷ বড় দুটো কোটরের মাঝে চোখ দুটো সত্যিই নেই৷ মাথা নামিয়ে নেয় মেয়েটা৷ তারপর আগের মতোই নীচু গলায় বলে, ‘আমার পা-টা চিরে গেছে, সেলাই না করলে কাটাটা আরও বেড়ে যাবে৷’
কথাটা কানে যেতে সম্বিত ফেরে বিনুর৷ সে টর্চের আলোটা পায়ের উপরে নামিয়ে এনে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, ‘কিন্তু তুমি কথা বলছ কী করে?’
ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ায় মেয়েটা৷ তার অন্ধকার অক্ষিগোলকেও কিছু একটা অভিব্যক্তি খেলে যায়, ‘সেটাই বুঝতে পারছি না৷’
বিনু অনেককাল আগে টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখেছিল৷ তাতেও একটা ম্যানিকুইন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল৷ এ ঘটনাটাও অনেকটা সেইরকম৷ চোখের সামনে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করত না৷ একবার তার মনে হল ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে৷ কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে তো একবারও মনে হয় না যে স্বপ্ন দেখছে৷ যেহেতু সেটা মনে হচ্ছে তাই নিশ্চিত ভাবে বলা যায় এটা স্বপ্ন নয়৷
মেয়েটার উপর থেকে নীচ অবধি একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বিনু বলল, ‘তা দিনের বেলা থাক কোথায়?’
‘বেসমেন্টে, বেশি আলো আমার সহ্য হয় না৷’
‘তখন তোমাকে কেউ দেখতে পায় না?’
‘না৷’
‘কেন?’
মেয়েটা আর কিছু বলল না৷ একটা হাত মাথায় রেখে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল৷ বিনুর মনে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল৷ সেই সাথে মায়াও লাগছিল মেয়েটাকে দেখে৷ হয়তো কোনও বিদেহী আত্মা, উপায় না পেয়ে পুতুলের ভিতর ঢুকতে হয়েছে৷ এমনিতে পুতুলটাকে দেখতে খারাপ নয়৷ ছোটখাটো গড়ন, ছিপছিপে শরীর, কথা বলার সময় ঠোঁটগুলোও কেঁপে উঠছে৷ শুধু চোখের কোটর দুটো খালি বলে কেমন যেন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে তাকে৷ নিজের মুখে হাত দিয়ে এতক্ষণে সেটাই যেন বুঝতে পারল সে৷ আবার হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিয়ে বলল, ‘আগে চোখ দুটো খুঁজতে হবে, না হলে আপনি ভয় পাবেন৷’
‘চোখ কোথায় পাব?’
‘ডল শপে, দোতলায়৷’
‘এখন খোলা আছে?’
‘খোলা নেই, তবে…’
কিছু একটা বলতে গিয়েও আটকে গেল মেয়েটা৷ বিনুর মনে হল কোনও ব্যাপারে বিনুর সাহায্য দরকার মেয়েটার৷ সে খানিক ভেবে নিয়ে বলল, ‘বেশ, খুঁজে নাও চোখ৷ তবে তারপরে আর এখানে থাকা চলবে না৷’
মেয়েটা মাথা নাড়ল৷ এমন পুতুলের শরীর নিয়ে সে যে কোথায় যাবে সেটা অবশ্য বিনু জানে না৷ টর্চটা সামনে জ্বেলে হাঁটতে লাগল বিনু৷ এত রাতে এস্কালেটার চলে না, ফলে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা ছাড়া উপায় নেই৷ সিঁড়িগুলো বেশ খাড়াই—কয়েকটা ধাপ উঠতেই কষ্ট হয়৷ বিনু লক্ষ্য করল৷ মেয়েটা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে৷ সে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমার ভিতরে যন্ত্রপাতি আছে নাকি?’
‘কী যন্ত্রপাতি?’
‘এই যেমন, হার্ট, লাংস, কিডনি, আরও যা-যা থাকে৷’
‘না, হার্ট থাকলে সেই দেহের ভিতরে ঢুকতে পারতাম না আমি৷’
‘তাহলে নিঃশ্বাস নিচ্ছ কী করে?’
‘না হলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়৷’
এতক্ষণের উত্তেজনাটা কেটে গিয়ে এই প্রথম বিনুর হাসি পেল৷ সে মুখ ফিরিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে বলল, ‘থাক, অত স্বাভাবিক করতে হবে না সব কিছু৷ নিঃশ্বাস বন্ধ কর৷’
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল৷ সিঁড়ির উপরে শুধু দু-খানা পায়ের আওয়াজ৷ বিরাট শপিং মলটা খালি বলে এখন আওয়াজটা ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে৷ সিঁড়ির শেষ ধাপটা পার করে পিছন ফিরে তাকাল বিনু৷ তারপর টর্চটা নীচের দিকে ফেলতেই আবার চমকে উঠল—সিঁড়ি ফাঁকা পড়ে আছে৷ মেয়েটা বেপাত্তা৷
ভয়ে-ভয়ে চারিদিক তাকাতেই ঘাড়ের ঠিক পিছন থেকে চেনা গলা শুনতে পেল সে, ‘এই জন্যেই নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম; যাই হোক, এদিকে আসুন৷’
থতমত খেয়ে পিছন ফিরে আবার হাঁটতে লাগল বিনু৷ কাচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে থেকে খানিকটা আলো ভিতরে আসছে এখন৷ সেই আলোয় মেয়েটার চেহারার আউটলাইন ভালো মতো চোখে পড়ছে৷ তার চেহারাটা ছোটখাটো হলেও বেশ বড়-বড় পা ফেলে হাটে৷ ফলে হাতদুখানাও একটু বেশি নড়াচড়া করে৷ আপাতত বিনুর থেকে হাত পনেরো দূরে হাঁটছে সে৷ ওদিকে যে একটা পুতুলের দোকান আছে সেটা বিনু আগেও দিনের বেলা লক্ষ করেছে; কিন্তু এত রাতে সেটা বন্ধ আছে, চাবিও নেই বিনুর কাছে৷ তাহলে গিয়ে লাভটা কী হবে?
যাই হোক, বেশি ভাবনাচিন্তা না করে বিনু ধীরে-ধীরে দোকানটার সামনে এসে দাঁড়ায়৷ দোকানের মেন দরজাটা কাচের৷ তার উপরে এখন ক্লোজড বোর্ড ঝুলছে৷ সেটার দিকে একবারও না তাকিয়ে একদিকের দেওয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে মেয়েটা বলল, ‘এইখানে একটা হ্যান্ডেল ছিল, সেটা খুঁজে পেলেই ভিতরে ঢোকা যাবে৷’
‘হিডেন ডোর! এখানে!’
‘না, না৷ হ্যান্ডেল৷ সেটার উপরে পা রেখে উপরে হাত বাড়ালেই কিছু ধরা যাবে৷’
ব্যাপারটা একটু আগেই সন্দেহ করেছিল বিনু, জোর গলায় বলল, ‘আর সেটাতে উঠবে কে? আমি?’
‘আমিই উঠতাম, কিন্তু হাত পাব না যে৷’
বিনুর রাগ লাগল৷ মলের ভিতরে যাতে অবাঞ্ছিত লোক না ঢুকে পড়ে সেটা দেখাই তার কাজ৷ একসপ্তাহ হল তার চাকরি হয়েছে, সিসিটিভি ক্যামেরা যদিও বন্ধ তাও কাজটা করতে কেমন যেন বাধো-বাধো ঠেকল তার৷ সে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘না না, আমি এসব পারব না, তুমি নিজে করে নাও৷’
মেয়েটা তার স্কার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে নিয়ে বলল, ‘এটা নাও, হয়ে যাবে৷’
বিনু তাকিয়ে দেখল সেটা একটা ডেবিট কার্ড৷ সম্ভবত কারও হাত থেকে পড়ে গেছিল; মেয়েটা সুযোগ বুঝে তুলে নিয়েছে৷ কার্ডটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বিনু বলল, ‘কী হবে এটা দিয়ে?’
‘ওতে কত টাকা আছে জানি না৷ কিন্তু একটা পুতুলের দাম হয়ে যাবে৷’
‘তা হবে হয়তো, কিন্তু পিন তো জানি না৷’
‘ফোর টু জিরো নাইন৷’
‘তুমি জানলে কী করে?’
মেয়েটা একটু সংকোচ করে বলল, ‘যে লোকটা আমাকে এখানে এনেছিল সে একটা এটিএমের পাশে আমাকে দাঁড় করিয়ে টাকা তুলেছিল৷’
‘আর তুমিও সেই ফাঁকে পিনটা দেখে নিয়েছিলে৷’
মেয়েটা মাথা নামিয়ে নিল৷ বিনুর বেশ হাসি পেল৷ এতক্ষণে যে লোকটা কার্ড ব্লক করে দিয়ে থাকতে পারে সেটা হয়তো জানে না মেয়েটা৷ বিনু কার্ডটা আবার তার হাতে দিতে-দিতে বলল, ‘এসব লাগবে না৷ পুতুলের শরীরে প্রাণ আসাটাই আনএথিক্যাল, সেটা যখন হয়েছে তখন বাকি এইটুকু হলে অসুবিধা নেই কিছু৷’
টর্চটা জ্বেলে দেওয়ালের উপরে ঘোরাতেই হ্যান্ডেলটা চোখে পড়ল৷ সে টর্চটা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা ধর, আমি ভিতরে নামলে বাইরে কাচের এপার থেকে ভিতরে আলো ফেলবে৷’
মেয়েটা ঘাড় নেড়ে দিল৷ বিনু এক পা হ্যান্ডেলের উপরে রেখে দেওয়ালের পাশের দিকটা দু-হাতে ধরে কোনওরকমে দাঁড়াল৷ তারপর একটা হাত সরিয়ে নিয়ে উপরে হাত বাড়িয়ে খাঁজটা ধরল৷ খুব একটা বেশি উঁচু নয় দেওয়ালটা৷ ফলে সেটা টপকে যেতে বেশি অসুবিধা হল না৷ শুধু উপর থেকে নীচে পড়তে পায়ে বেশ জোরে ঝাঁকুনি লাগল৷ হাঁটুটা ঠুকে গেল মাটিতে৷ মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে বিনু মেঝেতে বসে পড়ল৷
‘কী হল? লাগল পায়ে?’
সে হাঁটুতে হাত বোলাতে-বোলাতে বলল, ‘নাহ৷ চোট লেগেছে, আলোটা জ্বালাও৷’
সাথে-সাথে কাচের ওপাশ থেকে আলো এসে পড়ল৷ বিনু চারিদিক দেখতে-দেখতে বলল, ‘চোখ কোথায় আছে?’
‘নীচ থেকে দুই নম্বর ড্রয়ারে৷’ খানিক দূর এগিয়ে ড্রয়ারটা খুলে ফেলল বিনু, সাথে-সাথে গোটাদশেক চোখ গড়িয়ে-গড়িয়ে ড্রয়ারের শেষপ্রান্তে চলে এল৷ একবার দেখেই বেশ গা ঘিনঘিন করল বিনুর৷ ধীরে সুস্থে একটা চোখ তুলে ধরল সে, টর্চের সাদা আলোয় রং বোঝার উপায় নেই৷ গোটাচারেক মণি তুলে নিয়ে কাচের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর গলা তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘কোনগুলো নেব?’
মেয়েটা আর একটু এগিয়ে এল কাচের দিকে, তারপর টর্চটা ভালো করে বিনুর হাতের উপরে ফেলে বলল, ‘রং তো বোঝা যাচ্ছে না৷ দুটো দু-রকম হয় যদি?’
বিনু কিছু ভেবে পেল না৷ মেয়েটা টর্চ ধরে আছে বলে তার নিজের চেহারাটা দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু মাঝে-মাঝে টর্চটা হাত বদল করছে৷
‘উপরের ড্রয়ারে হ্যান্ড এলইডি আছে৷ রং বোঝা যাবে, নিয়ে এসো না একটু৷’
বিনু আর বাক্যব্যয় না করে তড়িঘড়ি উপরের ড্রয়ারটা খুলে বের করে আনল এলইডিটা৷ তারপর আবার ফিরে এল কাচের কাছে৷ এতক্ষণে টর্চের আলো নিভে গেছে৷ নিজের হাতের আলোটা জ্বালতেই আবার মেয়েটাকে দেখতে পেল বিনু৷ মাথা নীচু করে চোখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে সে৷ বিনু বলল, ‘এখানে তো নানারকম সাইজ আছে, কোন সাইজটা তোমার চোখে বসবে জানো?’
মেয়েটা মাথা নামিয়ে রেখেই নাড়ল মাথাটা৷ বিনু কী যেন ভেবে বলল, ‘আমি এখান থেকে উপর দিয়ে ছুঁড়ে ওপারে ফেলছি; লাগিয়ে দেখে নাও৷’
‘বেশ, আমি দাঁড়াচ্ছি ওখানে৷’
পুতুলের চোখে কালো মণি ভালো লাগে না৷ বিনু খানিক ভেবে নিয়ে দুটো নীল মণি উপরের ফাঁকটা দিয়ে ছুঁড়ে দিল ওপারে৷ সেগুলো গিয়ে পড়তে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল৷ সে আবার গলা তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘হয়েছে?’
কোনও উত্তর নেই৷ মিনিট তিনেক কেটে গেল, মেয়েটা যেন আবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে৷ বেশ বিরক্তি লাগল বিনুর, একটা জীবন্ত পুতুলের জন্যে এতক্ষণ অনেক হ্যাপা সয়েছে৷ দেওয়াল বেয়ে আবার উঠে আসতে যাচ্ছিল সে৷ এমন সময় কাচের কাছ থেকে আবার পায়ের আওয়াজ পেয়ে থমকে গেল৷
‘দেখ তো ঠিক লাগছে কি না…’
গলাটা শুনে আবার কাচের দিকে আলো ফেলল বিনু৷ একটু-একটু করে কাচের দিকে এগিয়ে আসছে মেয়েটা, তার চোখের অন্ধকার কোটর দুটোর জায়গায় এখন ঝলমল করছে দুটো উজ্জ্বল ঘন নীল চোখ৷ চোখের ঠিক উপরেই হাতে আঁকা ছবির মতো টানাটানা চোখের পাতা৷ মসৃণ মুখটা সাদা আলোয় চকচক করে উঠছে৷ দু-জনেই একটু-একটু করে কাচের দুই প্রান্তে এসে দাঁড়াল৷ নিষ্প্রাণ দুটো চোখের মণি অথচ কী অস্থির প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ছে সেখান থেকে৷ বিনু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে৷ তার একটা হাতে এলইডিটা ধরা আছে, অন্য হাতটা কাচের উপরে৷
‘ঠিক লাগছে এখন?’
‘একদম পারফেক্ট৷’
কয়েক সেকেন্ড পরে আলোটা নিভিয়ে নিল বিনু৷ তারপর সেটা হাতে নিয়ে উপরের ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে৷ মেয়েটা কাচের উপরেই পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ চোখ লাগানোর পরেও হয়তো মাথা তুলে তাকাতে সংকোচ হচ্ছিল তার৷ বিনু সেদিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘এবার নেক্সট টার্গেট কী?’
‘ওই যে বললাম, পা-টা সেলাই করব৷’
‘ও হ্যাঁ, তা সেটার জন্যে কোথায় উঠতে হবে?’
‘উঠতে হবে না৷ একটু পেড়ে দিতে হবে৷’
বিনু এতক্ষণে বুঝেছে মেয়েটা বেশি কথা বলে না৷ বা সে পুতুল বলে সংকোচে বেশি মুখ খুলতে চায় না৷ খুব ছোটবেলায় চাইল্ডস প্লে দেখেছিল বিন, তাতে একটা খেলনা পুতুল ছুরি দিয়ে মানুষ খুন করত৷ এখন এই লাজুক পুতুল বেশ অবাক করেছে তাকে৷
মেয়েটা আবার হাঁটতে শুরু করেছে৷ বিনু তার পিছু নিল৷ এবার কিন্তু আর বড়-বড় পা ফেলছে না মেয়েটা৷ মনে হল এতক্ষণ চোখ ছিল না বলে অস্বস্তিটাই তাকে তাড়াতাড়ি পা ফেলতে বাধ্য করছিল৷ এতক্ষণে হয়তো পায়ের কাটাটা বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে তার৷ কী করে যে কাটল সেটাই প্রশ্ন৷ তার থেকেও বড় কথা পুতুলের ভিতরে প্রাণ এল কী করে?
এমব্রয়ডারির জায়গাটা অনেকটা খোলামেলা৷ দিনের বেলা এখানটায় জামাকাপড় সেলাইয়ের কাজ চলে৷ অনেকে কেনা জামাকাপড় ছোট করাতে আসে, কেউ জিনসের তলা কাটাতে আসে৷ দু-দিকে দেওয়াল, একদিকটায় স্লাইডিং জানলা করা আছে৷ এখন জানলাটা একদিকে সরানো, ফলে বাইরে থেকে বেশ ঝরঝর করে হাওয়া আসছে৷
সেখানটায় এসে দাঁড়াল বিনু৷ হাতের আলোটার এই মুহূর্তে আর দরকার হচ্ছে না৷ বাইরে থেকে একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে মেঝেতে৷ পিছন থেকে আবার পায়ের শব্দ পেয়ে বিন বলল, ‘আচ্ছা, প্রথম কী স্মৃতি মনে পড়ছে তোমার?’
‘কিসের স্মৃতি?’
‘মানে ধর চোখ খোলার পরে প্রথম কী দেখেছিলে?’
মেয়েটা কিছু যেন মনে করার চেষ্টা করতে-করতে বলল, ‘প্রথমে সব অন্ধকার, মনে হল একটা বাক্সের ভিতরে শুয়ে আছি৷’
‘তার আগের কিছু মনে নেই?’
‘নাহ৷’
‘বেশ৷ তারপর?’
‘তারপর মনে হল একটু-একটু নড়ছে বাক্সটা৷ চারপাশে কেউ কথা বলছে, কথাগুলো বুঝতে পারলাম আমি৷ তারপর বাক্সের ঢাকনা খুলে গেল, একটা লম্বা লোক আমাকে কাঁধে করে এনে একটা দোকানের সামনে বসিয়ে দিয়ে গেল…’
‘হুম… তারপর থেকে এখানেই আছ?’
একটু এগিয়ে জানলার আরেক প্রান্তে এসে দাঁড়াল মেয়েটা৷ বাইরে রূপালি আলোয় ভরা ঘরবাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’
বিনু হাসল৷ বাড়িটা সত্যি এখান থেকে দেখা যায় বটে৷ এই শপিং মলের চারপাশে এখনও দোতলার বেশি বাড়ি ওঠেনি, ফলে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়৷ ভালো করে খানিকক্ষণ দেখে নিয়ে একটা বিশেষ দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বিনু বলল, ‘ওই যে, দোতলার ঘরে আলো জ্বলছে, ওখানে থাকি আমি৷’
মেয়েটা সেদিকে তাকিয়ে ভালো করে দেখতে-দেখতে বলল, ‘আলো জ্বলছে কেন?’
‘কুচির পরীক্ষা, তাই রাত জেগে পড়াশোনা করছে৷’
‘কুচি কে?’
‘আমার বোন৷ মা-বাবা নেই আমাদের৷ বাড়িটা ভাড়ার৷’
জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল মেয়েটা, তারপর চোখ তুলে তাকাল বিনুর দিকে৷ তার চকচকে চামড়ায় এখন রুপালি আলো এসে পড়েছে, নীলচে চোখের মণিদুটো টলটল করে কেঁপে উঠছে বারবার৷
‘এখানে সারারাত একা-একা কী কর?’
‘ডায়েরি লিখি৷’
‘কী লেখ ডায়েরিতে?’
‘এই রোজকার কথা৷ হাবিজাবি সারাদিন যা ঘটে৷’
‘আজকের কথা লিখবে?’
বিনু আর কিছু উত্তর দিল না৷ মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘সুতো হয়তো টেবিলে পাওয়া যাবে… আর সুচ…’
টেবিলের দিকে বেশ খানিকটা সরে এল সে৷ ‘ডায়েরিটা দেবে আমাকে?’
‘ডায়েরি!’ অবাক হয়ে গেল বিনু, ‘ডায়েরি দিয়ে কী হবে?’
‘রাতের দিকটা একটু আলো পেলে পড়ব, অন্য কাজ তো নেই…’
বিনু একটু হেসে বলল, ‘আমার টেবিলে আছে, ফেরার সময় দিয়ে দেব৷’
মেয়েটা জানলা ছেড়ে এগিয়ে এসে ঘরের ভিতরের দিকে খানিকটা হেঁটে গিয়ে বলল, ‘সরু সুচ দিয়ে হবে না, মোটা সুচ ওই উপরে রাখা আছে৷’
বিনু তাকিয়ে দেখল আলমারিটা ফুট ছয়েকের বেশি লম্বা হবে না৷ উপরে কতগুলো প্লাস্টিকের বাক্স রাখা আছে৷ একটু লম্বা মানুষ হলে মাটিতে দাঁড়িয়েই সেগুলো হাতে পাওয়া যায়৷ ধীরে-ধীরে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বাক্সগুলো নামিয়ে আনল বিনু৷ তারপর সেটা খুলে মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নিজে করতে পারবে না আমি করে দেব?’
একটু যেন লজ্জা পেল মেয়েটা, তার প্লাস্টিকের মুখে একটা মিহি হাসি ফুটে উঠল, ‘না না, আমি করে নেব৷’
‘যদি ব্যথা লাগে?’
‘যাহ, যার প্রাণ নেই তার আবার ব্যথা লাগে নাকি? সুতোটা পরিয়ে দেবে?’
সুচ আর সুতোটা হাতে নিয়ে এলইডিটা জ্বেলে জানলার দিকে এগিয়ে গেল বিনু৷ সুতোটা গলাতে-গলাতে বলল, ‘আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন আছে৷’
‘কী প্রশ্ন?’
‘বাক্সের মধ্যে যখন তোমার জ্ঞান ফিরল তখন চেঁচামিচি করনি তুমি? মানে তখনও তো জানতে না যে তুমি পুতুলের শরীরে…’
‘আমি তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি যে…’
‘কী বুঝতে পারনি?’
বিনুর দিকে একটু এগিয়ে এল মেয়েটা৷ তারপর হাতের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘সুতো পরানো হয়ে গেছে?’
সুতোটা এগিয়ে দিল বিনু৷ বলল, ‘তোমার যা করার করে নিয়ে এখান থেকে চলে যেও, আর যেন এখানে না দেখি৷’
কথাটা বলে বিনু হেঁটে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল মেয়েটা তাকে থামিয়ে দিল, ‘আরে চলে যাচ্ছ যে! তুমি না থাকলে হয় নাকি?’
বিনু একটু অবাক হয়ে যায়, ‘কেন? এই তো বললে তুমি নিজেই সেলাই করে নেবে৷’
মেয়েটা বিরাট নীল চোখে সুচটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বলল, ‘সেলাই তো আমিই করব, কিন্তু নিজেকে করব তো বলিনি…’
বিনু আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটার চকচকে প্লাস্টিকের বাঁ হাতটা উঠে এল৷ সেইসাথে চাঁদের আলোয় লিকলিকে সাপের মতো ঝলমল করে উঠল একটা ছুরির ফলা৷ পরমুহূর্তে বিনুর বুকে হৃৎপিণ্ডের ঠিক উপরে বসে গেল সেটা৷ রক্তের ফিনকি ছিটকে বেরিয়ে এল সেখান থেকে৷ আতঙ্ক আর যন্ত্রণার মাঝেও একটু আগে মেয়েটারই বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল বিনুর, ‘যাদের হার্ট থাকে তাদের শরীরে ঢুকতে পারি না আমি…’ খানিক পরে বিনুর রক্তাক্ত নিথর শরীরটা মাটির উপরে পড়ে যেতে একটু-একটু করে সেদিকে এগিয়ে গেল মেয়েটা৷ তার চকচকে মুখ এখন আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে নীলচে আভা৷ গুনগুন করে একটা গানও গাইছে৷ বিনুর শরীরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে৷ বুকের উপরে বিঁধে থাকা ছুরিটাকে একটানে তুলে নিয়ে একটু পাশে রেখে আবার বুকের উপর ঝুঁকে পড়ে৷ তার ঠোঁটের কোনায় একটু আগের সেই হাসিটা আবার ফিরে এসেছে…
সকালে মলে ঢোকার আগে একটু থমকে দাঁড়ালেন সমাজপতি৷ বাইরে কিছুদিন হল নতুন নাইটগার্ড বসেছে৷ লোকটার সাথে আলাপ করা হয়নি তার৷ পাশে তাকিয়েই নীল ইউনিফর্ম পরা লোকটাকে দেখতে পেলেন তিনি৷ দু-পা হেঁটে তার সামনে গিয়ে একটা ভারীক্কি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হে ছোকরা, চেনো আমাকে?’
‘আজ্ঞে না স্যার৷’ লোকটা থতমত খেয়ে উত্তর দিল৷
সমাজপতি আরেকটু সরু হাসি হেসে একটা হাত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কে.কে. সমাজপতি—এই কমপ্লেক্সের মালিক৷’
লোকটা হাত না ধরে ডানহাতটা কপালে ঠেকিয়ে মিলিটারি কায়দায় সেলাম করে বলল, ‘গুড মর্নিং স্যার৷’
‘হুম… তা শুনলাম আজ নাকি দেরি করে এসেছ, ব্যাপার কী হে?’
‘বাড়িতে বোন আছে স্যার৷ বায়না করছিল, শান্ত করে এলাম৷’
‘বেশ বেশ, দেখ রোজ যেন না হয়৷’
ভিতরে ঢুকতে গিয়েও থমকে যান সমাজপতি৷ লোকটার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, ‘আর আমাকে অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই৷ নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, রিল্যাক্স…’
বিনুর মুখে একটা লজ্জার হাসি খেলে যায়, জিভ কেটে বড় একটা শ্বাস নিয়ে সে বলে, ‘হেঁহেঁ… একদম ভুলে গেছিলাম স্যার…’
‘নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়! এ কে রে বাবা…’
সমাজপতি আর কথা না বাড়িয়ে ভিতরে ঢুকে যান৷ বিনু অল্প হেসে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়৷ একটু-একটু করে ভিড় বাড়ছে শপিং মলে৷ প্রত্যেকটা মানুষকে ভালো করে দেখতে থাকে সে…