ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৬৮–১৯৩৬) – যাঁর সাহিত্যকর্মের প্রধান উপজীব্য গণমানুষের কথা
এই নামেই তাঁর পরিচয়। পরিচয় সারা বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু এটা তাঁর আসল নাম নয়। আসল নাম আলেক্সি ম্যাক্সিমভিচ পেস্কভ। পিতৃদত্ত নামের পরিবর্তে তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়েছেন ছদ্মনামেই।
রুশ ভাষায় গোর্কি শব্দের অর্থ তিক্ত। কিন্তু এমন একটি তিক্ত অর্থবিশিষ্ট নাম তিনি কেন বেছে নিলেন, সেটাই রহস্য। আসলে এই নাম তিনি গ্রহণ করেছিলেন নিজের জীবনের তিক্ত পটভূমির বিচার থেকে। একেবারে শৈশব থেকেই তিনি এমন সব তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, যা তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে উঠে এসেছে তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, আত্মজীবনী, স্কেচধর্মী রচনাসহ প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে।
জন্ম তাঁর ১৮৬৮ সালে। রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরে নিঝনি নভগরদ শহরে। জন্মের পর মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই তিনি পিতৃহীন হন। মা নিজের সুখের পথ বেছে নেন দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। এদিকে অবাঞ্ছিত অনাথ বালক গোর্কি আশ্রিত হন তাঁর বদমেজাজি দাদুর কাছে। নির্দয় বলতে বা বোঝায়, তাঁর দাদু ছিলেন তা-ই। বালক গোর্কির সাথে তিনি কখনও ভাল আচরণ করতেন না। দুঃখ-কষ্ট আর নির্যাতন ছিল নিত্য সহচর। অবাঞ্ছিতের মতো, পরগাছার মতো বড় হতে লাগলেন তিনি এই নির্দয় দাদুর আশ্রয়ে। যে সময় পিতার স্নেহ আর মায়ের মমতাময় হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার কথা, সেই সময়েই বাঁচার তাগিদে তাঁকে করতে হয়েছে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম।
স্কুলে পড়ার সুযোগ গোর্কি জীবনে কখনোই পাননি। নিজের শহর নিঝনি নভোগরদের এক স্কুলে মাস কয়েক অনিয়মিত যাতায়াত করেছিলেন মাত্র। বিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন বলতে তাঁর ঐটুকুই।
বিদ্যালয়ের শিক্ষা তিনি না পেলেও পৃথিবীর রূঢ় বাস্তব জীবনকে খুব কাছে থেকে নিবিড় করে দেখার এবং শেখার সুযোগ তাঁর হয়েছিল। আর এই বাস্তব শিক্ষাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত ম্যাক্সিমোভিচ থেকে ম্যাক্সিম গোর্কি করে গড়ে তুলেছিল। ‘মা’ (Mother)- এর মতো অবিস্মরণীয় ও কালজয়ী উপন্যাস সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল তাঁকে।
ম্যাক্সিম গোর্কি প্রথম জীবনে জীবিকার তাগিদে অনেক কিছুই করেছিলেন। তাঁর যখন মাত্র আট বছর বয়স, তখনই দাদু স্কুলে তাঁর যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে তাঁকে লাগিয়ে দিয়েছিলেন কাজে। মুচির দোকানে, ছবি আঁকিয়ের দোকানে বয়গিরি, জাহাজের বাবুর্চির সহকারী—এমন সব কাজও করতে হয়েছে পেটের তাগিদে তাঁকে।
কিন্তু কোথাও মালিকের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাননি তিনি। সবখানেই তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন আর অত্যাচার। এত খাটুনি খেটেও তাঁকে প্রায়ই অনাহারে থাকতে হতো, শীতের রাত্রে জুটত না গরম কাপড়।
এ-ভাবেই তিনি বাস্তব জীবনকে অবলোকন করেছেন নিতান্ত শৈশব থেকেই। পরবর্তী জীবনে তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে এই জীবনেরই বাস্তব ছবি ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে।
গোর্কি যখন ভলগা নদীতে চলাচলকারী এক জাহাজের বাবুর্চির সহকারী, তখনই তাঁর জীবনে একটি সুযোগ আসে। আর সেটা হলো বই পড়ার সুযোগ। স্কুলে গিয়ে যে- বই পড়ার সুযোগ থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন, সেই সুযোগ তাঁর জীবনে এলো নতুন করে। আর এখান থেকেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেল। তাঁকে পেয়ে বসল বই পড়ার নেশায়।
তারপর জাহাজের কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি কাজ নিলেন কাজান শহরে এক রুটির দোকানে। এখানে তিনি নিজের হাতে রুটি বানাতেন আর সারাদিন পরিশ্রমের পরে ঘরে ফিরে শুরু হতো বইয়ের পর বই পড়া।
ম্যাক্সিম গোর্কির সময়ে রাশিয়ায় ছিল জারের রাজত্বকাল। চারদিকে রাজতন্ত্রের অত্যাচার ও কঠোর শাসন। কিন্তু এরই মধ্যে গোপনে সমাজসচেতন কিছু কিছু মানুষ জারশাসনের অবসানের জন্য চেষ্টা করছিলেন। ম্যাক্সিম গোর্কিও এসব সমাজসচেতন লোকদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ পান। আর তখন থেকেই তিনিও ভাবতে শুরু করেন সমাজকে বদলে দেবার কথা।
তাঁর বয়স যখন একুশ বছর, তখন তিনি কাজান শহরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শুরু করেন ভবঘুরের জীবনযাপন। ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন দক্ষিণ রাশিয়ার নানা অঞ্চল। সেখানে যে কাজ জুটত, সুযোগ পেলে তা করতেন, আর ঘুরে বেড়াতেন মনের খুশিতে। দুচোখ ভরে দেখতেন চারপাশের জীবনকে।
ঠিক এই সময় থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন। ১৮৯৫ সালে পিটার্সবার্গ থেকে প্রকাশিত একটি কাগজে সর্বপ্রথম ‘চেলকাশ’ নামে তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়। এই একটি গল্পে জন্যই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এর পর থেকেই শুরু হয় তাঁর প্রকৃত লেখকজীবন। তাঁর গল্পে উঠে আসে কলকারখানার নির্যাতিত কুলি-মজুর, খেতের চাষী, পথের ক্ষুধার্ত ভিখারি আর ভবঘুরেদের জীবন কাহিনী।
এদের গল্প নিয়েই একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর গল্প, নাটক, উপন্যাস। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। বহু বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদার’ (মা)। এই উপন্যাসেই তিনি দেখিয়েছেন কেমন করে একজন অশিক্ষিত মা সত্যকে ভালবেসে, মানুষকে ভালবেসে, ধীরে ধীরে অলক্ষে নিজেও একজন বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। এই কালজয়ী উপন্যাসটি বিশ্বে বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
বিপ্লবাত্মক সাহিত্য রচনা করতে করতে গোর্কি নিজেও একসময় জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির সাথে। তিনি একটি পত্রিকা প্রকাশ করে বিপ্লবের বাণী প্রচার করতে শুরু করেন। ফলে সরকারের কোপানলের শিকার হয়ে কারারুদ্ধ হন তিনি।
তাঁর এই গ্রেফতার নিয়ে চারদিকে প্রচণ্ড প্রতিবাদ উঠলে জার সরকার অবশেষে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯০৫ সালে গোর্কি বিপ্লবে প্রধান ভূমিকা পালনের জন্য আবারও কারারুদ্ধ হন। কিন্তু প্রতিবাদের মুখে সরকার আবারও তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু জেল থেকে মুক্তি দিলেও পরের বছর অর্থাৎ ১৯০৬ সালে তাঁকে সরকার দেশত্যাগে বাধ্য করে। তারপর ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় বিপ্লব সফল হলে এবং জারশাসনের অবসান ঘটলে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন।
১৯৩৬ সালে এই মহান বিপ্লবী সাহিত্যসাধকের জীবনাবসান ঘটে। কিন্তু তিনি মৃত্যুর আগেই রাশিয়ার শ্রেষ্ঠ লেখকের সম্মান অর্জন করেছিলেন। শুধু জীবিতকালেই নয়, মৃত্যুর পরেও আজও তিনি সারা বিশ্বে সমানভাবে জনপ্রিয়।
তাঁর প্রতি সম্মান দেখিয়ে সাবেক সোভিয়েত সরকার ১৯৩২ সালে (তাঁর জীবিতকালেই) তাঁর জন্ম-শহর নিঝনি নভোগরদের নতুন নামকরণ করে রাখেন গোর্কি। আজও এই শহরটি এই নামেই পরিচিত।