শ্বেতহস্তী চুরির কাহিনী
The Stolen White Elephant
০১.
[এই রচনাটি A Tramp Abroad গ্রন্থ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল, কারণ মনে হয়েছিল যে এর কোন কোন বিবরণ অতিরঞ্জিত এবং কোনটা অসত্য। এই আশংকা যখন অমূলক প্রমাণিত হল ততদিনে বইটি ছাপতে চলে গিয়েছিল। এম. টি.]
রেলের জনৈক সহযাত্রী আমাকে এই বিচি ত্ৰ কাহিনীটি বলেছিল। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের উপরে; তার শান্ত ভদ্র মুখমণ্ডল আর আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণে তার মুখনিসৃত প্রতিটি কথাই আমার কাছে অভ্রান্ত সত্য বলে মনে হয়েছিল। সে বলেছিলঃ
আপনি তো জানেন শ্যামদেশের রাজকীয় শ্বেত হস্তীকে সে দেশের মানুষ কত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। আপনি জানেন সে হাতি রাজার কাছেও পবিত্র বস্তু, একমাত্র রাজাই সে হাতি রাখতে পারে, আর এক অর্থে সে রাজার চাইতেও বড়, কারণ সে হাতি শুধু সম্মানই পায় না, পূজাও পায়। খুব ভাল কথা; পাঁচ বছর আগে গ্রেট বৃটেন ও শ্যামের মধ্যে যখন সীমান্ত নিয়ে গোলযোগ দেখা দিল, তখন স্পষ্টই বোঝা গেল যে শ্যামেরই দোষ। সঙ্গে সঙ্গেই সব রকম ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয়ে গেল; বৃটিশ প্রতিনিধি জানালেন, তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন, কাজেই অতীতের সবকিছু ভুলে যাওয়া উচিত। শ্যামের রাজা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এবং কিছুটা কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ, আর কিছুটা হয় তো ইংলণ্ডের মনে যদি তখনও কিছুটা অসন্তোষ থেকে থেকে সেটা মুছে ফেলবার জন্য রাজার মনে বাসনা হল রাণীকে একটি উপহার পাঠাবেন-প্রাচ্য দেশীয়দের ধারণা, শত্রুকে প্রসন্ন করবার সেটাই একমাত্র নিশ্চিত উপায়। সে উপহার শুধু রাজকীয় হলেই চলবে না, সর্বতোভাবে রাজার উপযোগী হওয়া চাই। সুতরাং শ্বেতহস্তী ছাড়া আর কোন্ উপহার সে মর্যাদার অধিকার হতে পারে? ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে আমার পদমর্যাদা বিবেচনা করে আমাকেই মহামান্য রাণীর কাছে সেই উপহার বহন করে নিয়ে যাবার সম্মান লাভের উপযুক্ত বলে মনে করা হল। আমি, আমার ভৃত্যাদি, অফিসারবর্গ ও হাতির পরিচারকদের জন্য একটা জাহাজের ব্যবস্থা করা হল। যথাসময়ে নিউ ইয়র্ক বন্দরে পৌঁছে জার্সি শহরের একটা চমৎকার বাড়িতে রাজ-অতিথিকে রাখা হল। নতুন করে যাত্রা শুরু করবার আগে হাতিটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সেখানেই কিছুদিন অপেক্ষা করতে হল।
এক পক্ষকাল বেশ ভালই কাট ল-তারপরেই শুরু হল আমার বিপদ। সাদা হাতিটা চুরি গেল! গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে এই ভয়ংকর দুর্ভাগ্যের কথা আমাকে জানানো হল। ত্রাসে ও উৎকণ্ঠায় কয়েক মুহূর্ত একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়লাম; আমি তখন বড়ই অসহায়। তারপর শান্ত হয়ে ভাবতে বসলাম। অচিরেই পথ খুঁজে পেলাম-বস্তুত, একজন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে একটি মাত্র পথই খোলা ছিল। অনেক রাত হলেও তৎক্ষণাৎ নিউ ইয়র্ক চলে গেলাম এবং একজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের সদর দপ্তরে হাজির হলাম। সৌভাগ্যক্রমে যথাসময়েই সেখানে হাজির হলাম, কারণ গোয়েন্দাবাহিনীর প্রধান বিখ্যাত ইন্সপেক্টর ব্লান্ট তখন বাড়ি যাবার জন্য প্রস্তু হচ্ছিলেন। মাঝারি উচ্চ তার শক্ত-সমর্থ লোকটি; যখনই গভীরভাবে কোন কিছু চিন্তা করেন তখনই তার ভুরু দুটো জুড়ে যায়, আর চিন্তিতভাব আঙুল দিয়ে কপালে টোকা মারতে থাকেন; তখন তাকে দেখলেই আপনার মনে হবে যে যার সামনে। আপনি দাঁড়িয়েছেন তিনি যে-সে লোক নন। তাকে দেখামাত্রই নিজের উপর বিশ্বাস ফিরে পেলাম; মনে আশা জাগল। সব কথা বললাম। তিনি মোটেই ব্যস্ত হলেন না; আমি যদি বলতাম যে কেউ আমার কুকুরটা চুরি করেছে তাহলে তার মনের যে ভাব হত এই সংবাদ শুনে তার কঠোর আত্মসংযমে তার চাইতে বেশী কিছু পরিবর্তন দেখা গেল না। ইঙ্গিতে একটা আসন দেখিয়ে তিনি শান্তভাবে বললেন:
দয়া করে এক মিনিট আমাকে ভাবতে দিন।
এই কথা বলে টেবিলের সামনে বসে তিনি হাতের উপরমাথাটা রাখলেন। ঘরের অপর কোণে কয়েকজন করণিক কাজ করছিল; পরবর্তী ছ সাত মিনিট ধরে তাদের কলমের খস্-খস্ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলাম না। ইন্সপেক্টর একইভাবে চিন্তায় ডুবে রইলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি মাথা তুললেন। তার মুখের কঠিন রেখাগুলো দেখেই বুঝতে পারলাম যে তার মস্তিষ্কের কাজ সমাধা হয়েছে-পরিকল্পনা প্রস্তুত। তিনি কথা বললেন–গলার স্বর নীচু, অথচ জোরালো:
ঘটনাটা সাধারণ নয়। প্রতিটি পা সতর্কভাবে ফেলতে হবে; পরবর্তী পদক্ষেপের আগে প্রথম পদক্ষেপ সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে হবে। গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে-গভীর ও পরিপূর্ণ গোপনীয়তা। এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলবেন না-এমনকি সংবাদপত্রের প্রতিবেদকদেরও নয়। তাদের ভার আমি নেব; তারা যেটুকু জানলে আমার কাজের সুবিধা হবে শুধু সেইটুকুই তারা জানবে। ঘণ্টায়। হাত দিলেন; একটি যুবক এল। আলারিক, প্রতিবেদকদের আপাতত অপেক্ষা করতে বল। ছেলেটি চলে গেল। এবার কাজের কথায় যাওয়া যাক-একের পর এক। কঠোর পুংখানুপুংখ পদ্ধতি ছাড়া আমার এ কাজে কিছুই করা যায় না।
একটা কলম ও কাগজ নিলেন। এবার-হাতিটার নাম?
হাসান বেল আলি বেন সেলিম আব্দাল্লা মহম্মদ মুসে আলহাম্মাল জামসেৎজেজিভয় দিলীপ সুলতান এবু ভুদপুর।
খুব ভাল। ডাক নাম?
জাম্বো।
খুব ভাল। জন্মস্থান?
শ্যামের রাজধানী শহর।
বাপ-মা বেঁচে আছে?
না-মৃত।
এটি ছাড়া তাদের আর কোন সন্তান ছিল?
না। এটি একমাত্র সন্তান।
খুব ভাল। এই খাতে এগুলিই যথেষ্ট। এবার দয়া করে হাতিটার বর্ণনা দিন; যত তুচ্ছই হোক-মানে, আপনার দিক থেকে তুচ্ছ-কোন বিবরণই বাদ দেবেন না। আমার পেশার যারা লোক তাদের কাছে তুচ্ছ বিবরণ বলে কিছু নেই; থাকতে পারে না।
আমি বললাম-তিনি লিখে নিলেন। আমার বলা শেষ হলে বললেন:
এবার শুনুন। আমি কোন ভুল করে থাকলে সংশোধন করে দেবেন।
তিনি পড়তে লাগলেন:
উচচতা ১৯ ফুট; মাথার সীমানা থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২৬ ফুট; শুড়ের দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট; লেজের দৈর্ঘ্য ৬ ফুট; শুড় ও লেজ সমেত মোট দৈঘ্য ৪৮ ফুট; দাঁতের দৈর্ঘ্য সাড়ে নয় ফুট; কান দুটি এই মাপের অনুপাতিক; বরফের মধ্যে একটা পিপে উপুড় করলে যে রকম দেখায় পায়ের ছাপ সেই রকম; গায়ের রং একঘেয়ে সাদা; অলংকার পরবার জন্য প্রত্যেক কানে প্লেটের আকারে একটি করে গর্ত আছে; দর্শকদের গায়ে জল ছিটিয়ে দেবার এবং পরিচিত-অপরিচিত সকলের সঙ্গেই শুড় দিয়ে খারাপ ব্যবহার করবার অভ্যাসট। বেশী মাত্রায় আছে; ডান দিকের পিছনের পা-টা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে, আর এক সময়ে ফোঁড়া হওয়ার ফলে বাঁ দিকের বগলে একটা ছোট দাগ আছে; চুরি যাবার সময় পনেরো জন বসবার মত আসনসহ একটা হাওদা ছিল, আর সাধারণ কার্পেটের মাপের সোনালী কাপড়ের জিন পাতা ছিল।
কোন ভুল ছিল না। ইন্সপেক্টর ঘণ্টায় হাত দিলেন। আলারিকের হাতে বিবরণটা দিয়ে বললেন:
এখনই এটার পঞ্চাশ হাজার কপি ছাপিয়ে এই মহাদেশের প্রতিটি গোয়েন্দা-আপিসে ও দালালদের দোকানে ডাকযোগে পাঠিয়ে দাও। আলারিক চলে গেল। এই তো-এ পর্যন্ত তো হল। এরপর আমার চাই ঐ মালের একটি ফটোগ্রাফ।
দিলাম। ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বললেন:
এর চাইতে ভাল কিছু যখন নেই, তখন এতেই চলবে। কিন্তু শু ডুটা বেঁকিয়ে মুখের মধ্যে ভরা আছেএটা দুর্ভাগ্যের বিষয়; ভুল ধারণার সৃষ্টি হতে পারে, কারণ সে তো স্বাভাবিকভাবে ঐ অবস্থায় থাকে না। আবার ঘণ্টায় হাত দিলেন।
আলারিক, সকালে তোমার প্রথম কাজই হবে এই ফটোগ্রাফের পঞ্চাশ হাজার কপি ছাপিয়ে বিবরণ-সম্বলিত কাগজের সঙ্গেই ডাকে দেওয়া।
আলারিক হুকুম তামিল করতে চলে গেল। ইন্সপেক্টর বলল:
অবশ্য একটা পুরস্কারও ঘোষণা করা দরকার। তার অংকটা কত হবে?
আপনি কত বলেন?
শুরুতেই বলছি-তা, পাঁচ শ হাজার ডলার। খুবই জটিল ও কঠিন কাজ। পালিয়ে যাবার ও লুকিয়ে থাকবার হাজার পথ ও সুযোগ খোলা আছে। সর্বত্র এই চোরদের বন্ধু ও ওস্তাদরা আছে-
আচ্ছা, তারা কে তা কি জানেন?
সেই সতর্ক মুখ মনের চিন্তা ও ভাবকে গোপন করতেই অভ্যস্ত, সে মুখ দেখে কোন হদিস পেলাম না; শান্তভাবে উচ্চারিত যে কথাগুলি বললেন তা থেকেও কিছু বুঝতে পারলাম না। বললেন:
ও সব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। আমি জানতেও পারি, আবার নাও পারি। কাজের ধরণ ও আকাংখিত শিকারের চেহারা থেকেই আমরা সাধারণত প্রার্থিত লোকটি সম্পর্কে একটা ধারণা করে থাকি। একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে এ ক্ষেত্রে কোন পকেট মার বা ছিঁচকে চোরকে নিয়ে আমাদের কারবার নয়। কোন শিক্ষানবীশ এ মালকে তুলে নিয়ে যায় নি। কিন্তু, যে কথা বলছিলাম, যে পরিমাণ পথে হাঁটাহাঁটি করতে হবে এবং চোরের দল যেতে যেতে যে রকম পরিশ্রমের সঙ্গে তাদের চলার সব চিহ্ন মুছে দিয়ে যাবে, তাতে পঁচিশ হাজার পাউণ্ড হয় তো কিছুটা অল্পই হবে, তবু ঐ দিয়েই শুরু করা যেতে পারে বলেই আমি মনে করি।
কাজেই শুরুতে ঐ টাকাই স্থির হল। তখন তিনি বললেন:
গোয়েন্দাগিরির ইতিহাসে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ক্ষুধার বিশেষত্ব বিচার করেই অনেক সময় অপরাধীদের ধরা হয়েছে। তাহলে, এই হাতিটা কি খায়, এবং কতটা খায়?
দেখুন, কি খায় যদি বলেন-তো সব কিছুই খায়। সে মানুষ খাবে, বাইবল খাবে-মানুষ থেকে আরম্ভ করে বাইবল পর্যন্ত সব কিছু খাবে।
ভাল-সত্যি খুব ভাল, তবে বড়ই সাধারণ। বিস্তারিত বিবরণ দরকার-আমাদের পেশায় বিস্তারিত হচ্ছে একমাত্র মূল্যবান বস্তু। ঠিক আছে-মানুষের কথাই ধরা যাক। একবারে অথবা আপনার যদি সুবিধা হয় তো সারাদিনে-তাজা মানুষ সে কজন খেতে পারে?
তাজা কিনা তাতে তার কিছু যায়-আসে না; একবারে পাঁচটি সাধারণ মানুষকে সে খেতে পারে।
খুব ভাল; পাঁচ জন; তাই লিখে নিচ্ছি। কোন্ জাতির মানুষ তার পছন্দ?
জাতির ব্যাপারে সে নির্বিকার। পরিচিত লোকজনই তার পছন্দ, কিন্তু অপরিচিত লোকেও তার আপত্তি নেই।
খুব ভাল। এবার বাইবলের কথা। একবারে কতগুলি বাইবল খেতে পারে?
একটা পুরো সংস্করণই খেতে পারে।
এটা যথেষ্ট পরিষ্কার হল না। আপনি কি সাধারণ অক্টোভোর কথা বলছেন, নাকি চিত্রসম্বলিত পারিবারিক সংস্করণের কথা বলছেন?
মনে হয় ছবি-টবির ব্যাপারে সে নিস্পৃহ; অর্থাৎ সাধারণ ছাপার চাইতে ছবিকে সে বেশী দাম দেবে না।
না, আমার কথাটা আপনি ধরতে পারেন নি। আমি বলতে চাইছি আয়তনের কথা। সাধারণ অক্টোভো বাইবলের ওজন হয় আড়াই পাউণ্ডের মত, আর চি এসম্বলিত বড় কোয়ার্টা সংস্করণের ওজন হয় দশ থেকে বারো পাউন্ড। কখানা ডোরে বাইবল সে একবারে খেতে পারে?
হাতিটাকে চিনলে আপনি এ প্রশ্ন করতেন না। যা দেবেন তাই সে খেয়ে নেবে।
দেখুন, ডলার আর সেটের হিসাবে বলুন। আমাদের তো একটা আন্দাজ করতে হবে। রুশীয় চামড়ায় মাপমত বাঁধানো ডোরে-সংস্কারণ একখানা বইয়ের দাম একশ ডলার।
তাহলে তার খাবার খরচ পড়বে পঞ্চাশ হাজার ডলারের মত-ধরুন পাঁচ শ, বইয়ের একটি পুরো সংস্করণ।
এটা অনেকটা সঠিক কথা। লিখে নিচ্ছি। ঠিক আছে; মানুষ ও বাইবল দুইই তার পছন্দ; খুব ভাল কথা। আর কি খায়? আমি চাই বিস্তারিত বিবরণ।
সে বাইবল ফেলে ইট খাবে, ইট ফেলে বোতল খাবে, বোতল ফেলে কাপড় খাবে, কাপড় ফেলে বিড়াল খাবে, বিড়াল ফেলে ঝিনুক খাবে, ঝিনুক ফেলে শুয়োর খাবে, শুয়োর ফেলে চিনি খাবে, চিনি ফেলে শুটি খাবে, শুটি ফেলে আলু খাবে, ভূষি ফেলে খড় খাবে, খড় ফেলে খই খাবে, খই ফেলে চাল খাবে, কারণ প্রধানত চাল খেয়েই সে বড় হয়েছে। একমাত্র ইওরোপের মাখন ছাড়া হেন জিনিস নেই যা সে খাবে না, আর একবার স্বাদ পেলে সে জিনিসও সে খাবে।
খুব ভাল। খাদ্যের সাধারণ পরিমাণ-ধরুন মোটামুটি–
তা সিকি থেকে আধ টন।
আর পানীয় কি চলে-
যে কোন তরল পদার্থ। দুধ, জল, হুইস্কি, ঝোলাগুড়, ক্যাস্টর ওয়েল, ক্যাম্ফিন, কার্বলিক এসিড়–অত কথা বলে কি হবে; যা কিছু তরল পাবেন, সামনে ধরে দেবেন। একমাত্র ইওরোপীয় কফি ছাড়া যে কোন তরল পদার্থই সে পান করে।
খুব ভাল। পরিমাণটা কি?
তা পাঁচ থেকে পনেরো পিপে ধরে রাখুন-তার তেষ্টার কম-বেশী আছে, যদিও খাবার বেলায় সেটা নেই।
এ সব কিছুই বেশ অসাধারণ। তাকে খুঁজে পাওয়ার পক্ষে এগুলো বেশ ভাল সূত্র হওয়া উচিত।
সে ঘণ্টায় হাত দিল।
আলারিক, ক্যাপ্টেন বার্ণসসকে ডাক।
বার্ণস্ এল। ঈন্সপেক্টর ব্লান্ট বিস্তারিতভাবে সব কথা খুলে বলল। তারপর স্পষ্ট, স্থিরসিদ্ধান্ত সূচক সুরে আদেশের ভঙ্গীতে বলল: ক্যাপ্টেন বার্ণস, গোয়েন্দা জোন্স, ডেভিস, হাসলি, বেটস্ ও হ্যাকেট কে হাতির খোঁজে পাঠিয়ে দিন।
হ্যাঁ স্যার।
গোয়েন্দা মোজেস, ডাকিন, মারফি, রোজার্স, টু প্পার, হিগিন্স ও বার্থোলোমিউকে পাঠান চোরদের খোঁজে।
হ্যাঁ স্যার।
যেখান থেকে হাতিটা চুরি গেছে তার চারদিকে কড়া পাহাড়া বসান-বাছাই ত্রিশ জনের রক্ষীদল আর ত্রিশ জনের রিলিফ দল; দিন রাত তারা খাড়া পাহাড়ায় থাকবে; একমাত্র সংবাদপত্রের প্রতিবেদক ছাড়া আমার লিখিত অনুমতি ব্যতীত কাউ কে সেখানে যেতে দেবে না।
হ্যাঁ স্যার।
রেলওয়ে, স্টীমার ও ফেরিঘাটে এবং জার্সি সিটি থেকে বের হবার সব বড় রাস্তায় সাদা পোশাকের গোয়েন্দা মোতায়েন করুন; তাদের উপর নির্দেশ দিন-যে কোন সন্দেহভাজন লোককেই যেন তল্লাসী করা হয়।
হ্যাঁ স্যার।
হাতিটা ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ আটক করে টেলিগ্রাম করে যেন আমাকে খবর পাঠানো হয়।
হ্যাঁ স্যার।
জন্তুটি র পায়ের ছাপ বা ঐ ধরনের যে কোন সূত্র পেলেই তৎক্ষণাৎ আমাকে খবর দিতে হবে।
হ্যাঁ স্যার।
হুকুম জারী করে দিন, বন্দর-পুলিশ যেন সারা উপকূল জুড়ে সতর্কতার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
হ্যাঁ স্যার।
উত্তরে কানাডা পর্যন্ত, পশ্চিমে ওহিয়ো পর্যন্ত, দক্ষিণে ওয়াশিংটন পর্যন্ত রেলপথের সর্বত্র সাদা পোশাকের গোয়েন্দ পুলিশ পাঠান।
হ্যাঁ স্যার।
টেলিগ্রাফের যে কোন সংবাদ ধরবার জন্য সব টেলিগ্রাফ আপিসে বিশেষজ্ঞ বসান; যে কোন সাংকেতিক তার-বার্তা যেন তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
হ্যাঁ স্যার।
এ সবই যেন করা হয় অত্যন্ত গোপনে-মনে রাখবেন, অতীব দুর্ভেদ্য গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে।
হ্যাঁ স্যার।
যথাসময়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সব জানাবেন।
হ্যাঁ স্যার।
যান!
হ্যাঁ স্যার।
সে চলে গেল।
ইন্সপেক্টর ব্লান্ট কিছুক্ষণ চুপচাপ চিন্তা করল। ধীরে ধীরে তার চোখের আগুন ঠাণ্ডা হতে হতে মিলিয়ে গেল। তারপর আমার দিকে ঘুরে শান্ত স্বরে বলল:
আমি গর্ব করি না, গর্ব করা আমার স্বভাব নয়; কিন্তু-হাতিটাকে আমরা খুঁজে বের করবই।
সাদরে করমর্দন করে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। লোকটিকে যত দেখছি ততই তাকে ভাল লাগছে, ততই তাকে প্রশংসা করতে ইচ্ছা করতে, ততই তার কাজের রহস্যময় বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ছি। তারপর আমরা রাতের মত বিদায় নিলাম; যে মন নিয়ে তার আপিসে ঢুকেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশী খুসি মন নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলাম।
.
০২.
পরদিন সকালে সব কথাই খবরের কাগজে প্রকাশিত হল-পুংখানুপুংখ বিবরণসহ। কিছু কিছু যোগ করাও হয়েছে-কি ভাবে ডাকাতিটা হল, সে ডাকাত কারা, ডাকাতির মাল নিয়ে তারা কোন্ দিকে সরে পড়েছে, সে সম্পর্কে গোয়েন্দা অমুক, গোয়েন্দা তমুক ও গোয়েন্দা শমুক-এর নানাবিধ থিয়োরি। এ রকম এগারোটা থিয়োরি ছাপা হয়েছে, আর তাতেই সব রকম সম্ভাবনার কথা বলা হয়ে গেছে। এই একটি মাত্র ঘটনা থেকেই বোঝা যায় গোয়েন্দাদের চিন্তাধারা কত স্বাধীন। কোন দুটো থিওরি এক রকম নয়। এমন কি একটি বিশেষ ব্যাপার ছাড়া তাদের মধ্যে কোন সাদৃশ্যও নেই; আর সেই একটি ব্যাপারে এগারোটি থিয়োরিই একমত। সেই একটি ব্যাপার হল–যদিও আমার তাঁবুর পিছন দিকটা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে এবং তার একমাত্র দরজাটা তালাবন্ধই রয়েছে, তবু সে ছেঁড়া জায়গা দিয়ে হাতিটাকে বের করে নেওয়া হয় নি, নেওয়া হয়েছে অন্য কোন (অনাবিস্কৃত) পথে। সকলেই একমত যে গোয়েন্দাদের ভুলপথে চালাবার জন্যই ডাকাতরা তাঁবুটাকে ছিঁড়ে রেখে গেছে। হয় তো এ সত্যটা আমার মনে বা অন্য কোন সাধারণ লোকের মনেই উঠত না, কিন্তু মুহূর্তের জন্যও তারা গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিতে পারে নি। কাজেই, যে ব্যাপারে কোন রকম রহস্যই নেই বলে আমার মনে হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে সেখানেই আমি ভুল করেছিলাম সব চাইতে বেশী। এগারোটা থিয়োরির সবগুলোতেই সম্ভাবিত ডাকাতদের নাম বলা হয়েছে, কিন্তু দুটো থিয়োরিতেই একই ডাকাতদলের নাম করা হয় নি; এ ধরনের সন্দেহজনক লোকের সংখ্যা মোট সাঁইত্রিশ। বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিবরণের শেষেই প্রকাশ করা হয়েছে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান অভিমতটি–সে অভিমত প্রধান ইন্সপেক্টর ব্লান্ট–এর। তার বিবৃতির একটি অংশ নিম্নরূপ:
গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কর্তা দুজন প্রধান পাণ্ডা অর্থাৎ ইট ডাফি ও লাল ম্যাকফাডেনকে চেনেন। ডাকাতি হওয়ার দুদিন আগেই তিনি এরকম একটা প্রচেষ্টার কথা জানতে পেরেছিলেন এবং চুপিচুপি এই দুই কুখ্যাত শয়তানের পিছু নিয়েছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঘটনার দিন রাতে তাদের খোঁজটা হারিয়ে যায় এবং পুনরায় সেটা ফিরে পাবার আগেই পাখি উড়ে গেছে-অর্থাৎ হাতি উধাও।
ডাফি ও ম্যাকফাডেন এ কাজের দুই দুঃসাহসিক বদমাশ; আমাদের প্রধানের বিশ্বাস করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে গত শীতকালে এক তীব্র শীতের রাতে এরা দুজনই গোয়েন্দা হেড কোয়ার্টার থেকে স্টোভটা চুরি করেছিল-আর তার ফলেই প্রধান ও উপস্থিত অন্যসব গোয়েন্দাই কেউ ঠাণ্ডায় জমাট পা নিয়ে, কেউ জমাট আঙুল, কান বা অন্য অঙ্গ নিয়ে সকালের আগেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন বাধ্য হয়েছিল।
বিবরণের প্রথম অংশ পড়েই এই আশ্চর্য লোকটির বিস্ময়কর দূরদর্শিতায় আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সে যে শুধু বর্তমানকেই সম্পষ্ট চোখে দেখতে পায় তাই নয়, ভবিষ্যৎকেও তার দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখা যায় না। অচিরেই তার আপিসে গিয়ে জানালাম, আমার ইচ্ছা এই লোকগুলিকে গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করে অধিক গোলযোগ ও ক্ষতির পথ বন্ধ করা হোক; কিন্তু যে জবাব পেলাম সেটা যেমন সরল তেমনই তর্কাতীত।
অপরাধ বন্ধ করা আমাদের এক্তিয়ার নয়, আমাদের কাজ অপরাধীর শাস্তি বিধান করা। কিন্তু অপরাধ না ঘটা পর্যন্ত তো আমরা শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারি না।
আমি বললাম, যে গোপনীয়তা নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম, সংবাদপত্রগুলো তো সে সবই পণ্ড করে করে দিয়েছে; শুধু ঘটনাবলীই নয়, আমাদের সব ফন্দি-ফিকিরও প্রকাশ পেয়ে গেছে; এমন কি সন্দেহজনক লোকগুলোর নাম পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে; ফলে তারা হয় তো ছদ্মবেশ নেবে, আর না হয় তো গা-ঢাকা দেবে।
তা দিক। সময় যখন হবে তখন নিয়তির অমোঘ হাতের মতই আমার হাতও যে কোন গোপন স্থানে তাদের উপর ঠিকই নেমে আসবে। আর সংবাদপত্রের কথা? তাদের সঙ্গে মানিয়েই আমাদের চলতে হবে। যশ, খ্যাতি, প্রকাশ্যে অবিরাম নাম-ঘোষণা-একজন। গোয়েন্দার পক্ষে এইগুলিই তো রুটি–মাখনের মত। কিছু ঘটনা তাকে প্রকাশ করতেই হবে, অন্যথায় লোকে ভাববে তার হাতে কোন ঘটনাই নেই; তার থিয়োরিও অবশ্য প্রকাশ করতে হবে, কারণ একজন গোয়েন্দার থিয়োরির মত আশ্চর্য ও আকর্ষণীয় আর কিছু নেই, আর এই থিয়োরিই তাকে এনে দেয় বিস্ময়কর সম্মান কাজের পরিকল্পনাও প্রকাশ করতেই হয়, কারণ পত্রিকাগু লি তাই চায়, আর না দিলে তাঁরা গোঁসা করে। আমরা কতদূর কি করছি সেটা জনসাধারণকে সব সময়ই জানাতে হবে, নইলে তারা মনে করবে যে আমরা কিছুই করছি না। কোন সংবাদপত্র কড়া বলবে, বা তার চাইতেও যেটা খারাপ, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করব; তার চাইতে তারা যদি লেখে, ইন্সপেক্টর ব্লান্ট–এর সুকৌশলী ও অসাধারণ থিয়োরিটা এই রকম, তাহলে সেটাই তো শুনতে অনেক ভাল লাগে।
আপনার কথার সারবত্তা আমি ধরতে পেরেছি। কিন্তু এটাও আমার চোখে পড়েছে যে আজ সকালেই কোন একটা কাগজে বেরিয়েছে। যে একটি ছোট খাট বিষয়ে কোন মতামত প্রকাশ করতে আপনি অস্বীকার করেছেন।
হ্যাঁ, ওটা আমরা সব সময়ই করে থাকি; এরও একটা ভাল ফল আছে। তাছাড়া, ও বিষয়ে এখনও আমি কোন মতামতই গড়ে তুলি নি।
চলতি খরচ পত্র বাবদ ইন্সপেক্টরের হাতে বেশ মোটা টাকা জমা দিয়ে খবরের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকলাম। আশা করেছিলাম, যে কোন মুহূর্তেই টেলিগ্রাম আসতে শুরু করবে। ইতিমধ্যে আবার নতুন খবরের কাগজগুলো ও আমাদের ঘোষণাপত্রগুলো পড়তে লাগলাম। তা থেকেই বুঝতে পারলাম, পঁচিশ হাজার ডলারের পুরস্কারটা শুধু গোয়েন্দাদেরই দেওয়া হবে। আমি বললাম, আমার ধারণা ছিল যে কেউ হাতিটাকে ধরে দিতে পারবে পুরস্কারটা তাকেই দেওয়া হবে। তখন ইন্সপেক্টর বলল:
গোয়েন্দারাই তো হাতিটাকে খুঁজে বের করবে, কাজেই পুরস্মরও ঠিক জায়গায়ই যাবে। অন্য লোক যদি সেটাকে পায় তাহলে বুঝতে হবে গোয়েন্দাদের গতিবিধির উপর নজর রেখে এবং তাদের কাছ থেকে চরিকরা সূত্র ও নির্দেশের সুযোগ নিয়েই তারা সেটা পেয়েছে, আর সেই কারণে শেষ পর্যন্ত পুরস্মরটা গোয়েন্দাদেরই প্রাপ্য হবে। এই সব পুরস্কারের আসল উদ্দেশ্যই হল, এই ধরনের কাজের পিছনে যারা তাদের সময় ও শিক্ষিত পটু ত্বকে নিয়োজিত রাখে তাদেরই উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা; যারা নিজেদের ক্ষমতা বা পরিশ্রমের মূল্যে সুবিধাটা অর্জন করার পরিবর্তে হঠাৎই একটা কাজ গুছিয়ে ফেলে সেই সব আকস্মিক নাগরিকদের তুষ্টি বিধান করা নয়।
নিশ্চয়ই বক্তব্যটা খুবই যুক্তিযুক্ত। এতক্ষণে ঘরের কোণের টলিগ্রাফ যন্ত্রটা শব্দ করে উঠল, আর তার ফলে নিম্নলিখিত বার্তাটা বেরিয়ে এলঃ
ফ্লাওয়ার স্টেশন, এন, ওয়াই, সকাল ৭-৩০ মিঃ একটা সূত্র পেয়েছি। কাছেই একটা গোলাবাড়িতে পরপর অনেকগুলি গভীর পায়ের দাগ দেখেছি। সেগুলি অনুসরণ করে পূব দিক দুমাইল হেঁটেছি, কোন ফল হয় নি; মনে হয় হাতি পশ্চিম দিকে গেছে। এবার সেই দিকেই তার পিছু নেব।…..
—ডার্লি, গোয়েন্দা
ইন্সপেক্টর বলল, ডার্লি বিভাগের একজন শ্রেষ্ঠ কর্মী। শীঘ্রই তার কাছ থেকে আবার খবর পাব।
২ নং টেলিগ্রাম এল:
বাৰ্করস এন. জে.,
সকাল ৭-৪০ মিঃ
এই মাত্র পৌঁছেছি। কাঁচের কারখানা ভেঙে চুরমার রাতের বেলা। আট শ বোতল নিখোঁজ। পাঁচ মাইলের মধ্যে বড় জলাশয় নেই। হাতিটা অবশ্য তৃষ্ণার্ত হবে। বোতলগুলি খালি ছিল।
—বেকার, গায়ন্দা
ইন্সপেক্টর বলল, কাজ ভালই এগোচ্ছে। বলেছিলাম না, জন্তুটার ক্ষিধে সূত্র হিসাবে খারাপ হবে না।
৩ নং টেলিগ্রাম:
টে লরভিল, এল, আই.,
সকাল ৮-১৫ মিঃ
কাছেই একটা খড়ের গাদা রাতারাতি অদৃশ্য হয়ে গেছে। সম্ভবত কিছুতে খেয়েছে। একটা বড় সূত্র পেয়েছি। চলে যাচ্ছি।
—হিউবার্ড, গোয়েন্দা
ইন্সপেক্টর বলল, কি রকম ছুটে বেড়াচ্ছে! জানতাম, কাজটা বড়ই কঠিন। কিন্তু তবু তাকে আমরা ধরবই।
আবার টেলিগ্রাম:
পায়ের ছাপ ধরে পশ্চিম দিকে তিন মাইল ছুটে ছি। পায়ের দাগ বড়, গভীর, অসমান, এই মাত্র একজন কৃষকের সঙ্গে দেখা। সে বলছে, এ গুলো হাতির পায়ের ছাপ নয়। বলছে, গত শীতকালে মাটির উপর যখন বরফ জমেছিল তখন ছায়া-তরুর জন্য যে সব চারা গাছ। সে খুঁড়ে তুলেছিল এ গু লি তারই শর্ত। কি ভাবে অগ্রসর হব নির্দেশ পাঠান।
—-ডার্লি, গোয়েন্দা
আঃ! যত সব চোরের স্যাঙাৎ! অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, ইন্সপেক্টর বলল। ডার্লি-কে নিম্নলিখিত টেলিগ্রাম পাঠাল:
লোকটাকে গ্রেপ্তার কর আর তার সঙ্গীদের নাম বলতে বাধ্য কর। পায়ের দাগ ধরে এগিয়ে যাও-দরকার হলে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত।
—প্রধান ব্লান্ট
পরবর্তী টেলিগ্রাম:
রাতের বেলা গ্যাস-আপিস ভেঙে তচনচ করেছে আর তিন মাসের বকেয়া গ্যাস-বিল নিয়ে গেছে। সূত্র পেয়েছি। চলে যাচ্ছি।
—মারফি, গোয়েন্দা
ইন্সপেক্টর বলল, হা ভগবান! সেটা কি গ্যাস-বিলও খায়?
হয় তো না জেনে খেয়েছে; কিন্তু তা খেয়ে তো বাঁচবে না। অন্তত আর কিছু না খেতে পেলে।
তার পরেই এল এই চাঞ্চল্যকর টলিগ্রাম:
আয়রণভিল, এন. ওয়াই,
সকাল ৯-৩০ মিঃ
এই মাত্র পৌঁছেছি। গ্রাম আতংকিত। আজ সকাল পাঁচটায় এখান দিয়ে হাতি গেছে। কেউ বলছে পূর্বে গেছে, কেউ বলছে পশ্চিমে, কেউ উত্তরে, কেউ দক্ষিণে-কিন্তু সকলেই বলছে ভালভাবে লক্ষ্য করবার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নি। একটা ঘোড়া মেরেছে; আঘাতের ধরণ দেখে মনে হয় বাঁ-হাতে আঘাত করেছে। ঘোড়াটা যে অবস্থায় পড়ে আছে তাতে মনে হয়, হাতিটা বার্কলে রেলপথ বরাবর উত্তর দিকে গেছে। সাড়ে চার ঘণ্টা আগে চলে গেছে, কিন্তু আমি এই মুহূর্তেই তার পায়ের দাগ ধরে যাত্রা করছি।
—-হয়েস, গোয়েন্দা
আমি আনন্দে চীৎকার করে উঠলাম। ইন্সপেক্টর পাথরের মূর্তির মত গম্ভীর। শান্তভাবে সে ঘণ্টায় হাত দিল।
আলারিক, ক্যাপ্টেন বার্নকে এখানে পাঠিয়ে দাও।
—বার্নস্ এল।
আপনার হুকুমের অপেক্ষায় কত লোক প্রস্তুত আছে?
ছিয়ানব্বই জন স্যার।
এখনই তাদের উত্তরে পাঠিয়ে দিন। আয়রণভিল-এর উত্তরে বার্কলে রোড বরাবর তাদের মোতায়েন থাকতে বলুন।
হ্যাঁ স্যার।
তারা যেন অত্যন্ত গোপনে অগ্রসর হয়। যারা এখন বাইরে আছে, তাদের হুকুমের অপেক্ষায় তৈরি থাকতে বলুন।
হ্যাঁ স্যার।
যান!
হ্যাঁ স্যার।
ইতিমধ্যে আর একটা টেলিগ্রাম এল:
সেজ কর্ণার্স, এন, ওয়াই,
১০-৩০ মিঃ
এই মাত্র পৌঁছেছি। ৮-১৫ মিঃ-এ হাতি এখান দিয়ে গেছে। একটি পুলিশ ছাড়া সকলেই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। স্পষ্টতই হাতি পুলিশকে আঘাত করে নি আঘাত করেছে ল্যাম্পপোস্টটাকে। দুটোই গেছে। সূত্র হিসাবে পুলিশের একটা অংশ সংগ্রহ করেছি।
—স্টাম, গোয়েন্দা
ইন্সপেক্টর বলল, হাতিটা তাহলে পশ্চিম দিকে ঘুরেছে। যা হোক, সে পালাতে পারবে না, কারণ আমাদেরর লোক ও অঞ্চলের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।
পরবর্তী টেলিগ্রামের কথা:
গ্লোভার্স,
১১-১৫ মিঃ
এই মাত্র পৌঁছেছি। রুগ্ন ও বৃদ্ধ ছাড়া গ্রাম পরিত্যক্ত। পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে হাতি এখান দিয়ে গেছে। মদ্যপান-নিবারণী জনসভার অধিবেশন চলছিল; একটা জানালায় শুড় লাগিয়ে জালার জল ছড়িয়ে সব ধুয়ে-মুছে দিয়েছে। কেউ কেউ আকণ্ঠ জল গিলেছিল-পরে মারা গেছে। কিছু লোক ডুবে গেছে। গোয়েন্দা ক্ৰস্ এবং ও শৌনেসি শহরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু দক্ষিণ দিকে যাওয়ায়-হাতিতে দেখতে পায় নি। চারদিকে বহু মাইল পর্যন্ত গোটা অঞ্চ ল আতংকের কবলে-লোকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। যেখানে যাচ্ছে সেখানেই হাতি। অনেকে মারা পড়েছে।
—ব্র্যান্ট, গোয়েন্দা
এই ধ্বংসকাণ্ড আমাকে বিচলিত করল, চোখে বুঝি জল এসে গেল। কিন্তু ইন্সপেক্টর শুধু বলল:
দেখছেন-তাকে কেমন ঘিরে ধরেছি। আমাদের চাপ সে বুঝতে পেরেছে; আবার পূর্বদিকে মোড় নিয়েছে।
তখনও আরও খারাপ খবর আমাদের জন্য জমা ছিল। সে খবর আনল এই টেলিগ্রামটি :
হোগানস্পোর্ট,
১২-১৯ মিঃ
এইমাত্র পৌঁছেছি। আধ ঘণ্টা আগে হাতি এখান দিয়ে গেছে। সর্বত্র তীব্র ভয় ও উত্তেজনা। হাতি রাস্তা বরাবর যাচ্ছিল। দুজন। জল-মিস্ত্রি যাচ্ছিল। একজনকে মেরেছে-অন্যজন পালিয়েছে। সকলেই দুঃখিত।
—ও ফ্লা হার্টি, গোয়েন্দা
ইন্সপেক্টর বলল, এবার আমার লোকজন তাকে ঘিরে ফেলেছে। আর তার রক্ষা নেই।
সারা নিউ জার্সি ও পেনসিলভানিয়াতে ছড়িয়ে থাকা গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পর পর টেলিগ্রাম আসতে লাগল। আক্রান্ত গোলাবাড়ি, কারখানা ও রবিবার-বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার প্রভৃতির সূত্র ধরে অনেক আশা নিয়ে প্রায় নিশ্চিন্ত বিশ্বাস নিয়ে এই সব গোয়েন্দারা কাজ করে বেড়াচ্ছে। ইন্সপেক্টর বলল:
এদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যদি উত্তরে যাবার হুকুম দিতে পারতাম তাহলে ভাল হত; কিন্তু সে তো অসম্ভব। একজন গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাঠাতে শুধু টেলিগ্রাম আপিসেই যায়, আর তারপরেই উধাও হয়; তখন যে কোথায় গেলে তাকে ধরা যাবে তা কেউ জানে না।
এবার এল এই তারটা:
ব্রিজপোর্ট, সি, টি,
১২-১৫ মিঃ
এখন থেকে শুরু করে গোয়েন্দারা হাতিটাকে খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত সেটাকে ভ্রাম্যমান বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহারের একচেটিয়া। অধিকারের জন্য বার্ণাম বার্ষিক ৪,০০০ পাউণ্ড দেবার প্রস্তাব রেখেছে। তার গায়ে সার্কাসের বিজ্ঞাপন সেঁটে দিতে চায়। অবিলম্বে জবাব চাইছে।
—বগস, গোয়েন্দা
সেটা তো একেবারেই অসম্ভব! আমি বললাম।
ইন্সপেক্টর বলল, নিশচয়। মিঃ বার্ণাম নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবে; সে আমাকে চেনে না; কিন্তু আমি তাকে চিনি।
তারপর টেলিগ্রামের এই জবাব সে লিখে নিতে বলল:
মিঃ বার্ণাম-এর প্রস্তাব বাতিল। হয় ৭,০০০ পাউণ্ড, নইলে কিছুই না।
—প্রধান ব্লান্ট
ঠিক আছে। জবাব আনতে বেশী দেরি হবে না। মিঃ বার্ণাম বাড়িতে নেই; সে এখন টেলিগ্রাম আপিসে-হাতে কাজ থাকলে এটাই তার রীতি। তিনজনের ভিতরে–
কথা পাকা।-পি. টি. বার্ণাম
টে লিগ্রাম যন্ত্রটার ক্লিক-ক্লিক শব্দ তার কথায় বাধার সৃষ্টি করল। এই অদ্ভুত অধ্যায়টি সম্পর্কে কোন রকম মন্তব্য করবার আগেই নিম্নলিখিত টেলিগ্রামটি এসে আমার চিন্তাধারাকে আর একটি দুর্বিপাকের দিকে ঘুরিয়ে দিলঃ
১১-৫০ মিনিটের সময় হাতিটা দক্ষিণ দিক থেকে এখানে এসে জঙ্গলের দিকে চলে গেছে; পথে একটা শব-যাত্রাকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে এবং শবযাত্রীদের সংখ্যা দুজন কমিয়ে দিয়েছে। নাগরিকরা তাকে লক্ষ্য করে কয়েকটা ছোট কামানের গোলা ছুঁড়ে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা বার্ক ও আমি দশ মিনিট পরে উত্তর দিক থেকে সেখানে হাজির হই এবং পথের খোঁড়াখুড়িকে পায়ের দাগ বলে ভুল করে অনেকটা সময় নষ্ট করি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঠিক পথ ধরে জঙ্গল পর্যন্ত অগ্রসর হই। তারপর হাত-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে পায়ের ছাপের উপর কড়া নজর রেখে চলি এবং একটা ঝোপ পর্যন্ত এগিয়ে যাই। বার্ক ছিল আগে। দুর্ভাগ্যবশত জন্তুটা তখন। বিশ্রাম করছিল। মাথা নীচু করে পায়ের দাগ দেখতে দেখতে এগিয়ে গিয়ে সে সোজা হাতিটার পিছনের পায়ের সঙ্গে ধাক্কা খায়; হাতিটা যে এত কাছে ছিল তা সে বুঝতেই পারে নি। সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে দাঁড়ায় এবং লেজটা ধরে সহর্ষে চীৎকার করে ওঠে, আমিই পেয়ে গেছি পুর-কিন্তু তার মুখের কথা আর শেষ হল না, প্রকাণ্ড শুড়ের একটি আঘাতেই সাহসী সঙ্গীটির বিচূর্ণিত দেহ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। আমি পিছন ফিরে ছুটতে লাগলাম, আর হাতিটা মুখ ঘুরিয়ে আমাকে তাড়া করে জঙ্গলের সীমানা পর্যন্ত ছুটে এল। প্রচণ্ড গতিবেগ তার; তাই আমার মৃত্যুও ছিল অনিবার্য, কিন্তু ভাগ্যক্রমে অবশিষ্ট শব যাত্রীরা সেখানে এসে পড়ায় তার মনোযোগ সেই দিকে ঘুরে গেল। এইমাত্র জানতে পারলাম, সেই শবযাত্রীদের কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু এ ক্ষতি কোন ক্ষতিই নয়, কারণ আমরা প্রচুর তথ্যাদি হাতে পেয়ে গেছি। এদিকে হাতিটা আবার উধাও হয়েছে।
—মালরুনি, গোয়েন্দা
নিউ জার্সি, পেসিনিয়া, ডেলাওয়ার ও ভার্জিনিয়াতে নতুন নতুন সূত্র ধরে কর্মরত গোয়েন্দাদের কাছ থেকে ছাড়া আর কোন সংবাদ এল না। অবশেষে বেলা দুটোর একটু পরেই এই টেলিগ্রামটি এল:
বক্সটার সেন্টার,
২-১৫ মিঃ
সারা গায়ে সার্কাসের বিজ্ঞাপন সাঁটা অবস্থায় হাতিটা এখানে এসেছিল; নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে জীবনের অনেক নবীন। পথিককে পায়ে দলেছে; নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নাগরিকরা অনেক লেখালেখি করে একজন পাহারাদার বসিয়েছে! তার কিছু সময় পরেই গোয়েন্দা ব্রাউন ও আমি সেখানে পৌঁছেই এবং ভিতরে ঢুকে ফটোগ্রাফ ও অন্য বিবরণের সাহায্যে হাতিটাকে সনাক্ত করতে চেষ্টা করি। সব চিহ্নই ঠিক ঠিক মিলে গেছে, শুধু একটি বাদে-বগলের নীচে কার ক্ষত-চিহ্নটা আমরা দেখতে পাই নি। সঠিকভাবে জানবার জন্য ব্রাউন হামাগুড়ি দিয়ে হাতিটার পেটের নীচে ঢুকে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গেই সাবাড়-মাথাটা একেবারে চুরমার হয়ে গেছে, যদিও ফল কিছুই হয় নি। সকলেই পালিয়ে যায়; হাতিটাও; তবে যাবার আগে ডাইনে-বাঁয়ে যাকে পায় তাকেই মারে। পালিয়েছে বটে, কামানের গোলার ঘায়ের দরুণ রক্তাক্ত পদচিহ্ন রেখে গেছে। ধরা অবশ্য পড়বে। গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ দিকে গেছে।
—ব্রেন্ট গোয়েন্দা
এটাই শেষ টেলিগ্রাম। রাতের দিকে এত ঘন কুয়াশা হল যে তিন ফুট দূরের কোন জিনিসও দেখা যায় না। সারা রাত এই রকম চলল। খেয়া নৌকা ও অমনিবাসগুলোও চলাচল বন্ধ রাখতে বাধ্য হল।
.
০৩.
পরদিন সকালে সব সংবাদপত্রগুলিই আগের দিকের মত গোয়েন্দাদের নানা রকম থিয়োরিতে ভর্তি হয়ে বের হল; এই সব শোচনীয় ঘটনার সবিস্তার বিবরণ তো তাতে ছিলই, উপরন্তু ছিল তার-যোগে পাওয়া বিশেষ প্রতিনিধিদের নানাবিধ প্রতিবেদন। বড় বড় শিরোনামে কলামের পর কলম ভর্তি সংবাদ-সে সব পড়তেই আমার গা গুলিয়ে উঠল। সে সবেরই মুল সুর অনেকটা এই রকম:
শ্বেত হস্তী ছাড়া পেয়েছে! শুরু করেছে মারাত্মক অভিযান! ভয়ার্ত অধিবাসীরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে! তার আগে চলে তীব্র আতংক, আর পিছনে চলে মৃত্যু ও ধ্বংসা তারপর আছে গোয়েন্দারা! গোলাবাড়ি বিধ্বস্ত, কারখানা চুরমার, ফসল উদরস্থ, জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গ, আর সেই সঙ্গে অবর্ণনীয় নরহত্যার দৃশ্য! গোয়েন্দা বাহিনীর চৌত্রিশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিমত! গোয়েন্দা-প্রধান ব্লান্ট–এর অভিমত!
শুনলেন তো! ইন্সপেক্টর ব্লান্ট-এর কণ্ঠে ও উত্তেজনার প্রকাশ কী চমৎকার! কোন গোয়েন্দা-প্রতিষ্ঠানের ভাগ্যে এতবড় প্রশংসা আর কখনও জোটে নি। এই সুখ্যাতি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে, নিরবধি কাল বেঁচে থাকবে, আর সেই সঙ্গে থাকবে আমার নাম।
কিন্তু আমার মনে সুখ নেই। আমার মনে হতে লাগল, এই সব রক্তাক্ত অপরাধ বুঝি আমারই কৃতকর্ম, আর এই হাতিটা বুঝি আমারই দায়িত্বহীন প্রতিনিধি। আর দুস্কর্মের তালিকা কি ভাবে বেড়ে চলেছে! এক জায়গায় নির্বাচক-ক্ষেত্রে হানা দিয়ে সে পাঁচ জন বক্তাকে হত্যা করেছে। তারপরেই মেরেছে ও ডোনেহিউ ও ম্যাকানিগান নামক দুটি গরীব মানুষকে; মাত্র একদিন আগে তারা এসে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে এবং এই প্রথম ভোট কেন্দ্রে গিয়ে মার্কিন নাগরিকের মহান অধিকার পালনে ব্রতী হয়েছিল। সেই অবস্থাতেই শ্যামদেশীয় শয়তানের নৃশংস হাত তাদের উপর নেমে এসেছিল। আর এক জায়গায় সে মেরেছে একজন বজ্রবারণ দণ্ডের প্রতিনিধিকে। এই ভাবে তালিকা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, আরও রক্তাক্ত হচ্ছে, আরও হৃদয়বিদারক হয়ে উঠেছে। ষাট জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে দুশ চল্লিশজন। বিবরণগুলিতে সব শেষে মন্তব্য করা হয়েছে, তিন লক্ষ নাগরিক ও চারজন গোয়েন্দা এই ভয়ংকর জীবটি কে প্রত্যক্ষ করেছে; তাদের মধ্যে দুজন গোয়েন্দা নিহত হয়েছে।
টেলিগ্রাফ–যন্ত্রটা পুনরায় ক্লিক করে উঠতেই আমার ভয় ধরে গেল। খবরের পর খবর আসতে লাগল। সেগুলো শুনে আমি হতাশ হলেও খুসি হলাম। শীঘ্রই বোঝা গেল যে হাতিটার সব চিহ্ন হারিয়ে গেছে। কুয়াসার ফলে একটা ভাল লুকোবার জায়গা সে পেয়ে গেছে। দূরদূরান্ত থেকে টেলিগ্রাম আসতে লাগল, অমুক অমুক সময়ে কুয়াসার ভিতর দিয়ে একটা প্রকাণ্ড কিছু দেখা গেছে, আর সেটা নিঃসন্দেহে হাতি। এ ধরনের একটা অস্পষ্ট প্রকাণ্ড কিছু দেখা গেছে নিউ হ্যাভন-এ, কিড জার্সিতে, পেনসিলভানিয়াতে, নিউ ইয়র্ক-এর শহরতলীতে, ব্রুকলীন-এ, এমন কি খাস নিউ ইয়র্ক শহরে পর্যন্ত। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই সেই অস্পষ্ট প্রকাণ্ড কিছু দ্রুত অদৃশ্য। হয়েছে এবং কোন চিহ্ন পর্যন্ত রেখে যায় নি। বিরাট গোয়েন্দা বাহিনীর প্রতিটি লোক ঘণ্টায় ঘণ্টায় নানা দিক দেশ থেকে প্রতিবেদন। পাঠিয়েছে। প্রত্যেকেই একটা না একটা সূত্র পেয়েছে, কোন না কোন কিছুকে অনুসরণ করেছে এবং অনেক সময়ই তাকে তাড়া করে ফিরেছে।
কিন্তু একটা দিন বিফলে গেল।
পরদিনও তাই।
তার পরদিনও ঠিক তাই।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন একঘেয়ে হয়ে উঠল; ঘটনা আছে, তাতে নতুনত্ব নেই; সূত্র আছে, তার কোন অর্থ নেই; থিয়োরি আছে, কিন্তু বিস্ময় ও আনন্দের চমক নেই।
ইন্সপেক্টরের পরামর্শক্রমে পুরস্কারের অংক দ্বিগুণ করা হল।
আরও চারটি একঘেয়ে দিন কেটে গেল। তারপরেই এল কঠোর পরিশ্রমী বেচারি গোয়েন্দাদের উপর নির্মম আঘাত-সাংবাদিকরা তাদের থিয়োরি ছাপতে অস্বীকার করে বসল; ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমাদের একটু বিশ্রাম দিন।
হাতি নিরুদ্দেশ হবার দুসপ্তাহ পরে ইন্সপেক্টরের পরামর্শে পুরস্কার বাড়িয়ে করা হল পঁচাত্তর হাজার ডলার। টাকাটা খুবই বেশী, কিন্তু আমি ভাবলাম, আমার যথাসর্বস্ব যায় যাক, তবু আমার সরকারের কাছে আমার সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকুক। গোয়েন্দাদের তখন দুর্দিন চলছে; তাই সংবাদপত্রগুলো তাদের উপর চড়াও হল; কড়া বিদ্রুপের হুল ফোঁটাতে লাগল তাদের গায়ে। সুযোগ বুঝে যত রাজ্যের চারণের দল গোয়েন্দার মত সাজপোশাক পরে রঙ্গমঞ্চের উপর হৈ-হৈ করে হাতি খোঁজা শুরু করে দিল।
ব্যঙ্গ চিত্রশিল্পীরা গোয়েন্দাদের এমন সব ছবি আঁকতে লাগল যাতে দেখান হল, গোয়েন্দারা পাই-গ্লাস চোখে লাগিয়ে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াচ্ছে আর হাতিটা পিছন থেকে এসে তাদের পকেট থেকে আপেল তুলে নিচ্ছে।
গোয়েন্দাদের তকমা (ব্যাজ)-র নানা রকম ব্যঙ্গাত্মক ছবি তারা আঁকতে শুরু করল–গোয়েন্দা-উপন্যাসের মলাটে সোনার জলে ছাপা সে তকমা আপনারা অবশ্যই দেখেছেন-সেই বিস্ফারিত চোখ আর তার নীচ লেখা, আমরা কখনও ঘুমোই না। গলা ভেজাবার জন্য । গোয়েন্দারা দোকানে ঢুকলে সুরসিক মালিকটি একটি অপ্রচলিত উক্তি করে বলল, চোখ খোলার যন্ত্র সঙ্গে আছে তো? ঘরের বাতাস ঠাট্টা-বিদ্রুপে ভারী হয়ে উঠল।
কিন্তু এ সমস্ত কিছুর মধ্যেও একটি মানুষ রইল স্থির, অবিচল, অনুদ্বেগ। যেন ওক-কাঠে গড়া হয়। যে মানুষ প্রধান ইন্সপেক্টর। তার সাহসী চোখ দুটি কখনও আনত হল না; তার গম্ভীর আত্মবিশ্বাস এতটুকু কাঁপল না। সে সর্বদাই বলত:
ওদের চালাতে দিন; যে সকলের শেষে হাসতে পারে সেই তো হাসির রাজা।
লোকটির জন্য আমার প্রশংসা ক্রমে পূজায় পরিণত হয়েছে। সব সময় তার পাশেপাশেই থাকি। তার আপিসটা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছিল; দিনের পর দিন সে ভাব বেড়েই চলেছে। তথাপি সে যখন সইতে পারছে তখন আমিও সইতে পারব-অদ্ভুত যতদিন পারি। কাজেই নিয়মিত সেখানে যেতাম-বাইরের লোকের মধ্যে একমাত্র আমিই যেতাম। সকলে অবাক হয়ে ভাবত এ কাজ আমি পারছি কেমন করে; এক এক সময় মনে হত, তাকে ছেড়ে যাব, কিন্তু তার সেই শান্ত, আপাত-অচঞ্চল মুখখানি দেখলেই আমার মত বদলে যেত।
হাতি নিরুদ্দেশের তিন সপ্তাহ পরে একদিন সকালে সবে বলতে যাচ্ছি যে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এবার আমাকে যেতে হবে, এমন সময় সেই মহান গোয়েন্দা আর একটি মোক্ষম চাল দিয়ে আমার সব চিন্তা ভেস্তে দিল।
ডাকাতদের সঙ্গে একটা মিটমাটের প্রস্তাব এল। পৃথিবীর বড় বড় মানুষের সঙ্গে আমার অনেক যোগাযোগ ঘটেছে, কিন্তু এই লোকটির মত আবিষ্ণুরের উর্বতরা আগে কখনও দেখি নি। সে বলল, তার খুবই বিশ্বাস এক লক্ষ ডলার হলেই সে একটা মিটমাট করে হাতিটাকে উদ্ধার করতে পারবে। আমি বললাম, টেনেটুনে আমি না হয় টাকাটা যোগাড় করলাম, কিন্তু যে গোয়েন্দারা এত খাটা-খাটুনি করল তাদের কি হবে? সে বলল:
মিটমাটের ক্ষেত্রে তারা সব সময়ই অর্ধেক পেয়ে থাকে।
আমার একমাত্র আপত্তিও দূর হল। আর ইন্সপেক্টর এই মর্মে দুটো চিরকুট লিখল:
প্রিয় ম্যাডাম, আমার সঙ্গে অবিলম্বে যোগাযোগ করলে আপনার স্বামী প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে (আইনের দিক থেকেও তার সম্পূর্ণ সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকবে)।
–প্রধান ব্লাণ্ট
নির্ভরযোগ্য পত্রবাহকের হাত দিয়ে একটা চিরকুট পাঠাল ইট ডাফির ডাকসাইটে স্ত্রীর কাছে, আর অপরটি পাঠাল লাল ম্যাকফাডেন-এর ডাকসাইটে স্ত্রীকে।
এক ঘন্টার মধ্যেই দুখানি মারাত্মক জবাব এল:
ওরে বুড়ো ভাঁড়: লাল ডাফি তো দু সন আগেই পটল তুলেছে।
—ব্রিজেট মেহনি
ধেঁড়ে বাদুর-লাল ম্যাকফাড়ে ন-কে তো ঝুলিয়ে দিয়েছে; এখন ১৮ মাসের ধাক্কা। গোয়েন্দা ছাড়া যে কোন গর্দভই তো তা জানে।
—মেরি ও হুলিগান
অনেক আগেই আমি সন্দেহ করেছিলাম, ইন্সপেক্টর বলল: আমার সহজবুদ্ধি যে কত অভ্রান্ত এতেই তা প্রমাণ হল।
একটা উপায় বিফল হলেই সে আর একটা উপায় বের করে ফেলে। তৎক্ষণাৎ প্রাতঃকালীন সংবাদপত্রের জন্য সে একটা বিজ্ঞাপন। লিখে ফেলল। আমি তার একটা নকল রেখে দিলাম:
A.-xwblv, 242 N. Tjnd-fz 328 wmlg, Ozo-2m! ogw, Mum.
সে বলল, চোর যদি বেঁচে থাকে তাহলে এটাই তাকে এই বৈঠকে টেনে আনবে। সে আরও বুঝিয়ে বলল, সাধারণত এ ধরনের বৈঠকে গোয়েন্দা ও অপরাধীরাই তাদের ব্যবসায়িক লেন-দেন করে থাকে। বৈঠক বসবে কাল রাত বারোটায়।
তার আগে আর কিছু করবার নেই। সময় নষ্ট না করে আপিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এ সুযোগ পেয়ে সত্যি আমি কৃতজ্ঞ।
পরদিন রাত এগারোটায় এক লক্ষ ডলারের ব্যাংক নোট নিয়ে প্রধানের হাতে দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই সে বিদায় নিল; তার চোখে তখনও সেই অকল্পিত আত্মবিশ্বাসের স্থির দীপ্তি। একটি প্রায়-অসহনীয় ঘণ্টা কেটে গেল; তার প্রার্থিত পদশব্দ শুনতে পেলাম। তার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে কল্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম। দুটি সুন্দর চোখে জয়ের অগ্নিশিখা জ্বলছে! সে বলল:
মিটমাট হয়ে গেছে! জোকাররা কাল নতুন সুরে গান ধরবে! আসুন আমার সঙ্গে!
একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে ভূগর্ভস্থ মস্ত বড় ঘরটায় ঢুকল। ষাট জন গোয়েন্দা সেখানে সব সময় ঘুমোয়, আর এখন জন কুড়ি বসে তাস খেলে সময় কাটাচ্ছিল। আমি তার পিছন পিছনই ঢুকলাম। সে দ্রুতপায়ে ঘরের অন্ধকার কোণটায় চলে গেল, আর দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে যন্ত্রণায় আমার মূৰ্ছা মত অবস্থা ঠিক তখনই একটা প্রচণ্ড কিছুর ভূপাতিত দেহের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সে নীচে পড়ে গেল। পড়তে পড়তেই সে চীৎকার করে বলে উঠল:
আমাদের মহান জীবিকার জয় হয়েছে। এই আপনার হাতি!
আমাকে আপিস-ঘরে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। কার্বলিক এসিড দিয়ে আমার মূৰ্ছা ভাঙানো হল। গোটা গোয়েন্দা বাহিনী এসে ঘরের মধ্যে ভিড় করল, আর এমন বিজয়োৎসব শুরু করে দিল যেমনটি আগে কখনও দেখি নি। সংবাদপত্রের লোকদের ডাকা হল, শ্যাম্পেনের বাক্সের পর বাক্স খুলে দেওয়া হল, সকলের স্বাস্থ্য পান হল, আর অবিরাম গতিতে চলল সোৎসাহ করমর্দন ও অভিনন্দন। স্বভাবতই গোয়েন্দা-প্রধানই হল উৎসবের নায়ক; তার খুসি এতই পরিপূর্ণ এবং এত ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে সার্থকভাবে অর্জিত যে তা দেখে আমার ভালই লাগল; অবশ্য আমি তখন একটি গৃহহীন ভিক্ষুকের মত সেখানে দাঁড়িয়ে; আমার অমূল্য হাতিটি মৃত; আর একটি মহান দায়িত্ব পালনে মারাত্মক অসতর্কতার ফলস্বরূপ দেশের সেবায় আমার মর্যাদা একেবারেই ভূলুণ্ঠিত। বহু চোখের সবাক দৃষ্টিতেই ফুটে উঠেছে তাদের প্রধানের প্রতি ঐকান্তিক প্রশংসা, অনেক গোয়েন্দার কণ্ঠে ই ধ্বনিত হচ্ছে একটি বাণী, ওঁর দিকে। তাকাও-আমাদের জীবিকার ক্ষেত্রে উনি তো রাজা; শুধু একটি সূত্র ধরিয়ে দাও, সেটাই শুধু তার দরকার, তাহলেই যা কিছু লুকনো থাকে সব তিনি টেনে বের করবেন। বেশ আনন্দের সঙ্গেই পঞ্চাশ হাজার ডলারের ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেল। নিজের অংশটা পকেটে ভরতে ভারতে প্রধান একটি ছোট্ট বক্তৃতায় বলল, তোমরা আনন্দ কর হে, এটা তোমরা অর্জন করেছ; তার চাইতেও বড় কথা, গোয়েন্দা-বৃত্তির জন্য তোমরা জয় করে এনেছ মৃত্যুহীন খ্যাতি।
একটা টেলিগ্রাম এল; তাতে লেখা;
মনরো, মিচ,
রাত ১০টা।
তিন সপ্তাহেরও বেশী হয়ে গেল এই প্রথম আমি টেলিগ্রাফ-আফিসের দরজায় পা ফেললাম। ঘোড়ায় চেপে জঙ্গলের পথে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এখান থেকে হাজার মাইল ছুটে ছি; প্রতিদিনই ছাপগুলির গভীরতর, বৃহত্তর ও আগের চাইতে তাজা দেখতে পেয়েছি। দুশ্চিন্তা করবেন না-আর এক সপ্তাহের মধ্যেই হাতিকে পেয়ে যাব। একথা মোক্ষম সত্য।
—ডার্লি, গোয়েন্দা
ডার্লি আমাদের বাহিনীর একটি শ্রেষ্ঠ রত্ন এই কথা উচ্চারণ করে তিনবার তার জয়ধ্বনি করে গোয়েন্দা-প্রধান হুকুম দিল, তাকে টেলিগ্রাম করে দেওয়া হোক, সে যেন বাড়ি এসে তার পুরস্কারের অংশটা নিয়ে নেয়।
হাতি চুরির বিস্ময়কর কাহিনী এইভাবে শেষ হল। পরদিন সংবাদপত্র গুলিতে আর একপ্রস্থ প্রশংসা-বাণী প্রকাশ করা হল; ব্যতিক্রম শুধু একটি নগণ্য সংবাদপত্র। তাতে লেখা হল, গোয়েন্দাপ্রবর মহান! একটা হারানো হাতিকে খুঁজে বের করতে হয়তো তার একটু বিলম্ব ঘটেছে-তিন-তিনটে সপ্তাহ ধরে তিনি হয়তো সারাদিন তাকে খুঁজেছেন তার সারাটা রাত তার গলিত শবের সঙ্গে কাটিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে খুঁজে বের করবেনই-অবশ্য যে লোক হাতিটাকে সরিয়েছিল সে যদি এসে জায়গাটা তাকে দেখিয়ে দেয় তবেই!
বেচারি হাসানকে আমি চিরদিনের মত হারালাম। কামানের গোলা তাকে মারাত্মকভাবে জখম করেছিল, কুয়াশার মধ্যে একটা অস্বাস্থ্যকর জায়গায় সে ঢুকে পড়েছিল, আর সেখানেই শত্রু পরিবৃত অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়বার আশংকার মধ্যে ক্ষুধায় ও যন্ত্রণায় তিল তিল করে ক্ষয় হয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে শান্তি লাভ করেছে।
মিটমাট করতে আমার ব্যয় হয়েছে এক লক্ষ ডলার; গোয়েন্দাদের দরুন ব্যয় হয়েছে আরও বিয়াল্লিশ হাজার ডলার; আর কখনও আমি সরকারের কাছে চাকরির জন্য আবেদন করি নি; আমার সর্বস্ব গেছে; পৃথিবীর পথে আজ আমি পথিক-কিন্তু যে লোকটি কে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা বলে বিশ্বাস করি তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আজও অম্লান আছে এবং শেষ পর্যন্ত থাকবে।
[১৮৮২]