ম্যমির জীবন্ত হাত – খগেন্দ্রনাথ মিত্র
সকাল থেকে সেদিন কাজের আর বিরাম ছিল না; যখন বিশ্রাম পেলাম, রাত তখন বারোটা। যেখানে আমার আস্তানা ছিল, সে জায়গাটার চারধারে দশ ক্রোশের মধ্যে কোন লোকালয় নেই, গাছপালাও বড় একটা দেখা যায় না, কেবল শুষ্ক পাষাণ ও তার এধারে-ওধারে অতি প্রাচীন সমাধিগুলি নীরবে পড়ে আছে। এইসব কারণে জায়গাটা স্বভাবতই নির্জন ও নিস্তব্ধ। দ্বিপ্রহরে ও সন্ধ্যার পর থেকে তার নীরবতা যেন গুরুভার পাষাণের মত বুকের উপর চেপে বসে। রাত যত বাড়ে, মনে হয়, এখানে মাটির নিচে যারা ঘুমিয়ে আছে তারা জেগে উঠে রাত্রির মত অতি চুপে চুপে পা ফেলে এবং বাতাসের মত লঘু ও স্বচ্ছ দেহে এদিক-ওদিক চলা-ফেরা করছে।
আমার কাজ ছিল সমাধির নিচের শুষ্ক ও প্রাণহীন মৃতদেহগুলি নিয়ে। এক-এক রাতে মনে হত, কে যেন আমার পিঠের উপর দিয়ে ঝুঁকে বা সামনে দাঁড়িয়ে আমার রচনাটা খুব কৌতূহলের সঙ্গে পাঠ করছে। কখনো কখনো সচকিত হয়ে মাথা তুলে এদিক-ওদিক তাকিয়েছি। কিন্তু কিছুই দেখতে পাই নি।
সেজন্যে ভাবতাম, ওটা মনের ভুল। রাতদিন মৃতের সম্বন্ধে চিন্তা করছি, মৃতের নানারকম সামগ্রী নাড়া-চাড়া করি; আমার চারধারেই যে সমাধি। এ অবস্থায় প্রেত বা ছায়া অথবা ওই ধরনের কিছু যে দেখব কিংবা অনুভব করব, এতে আর বিচিত্র কী!
যাই হোক, কাজ সেরে আমি আস্তানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পরদিন আমাদের দেশে যেতে হবে, সেজন্যে আমার সঙ্গী জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত। আমাদের বৃদ্ধ আরব অনুচরটি তখন কোথায় জানি না।
আমি আস্তানার বাইরে দাঁড়িয়ে একটা চুরুট ধরিয়ে চারধারে তাকিয়ে দেখলাম। কিন্তু সেই ঘন অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না; কেবল কিছু দূর থেকে নাইলের অস্পষ্ট কলধ্বনি ও চারধারের অশ্রান্ত ঝিল্লিরব একসঙ্গে মিশে একটি অদ্ভুত সুরের সৃষ্টি করে আমার কানে বাজতে লাগল এবং মনকেও স্পর্শ করতে লাগল। আমি স্তব্ধ হয়ে সেই শব্দের দিকে কান পেতে রইলাম।
সম্ভবত ক্ষণিকের জন্যে তন্ময় হয়ে থাকব। হঠাৎ দেখি, আমার একেবারে সমুখে একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি সচকিত হয়ে এক পা পিছিয়ে যেতেই আমারও বিস্ময়ের ঘোর কাটল, সেই মূর্তিও কথা বলে উঠল। সে অতি মৃদু কণ্ঠে বললে, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’
তার সুরে, কথায় ও ভাব-ভঙ্গিতে এমন একটা গাম্ভীর্য ছিল যে, সে আমাদের অনুচর হলেও তা উপেক্ষা করতে পারলাম না; কেবল বললাম, ‘কোথায়?’
সে হাত বাড়িয়ে পুব দিকটা দেখিয়ে দিলে। আমি নীরবে তাকে অনুসরণ করে চললাম।
দুজনে চলেছি। আমাদের পথের এদিকে-ওদিকে ভগ্ন সমাধিস্তম্ভগুলো পড়ে আছে। মাঝে-মাঝে পায়ে বাধা পাই, কোন সমাধিস্তম্ভ-চূড়ায় বা আর কোথাও বসে হঠাৎ দুটি-একটি পেচক ডেকে ওঠে, মাথার উপর দিয়ে বাতাসকে পাখার আঘাতে বিক্ষুব্ধ করে কখনো কখনো বাদুড় উড়ে যায়। সেই ঘন অন্ধকার, সেই আচম্বিত শব্দ, সেই জনবিরল সমাধি-প্রান্তর ও বৃদ্ধ অনুচরটির রহস্যপূর্ণ ব্যবহার আমাকে ক্রমে যেন অভিভূত করে ফেলতে লাগল। আমার মনে হতে লাগল, আমি কোন অভূতপূর্ব ঘটনা বা কোন রহস্যের সম্মুখীন হতে চলেছি।
তার সঙ্গে কতক্ষণ যে চলেছি, তা ঠিক করে বলা সম্ভব নয়। তবে দূরত্বের অনুমানে বুঝলাম, আমার আস্তানা থেকে প্রায় এক মাইল পার হয়ে এসেছি। এর মধ্যে অবশ্য আমরা দুজনে কেউ কারো সঙ্গে একটি কথাও বলি নি।
এক জায়গায় এসে আমার অনুচরটি হঠাৎ দাঁড়াল। তারপর বললে, ‘অপেক্ষা করুন।’
আমার চোখে অন্ধকার এতক্ষণে সয়ে এসেছিল। তার উপর তিথি অনুসারে আর-একটু পরেই চাঁদ উঠবে। পুব আকাশের কোল একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার ফলে জায়গাটার একটা অস্পষ্ট ছবি আমার চোখে ফুটল। মনে পড়ল, এর আগে এখানে দিনের বেলায় একবার এসেছিলামও। দেখলাম, আমার সমুখে সেই জীর্ণ স্ফীংক্স্; তার নিচে প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাটা সুড়ঙ্গ ও খাদ।
অনুচরটি সেখানে আমাকে রেখে সেই খাদের মধ্যে নেমে গেল।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। দূর শৈলশিখরে ধীরে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠল। তার ম্লান আলো সেই নিস্তব্ধ নিৰ্জন জায়গা, সমাধিগুলি ও স্ফীংক্স্টাকে এমন একটি রূপ দান করলে যে আমার মনে হতে লাগল, চারধার থেকে কারা যেন ঘুম থেকে ধীরে জেগে উঠছে। চিন্তাটা মনে উঠতেই আমার শরীরের মধ্য দিয়ে কেমন একটু শিহরণ বয়ে গেল।
ঠিক তখনই পিছনে পায়ের শব্দে ফিরে দেখি, আমাদের অনুচরটি ফিরে আসছে। তার হাতে যেন একটি কি।
সে কাছে আসতেই দেখি, জিনিসটা কাপড়ে জড়ানো। সাধারণত ‘ম্যমি’গুলি যে ধরনের কাপড়ে জড়ানো থাকে এ কাপড়খানাও সেই ধরনের। আমার কৌতূহলের সীমা থাকল না।
সেও কোন কথা না বলে, কাল-বিলম্ব না করে জিনিসটার উপরের জড়ানো কাপড়টা খুলে ফেললে। ততক্ষণে চাঁদ আর একটু উপরে উঠেছে।
জিনিসটার কাপড়খানা সে সম্পূর্ণ খুলে দিতেই আমার কৌতূহল চরম বিস্ময়ে পরিণত হল। দেখলাম, সেটা একখানি হাত!
হাতখানার গঠন এবং সুন্দর ও সরু আঙুলগুলি দেখে বুঝলাম, সেটি কোন নারীর। তার কোথাও এতটুকু বিকৃতি ঘটেনি। তার নখগুলি চমৎকার করে কাটা; প্রত্যেক নখের উপর যে খুব পাতলা সোনালি পাত মোড়া রয়েছে, সেগুলি পর্যন্ত জ্যোৎস্নায় ঝলমল করছে। দেখে মনে হতে লাগল, হাতখানা এই মুহূর্তে কোন সুন্দরী নারীর দেহ থেকে কেটে আনা হয়েছে। তার ক্ষতস্থান থেকে যে দুটি হাড় বেরিয়ে আছে, চাঁদের আলো পড়ে সে দুটি আরও সাদা দেখাচ্ছে। ততক্ষণে চাঁদের আলো আরও উজ্জ্বল ও নির্মল হয়ে উঠেছিল। অনুচরটি হাতখানা আমার আর-একটু কাছে আনতে দেখলাম, তার তর্জনীতে একটি উজ্জ্বল সোনার আংটি; তার উপর প্রাচীন ইজিপ্টের কয়েকটি সাঙ্কেতিক অক্ষর খোদাই করা।
আমার বৃদ্ধ অনুচরটির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার চেহারায় কেমন একটা পরিবর্তন এসেছে। তাকে আমরা আরব বলে জানতাম। কিন্তু এখন তার মুখ-চোখের আরবীয় গঠনের পাশে আর একটি অন্য ভাব ফুটে উঠে সে ভাবটিকে ম্লান করে দিয়েছে। সে পরম স্নেহভরে সেই হাতখানি দু-হাতে তুলে ধরে বলল, ‘এখানা ফারাও আখ্নাটেনের সপ্তম কন্যার দক্ষিণ হাত।
‘আখ্নাটেন তাঁর পূর্বপুরুষদের ধর্মত্যাগ করে এক নূতন ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। সে ধর্ম ছিল, সূর্যের উপাসনা। তাঁর মৃত্যুর পর টুটেনখামেন ফারাও হন। তিনি আখ্নাটেন যে ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন তা দেশ থেকে দূর করে দেশের যা পুরাতন ধর্ম তা আবার প্রতিষ্ঠা করেন। তার ফলে ইজিপ্টের পুরোহিত সম্প্রদায় আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে, থিবিস নগরের মন্দিরের পুরোহিতগণ আবার অবাধে ইজিপ্টের সর্বত্র প্রভুত্ব করতে থাকে।
‘কিন্তু ফারাও আখ্নাটেনর সপ্তম কন্যা মাকিটাটেন তাঁর পিতৃ-ধর্ম তখনও ত্যাগ করেননি। সে ধর্মের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ছিল বড় গভীর। রাজকুমারী পিতার মৃত্যুর পর একদল সৈন্য সংগ্রহ করে থিবিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু প্রথম যুদ্ধেই তিনি নিহত হন।
‘থিবিসের মন্দিরের পুরোহিতগণ তখন রাজকুমারী যে হাতে তাদের বিরুদ্ধে তরবারি ধারণ করেছিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁর মৃতদেহ থেকে সেই দক্ষিণ হাতখানি মণিবন্ধের একটু উপরে তরবারি দিয়ে ছিন্ন করে এবং কয়েকটি বিশেষ প্রক্রিয়ার সাহায্যে হাতখানিকে ‘ম্যমি’ করে এই মন্দিরটিতে রেখে দেয়। এই নৃশংস কাজ করবার উদ্দেশ্য এই ছিল, যাতে আর কেউ রাজকুমারীর মত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা না করে, তাহলে তাদেরও দশা হবে রাজকুমারীর মত। থিবিসের এই মন্দিরটাই ছিল তখন প্রধান। এখানা সেই।’ বলে বৃদ্ধ পরম স্নেহের সঙ্গে হাতখানা একটু দোলালে।
তারপর আবার বললে, ‘এই কাহিনী আমি শুনেছি আমার পিতার মুখে; তিনি শুনেছিলেন তাঁর পিতার কাছে। এইভাবে কাহিনীটি পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। আমার পূর্বপুরুষেরা থিবিসের এইসব মন্দিরে পৌরোহিত্য করতেন। এই হাতখানি যে কোথায় লুকোনো ছিল তাঁরা ছাড়া আর কেউ তা জানত না। আমার পিতা আমাকে এর গোপন সন্ধান দিয়ে গেছেন। তোমার কাছে আমি নানাভাবে ঋণী। তাই আজ আমি সেই হাতখানা তোমায় উপহার দিচ্ছি।’
আমি বললাম, কিন্তু হাতখানা আমায় না দিয়ে কোন জাদুঘরে তোমার দেওয়া উচিত। তারা সযত্নে এটাকে রক্ষা করবে।’
সে কঠোর স্বরে বললে, ‘তা হতে পারে না। এই হাতের উপর যে অভিসম্পাত আছে, তা আজও পূর্ণ হয়নি। আর সেই অভিসম্পাতটি পূরণ করবার জন্যে ভাগ্য তোমাকেই নির্বাচিত করেছে।’
আমি চমকে উঠলাম; বললাম, ‘অসম্ভব! আমার সঙ্গে ওর সম্বন্ধ কী? আমি তো বিদেশী।’
সে একটু হেসে বললে, বন্ধু, নিয়তির চলা-ফেরা বড় বিচিত্র। আমি যা বলছি, তা সত্য। রাজকুমারী মাকিটাটেনের দেহটা ম্যমিতে পরিণত করে তাঁর পিতা আথ্নাটেনের মমির কাছে রাখা হয়েছে। সেটা এখন শান্তিতেই আছে। কিন্তু তাঁর দক্ষিণ হাতখানার উপর যে অভিসম্পাত আছে, তা আজও পূর্ণ হয়নি। সেজন্য এটার শান্তি নেই। এটা তোমার সঙ্গে পৃথিবীর নগরে নগরে ঘুরে বেড়াবে, লক্ষ-লক্ষ লোকের চোখের সমুখে প্রদর্শিত হবে। হাতখানার উপর যে অভিসম্পাত আছে, তা পূর্ণ হবে তোমার দ্বারাই। নিয়তির এই বিধান।’
‘অসম্ভব!’
‘পৃথিবীতে “অসম্ভব” বলে কিছু নেই। তুমিও কোথাও শান্তিতে বাস করতে পারবে না। আজ থেকে এক বছর পরে তোমার ভ্রমণ শুরু হবে। আর আজ থেকেই ত্রিশ বৎসর পরে এক মহাযুদ্ধের শেষ ভাগে রাজকুমারী মাকিটাটেনের ভগ্নীপতি ফারাও টুটেনখামেনের সমাধি আর ম্যমি যে সময় আবিষ্কৃত হবে, ঠিক তার পূর্বেই রাজকুমারীর আত্মা এসে তোমার কাছ থেকে তাঁর দক্ষিণ হাতখানা উদ্ধারের চেষ্টা করবে। হাতখানাও তখন হয়ে উঠবে জীবন্ত। যতকাল তোমার কাছে থাকবে, ততকাল তোমার কোন বিপদ-আপদের ভয় থাকবে না। তুমি এখানা সযত্নে রক্ষা করবে, তাহলে এই হাতও তোমাকে সকল বিপদে রক্ষা করবে। আমার কাছে শপথ কর যে, হাতখানা তুমি সব সময়ে খুব সাবধানে রাখবে!’ বলতে বলতে বৃদ্ধের চোখমুখের ভাব, গলার স্বর, দেহের ভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে গেল।
আমার তখন মনে হতে লাগল, একজন ইজিপ্টীয় পুরোহিত সেই অতি প্রাচীন জীর্ণ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে আমাকে কঠোর স্বরে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে আজ্ঞা দিচ্ছে। সেই নিস্তব্ধ নির্জন সমাধি-প্রান্তরে, শান্ত বাতাসে, উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে তার সেই মূর্তির সম্মুখে আমি ক্রমে অভিভূত হয়ে পড়লাম। আমার ইচ্ছাশক্তি মনের মাঝে মিলিয়ে গেল। বোধ হতে লাগল, আমি তার আজ্ঞাবহ ভৃত্য। আমার মাথা আপনা হতেই তার সম্মুখে নত হয়ে পড়ল।
সে বললে, ‘কেবল ওইটুকু প্রতিজ্ঞাই যথেষ্ট নয়। এই আমরা দুজনে আমেনের জীর্ণ, ভগ্ন মন্দিরতলে দাঁড়িয়ে আছি। এখানে নতজানু হয়ে বসে আকাশের দিকে তোমার দক্ষিণ হাত তুলে সকলের যিনি ঈশ্বর, তাঁকে সাক্ষ্য করে শপথ কর যে তোমার কথা তুমি পালন করবে!’
তার অনুজ্ঞা উপেক্ষা করবার শক্তি আমার তখন ছিল না; আমি যথাযথ তা পালন করলাম। তারপর আমি উঠে দাঁড়াতেই সে আমার হাতে রাজকুমারীর ছিন্ন হাতখানি ধীরে রেখে দিলে।
অতঃপর দুজনে পূর্বের পথ ধরে আস্তানায় ফিরে এলাম। আমার মন এক অভূতপূর্ব ভাবে ভরে গেল।
দেখলাম, আমার সঙ্গী তখনও তেমনি ব্যস্ত আছেন। আমি যে কাপড়ে জড়ানো একটা কিছু নিয়ে কুটীরে ঢুকলাম, সেদিকে তাঁর খেয়ালই হল না। আমিও তাঁকে হাতখানির বিষয় কোন কথা বলা আবশ্যক বলে মনে করলাম না। হাতখানিকে আর-একখানা কাপড়ে ভাল করে জড়িয়ে আমার বালিশের নিচে রেখে তাতে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু অন্য দিনের মত আমায় সে রাতে কিছুক্ষণ জেগে থাকতে হল না। শোবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখে তন্দ্রা নেমে এল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন যথাসময়ে আমরা জিনিসপত্র নিয়ে আস্তানা ছেড়ে চলে এলাম। আমাদের বৃদ্ধ অনুচরটিও স্টিমারঘাট অবধি আমাদের সঙ্গে এল।
আমি যখন স্টিমারে উঠছি, তখন সে একবার তীক্ষ্ণ চোখে আমার চোখের দিকে তাকাল। আমার মনে হল, সেই দৃষ্টির অর্থ, ‘তোমার শপথ পালন করো।’
যাই হোক আমাদের স্টিমার যথাসময়ে থিবিস ছেড়ে নাইল দিয়ে সুদূর উত্তরে সমুদ্রের দিকে চলতে আরম্ভ করলে।
সেই সময়ে ফিরে দেখলাম, আমাদের বৃদ্ধ অনুচরটি ঘাটের একধারে স্থির হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন ছায়ামূর্তি। ক্রমে সেই ছায়া থিবিসের বিলীয়মান তীরভূমির সঙ্গে আমার চোখের সম্মুখ থেকে চিরকালের জন্য মিলিয়ে গেল।
তারপর দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর কেটে গেছে। এই সময়ের মধ্যে আমি পৃথিবীর নগরে নগরে ভ্রমণ করেছি, কত লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমি হাতখানাকে কখনও আমার কাছছাড়া করিনি। সকলেই রাজকুমারী মাকিটাটেনের সেই হাতখানিকে আমার বসবার ঘরে আমার পাশে দেখে গেছে ও তার চমকপ্রদ কাহিনীটি মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।
হাতখানিও এই দীর্ঘকালের মধ্যে আমাকে যে কত বিপদ-আপদে রক্ষা করেছে, তা বলতে গেলে একখানি প্রকাণ্ড পুঁথি হয়ে যাবে।
একবার এক চোর আমার ঘরে ঢুকে এক জায়গায় লুকিয়ে থাকে। তার মতলব, রাত যখন গভীর হবে, তখন সে আমার মূল্যবান যা কিছু চুরি করে পালাবে।
সে রাতে তার কাজ হাসিল করবার সুযোগেরও অভাব হল না। ঘর অন্ধকার হল, রাতও গভীর হয়ে এল। সে আমার সোনার ঘড়িটা সংগ্রহ করে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের উপর থেকে টাকার থলিটা নিতে গিয়েই তার হাতখানা রাজকুমারীর হাতের উপর পড়ল।
তৎক্ষণাৎ সে ভয়ে আঁতকে উঠে সব ফেলে প্রাণ-ভয়ে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।
আর একবার এক হোটেলে থাকার সময় হঠাৎ সেখানে আগুন লাগে। অন্য সকলের সঙ্গে আমিও প্রাণ বাঁচাবার জন্যে ছুটে পালাতে পালাতে মনে পড়ল, রাজকুমারীর হাতখানা আনা হয়নি, সেটা টেবিলে লাল মখমলের গদির উপর রয়েছে। না আনলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
কথাটা মনে হওয়া মাত্র আমি ঘরের দিকে ফিরলাম। ঘরে এসে হাতখানা নিয়ে আবার ছুটতে ছুটতে লিফ্টের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ভয়ঙ্কর একটা শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি, লিফ্ট্টা পুড়ে ছিঁড়ে নিচে পড়ে গেল। তার ফলে অনেকগুলি লোক জখম হল ও প্রাণ হারাল।
এরপর এক রাতে স্বয়ং রাজকুমারী এলেন, তাঁর ওই হাতখানি নিতে।
তখন ইউরোপের মহাযুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আমি ইউরোপের যে নগরে সে সময় বাস করছি, মনস্থ করলাম সেখানেই জীবনের শেষ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে বাস করব। কিন্তু থিবিসের জীর্ণ ভগ্ন মন্দির-তলে দাঁড়িয়ে আমার বৃদ্ধ অনুচরটি যে ভবিষ্যৎ-বাণী করেছিল, তা তখনও পূর্ণ হয়নি বলেই বোধহয় আমার সঙ্কল্প সফল হল না। আমি নগরটি ছেড়ে যেতে বাধ্য হলাম।
যাবার সমস্ত আয়োজন করছি। কতক জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি, কতক তখনও আছে। সেগুলোর মধ্যে রাজকুমারীর হাতখানিও একটি।
সত্য কথা বলতে কি, হাতখানি নিয়ে আমি কিছু বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম। কয়েক দিন থেকে লক্ষ্য করছিলাম, যে হাত এতকাল লোহার মত শক্ত ও অসাড় ছিল, তা বেশ কোমল হয়েছে। তার সরু সরু আঙুলগুলোকে সহজেই এধারে-ওধারে সঞ্চালন করা যায়। তারপর ক্রমে সমস্ত হাতখানার আকৃতিও সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে সেখানা হয়ে উঠল জীবন্ত মানুষের হাতের মত।
সেখানার দিকে হঠাৎ তাকিয়ে সময়ে সময়ে আমি নিজেই চমকে উঠি। মনে হয় টেবিলের উপর লাল মখমলের গদিতে একটি সুন্দরী নারীর দক্ষিণ হাতখানি কেটে রাখা হয়েছে।
একদিন সকালে উঠে রাজকুমারীর হাতের দিকে তাকিয়ে আমার বিস্ময়ের সীমা থাকল না। দেখলাম, হাতখানার আঙুলের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে ফোঁটা-ফোঁটা তাজা রক্ত। প্রত্যেকটি আঙুলের আগা দিয়েও রক্ত বার হচ্ছে।
এমন অলৌকিক ঘটনা আমি জীবনে কখনও দেখিনি। ভয়ে আমার মন ভরে গেল। তবুও মনকে শান্ত করবার জন্যে ভাবলাম, ওই লাল, তরল ও ঘন জিনিসটা রক্ত না হতেও পারে।
কিন্তু একজন রাসায়নিক যখন তার কয়েক বিন্দুকে নানারকম রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে পরীক্ষা করে বললেন জিনিসটা মানুষের রক্ত ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! তিন হাজার বছরের পুরাতন একখানি শুষ্ক কঠিন ‘ম্যমি’ হাত সহসা জীবন্ত হয়ে উঠল!
রক্তাক্ত হাতখানার দৃশ্য আমাকে এমন পীড়া দিতে লাগল যে রাসায়নিককে বললাম, ওই হাতখানার রক্ত পড়া কি কোন রকমে বন্ধ করতে পারেন না? ওটা কি আবার আগের মত শক্ত হতে পারে না? যে রকমেই হোক ওটাকে আগের অবস্থায় পরিণত করুন। চোখের সম্মুখে এ দৃশ্য বড় অসহ্য!’
তিনি বললেন, ‘তরল গালা ও পিচের মধ্যে ডুবিয়ে দিলে হাতখানা আবার আগের মত শক্ত ও অসাড় হওয়া সম্ভব এবং ওর রক্ত পড়াও নিশ্চয় বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া আর কোন উপায় তো আমার জানা নেই।’
আমি তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়ে বললাম, ‘অনুগ্রহ করে এই মুহূর্তেই ওটা নিয়ে যান।’
রাসায়নিক হাতখানা নিয়ে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে হাতখানা আমায় দিয়ে বললেন, ‘দেখুন, এটা আগের মতই শক্ত ও অসাড় হয়ে গেছে, রক্ত পড়াও বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ম্যমির হাত দিয়ে কী করে যে রক্ত পড়তে পারে, আমি তো কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। এ ব্যাপারটা নিতান্ত অভাবনীয়।’
এই কথাটা আমিও মনে মনে ভাবছিলাম; কাজেই তাঁর প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হল না। আমি রাজকুমারীর হাতখানা হাতে নিয়ে দেখি, তার কোন জায়গা দিয়েই আর রক্ত পড়ছে না।
আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হাতখানা যথাস্থানে, সেই লাল মখমলের গদির উপর রেখে দিলাম।
সারা দিন গেল; সন্ধ্যা নামে নামে। এর মধ্যে আমি এমন একটু সময় করতে পারিনি যে হাতখানার দিকে একবার মনোযোগ দিই। অবশ্য তার দরকারও ছিল না। কেননা গালা ও পিচের কঠিন ঘন আবরণের নিচে হাতখানা আগের মতই অসাড় হয়ে আছে বলে আমি নিশ্চিন্ত।
সেই সময় কাজের পাকে একবার আমার বসবার ঘরের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ হাতখানার দিকে আমার চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।
আমার পা দুটো আপনা থেকেই গতিহীন হয়ে গেল, হৃৎপিণ্ডটা ভয়ানক দুলতে লাগল। যে হাতকে আমি অসাড় ও কঠিন ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলাম, আবার তার গ্রন্থি ও আঙুলের আগা দিয়ে পিচ এবং গালার আবরণ ভেদ করে তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে! ঘরখানা ততক্ষণে ঘনায়মান সন্ধ্যার ম্লান ছায়ায় একটু কালো হয়ে উঠেছে, কোণে কোণে অন্ধকার জমা হচ্ছে। আমি অনুভব করলাম, সন্ধ্যা সেই ম্লান ছায়ায় আরও একটি ছায়া যেন কায়া মিলিয়ে বড় নিঃশব্দে ভেসে বেড়াচ্ছে।
সাহসী বলে আমার খ্যাতি ছিল। কিন্তু সেদিন অন্তত কয়েক মুহূর্তের জন্যেও আমার মন গভীর শঙ্কায় ভরে উঠল।
সৌভাগ্যবশত আমি একেবারে চেতনা হারাই নি। পরক্ষণেই আত্মসম্বরণ করে, মনে প্রচুর সাহস এনে হাতখানার কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম, আগেরও চেয়েও সেটা কোমল হয়ে এসেছে, যেন ধীরে গলে যাচ্ছে। বুঝলাম, আমার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ।
মনে পড়ল, ত্রিশ বৎসর পূর্বে নাইলের তটভূমিতে সেই স্তব্ধ জ্যোৎস্না রাতে থিবিস নগরে আমেনের জীর্ণ মন্দিরে দাঁড়িয়ে আমার বৃদ্ধ অনুচরটির কথা—‘আজ থেকে ত্রিশ বৎসর পরে একদিন।’
সেই ক্ষণটি আজই এল কি? কালসাগরের তিন হাজার বৎসরের দুস্তর ব্যবধান পার হয়ে রাজকুমারী জীবনের পরপার থেকে আজই তাঁর শুষ্ক দক্ষিণ হাতখানি নিতে এলেন?
কিন্তু আমি হিসেব করে দেখলাম, ভবিষ্যদ্বাণী পূরণের তখনও একটি দিন বিলম্ব। এদিকে আমিও আর সময় নষ্ট করতে পারি না। নগরে তখন পূর্ণ অরাজকতা। আমার জিনিসপত্র যা ছিল সেইদিনই সব গুছিয়ে নিলাম। তবে, হাতখানার অবস্থা দেখে, সেটা আর সঙ্গে নেওয়া হবে না ভেবে স্থির করলাম, কালই আগুনে ওটাকে পুড়িয়ে ফেলব। কথাটা ভাবতেই আমার মনের কোণে একটু ব্যথা বেজে উঠল। ওই হাতখানি যে আমার জীবনের এক অংশের একটি পাশ এতকাল ধরে রেখেছিল। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে? কিন্তু তা ছাড়া উপায়ই বা কী? আবার ভাবলাম, ওটাকে যদি সমাধিস্থ করি? কিন্তু তারই বা সুযোগ কোথায়!
আমি আর হাতখানার প্রতি মনোযোগ দিলাম না; নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু সে রাতে আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
রাত তখন গভীর; প্রায় সারা নগরী ঘুমে অচেতন। কেবল দূর থেকে মাঝে মাঝে বিদ্রোহী সৈন্যদের উন্মত্ত উল্লাস, সঙ্গীত ও দুটি একটি বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই সময় চারজন সশস্ত্র দস্যু আমার ঘরে হানা দিল। ঘরে ঢুকে প্রথমেই তাদের চোখ পড়ল রাজকুমারীর আঙুলের সোনার আংটিটির উপর।
দস্যুসর্দার তৎক্ষণাৎ রাজকুমারীর হাতখানি মখমলের গদির উপর থেকে ছোঁ দিয়ে তুলে নিলে। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলে, তার হাত রক্তাক্ত হয়ে গেছে। সে সভয়ে চিৎকার করে হাতখানা টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে ঘর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গেল।
পরদিন আমার আরও জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিলাম। বাকি রইল কেবল রাজকুমারীর হাতখানি, কয়েকটা কাঠের খালি বাক্স ও আমার একটা বড় পোর্টম্যান্টো।
যথারীতি দিন শেষ হয়ে নগরীর প্রাসাদ-শ্রেণীর মাথায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আর একটু পরেই সে-অন্ধকার দূর করে উঠল চাঁদ।
আমার হাতে তখন আর কোন কাজ নেই। মন বিষণ্ণ। কাল থেকে আর এই গৃহ ও ওই হাতের সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না।
আমি বার বার হাতখানিকে দেখতে লাগলাম। রক্তে সেখানা ভেসে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল, থিবিসের বিশাল প্রান্তরে নাইলের তীরভূমিতে রাজকুমারীর মৃতদেহটি যেন পড়ে আছে। আর, তাঁর দক্ষিণ হাতখানি সদ্য কেটে এনে ওইখানে রাখা হয়েছে।
ক্রমে রাত গভীর হতে লাগল। ঘরের চিমনিতে সন্ধ্যা থেকেই আগুন জ্বলছিল। আমি তাতে আরও কাঠ দিয়ে প্রখর ও প্রদীপ্ত করে দিলাম, যাতে রাজকুমারীর হাতখানি নিঃশেষে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
আকাশে তখন জ্যোৎস্নার বন্যা এসেছে; নগরীর চোখেও তন্দ্রা নেমেছে। আমার ঘরে সন্ধ্যা থেকেই কোন আলো জ্বালিনি। খোলা জানলা-পথে জ্যোৎস্না এসে শূন্য ও নিস্তব্ধ ঘরখানির মেঝেয় ঘুমিয়ে আছে। এই আলোছায়ায় আমি একা দাঁড়িয়ে।
আমার বাড়ির গেটে খিলানের উপর একটা সুগন্ধ ফুলের লতা লতিয়ে উঠেছিল। গাছটি তখন সাদা ফুলে ফুলে ভরা। জ্যোৎস্নায় সেগুলো আরও সাদা, সুন্দর ও স্বপ্নময় বলে মনে হচ্ছে। হঠাৎ আমার মন নীল সিন্ধুপারে সুদূর ইজিপ্টের দিকে ছুটে গেল। চোখের সামনে ছায়ার মত ভেসে উঠল বিশাল নাইল, তার তীরভূমিতে পামশ্রেণী, দূরে আকাশের গায়ে পিরামিড, তার উপর নির্মেঘ নীল আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ। সব যেন নির্মল জ্যোৎস্নায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
হঠাৎ দূরে গীর্জার ঘড়িতে ঢং-ঢং-শব্দে রাত্রি বারোটা বাজল। সেই শব্দে আমারও চমক ভাঙল।
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার দরজায় খিল আটকে, আমার ঘরেরও দরজাটা বেশ করে এঁটে বন্ধ করে দিলাম। ওক কাঠের ভারী দরজা; কাপে কাপে বসে গেল।
চিমনির চুল্লিতে তখন খুব তেজে আগুন জ্বলছে। আমি সেটা আরও উসকে দিয়ে টেবিলের কাছে সরে এসে রাজকুমারীর কোমল ও রক্তাক্ত হাতখানি দুহাতে তুলে নিলাম। সেই সময় হাতখানির স্পর্শে আমার সারা শরীরের মধ্য দিয়ে কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল। সেইসঙ্গে মনে পড়ল, আজই রাতে রাজকুমারী হাতখানি আমার কাছ থেকে নিতে আসবেন।
আমার মন আরও বিষণ্ণ উঠল। আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে হাতখানিকে প্রদীপ্ত চুল্লির ঠিক মাঝখানে ফেলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চারধার থেকে খর জিহ্বা মেলে শত-শত অগ্নি-শিখা তাকে ঘিরে ধরে দগ্ধ করতে লাগল। যে সুগন্ধি আরক মাখিয়ে হাতখানি ম্যমি করা ছিল, অগ্নিস্পর্শে তার সুন্দর বাসে ঘরখানি ভরে গেল।
আমি স্থির দৃষ্টিতে চুল্লির দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিস্তব্ধ নির্জন ঘর। কেবল চুল্লি থেকে একটু একটু শব্দ হচ্ছে। ক্রমে হাতখানাকে নিঃশেষে জীর্ণ করে অগ্নিশিখাগুলি সাপের মত ফণা নত করে রক্তোজ্জ্বল অঙ্গাররাশির উপর দিয়ে লতিয়ে এক-এক দিকে যেন মিলিয়ে যেতে লাগল। অবশেষে কেবল তপ্ত ও গাঢ় রক্তবর্ণ উজ্জ্বল অঙ্গাররাশি ছাড়া চুল্লিতে আর কিছু দেখা গেল না। আমি নিশ্বাস ফেলে চেয়ার থেকে উঠতেই বাইরের দরজায় প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ শুনে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম।
প্রথমে মনে হল, প্রবল বাতাস দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। সে সময় কোথাও এতটুকু বাতাস ছিল না; সব শান্ত ও তন্দ্রাচ্ছন্ন। বোধ হল, কে যেন বারান্দার ভারী দরজাটা প্রচণ্ড ধাক্কায় খুলে ফেললে। তারপরেই দেখলাম, আমার ঘরের অর্গলবদ্ধ দরজাটাও হঠাৎ এক ধাক্কায় সশব্দে খুলে গেল।
ভাবলাম দস্যুদল ঘরে ঢুকছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে জনপ্রাণী নেই, কেবল খানিকটা চাঁদের আলো ঘরের মধ্যে এসে অনেকখানি জায়গা আলোকিত করে তুলল।
এই দৃশ্যে ভয়ে আমার হাত-পা অসাড় হয়ে এল। সেখান থেকে একেবারে গেট অবধি পরিষ্কার দেখা যেতে লাগল। আমার এই দৃষ্টিসীমার মধ্যে কেবল গেটের খিলানের উপর জ্যোৎস্নাঢালা পুষ্পিত লতাটি ছাড়া আর কিছু নেই।
হঠাৎ দেখলাম, সেখানে যেন স্বচ্ছ বাতাসের একটি ক্ষীণ ছায়া একটু একটু করে কায়া নিচ্ছে, যেন কোন অশরীরী ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ক্রমে সেটি সেখান থেকে আমার ঘরের বারান্দার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল এবং সেইসঙ্গে তার কায়া আরও স্থূল হয়ে উঠতে লাগল। শেষে সেটা যখন আমার ঘরের অন্ধকারে এসে পৌঁছল তখন দেখলাম, একটি সুন্দরী নারীমূর্তি। তার মাথা থেকে কটিদেশ অবধি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চলার বেগে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি একটু একটু দুলছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
মূর্তিটি আরও এগিয়ে এল। তার উজ্জ্বল ও আয়ত চোখদুটি এবার আরও উজ্জ্বল হয়ে দুটি স্থির নক্ষত্রের মত জ্বলছে; তাঁর সারা মুখে ও দেহ-ভঙ্গিমায় রাজকীয় ভাব পরিস্ফুট। আমার বোধ হতে লাগল, আমি যেন তিন হাজার বৎসর আগে ইজিপ্টের এক রাজকুমারীর সম্মুখে অতি সম্ভ্রমভরে দাঁড়িয়ে আছি।
রাজকুমারী ঘরখানা পার হয়ে আমার পাশ দিয়ে চুল্লিটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। এবার দেখলাম, তাঁর মাথায় উজ্জ্বল সোনার মুকুট চুলের উপর দিয়ে কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, তার মধ্যখানে কপালে একটি উদ্যত-ফণা সোনার সাপ, আর তাঁর কটিদেশ ঘিরে উজ্জ্বল রত্নাভরণ ঝলমল করছে।
রাজকুমারী মরাল গতিতে চুল্লির কাছে গিয়ে নত হয়ে সেই উজ্জ্বল অঙ্গাররাশির মধ্য থেকে কি যেন দুহাতে তুলে নিলেন। তারপরই আমার দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ, চোখদুটি ও দেহখানি যেন পরম উল্লাসে দুলে উঠল। তাঁর সে উজ্জ্বল দৃষ্টি, সেই চোখদুটি আজও আমার চিত্তাকাশে উজ্জ্বল হয়ে আছে। সেই সময়ে তাঁর ক্ষীণ অধরদুটি কি যেন বলতে গিয়ে একবার মৃদু কম্পিত হল। সে কথা আমার কানে পৌঁছল না বটে, কিন্তু তার মর্ম আমার অন্তর স্পর্শ করলে। বুঝলাম তিনি এই হতভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন; আমারও মাথা আপনা হতেই সম্ভ্রমে নত হয়ে এল।
তারপর রাজকুমারী হাত দুখানি ধীরে লীলায়িত ভঙ্গিতে তাঁর মাথার উপর তুলে আমার দিকে অতি ধীরে মাথা নুইয়ে আবার গর্বিতভাবে সোজা হয়ে উঠে একটু একটু করে দরজার দিকে পিছিয়ে যেতে লাগলেন।
আমিও যন্ত্রচালিতের মত ধীরে ধীরে তাঁর সঙ্গে চললাম।
ক্রমে সেই ছায়ামূর্তি ঘর থেকে বার হয়ে বারান্দা দিয়ে খোলা চাঁদের আলোয় ফুলের মৃদুগন্ধ-ভরা শান্ত বাতাসে ভাসতে ভাসতে খিলানের কাছে পৌঁছল। এই সময়ের মধ্যে তাঁর দেহ একটু ক্ষীণ হয়ে এসেছিল; তখন আরও ক্ষীণ হয়ে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু চোখদুটি তখনও তেমনি উজ্জ্বল।
ক্রমে তাঁর সারা দেহ অদৃশ্যলোকে লীন হয়ে গেল, বাতাসে ভেসে রইল কেবল নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল চোখ দুটি। শেষে সে-দুটিও ম্লান হয়ে রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল, আমার চোখের সামনে ফুটে রইল কেবল সাদা স্বপ্নালস ফুলগুলি, আর মনের মধ্যে সেই জ্যোৎস্না রাতের বিচিত্র স্মৃতিখানি।