৯৯
স্ট্রেটোনিস গেছেন টলেমি কেরাউনোসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এন্টিওকাসের কোনো অনুমতি ছাড়াই গেছেন।
কেরাউনোস প্রথমে কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি এই স্ট্রেটোনিস নয়, সম্রাজ্ঞী স্ট্রেটোনিসকে চেয়েছেন। এই স্ট্রেটোনিস আসাতে বিরক্তই হয়েছেন।
নৌযানে অবস্থান করে স্ট্রেটোনিস একটি পত্র লিখলেন কেরাউনোসের কাছে। তাতে বললেন, তার সৎবোন আরসিনোয় সেলুকাসের সঙ্গে আঁতাত করে তাঁকে সরানোর ষড়যন্ত্র করছেন। এ ব্যাপারে স্ট্রেটোনিস তাঁকে সাহায্য করতে চান।
সৎবোনের কথা শুনে স্ট্রেটোনিসকে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন কেরাউনোস। কেরাউনোস বললেন, এ ব্যাপারে আপনার কী স্বার্থ?
আমার স্বার্থ আছে, নইলে এখানে আসার কথা নয়।
কী চান আপনি?
বলছি। সেলুকাসের এখন বিশাল সাম্রাজ্য। রানি আরসিনোয়কে এশিয়া মাইনরের কিছু জায়গা ছেড়ে দিয়ে বাকিটা লাইসিমেকাসের মৃত্যুর পর দখল করে নিয়েছেন।
তা আমি জানি। কিন্তু আরসিনোয়কে এই ছাড় কেন? স্বামীকে হত্যা করে তা গরু মেরে জুতা দানের মতো নয় কি?
আপনার জানা থাকার কথা, পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আরসিনোয় সেলুকাসের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।
আপনারা নারীরা সবকিছু পারেনও। আপনি যা করেছেন!
আমাদের দুষছেন কেন? আরসিনোয় তো অভিযোগ করেছেন যে আপনি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।
সে তো তার আপন ভাইকে বিয়ে করতে চায়। আমি তার কোনো পুত্রসন্তানকে জীবিত রাখব না।
এরা তো খুব ছোট।
আপনি সিংহ দেখেছেন। সিংহীকে সন্তানহারা করতে পারলেই তার সংসর্গ পাওয়া যায়। বড়টিকে শেষ করেছি, এবার ছোটগুলো।
সেলুকাস তা হতে দেবে না। সেলুসিয়ায় এ রকম চুক্তি হয়েছে একটি।
তাহলে এখন সেলুকাসকেই টার্গেট করতে হয়।
ওরা ইজিপ্ট আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছে।
আপনাকে এ তথ্য দিল কে?
এন্টিওকাসের কাছে সম্রাটের নির্দেশ এসেছে, সে যেন অশ্বারোহী সৈন্যদের নিয়ে ইজিপ্টের দিকে অগ্রসর হয়।
তার অবস্থান কোথায়?
এখনো সে যাত্রা শুরু করে নি। আমি ফিরে গেলে সে সিদ্ধান্ত নেবে তার কী করা উচিত।
ভালো সংবাদ এনেছেন আপনি।
এখন আমাদের সিদ্ধান্ত কী?
কেরাউনোস একটু ভাবলেন। কারণ, তাঁর দেওয়া তথ্যগুলোর যাচাই এখনো হয় নি দ্বিতীয়ত, এ মহিলাকে কতটুকু বিশ্বাস করা যায়, যে সৎছেলেকে বিয়ে করে। পরে মনে মনে বললেন, যদি তাঁর তথ্য সঠিক না হয়, শঠতা থাকে, তাহলে তাঁর কঠিন জবাব আছে। শব্দ করে বললেন, আপনার স্বামীকে সেলুসিয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি হতে আমি সাহায্য করব।
লিখিত চুক্তি করার প্রয়োজন আছে কি?
লিখিত চুক্তি হলে তা জানাজানি হয়ে যাবে এবং আপনার স্বামী বিপদে পড়বেন। অঙ্গীকার হচ্ছে বড় কথা, যখন তরবারি কথা বলে।
.
আরসিনোয় সেলুসিয়া থেকে নানা রকম সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সেলুকাসের সঙ্গে কয়েকটা রাত কাটিয়েছেন। প্রতিবারই সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের কথা স্মরণ করে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এ ছাড়া সেলুকাস আরসিনোয় এবং পুত্রদের পিতামাতাসহ তাঁর রাজ্যের রক্ষাকবচস্বরূপ কিছু সেলুসিড সৈন্য পাঠানোর অঙ্গীকার পেয়েছেন। সেলুকাস বলেছেন, কেরাউনোসকে হত্যা করেই তিনি আরসিনোয়কে শঙ্কামুক্ত ভোগময় জীবন উপহার দিতে চান।
দিদাইমেইয়া গেছেন অ্যাপোলো মন্দিরে প্রার্থনা করার জন্য। এটি তাঁর নিয়মিত প্ৰাৰ্থনা। হঠাৎ সেখানে ধূপ জ্বালানোর পাত্রটি ধূপসমেত ভূমিতে পড়ে গেল। তিনি অমঙ্গল আশঙ্কায় আঁতকে উঠলেন। পরে ধূপ জ্বালালেন বটে, কিন্তু প্রার্থনায় মনঃসংযোগ করতে পারলেন না। কেমন যেন অজানা এক আশঙ্কায় তাঁর মন খারাপ হতে থাকে। তিনি শান্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। মন্দির থেকে ছুটে এলেন। দেখতে পেলেন, আরসিনোয় ফিরে যাচ্ছেন, তাঁকে উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। দিদাইমেইয়া তাঁর পরিবর্তন এবং নারী হিসেবে আরসিনোয়ের উৎফুল্ল হবার কারণ বোধ হয় বুঝতে পারলেন। তাই তাঁর মনে যে বিষয়ের উদয় হলো, তাকে তিনি পাপ বলে শনাক্ত করলেন। এ পাপ মানুষকে ট্র্যাজিক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। গ্রিক মিথে তা আছে। মন নয়, এখন যেন দিদাইমেইয়ার শরীরও জ্বলে যাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কম বয়সী সম্রাজ্ঞী স্ট্রেটোনিস। একসময় তাকে তাঁর পছন্দ ছিল না। পরে মনে হলো, এ মেয়েটি তার পিতা দিমিত্রিয়াসের মতো নয়; নম্রতা, ভদ্রতা ও শ্রদ্ধাবোধ আছে। তার কচি মুখের দিকে তাকিয়ে আরও গ্লানিবোধ জাগ্ৰত হলো। তিনি জানেন না সেলুসিয়ার ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে।
আরসিনোয়কে বিদায় দিলেন মনে মনে পাপী বলে। একা একা গেলেন সেলুকাসের কক্ষে। সেলুকাস দারুণ রকম মুডে আছেন। দিদাইমেইয়াকে বললেন, দিদাই, তুমি এসে গেছ, ভালোই হলো, না হয় তোমার কাছেই যেতাম। আমি ইজিপ্ট আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেরাউনোসকে শিক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। আরসিনোয়ের মুখ থেকে তার অপকীর্তির কথা শুনে থাকবে।
রাগে জ্বলে যাচ্ছিলেন দিদাইমেইয়া, এ বয়সে রাগ ধরে রাখা কঠিন। তাই বিস্ফোরণ ঘটল, তোমার অপকীর্তির শাস্তি কে দেবে?
আরসিনোয় তোমাকে কিছু বলেছে?
এ কথার জবাব না দিয়ে দিদাইমেইয়া বললেন, তোমার পাপ যেন আর কাউকে স্পর্শ না করে। আমি লক্ষণ ভালো দেখছি না। তুমি তোমার অপকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করো।
সেলুকাস যেন ব্যাপারটাকে উপভোগের বিষয় বলে মনে করলেন। বললেন, টলেমির নৌ কমান্ডার থাকাকালেই তাকে দেখেছিলাম। সে আমাকে পছন্দ করত, তখন বুঝতে পারি নি, এখন…
চুপ করো তুমি। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছ। আমি তোমাকে অভিশাপ ছাড়া আর কিছু দিতে পারছি না।
দাও, দাও। তুমি অভিশাপই দাও। আমার কিছু হবে না। আমি আরেকজন আলেকজান্ডার, প্রতিদ্বন্দ্বী নেই কেউ, ওই ছোকরা? ওকে আমি পিষে মারব। তারপর যাব এথেন্স। সব ঠিক করাই আছে।
তুমি মাতাল হয়ে গেছ?
সকালে আমি একটু-আধটু পান করি। আজ আনন্দে একটু বেশি পান করে ফেলেছি। তুমি, তুমি তো আবার ওসব পছন্দ করো না। এখন যাও।
তোমাকে এখন কিছু বলে লাভ নেই। তোমার জন্য শক্ত পরিণাম অপেক্ষা করছে।
অভিশাপ দিচ্ছ কেন, এ্যা? আমি বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি সেলুকাস। ওসব আমাকে স্পর্শ করবে না।
তোমার অহংকারই তোমাকে ধ্বংস করবে।
এখন যাও, আমি আরও পান করব।
দিদাইমেইয়া চলে এলেন। এসব তিনি কাউকে জানাতে চাচ্ছেন না। কিন্তু অমঙ্গলের আশঙ্কাও তার পিছু ছাড়ছে না।
.
হেলেনের মন খারাপ। সম্রাট ছেলেটার মতামত গ্রহণ করলেন না। বিন্দুসারের পরামর্শ তার মনঃপূত হয়েছে। কিন্তু সম্রাট বললেন, আমি এখন পরিকল্পনা বদল করে কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না। তুমি স্বপ্নের কথা জানো। কোনো ভুল করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
হেলেন বললেন, আপনি যা ভালো মনে করেন। তবে আমি বিন্দুসারের মতামতের গুরুত্ব দিই
তা শুনে আমার খুব ভালো লাগছে। হেলেন, তুমি অন্তরে একেবারে ভারতীয় মা হয়ে গেছ। পুত্রের মতামতকে সম্মান জানিয়ে যে কথা বলছ, তা আমাকে তোমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছে। আমি দুঃখিত যে এখন এ অবস্থায় ঝুঁকিটা নিতে পারছি না। তোমরা কি আমার সঙ্গে অভিযানে যাবে? সেখানে সব ব্যবস্থা করা আছে।
এ মুহূর্তে কোনো পরিবর্তন কিংবা অভিযানে পরিবারের সংযুক্তির চিন্তা না করাই ভালো, সম্রাট। এ ছাড়া রাজধানী একেবারে খালি রেখে যাওয়া ঠিক না।
তুমি তো যেতে পারো।
হেলেন হেসে দিয়ে বললেন, এখন স্ত্রীর চাইতে মাতার দায়িত্ব বড়। বিন্দুসারকে এ অবস্থায় রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনি বরং যুদ্ধের দিকে মনোযোগ দিন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যুদ্ধের দিকেই মনোযোগ দিলেন। মহামন্ত্রী চাণক্য, প্রধান সেনাপতি এবং অমাত্যদের নিয়ে অন্ধ্রের রাস্তাঘাট, জনপদ, নদী, জলাশয়, পাহাড়-পর্বত সবকিছুর খোঁজখবর নিলেন। যুদ্ধে সেনাশিবিরের অবস্থান কোথায় হবে, তারও স্থান নির্ধারণে সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করলেন।
প্রধান সেনাপতি বিজয়গুপ্ত অভিযানের পথ সম্পর্কে সম্রাটকে ধারণা দিতে যাচ্ছিলেন। মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, অন্ধ্র আর অমরাবতী ঐতিহ্যবাহী স্থান। আমি ইতিহাস সম্পর্কে একটু ধারণা দিই। ঐরতেয় ব্রাহ্মণের (খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৫০০ অব্দ) ঋকবেদে অন্ধ্রের উল্লেখ আছে। এখানকার জনপদ এবং জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয়েছে, উত্তর থেকে এসে এরা দক্ষিণের সাগর উপকূল মালভূমি এলাকায় বসতি স্থাপন করে। আদিবাসীরা দীর্ঘকাল ধরেই এখানে শাসন করছে। কৃষ্ণা নদীর তীর ঘেঁষে এদের রাজধানী এখন অমরাবতীতে। শতবর্ষ আগে থেকে অমরাবতী গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে আছে।
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আচার্য, নৌপথে অমরাবতী পৌঁছা কি সম্ভব?
নৌজাহাজের অধিপতি বললেন, স্থল-নৌ উভয় পথেই আমাদের অভিযান চলবে।
নৌবহরের যাত্রা কোথা থেকে হবে?
একজন ভূগোল বিশারদ সেনাপতি মানচিত্রে বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি নৌ যাত্রার স্থান দেখিয়ে দিল। স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে পূর্বঘাট, পশ্চিমঘাট, গোদাবরী নদী, গোগেনাকাল ঝরনা, নীলগিরি পর্বত, বিন্ধ্যপর্বত প্রভৃতি।
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আমাদের অভিযান বাধাপ্রাপ্ত হবে কোথায়?
চাণক্য বললেন, এটি পূর্বঘোষিত কোনো যুদ্ধ নয়। তাই সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। যেকোনো স্থানে বাধা আসতে পারে। উত্তর থেকে দক্ষিণে যাত্রা।
আমরা তো আর রাজধানী থেকে সৈন্য পাঠাচ্ছি না। দক্ষিণে আমাদের সর্বশেষ সীমান্তে সৈন্য জড়ো করব। সেখানে আমরা পৌঁছার পর অভিযান শুরু করব।
মহামান্য সম্রাট ঠিকই বলেছেন, বললেন প্রধান সেনাপতি।
কিন্তু সুনির্দিষ্ট স্থানটি কোথায়? তার দূরত্ব কত?
মানচিত্র বিশেষজ্ঞ সেনাপতি তেলিঙ্গানা স্থানটি দেখিয়ে অমরাবতী থেকে এর দূরত্ব গণনা করে দিল।
চাণক্য বললেন, হিসাব ঠিক আছে।
মাঝখানে কোনো বাধা? সম্রাটের প্রশ্ন।
আমাদের অধিকৃত এলাকায় কোনো সমস্যা নেই, বললেন প্রধান সেনাপতি।
চাণক্য হঠাৎই বললেন, ধরণীকোটা এবং ভাদ্দমানু গ্রাম দুটি অমরাবতীর কাছাকাছি। এ দুটো গ্রামও বিখ্যাত। এখানেও তাদের সেনাশিবির থাকতে পারে।
প্রধান সেনাপতি বললেন, আমরা গ্রাম দুটিতে অভিযান চালিয়ে প্রথমেই অধিকারে নিয়ে নেব। উপকূলীয় পথে আমাদের পদাতিক বাহিনী এ অভিযান চালাবে।
বড় দুর্ধর্ষ বাহিনী উপজাতিদের। খুবই সাবধানে অভিযান চালাতে হবে, বলে সম্রাটের দিকে তাকালেন মহামন্ত্রী। উদ্দেশ্য, সম্রাটের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা।
সম্রাট বললেন, খুবই সাবধানে।
চাণক্য স্বস্তির মাথা নাড়লেন।
সম্রাট বললেন, অন্ধ্র দখল করে আমরা অমরাবতীতে দাক্ষিণাত্যের শাসনকেন্দ্র স্থাপন করব (তাঁর ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল। সম্রাট অশোকের সময় তো বটেই, তার কিছুকাল পরও খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ পর্যন্ত অমরাবতী মৌর্যদের দক্ষিণাঞ্চলীয় শাসনকেন্দ্র ছিল)।
চাণক্য বললেন, অবশ্যই। অমরাবতীই আমাদের মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সমুদ্রসীমা।
সম্রাট বললেন, তাহলে সৈন্যদের সীমান্তে পাঠিয়ে দিন এবং আমাদের যাত্রার দিনক্ষণ নির্ধারণ করুন। সেনাপতি আগেই যাবে। পরিকল্পনা মতে যুদ্ধশিবির স্থাপন, আক্রমণস্থল নির্ধারণ, রসদ-যানবাহন প্রেরণ, দাস-দাসী এবং বিনোদন শ্রমিক পৌঁছানো নিশ্চিত করবে। সবার আগে যাবে নগর বিচারকের নেতৃত্বাধীন কর্মিকবৃন্দ, যারা সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধান করে। যুদ্ধশিবিরে যেন নগর বিচারকের সম্মানজনক আবাস থাকে।
মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, বিভিন্ন বাহিনীর আমি নাম ধরে ডাকব, দায়িত্বপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সাড়া দেবে। নৌজাহাজের অধিপতি। লোকটি সটান দাঁড়িয়ে বলল, প্রস্তুত মহামান্য সম্রাট। এভাবে ডেকে গেলেন ষাঁড়ে টানা লরি, পদাতিক সৈন্য, অশ্বারোহী, গজারোহী, রথী এবং সবশেষে রাজকীয় সুস্থির বাহিনীর বা সম্মিলিত বাহিনীর তত্ত্বাবধায়ককে, যারা সরাসরি সম্রাটের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সম্রাট বললেন, এ যুদ্ধে নৌবাহিনীর ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পর্বতবাহিনীকেও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
চাণক্য সম্রাটের কথায় বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেন।
অবশেষে সম্রাট বললেন, এটাই আমাদের এখানে শেষ প্রস্তুতি সভা। যুদ্ধশিবিরে পৌঁছে বাকি কথা।
.
এদিকে মেগাস্থিনিস গেছেন আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে। আজকে তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। ভদ্ৰবাহু হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, দূতপ্রবর, আসুন। অনেক দিন পর আপনাকে দেখলাম।
আচার্য, আমি এসে এসে ফিরে যাচ্ছি। আপনার সাক্ষাৎ মিলছে না।
এখন দেখা হয়ে গেল, বলুন কী অবস্থা?
স্থুলভদ্রের সঙ্গে দেখা হলো সেদিন।
কোনো সমস্যা?
না, সে রকম না, আপনার মতো না।
সবাই কি এক রকম হয়? হয় না।
সম্রাট তাহলে অন্ধ্রে অভিযানে যাচ্ছেন। আমার মনে হয় সম্রাটকে কেউ পরাজিত কিংবা ইন্ডিয়া কেউ দখল করতে পারবে না।
কেন?
মেগাস্থিনিস বললেন, গ্রিক ডায়োনিসাস এবং হারকিউলিসের মতো দেবতা এখানেও আছেন।
আপনি তাঁদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন?
পাইনি, তবে মূর্তি দেখেছি এবং বিজ্ঞ ইন্ডিয়ানরা এ কথা স্বীকারও করেছেন।
আচার্য মেগাস্থিনিসের কথা শুনে হাসলেন। মেগাস্থিনিস আবার বললেন, যে জন্য এসেছি, মানুষ কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে কথা বলবে, তা আপনি সমর্থন করেন?
আচার্য ভদ্ৰবাহু বুঝতে পারলেন মেগাস্থিনিস কী বোঝাতে চাইছেন। বললেন, স্থূলভদ্র আমাকে বলেছে। আমি সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছি। সম্রাজ্ঞীও খোঁজখবর নিচ্ছেন। সুসংবাদ আপনি পেয়ে যেতে পারেন।
এরা স্বাভাবিক মানুষের মতো লোকালয়ে বাস করতে পারবে?
কিন্তু সাধারণ মানুষ যে তাদের মুখ দেখতে চায় না।
তাদের ভুল ভাঙতে হবে, আচার্য। মহামন্ত্রীর অবস্থান বোঝা যাচ্ছে না। তিনি অবশ্য আমাকে পছন্দ করেন না। তাঁর সঙ্গে শক্ত শক্ত কথা হয়েছে। তিনি পণ্ডিত মানুষ, বিচক্ষণ ব্যক্তি; কিন্তু প্রাণখোলা নন।
কথা শুনে ভদ্রবাহু হাসলেন। মেগাস্থিনিস আবার বললেন, আপনি প্রধান মন্ত্রক হলে ভালো হতো। এবার উচ্চ স্বরে হাসলেন ভদ্রবাহু।
আমি তাহলে আসি, আচার্য?
আচার্য শর্মিলাকে ডাকলেন এবং বললেন, তুমি দূতপ্রবরকে এগিয়ে দিয়ে এসো।
শর্মিলা নিঃসংকোচে মেগাস্থিনিসকে এগিয়ে দিতে গেলেন। আচার্য তাঁদের গমন পথে তাকিয়ে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। কেন তা তিনিই জানেন।