মৌর্য – ৯৮

৯৮

মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, আন্ধারেই নামে এক রাজা দাক্ষিণাত্যের অন্ধ্র শাসন করতেন। তিনি একজন শক্তিশালী উপজাতি অথবা আদিবাসী রাজা ছিলেন। তাঁর ছিল এক লক্ষ পদাতিক, দুই হাজার অশ্বারোহী এবং এক হাজার গজারোহী সৈন্য। তিনি মালভূমিতে অবস্থান করতেন।

তাঁর বিরুদ্ধে মৌর্যরা সব শক্তি নিয়োগ করতে চেয়েছে। সেলুকাসের পরাজয়ের পর দীর্ঘ সময় মৌর্য সৈন্যরা অলস সময় পার করেছে। দাক্ষিণাত্য অভিযানে সবাই যেতে চায়। রাজধানী এখন অরক্ষিত রেখে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, মৌর্যদের সাম্রাজ্য আক্রমণ করবে, এ রকম শক্তি আর আশপাশে নেই। তবু সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত পুত্রের কাছে সব বাহিনীর প্রায় দুই লক্ষ সৈন্যের একটি বড় সেনাবাহিনী রাজধানী এবং সম্রাজ্ঞী ও পুত্রের প্রতিরক্ষার্থে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এখানে সুবন্ধু ও সেনাপতি সদাচার ভট্ট থাকবেন।

চার লক্ষ সৈন্যের বিরাট বাহিনী যুদ্ধাভিযানে যাবে। কারণ, চাণক্য, চন্দ্রগুপ্ত ও ভদ্রবাহু সবাই চাচ্ছেন অভিযানটা সফল হোক এবং মৌর্য বাহিনী অবশ্যই জয়লাভ করুক। চাণক্য অভিযানটাকে অনিবার্য করে তুলেছেন যে কারণ দেখিয়ে, চন্দ্রগুপ্ত সে কারণ না জানলেও স্বপ্নজনিত আশঙ্কায় তিনি বেশি তৎপর, এ যুদ্ধে কোনো অবস্থায়ই পরাজিত হওয়া যাবে না। আচার্য ভদ্রবাহু সামনে একটা অশুভ ও ভয়ংকর কিছু আন্দাজ করছেন। মৌর্যদের পরাজয় কিংবা দুর্ভিক্ষ। তিনি এ ব্যাপারটায় নিশ্চিত হতে চান। জ্যোতিষী চর্চায় যে ফলাফল আসছে, তাতে মঙ্গল দেখছেন না। আসলে ব্যাপারটা কী, তা জানতে ধ্যানমগ্ন থাকছেন প্রায়ই। তাঁর নিশ্চিত হওয়া একান্ত জরুরি।

চাণক্য গেছেন ভদ্রবাহুর কক্ষে। ভদ্রবাহু ধ্যান করছেন। তাই অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাঁকে। অবশ্য সংবাদ দিয়ে গেলেই ভালো ছিল। সেখানে দেখা হয়ে গেল মেগাস্থিনিসের সঙ্গে। মেগাস্থিনিসও অপেক্ষা করছেন সাক্ষাতের জন্য। মেগাস্থিনিস কূটনীতিক, চাণক্যকে পছন্দ না করলেও সামনাসামনি সৌজন্য দেখাতে ভুল করেন নি, দৃশ্যত সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। চাণক্য সে রকম সম্পর্ক বজায় রাখেন না। বিদেশিদের প্রতি, বিশেষ করে বিদেশি দূতদের প্রতি রাজার কী করা উচিত, এ সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রে বিস্তর বয়ান লিপিবদ্ধ থাকলেও বাস্তবে তিনি কাজ করেন পছন্দ-অপছন্দের নিরিখে।

মেগাস্থিনিস বললেন, আপনাকে ধন্যবাদ, মহামন্ত্রী, আপনি সেদিন মহামান্য সম্রাটের কাছে আমাকে বেশ উঁচুতে স্থান দিয়েছেন।

সম্রাট যাঁকে পছন্দ করেন, মন্ত্রীরা তাঁর সম্পর্কে সম্রাটের কাছে উচ্চবাচ্য করবেন, তা স্বাভাবিক। চাণক্যও তা করেছেন একটা উদ্দেশ্য সামনে রেখে। কিন্তু আজকে বললেন ভিন্ন কথা। বললেন, দূতপ্রবর, আপনি এখানে আসার পর থেকে নিয়মরীতি ভঙ্গ করে চলেছেন। আপনাকে আমি ডেকে পাঠাতাম, ভালোই হলো, দেখা হয়ে গেল।

আমি জানি না কোন নিয়মরীতি ভঙ্গ করেছি। আর করে থাকলে সম্রাটেরই আমাকে তা বলার কথা।

সেদিন আপনি আমাকে না দেখিয়ে সম্রাটের কাছে সেলুকাসের পত্র হস্তান্তর করেছেন।

আপনি সেলুকাসের নাম উচ্চারণের আগে ‘মহামান্য সম্রাট” বলুন। আপনার কথা শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। সম্রাটের পত্র আরেক সম্রাটের হাতেই দিতে হয়। আগে ভুল করেছি, এখন আর করব না।

আপনি নুলো পর্বতের উল্টো পায়ের লোকদের নিয়ে সমস্যা পাকাচ্ছেন, যা করছেন, এটি আপনার কর্ম নয়।

দেখুন, কোনো একটি বিষয় নিয়ে আমি অনুরোধ করতেই পারি, শোনা না শোনা সম্রাটের ব্যাপার।

না, আপনি তা করতে পারেন না, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আপনি অনুরোধ-উপরোধ করতে পারেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নয়। আপনি আপনার সীমা অতিক্রম করবেন না।

আমি আমার সীমা জানি। আমি যে একজন সাধারণ দূত নই, তা আপনার জানা আছে। আপনাদের সন্ধির শর্ত বাদ দিলেও আপনার জানা দরকার, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের কারণে সম্রাটের সঙ্গে আমার নৈকট্য সৃষ্টি হয়েছে। আমি এখন যেকোনো কথা সম্রাটকে বলতে পারি, সম্রাট তা পছন্দ না করলে বলব না।

এ সময় ভদ্রবাহু এসে উপস্থিত হলেন। তাঁদের তর্কের ব্যাপারটি তাঁর কানেও গেছে। হেসে দিয়ে বললেন, তর্ক অনেক বিষয়কে পরিষ্কার করে তোলে। আমি শুনতে পারলে আমার কাছেও বিষয়টি পরিষ্কার হয়।

মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, তেমন কিছু নয়, আপনার সঙ্গে এ নিয়ে আমি পরে কথা বলব। মেগাস্থিনিস বললেন, তেমন কিছু নয়, সঠিক নয়, মহামন্ত্রী আমার কার্য, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। আমার কর্মসীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি পরে আবার আসব, আপনি মহামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলুন।

আপনি বসুন। যদি মহামন্ত্রীর সামনে কথা বলতে না চান, ভেতরের কক্ষে চলুন। দরকারি কথা আগেভাগে বলে ফেলা ভালো।

তেমন দরকারি কথা নয়, আচার্য। আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছিলাম, এখন গল্প করার মতো অবস্থা আমার নেই। আমি পরে আসব।

মন খারাপ করে যাবেন না, মাননীয় দূত। আচার্য চমৎকার মানুষ। কথা শক্ত বলেন, কিন্তু অন্তর বড় নরম, বলে হাসলেন।

মেগাস্থিনিস চলে গেলে চাণক্য বললেন, একেবারে রদ্দি। বুদ্ধিমান সেলুকাস কেন যে তাঁকে পাঠালেন, আমি বুঝতে পারছি না।

আমি দেখেছি আপনারা দুজন মেগাস্থিনিসকে বোকার হদ্দ বলেন, একজন মহাপণ্ডিত আচার্য চাণক্য, অর্থাৎ আপনি, আরেকজন লাউডিসের শিশু মেয়ে হারমিজ।

শিশুরা সত্য কথাই বলে।

মহাপণ্ডিতেরাও শিশু, বলে দুজন খুব হাসলেন।

শিশুদের মতো ঝগড়া করি বলে? আচ্ছা, যে কথা বলব বলে এসেছি তা হলো, যুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত। একটা অনুলিপি আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি। সম্রাট যেন কোনো অজুহাতেই অভিযানে পিছিয়ে না পড়েন অথবা বাদ না দেন।

তারিখ নির্ধারণ হয়েছে?

সেটি আপনার মতামতের ওপর নির্ভর করছে।

আপনাদের পছন্দের সময় কোনটি?

বর্ষাকাল বাদ দিয়ে বাকি সব সময়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

ব্রাহ্মণী কি তাড়া দিয়েছেন?

তিনি তাঁর মতোই আছেন। তা থাকুন, দূরে থাকাই ভালো, কাজকর্মে সুবিধে।

মেয়ের ব্যাপারে কোনো অনুযোগ?

তা তো আছেই, আমারও তো একটা পিতৃহৃদয় আছে। আছে না?

গোয়েন্দারা কোনো সন্ধানই পেল না?

চেষ্টা করছে। এদের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জানেন আচার্য, নানা কারণেই সংসারবৈরাগ্যটা মাঝেমধ্যে আমার মধ্যে অনিবার্য হয়ে ওঠে। মনে হয় লোক-সংসার ছেড়ে যাই।

‘সেখানেতে সর্বসুখ’, এই আপনার বিশ্বাস?

সুখ না থাক, অশান্তি তো নেই।

বাস্তবটা কী, আচার্য জানেন, মানুষ নিয়ে যেমন চলে না, মানুষ ছাড়াও চলে না।

একটা বিষয়, হঠাৎ করেই চাণক্য বিষয়টার অবতারণা করলেন।

ভদ্ৰবাহু বললেন, সম্ভবত বিশাখাকেও এ ব্যাপারটা আপনি বলেছেন। বিশাখা আমার সঙ্গে কথা বলেছে। শর্মিলা উপস্থিত ছিল। আচার্য, আমি শর্মিলাকে চিনি, ছোট থেকেই তাকে দেখছি। সে আমার সঙ্গেই থাকে। বিশাখাকে আমি যে কথা বলেছি, আপনাকেও বলি, তার ওপর আমার আস্থা আছে। সে মেগাস্থিনিসের দোভাষী, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। আমি চাই কাজটি সে করুক।

আপনার এবং আমাদের কোনো গোপন তথ্য…

চাণক্যের কথার মাঝখানে ভদ্রবাহু বললেন, সে কখনোই তা করবে না। আমরা যদি মেগাস্থিনিসের তথ্য…

এবার চাণক্য বললেন, ঠিক কথা বলেছেন। আমার গোয়েন্দাগুলো কোনো কাজের না। আমার কথা শেষ হয় নি, আচার্য, তথ্য চাই, তাও সে দেবে না। আর আমি কখনোই তাকে এ কাজে লাগাব না। সে একজন সন্ন্যাসিনী, জৈন মন্দিরের সেবায়েত, তার বেশি কিছু নয়। প্রসঙ্গান্তরে বললেন, মিহিরের প্রেত কি সাক্ষাৎ দেয়?

না না। বেশ নিশ্চিন্তে আছি, আপনার ওপর এসব চিন্তা ছেড়ে দিয়ে ভালো আছি।

তাহলে সামনে যুদ্ধ। রাজা আন্ধারেই আসলে কি খুব ভয়ংকর? একজন উপজাতি রাজা এত শক্তিশালী হওয়ার কথা নয়, তার কি কোনো সহযোগী রাজা আছেন?

একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চাণক্য বললেন, গোয়েন্দাদের দিয়ে খবর নিয়েছি, খুব ভয়ংকর নয়। কিন্তু আমি এখন একটি যুদ্ধ চাচ্ছি। এভাবে আর কত? রাজা যুদ্ধ না করে বসে থাকবে, তা হয় না। রাজকোষ খালি। যুদ্ধ না করলে সম্পদ আসবে কোথা থেকে? তিনি প্রজাদের ওপর করারোপ একদম পছন্দ করেন না। এ ছাড়া…

হেসে দিয়ে ভদ্রবাহু বললেন, আচার্য, আপনার পক্ষে যায়, এ রকম ঘটনা বাস্তবিকই ঘটছে। না হয় এ সময় সম্রাট দুঃস্বপ্ন দেখবেন কেন?

চাণক্য বললেন, আপনি সহায়, বলে তিনিও হাসলেন। বড় নির্ভরতার হাসি।

ফিরে যাওয়ার সময় চাণক্য উপলব্ধি করলেন, শর্মিলার ওপর তাঁর ক্রোধটা রয়ে গেছে। তাহলে কি গোয়েন্দা দিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবেন। কেউ তাঁর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলে তাকে ক্ষমা করেন নি কখনো। কিন্তু মাঝখানে যে আচার্য ভদ্রবাহু এবং একটি অলঙ্ঘনীয় ও অনিবার্য যুদ্ধ।

.

বিন্দুসার যুদ্ধে যাবেন না। কিন্তু যুদ্ধের বিষয়ে তিনি একেবারে নির্লিপ্ত নন। সম্রাজ্ঞী চাইছেন বিন্দুসার যুদ্ধবিদ্যায় বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করুন এবং তাঁর নিজের অবদান রাখুন। তাঁর বিশ্বাস, বিন্দুসারের দেওয়া মতামত সম্রাটের অনেক কাজে আসবে।

সম্রাজ্ঞী বিন্দুসারকে নিয়ে সম্রাটের কাছে উপস্থিত হয়েছেন। সম্রাট তাঁর কর্মকক্ষের বারান্দায় পায়চারি করছেন। হাতে চূড়ান্ত যুদ্ধ পরিকল্পনা। খানিকটা উত্তেজনা কাজ করছে তাঁর মধ্যে। যুবরাজ পুত্র ও সম্রাজ্ঞীকে একসঙ্গে আসতে দেখে সম্রাট প্রীত বোধ করলেন। বললেন, ভালোই হয়েছে, তোমরা এসেছ। আমি তৃতীয় একটি পক্ষের সঙ্গে পরিকল্পনাটি নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।

হেলেন বললেন, আর দুটি পক্ষ কে?

সম্রাট বললেন, মহামন্ত্রী, সুবন্ধু এবং প্রধান সেনাপতির সঙ্গে কথা হয়েছে। এরাই মূলত যুদ্ধ পরিকল্পনাটি তৈরি করেছে। আচার্যের (ভদ্রবাহু) সঙ্গে পরামর্শ করেছি। তিনি যে উপদেশ দিয়েছেন, তা-ও মাথায় আছে। এখন পরিবার। পরিবারই হচ্ছে চূড়ান্ত অনুমোদনকারী।

বিন্দুসার, তুমি পরিকল্পনাটি পাঠ করো এবং তোমার মতামত দাও, বললেন সম্রাজ্ঞী। আমি তোমার মতামতের গুরুত্ব দিই, আমার বিশ্বাস, সম্রাট তোমার মতামতের মূল্যায়ন করবেন।

বিন্দুসার যুদ্ধ পরিকল্পনাটির ওপর চোখ বোলাতে থাকলেন। সম্রাজ্ঞী বললেন, সব যুদ্ধের ক্ষেত্রেই কি আপনি এমন গুরুত্ব দিয়েছেন?

নন্দরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ হয় নি, যার জন্য আমরা হেরে যাই। বিশ্বাস করো আর না-ই করো, একজন সাধারণ হতদরিদ্র মহিলা আমাদের ভুল ধরিয়ে দিয়েছিল।

পরে তাকে পুরস্কৃত করেন নি?

সে পর্বে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন শুধু আচার্য চাণক্য।

তার মানে করা হয় নি।

এখন হবে। এখন আমিই সিদ্ধান্তদাতা।

পরামর্শ দাতারা না চাইলে?

এখন পরামর্শ আমি শুনতে পারি, না-ও শুনতে পারি। একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও আমারই, বলে হাসলেন চন্দ্রগুপ্ত।

বিন্দুসারের মেধা অত্যন্ত প্রখর। অতি দ্রুত পরিকল্পনাটায় ডুবে গেলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, গোয়েন্দা তথ্যটা সঠিক বলে আমি মনে করি না।

কোনটা, প্রশ্ন করলেন সম্রাট।

একজন উপজাতি রাজার এত সৈন্যসামন্ত থাকতে পারে না। এ ছাড়া অর্থশাস্ত্রের নিরিখে পরিকল্পনাটা করা হয়েছে। এতগুলো যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা কোথায়? অর্থশাস্ত্রের প্রায়োগিক বিষয় নিয়ে আমি তক্ষশীলায় প্রচুর বিতর্ক করেছি। আচার্য কৌটিল্যের সমসাময়িক এবং পূর্ববর্তী আচার্যদের মতামত প্রাসঙ্গিকভাবে এসে গেছে। যুদ্ধ পরিকল্পনা হবে বাস্তব প্রেক্ষিত বিবেচনা করে। শুধু গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভরশীলতা সব প্রয়োজন মেটাতে পারে না। আমি দেখেছি, সব কটি খাতে অতি-বরাদ্দের প্রবণতা। মহামন্ত্রী বলেছেন, দাক্ষিণাত্য সম্পদশালী অঞ্চল। সে সম্পদ আর্থিক খাতে সহায়ক জোগান হিসেবে কাজ করবে। গোয়েন্দা সূত্রের তথ্যের ওপর নির্ভর করে প্রায় সাড়ে চার লাখ সৈন্যের বাহিনী অভিযানে যুক্ত করা হচ্ছে। এর ব্যয় নির্বাহের বাজেট লাগামহীন মনে হয়েছে আমার কাছে। আসলে কি এত সৈন্যের প্রয়োজন আছে এ অভিযানে? এত সৈন্য কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে? মহামান্য সম্রাট, আপনি চাইলে আমি একবার ঘুরে দেখে আসতে চাই অন্ধ্ররাজ্যের কী অবস্থা।

সম্রাট হেসে দিয়ে বললেন, তোমার বক্তব্য ঠিক আছে, বিন্দুসার। তক্ষশীলায় আচার্য চাণক্যের কাছে শিক্ষা লাভ করার সময় আমার মনেও নানা প্রশ্ন জেগেছে। আচার্য তক্ষশীলা ছেড়ে এসেছিলেন, আমাকে নিয়ে আবার গেছেন। বাস্তব যুদ্ধেও আমার সঙ্গে থেকেছেন সব সময়। একটি ছাড়া সব যুদ্ধেই আমরা জয়লাভ করেছি। বাস্তব প্রেক্ষিত বিবেচনা করে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে। তোমাকে আমি বাঘের সম্মুখে পাঠাতে পারি না। যারা আমার সঙ্গে যাচ্ছে, তাদের অভিজ্ঞতা আছে। আমরা আমাদের মেধা, কৌশল ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাব।

সম্রাজ্ঞী বললেন, অন্য কাউকে পাঠানো যায় না? দেখে আসুক বাস্তবটা কত সংগতিপূৰ্ণ।

সময় যে নেই, সম্রাজ্ঞী। তা ছাড়া মহামন্ত্রীর দেওয়া পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলবে না।

আপনি চাইলেও না, বললেন বিন্দুসার।

সম্রাট অন্যভাবে উত্তরটা দিলেন। বললেন, এখন আমি চাইবও না। শক্তিকে বিভক্ত করতে চাই না আমি। যুদ্ধে এখন জয় লাভটাই মুখ্য। সম্রাজ্ঞী, তুমি তো সবই জানো।

হেলেন বললেন, তারপরও আমি বিন্দুসারের মতামতকে সমর্থন করব।

বড় বড় যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি, সেসব এলাকায় আগে কাউকে না পাঠিয়েই। সামনে যা বাধার কারণ হবে চুরমার করে যাবে আমার সৈন্যরা।

সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে?

বিন্দুসারের প্রশ্নের জবাবে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?

প্রজাসাধারণের জীবন ও সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব বিজয়ী রাজার।

তাতে সন্দেহ নেই। তবে সেখানে আমি কোনো অশুভ শক্তিকেই অবশিষ্ট রাখব না।

বিন্দুসার ও হেলেন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। হেলেন বললেন, গ্রিক পুরাণে আছে, সব ভুলই প্রতিফল হয়ে ফিরে আসে। আপনার শুভ কামনা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই, সম্রাট।

তোমরা দেখো, এবারও আমরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *