৯৭
স্ট্রেটোনিসের মন খারাপ। এন্টিওকাস তাঁকে বোঝাতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। এন্টিওকাস বাবাকে এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। মনে করছেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে, বাবা কোনোরূপ বিদ্বেষ পোষণ করেন নি। এ ছাড়া সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার পাওয়া তাঁর জন্য সময়ের ব্যাপার। এ কথাই বোঝাচ্ছেন তিনি।
সেলুকাসের কথা শুনলেই স্ট্রেটোনিসের পিত্তে জ্বলে ওঠে। অথচ এন্টিওকাস সেলুকাসের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন! স্ট্রেটোনিসের এক কথা, এক দাবি, সেলুকাসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। কৃত্রিম স্ট্রেটোনিস সম্রাজ্ঞী হয়ে সেলুসিড সাম্রাজ্যের বেটার হাফ হয়ে থাকবে, তা অসহ্য।
এন্টিওকাস মাঝেমধ্যে মজা করে বলেন, তোমার নামটা রাজপ্রাসাদ এবং সাম্রাজ্যের সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে, এ আর কম কী। আসল সম্রাজ্ঞী তো তুমিই।
স্ট্রেটোনিস বলেন, দেখো, এ প্রসঙ্গে একদম কোনো কথা বলবে না। তুমি সাম্রাজ্যের সিংহাসন পেলে ওই মেয়েকে আমি প্রথম দিনই মারব। অবশ্য আমি নিশ্চিত, তুমি কখনোই সম্রাট হচ্ছ না। তুমি একটা সাত্রাপের (প্রদেশ) শাসনকর্তাই থাকতে চাও।
তুমি আমাকে যত আঘাতই করো না কেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি, স্ট্রেটোনিস। ভালোবাসার অভিনয় কোরো না। আজ পর্যন্ত তুমি আমার কোনো ইচ্ছা পূরণ করো নি। আমি অযথাই তোমার সন্তান উৎপাদন করে চলেছি।
অযথা নয়, সেলুসিয়ার ভবিষ্যৎ সম্রাজ্ঞী! তুমিই সম্রাজ্ঞী হচ্ছ।
এত নিশ্চিত হলে কী করে? বুড়োটা তোমাকেই সাম্রাজ্য দিয়ে যাবে, বললেটা কে? দেখবে ওই ছুকরিটাকেই সিংহাসনে বসিয়ে যাবে।
তার পরিণাম কি ভালো হবে?
যুদ্ধ করবে তুমি? ওদেরই সৈন্য বেশি, জেনারেল বেশি। তুমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
ভুল বললে। গ্রিসে এমন কোনো নজির নেই, কোনো মহিলা সম্রাট হয়েছে।
এশিয়া মাইনরের একাংশের রানি কে? সে কার সন্তান?
আর্সিনোয়ের কথা বলছ? লাইসিমেকাসের তৃতীয় স্ত্রী?
তোমার দাদা টলেমির মেয়ে। তুমি সম্রাট হতে পারলে অবশ্য এ রকম তৃতীয় স্ত্রী তোমারও থাকবে।
এবং সে-ও সম্রাট হবে, এই তো?
মজা কোরো না। তুমি সম্রাট হচ্ছ না। সম্রাট হতে হলে বুদ্ধির দরকার হয়। দেখো না বুড়োটা বুদ্ধি খাটিয়ে আলেকজান্ডারের সব রাজ্য দখলে নিয়েছে। বাকি রয়েছে ইজিপ্ট।
একবার এন্টিওকাস প্রায় বলে ফেলেছিলেন, বুদ্ধিমান বুড়োটাকে কেন ছেড়ে এলে তুমি, নির্বিঘ্নে সম্রাজ্ঞী থাকতে পারতে, সিংহাসনের জন্য আমিও নিশ্চিত থাকতে পারতাম। বললেন না তিনি। চুপ করে রইলেন। স্ট্রেটোনিস আবার বললেন, চলো ইজিপ্টের কেরাউনোসের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
কেন?
তাকে আমি সঙ্গে রাখতে চাই। তাতে আমাদের শক্তি বাড়বে। আমি শুনেছি দিমিত্রিয়াসের কন্যাকে সে পছন্দ করত। একটা শক্ত বিরোধ আছে সেলুকাস ও কেরাউনোসের মধ্যে। সে নারীর প্রতি আকর্ষণ আছে তার, আমরা তা কাজে লাগাবই।
তুমি একটু শান্তিতে থাকতে পারছ না?
শান্তি পাচ্ছি কোথায়? চারদিকে এত ঝামেলা রেখে শান্তি পাই কী করে?
আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, ওটি তার আসল নাম।
সেলুকাসের দেওয়া নাম নয়?
না।
স্ট্রেটোনিস একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আমি তো বলি নি তা যাচাই করতে, তুমি এতে আগ্রহী হলে কেন?
প্রয়োজন ছিল।
কী প্রয়োজন?
আমি চাই না তোমার নামটার বহিঃপ্রকাশ ঘটুক ওই মেয়ের মধ্য দিয়ে।
বহিঃপ্রকাশ?
বুঝলাম না।
তোমার বোঝার দরকার নেই।
আমার বোঝার দরকার নেই? বেশ, তাই হোক। আমি নিজে টলেমি কেরাউনোসের সঙ্গে যোগাযোগ করব।
তুমি একবার দিমিত্রিয়াসের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলে, যার ফল খুবই খারাপ হয়েছে।
এবার হবে না। অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।
এন্টিওকাস হতাশ হয়ে বললেন, তোমার যা খুশি করো। তার আগে আমার কথা বাদ দাও, তোমার সন্তানদের কথা ভাবো একবার।
স্ট্রেটোনিস স্বগত উক্তি করে বললেন, মাছের মায়ের আবার পুত্রশোক।
তুমি বললে কিছু?
না, আমি থামব না। আমি তোমাকে না জানিয়েই কেরাউনাসের সঙ্গে যোগাযোগ করব।
.
হেলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ঘনিষ্ঠ হয়ে বললেন, সম্রাট, আজকে আমার খুব ভালো লাগছে।
কেন?
এ জন্য যে মৌর্য সাম্রাজ্য একজন যোগ্য উত্তরাধিকারীকে পাচ্ছে।
কী করে বুঝলে?
আজ সকালে সংগীতচর্চা কেন্দ্রে গিয়েছিল বিন্দুসার। সেখানে তার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। অগাধ জ্ঞান আর বুদ্ধির অধিকারী সে। কৌতুকবোধও প্রচুর।
সংগীত পছন্দ করে সে?
করে। সংগীত সম্পর্কে অনেক কিছু জানেও।
দেখো, সেই ছোটবেলা থেকে বিন্দুসার প্রাসাদ থেকে দূরে। শিক্ষার নামে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছি দূরে। তাকে জানবার, বুঝবার সময় পেলাম কোথায়? সেদিন আমাকে এসে বলল, বাবা, সম্রাজ্ঞীকে কি আমি ‘মা’ সম্বোধন করব? আমি বললাম, তোমার যা পছন্দ, তা-ই করো।
সে আমাকে ‘মা’ সম্বোধন করে। বলে একটু আবেগময়ী হয়ে উঠলেন হেলেন। ও আমার ছেলে, আমারই। এ সন্তান উপহার হিসেবে দিয়ে যাওয়ার জন্য সম্রাজ্ঞী দুরধরাকে নমস্কার জানাই। বলে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন।
হেলেন তোমাকে বলা হয় নি, তুমি জানতেও চাইলে না তোমার বাবার লেখা পত্রে জরুরি কী আছে।
সেলুসিড সম্রাটের বয়স হয়েছে। তাঁর প্রয়োজন যৌন-উত্তেজক ওষুধাদি, যা আপনি পাঠান, তাঁর প্রয়োজন যুদ্ধহস্তী, যা আপনি পাঠান, তাঁর প্রয়োজন…হেলেনের অভিমানটা চন্দ্রগুপ্ত বোঝেন, তাই তাঁকে কাছে টেনে নিয়ে তাঁর মুখ চেপে ধরলেন। বললেন, আমি জানি কোথায় তোমার কষ্ট। তারও তো কষ্ট আছে। কোন সম্রাট চান তাঁর কন্যা বিদেশি, অন্য এক ভাষার সম্রাটের স্ত্রী হোক — যাদের সঙ্গে রক্ত, শরীর, বর্ণ, চিন্তা কোনোটারই মিল নেই।
কিন্তু আপনার সঙ্গে তো তাঁর ভালো সম্পর্ক। চন্দ্র ছাড়া কথা নেই। তা কেন আমি জানি। তাঁর রক্ত-মাংস ও বর্ণের কথা বলছেন? আমার আপন মায়ের চেয়ে যে প্রিয়, ভুল বললাম, স্ট্রেটোনিসের সঙ্গে আমার (সৎ) মা আপামার তুলনা হয় না, আপামা দেবীতুল্য নারী, তাঁকে বিয়ে করেন নি? জোর করে বিয়ে করলে সম্রাটের ব্যাকরণে ভুল নেই। ভালোবেসে বিয়ে করলে যত সমস্যা? আপনি যদি ওই দিন জোর করতেন, কী করার ছিল তাঁর? আমাকে সম্মান করেছেন, আমার ভালোবাসার মর্যাদা দিয়েছেন, আমি সম্মানিত হয়েছি—এটাই তাঁর অপছন্দ?
সব বাবারাই মেয়ের কল্যাণ চান। তোমার বেলায়ও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটে নি। আমাকে লেখা সব পত্রেই তিনি তোমার খোঁজখবর নিয়েছেন।
আমি তা জানি। কিন্তু আপনি যা জানেন না তা হলো গ্রিকরা মনে করে তারাই শ্রেষ্ঠ। তারাই সব কিছু করার অধিকার রাখে, অন্যরা নয়। তাদের ইতিহাস কিংবা অভিধানে ‘বেঠিক’ কোনো শব্দ নেই।
সম্রাট এবার হেসে দিয়ে বললেন, তুমিও তো গ্রিক, তাই তোমার অভিধানেও ‘বেঠিক’ শব্দ থাকার কথা নয়, তুমি যা করেছ, সব ঠিক করেছ।
আমি ওদের মতো গ্রিক হতে চাই না, যারা (সৎ) মাকে বিয়ে কিংবা আপন বোনকে ভোগ করে।
ইডিপাস নাটকের কথা প্রসঙ্গক্রমে তুমি আমাকে বলেছিলে, বলে থামলেন চন্দ্রগুপ্ত। রাজা ইডিপাস না জেনে আপন মাকে বিয়ে করেছিলেন। যখন জানলেন, তখন নিজের চোখ তুলে অন্ধভাবে সিথায়েরন পর্বতে নির্বাসনে যান। গ্রিসে তো ভালো মানুষও আছেন।
আমার চারপাশে যারা আছে, সেসব পুরুষ গ্রিকদের আমি শ্রদ্ধা করতে পারছি না। বাকি গ্রিকদের প্রতিও আমি বীতশ্রদ্ধ।
এ কথা বোলো না, লক্ষ্মীটি। দিদাইমেইয়ার মতো মানুষকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায়? যায় না। আমি লাউডিস, নিকো, ফাওলিন—এদেরও দেখেছি। সত্যিকার অর্থেই এরা সবাই চমৎকার মানুষ। আভিজাত্যের দিক থেকেও সর্বোচ্চ। এই যে মেগাস্থিনিস, তাকেও আমার দারুণ মানুষ মনে হয়। সে তো তোমাদের আত্মীয়-পরিজন কেউ নয়, তাকেও তুমি অসম্মান করবে? সেদিন আমার কাছে এসে বললেন, সম্রাট, আমি আপনার কাছে একটা দাবি নিয়ে এসেছি। আমি ভাবলাম কি-না-কি দাবি নিয়ে এসেছে। তবু বললাম, বলুন, কী দাবি। বললেন, আমি ওই উল্টো পায়ের মানুষগুলোর মুক্তি চাই, এরা তো কোনো অপরাধ করে নি, কেন নির্বাসনে যাবে? আমি বললাম, দীর্ঘকালের সংস্কার, এদের দেখলে যাত্রা শুভ হয় না। তিনি বললেন, আপনি বিশ্বাস করেন? আমি বললাম, তা ভেবে দেখি নি। তা ছাড়া তা সাম্রাজ্য চালনার জন্য সমস্যা নয়। বরং মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সমস্যা। নতুন সমস্যা আমি ডেকে আনতে চাই না। তিনি বললেন, মহামান্য সম্রাট, আপনি আমার এ অনুরোধটা রাখুন। আমি তাকে নিবৃত্ত করতে বললাম, ভেবে দেখব, মন্ত্রণাদাতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
আপনি তাকে ভালো মানুষ বলছেন, তার দাবি মানছেন না কেন?
তোমার কী মত?
আমি এখনই ঝট করে মতামত দিতে পারি না। ব্যাপারটা এত দিনেও আমার জানা হয় নি। আমি খোঁজখবর নিই। তারপর জানাব।
.
মেগাস্থিনিস গেছেন আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে। আচার্য কেন্দ্রীয় মন্দিরে নেই, প্রাসাদে আছেন। তাই দেখা হয়ে গেল স্থলভদ্রের সঙ্গে। স্থুলভদ্র চৌকস মানুষ। মোটামুটি ভালো জ্ঞান রাখেন। তাঁর সমস্যা হচ্ছে ভালো গ্রিক জানেন না। তাই খোঁজ পড়ল শর্মিলার। আচার্য ভদ্রবাহুর দেওয়া প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারছেন তিনি। স্থুলভদ্রের ডাকে দ্রুতই আসতে হলো। এখানে মেগাস্থিনিসকে দেখে খুব রাগ হলো তাঁর। রাগ বেশি হওয়ার কারণ, তাঁর মনে হয়েছে, মেগাস্থিনিস তাঁকে স্থুলভদ্রের দ্বারা ডেকে আনিয়েছেন। শর্মিলা বুদ্ধিমতী। কাউকে রাগটা বুঝতে দিলেন না। মেগাস্থিনিসের সঙ্গে হেসে কথা বললেন। মেগাস্থিনিস অবাক হলেন।
শর্মিলার সাহায্যে মেগাস্থিনিস জানতে চাইলেন সুলভদ্র কেমন আছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে এখানে তিনি কী কী করেন।
স্থলভদ্রের কাজ অনেক। তবে তিনি এখনো শিখছেন। বললেন, শিক্ষার তো আসলে শেষ নেই। বিশেষ করে শ্রুতকেবলী বা সর্বজ্ঞান বিশেষজ্ঞ আচার্যের কাছ থেকেই শিখছেন তিনি। এ শেখার মধ্যে মাঝেমধ্যে তাঁর হৃদয়ে উচ্ছ্বাস জাগে, কেন তা তাঁর জানা নেই। মাঝেমধ্যে সে কথাও মনে পড়ে, একেবারে প্রথম জীবনে কিছুই তো ছিল না। আচার্যের সান্নিধ্যে এসে নাম-যশ সবই হয়েছে। তবু কেন যেন আচার্যকে অতিক্রমের ইচ্ছা হয়। শ্বেতাম্বর একটা ধারার জন্ম দিলে কেমন হয়? আবার ভাবেন, এ রকম ভাবাটা অন্যায়। গুরুর নাম নিতে প্রাচ্যের মানুষ যা করে, কর্ণ স্পর্শ, তাই করলেন তিনি। মেগাস্থিনিসকে বললেন, প্রাচ্যের মানুষ কর্মকেই ধর্ম জ্ঞান করে। সাধকের কর্ম হচ্ছে গুরুকে সন্তুষ্ট করা। এসব কথার মর্ম খুব একটা অনুধাবন করতে পারলেন না মেগাস্থিনিস। বোকার মতো শর্মিলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শর্মিলা এতে বেশ মজা পেলেন। ঠোঁট চেপে হাসলেন।
মেগাস্থিনিস বললেন, ভুল কিছু কি করেছি?
শর্মিলা এবার মুখ চেপেই হু হু করে হাসলেন।
সুলভদ্র শাসনের ভঙ্গিতে তাকালেন। বললেন, বিশাখার সঙ্গে কি সাক্ষাৎ হয়েছে? তোমাকে খুঁজছিলেন তিনি।
আমি যাচ্ছি, আচার্য।
শর্মিলা চলে গেলে স্কুলভদ্র বললেন, সন্ন্যাসিনীদের এত হাসতে নেই। ইদানীং তাঁর মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।
শর্মিলা চলে যাওয়ায় মেগাস্থিনিস বিরক্তই হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
শর্মিলা বিশাখার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বিশাখা প্রবীণ এক জৈন সন্ন্যাসিনী। একেবারে প্রাচীনপন্থী।
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মতো রক্ষণশীল। ধর্মীয় আচারে অতীব নিয়মনিষ্ঠ। লোকমহলে বড় একটা বের হন না। শর্মিলাকে ডেকে বললেন, শর্মিলা, আমি তোমাকে যে কারণে খোঁজ করেছি, মহাচার্য এখন কোথায়?
সম্রাটের প্রাসাদে আছেন তিনি।
তিনি ফিরে এলে আমাকে জানাবে।
কিছু কি বলতে হবে?
আমিই বলব, তুমি উপস্থিত থেকো।
শর্মিলা কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কী বলবেন তিনি? তাঁর সম্পর্কে নয় তো?
.
নুলো পর্বতের উল্টো দিকে যাদের নির্বাসনে রাখা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে মেগাস্থিনিস স্থুলভদ্রের মতামত জানতে চাইলেন।
স্থুলভদ্র বললেন, এদের ব্যাপারে আপনার আগ্রহ কেন?
এরা মানুষ নয়? আমি সম্রাটকে বলেছি।
কী বললেন তিনি?
যা বলেছেন, তাতে আমি সন্তুষ্ট নই।
স্থুলভদ্র হেসে দিয়ে বললেন, আপনার এ তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
কেন?
আপনি ভুল করছেন
আমি ভুল করছি?
রাষ্ট্রদূতের এটা অনধিকারচর্চা।
আমি আপনার কথায় সন্তুষ্ট নই।
আমার আসলে কিছু করারও নেই, আপনি সুবন্ধুর কাছে যেতে পারেন।
যাব, আমি সব জায়গায়ই যাব। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
আপনি এ রকম কঠিন শপথ করবেন না। মহামন্ত্রী তা ভালোভাবে নেবেন না!
মেগাস্থিনিস বললেন, আমি এখন সুবন্ধুর কাছে যাব। পরে সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে দেখা করব।
.
মেগাস্থিনিস সুবন্ধুর কাছে গেলেন। সুবন্ধু খুবই ব্যস্ত। মহামন্ত্রী চাণক্য তাঁকে বলেছেন, দাক্ষিণাত্যে যে অভিযান শুরু হবে, তার একটি খসড়া যেন সেনাপ্রধানকে নিয়ে প্রস্তুত করে চাণক্যকে দেখান। সেদিন মহামান্য সম্রাট মহাসভায় যে সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছেন, সেগুলো মূল পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে খসড়া করতে হবে এবং মহামন্ত্রী দেখে দিলে সম্রাট তা চূড়ান্ত করবেন। এখানে মহামন্ত্রীর একটি রাজনৈতিক চাল আছে। সম্রাট সুবন্ধুকে পছন্দ করেন, পরিকল্পনাটি তাঁর হাত ঘুরে যাওয়ার মানে হচ্ছে, সম্রাটের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া।
মৌর্য শাসনব্যবস্থায় সুবন্ধুর স্থান ছিল তিনে। এখন বিন্দুসার ফিরে আসার পর চারে। তাঁর লক্ষ্য তিনে উঠে যাওয়া। তাই সম্রাট ও বিন্দুসারের মন পেতে খুব অনুগত ও তৎপর তিনি। অদৃশ্য সংগ্রামটা চলছে মহামন্ত্রী চাণক্যের বিরুদ্ধে। চাণক্য মাঝেমধ্যে সুযোগ বুঝে তাঁকে ব্যবহার করেন, কখনোবা জলে ডুবিয়ে মারতে চান।
মেগাস্থিনিসকে সুবন্ধু পছন্দ করেন। পছন্দের অনেকগুলো কারণ আছে। মেগাস্থিনিসকে সম্রাট-সম্রাজ্ঞী পছন্দ করেন, তাই তিনিও পছন্দ করেন। তবে বড় কারণ এটি নয়, বড় কারণ হচ্ছে মেগাস্থিনিসকে মহামন্ত্রী চাণক্য অপছন্দ করেন। তাই শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেনাপ্রধানকে বিদায় করে মেগাস্থিনিসকে নিয়ে বসলেন। মেগাস্থিনিসের মনখারাপ। কারণ একটি নয়, দুটি, সে কথা আমরা জানি।
সুবন্ধু মনখারাপের কারণ জানতে গেলেন না। উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, মহামান্য দূতপ্রবরের আগমনে ধন্য হয়ে গেলাম। বলুন আপনার জন্য কী করতে পারি?
একটা ছোট কাজ আছে। স্থুলভদ্র বলেছেন এটা আপনার দ্বারাই সম্ভব হবে।
কী কাজ, মহাশয়?
মেগাস্থিনিস তাঁর কাজ সম্পর্কে ধারণা দিলেন। সুবন্ধু এ সম্পর্কে আগেই সম্রাজ্ঞীর মুখ থেকে সম্রাটের নমনীয়তার কথা শুনেছেন। জনমত সৃষ্টি করতে পারলেই সম্রাট ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেন। তাই বললেন, ধরুন, আপনার অভিযান সফল হয়ে গেছে।
কী বলছেন আপনি? মন্ত্রী মানবেন?
বললাম তো। আমি নিজেই আপনাকে সুখবরটি শোনাব।
সুবন্ধুর কথা শুনে মেগাস্থিনিস প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, আপনি অনেক পুণ্য লাভ করবেন। মন্ত্রী হবেন। আমি বলে দিলাম, আপনি অনেক দূর যাবেন। সম্রাটকে আমি বলব যে আপনার প্রশাসনে একজন পজেটিভ ম্যান আছেন, তাঁকে আপনি যথাযথ মূল্যায়ন করুন।
আমি জানি, আপনি আমাকে পছন্দ করেন। আপনি অত্যন্ত সৎ ও যোগ্য একজন রাষ্ট্রদূত আপনাকে আমি সব সময় সহযোগিতা করব।
ধন্যবাদ, বলে হাসলেন মেগাস্থিনিস।