৯৬
প্রতিবারের মতো এবারও মহামন্ত্রী চাণক্য যুদ্ধপ্রস্তুতির তেরোটি প্রকরণ বা আলোচ্য বিষয়ে সভা সঞ্চালনার দায়িত্ব পেলেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বললেন, আচার্য, প্রতিটি যুদ্ধে আমরা যেসব বিষয় গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনি, সেগুলো বিশদভাবে এবারও পর্যালোচনায় স্থান পাবে। দাক্ষিণাত্যে অভিযান একটি নতুন অভিজ্ঞতা বিধায় গুপ্তচরদের প্রতিবেদনগুলোও বিচার- বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখবে। শুরু করুন।
মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, মহামান্য সম্রাট যে কথা বলেছেন, দাক্ষিণাত্য অভিযান আমাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা, সে আলোকে এবারের বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে। স্কন্ধবার বা সেনাশিবির স্থাপন বিষয়ে প্রধান স্থপতি, সেনাধ্যক্ষ এবং গৃহনির্মাণের শুভক্ষণ নির্ণায়ক মৌহূর্তিক উপস্থিত আছেন। এখন স্থাপত্যবিদ্যায় বিদগ্ধ স্থপতি তাঁর মত ব্যক্ত করছেন।
প্রধান স্থপতি বললেন, মহামান্য সম্রাট, এবারের সেনাশিবির হবে বৃত্তাকৃতির। কারণ, আমাদের বলা হয়েছে, সেখানে ভূমির অবস্থান মালভূমিপ্রতিম। এ ভূমির অবস্থান সুবিধাজনক প্রকৃতির। সৈন্যদের আসা-যাওয়ার সুবিধার কথা চিন্তা করে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে চারটি দ্বারের সংস্থান রাখা হয়েছে। স্থপতি একটি মানচিত্রে যুদ্ধশিবিরের নানা দিক নির্দেশ করে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরছেন। এ পর্যায়ে তিনি বললেন, প্রধান চারটি দ্বারের পাশাপাশি সবদিকেই একটি করে গুপ্ত দরজা থাকবে।
মহামন্ত্রী বললেন, চারটি নয়, গুপ্ত দরজা থাকবে তিনটি। তাৎক্ষণিকভাবে এগুলোর সন্ধান দেওয়া হবে।
স্থপতি বললেন, সুড়ঙ্গপথ থাকবে দুটি।
মহামন্ত্রী বললেন, এগুলোর ব্যবহারকারী হবে সীমিত ও পূর্বনির্ধারিত।
স্থপতি বললেন এবং মানচিত্রে দেখালেন, শিবিরটি থাকবে নয় ভাগে বিভক্ত। শিবিরের চারপাশে এখানে পরিখা খননের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন সেনাপ্রধান
সবার দৃষ্টি এখন সেনাপ্রধানের দিকে, তিনি বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমাদের শিবিরের অবস্থান বেশ উঁচুতে। পরিখার প্রয়োজন হয় সমভূমিতে। পর্যবেক্ষণবেদি নির্মাণ করা হবে চারদিকে চারটি। প্রধান প্রধান দরজা ছাড়া চৌহদ্দির সর্বত্র চোখা বংশদণ্ড বসিয়ে শত্রুর আগমন প্রতিহত করা হবে। গুপ্ত দরজা ও সুড়ঙ্গপথে বসানো থাকবে কৃত্রিম বংশদণ্ড, যা সহজভঙ্গুর ও ক্ষতিবিনাশক।
সেনাশিবিরের মধ্যস্থলের নবমাংশের উত্তর দিকে ঠিক এ স্থানে থাকবে মহামান্য সম্রাটের আবাস। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে ১০০ x ৫০ ধনু (এক ধনুতে চার হাত)। এ আবাসনের পশ্চিম দিকে, অর্থাৎ এখানে নির্মিত হবে স্ত্রীলোকদের অন্তঃপুর। তার পাশেই থাকবে অন্তঃপুরের রক্ষীদের বাসস্থান। সম্মুখভাগে নির্মিত হবে মহামান্য সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের বৈঠকখানা। দক্ষিণ দিকে নির্মিত হবে রাজকোষ, সম্রাটের আদেশ লিখন ও প্রেরণ কার্যালয় এবং শিবির রক্ষণাবেক্ষণকাজের লোকদের আবাস।
আবাসনের বাম দিকে…সম্রাট তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, সম্রাটের আবাসনের মাপ কম- বেশি করা যায় কি না।
চাণক্য বললেন, এটাই প্রচলিত, সিন্ধুতেও তাই করা হয়েছে। আচার্যেরা এ পরিমাপের কথাই বলেছেন। আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, এটা বলেছেন রাজাদের জন্য। সম্রাটের জন্য আবাসটা আরও বড় হওয়াই যৌক্তিক।
স্থপতি বললেন, তা ঠিক। আমরা এর পরিমাপটি বাড়িয়ে দেব। আবাসনের বাম দিকে রাজাকে বহনকারী হস্তী, অশ্ব, রথ রাখার স্থাপনা থাকবে। এ বাহন স্থানের একশ ধনুর ব্যবধানে পরপর চারটি পরিবেষ্টিত স্থান থাকবে– প্রথমটি শকট, দ্বিতীয়টি কাঁটাযুক্ত বৃক্ষশাখা, তৃতীয়টি দারুময় স্তম্ভ এবং চতুর্থটি দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবে। এ পরিবেষ্টিত স্থানের প্রথমটির সম্মুখে নির্মিত হবে মন্ত্রী ও পুরোহিতদের আবাসন ও অস্ত্রাগার।
বিন্দুসার বললেন, যুবরাজ বা রাজপুত্রদের জন্য আলাদা কোনো আবাসনের ব্যবস্থা নেই? স্থপতি আমতা আমতা করছিলেন, মহামন্ত্রী বললেন, তিনি সম্রাটের আবাসনে অবস্থান করবেন। যদি যুদ্ধে যাত্রা করেন।
যুবরাজ বললেন, শিশু-কিশোর রাজকুমারদের জন্য তা ঠিক আছে। কিন্তু যিনি যুদ্ধ করতে যাবেন, তাঁর আলাদা আবাসনের প্রয়োজন আছে।
মহামন্ত্রী অর্থপূর্ণভাবে সম্রাটের দিকে তাকালেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল, সম্রাট তা নাকচ করে দেবেন। কিন্তু সম্রাট বললেন, যুবরাজের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকবে এবং তা মন্ত্রী-পুরোহিতদের ওপরে।
তাহলে বেষ্টনীযুক্ত এলাকা হবে পাঁচটি, বললেন স্থপতি। দ্বিতীয় পরিবেষ্টনের সামনে তত্ত্বাবধায়ক, বিশ্বস্ত সৈনিক, অর্থাৎ বংশপরম্পরায় নিযুক্ত সৈন্য, বেতনভুক সৈন্য, রথ ও অশ্ববাহিনী এবং প্রধান সেনাপতির অবস্থানের স্থাপনা।
আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, এটি দ্বিতীয় নয়, হবে তৃতীয় প্রতিবেষ্টনীর সম্মুখে। দ্বিতীয় বেষ্টনীর সম্মুখে থাকবে যুবরাজের আবাস।
স্থপতি তাঁর ভুল সংশোধন করে নিয়ে বাকি পরিবেষ্টনীতে কাদের অবস্থান থাকবে, তা বলে গেলেন।
এবার প্রধান সেনাপতি বললেন, দেয়াল দ্বারা নির্মিত পরিবেষ্টনীর সামনে থাকবে কার্যকর দশ সেনাপতির প্রধানগণ, নিজ নিজ অধিনায়কের মিত্রবল, অমিত্রবল ও অটবিলের অবস্থান স্থাপনা।
সম্রাট বললেন, প্রশান্তা (শিবির তত্ত্বাবধায়ক) ছোট পদের কর্মকর্তা হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই চতুর্থ বেষ্টনী নয়, সে থাকবে শিবির রক্ষণাবেক্ষণকাজে নিযুক্ত লোকবলের সঙ্গে।
মহামন্ত্রী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। সম্রাট তাঁকে হাতের ইশারায় থামতে বললেন। সেনাপ্রধান আবার বললেন, সম্রাটের ইচ্ছেমতো শত্রু আগমনের সম্ভাব্য পথে তৃণাচ্ছাদিত গভীর গর্ত এবং কাঁটাযুক্ত ফলক স্থাপন করতে হবে। শিবিরের অষ্টাদশ বর্গকে আবাসনস্থলের রদবদল ঘটানো হবে, যাতে শত্রুপক্ষ কোনো সুবিধে গ্রহণ করতে না পারে। দিনের বেলায়ও শিবির প্রহরার ব্যবস্থা থাকবে। শিবিরে অবস্থানরত সৈন্যদের পারস্পরিক বিবাদ, জুয়া খেলা, মদ্যপান এবং কৌতুকপূর্ণ আড্ডাবাজি একেবারেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আচার্য চাণক্য বললেন, এবার তুমি থামো। দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থপতি বাদ দিয়ে গেছে। বেশ্যাদের আবাসন কোথায় হবে এবং ছদ্মবেশী রক্ষক ও গোয়েন্দারা কোথায় থাকবে, তা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
স্থপতি বললেন, ক্ষমা করুন, আচার্য। ভুল হয়ে গেছে। মানচিত্র এবং তার বাইরে এদের অবস্থান নির্দিষ্ট করা আছে। রাস্তার পাশে বেশ্যাদের জন্য আবাসন নির্মাণ করা হবে এবং ছদ্মবেশী রক্ষক ও গোয়েন্দারা থাকবে শিবিরের বাইরে।
এ সময় আচার্য ভদ্রবাহু সম্রাটের কানে কানে কী যেন বললেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত একটু শ্রবণযোগ্যভাবে বললেন, আচার্য, এটা আমরা কখনো বাদ দিই না। না হয় এরা বিজিতদের ওপর চড়াও হবে। এখানেও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। প্রধান সেনাপতির উদ্দেশে বললেন, অভিযানে যাত্রাকালের প্রস্তুতি সম্পর্কে বলো।
পাটালিপুত্র থেকে দাক্ষিণাত্য অনেক দূরে। তাই মহামান্য সম্রাট এবং মৌর্য বাহিনীতে স্থানে স্থানে পথিমধ্যে গ্রাম ও অরণ্য এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। দাক্ষিণাত্যে কতগুলো নদীর তীর ও অববাহিকায় অবস্থান করে যুদ্ধ করার কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এটা পূর্বঘোষিত থরের মতো যুদ্ধ নয়, তাই এ ব্যবস্থা। অভিযানকালে দ্বিগুণ খাদ্য পরিবহন করা হবে। পানীয় জলের জন্য নদীর ওপর নির্ভর করতে হবে। তাই নদীতীরে শিবির স্থাপন করাই শ্রেয়।
যুদ্ধাভিযানকালে অগ্রভাগে অবস্থান করবে নায়ক বা দশ সেনাপতির অধিনায়ক, মধ্যভাগে সম্রাট এবং তাঁর পরিজন (যদি যান)। দুপাশে থাকবে অশ্বারোহী বাহিনী। সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর পশ্চাদ্ভাগে থাকবে হস্তীবাহিনী, চতুর্দিকে থাকবে প্রচুর পশুখাদ্য। অভিযানকালে বীবধ (দেশীয় খাদ্য) প্রচুর পরিমাণে বহন করা হবে।
মহামন্ত্রী বললেন, যাত্রাপথে শত্রুবাহিনী আক্রমণ করলে কী প্রস্তুতি?
সামনে কুমিরাকৃতির বিন্যাস, পশ্চাতে রথবাহিনীর ব্যূহ রচনা। দুপাশ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা থাকলে বজ্রব্যূহ। সর্বদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বতোভদ্রব্যূহ।
যাবে কোন পথে?
হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিক বাহিনীর জন্য যে পথ অনুকূল বলে মনে হয়। যাত্রা হবে মধ্যম গতিতে প্রতিদিন দেড় যোজন পথ।
দাক্ষিণাত্যে যাত্রার পথ খুবই বন্ধুর। পাহাড়, নদী, খাল প্রভৃতি হচ্ছে প্রধান প্রতিবন্ধকতা। কোথাও কোথাও পাহাড়ি পথে জঙ্গল পরিষ্কার করে সামনে এগোতে হবে। সে প্রস্তুতি আমাদের আছে। বেশ কটা নদী পাড়ি দিতে হবে। কয়েকটি নদী সাঁকোতে এবং কয়েকটি নদী হাতি ও নৌকোর সাহায্যে পার হতে হবে। ছোট নদীগুলোর বাঁধ নির্মাণ করে ফেলতে হবে। ভেলার মাধ্যমে সৈন্য এবং মালামাল পারাপারের ব্যবস্থা হচ্ছে। ভাটির টানে স্রোতের অনুকূলে যাওয়ার এ ব্যবস্থা। জলপথ ব্যবহারে সুবিধে বেশি। আমাদের সামরিক গোয়েন্দারা যাতায়াতপথের সংবাদ দেবে। শত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনা থাকলে অঘাট দিয়ে পারাপার সম্পন্ন করতে হবে। সামরিক গোয়েন্দারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে।
সম্রাট বললেন, বেশ বেশ। নিরাপত্তা ও যুদ্ধ অভিযানে মোটেও কোনো ঘাটতি রাখবে না। এবার বলো, অসুখবিসুখ, পথচলায় ক্লান্তি আর অবসন্নতা, আহত হওয়া, মৃত সৈন্যদের যথাযোগ্য মর্যাদায় সৎকার প্রভৃতির জন্য কী ব্যবস্থা?
প্রধান সেনাপতি বললেন, অসুখ-বিসুখ, ব্যাধি, মড়ক, যুদ্ধাহত ও যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ প্রভৃতি বিষয়ে মানুষ ও পশুদের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা আছে। মানুষের জন্য চিকিৎসক ও ওষুধপথ্যাদি এবং পশুদের জন্য পশু চিকিৎসক, যেমন হস্তীর জন্য হস্তায়ুর্বেদ, অশ্বের জন্য অশ্বায়ুর্বেদ, ষাঁড় ও গাধার জন্য আলাদা চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসকগণ সঙ্গে যাচ্ছে। রাজবৈদ্যগণ সম্রাটের সঙ্গে থাকবেন সার্বক্ষণিকভাবে।
মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা আছে। শত্রুর মৃতদেহও ধর্মীয় বিধানমতে সৎকার করা হবে। পুরোহিতগণ সৎকারানুষ্ঠান পরিচালনা করবেন।
সম্রাট বললেন, উত্তম। এখন বলো শত্রুর সৈন্য সম্পর্কে কী তথ্য আছে।
প্রধান সেনাপতি এবার মহামন্ত্রীর দিকে তাকালেন। কারণ, মহামন্ত্রী আগেই তাঁকে বলে রেখেছেন, গোয়েন্দা তথ্য সেনাপ্রধান বলবেন না, চাণক্য নিজেই বলবেন। মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমাদের ছদ্মবেশী গোয়েন্দা হরিহর মিশ্র পাচকের সহকারীর বেশে জেনে এসেছে, যোদ্ধাদের আহারসংখ্যা, শয্যাসংখ্যা, রন্ধনচুল্লির সংখ্যা প্রভৃতির আলোকে সৈন্যসংখ্যা কত। সমরাস্ত্রের সংখ্যা জেনেছে প্রদীপ্ত। আর হাতি, অশ্বের ভোজ্যসংখ্যা জানতে গিয়ে সুদীপ্ত ধরা পড়ে প্রাণ দিয়েছে। হস্তী পদতলে তার মস্তক দিয়ে জীবন হরণ করা হয়েছে। তার মৃত্যুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হলো।
হরিহরকে ডাকা হলো। মহামন্ত্রী বললেন, বলো হরিহর, তুমি কী জানো।
হরিহর একবার মহামন্ত্রীর দিকে, আরেকবার সম্রাটের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে বলল, আহারসংখ্যা, শয্যাসংখ্যা এবং রন্ধনচুল্লির সংখ্যা মিলিয়ে আমার মনে হয় তিন লক্ষ সৈন্য হবে।
যুবরাজ হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, রন্ধনচুল্লির সংখ্যা কত?
এ রকম প্রশ্নের জন্য হরিহর প্রস্তুত ছিল না। অসহায়ের মতো মহামন্ত্রীর দিকে তাকাল।
মহামন্ত্রী বললেন, হরিহর, তুমি তো আমাকে বলেছিলে তিন সহস্রাধিক। তার মানে, প্রতি একশজনে এক চুল্লি।
শয্যাসংখ্যাটাই আসলে সঠিক সংখ্যা। বলো তো সঠিক শয্যাসংখ্যা কত, বললেন আচার্য ভদ্রবাহু। সম্রাট বললেন, আচার্য যথার্থই বলেছেন। বলো শয্যাসংখ্যা কত?
এবারও হরিহর মহামন্ত্রীর দিকে তাকাল। মহামন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, তুমি তো বলেছিলে তিন লক্ষ যোগ-বিয়োগ, মানে কম-বেশি।
ভদ্রবাহু বললেন, হিসাবটা সহজই!
কিন্তু যুবরাজের দিকে তাকিয়ে মনে হলো কোনো উত্তরেই তিনি সন্তুষ্ট নন।
এবার সম্রাট কতগুলো নির্দেশনা দিলেন। বললেন, আমাদের সৈন্যসংখ্যা বেশি, আমরাই প্রথমে আক্রমণ করব। আমি জানি, মালভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের অনুকূল নয়। প্রতিকূল অবস্থায় যুদ্ধ করে আমরা অভ্যস্ত। আমাদের যুদ্ধাভিযান হবে প্রকাশ্য। আমাদের আক্রমণে শত্রুবাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়বে। আর তখনই চারদিক থেকে আক্রমণ করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
তোমরা রাত্রিকালে শত্রুশিবিরে অকস্মাৎ আক্রমণ চালাবে।
রাত্রিকালে? বললেন চাণক্য।
হ্যাঁ, রাত্রিকালে। তাহলে ওরা রাত্রি জাগরণে বাধ্য হবে এবং দিনে এরা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় যুদ্ধের ময়দানে সমবেত হবে। আর তখনই আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করতে হবে। শত্রুসৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে হবে। আচার্য, বলুন তা কীভাবে করতে হবে।
গোলাকার পাথরে পরিপূর্ণ চামড়ার বস্তা গরু-মহিষ-উটের পিঠে চাপিয়ে শত্রুবাহিনীর এলাকায় প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে। তাতে পাথরে ঘর্ষণ সৃষ্টি হলে শত্রুর হাতি ও অশ্বরা দৌড়াতে শুরু করবে, তা থেকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সংহতভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবে না। এ সুযোগ আমাদের নিতে হবে।
এবার সম্রাট বললেন, প্রকৃতির মধ্যে প্রতিকূলতা আছে, আবার প্রকৃতি সহায়তাও করে। প্রধান সেনাপতি, এ সুযোগ আমাদের নিতে হবে। আমি শুধু সম্রাটই নই, তোমাদের মতোই একজন যোদ্ধা। গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে তোমরা তা দেখেছ। এবারও তোমাদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হব। যার যার ধর্মানুসারে প্রার্থনা করবে, যেন জয় আমাদের সুনিশ্চিত হয়। আমি যুদ্ধের পূর্বদিনে উপবাস করব। আচার্য মহামন্ত্রীও তাই করবেন। যজ্ঞ দেব। বীরগণের যেন স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে সে জন্য যজ্ঞে তাদের নামোচ্চারিত হবে। যুদ্ধে যারা বিরত থাকবে, তাদের স্থান হবে নরকে। যুদ্ধের ময়দানে আমি তোমার সৈন্যদের প্রাণবন্ত ও যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখতে চাই। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে তার মুণ্ড আগে নেওয়া হবে। কেউ ভুল তথ্য দিলে তার রক্ষা নেই। আমি সৈন্যদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করছি—যে সৈনিক শত্রুনৃপতিকে হত্যা করবে, সে পাবে এক লক্ষ পণ, শত্রুর কুমার হত্যা করলে পঞ্চাশ হাজার পণ, শত্রুর বীরযোদ্ধাকে হত্যা করলে দশ হাজার পণ, হাতি বধ কিংবা ধ্বংস করলে পাবে পাঁচ হাজার পণ, অশ্ব হত্যায় এক হাজার, পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক হত্যায় একশ এবং সাধারণ সৈন্য হত্যায় বিশ পণ লাভ করবে। এ ছাড়া খাদ্য ও বেতন হবে দ্বিগুণ। লুটের মালের ভাগ পাবে। অন্য বিষয়গুলো তোমাদের জানা আছে। মহামন্ত্রী চাইলে কিছু বলতে পারেন।
মহামন্ত্রী বললেন, সবই বলা হয়ে গেছে, মহামান্য সম্রাট। এবার যুদ্ধের দিনক্ষণ শুভ-অশুভ বিষয়ে আচার্য ভদ্ৰবাহু কিছু বলতে পারেন।
আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, এখনই প্রকাশ্যে দিনক্ষণ বলে দেওয়া ঠিক হবে না।