মৌর্য – ৯৪

৯৪

বিন্দুসার ভোরে ঘুম থেকে উঠে নগ্নপদে হাঁটছেন। তক্ষশীলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা এটি। তাঁর সঙ্গে সুবন্ধু। বিন্দুসার আসার পর থেকে সুবন্ধু তাঁর সঙ্গে লেগে আছেন। কোনো মুহূর্তের জন্য সঙ্গছাড়া হন নি।

রাজকীয় বাগানের ঘাসে কুয়াশা পড়ে আছে। বিন্দুসার কুয়াশাসিক্ত ঘাসে হেঁটে আনন্দ পাচ্ছেন। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তাঁর কানে রাগসংগীতের সুর ভেসে এল। তিনি উৎকর্ণ হয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করলেন, শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে।

তার মধ্যেই সুবন্ধু বললেন, যুবরাজ, সম্রাজ্ঞী উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা করছেন। এটি তাঁর প্রতিদিনের কাজ। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত।

কোথায় চর্চা করছেন তিনি?

আপনি যাবেন, যুবরাজ?

না, এখনই যাব না, সংগীতের চর্চায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিন্তু কোথা থেকে সুরেলা শব্দ আসছে?

প্রাসাদের পাশে সম্রাজ্ঞীর জন্য একটি সংগীতচর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সম্রাজ্ঞী চান না প্রাসাদে সংগীতচর্চায় কারও সমস্যার সৃষ্টি হোক।

যারা বাগানে আসে?

খুব কম লোকই এখন এ বাগানে আসে।

কেন কেন?

কী বলব যুবরাজ, বলতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু আপনাকে কতকাল আর না বলে থাকা যাবে। তাই আগে বলে ফেলাই ভালো।

বিন্দুসার কৌতূহলী হয়ে বললেন, কী গোপন করতে চাইছিলেন?

বলছি যুবরাজ, আচার্য ভদ্রবাহুর ভ্রাতা বরাহ মিহির।

নাম শুনেছি।

দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর। কেউ কেউ বলেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

তা-ও শুনেছি।

তাঁর প্রেতাত্মা এ বাগানে ঘোরাফেরা করে।

কী বলছেন আপনি? এ রকম একটা অদ্ভুত কথা বিশ্বাস করতে হবে?

আপনার মতো সম্রাজ্ঞীও তা বিশ্বাস করেন না।

তিনি কী বলেন?

তিনি বলেন, প্রেতাত্মা বলতে কিছু নেই। এটি দুর্বল মনের লোকদের ভ্রষ্ট কল্পনা।

তিনি ঠিকই বলেছেন।

তিনি ঠিক বলেন নি, যুবরাজ। স্বয়ং মহামন্ত্রী চাণক্য কয়েকবার দেখেছেন।

আমি তো জানতাম আচার্য একজন সংস্কারপন্থী সুস্থ চিন্তার মানুষ। কোনো কুসংস্কার তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।

কুসংস্কার নয়, যুবরাজ, আমিও…

দেখেছেন, এই তো?

না।

তাহলে?

এ বাগানে সম্রাজ্ঞীর আত্মীয়স্বজনরা বেড়াতে এসেছিলেন। এঁরা কুয়াশার কুণ্ডলীতে গোলকধাঁধায় পড়ে যান। সৌভাগ্যক্রমে আমি এসে তাঁদের উদ্ধার করি।

এবার বিন্দুসার হাসলেন। বললেন, ও কিছু না। বাগানে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় কুয়াশাকুণ্ডলীর সৃষ্টি হতেই পারে। আপনি তো ব্রাহ্মণ।

জি যুবরাজ।

তাহলে আপনার সংস্কারপন্থী হওয়ার কথা। আমাদের সমাজে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি বলতে আপনারা দুয়েকজন। আপনাদের মধ্যে কুসংস্কার বাসা বাঁধলে বিপদ।

কী জানি যুবরাজ, তবু আপনার সাবধানে থাকা দরকার।

আপনি রামায়ণ পড়েছেন?

পড়েছি।

তাহলে তো জানার কথা সে প্রবাদটি যে সারা রাত রামায়ণ পড়ে আপনার মতো কেউ প্ৰশ্ন করল, সীতা কার বাপ?

বলে খুব হাসলেন। পরে বললেন, চলুন আমরা এখন সংগীতচর্চা কেন্দ্রে যাই। প্রথমে আঙিনায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকব। সম্রাজ্ঞীর সংগীতচর্চা শেষ হলেই ভেতরে যাব। আচ্ছা, বাঁশির শব্দ আসছে না? আর একটা কী যন্ত্র যেন বাজানো হচ্ছে।

আপনি ঠিক ধরেছেন। সেখানে একজন সংগীতগুরু আছেন। তিনি রাবণহাথা বাজাচ্ছেন।

রাবণহাথা?

বাদ্যযন্ত্র। রাবণ নাকি এটা বাজিয়ে গান করতেন?

হতে পারে।

হতে পারে কি, যুবরাজ? সে তো লঙ্কার রাবণ, যে সীতাকে অপহরণ করেছিল। তার পক্ষে কি সৌন্দর্য আর সুরের চর্চা করা সম্ভব?

সুবন্ধু, আপনি একজন সুশিক্ষিত ব্রাহ্মণ। শিক্ষিত নয়, এমন মানুষের মতো কথা বলছেন কেন?

আপনিও দেখছি সম্রাজ্ঞীর মতো কথা বলছেন।

বাঁশিটা বাজাচ্ছে কে? মনে হয় একটি নয়, দুটি বাঁশি।

একটি নিখিল বাজায়। আরেকটি চীনা এক প্রবাসী। নিজের দেশ ছেড়ে এসেছে রাজার ভয়ে।

নিখিলটা কে?

সম্রাট-সম্রাজ্ঞী তক্ষশীলা থেকে এনেছেন।

বাজায় ভালো।

কিন্তু আমরা উৎকণ্ঠায় থাকি। বিশেষ করে সম্রাজ্ঞী।

কেন?

পাগলাটে তো, কখন কী করে বসে, কে জানে।

অনেকক্ষণ হলো। আর কত বসে থাকা যায়? আজকে সম্রাজ্ঞীর সংগীতচর্চায় বিঘ্ন ঘটাবই। পরে ক্ষমা চেয়ে নেব। চলুন।

অন্য কেউ হলে সম্রাজ্ঞী রেগে যেতেন। কিন্তু বিন্দুসারকে দেখে সংগীতচর্চা ফেলে ছুটে এলেন। বললেন, বিন্দুসার, আমাকে সংবাদ পাঠাতে পারতে। আমি যে কী খুশি হয়েছি বোঝাতে পারব না।

মা, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

চমকে উঠলেন হেলেন। মা ডাকটি তাঁর অন্তর বিদ্ধ করেছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ক্ষমা প্রার্থনা কেন?

বিঘ্ন সৃষ্ট করলাম বলে।

সে কথা? বসো, কথা বলি। আমার বাবা সেলুকাস প্রথম বিয়ে করেন আপামাকে। আমি দ্বিতীয় মায়ের সন্তান, কখনোই আপামাকে মায়ের মর্যাদা দিয়ে কথা বলি নি। তিনি এত ভালো একজন মহিলা, যার তুলনা হয় না। গ্রিক রীতিতে বাবার অন্য স্ত্রীদের মা বলতে হয় না। আমরা নাম ধরে ডাকি। ভারতবর্ষ অদ্ভুত এক দেশ, এখানে শুধু বাবার অন্য স্ত্রী কেন, বয়োজ্যেষ্ঠ সবাই মর্যাদা পায়। আমি একটু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি, বিন্দুসার। আমাকে ক্ষমা করো।

বিন্দুসার উঠে কাছে এলেন। হেলেনকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ভারতীয় রীতির বাইরেও আসার পর থেকে আপনাকে যা দেখছি এবং আপনার ব্যাপারে যা শুনেছি, তা থেকে আমার বারবারই মনে হয়েছে, আপনি যে দেশের যে জাতের মানুষই হোন না কেন, আপনি আমার মায়ের আসনে বসবার উপযুক্ত। কষ্ট হয় ভাবলে যে কেন আমি এত দিন আপনার থেকে এত দূরে ছিলাম।

বিন্দুসারকে পাশে বসিয়ে হেলেনের মনে হলো তিনি এখন বয়সী একজন মা, যার বড় একটা পুত্র সন্তান আছে। এত দিন সম্রাজ্ঞী হিসেবে সবই ছিল তাঁর, শুধু সন্তান ছিল না। এখন তা-ও পাওয়া গেছেন। তিনি এ আবেগঘন প্রসঙ্গটা আপাতত পরিবর্তনের জন্য বললেন, আমি জানি না, বিন্দু, তোমার সংগীতের প্রতি আগ্রহ আছে কি না।

মা, আমাদের তক্ষশীলায় চৌষট্টি কলা শিখতে হয়েছে, উচ্চাঙ্গসংগীতও বাদ যায় নি। কারণ, সংগীতও তো একটি কলা।

রাবণহাথা হাতে গুরু বললেন, যুবরাজ, শুধু কলা বলছেন কেন, সবচেয়ে বড় শিল্প।

হেলেন বললেন, তিনি একজন সংগীতগুরু। তুমি দেখতেই পাচ্ছ, রাবণহাথা খুব ভালো বাজান। চীনা শিল্পীকে দেখে কী মনে হচ্ছে তোমার? হাড়ের বাঁশি বাজান। আর নিখিল …

আমি শুনেছি মা, তার সম্পর্কে।

সুবন্ধু বলেছে নিশ্চয়ই? মাঝেমধ্যে আমরা তাকে নিয়ে বড় সমস্যায় পড়ে যাই, সে অবশ্য নিজেই আমাদের উদ্ধার করে।

এদের প্রত্যেকেই যুবরাজকে প্রণাম জানান।

যুবরাজ বললেন, আমিও আপনাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাই। আমার শিক্ষাটা কেমন হয়েছে, একবার পরীক্ষা নেবেন না, মা?

পরীক্ষা নেব কী, তুমি চৌষট্টি কলা শিখেই পাস দিয়ে এসেছ। বরং আমি তোমার কাছ থেকে মাঝেমধ্যে এটা-সেটা শিখে নেব।

চীনা হাড়ের বাঁশিওয়ালা বললেন, এ আনন্দে একটু বাঁশি বাজাই? বলে ছোট ছোট চোখে হাসি হাসি ভাব নিয়ে মিটমিট করে তাকালেন যুবরাজের দিকে। তাঁর এক ফালি দাড়িতে গিয়ে থামছে সে হাসির রেখা। যুবরাজ বললেন, কেন নয়?

চীনা শিল্পী তাঁর হাড়ের বারো ছিদ্রের বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। আলোছায়ার সুরে স্তব্ধ প্রত্যুষের পাটালিপুত্র। নিখিল অস্থির হয়ে উঠেছে। এ রকম একটি সুরের সঙ্গে সে নিজেকে তার বাঁশিতে মেলাতে পারছে না। রাবণহাথার সংগীতগুরু দুয়েকবার টুংটাং করে থেমে গেছেন। বাঁশি বাজানোর মধ্যেই চীনা শিল্পী মিটিমিটি করে হাসছেন, বন্ধুদের ব্যর্থতায়। বাঁশি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কে জানে। তার সুরে প্রকৃতিতে যেন জীবন-মৃত্যুর খেলা। সুরটা লৌকিক, কিন্তু খেলাটা চলছে যেন স্বর্গ আর মর্তে।

একসময় বাঁশি থামল। তখনো সবাই চুপ হয়ে আছেন। রেশ কাটছে না। অবশেষে হেলেনের হাতে হাততালি বেজে উঠল। যুবরাজ, সুবন্ধু এবং অন্যরাও এতে যোগ দিলেন। যুবরাজ বললেন, অসাধারণ ও অলৌকিক। চীনা বাঁশিওয়ালাকে উদ্দেশ করে বললেন, স্বর্গের সঙ্গে মর্তের একটা যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছেন আপনি। এ সংগীত সম্পর্কে কিছু বলুন।

শিল্পী স্মিত হাসলেন। পরে বললেন, চীনে আমরা একে প্রাকৃতিক সংগীত বলি। তার মূলে আছে ‘ইয়াইন ও ইয়াং’ তত্ত্ব। ‘অন্ধকার ও আলো’ বিশ্বলৌকিক এক সম্পূর্ণরূপ। চীনা তত্ত্ববিদেরা মহাবিশ্বভাবনায় যে তত্ত্বকথা বলেছেন, ধ্রুপদি সংগীতের সুরেও তা যুক্ত হয়েছে অখণ্ডভাবে। একটা যুগলভাবনা এখানে আছে, দুজন শিল্পী হলে আলো-আঁধারি ভাবটা আরও স্পষ্ট হয়। কনফুসিয়াস তত্ত্বটায় নতুন মাত্রা দিয়েছেন। আমি অবশ্য আগেরটাই বাজিয়েছি।

যুবরাজ বললেন, কনফুসিয়াসেরটা একটু শোনান!

শিল্পী বাজালেন। পরে বললেন, তাঁর সময়ে তত্ত্বটিতে ‘ভালো-মন্দে’র নৈতিক ভাবনা যুক্ত হয়েছে। মন্তব্য করলেন, শিল্পকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করলে তার উপযোগিতা খাটো হয়, বিশ্বজনীন সত্য মিথ্যে হয়ে যায় না বটে, প্রকৃতির মহাবিশ্বকে সীমার মধ্যে টেনে আনা হয়। তাই আমি তাঁর আগের তাত্ত্বিক সুরটাই বাজাই।

এ রকম একটি ব্যাপার জৈন দর্শনেও আছে। বলে থামলেন বিন্দুসার। আবার বললেন, ভারতীয় প্রায় সব দার্শনিক আর তাত্ত্বিকদেরও আলো-অন্ধকারের মধ্যে ভালো-মন্দ শুভ-অশুভর তাত্ত্বিক বিষয়গুলো অনুসন্ধানে তৎপর হতে দেখা যায়। কিন্তু সংগীতের মধ্যে তত্ত্বের বিস্তার দেখা যায় না। তক্ষশীলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দর্শনের পাশাপাশি তাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেওয়া হয়। তবে রাষ্ট্রচিন্তার বলয়ের বাইরে নয়। চৌষট্টি কলার এক কলাসংগীত। সংগীত শিক্ষা দেওয়া হয় গাইবার জন্য নয়, জানবার জন্য। সে জানায় বহু ঘাটতি আছে। পৃথিবীতে কত কিছু যে ঘটছে, মানুষে মানুষে, দেশে দেশে যোগসূত্র তৈরি না হলে তা জানার উপায় নেই।

হেলেন মন দিয়ে শুনছিলেন বিন্দুসারের কথা। বিন্দুসার খুব কম বয়সে অনেক ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন। তাঁর (হেলেন) কথা বলার মতো ধীশক্তির একজন মানুষ পাওয়া গেল।

রাবণহাথা সংগীতযন্ত্রটা পছন্দ হয়েছে বিন্দুসারের। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। টুংটাং শব্দ করলেন। এ যন্ত্রের জন্মবৃত্তান্ত শুনলেন। আক্ষেপ করে বললেন, তক্ষশীলায় এ সংগীতযন্ত্র নেই, কারণ, সেখানকার শিক্ষা এখনো ব্রাহ্মণ্য ভাবনায় আচ্ছন্ন। ভারতীয় অন্য ধর্মদর্শন যতটা উদার, ব্রাহ্মণ্য ধর্মদর্শন ততটা নয়।

আমার মনে হয় পরিবর্তন আসবে। তক্ষশীলা অধিকারের পর গ্রিকরা জেনেছিল, প্রায় চারশ বছর আগে থেকে এখানে শিক্ষাদানের কাজ চলছে (খ্রিষ্টজন্মের আট শ বছর আগে) সব সময় তো এক রকম যায় নি।

হেলেনের কথার জবাবে বিন্দুসার বললেন, তা যায় নি। কিন্তু এখনো ব্রাহ্মণ্য প্রভাব অপ্রতিরোধ্য।

হেলেন বললেন, আমি শুনেছি এখানে বেদ, ভাষা, ব্যাকরণ, দর্শন, চিকিৎসা, রাজনীতি, তির নিক্ষেপ, যুদ্ধবিদ্যা, জোতিষী, জোতির্বিদ্যা, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবসাবাণিজ্য, নৃত্যকলা…আরও অনেক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় এবং বহু দূর দেশ থেকে শিক্ষার্থী পড়তে আসে।

ঠিকই শুনেছেন আপনি। ব্যাবিলন, গ্রিস, সিরিয়া, আরব, ফোয়েনোশিয়া, চীন, তুরস্ক—সব জায়গা থেকেই শিক্ষার্থীরা আসে। এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা দশ হাজারের বেশি। আর বিষয়, যা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি। তবে রাজপুত্রদের বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মৌর্য সম্রাটের পুত্র বলে আমি একটু বেশি গুরুত্ব পেয়েছি, বলে হাসলেন বিন্দুসার। পরে বললেন, আমাদের বেশি পড়ানো হয় রাজনীতিবিদ্যা, বলে হাসলেন। মানুষ কাটাছেঁড়ার বিদ্যা পড়ে রাজপুত্ররা কী করবে, বলুন। তবু এক-আধটু ধারণা রাখতে হয়। সংগীতের ধারণাটাও সে রকম। আচার্য কৌটিল্য বলেছেন, রাজপুত্র যদি রাজকর্মের অযোগ্য হন, তাঁর কলাচর্চা করাই শ্রেয়, বলে উচ্চ স্বরে হাসলেন বিন্দুসার।

হেলেন দেখলেন, বিন্দুসারের দারুণ কৌতুকবোধও আছে। বললেন, আচার্য ঠিক বলেন নি যোগ্য মানুষেরাই সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

মা, গ্রিকরা কি সংগীতপ্রিয় জাতি?

হেলেন সংগীতদেবতা মিউজ ও অ্যাপোলোর বৃত্তান্ত বললেন এবং নিজেরা যে দেবতা অ্যাপোলোর বংশধর, তা-ও জানাতে ভুললেন না। অবশ্য ফুফু বা পিসির বরাতে কথাগুলো বললেন তিনি।

বিন্দুসার বিস্ময় নিয়ে বললেন, আমাদের দেশেও এমন অনেক রাজবংশ আছে, যারা দেবতার বংশধর দাবি করে। ব্যাপারটা কি আসলে তাই?

ভারতবর্ষের কথা বলতে পারব না, কিন্তু আমাদের পরিবারের বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যাপারটা মিশে আছে। বিশ্বাস করতে দোষ কী বলো, যদি তা ইতিবাচক ফল দেয়, বলে হাসলেন হেলেন।

বিন্দুসার লক্ষ করলেন, হেলেনের হাসিটা কোনো বিদেশিনীর ভারতীয় সংস্করণ। কৃত্রিম বলবেন, না আন্তরিক, বুঝতে পারলেন না। ভাবলেন তাঁকে বুঝবার জন্য আরও সময়ের প্রয়োজন।

হেলেন আবার বললেন, আমার বাবা এবং ভাই এ নিয়ে মোটেও উৎসাহী নয়। কিন্তু আমার দাদা জেনারেল এন্টিওকাস এ নিয়ে খুব সিরিয়াস ছিলেন। তিনি আমার ফুফু দিদাইমেইয়ার নাম রেখেছিলেন অ্যাপোলোর এক মন্দিরের নামে।

আপনার দাদাও জেনারেল ছিলেন?

রাজা ফিলিপের জেনারেল।

আপনার পরিবারে যে সামরিকায়ন ঘটেছে, আপনাকে দেখে তা মনে হয় না।

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে হেলেন বললেন, সবাই তো এক রকম হয় না।

বিন্দুসার দেখলেন, এখানে হেলেনের ছোট্ট একটা ব্যথা আছে। তিনি এদিকে আর গেলেন না, সংগীতের প্রসঙ্গে চলে গিয়ে বললেন, ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি আপনার আগ্রহের কারণ কী?

এককথায় ভালো লাগা। কী অসাধারণ মনে হয় বলে বোঝাতে পারব না।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানবুদ্ধিতে মনে হয় আপনিও এক অসাধারণ মহিলা, যার বিবেচনাশক্তি অন্য কারও মতো নয়। কথাটা বলতে গিয়েও বললেন না বিন্দুসার। বললেন, আপনি সবকিছুর সঙ্গে দারুণ মানিয়ে নিয়েছেন।

তাই?

মা, সেলুসিয়ার কথা মনে হয় না আপনার?

হয়।

ওসবের গল্প শুনব আপনার কাছে।

আজই?

না, আজ না, আরেক দিন।

অবশ্যই শুনবে। অদ্ভুত দেশ গ্রিস, মেসডোনিয়া আর সেলুসিয়া। তার চেয়েও অদ্ভুত এবং বিচিত্র ওসব দেশের মানুষ। হঠাৎ করে বললেন, আমাকে তোমার অদ্ভুত মনে হয় না?

হেসে হেসে বিন্দুসার বললেন, মনে হয়, তবে যে জন্য আপনি আপনার লোকদের অদ্ভুত বলেছেন, সে জন্য নয়, আমাদের যেভাবে আপন করে নিয়েছেন এবং যেভাবে আমরাও আপনাকে আপন করে পেয়েছি, সে জন্য। এখানে প্রত্যেকে আপনার কথা বলে।

বলে নাকি, বলে হাসলেন হেলেন।

আপনি এত তাড়াতাড়ি এখানকার ভাষাটা শিখলেন কী করে?

ওই যে বললে প্রত্যেকে আমার কথা বলে। আমি তাদের কাছে পৌঁছে যেতে চেয়েছি। আর তার প্রধান উপায় হলো তাদের ভাষাটা জানা। তোমার বাবা মন্দাকিনীকে দিয়ে গ্রিক ভাষায় পত্ৰ লেখাত আমার কাছে। যুদ্ধ জয় করবার আগেই চন্দ্র আমার হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। বুঝলে বিন্দু। তুমিও ভালো গ্রিক জানো দেখছি।

গ্রিক শেখার হাতেখড়ি আপনার হাতে। গ্রিক ভাষাটা আমাদের তক্ষশীলায়ও শেখানো হয়, বিশেষ করে রাজপুত্রদের। এরই মধ্যে খবর এল সম্রাট বিন্দুসারকে প্রাসাদে ডেকেছেন। সেখানে মহামন্ত্রী, আচার্য ভদ্ৰবাহু, মহা অমাত্য এবং সেনাপ্রধান উপস্থিত হয়েছেন। আসন্ন যুদ্ধপ্রস্তুতি এবং যুদ্ধ অভিযানের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে কথা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *