মৌর্য – ৯২

৯২

মেজাজটা আজ বেশ ফুরফুরে সেলুকাসের। চন্দ্রগুপ্তের পাঠানো বলবর্ধক ওষুধে কাজ হয়েছে। রাতের স্মৃতি রোমন্থন করছেন তিনি। মনে একপ্রকার উল্লসিত ভাব। এ রকম ভাব শুধু যুদ্ধজয়ের পরই মনে উদিত হয়।

সামনে তাঁর মেগাস্থিনিসের বিবরণটি, রিপোর্ট আকারে দুদিন আগে যা জমা দিয়ে গেছেন। মেগাস্থিনিস মুখে যা বলেছেন, সেসবের সঙ্গে বিস্তারিত ভৌগোলিক বিবরণ। এসবে চোখ বোলালেন। গভীরে গেলেন না। এক জায়গায় এসে সিরিয়াস হয়ে গেলেন। মেগাস্থিনিস লিখেছেন, মৌর্যদের শাসনব্যবস্থা শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে ইজিপ্টের ফারাওদের শাসনের সঙ্গে তুলনীয়। শাসন-শৃঙ্খলার দিক থেকে এরা ইজিপশিয়ানদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।

কেন শ্রেষ্ঠ? সেলুকাসের মনে এ প্রশ্ন ধাক্কা মারল। জবাবটা অবশ্য মেগাস্থিনিস নিচের অনুচ্ছেদেই দিয়েছেন। লিখেছেন, এদের সাম্রাজ্য শাসনের মূল কেন্দ্র হচ্ছে নগর প্রশাসন। নগর প্রশাসনের ছয়টি বিভাগ। প্রথম বিভাগে আছে শিল্পসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়। দ্বিতীয় বিভাগে আছে বিদেশিদের দেখভাল। বিদেশিদের এরা স্কট করে এগিয়ে নিয়ে আসে, থাকার ব্যবস্থা করে এবং এদের নানা কাজে সহায়তা করে। অসুস্থ বিদেশিদের চিকিৎসাসেবা এবং মৃত বিদেশিদের সৎকার করাও এদের কাজ। মৃত বিদেশিদের সম্পদ আত্মীয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও এরা পালন করে। তৃতীয় বিভাগে আছে জন্ম-মৃত্যুর খোঁজখবর রাখা। এটা করের আকার ধার্য কিংবা সংখ্যা বেশি-কম হওয়ার জন্য নয়, সরকারের নজরের বাইরে যাতে কিছু না ঘটে, সে জন্য। চতুর্থ ভাগে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য। উৎপাদন, ওজন পরিমাপ, মৌসুমি ফলন ক্রয়-বিক্রয় প্রভৃতি দেখা এ বিভাগের কাজ। পঞ্চম বিভাগের কাজ হলো ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন, বিক্রয় বা বাজারজাতকরণ প্রভৃতির দিকে নজর রাখা। নতুন-পুরোনো জিনিস আলাদাভাবে বিক্রয় করতে হয়। দুটোর মিশ্রণ ঘটলে বা পুরোনোকে নতুন বলে বিক্রয় করলে কঠোর সাজা ভোগ করতে হয়। ষষ্ঠ বিভাগের কাজ হলো বিক্রয় করা পণ্যের কর হিসেবে দশ ভাগের এক ভাগ আদায় করা। কর ফাঁকি দেওয়ার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।

ছয়টি বিভাগের পাঁচজন করে কর্মকর্তা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করে। তাদের সামগ্রিক সক্ষমতা সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষা, সরকারি অবকাঠামো সংস্কার, দর নির্ধারণ ও কার্যকরকরণ, বাজার নজরদারি, সমুদ্র-নদীবন্দর, মঠ প্রভৃতির ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রশাসন পরিচালনা এবং নগর বিচারকের তৃতীয় একটি বড়ি বিচারকাজের পাশাপাশি কীভাবে সামরিক বাহিনীকে পরিচালনা করে, তারও একটি চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। সেলুকাস যতই দেখছেন, অবাক হচ্ছেন। সারা সাম্রাজ্যের প্রশাসন কীভাবে চলে, তারও বিস্তারিত ধারণা দেওয়া আছে। সেলুকাস ভাবলেন, একজন উপযুক্ত মানুষকেই তিনি দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন।

রিপোর্টে উল্লেখ আছে সাম্রাজ্যে মানুষের শ্রেণিবিভাজনের কথা, তবে তা বর্ণভিত্তিক নয়। পেশা বা কর্মভিত্তিক। পেশার সঙ্গে মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত। এখানে দার্শনিকেরা হচ্ছেন প্রথম অভিজাত শ্রেণি। অন্যদের থেকে সংখ্যায় কম কিন্তু মর্যাদার দিক থেকে সবার ওপরে। এরা কারও প্রভু নন, আবার ভৃত্যও নন। এরা বছরে একবার একত্র হয়ে খরা, জলবায়ু, রোগব্যাধি ও সম্ভাব্য সব বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। এতে রাজা ও প্রজাগণ সব রকম দুর্যোগ মোকাবিলায় সচেষ্ট থাকতে পারেন। যেসব দার্শনিকের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয় না, এঁরা বাকি জীবনের জন্য একেবারে চুপ হয়ে যান। যাঁদের বাণী সঠিক হয়, এঁরা সম্মানিত হন, উপহার পান, মর্যাদার অধিকারী হন।

সব সম্পত্তি রাজা বা সম্রাটের। হাজব্যান্ডম্যানরা তাতে ফসল ফলায়। ফসলের এক- চতুর্থাংশ রাজকোষাগারে জমা দেয়। এরা গ্রামে থাকে। এরা দ্বিতীয় কাস্টের মানুষ। তৃতীয় এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা বেদেশ্রেণির। শহর বা গ্রাম কোথাও বসতি গড়ে না ভেসে বেড়ায়। এদেরও কোনো কর দিতে হয় না।

চতুর্থ হচ্ছে আর্টিজানস। তির-ধনুকধারী। কর দিতে হয় না, বরং রাজকোষ থেকে পারিতোষিক পায়। পঞ্চম মিলিটারি। এরা বেশ সংগঠিত এবং যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত। ষষ্ঠ হচ্ছে ওভারশিয়ার। এরা সমগ্র সাম্রাজ্য পরিদর্শন করে সম্রাটকে রিপোর্ট দেয়। সম্রাটকে না পারলে ম্যাজিস্ট্রেটকে। সুবিচার আছে। তাই মানুষজন সুখী। সপ্তম হচ্ছেন কাউন্সিলর এবং এসেসররা। এঁদের মধ্যে আছেন উপদেষ্টা/মন্ত্রী, কোষাধ্যাক্ষ, আরবিটেটর, সেনাপ্রধান, প্রধান বিচারক প্রমুখ। এঁরা খুবই মর্যাদাবান, উচ্চমাত্রার চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী এবং সদিচ্ছা পোষণকারী। কেউই নিজের কাস্টের বাইরে বিয়ে করতে পারে না। সৈন্যরা হাউসহাজব্যান্ড, আর্টিজান অথবা দার্শনিক হতে পারে না। (মেগাস্থিনিস পাটালিপুত্রকে ‘পালিবোথ্রোস’ এবং চন্দ্রগুপ্তকে ‘সানশুভ্রা’ বলেছেন)।

শেষে লিখেছেন, প্রজারা আইন মেনে চলে। চৌর্যবৃত্তি নেই। সহজ-সরল জীবন যাপন করে। মদ্যপান করে না, ভদ্র, শান্তশিষ্ট জনগণ সহযোগিতাপ্রবণ। এরা ফুলের নকশা করা বস্ত্র ও গয়না পরিধান করে। সৌন্দর্যের জন্য তাদের সমীহ করতে হয়। সাজসজ্জায় বিভিন্ন ‘লুক’ পছন্দ করে।

মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের শাস্তি হস্তচ্ছেদন। আর্টিজানরা এ রকম অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড ভোগ করে। ঋণ যথাসময়ে ফেরত না দিতে পারলে বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি ভোগ করতে হয়।

রিপোর্ট পড়ে সেলুকাস ভাবলেন, কোনো কোনো ব্যাপারে মেগাস্থিনিসের সঙ্গে তাঁর আলোচনা করা দরকার। তবে সামগ্রিকভাবে রিপোর্টটি তাঁর মনঃপূত হয়েছে।

আলোচনাকালে দেখা গেল, কূটনৈতিক বিষয়গুলো রিপোর্টে আসে নি। এ ছাড়া সেলুকাস যুদ্ধ-পরবর্তী সময় উত্তর থরে অবস্থানকালে অধ্যাপকদের যে দাপট দেখেছেন, তা-ও অনুক্ত রয়ে গেছে। তিনি দুটো বিষয়ে আবার প্রতিবেদন দিতে বললেন মেগাস্থিনিসকে।

এ সময় দিদাইমেইয়া উপস্থিত হলেন সেলুসিয়ায়। হারমিজ তার নানাকে দেখে যতটা খুশি, তার চেয়ে বেশি মজা পাচ্ছে মেগাস্থিনিসকে দেখে। তার ধারণা, মেগাস্থিনিস একটা বোকার হদ্দ। মেগাস্থিনিস এতে কিছু মনে করেন না। সবাই প্রায় একসঙ্গে ইন্ডিয়া থেকে এসে পড়ায় এবং দেখাসাক্ষাৎ হওয়ায় ভালোই বোধ করছেন। দিদাইমেইয়া মেগাস্থিনিসকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আবার কবে যাচ্ছ?

মেগাস্থিনিস তাড়াতাড়িই যেতে চান। একটা বাড়তি টান অনুভব করেন ভারতবর্ষের প্রতি। বললেন, শিগগিরই। তবে আরাচোশিয়ায় একবার ঘুরে আসতে চাই।

বেশ, যাও। তবে তাড়াতাড়ি এসো। ইন্ডিয়ায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাও। এত দিন আমরা সবাই ছিলাম। এখন কর্নেলিয়া একাকিত্বে ভোগবে। তোমার উপস্থিতি এ সময় তার জন্য স্বস্তির কারণ হতে পারে।

সেলুকাস বললেন, তোমার কাজ দুটো শেষ করে রিপোর্ট জমা দিয়ে তবে যাও। আরাচোশিয়া যাওয়া কি জরুরি?

না গেলেও চলে।

তাহলে তুমি ইন্ডিয়ায়ই ফিরে যাও, বললেন দিদাইমেইয়া।

এখানে এসে দলটির দারুণ ভাঙন সৃষ্টি হলো। মিসরে যাচ্ছে নিকোমেডেস ও ফাওলিন। লাউডিস যাচ্ছে সিরিয়ায়। জেনারেল কিউকেকাস এখন নতুন অধিকৃত এলাকায় তাঁর সৈন্যদের সঙ্গে অবস্থান করছেন। দিদাইমেইয়া ভাবলেন তাঁর জন্মস্থানে যাবেন, সেখানে তাঁর নামের যে অ্যাপোলো মন্দির রয়েছে, তাতে আরাধনা করে আসবেন।

সেলুকাস বললেন, তোমরা তাহলে ইন্ডিয়ায় থেকে যেতে পারতে এবং তা-ই বরং ভালো ছিল।

হারমিজ বলল, একদম ঠিক বলেছ। আমার মনে হচ্ছে থাকার জন্য ইন্ডিয়াটাই ভালো।

মেগাস্থিনিস বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, ভাবো, ইন্ডিয়া হচ্ছে আমার জন্য শ্রেষ্ঠ জায়গা।

সবাই অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন মেগাস্থিনিসের দিকে। সেলুকাস বোধ হয় আরও বেশি অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন।

এবার মেগাস্থিনিস কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। তা লক্ষ করে সেলুকাস বললেন, মেগাস্থিনিস, এখন দ্রুত কাজগুলো শেষ করো। আমরা পারিবারিক বিষয় নিয়ে কথা বলি।  

মেগাস্থিনিস উঠে গেলে দিদাইমেইয়া বললেন, কর্নেলিয়া ভালোই আছে। গুছিয়ে নিয়েছে সবকিছু। আমার মনে হয় প্রাসাদের বাইরেও প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে।

কী রকম, জিজ্ঞেস করলেন সেলুকাস।

মহামন্ত্রী, মহামাত্য—সবাই তার থেকে পরামর্শ নেয়।

কন্যা আরেকটি সাম্রাজ্যের পরিচালনায় প্রভাব বিস্তার করছে, তা শ্লাঘার কথা। কিন্তু সেলুকাস বললেন, তাতে সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে না তো?

এ সুযোগ তো সম্রাটই দিয়েছেন।

কত দিন দেবেন?

এ নিয়ে তুমি ভেবো না তো। আমাদের কর্নেলিয়া বেশ বুদ্ধিমতী, সব সামলে নেবে। বেশি বুদ্ধিমান তো মহামন্ত্ৰী চাণক্য, তাঁকে হাতে রাখতে পারলে মনে হয় না কোনো সমস্যা হবে।

তুমি ভুলে যাচ্ছ যে তক্ষশীলায় সম্রাটপুত্র বিন্দুসার বড় হচ্ছে।

এটি আশঙ্কার কথা বলেছ, যদিও কর্নি যুবরাজের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখছে। ম্যানেজ করে নেবে সে সবকিছু। এখন নতুন রাজকন্যাকে ডাকো দেখি তাকে। শুনেছি সে দিমিত্রিয়াসের মেয়ে।

দিদাইমেইয়ার মুখে দিমিত্রিয়াসের মেয়ের কথা শুনে সেলুকাস হাসলেন। বললেন, আপামার মতোই তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেব।

তুমি ভুলে যাচ্ছ কেন, এ হচ্ছে কালকেউটে, তোমার মতো গ্রিক রক্ত তার দেহে।

তুমি না দেখে, তাকে না জেনে মন্তব্য করছ। আপামাকে বলেছিল ইজিপশিয়ান কেউটে। অথচ ওর মতো শান্ত আর ভালো রাজকুমারী হয়ই না।

দুটোকে মেলাবে না। আপামা ছিল সত্যিকার অর্থেই রাজকন্যা। এ তো তোমার সেনাগো শত্রু এন্টিগোনাসের নাতনি। যে নাম শুনলাম, এটা কি তার আসল নাম? না, শয়তানটাকে না ভুলতে পেরে ওর নামে নাম রেখেছ?

এ কথায় সেলুকাস বেশ বিব্রত হলেন। লাউডিস উঠে গেলেন। নিকোমেডেসরা তাঁকে অনুসরণ করল। সেলুকাস বললেন, না, এটি তার আসল নামই। আমি যুদ্ধ জয় করে তাকে পেয়েছি। বিজয়ী বীর জয়ের স্বাদ নানাভাবেই ভোগ করতে পারে। এ ছাড়া সব বয়সেই একজন সঙ্গীর প্রয়োজন হয়।

দেখো, কোথাও যেন ভুল না হয়।

কোনটা ভুল সহজে বলা শক্ত। একটু আগে মেগাস্থিনিস হিমালয় পর্বতকে বলছিল মাউন্ট ‘হেমোডোস’।

নাম ভুল কিংবা বিকৃতভাবে বললেও বদলায় না। যেমন চন্দ্রগুপ্তকে সে বলেছে সানড্রাকোট্রোস। যাক, ব্যাপারটা একান্তই তোমার। আমি পরামর্শ দেব সতর্কভাবে হ্যান্ডেলিং করো। মনে রেখো, দিমিত্রিয়াস বেঁচে আছে।

সেলুকাস এ রকম অনভিপ্রেত আলোচনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। দিদাইমেইয়ার অপ্রীতিকর কথাবার্তায় মনে মনে ক্ষুব্ধ। এ রকম ক্ষোভের প্রকাশ করে বললেন, দিমিত্রিয়াসকে আমি এবার জীবন্ত ধরে নিজ হাতে হত্যা করব। তার বাবার মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে তাকে।

দিদাইমেইয়া উঠে গেলেন।

.

স্বজনদের চলে যাওয়ায় হেলেন বেশ শূন্যতাবোধ করছেন। তা চন্দ্রগুপ্তের দৃষ্টি এড়াল না। কাছে এসে হেলেনের হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন, বড় চমৎকার মানুষ এরা সবাই। এমন আত্মীয়স্বজন কমই হয়। দিদাইমেইয়া এক অসাধারণ মমতাময়ী মা। তাঁকে আমি ভুলব না কখনো। লাউডিস, তার মেয়ে, নিকোমেডেস, ফাওলিন—সবাই। আমরা আবার তাদের নিয়ে আসব। এ কথায় চন্দ্রগুপ্তের কাঁধে মাথা রাখলেন হেলেন। তাঁর ভেতর থেকে উষ্ণ একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে এল। আবার চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আমি জানি, তোমার মনে অনেক কষ্ট। তা দূর না করতে পারাটা আমার ব্যর্থতা। আজ পূর্ণিমার রাত। নিখিলের বাঁশি শুনবে থর মরুভূমিতে।

হেলেন মাথা তুলে উঠে বসলেন। বললেন, সেদিন সব শিল্পীকে পুরস্কৃত করলেন, নিখিল আপনার কাছ থেকে কিছু পেল না।

তাই তো। সে এমনভাবে আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে যে তাকে বড় কিছু দেওয়ার কথা। আমি দেব তাকে।

সবার সামনে দেওয়া ঠিক হতো না?

আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কী দেব, সেদিন একবার মনে হয়েছিল, তাকে সাম্রাজ্যটা দিয়ে দিই। দিলে পাগলামি হতো সন্দেহ নেই, কিন্তু তা অর্থপূর্ণ পাগলামি হতো।

সম্রাটের কথা শুনে কষ্টের মধ্যেও হেলেন হাসলেন। সম্রাট আবার বললেন, সে পাবে অসাধারণ কিছু। তাহলে আজ থর মরুভূমিতে আবার নিখিলের বাঁশি শুনছি আমরা।

হেলেন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

.

আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললেন মহামন্ত্ৰী চাণক্য।

ভদ্রবাহু বললেন, অন্ধ্রের উপজাতি রাজার এক লক্ষ পদাতিক, দুই হাজার অশ্বারোহী এবং এক হাজার হস্তীসৈন্য বল থাকতেই পারে। কিন্তু এই শক্তি নিয়ে এর মৌর্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করবে?

সে তো তা-ই বলল। সে অবশ্য সৈন্যসংখ্যা বলতে পারে নি। তার ভাষ্যমতে, শুধু রাজাই জানেন কত সৈন্য আছে। আমি আমাদের গোয়েন্দাদের দিয়ে এ সংবাদ আনিয়েছি। সে একজন সেনাপতি। তার সব সংবাদই জানার কথা। হতে পারে সে ক্ষতিকরভাবে চিহ্নিত সেনাপতিদের একজন, যার তথ্য জানাটা ঠিক নয় ভেবে তার কাছে গোপন রাখা হয়েছে। আপনি চাচ্ছেন দাক্ষিণাত্যে অভিযান চালাতে, এই তো?

চাণক্য বললেন, সম্রাট এখন নতুন সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে ব্যস্ত। এ সময় অভিযানে যাবেন কি না, তা নিয়ে ভাবছি। আমার পরিকল্পনা হলো, শত্রুর আক্রমণের আগে অকস্মাৎ আক্রমণ করে নাস্তানাবুদ করে দেওয়া।

তার অর্থ, ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধ হবে না।

না।

সম্রাটের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে পরামর্শ করুন। তাঁর নির্দেশেই তো অভিযান হবে।

আমি সেনাপতিটিকে ডাকাব। সে-ই সবকিছু উপস্থাপন করবে সম্রাটের সামনে। মানচিত্র ধরে সে যুদ্ধের পথ দেখাবে।

আমাদের সৈন্যরা মালভূমি এলাকায় যুদ্ধ করে-নি, এটা মাথায় রাখতে হবে। সৈন্যদের সেভাবে তৈরি করতে হবে।

আচার্য, আপনি ঠিক বলেছেন। যুদ্ধের কলাকৌশল আপনারও রপ্ত হয়ে গেছে।

সেটি আপনার কল্যাণে। আপনার সঙ্গে থাকতে থাকতে।

দেখুন, গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৈন্যরা কিছুই পায় নি। দাক্ষিণাত্য সম্পদে পরিপূর্ণ। সে সম্পদ হস্তগত করতে পারলে আমরা কখনো অর্থসংকটে পড়ব না।

এসব সম্রাটকে বলবেন।

তা-ই ভাবছি আমি।

.

পরদিন সকালে সম্রাট লোক পাঠালেন আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে। ভদ্রবাহুকে কষ্ট করে এখনই আসতে হবে। বহুদিন হলো এভাবে ডাক আসে নি। ভদ্রবাহু কিছুটা অবাক হলেন। তবে তিনি গেলেন।

চন্দ্রগুপ্ত প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন ভদ্রবাহুর কাছে যে তাঁকে কষ্ট দিয়ে প্রাসাদে আনা হয়েছে। ব্যাপারটা সম্রাটের কাছে বেশ শঙ্কার এবং তিনি তাতে চিন্তিত বোধ করছেন।

ব্যাপারটা কী, প্রশ্ন করলেন ভদ্রবাহু।

সম্রাট বললেন, স্বপ্ন। কিছু স্বপ্ন দেখেছি, যার ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির লাগছে। এ অস্থিরতার কথা লোকজন পাছে টের পেয়ে যায়, তাই তিনি আচার্যকে এখানে ডেকে এনেছেন। শেষে এ কথাও বললেন।

আচার্য জিজ্ঞেস করলেন, কী স্বপ্ন, চন্দ্র?

একবার দেখলাম একটা বানর সিংহাসনে বসে আছে। আবার দেখলাম ক্ষত্রিয় বালকেরা গাধার পিঠে চড়ছে। কিছুক্ষণ পর দেখি বানরের ভয়ে হংস উড়ে যাচ্ছে। সবশেষে দেখলাম বারো মাথার এক সর্প ফণা তুলছে।

আচার্য এতে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সর্বাগ্রে তাঁর মনে পড়ল মহামন্ত্রী আচার্য চাণক্যের কথা। একটা বানর মানে কি উপজাতি রাজা? বানরেরা জঙ্গলে মালভূমিতে থাকে। প্রতীকী অর্থে সব মিলে যাচ্ছে। দ্বিতীয় স্বপ্নে দেখা ক্ষত্রিয় বালকদের ঘোড়ায় চড়ার কথা, কেন এরা গাধার পিঠে চড়বে? তৃতীয় স্বপ্ন বানরের ভয়ে রাজহংস উড়ে যাচ্ছে, তার অর্থ কি রাজ অমাত্য জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ও রাজপরামর্শকেরা বিতাড়নের শিকার হবেন? বারো মাথার সর্প তো সাংঘাতিক ব্যাপার। স্বপ্নগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র রয়েছে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আচার্য ভদ্ৰবাহু বললেন, চন্দ্র, তোমার ডান হাতটা দাও। সম্রাট হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ ভালো করে দেখে আচার্য বললেন, কোনো কোনো স্বপ্ন আসে পূর্বসতর্কতার জন্য। তোমার দেখা স্বপ্নগুলো সে রকম কিছু।

চন্দ্রগুপ্ত অস্থির হয়ে বললেন, কী রকম সতর্কতা? কোন ব্যাপারে সতর্কতা?

ধৈর্য ধরো তুমি। আমি ব্যাখ্যা করে বলছি।

একটা বানর সিংহাসনে বসে আছে, তার ব্যাখ্যা হলো কুৎসিত নীচুজন্মা মন্দ লোকেরা ক্ষমতা দখল করবে।

কারা এরা?

খোঁজ করে জানতে হবে। গোয়েন্দাদের তৎপর করতে হবে।

ক্ষত্রিয় বালকেরা গাধায় চড়ছে, তার অর্থ কী আচার্য?

উচ্চমর্যাদার রাজা নিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবেন।

বুঝলাম না।

রাজা সাধারণ মানুষের কাতারে চলে আসবেন, তিনি আর রাজা থাকবেন না।

বানরের ভয়ে রাজহংসরা উড়ে চলে যাচ্ছে।

উঁচু জাতের ব্যক্তিদের নিচে নামানোর চেষ্টা হবে। মর্যাদার দিক থেকে উচ্চপদের ক্ষেত্রেও তা হতে পারে।

বারো মাথার সর্প ফণা তুলছে কেন?

দেখো চন্দ্র, বারো মাথার সর্প কেউ দেখে নি কখনো, এটা কল্পনামাত্র!

তাহলে তার কোনো অর্থ নেই, আচার্য?

আছে, আছে। ব্যাপারটা দুর্ভিক্ষ হতে পারে।

আমার সাম্রাজ্যে তো খাদ্যের অভাব নেই, দুর্ভিক্ষ কেন হবে?

না-ও হতে পারে। সব স্বপ্ন বাস্তবে ফলে না। বস্তুগতভাবে কিছু বিষয় আছে, যার অর্থ ভিন্ন। চন্দ্র, স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমি করি বটে। স্বপ্ন আসলে এটা নয়, যা আমরা ঘুমিয়ে দেখি। স্বপ্ন হচ্ছে সেটা, যা আমাদের ঘুমোতে দেয় না। আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা বলছি।

এমন কথা তো কখনো বলেন না, আচার্য। আজ কেন বলছেন?

এ মুহূর্তে আমি নিজেও জানি না, তুমি এ নিয়ে ভাবো, আমাকেও ভাবতে দাও। তা ছাড়া এমন এক স্বপ্ন দেখো তুমি, যা তোমাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

আমি কি ইচ্ছা করলেই স্বপ্ন দেখতে পারি?

আমরা ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখি, ইচ্ছা করলে তা দেখতে পাই না বটে, কিন্তু জেগে স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়?

আচার্য, আপনি আজ নতুন কথা বলছেন। স্বপ্নের ভিন্ন এক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তা আমাকে অস্থির করে তুলছে।

জেগে থাকার স্বপ্নে যে অস্থিরতা, তা মূল্যবান, এখানে কোনো আতঙ্ক নেই, আছে সম্ভাবনার হাতছানি।

ভাবতে হবে আমাকে, ভাবতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *