মৌর্য – ৮৯

৮৯

বসন্ত উৎসবের তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠান ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত। এর উদ্যোক্তা স্বয়ং সম্রাজ্ঞী। তাই মহা আয়োজন। উৎসাহের কমতি নেই কারও। সুবন্ধু খুব তৎপর। নামকরা ভারতীয় সংগীতগুরুরা অংশ নিতে এসেছেন। মজার ব্যাপার, আরও একজন চীনা পরিব্রাজক এসেছেন পাটালিপুত্রে। তাঁর পরিচয় বিবরণীতে এক জায়গায় লেখা হয়েছে শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। তার জন্য প্রদেয় মোহরযুক্ত অনুমতিপত্রেও এর উল্লেখ রয়েছে। মুদ্রাধ্যক্ষ তথ্যটি সুবন্ধুকে দিয়েছেন। সুবন্ধু সম্রাজ্ঞীকে বলে তাঁকে বসন্ত উৎসবে সংগীত পরিবেশন করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। নিখিল পাতার বাঁশি বাজাবে। মুড ভালো থাকলে বাঁশের বাঁশিও বাজাতে পারে।

ভারতীয় উপমহাদেশে শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গসংগীতের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। সিন্ধু (উপত্যকা) সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে সপ্তছিদ্রবিশিষ্ট বাঁশি এবং বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। তাতে মনে হয় সে সময় গীতবাদ্যের প্রচলন ছিল। বৈদিক যুগের শ্যামবেদ থেকে জানা যায় উপাসনাসংগীতের কথা। ঋকবেদেও এর উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে নাট্যশাস্ত্রে নাটক ও নৃত্যের পাশাপাশি সংগীতের কথা বলা হয়েছে। এসবের সূত্র ধরেই আচার্য চাণক্য ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীত সম্পর্কে দিদাইমেইয়াকে ধারণা দিচ্ছিলেন।

শিল্পীগুরুদের আসার অপেক্ষা। সম্রাট-সম্রাজ্ঞীসহ দেশি-বিদেশি অতিথিবৃন্দ এসে গেছেন। দিদাইমেইয়া এ সুযোগে গ্রিক ধ্রুপদি সংগীত সম্পর্কে দু-চার কথা বললেন। তার আগে বিস্ময় প্রকাশ করলেন এই বলে যে এ দেশে শিল্পী-সাধকদের বড় মর্যাদা রয়েছে। সম্রাট-সম্রাজ্ঞীও তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, ঐশ্বরিক ক্ষমতা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা এ সম্মান, মর্যাদা, শ্রদ্ধা পাওয়ার অধিকারী। বলছিলেন গ্রিক ধ্রুপদি সংগীতের কথা।

দেবরাজ জিউসের কন্যা মিউসের নাম থেকে মিউজিক নামটা এসেছে। তিনি সহনশীল শিল্প-সাহিত্যের দেবী। গ্রিক সমাজে মিউজিক বলতে সম্পূর্ণ শিক্ষাকে বোঝায়। আমরা যে দেববংশের সন্তান, সে অ্যাপোলো গান করেন। কচ্ছপের খোল দিয়ে তৈরি বীণা বাজান তিনি। দেবতা হারমিজের কাছ থেকে এমফোনিয়ন সংগীত শেখেন।

আমাদের হারমিজ মনে হয় সংগীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। আচার্য ভদ্রবাহুর কথায় সায় দিয়ে দিদাইমেইয়া বললেন, এ কথায় পরে আসছি। আগে অ্যাপোলোর কথা শেষ করি। দেবতা হারমিজ অ্যাপোলোকে কচ্ছপের খোলের মতো স্বর্ণনির্মিত এক লইয়ার (বীণা) বাজিয়ে শোনান। বীণার সুরে পাথর পর্যন্ত নড়তে-চড়তে শুরু করে। আসলে হারমিজ অ্যাপোলোর মহত্ত্ববাচক নিবেদনসংগীত গাইছিলেন। কারণ আছে। আরেক দেবতা মারসেয়াস একবার অ্যাপোলোকে চ্যালেঞ্জ করছিলেন যে গান গেয়ে অ্যাপোলোকে তিনি হারিয়ে দেবেন। অ্যাপোলো বললেন, হেরে গেলে তোমাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। মারসেয়াস চ্যালেঞ্জ থেকে সরে আসেন নি। তাই সংগীত প্রতিযোগিতা হলো। বিচারক জিউস-কন্যা মিউজেস। প্রতিযোগিতায় মারসেয়াস হেরে যান। শাস্তিস্বরূপ মারসেয়াসের দৈহিক রূপান্তর ঘটে (রোমান কবি ওভিদ এ কাহিনি এবং দেফানের কাহিনি নিয়ে ‘মেটামরফোসিস’ মহাকাব্য রচনা করেন: সময় খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩)। আমরা তো মহাসংগীতগুরু অর্ফিয়াসের কথা জানি। তাঁর সংগীত বন্য পশুপাখি পর্যন্ত নীরব-নিঃশব্দে শুনত। আর আমাদের হারমিজ, সে সব ঐতিহ্যের ব্যাপারগুলোর সঙ্গেই যুক্ত। অ্যাপোলোকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা সংগীত সে-ও গাইতে পারে। আপনাদের আয়োজনটা এত বড় যে এটা তার জন্য মানানসই নয়, পরে আপনাদের সে নিশ্চয়ই গান শোনাবে। দারুণ কিছু কথা জানলাম আমরা, বললেন চাণক্য। এরই মধ্যে একজন সংগীতগুরু উপস্থিত হয়েছেন মঞ্চে। ভারতীয় রীতি অনুযায়ী সংগীতগুরুদের নাম নিতে হয় না, নিলে কর্ণ স্পর্শ করতে হয়। তাই আমরাও তা থেকে বিরত থাকলাম।

তিনি এসেছেন ঐতিহ্যবাহী একটি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। নাম রাবণাহাথা। এটা একধরনের বীণা। তিনি প্রথমে গলা সাধলেন। পরে রাগসংগীত শুরু করলেন। সঙ্গে তবলাজাতীয় একটা বাদ্যযন্ত্ৰ সংগত করতে শুরু করলেন এক সাধকগুরু। ক্রমে জমে উঠল আসর। সুরের অতল সমুদ্রে প্রবেশ করল সবাই।

হেলেন একপর্যায়ে বললেন, কন্ঠের সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে সংগীতযন্ত্রটার সুর। অদ্ভুত এক উদ্ভাবন।

চন্দ্রগুপ্ত বললেন, তার একটা ইতিহাস আছে।

কী ইতিহাস?

রাবণ এই বাদ্যযন্ত্রটা ব্যবহার করতেন।

রামায়ণের রাবণ?

হ্যাঁ, তাঁর নামেই এই বাদ্যযন্ত্রের নাম। রাবণ এই বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দেবতা শিবের আরাধনা করতেন। রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর রাম ও হনুমান বাদ্যযন্ত্রটা উত্তর ভারতে নিয়ে আসেন।

অদ্ভুত ব্যাপার! এ রকম একজন সংগীতপ্রেমী রাজার বিরুদ্ধে পরস্ত্রী হরণের অভিযোগ?

আসলে কী ঘটেছিল, এখন আর তা বলার উপায় নেই। মহাকবি বাল্মীকিই ভালো জানেন।

অসাধারণ গাইছেন সংগীতগুরু। বাজাচ্ছেন ‘জলবৎ তরলং’। হৃদয় স্পর্শ করে যাচ্ছে। ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের এমন সুর অন্তর না স্পর্শ করে পারে না।

আচার্য ভদ্রবাহুর পাশে বসে আছে নিকোমেডেসরা। ভদ্রবাহু বললেন, রাগসংগীত কি তোমাদের পছন্দ?

নিকোমেডেস বলল, তরুণ কিংবা যুবকদের সংগীত যে রাগসংগীত নয়, তা স্পষ্ট। তবে আমরা দুজনই পছন্দ করি। এ পছন্দটা মিসরে অবস্থানের জন্য হয়েছে। ফারাও সম্রাটরা সংগীত পছন্দ করেন। লোকজন বিশ্বাস করে, এদের সংগীতের দেব-দেবী রয়েছে। দেবতা হচ্ছে বেস আর দেবী হাযোর। সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে মিসরীয়দের জীবনে। সমাজ-ধর্ম সর্বত্র আপনি গির্জায় যাবেন—সংগীত, প্রাসাদে যাবেন—সংগীত, কবরস্থানেও সংগীত। বাদ্যযন্ত্রগুলো অদ্ভুত। অর্কেস্ট্রায় এরাই বোধ হয় সেরা। হাজার হাজার বছর ধরে যে সংগীতের চর্চা আছে, পিরামিডের ভেতরকার চিত্রগুলো তার প্রমাণ। রাজ-উপত্যকা একটি চমৎকার সংগীত। ‘রণসংগীত’ বিজয়ী সৈনিকদের প্রচণ্ডভাবে উজ্জীবিত করে। অন্ধকারসংগীত কিংবা ক্রিপী সংগীত, যেন মমি থেকে বের হয়ে আসছে একটা সকরুণ সুর। তাই একে মমিসংগীতও বলে। এ রকম শত শত সংগীত আছে এদের। সমৃদ্ধি যখন আসে, সবদিক থেকে আসে। মিসরীয় সভ্যতা তার প্ৰমাণ।

একসময় ধীরলয় দ্রুতলয়ে রূপ নেয় এবং মুনশিয়ানার সঙ্গে গুরু সংগীত শেষ করেন। দুই ঘণ্টাব্যাপী গাওয়া সংগীত শেষ করে বাদ্যযন্ত্রটি কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে সংগীতগুরু বিনয়ের সঙ্গে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে সবার প্রতি প্রণতি জানালেন। সম্রাট দাঁড়ালেন, সম্রাজ্ঞী দাঁড়ালেন, দেখাদেখি সবাই দাঁড়াল, সম্রাট এগিয়ে গিয়ে নিজের গলা থেকে খুলে সাতনলি মুক্তোর মালা সংগীতগুরুর গলায় পরিয়ে দিলেন। হাততালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠল।

এবারে চীনা শিল্পীর পরিবেশনা। তিনি দোভাষীর মাধ্যমে চীনা ধ্রুপদি সংগীত সম্পর্কে দু- চার কথা বললেন। ঝু সম্রাটদের আমল (১১২২-২৫৬ খ্রিষ্টপূর্ব) থেকে চীনে ধ্রুপদি সংগীত চালু হয়ে আসছে। লিং লুন হচ্ছেন এ সংগীতের উদ্ভাবক। ঝুদের হলুদ সম্রাটের অনুরোধে লুন এ সংগীতের প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। প্রচলিত সংগীতেরই তিনি একটা অভিজাত রূপ দেন, যাকে বলা হয় ইয়াইয়ু। কনফুসিয়াস তাঁর সাধনায় একে সর্বজনীন রূপ দিয়ে ‘শি ঝিং’ পর্যায়ে নিয়ে আসেন। বাঁশের বাঁশি এবং কিন বা জুকিন (কুন) হচ্ছে সর্বপ্রাচীন বাদ্যযন্ত্র। মাটি খুঁড়ে ছয় হাজার বছর আগের একটি হাড়ের বাঁশি পাওয়া গেছে, যাতে বারোটি ছিদ্র বা টিউন আছে। আমি এ দুটো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান করব। তবে গানটি ঝেনসংগীত হিসেবে প্রচলিত।

শিল্পী প্রথমে বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। স্তব্ধ হয়ে গেল চারদিক। বাঁশি যেন কোথায় নিয়ে গেল সবাইকে। সেখানে জুকিনের টুং টং সুরেলা শব্দ হতে থাকল কিছুক্ষণ। শিল্পী আবার ফিরে গেলেন বাঁশিতে। বাঁশি শেষে কণ্ঠ সাধলেন রাগ ধ্রুপদ ইয়ামানে। তারপর আবার বাঁশি। আবার জুকিন। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী বুঝতে পারলেন না শিল্পী কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদেরকে। আচার্য দুজন চোখ বন্ধ করে অন্য জগতে পৌঁছে গেছেন। তাঁদের অন্তরই যেন বেশি স্পর্শ করতে পেরেছেন চীনা শিল্পী।

মেগাস্থিনিস এ মোহময় সংগীতের গভীরতায় ডুব দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শর্মিলার দিকে। মূর্ত-বিমূর্ত শিল্পে তিনি আত্মহারা। শর্মিলা তাঁর গুরুর মতো চোখ বুজে সংগীতসুধা পান করছেন।

ফাওলিন নিকোমেডেসকে বলল, সুরটা ‘রাজ-উপত্যকা’র মতো শোনাচ্ছে না?

আমারও তা-ই মনে হচ্ছিল।

হারমিজ তার মাকে বলল, এ সংগীতটা শিখব, মা।

লাউডিস বলল, বেশ, তা-ই হবে।

দিদাইমেইয়া তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। বললেন, অ্যাপোলোর স্তুতির মতো শোনাচ্ছে। সংগীতের একটা বিশ্বজনীন রূপ আছে।

ভদ্ৰবাহু চোখ খুলে বললেন, আমারও সে কথা মনে হচ্ছে!

এ সংগীত শুনতে শুনতে হেলেন একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেলেন। নিখিলের বাঁশি এখন কে শুনবে? তাকে এই বাসন্তী উৎসবে বাঁশি বাজাতে দেবেন, নাকি দেবেন না। সম্রাটের সঙ্গে পরামর্শ করতে চান না। সিদ্ধান্তটা একাই নিতে হচ্ছে। তাঁর নির্বাচিত শিল্পী নিখিল। মরুভূমি আর এটা তো এক জায়গা নয়। নিখিলের অসফলতা তাঁরই ব্যর্থতা। সুবন্ধুকে চোখের ইশারায় ডাকলেন। সুবন্ধু বললেন, ব্যাপারটা কেমন হবে বুঝতে পারছি না, সম্রাজ্ঞী। তবে তাকে মোটেও হতোদ্যম বলে মনে হচ্ছে না। সে চীনা সংগীত শুনে যেন আরও উজ্জীবিত।

সম্রাজ্ঞী বললেন, পাগলাটে তো, কারণ বোধ হয় তাই। পটশিল্পী অনুষ্ঠানের ছবি এঁকে যাচ্ছিল। পাশে মঞ্চ শিল্পী ভবদানব। দুজন ব্যাপারটা আঁচ করছে। নিখিলকে বলল, কঠিন পরিস্থিতি, নিখিল।

কঠিন নয়, অনেক সহজ, বলল নিখিল। অনুষ্ঠানটা প্রতিযোগিতার নয়। কিন্তু সে রকমই মনে করছে মৌর্যদের সবাই। আর তাদের প্রতিযোগীর দায়িত্ব পড়েছে যেন নিখিলের ঘাড়ে। নিখিল তা মনে করছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। সে শুধু বাজাতে চায়।

সুবন্ধু তখনো সম্রাজ্ঞীর আদেশের অপেক্ষায়। অবশেষে আদেশ পাওয়া গেল। সম্রাজ্ঞী বললেন, বাজাক।

চীনা শিল্পী এবার বাঁশের পরিবর্তে হাড়ের বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন। যেন এক জাদুকরি সুর এ বাঁশির।

বাঁশের বাঁশি শুনে সবাই অভ্যস্ত। ছয় হাজার বছর আগের বাঁশির অনুকরণে তৈরি এটি। বারোটি ছিদ্র। অবলীলায় বাজাচ্ছেন শিল্পী। অবাক হওয়ার পাশাপাশি বিমোহিত সব শ্রোতা।

নিখিলের বিস্ময় সবচেয়ে বেশি। সে এদিক-সেদিক থেকে কাত হয়ে, সোজা হয়ে তাকাচ্ছে বাঁশিটির দিকে। সম্ভব হলে একবার ছুঁয়ে দেখবে, শুধু দেখবে কেন, একবার বাজিয়েও দেখতে চায়।

তা দেখে সুবন্ধু ভাবলেন, পাগলটা এমন পাগলামি করছে কেন? হঠাৎই বলে বসবে না তো, না, আমি এখানে বাজাব না। উৎকণ্ঠায় আছেন তিনি।

না, পাগল তা করল না। চীনা শিল্পীকে সম্রাট গলা থেকে হার খুলে পরিয়ে দেওয়া এবং আজীবন মৌর্য সাম্রাজ্যে থাকার মতো সম্মান দেওয়ার পর নিখিলের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সে মঞ্চে হাজির হলো।

তার পোশাক-আশাক রাজকীয়। ভাবভঙ্গির মধ্যেও শিল্পীদের সহজাত মনোভাব মূর্ত। পাতার বাঁশিটাই প্রথম নিল সে। দুই ঠোঁটে আবদ্ধ করে ফুঁ দিল। কিন্তু অ্যাবসার্ড নাটকের কুশীলবের মতো অভিনয়ই হলো, বাঁশি বেজে উঠল না। অবশ্য তাতে কোনো ক্ষতি হয় নি, দর্শক-শ্রোতারা ভাবলেন, শিল্পী ধুনের আগে বাদ্যযন্ত্র পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। নিখিল এই পাতার বাঁশিটা বদলে আরেকটা পাতার বাঁশি নিয়ে বাজানোর চেষ্টা করল। এতে ফুটো ছিল না, বাতাস তাকে সহায়তা করল। উত্তেজনায় প্রথমে বেসুরো মনে হলেও পরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো সম্পূর্ণভাবে।

এবার চীনা শিল্পীর বিস্ময়। পাতা দিয়ে এমন বাঁশি বাজানো যায়! বাঁশি মানুষকে মুগ্ধ করে, আবেগাপ্লুত করে। বাঁশির সঙ্গে সম্পর্কটা বোধ হয় হিমযুগ থেকে। মানুষ সুরের সন্ধান কীভাবে পেয়েছিল, কে জানে। মনে হয় সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে বাঁশি মানুষের সঙ্গে আছে। চীনের উয়াং প্রদেশের জিয়াহু গ্রামে পাওয়া আট হাজার বছর আগের হাড়ের বাঁশি এবং সিন্ধু সভ্যতার সপ্তছিদ্রের বাঁশিই তা প্রমাণ করে। পাতার বাঁশির বয়স হয়তো তার চেয়েও বেশি। কোনো আদিম মানব, বাচ্চা বয়সীও হতে পারে, পাতা ছিঁড়ে ভাঁজ করে ফুঁ দিতেই তা বেজে ওঠে। তা দেখে কেউ হয়তো তাতে সুর বেঁধে দেয়। একটুকরো গাছের বাকল কিংবা পশুচামড়া পরিহিত একজন আদিম শিকারি মানুষ শিকারের বল্লম বা পাথর-অস্ত্র পাশে রেখে পাতার বাঁশি বাজাচ্ছে, কল্পনা করতেই ভালো লাগছে। দৃশ্যটাও অদ্ভুত।

বাঁশি সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানবসভ্যতা ও ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। শ্রীকৃষ্ণ বাজান প্রেমের বাঁশি। নিরো বাজান ধ্বংসের বাঁশি, রোজ কেয়ামত শুরু হবে ইস্রাফিলের শিঙার শব্দ শুনে। হয়তো আরও অনেক ধর্ম বা লোকবিশ্বাসের সঙ্গে বাঁশি জড়িয়ে আছে।

মহামন্ত্রী চাণক্য নিখিলের ভক্ত। আগে তিনি সংগীত জিনিসটা পছন্দই করতেন না। নিখিল বাঁশির মাধ্যমে তাঁকে সংগীতপ্রেমী করে তুলেছে। ভদ্রবাহুকে উদ্দেশ করে বললেন, আচার্য, দেখুন পাতার কী গুণ। শ্রীকৃষ্ণ বোধ হয় এ বাঁশিতেই রাধাকে পাগল ও গৃহছাড়া করেছিলেন।

কিন্তু আমরা জানি বাঁশের বাঁশি বাজাতেন ব্রজের নাগর, বললেন ভদ্ৰবাহু।

দুটোই হতে পারে।

নিখিল ভূমিকাটা করেছে পাতার বাঁশি দিয়ে। মূল ধুনে বাঁশের বাঁশি বাজাতে গিয়ে প্রথমে হোঁচট খেলো। কোথায় ভুল হচ্ছে, বুঝতেও পারল না। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। কিছুটা আহত হলেন চাণক্যও। তবে বেশি দুঃখ পেল তার দুই বন্ধু মঞ্চ নির্মাতা ও পটশিল্পী। তাদের উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা আফসোসের পর্যায়ে। ভবদানব বলল, চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা হচ্ছে। গাধাটা করছেটা কী!

আমারও খারাপ লাগছে, বলল পটশিল্পী। আমি তার (নিখিল) একটি চমৎকার ছবি আঁকতে চেয়েছিলাম। সে বাঁশি বাজাবে, আমি ছবি আঁকব। এখন খুব কষ্ট হচ্ছে।

শর্মিলাকে মেগাস্থিনিস বললেন, ওই দুই শিল্পীর পর তাকে পারফর্ম করতে দেওয়া ঠিক হয় নি। কারণ, সব ভালো তার, শেষ ভালো যার। সে ভালো না বাজাতে পারলে চীনা শিল্পীকে বলব আবার বাজাতে।

সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত সুবন্ধু। তার ভাগ্যে কী আছে, কে জানে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিখিল বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সুর তুলল। এবার বায়ু তার নিয়ন্ত্রণে, সুর স্বাভাবিকভাবে আসছে। সে আস্তে আস্তে জবরদস্ত ওস্তাদি কায়দায় বাঁশি বাজাতে শুরু করল। সে আগে যেসব সুর বাজিয়েছে, আজকেরটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বসন্তরাগে বাজাচ্ছে সে।

ভদ্রবাহু বললেন, নিখিল আসলেই প্রতিভাধর।

সে আমার আস্থা এমনি এমনি অর্জন করে নি, বললেন চাণক্য। যোগ করলেন, আহা, এমন সুর যদি ধরে রাখা যেত।

একদিন হয়তো ব্যবস্থা হবে, তখন আমরা থাকব না, বলে ভদ্রবাহু অঙ্গুলি দিয়ে দেখালেন, দেখুন দেখুন, চীনা শিল্পী টুংটাং জুকিন সংগত করছেন। হয়তো মনের অজান্তেই ভারতীয় সংগীতগুরু নিখিলের কাছে এগিয়ে এলেন। নিখিলের কানে কানে বললেন, চমৎকার বাজাচ্ছ, ঈর্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে খাদের জায়গাগুলোয় রাবণাহাথাটা বাজাতে চাই।

নিখিল মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। কারণ, সংগীতগুরুর ভক্ত হয়ে গেছে সে।

শুরু হলো বাঁশি আর রাবণাহাথার দ্বৈরথ। শ্রোতাদের শুধু মুগ্ধ নয়, পাগল করে তুললেন এঁরা। আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, স্বর্গের কথা বলি আমরা, আচার্য, এই তো স্বৰ্গ।

আমারও মনে হচ্ছে স্বর্গে আছি আমি।

সম্রাটের চোখেমুখে উত্তেজনা। ভালো শিল্পী অন্তর স্পর্শ করে মানুষকে আবেগতাড়িত করে তোলে। কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, সম্রাট সে রকম একজন।

সম্রাজ্ঞী বললেন, আপনার ভালো লাগছে না?

অসাধারণ! কী বলব, বুঝতে পারছি না। হেলেন, তুমি এক জহুরি, সোনা চিনতে ভুল করো না, সোনা কী, এ তো হিরে। আমার সাম্রাজ্যে এমন হিরেও আছে, তা ভেবে উত্তেজিত আমি। সে যদি এখন মৌর্য সাম্রাজ্য চেয়ে বসে, দিয়ে দেব আমি।

সম্রাজ্ঞী মজা করে বললেন, আমি যে খুঁজে বের করেছি, তার জন্য আমাকে কোনো কিছু দেবেন না?

দিয়ে রেখেছি, আমার নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিয়েছি, নিজের চেয়ে মূল্যবান জিনিস আর কিছু নেই।

দিদাইমেইয়া লাউডিসকে বললেন, নিখিলকে দিয়ে আমি অ্যাপোলোর মতো একটা বন্দনাসংগীত কম্পোজ করাব।

অসাধারণ হবে, পিসি।

শর্মিলাকে মেগাস্থিনিস বললেন, আমি ভুল বলেছিলাম। ও মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একজন মস্ত শিল্পী।

আপনি জানেন, ভুলের জন্য এখানে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। আপনি ভুল স্বীকার করলে শাস্তি পেতে হবে।

কী শাস্তি দেবে? আমার এই ক্ষমাহীন ভুলের জন্য শাস্তি পাওয়াই উচিত।

কথা শুনে হেসে দিয়ে শর্মিলা বলল, কঠিন শাস্তি।

নিকোমেডেস কম বয়সে গ্রিক-মিসরীয় সংগীতের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিখিলের বাঁশি শুনে একেবারে স্তব্ধ। ফাওলিন বলল, তুমি এত চুপচাপ কেন?

বিশ্বাস করো, কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। একদিন আগে প্লেটোর সংগীতবিষয়ক অভিযোগগুলো পড়ছিলাম। অভিযোগগুলো পাঠ করে আমার মনও তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। যারা ভুলভাল সংগীত করছে, সংগীতের স্পিরিট অব লকে উপেক্ষা করছে, তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলাম। তিনি তাদের সংগীত-সন্ত্রাসী বলেছেন।

ভুলভাল সংগীত করছে কারা?

কতিপয় কবি, তাঁর ভাষায়, এরা কুসংগীতের মূল উদ্‌গাতা। গাইছে তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরাই, যারা সংগীতের ব্যাকরণ জানে না। কিন্তু এরা যে ন্যাচারাল টেলেন্ট, প্লেটো তা স্বীকার করেন। বলেন, ওরা মনে করছে আনন্দ দেওয়াটাই মূল কথা, ভালো-মন্দ নয়।

তাহলে ভালোটা কী?

ব্যাকরণ মেনে চলা।

আনন্দ দেওয়াটা মুখ্য নয়?

নিখিলের বাঁশি শুনে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। ন্যাচারাল টেলেন্টরাই পারে সবকিছু পাল্টে দিতে। রক্ষণশীল পণ্ডিতেরা কিছুই পাল্টাতে পারেন না। নিখিল আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে, নতুন প্রজন্মের ন্যাচারাল টেলেন্টরা আসলেই ঠিক করেছে। না হয় ভারতীয় সংগীতগুরু ও চীনের সংগীতপ্রতিভা তার সঙ্গে যুক্ত হতেন না।

তুমি ঠিক ধরেছ।

ধীরলয় থেকে দ্রুতলয়ে পৌঁছে গেছে সংগীত। তিনজনই মহাব্যস্ত। দর্শক-শ্রোতাদের উত্তেজনা তুঙ্গে। তাদের তনু-মন একাত্ম হয়ে গেছে সংগীতের সঙ্গে। এক স্বর্গীয় অনুভূতি ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কোনো শব্দ নেই কারও মুখে। উপনিষদের সেই কথা ভদ্রবাহু উচ্চারণ করে বললেন, ‘মানুষ অমৃতের সন্তান’। সংগীত তার সঙ্গে আরেকবার যোগাযোগ তৈরি করে দিল।

আচার্য চাণক্য বললেন, ঋকবেদ, তার আগে শ্যামবেদ সে রাস্তা তৈরি করে দিয়ে রেখেছে। সে মর্মবাণী আগে বুঝতে পারি নি। এখন যেন তাতে ভাসছি আমি।

ততক্ষণে বাঁশি বাজানো শেষ হয়ে এসেছে। এখানেও একটু ওস্তাদি দেখিয়ে নিখিল শেষ করল বাঁশি।

সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেল। নিকোমেডেস অস্ফুটে বলল, ন্যাচারাল টেলেন্ট। যেন সে বিজয়ী হয়েছে। শিল্পীরা সবাই এগিয়ে এসে তাকে অভিনন্দন জানালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *