৮৮
বসন্ত উৎসবে এবার নতুন করে সেজেছে পাটালিপুত্র। সর্বত্র আনন্দ আয়োজন। মেলা, গানবাদ্য, নৃত্য, উল্লাস—এসবের কোথাও কমতি নেই।
সম্রাটের রাজপুরী যেন আরও উজ্জীবিত। নতুন সম্রাজ্ঞী উজ্জীবনের প্রাণকেন্দ্রে। সম্রাটও তাতে উদ্বেলিত। তাই প্রাণের বন্যা সর্বত্র। বাসন্তী পোশাক-আশাক রং ছড়িয়েছে প্রাসাদ অভ্যন্তরে। বাইরে প্রকৃতি সেজেছে পুষ্পপল্লবে।
তার মধ্যেও হেলেন অস্থিরতায় ভুগছেন। অস্থিরতার কারণ গ্রিক রীতির সঙ্গে প্রাচ্যের মেলবন্ধন কীভাবে ঘটাবেন তিনি। গ্রিক বসন্ত উৎসব তাঁর মাথায় আছে। প্রাচ্যের উৎসবের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তাই তাঁর সাজসজ্জা হাস্যকর হয়ে যাবে না তো? প্রথমে অন্তঃপুরে, ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্য পরিচালনায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাবের ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেছে—এ অবস্থায় হাস্যকর সাজসজ্জা বা পোশাকের অর্থ তাঁর ব্যক্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেওয়া। এ ছাড়া ভারতীয় বসন্ত উৎসবের মর্মকথা, যে প্রেম বা ভালোবাসা এবং কামবোধ, তার উন্মত্ত প্রকাশ যেন না থাকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। এসব আগেই ভেবে রাখা উত্তম ছিল, ভাবলেন তিনি। আগের মতো উচ্ছল তারুণ্য নয়, এখন তাঁকে একজন দায়িত্বপূর্ণ সম্রাজ্ঞীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এসবই মাথায় ঘুরছে।
এ সময় ফাওলিন এসে উপস্থিত হলো। তার পোশাকটা ‘বাঙ্গক’ সিল্কের সঙ্গে মানানসই মিসরীয় ধাঁচের ঐতিহ্যবাহী হালকা গয়নায় সজ্জিত।
হেলেন বললেন, বাহ্, চমৎকার তো।
সম্রাজ্ঞী যদি মিসরীয় আর্টটা দেখতেন, তাহলে উপলব্ধিটা আরও বেশি উপভোগ্য হতো, বলল ফাওলিন।
এমনিতেই অপূর্ণ লাগছে তোমাকে। আমাকে ভাবনার মধ্যে ফেলে দিলে, এবার আমাকে পরামর্শ দাও।
অনেক পোশাক আর গয়না। ফাওলিন সম্রাজ্ঞীর বর্তমান অবস্থার কথা মাথায় রেখে এগুলোর মধ্য থেকে এক সেট পোশাক ও গয়না বের করে আনল। তাকে সাহায্য করল মন্দাকিনী। সুবর্ণকোড্যায় নানা রত্নখচিত তৈরি বিচিত্র পোশাক। এটি উদিত সূর্যের মতো উজ্জ্বল, কামরূপ থেকে আনা। কামরূপের শুধু নাম থেকে নয়, অন্তর্নিহিত তাৎপর্য থেকেও বের হয়ে আসে কামভাবের মর্মবাণী। রাজকীয় গয়নাকে বাদ দেওয়া যাবে না, ভারী হলেও সমস্যা নেই। গ্রিসের প্রতিনিধিত্ব করবে মাথার মুকুট। ফাওলিন বাছাই করে নিল করন্ডমুকুট। গ্রিক ঐতিহ্যবাহী হেলেনিস্টিক আর্মির একরা বাহিনী এ রকম শিরস্ত্রাণ পরিধান করে। অবশ্য করন্ডমুকুট এখানে উৎসবের পরিচয় বহন করে। সিটি ডায়নোসিয়ার নাট্যমঞ্চে অভিনেতাদের মাথায় শোভা পায় এ মুকুট।
দিদাইমেইয়া ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মরকত মণির মতো মসৃণ পৌত্রিকা এবং লাউডিস সৌবর্ণকুড্যকা পরিধান করেছেন। মাথায় তাঁদের ঐতিহ্যবাহী গ্রিক শিরচক্র। গ্রিক বসন্ত উৎসবে নায়িকারা এসব মাথায় পরে। লাউডিসের পোশাকটা আরও জমকালো হতে পারত। কিন্তু তাঁর মনে আনন্দ নেই। এমন উৎসবে তাঁর পাশে স্বামী জেনারেল কিউকেকাস নেই। কিউকেকাস এখনো সিরিয়ায় যুদ্ধের ময়দানে।
হারমিজ বেশি আনন্দিত। পোশাকটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। এ ছাড়া প্রাচ্যের রাজকীয় পোশাকে তাকে মানায়ও ভালো।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে গ্রিক বসন্ত উৎসবের নাটকের পোশাকে উপস্থিত হয়েছেন মেগাস্থিনিস। পোশাকটা টেনেটুনে নিজেই বললেন, বসন্ত উৎসবের পোশাক এ রকমই হওয়া উচিত।
নিকোমেডেস তাঁকে সমর্থন করতেই মেগাস্থিনিস ভালোভাবে তাকালেন তার দিকে। বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, তোমার পোশাক আমি ফারাওদের বসন্ত উৎসবে দেখেছি। অদ্ভুত! কিন্তু ছোট্ট একটা অমিল রয়েছে, এটা কী?
এটা ভারতীয় ঐতিহ্যের মেলবন্ধন। ভারতীয় বীরেরা তা বাহুতে পরে, নাম অঙ্গদ।
অনুষ্ঠানটা শুরু হলো ধ্রুপদি নৃত্য দিয়ে। মেগাস্থিনিস বাম দিকে তাকালেন। তিনি খুঁজছেন শর্মিলাকে। শর্মিলা তাঁর অনুরোধ রক্ষা করেছেন। ভদ্রবাহুর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এসেছেন।
ধ্রুপদি নৃত্যটা কী, প্রশ্ন করলেন মেগাস্থিনিস।
ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্স। ভারত বিখ্যাত নৃত্য।
মেগাস্থিনিসই একা। নিকোমেডেসের সঙ্গে ফাওলিন আছে, সম্রাটের সঙ্গে হেলেন, দিদাইমেইয়ার সঙ্গে লাউডিস এবং তাঁর মেয়ে, আর ভদ্রবাহুর সঙ্গে চাণক্য। দিদাই মইয়া ভদ্রবাহুর ডান পাশে বসেছেন। এটা-ওটা জানতে সুবিধে হচ্ছে। নৃত্য দেখে অভিভূত দিদাইমেইয়া। ভদ্ৰবাহুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী নৃত্য এটা? অসাধারণ লাগছে।
কথক নৃত্য এটি। উত্তর, পশ্চিম ও মধ্যভারতের নাচ।
আর সব এলাকায়ও ভিন্ন ভিন্ন নৃত্য আছে নাকি?
আছে। যেমন তামিলনাড়ুতে ভরতনাট্যম, কথাকলি নৃত্য কেরালায়, কুচিপুডি অন্ধ্রপ্রদেশে ও ডিসি উড়িশ্যায়, মণিপুরী মণিপুরে, মোহিনী ইয়াত্তাম কেরালায় এবং সত্যিয়া আসামে। সব ধ্রুপদি নৃত্যের মূল ভারতীয় কলাকৈবল্য ও ধর্মীয় বোধে।
তাহলে এসব নৃত্য বেশ প্রাচীন?
সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ দুই-আড়াই হাজার বছর আগের। সে সময়ও যে নৃত্য ছিল, তার প্রমাণ মেলে নৃত্যরত একটি বালিকার প্রত্নমূর্তি দেখে। তবে ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র একালের নৃত্যশিল্পের এত উন্মেষ ঘটিয়েছে। নৃত্যটা এখানে দেবতার আরাধনার শিল্পরূপ।
তাই তো দেখছি। সব কটি নৃত্য কি দেখাবে?
আজ শুধু নৃত্যই দেখাবে।
প্রাণভরে দেখব আমি।
আপনার ভালো লাগছে?
বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের নাটকগুলোর মতো প্রতিযোগিতা হয় না কেন?
এখানে নৃত্য হচ্ছে শিল্প ও দেবতার আরাধনা, প্রতিযোগিতা হলে দুয়েরই সম্মানের হানি হয়। তপস্যায় প্রতিযোগিতা চলে না।
মেগাস্থিনিস একবার নৃত্য এবং আরেকবার শর্মিলার দিকে তাকালেন। এবার প্রশ্ন করলেন, এ শারীরিক কসরত কতক্ষণ চলবে?
কেন, আপনার ভালো লাগছে না?
লাগছে। আমরা ড্যান্স করি জীবনের অংশ হিসেবে। সবাই ড্যান্স করি। এখানে এটা দেখছি শিল্প। ভঙ্গিগুলো চমৎকার। পোশাকটাও প্রাচ্য পরিচয়বাহী।
অনেক কষ্ট করে শিখতে হয়।
আপনি ড্যান্স করেন?
না, করি না।
অবশ্য আমাদের নানরাও করে না। এ ড্যান্স আমার ভালো লাগছে। আমি মুগ্ধ হচ্ছি।
শর্মিলা হেসে দিয়ে বললেন, ভালো।
মনে হয় ড্যান্সের মাধ্যমে কিছু বলা হচ্ছে।
এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বেশির ভাগ নৃত্যই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমনির্ভর।
রাধা কে?
রাধা এখানে জীবাত্মা। কৃষ্ণ পরমাত্মা।
বাস্তবে এঁরা ছিলেন না?
ছিলেন। তবে নৃত্যশিল্পে তাঁদের প্রেমকে ঐশ্বরিক উচ্চতা দেওয়া হয়েছে।
আধ্যাত্মিকতা?
ঠিক ধরেছেন।
হেলেন প্রাচ্যের সবকিছুতেই মুগ্ধ। এখানে এ নৃত্য তাঁর কাছে আরও বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। বললেন, কী অসাধারণ! এ নৃত্য যদি শেষ না হতো।
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, এ রকম আটটি নৃত্য দেখানো হবে। আট ফর্মে। সব কটিই ভালো লাগবে। সব কটিই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমনির্ভর।
রাধা-কৃষ্ণ?
চন্দ্রগুপ্ত রাধা-কৃষ্ণ এবং তাঁদের প্রেম সম্পর্কে হেলেনকে একটি ধারণা দিলেন। নৃত্যকলা সম্পর্কেও কিছু কথা বললেন। বললেন, ভারতীয় ঐতিহ্যে দেবতা শিব হচ্ছেন নটবর, নটরাজ |
তাঁকে দেখাবে না?
তিনি দেবরাজ জিউসের মতোই একজন দেবতা। তাঁকে দেখা যাবে না, তবে তাঁর নৃত্য শিল্পীদের কেউ মঞ্চে নিয়ে আসবেন।
আমার ইচ্ছা হচ্ছে আপনাকে নিয়ে এ রকম নৃত্য করি।
এসব নৃত্য শেখাটা শুরু হয় ছোটবেলা থেকে। সবাই সফল হয় না। আমি ক্ষমা চাই, পারব না, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো।
খুব কঠিন হবে।
চন্দ্রগুপ্ত বলতে চাইছিলেন, সম্ভবই নয়, কিন্তু বললেন না, বললেন, চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। তবে কষ্ট ও চেষ্টা করেও সবাই সফল হয় না।
মুদ্রাগুলো বেশ কঠিন। কী নাম এগুলোর?
চন্দ্রগুপ্ত নৃত্য দেখে দেখে হেলেনকে মুদ্রাগুলোর নাম বললেন, কর্ণ, বিস্ময়, অভয়, হরিণ, বরদ, করতরী, তর্জনী, বজ্র ঝংকার, কটকহস্ত, কটারলম্বিত, ক্ষেপণ, ভূতভীমর, তর্পণ, বিতর্ক, উত্তরাবোধি, অঞ্জলি, সূচি, নমস্কার, করিহস, চিন …
আপনি নৃত্য করতে জানেন, না হয় এত মুদ্ৰা মনে রেখেছেন কীভাবে?
চন্দ্রগুপ্ত হেসে দিয়ে বললেন, রাজাদের রাজপুত্রদের সবকিছুই জানতে হয়। তক্ষশীলায় রাজনীতির সঙ্গে চৌষট্টি কলা শিক্ষা দেওয়া হয়। আচার্য চাণক্য রাজনীতির দীক্ষা দিতেন, অন্য আচার্যরা চৌষট্টি কলা সম্পর্কে ধারণা দিতেন।
আপনার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর।
তাই বুঝি?
আপনাকে কোনো কিছুতে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
তোমার কাছে আমি হারতেই চাই হেলেন। এ পরাজয়ে গ্লানি নেই, আনন্দ আছে।
আমি যে কষ্ট পাব।
তা জানি।
কথক নৃত্য শেষ হয়েছে। ঘোষণা এল এবারে মঞ্চে আসছে ওডিসি নৃত্য
নৃত্য শুরু হলো। হেলেন বললেন, কথা ও ভাব আলাদা, কিন্তু মুদ্রাগুলো এক।
উৎস তো এক। ভরতনাট্যম। শাখাটা ভিন্ন।
সংগীতটাও আলাদা। ভাষা আলাদা।
তুমি সহজেই ধরতে পেরেছ।
শিল্পের ভাষাটা বোধগম্য। খুব ভালো লাগছে আমার। আপনি এদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেবেন।
কিছু তো পেয়ে আসছে।
হারমিজকে উদ্দেশ করে ভদ্রবাহু বললেন, এ নাচগুলো তোমাকে শিখতে হবে।
হারমিজ বলল, আমি শিখব, কিন্তু শেখাবে কে? উৎসবের পরই তো আমরা চলে যাচ্ছি। তোমার নানার জন্য আমরা যুদ্ধহস্তী পাঠানোর সময় প্রশিক্ষক পাঠিয়েছিলাম। তোমার জন্য একজন নৃত্যগুরু পাঠাব।
পাঠাবেন? সত্যি?
হ্যাঁ, পাঠাব।
মেগাস্থিনিসের ওডিসি নৃত্য আরও ভালো লাগছে। নৃত্যভঙ্গি এবং নিবেদনের বিষয়টা তাঁকে স্পর্শ করেছে। তিনি বললেন, শর্মিলা, নৃত্যে ভারতীয় মেয়েদের যে কমনীয়তা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আমি মুগ্ধ। কিন্তু আপনি সংসারী নন কেন?
আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
সরি, আমি দুঃখিত।
ভারতীয় মেয়েরা সুশীলা, নম্রভদ্র। তবে ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিবাদী। নৃত্যের নানা মুদ্রায়ও তার প্রকাশ আছে। আছে তর্জনী, বিতর্ক, বজ্রঝংকার।
ওসবকে আমি ভয় পাই। অঞ্জলি, নমস্কার, এসব ভালো লাগে। আমার স্ত্রী আমাকে ভক্তি করে না, গর্জন-তর্জন প্রায়ই লেগে থাকে।
বলেছি না ব্যক্তিগত কথা বলা যাবে না।
সরি, আমি দুঃখিত।
সব কটি নৃত্যই এরা দারুণ উপভোগ করেছেন। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান থেকে যাওয়ার কালে দিদাইমেইয়া বললেন, নৃত্যে ভারত শ্রেষ্ঠ।
দ্বিতীয় দিন উৎসব মঞ্চে মঞ্চায়িত হচ্ছে নাটক। নাটক রচনার চাইতে ভারতবর্ষ মহাকাব্য রচনায় বেশি এগিয়ে। জগতের বিখ্যাত দুটি মহাকাব্য রচিত হয়েছে কিছুকাল আগে মাত্ৰ। উৎসবে এ দুটি মহাকাব্যের অংশবিশেষ নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চে নিয়ে আসা হয়েছে। বাল্মীকি মুনির রামায়ণ থেকে সীতা অপহরণের অংশ নিয়ে রচিত হয়েছে লঙ্কাকাণ্ড এবং ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ অংশকে নাট্যরূপ দিয়ে বসন্ত উৎসবের মঞ্চে আনা হয়েছে। তবে উভয় নাটকে প্রচলিত ধ্যানধারণায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে জৈন পুরাণকে অনুসরণ করে। বিভিন্ন জৈন আগমে যেমন রবি সেনের পদ্মপুরাণে গল্পটা পদ্মমাজা এবং রামকে নিয়ে সাজানো। পদ্মমাজাই সীতা। জিনা চরিত্রে আচার্য ভদ্রবাহু যেমনটি বলেছেন তাতে বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা বলদেব এবং বাসুদেবকে পরাজিত করতে দেখা যায় না। এ দুই শক্তিশালী ভাই নয়বার চক্রাকারে পৃথিবীতে পুনর্জন্ম লাভ করেছেন বলে জৈন দর্শন মনে করে। রাম, লক্ষ্মণ এবং রাবণ এসেছেন আটবার। এখানে এরা বলদেব, বাসুদেব এবং প্রতিবাসুদেব হিসেবে আবির্ভূত। এই পরিবর্তনে দেখা যায় রাম রাবণকে হত্যা করেন না, যা বাল্মীকির মূল রামায়ণে রয়েছে, হত্যা করেছেন লক্ষ্মণ। জৈন পুরাণ মতে রাম মোক্ষলাভ করেছেন এবং রাবণকে দেখানো হয়েছে ভবিষ্যতের তীর্থঙ্কর হিসেবে। লক্ষ্মণ চতুর্থ নরকযন্ত্রণা ভোগের পর মুক্তি লাভ করে।
রাবণের সীতা অপহরণের মধ্যে প্যারিস কর্তৃক হেলেনকে অপহরণের গল্পটা মনে এল সব গ্রিক দর্শকেরই। দিদাইমেইয়া ভদ্ৰবাহুকে বললেন, আপনার শাস্ত্রকথা তেমন বুঝি নি, কিন্তু সীতা অপহরণের দৃশ্যটা বেশ উপভোগ করেছি, কারণ, এমন ঘটনা হোমারের ইলিয়াডে আছে। সীতার মতো হেলেনও পরস্ত্রী। তাকে নিয়ে প্যারিস পালিয়ে যায়। কাজটা মন্দ, কিন্তু প্রেমের কথা ভাবলে ক্ষমা করে দিতে হয়। রাবণ যে কাজটা করেছেন, তা ধর্মীয় এবং সামাজিক বিচারে নিন্দনীয়। কিন্তু শূর্পনখার রামকে দেখে যে কামার্তি, এটি বন্য হলেও মানবীয় বলেই রাম কর্তৃক তার নাক কেটে নেওয়ার প্রতিশোধে সীতা অপহরণ দুষ্কর্মের মধ্যে পড়ে না।
আমিও রাবণকে ক্ষমা করেছি ওই একই কথা মনে রেখে। তার মধ্যে কামভাব জেগেছিল কি না, তা বিতর্কের বিষয়। আর তাই তা বসন্ত উৎসবের নাটকীয় উপাদান হতে পেরেছে বাকিটা আচার্য চাণক্য বলতে পারবেন, বললেন ভদ্রবাহু।
দিদাইমেইয়া আচার্য চাণক্যের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। চাণক্য বললেন, বাল্মীকি মানুষের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে গুরুত্ব দিয়ে মহাকাব্যের যবনিকাপাত ঘটিয়েছেন। ‘জিনাচরিত’ এক ভিন্ন জিনিস। এখানে নামিবোধ মূল্যবোধের পরিবর্তনকে সমর্থন দেয়। আচার্য ভদ্ৰবাহু যখন গ্রন্থটি রচনা করেন, আমার সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন-বিজ্ঞান হাত-ধরাধরি করে চলেছে এবং যৌক্তিক মানবিক বোধ প্রচলিত মূল্যবোধকে ছাড়িয়ে গেছে।
দিদাইমেইয়া কিছু বুঝে কিছু না বুঝে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে আবার নাটক দেখায় মনোযোগী হলেন।
নাটকে একই ঘটনা দেখে মেগাস্থিনিসেরও ইলিয়াডের কথা মনে হলো এবং পাশাপাশি শর্মিলাকে হেলেনের ভূমিকায় রেখে নিজেকে প্যারিস ভেবে উভয়ের পলায়নের বিষয়টি কল্পনা করতে থাকলেন। শর্মিলা দেখলেন, মেগাস্থিনিস নাটক না দেখে গভীরভাবে কী যেন ভাবছেন।
আপনার বোধ হয় নাটক ভালো লাগছে না।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে মেগাস্থিনিস বললেন, না না, ভালো লাগছে। সীতা অপহরণের সঙ্গে হেলেনের অপহরণের মিল আছে।
হেলেন?
মেগাস্থিনিস হেসে দিয়ে বললেন, এই হেলেন না, ইলিয়াড মহাকাব্যের হেলেন। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস তাকে হরণ করেছিল, ঠিক অপহরণ নয়, দুজনই পালিয়ে গিয়েছিল।
তাই বলুন। আমাদের সম্রাট আপনাদের হেলেনকে অপহরণ করেন নি। ভালোবেসেই পরস্পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কে আগে ভালোবেসেছিল?
আমি জানি না।
মেগাস্থিনিস চাপা নিঃশ্বাস ফেলে স্বগতভাবে বললেন, আপনি অনেক কিছুই জানেন না।
কী বললেন?
না, কিছু না।
সম্রাজ্ঞী হেলেনও এ অংশটি দেখে ইলিয়াড মহাকাব্যে ফিরে গেলেন। সম্রাটকে বললেন, আমি যদি সম্মত না হতাম, আমাকে কি অপহরণ করতেন?
করা উচিত হতো।
কী?
তবে আমি তা করতাম না। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, তোমার দেহকে নয়। আমি বসন্ত উৎসবের কামাত্মক অনুভূতিকে কখনোই ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি না। ভারতীয় ঐতিহ্যের এ ধারা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে আচার্য ভদ্রবাহু ব্যাপারটাকে ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁর জৈন কাব্যে বিষয়টা অন্যভাবে এসেছে, বলে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা ও তুলনা করে বুঝিয়ে দিলেন চন্দ্রগুপ্ত। বললেন, শূর্পণখা সুদর্শন রাজপুত্র রামকে জঙ্গলের মধ্যে একা দেখে প্রেমে পড়তেই পারে। তার নাসিকা কর্তন তাই কোনো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। সে হতে পারে রাক্ষসনন্দিনী, রাজভগিনী তো। এ ছাড়া বনবাসী মানুষদের রাক্ষস ভাববার কারণটা কি মানবিক? কেউ না কেউ ভবিষ্যতে নান্দনিক সাহিত্যেই এ প্রশ্ন তুলবে।
তাহলে মানুষদের কারা রাক্ষস বানাল?
মানুষেরা। ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা
তারপরও এরা মোক্ষ লাভ করছে?
সেটি অপরাধবোধ থেকে অনুশোচনার পর কিংবা নরকযন্ত্রণার পর। মানুষের সংশোধনের পর তার একটা ভালো উত্তরণ থাকে। ঋষিরা মোক্ষের কথাই ভেবেছেন।
ভারতীয় ঋষিরা মহানুভব ও ক্ষমাশীল।
এই যে চারদিকে এত কাণ্ড ঘটছে, কোনো কিছুতেই মন নেই লাউডিসের। কিউকেকাস নেই, যেন তাঁর আনন্দও নেই। কী দিব্যি হাসছেন, আনন্দ করছেন হেলেন আর চন্দ্রগুপ্ত এবং নিকোমেডেস আর ফাওলিন। এই আনন্দের মধ্যে তাঁর বিরহ যেন দীর্ঘতর হচ্ছে। মাকে চুপচাপ এবং গম্ভীর দেখে হারমিজেরও ভালো লাগছে না। আগের দিনের নৃত্য ভালো লেগেছিল। আজকের সীতা অপহরণ কিংবা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কোনোটাই ভালো লাগে নি তার। মাকে মুখ গোমরা করে থাকতে দেখে তার মন আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু কিছু বলছে না সে।
নিকোমেডেসরা এক ফাঁকে বের হয়ে গেছে। নাট্যশালায় আবদ্ধ থাকতে চায় না এরা। বসন্তের বাতাসে ছুটে বেড়াতে চায়। তাই সোজা চলে গেছে ফুলবাগান ছাড়িয়ে বৃক্ষ উদ্যানে। সেখানে গাছতলায় যারা আছে, সবাই তাদের মতো। তাদের দেখে ওদের কৌতূহল। ওদের দেখে তাদের। তাদের পেছন পেছন অবশ্য সম্রাটের প্রহরীরা গেছে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।
এরা একটি সরোবরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সীতার মতো তুমি আমাকে মিসর থেকে অপহরণ করে নিয়ে এলে, বলল ফাওলিন।
ভুল বলেছ তুমি, আমি রাবণ নই, বড়জোর প্যারিস। তবে আমি তোমাকে নিয়ে পালাই নি, তুমি নিজেই চলে এসেছ। এ ছাড়া তুমি অন্য কারও স্ত্রী নও।
তাহলে আমি কালই চলে যাই?
যাবে? যাও।
কী!
তুমি যেতে চাইলে আমি বাধা দিতে পারি না। তাহলে তুমি আমাকে রাবণ ভাবতে শুরু করবে।
এত দিনে তোমার এই উপলব্ধি? তুমি এখানে থাকো, অন্য কাউকে খুঁজে নাও, আমি
চললাম।
নিকোমেডেস ফাওলিনকে থামাল। বলল, তুমি মজা করাটাও বুঝলে না?
সরোবরে একজোড়া রাজহাঁস পদ্মফুলের আড়ালে জৈবিক কর্ম সেরে নিচ্ছে। নিকোমেডেস বলল, দেখো দেখো, সত্যিকার অর্থে ওরাই বসন্ত উৎসব পালন করে নিচ্ছে।
ধ্যাৎ, পাজি কোথাকার, বলল ফাওলিন।
নাটক শেষ হয়েছে। মেগাস্থিনিস ও শর্মিলাও এখানে আসছেন। ফাওলিন বলল, এ্যাই, দেখো দেখো, কারা আসছে।
তাই তো, ব্যাপার কী?
সামনে যেয়ো না, কী করছে দেখো। কুঞ্জবনে আসবে কেন এরা?
মেগাস্থিনিস ও শর্মিলা একটা বড় পাথরে পাশাপাশি বসলেন। মেগাস্থিনিস ভেবে পেলেন না কী বলবেন।
শর্মিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ধারণ করে বললেন, দূতপ্রবর বোধ হয় পরিবার-পরিজনের কথা ভাবছেন।
পরিজনের কথাই ভাবছি।
পরিবারে কে কে আছেন?
কেউ নেই।
কেউ নেই মানে?
কেউ নেই।
এই যে বললেন পরিজনের কথা ভাবছেন।
পরিবারের কথা তো বলি নি।
আচ্ছা। তাহলে পরিজনটা কে?
মেগাস্থিনিস এ কথার জবাব না দিয়ে হঠাৎই বললেন, আপনি কি এখানে আমার দোভাষী এবং গাইড হতে সম্মত আছেন?
আপনার তো দোভাষী আছেন।
ওর চাইতে আপনি ভালো হবেন।
তাই? একটু ভাববার ভান করে শর্মিলা আবার বললেন, আমার তো সময় হবে না, আপনি চাইলে অন্য কাউকে খুঁজে দিতে পারি। আর আমরা সন্ন্যাসীরা এ রকম কাজ করতেও পারি না।
এ রকম স্বল্প সময়ের জন্যও আপনাকে পাওয়া যাবে না?
কদাচিৎ।
দূরে ফাওলিন আর নিকোমেডেসের কৌতূহল বাড়ছে। ফাওলিন বলল, এ সন্ন্যাসিনীর প্রেমে সবাই পড়ে কেন?
সবাই মানে?
ওকে নিয়ে তুমি এ কুঞ্জে কতবার এসেছ?
দুঃখিত, সুযোগ হয় নি। কারণ, এখানে আসার মতো অবস্থায় আমরা ছিলাম না। তোমার শুভার্থী মহামন্ত্ৰী চাণক্য আমি ও কর্নেলিয়াকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন।
তার অর্থ, সুযোগ পেলে তুমি আসতে?
এখন কী করে বলব?
মজা করছ, না?
আগে দেখো ওরা কী করছে। আমি তো চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
ঈর্ষা হচ্ছে, না?
এটা একান্তই তোমাদের জন্য সংরক্ষিত।
পাজি কোথাকার।