৮৭
বসন্ত উৎসব ভারতীয় ঐতিহ্যে এক আনন্দঘন উৎসব। এ উৎসব নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। নানা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে কালে কালে বাঁক পরিবর্তন করেছে। তীর্থঙ্কর মহাবীর চৈত্রদিনের কোনো এক পূর্ণিমারাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তা ছিল বসন্তেরই কোনো এক পূর্ণিমারাত। কল্পসূত্র সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে। জৈনাচার্য ভদ্রবাহু সে দৃষ্টিকোণ থেকে বসন্ত উৎসবের গুরুত্বকে মূল্যায়ন করতে চান। বসন্ত উৎসবের রাজকীয় যে অনুষ্ঠান, তা জৈন ধর্মানুভূতির আবেগকে ধারণ করে, যদিও এতে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ রয়েছে।
আচার্য চাণক্য পৌরাণিক চিন্তার দিক থেকে বসন্ত উৎসবের মর্মানুধাবনে বিশ্বাসী। বৈদিক সংস্কৃতি কিংবা লৌকিক জনজীবনে পৌরাণিক প্রভাব বসন্ত উৎসবেও পরিলক্ষিত হয়। চাণক্য হাসি হাসি মুখে আচার্য ভদ্রবাহুর উদ্দেশে বললেন, আচার্য, অথর্ববেদ বলছে, কাম হচ্ছে যৌন ভালোবাসার ঈশ্বর। কাম মানে কামদেব। যেমন গ্রিক পুরাণের ইরোস, রোমানদের কিউপিড। কিউপিডের কথা তো আপনিও বলেছেন কল্পসূত্রে। সেখানে কাম বাহুর তির ও ধনুক, সে ধনুক ইক্ষু নির্মিত, তার রজ্জু মৌমাছি, ফলাগুলো ফুল। এর বাহন টিয়ে। তার ব্যানারে আঁকা রয়েছে একটি মৎস্যচিত্র।
কাম ভারতীয় বসন্ত উৎসবের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভবিষ্যপুরাণে আছে, শিব ও কামদেবের দ্বন্দ্বযুদ্ধে কামদেবের জয় সূচিত হয়েছে। বসন্ত উৎসব তাই কামদেবের উৎসব হয়ে গেছে। বুঝলেন আচার্য, উৎসবে নারী-পুরুষ তাঁর পূজা করে পরস্পরের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য। বসন্ত উৎসবে তাই জোড়ায় জোড়ায় তাদের উপস্থিতি চোখে পড়ে।
ভদ্রবাহু নিকোমেডেস ও ফাওলিনকে দেখিয়ে বললেন, এবারের বসন্ত উৎসব তাদের জন্য। পুণ্ড্রবর্ধন, বঙ্গ, উড়িষ্যা ও মিথিলায় বসন্ত বাতাস যেন শ্রীকৃষ্ণ আর গোপীবালাদের অনুরাগের রং ছড়ায়। আমাদের ‘কথাকোষে’র রাজপুত্র সনদকুমার পূর্ণচন্দ্র ফাল্গুন-চৈত্রের বসন্ত উৎসবে প্রমত্ত হয়। এ উৎসবে সারা দেশ থেকে আসা প্রণয়-উমত্তদের মেলা বসে। ‘আমবেলা’ রাজকুমারী ময়না সুন্দরীর সিদ্ধিচক্র।
কিন্তু রাজা সাগরচন্দ্রের এ কন্যা তো সুখী বৈবাহিক জীবনই চেয়েছিলেন, বললেন আচার্য চাণক্য।
বৈবাহিক সূত্রে পুত্রবধূ হতেন। কতগুলো বসন্ত এবং বসন্ত উৎসব তাঁকে এলোমেলো করে দিল। কামদেবতা তাঁকে মুক্তি দিলেন।
তা জীবনবাদ নয়।
আচার্য, তা জীবনবাদই, ভোগবাদ নয়, বলে হাসলেন আচার্য ভদ্রবাহু
আপনার কথা মানতেই হয়। জানেন তো এবারের বসন্ত উৎসব আমাদের সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীর জন্যও প্রথম বসন্ত উৎসব।
তাঁদের উৎসব উদযাপনের পরিকল্পনা কী, জানতে পারলে ভালো হতো। তা জানাবে নিকোমেডেস।
নিকোমেডেস বলল, কামদেব মদনের কথা শুনলাম। মানবজীবনে তার প্রভাব আছে বুঝলাম। জীবনের আরও দুটো সময় আছে, যা দুজন আচার্য পার করে এসেছেন আর যারা শিশু- কিশোর, তাদের আনন্দটা অমলিন। এ দুটো বয়সের বিভ্রান্তি নেই তো বসন্ত উৎসবে?
বুদ্ধিদীপ্ত কথা নিকোমেডেসের, বললেন ভদ্রবাহু
যারা বিগতযৌবন, এরা যৌবনের কথা রোমন্থন করবেন এ উৎসবে।
আচার্য তাই করছেন, বললেন ভদ্রবাহু।
আচার্য চাণক্য বললেন, মিসর ও গ্রীসে এ উৎসব কীভাবে পালন করা হয়?
এ সময় দিদাইমেইয়া ও লাউডিস তাঁর মেয়ে হারমিজকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। দিদাইমেইয়া বললেন, কোন উৎসব?
ভদ্রবাহু বললেন, আপনি এসেছেন, ভালোই হয়েছে। আমরা বসন্ত উৎসব নিয়ে কথা বলছিলাম।
গ্রিসেরটা আমি বলতে পারি।
তাই বলুন।
অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটা হয় বসন্ত উৎসবকালে। দেবরাজ জিউসের জন্য এ প্রতিযোগিতা। আর পাইথিয়ান ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটা হয় ডেলফিতে দেবতা অ্যাপোলোর সম্মানে। আমরাই এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করি, সেলুসিয়ায় শুধু এ প্রতিযোগিতাটাই হয়। বসন্ত উৎসবকে রাঙিয়ে তোলা হয় গ্রিক রমণীদের রঙিন সাজসজ্জায়। মাঠে কিংবা ক্রীড়া শেষে তাদের নাচ-গান বসন্ত উৎসবকে আরও হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। দিনটা আসলে উপভোগেরই।
একটি উৎসব হয় এথেন্সে দেবতা ডায়োনিসেসের সম্মানে। এখানে হয় নাট্য প্রতিযোগিতা। গ্রিক ভাষার সেরা নাটকগুলো এ প্রতিযোগিতায় মঞ্চস্থ হয়, বলে একটু থামলেন লাউডিস। পরে আবার বললেন, নাট্যপাগল গ্রিকরা জড়ো হয় উৎসবকেন্দ্র সিটি ডায়োনিসিয়ায়।
কাদের নাটক প্রতিযোগিতায় আসে, ভদ্রবাহুর প্রশ্নের জবাবে দিদাইমেইয়া বললেন, ইস্কিলাস, সফোক্লিস ও ইউরিপিদেশের ট্র্যাজিডি/নাটকগুলোই বেশি মঞ্চস্থ হয়। গ্রিকরা দুঃখ বিলাসী জাতি, ট্র্যাজেডিতে নায়ক-নায়িকার বিয়োগান্তক পরিণতি দেখে কান্নাকাটি করে। তবে এরিস্টোফেনের কমেডিও প্রতিযোগিতায় আসে। নাটকের শুরুতে গীতবাদ্য হয়। অর্কেস্ট্রা বাজায় নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীরা। গ্রিক নাটকের কেন্দ্রে থাকে কোরাস বা দলবদ্ধ সংগীত। কোরাস বিবেকের কাজ করে। গান করে এরা নাটকের নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়।
ভদ্রবাহু বললেন, আমরা গ্রিক নাটক দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
কীভাবে দেখবে তোমরা? এথেন্সে যেতে হবে, বলল হারমিজ।
আমাদের নেবে না তুমি, বললেন চাণক্য।
আগামী বসন্তে এসো। তবে গ্রিসে যাবে কী করে? সেলুসিয়ায় যেতে পারো।
দিদাইমেইয়া বললেন, না না, গ্রিসে যেতে কোনো অসুবিধে নেই। আমি নিয়ে যাব।
নিকোমেডেস আর ফাওলিন অভিনয় করে দেখাবে, বললেন ভদ্ৰবাহু।
আমি অভিনয় পারি, বলে অভিনয় করার অনুমতি চাইল হারমিজ। সে প্রথমে ডায়োনিসেসের উদ্দেশে প্রণতি জানিয়ে কিছু সংলাপ উচ্চারণ করে মুগ্ধ করে দিল সবাইকে।
চাণক্য বললেন, ভাবতে ভালো লাগছে, নাটকের মতো উপচার দিয়ে দেবতার আরাধনা করা হয় সেখানে।
নিকোমেডেস বলল, মিসরীয়রাও বসন্ত উৎসবটি পালন করে গৌরবের সঙ্গে। উৎসবটিকে ওরা বলে ‘শ্যাম এল নেসিম’। ওরা উৎসবের চিত্রগুলো এঁকে রাখে পিড়ামিডগুলোর দেয়াল ও স্তম্ভে। আচর্য ভদ্রবাহু বললেন, চমৎকার তো। কিসের চিত্র আঁকে ওরা? উৎসবটার মূলে কী আছে, চিত্রাঙ্কন?
নিকোমেডেস বলল, খুব ভোরে ওঠে ওরা পরস্পরের প্রতি পানি ছিটিয়ে স্নান সমাপন করে। এই পানি ছিটানোটা উৎসবে রূপ নেয়। এ কাজটি ওরা এখনো করে। পিরামিডগুলোর দেয়াল ও স্তম্ভচিত্রে বসন্তনৃত্য, ফসল তোলা, ছাতার নিচে দলবদ্ধ শোভাযাত্রা ও স্ফিংসের মূর্তি স্থাপনের দৃশ্য বিদ্যমান।
এখনো উৎসবটি হয়। আমি নৃত্যানুষ্ঠান এবং নিকোসহ ছত্রশোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছি, বলল ফাওলিন। সে সময় আরেকটি ব্যাপার ছিল, যা এখনো আছে। তারা তাদের উপাস্য দেবতাদের লবণাক্ত মাছ, লেটুসপাতা ও পেঁয়াজ উৎসর্গ করে, যোগ করল সে।
নিকোমেডেস বলল, ‘শ্যাম এল, নেসিম’ উৎসবের প্রাচীন যে চিত্রগুলো প্রতিনিধিত্ব করে এগুলোর একটি বসন্ত ফুলভারে সজ্জিত বৃক্ষ থেকে বের হয়ে আসা বসন্ত দেবীর মূর্তি, যিনি দুজন নরনারীকে বর হিসেবে উপহারের ঢালি দিচ্ছেন।
ভদ্রবাহু বললেন, অদ্ভুত তো, নিশ্চয় তিনি মিসরীয়দের প্রেমেরও দেবী। প্রেমের ঋতু বসন্ত সব দেশেই। আর কী কী চিত্র আছে?
বসন্ত উৎসব শিরোনামে একটি দুর্বোধ্য চিত্র আছে। একটি সুন্দর পাখি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে চোখসর্বস্ব একটি ইমেজের দিকে, বোঝা যাচ্ছে না শিল্পী কী বলতে রংরেখার এত চমৎকার ব্যবহার করেছেন, যা আপনাকে মুহূর্তের মধ্যে ভাবে ডুবিয়ে দেবে।
সম্ভবত এরা গ্রিকদের নাট্য প্রতিযোগিতার মতো চিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন করত বসন্ত উৎসবে। বললেন চাণক্য। ভদ্রবাহু বললেন, প্রতিযোগিতা না হলেও উৎসবের অঙ্গ ছিল চিত্রাঙ্কন।
দিদাইমেইয়া বললেন, তাই হবে। কিন্তু আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে ভারতবর্ষের বসন্ত উৎসবে কামদেবের উপস্থিতি।
ভদ্ৰবাহু বললেন, কেন, কেন?
দেবতার উপাসনায় ব্যাপারটা আসছে।
চাণক্য হেসে দিয়ে বললেন, গ্রিক বলুন আর ভারতীয় পুরাণ বলুন, এই যে দেবতাদের এত সন্তানাদি হয়েছে, তা কামভাব থেকেই হয়েছে। এটা জীবনের একটা অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমাদের দেশে বাসররাতে ফুলসজ্জা হয়। ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলা হয় বাসরগৃহ—যেন বসন্ত উৎসব। বন্য প্রাণিকুল, পাখিকুল, অলিকুল—সবাই এ উৎসবে মত্ত হয়। আমাদের ঋষিজনেরা যা ভেবেছেন, প্রচলন করেছেন, বাস্তবের সঙ্গে সংগতি রেখেই করেছেন।
এবারের উৎসবে কী কী থাকছে?
মহাভারত ও রামায়ণের অংশ নিয়ে নাটক। মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব, দ্রৌপদী, রামায়ণে রাম- সীতা এবং নারদপুরাণের রতিকামভরতের বিশেষ বিশেষ অংশ নিয়ে মঞ্চে আসবে অভিনেতা- অভিনেত্রীরা। মহোৎসবের আরেকটা ব্যাপার আছে।
তা-ও নিশ্চয়ই প্রেম ও কামজ?
প্ৰচ্ছন্ন।
এদিকে হেলেন ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পীদের নিয়ে বসেছেন। উদ্দেশ্য, তাঁর পরিকল্পনামতো তাদের প্রস্তুতি কতখানি, তা যাচাই করা। ডেকেছেন নিখিলকেও। ব্যাপারটা জানেন শুধু সম্রাট আর সুবন্ধু। সুবন্ধু উৎসবের মূল দায়িত্ব পালন করছেন।