৮৬
চাণক্যের গোয়েন্দা হরিবালা মেগাস্থিনিসের পেছনে লেগেছে। চাণক্য যখন জানতে পারলেন, শর্মিলার প্রতি মেগাস্থিনিসের দুর্বলতা আছে, সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী হরিবালাকে নিয়োগ দিয়ে দিলেন। সম্রাটের পক্ষ থেকে সেবা-যত্নের জন্য সঞ্চার শ্রেণির এই গুপ্তচর মেগাস্থিনিসের গতিবিধি, কার সঙ্গে মেলামেশা করেন, কী খান, কী পছন্দ করেন প্রভৃতি বিষয়ে মহামন্ত্রীকে অবহিত করবে। তবে তার তথ্যই চূড়ান্ত নয়, আরও দুজন গুপ্তচর আছে, একজন বৃষলী, অপরজন কামশাস্ত্র নিপুণ সত্রী। প্রথমে ভেবেছিলেন পরিব্রাজিকা শ্রেণির কাউকে দেবেন, পরে মত পরিবর্তন করেছেন। বৃষলী ও সত্রী অবশ্য কারও নাম নয়, গুপ্তচর শ্রেণির নাম।
সর্বক্ষেত্রেই যেকোনো বিষয়ে তিনজন গুপ্তচরের তথ্যের প্রয়োজন হয়। তিনজনের তথ্য এক না হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না (অর্থশাস্ত্র)। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কোনো অবস্থায়ই মেগাস্থিনিসকে হত্যা করা যাবে না। অন্য কেউ হত্যা করতে চাইলে রক্ষা করতে হবে। শুধু তাঁর কর্ম-দুষ্কর্মের খোঁজখবর দিতে হবে।
হরিবালা মেগাস্থিনিসের পাশ দিয়ে চলে গেল। বাতাসে সুগন্ধ তখন। ঠিক যেন চিতা সুন্দরী যাচ্ছে চিতা সুন্দরের গা ঘেঁষে। হরিবালার এ চেষ্টা ব্যর্থ। কামশাস্ত্র নিপুণা সত্রী প্রথম চেষ্টায়ই সফল হয়ে গেছে। তবে মেগাস্থিনিসকে সে কাবু করতে পারে নি। তাই গেছে দোভাষীর কাছে।
সত্রী দোভাষীকে ইশারায় ডাকে। সত্রী দূতপ্রবরের সঙ্গে কথা বলতে চায়।
উদ্দেশ্য কী?
পরিচিত হওয়া।
তোমার কী লাভ?
আমার লাভ নেই। চাইলে আমি তাকে গণিকাধ্যক্ষের কাছে নিয়ে যেতে পারি। ভালো সম্ভোগসঙ্গীর ব্যবস্থা করতে পারি। পরে বাঁকা হাসি হেসে বলে, তোমারও স্বাদ পূরণ হবে গো।
দোভাষী ইঙ্গিতটা বুঝতে পারে। সে তাকে দূতপ্রবরের কাছে নিয়ে যায়। বলে, এই মেয়ে চাণক্যের বিরোধী। আপনার সম্পর্কে চাণক্য যা বলে, তা আপনাকে জানাতে চায়। আমার মনে হয় তাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি।
গ্রিক দূতেরও একজন বিশ্বস্ত গোয়েন্দা দরকার। তিনি আসার পর থেকে শীর্ষ পর্যায়ের খোঁজখবর রাখার জন্য এমন একজনকেই খুঁজছিলেন।
দোভাষীকে বললেন, তুমি তাকে ভালোভাবে চেনো?
চিনি।
কত দিন যাবৎ?
অনেক দিন যাবৎ। শীর্ষ মহলে তার যাতায়াত আছে।
আচ্ছা। সত্রী, তুমি আমার হয়ে কাজ করবে। আমি তোমাকে স্বর্ণমুদ্রা দেব।
সত্রী বলল, আমার সৌভাগ্য। তবে কাজ করতে হবে অত্যন্ত গোপনে, না হয় মৃত্যু অনিবার্য।
তুমি তোমাকে রক্ষা করে কাজ করবে।
মহামন্ত্রী বলছিলেন আপনি উল্টো পায়ের লোকদের পল্লিতে গিয়েছিলেন, তার জন্য মুদ্রাধ্যক্ষকে বলে আপনার মোহরযুক্ত অনুমতিপত্র বাতিল করে দেন।
দোভাষী কথা শুনে আতকে উঠল। সত্য নাকি? বলল সে।
আরে বোকা, সত্য নয়। তবু তুমি বলো।
দোভাষী তা-ই বলল মেগাস্থিনিসকে। এবার মেগাস্থিনিসের আঁতকে ওঠার কথা। কিন্তু তিনি ধীরস্থিরভাবে সে আমাকে অপছন্দ করে ঠিক, কিন্তু এতটা নিচে সে নামবে না। আমি সেখানে গেছি, এ আর গোপন কিছু নয়, সম্রাটকে বলব যেন ওদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা হয়।
দোভাষী বলল, না মহাশয়, এ কাজ আপনি করবেন না, বড় ঝামেলায় জড়িয়ে যাবেন।
সত্রী তাদের কথোপকথনের কিছুই বুঝল না। একবার মেগাস্থিনিসের দিকে, আরেকবার দোভাষীর দিকে তাকাল এবং মনে মনে বলল, আমার কাজ হয়ে গেছে।
এখানে আসা অবধি মেগাস্থিনিস একটা সমস্যায় আছেন। তাঁর ইচ্ছেমতো সুরার সরবরাহ পাচ্ছেন না। সুরার উৎপাদন ও বিপণনের দায়িত্বে নিয়োজিত সুরাধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কাজ হয় নি। সঙ্গে যা এনেছিলেন, তা-ও শেষ হয়ে গেছে। সত্রী তাঁকে পরামর্শ দিল, আপনি সুরাধ্যক্ষ বরাবরে একটি আবেদন করুন। আমি তা মঞ্জুর করিয়ে দেব।
মেগাস্থিনিস এতে খুব সন্তুষ্ট হলেন। সত্রীর প্রতি তাঁর বিশ্বাস ও নির্ভরতা অতিমাত্রায় বেড়ে গেল।
এদিকে হরিবালা দ্বিতীয় চেষ্টা হিসেবে শর্মিলার কাছে এসেছে। সে জানে, এখানে মেগাস্থিনিসের যাতায়াত আছে। শর্মিলা হরিবালাকে বললেন, আমি তোমার সঙ্গে মেগাস্থিনিসের আলাপ করিয়ে দেব। দোভাষী হিসেবেও কাজ করব। কিন্তু অনৈতিক কাজের সঙ্গে আমি থাকব না। আমি চাইব এমন কাজে তুমি আমাকে জড়াবে না।
আমি সাম্রাজ্যের পক্ষে কাজ করি। সাম্রাজ্যের স্বার্থটা আমাদের মাথায় রাখতে হয়।
তা ঠিক আছে। কিন্তু এমন কাজও করা যাবে না, যা নৈতিকতা বা আইনের পরিপন্থী। এ ছাড়া আমি আমার ভাবমূর্তি ও আদর্শ নষ্ট করতে পারি না।
আমি তা জানি। আপনার কথা মনে রাখব।
বৃষলী গেছে গাইডের কাছে, যারা দূতপ্রবরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। শূদ্রবালা বলে দোভাষীর কাছে পাত্তা পায় নি। বৃষলী শুরুতেই কান্নাকাটি শুরু করে দিল। কেঁদেকেটে একেবারে অসার।
লোকটির হৃদয়ে মায়া আছে। বৃষলীর অভিনয় বুঝতে পারল না, বলল, আহা, কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিস কেন? উল্টো পায়ের লোকদের পাহাড়ি পল্লিতে ওর সঙ্গে আমিও গেছি। তবে আমি ‘ওদের’ মুখ দর্শন করি নি।
তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে এ কথা বলবে তো?
কার কাছে?
মন্ত্রীর কাছে।
ওরে, বাবারে, তা সম্ভব নয়।
বৃষলী আবার কাঁদতে শুরু করে।
কী যন্ত্রণা! আচ্ছা, আমি যাব। তুই কান্না থামা
সম্রাটের সভায় প্রাত্যহিক কাজ শেষ হয়েছে। তিনি এখন খোশগল্প করছেন। আজ সম্রাট মজা করছেন মেগাস্থিনিসকে নিয়ে। মেগাস্থিনিসের কৌতূহলের বিষয়গুলো বেশ উপভোগ করছেন। আচার্য ভদ্রবাহু উপস্থিত আছেন। মহামন্ত্রী চাণক্যের এসব তেমন ভালো লাগছে না। তাঁর কাছে মেগাস্থিনিসের কথাবার্তা বালখিল্য ধরনের মনে হয়। রাজনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক কিংবা অর্থনীতি নিয়ে কথা নেই, চিন্তাধর্মী আলোচনা নেই, সবই হালকা ধরনের চিন্তা ও বিষয়াদি নিয়ে কথাবার্তা। গোয়েন্দাদের কথায় আরও খেপে আছেন চাণক্য।
মেগাস্থিনিস হিরের কয়েকটি নাম লিখে নিয়ে এসেছেন। সম্রাটকে এসব নাম বলছিলেন কিছুটা বিকৃত উচ্চারণে। যেমন মার্জারাক্ষসকে (বেড়াল চোখ) মাজারখস, শিরীষপুষ্পকে (শিরীষফুল) শিরিপুসক, গোমেদককে (গোরোচন) গোদক, মুলাটি পুষ্পকে (মুলাফুল) মুলপুসক ও শুদ্ধ স্ফটিককে শুদসটিক বলছিলেন। আর সম্রাট ও রাজসভাসদেরা হাসাহাসি করছিলেন।
একটু হেসে নিয়ে সম্রাট বললেন, আমাদের মহামন্ত্রী পণ্ডিত ব্যক্তি, আপনি তাঁর কাছে ভাষা শিখতে পারেন।
মহামান্য সম্রাট, এ দায়িত্বটা আপনি আচার্য ভদ্রবাহুকে দিন। তিনি শিষ্যকে মানুষ করে তুলতে পারেন।
মেগাস্থিনিস এসব কথা না বুঝে সম্রাটের উদ্দেশে বললেন, সিলবস্ (সিল্কবস্ত্র) আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
ভদ্রবাহু বললেন, কোন সিল্ক?
সব কটিই। বাঙ্গক (বঙ্গদেশ), পুণ্ড্রদেশ (মরকত মণির মতো মসৃণ), সুবর্ণকুড্যা (কামরূপ, উদিত সূর্যের মতো উজ্জ্বল), কীটের লালা থেকে উৎপন্ন পৌণ্ড্রিকা ও সৌবর্ণকুড্যকা। এগুলো উচ্চারণ শুনে আবার সবাই হাসলেন। সবশেষে মেগাস্থিনিস বললেন, সমরাট সান্দ্রোকোটটাস গ্রেট সমরাট। তাঁর শাসন ইজিপ্টের ফারাওদের মতো, সুশৃঙ্খল।
মেগাস্থিনিস যে চন্দ্রগুপ্তেরই প্রশংসা করছেন, নাম শুনে তা বুঝবার উপায় নেই। যখন সম্রাট বুঝতে পারলেন, খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। সব অমাত্যেরও হাসি থেমে গেল। কিছুক্ষণ পর সম্রাট আবার উচ্চহাস্য করলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে অমাত্যরাও।
মেগাস্থিনিস তা দেখে বললেন, ভারতীয়রা হাস্যপ্রিয় জাতি। তা প্রমাণ করে এখানে সবাই সুখী।
মেগাস্থিনিসসহ অন্য সভাসদেরা চলে গেলে আচার্য ভদ্রবাহুও উঠে যাচ্ছিলেন। মহামন্ত্রী বললেন, আচার্য, আপনি বসুন। চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যের দিকে তাকালেন। মহামন্ত্রী বললেন, মহামান্য সম্রাট, গতকাল গুপ্তচরেরা একটি তথ্য দিয়েছে, যা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।
চাণক্যের ভূমিকা শুনে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন দুজন। তিনি বললেন, গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস সব কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে উল্টো পায়ের লোকদের পল্লিতে গিয়েছিলেন।
তাকে এসব ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয় নি?
সম্রাটের প্রশ্নের জবাবে চাণক্য বললেন, বিদেশিদের দেওয়া মোহরযুক্ত অনুমতিপত্রেই তার উল্লেখ আছে। এ ছাড়া মুদ্রাধ্যক্ষ বিদেশিদের কী করা অনুচিত, তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন।
ভদ্রবাহু বললেন, এসব স্পর্শকাতর বিষয়ে খুবই কড়াকড়ি আরোপ করা উচিত।
সম্রাট বললেন, ব্যাপারটা আমি দেখছি। আমার মনে হয় কৌতূহলবশত তা তিনি করেছেন, উদ্দেশ্য খারাপ নয়।
তবু শক্তভাবে না দেখলে অন্য বিদেশিরাও নিয়ম লঙ্ঘন করতে পারে। মহামন্ত্রীর আশঙ্কা অমূলক নয়, এ রকম মত প্রকাশ করলেন ভদ্রবাহু।
সম্রাট বললেন, মুদ্রাধ্যক্ষ ও বিদেশিদের তত্ত্বাবধায়ককে ডেকে আনা হোক।
পাটালিপুত্র নগরের নানা দায়িত্ব পালন করে ছয়টি বিভাগের পাঁচজন করে ত্রিশজন কর্মকর্তা- কর্মচারী। দ্বিতীয় বিভাগটির কাজ হচ্ছে বিদেশিদের দেখভাল করা। তাদের সব কাজে সহায়তা করা। অসুস্থ বিদেশিদের সেবা ও মৃত বিদেশিদের সৎকার এদেরই কাজ। মৃত বিদেশিদের সম্পত্তি আত্মীয়স্বজনের কাছে পৌঁছে দেওয়াও এদের দায়িত্ব (ইন্ডিকা)।
সম্রাট রাগান্বিত। মুদ্রাধ্যক্ষ ও তত্ত্বাবধায়কদের ধমকের সুরে বললেন, তোমরা বিদেশিদের খোঁজখবর রাখো?
কিছু না বুঝে এরা মাথা নিচু করে থাকল। গ্রিক দূতের গতিবিধি সম্পর্কে বলো।
মুদ্রাধ্যক্ষ বুঝে উঠতে পারলেন না কী বলবেন। তিনি তত্ত্বাবধায়কের দিকে তাকালেন। তত্ত্বাবধায়ক তখনো মাথা নিচু করে আছে।
এবারে ধমকে উঠলেন চাণক্য, মেগাস্থিনিস কোথায় যায়, কী করে, তা দেখার দায়িত্ব কার? তার কোনো ক্ষতি হলে গ্রিকদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে ঠেকবে?
মহামন্ত্রী, আপনি আপনার লোকদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে দিন।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যকে সাধারণত আচার্য বলে সম্বোধন করেন কিন্তু রাগান্বিত হলে মহামন্ত্ৰী বলেন।
ব্যাপারটাকে ঠান্ডা করতে এগিয়ে এলেন ভদ্রবাহু। বললেন, আমি যত দূর জানি, তিনি আমাদের দেশের প্রকৃতি, আমাদের পাটালিপুত্র নগরী, আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি—এসব বিষয়ে আগ্রহী এবং কোনো কোনো বিষয়ে কৌতূহলী। কৌতূহলই বোধ করি নুলো পর্বতে যাওয়ার কারণ। তবে নিরাপত্তা এবং নগরের বাইরে গমনের ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে। তাঁকে অবশ্য আমার এখনো ক্ষতিকর মনে হয় না।
ঠিক আছে, তোমরা যাও। ব্যাপারটা আমিই দেখছি, বললেন সম্রাট। আচার্য, আপনারও দূতকে কিছু বলার দরকার নেই। শেষের কথাটি চাণক্যকে উদ্দেশ করে। বোঝা গেল, সম্রাটের রাগ পড়ে গেছে।