৮৩
ইপসাসের যুদ্ধে উভয় পক্ষ ফ্যালনক্স রীতির যুদ্ধকৌশল নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান করছে। সামনের দিকে উভয় পক্ষের পদাতিক বাহিনীকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এন্টিওকাসের কাছে রয়েছে সেলুকাসের এপিলেকটোই বাহিনী। তবে এন্টিগোনাসের পদাতিক সৈন্যসংখ্যা সেলুকাসের চাইতে বেশি। তার এপিলেকটোই (অশ্বারোহী) সৈন্যও বেশি। তিনি পঁচাত্তরটি যুদ্ধহস্তী নিয়ে এসে গোপনে আড়াল করে রেখেছেন, যাতে করে সময়মতো ব্যবহার করতে পারেন। তাঁর বিশ্বাস, এসব হাতির খবর সেলুকাস আর তাঁর মিত্ররা জানেন না। তাঁর ভরসার আরেকটি জায়গা আছে। তিনি আশা করছেন, এন্টিওকাস সময় ও সুযোগমতো তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন।
সেলুকাস ও তাঁর মিত্রদের অবস্থানও একই রকম। সেলুকাস কোনো মিত্রকে যুদ্ধহস্তী হস্তান্তর করেন নি। গোপনে নিজের কাছে, ফিলেকাসের কমান্ডে রেখে দিয়েছেন। অন্য মিত্রদের কাছে একরা বাহিনীর জায়গির রীতির সৈন্যরা শুধু আদেশের অপেক্ষায় আছে।
এন্টিগোনাসপুত্র দিমিত্রিয়াসের যেন অপেক্ষা সইছে না। কারণ, তাঁর পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য বেশি। তিনি শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রথম পর্যায়ের এ যুদ্ধে তিনি বেকায়দায় ফেলে দিলেন সেলুকাসের সেনাবাহিনীকে। বাম উইং “ আপাতত মনে হবে এন্টিওকাস সুবিধে করতে পারছেন না। আসলে এন্টিওকাস উভয় তাঁর মিত্ররা যুদ্ধে জয়ী হন, তাহলে তো জয় ত
পা দিয়ে রেখেছেন। যদি সেলুকাস ও হ। আর যদি এঁরা হেরে যান, তাহলে তিনি দিমিত্রিয়াসের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিজয় উৎসব করবেন।
এই মনোভাবে সেলুকাসের অশ্বারোহী বাহিনী যুদ্ধে যে ভূমিকা রাখে, তা দুর্ভাগ্যজনক। সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে দিমিত্রিয়াস সামনে চলে আসেন এবং চিৎকার করে বলেন, সেলুকাস, সারেন্ডার করুন, আপনার পতন অনিবার্য।
সেলুকাস আর তাঁর মিত্ররা দিমিত্রিয়াসকে তাঁর বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। পেছনে কী হচ্ছে, তা টের পেলেন না দিমিত্রিয়াস।
শুরু হলো যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়। সেলুকাস তিনশ হাতি নিয়ে দিমিত্রিয়াসকে ঘিরে ফেললেন এবং চিৎকার করে বলতে থাকলেন, এন্টিগোনাসপুত্র দিমিত্রিয়াস, তুমি আমাদের জালে আটকা পড়ে গেছ। উদ্ধার করতে পিতাকে ডাকো। তিনি হাতিদের দ্বারা দিমিত্রিয়াসের অশ্বারোহী বাহিনীকে মাঝখানে রেখে চারদিকে চক্কর দিতে থাকলেন। চাইলে আক্রমণ করে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু মজা করতে চাইলেন। দিমিত্রিয়াসের অশ্বরা যেই না পালাতে চায়, তাঁর হাতিরা ভয় দেখিয়ে আবার পূর্বস্থানে ফিরিয়ে দেয়। এই খেলায় গজারোহী বাহিনী বেশ মজা পায়।
এদিকে এন্টিগোনাস সেলুকাসের অন্য মিত্রদের মাঝখানে পড়ে কৌশলে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর নিজস্ব হস্তীবাহিনী থেকেও তিনি বিচ্ছিন্ন। এ সময় হস্তীবাহিনী তাঁর সঙ্গে থাকা দরকার ছিল। তিনি তাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়ে শুধু পদাতিক একরা বাহিনীর ওপর নির্ভর করলেন, তা রহস্যাবৃতই থেকে গেল। তাঁর হস্তীবাহিনীকে আগুনের মশাল জ্বালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হলো। সৈন্যরা হাতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এদিক-সেদিক পালাতে শুরু করল।
এন্টিগোনাস আশা করতে থাকলেন, তাঁর পুত্র তাঁকে উদ্ধার করতে আসবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁর পুত্র কোনো সাহায্যেই এগিয়ে আসতে পারলেন না। সেলুকাসের মিত্রবাহিনীর বর্শার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে এন্টিগোনাসের মৃত্যু হলো।
এন্টিগোনাসের মৃত্যুর খবর অচিরেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। এ সংবাদে তাঁর সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে শুরু করল। সেলুকাসের কানে এ সংবাদ পৌঁছালে তাঁর সৈন্যরা আনন্দ- উল্লাস করতে থাকল হাতির পিঠে অবস্থান করেই। তাতে মনোযোগ নষ্ট হলো। এক ফাঁকে দিমিত্রিয়াস তাঁর ঘোড়াকে নিষ্ঠুর এক চাবুক মেরে দ্রুত বেষ্টনী থেকে পালাতে সক্ষম হলেন। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে তিনি কিছু সৈন্য সংগ্রহ করলেন বটে, কিন্তু তা এত নগণ্য যে আক্রমণের সাহস পর্যন্ত করলেন না।
মিত্রবাহিনীর জয় হলো ইপসাসের যুদ্ধে। সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের একাংশ চলে এল সেলুকাসের দখলে। মিত্ররাও এন্টিগোনাসের সাম্রাজ্যের ভাগ পেলেন। তবে একটি অবিশ্বাস সবার মধ্যে দানা বেঁধে উঠল। সব যুদ্ধহস্তী কেন সেলুকাস তাঁর অধীনে রাখলেন? তিনি কি মিত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন? হস্তীবাহিনী না থাকায় এঁরা যেকোনো বিপদের সম্মুখীন হতে পারতেন। এন্টিওকাসের অবস্থানও তাঁদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে কি মৈত্রী বন্ধন এখানেই শেষ?
যুদ্ধে জয়লাভ করেই সেলুকাস আবার পত্র লিখলেন চন্দ্রগুপ্ত ও টলেমির কাছে। একটি ভারতবর্ষে এবং অপরটি মিসরে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০১ সালের যুদ্ধে এন্টিগোনাসের পরাজয়ের পর সিরিয়া আবার সেলুকাসের দখলে আসে। আশপাশের আরও কিছু দ্বীপের দখলও পেয়ে যান তিনি। ষড়যন্ত্রের জন্য পুত্র এন্টিওকাস ও পত্নী স্ট্রেটোনিসকে শাস্তি না দিয়ে ক্ষমা করে দেন।
এ যুদ্ধজয়ের পেছনে যে চন্দ্রগুপ্তের পাঁচশত হাতিই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, সে কথা জানিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে পত্রে কৃতজ্ঞতাও জানান। টলেমিকে পত্রে জানান, আমি আপনার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পেরে কৃতার্থ বোধ করছি। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দিমিত্রিয়াস পালিয়ে যায়।
এ যুদ্ধে জয়ের জন্য চন্দ্রগুপ্ত পাটালিপুত্রে এক বিজয়োৎসবের আয়োজন করলেন। বসন্ত উৎসব উপলক্ষে আসা দিদাইমেইয়ারা ও মেগাস্থিনিস এ উৎসবে যোগ দিলেন।
মেগাস্থিনিসের আনুষ্ঠানিক পরিচয়পর্ব দুদিন আগেই সাঙ্গ হয়েছে। পরিচয়কালে তাঁকে কোনো বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় নি। সঙ্গে ছিলেন দিদাইমেইয়া। মহামন্ত্ৰী আগেই সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হন। তিনি সম্রাটের নতুন বধূবরণের সব আয়োজনই শেষ করে রেখেছিলেন। ভারতীয় রীতিতে বধূবরণটা হেলেন খুব উপভোগ করেছেন। মহামন্ত্রী চাণক্যের আন্তরিকতায় মুগ্ধ চন্দ্রগুপ্ত। তাই কথাবার্তা হচ্ছিল আন্তরিক পরিবেশে। মহামন্ত্রী যা কখনো করেন না, মেগাস্থিনিসকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কালে তা-ই করলেন। তাঁকে বেশ প্রগল্ভ মনে হলো। পরিবেশটা তিনি মেগাস্থিনিসের অনুকূল করে দিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মেগাস্থিনিসের জন্মস্থান- বৃত্তান্ত থেকে সব ব্যক্তিগত, পেশাগত, এখানে তাঁর উর্দিষ্ট সব বিষয়ের খোঁজখবর নিলেন। দিদাইমেইয়া কোনো কোনো বিষয়কে সহজ করে দিলেন। শেষে কথা উঠেছিল বসন্ত উৎসব নিয়ে। তাঁর বিশাল আয়োজনের রূপরেখা তুলে ধরেন চাণক্য নিজে। এতে উৎসবের পূর্ব অনুরাগের সৃষ্টি হয় সমগ্র পরিবেশজুড়ে। চন্দ্রগুপ্ত সম্পর্কেও একটি সুউচ্চ ধারণার জন্ম হয় মেগাস্থিনিসের।
বসন্ত উৎসবের আগেই সেলুকাসের ইপসাস বিজয় উৎসব করতে বলেন চন্দ্রগুপ্ত। তিনি সম্ভবত বোঝাতে চাইলেন, এ বিজয়টি একা সেলুকাসের নয়, তাঁরও। কারণ, তিনি যুদ্ধজয়ের প্রধান হাতিয়ার যুদ্ধহস্তী পাঠিয়েছিলেন। সেলুকাসের মনোবল বৃদ্ধিতে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছাড়া থরের যুদ্ধে পরাজয়ই সেলুকাসকে একটি যুদ্ধে জয়ের জন্য মরিয়া করে তুলেছিল। কাঙ্ক্ষিত সে বিজয় নিশ্চয়ই সেলুকাসকে পরম প্রাপ্তির তৃপ্তিতে ভরিয়ে দিয়েছে। তিনি যখন শুনবেন তাঁর বিজয়ে ভারতীয় সম্রাটও বিজয়োৎসব করেছেন, তাহলে ব্যাপারটা একটা ভিন্ন মাত্রা পাবে। যার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। যেখানে হেলেনের খুশির ব্যাপারটাও প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকবে।
অন্য সময় হলে মহামন্ত্রী চাণক্য প্রকাশ্য না হোক, আড়ালে-আবডালে হলেও বিরোধিতা করতেন। হয়তো এমন কথাও বলতেন, সেলুকাস জয়লাভ করেছেন, এতে আমাদের কী! গ্রিকরা তো আমাদের কম জ্বালায় নি।
এসবের তিনি কিছুই বললেন না, বরং এমনভাবে সহযোগিতা করলেন যে মনে হলো এটি তাঁর জয়োৎসব। চাণক্য এভাবে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। সম্রাজ্ঞী দুরধরার মৃত্যু থেকে থরের যুদ্ধ পর্যন্ত নানা সমস্যা তাঁকে যথেষ্ট অগোছালো করে তুলেছিল। মানসিক অস্থিরতা, সিদ্ধান্তে ভুল এবং সম্রাটের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি যেন তাঁর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই অবস্থা থেকে তিনি বের হয়ে আসতে চান।
আচার্য ভদ্ৰবাহু এ বিজয় উৎসবে উৎফুল্ল। গ্রিকদের সঙ্গে সম্পর্কটাকে তিনি এগিয়ে নিতে চান। গভীরভাবে দেখলে মনে হবে চন্দ্রগুপ্তকে সুখী দেখতে চান। হেলেনই তাঁকে সুখী করতে পারেন।
উৎসব নিয়ে খুশি নিকোমেডেস ও ফাওলিনও। উৎসবে গ্রিকদের উপহার প্রদান করা হলো। চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আজ যেহেতু গ্রিক বিজয় উৎসব, অনুষ্ঠানে সব গ্রিককে কিছু না কিছু করতে হবে। তার আগে আমি কিছু বলব। গ্রিকরা একসময় আমাদের শত্রু ছিল। মহামতি আলেকজান্ডারকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হতো তাঁকে হত্যা করি। কিশোর বালক আমি। তারপরও এতটা ক্রোধ আর ঘৃণা চেপেছিল মনে। কিন্তু কি জানেন, এ লোকটিকে আমার পছন্দও ছিল। দেখতে বড় সুপুরুষ ছিলেন। দিগ্বিজয়ী বীর। আমাদের রাজারা যেন কেমন ছিলেন। তাঁদের ব্যক্তিত্ব, সাজসজ্জা আলেকজান্ডারের কাছে নস্যি। পছন্দটা সে জন্য। তিনি যখন ঘোড়া ছুটিয়ে চলতেন, কী যে লাগত আমার! সব সময়ই ভাবতাম, আমি যদি এ রকম বিশ্ববিজয়ী বীর হতে পারতাম। আলেকজান্ডার বড় অসময়ে মারা গেলেন।
তক্ষশীলা থেকে ফেরার পথে একদিন ঝিলামের বিনোদন প্রাসাদে হেলেনকে দেখি। তাঁর চটপটে ভাব, আমাদের ভারতীয় তরুণীদের মতো নয়। ভিন্ন রকম। পরে জানলাম, তিনি সেলুকাস-কন্যা। আলেকজান্ডার তখনো আমার হৃদয়ে লুকিয়ে ছিলেন হয়তো। তিনি নারীরূপে হেলেনে রূপান্তরিত হলেন। শ্রদ্ধাটা বাড়তে থাকল। সঙ্গে…।
নিকোমেডেস বলল, সঙ্গেটা কী?
সবাই এ প্রশ্নে হেসে দিলেন। চন্দ্রগুপ্তও হাসলেন। বললেন, গ্রিকরা বীরের জাতি, বীরদের সম্মান করতে হয়। যুদ্ধক্ষেত্রেও সে সম্মানের কথা মনে রেখেছি আমি। আজ গ্রিক বীর সেলুকাসের যুদ্ধজয়েও শ্রদ্ধা জানাই। এ যুদ্ধে পরোক্ষভাবে আমরাও অংশ নিয়েছি। এখন নিকোমেডেস দায়িত্ব নাও। বাকি অনুষ্ঠান তুমি পরিচালনা করবে।
নিকো, তুই ঠিকঠাকমতো অনুষ্ঠান পরিচালনা করবি। দেখিস আবার সেনা কমান্ডারের মতো আদেশ করবি না, বললেন হেলেন।
তুই কর না। পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, দুঃখিত সম্রাজ্ঞী, আপনিই করুন না।
হেলেন মিটিমিটি হাসলেন। বললেন, প্রয়োজনে ফাওলিনের সাহায্য নে।
প্রথমে হারমিজ। হারমিজ একটি নাচ দেখিয়ে দিল। গানটাও সে নিজেই গাইল।
ফাওলিন হোমারের ইলিয়াড থেকে হেলেনের প্যারিসের সঙ্গে পালিয়ে আসার অংশটি আবৃত্তি করে শোনাল।
লাউডিস তাঁর মা রাজকন্যা আপামার গল্প করলেন। তাঁর মা এক বিদেশি জেনারেলের প্রথমে অবিবাহিত সঙ্গী থেকে কী করে প্রিয় স্ত্রী এবং সবার শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছিলেন, সে কথা বললেন। এশিয়ায় মায়েরা কত দয়ালু ও হৃদয়বান, সে কথা বলতেও ভুললেন না। ব্যতিক্রমও আছে। দিদাইমেইয়া অর্থপূর্ণভাবে লাউডিসের দিকে তাকালেন। লাউডিস এখানেই কথা শেষ করলেন।
দিদাইমেইয়া বললেন, একসময় আমরা অ্যাপোলো পরিবারের সদস্য ছিলাম। আমরা সবাই এ কথা বিশ্বাস করি। কিন্তু কর্নেলিয়া এ কথা বিশ্বাস করে না। কেন করে না, তা আমি জানি না। অ্যাপোলো হচ্ছেন সংগীতের দেবতা। অবিশ্বাসের জন্য তাঁর ভালো কণ্ঠ থাকা সত্ত্বেও সংগীত সাধনা হলো না। ভবিষ্যদ্বাণীতেও সে বিশ্বাস করে না। অ্যাপোলোর সঙ্গে এখানেও তাঁর বিবাদ। অ্যাপোলো ভবিষ্যদ্বাণীর দেবতাও, যে কাজটা এখানে আচার্য ভদ্রবাহুরা করেন।
আমরা তো দেবতা না, বললেন ভদ্ৰবাহু।
জানি, জানি। তবে দেবত্বের কাছে পৌঁছে যাওয়া মানুষ।
আচার্য চাণক্য বললেন, একেবারে ঠিক বলেছেন।
হারমিজও বলল, একেবারে ঠিক। তা শুনে সবাই উচ্চ স্বরে হেসে দিল।
এবার মেগাস্থিনিসের পালা। এ ভদ্রলোক কী বলবেন, কী নিয়ে বলবেন, বুঝে উঠতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে পরে বললেন, মৌর্য সম্রাটের দরবারে আসার আগে আমি কোথায় যাচ্ছি, এ নিয়ে বড় চিন্তায় ছিলাম। শুনেছিলাম ভারতবর্ষের মানুষ জাদুটোনা জানে, সাপ- ব্যাঙের মতো গর্তে বাস করে। মানুষের মাংস খায়। দোভাষীর সঙ্গে যখন কথা বলি, সে-ও বলেছিল, এখানে বড় বড় গর্ত আছে। সাধুসন্তরা এসব গর্তে বসে মানুষের সদ্য কর্তিত মাথার খুলি গলায় পরে দেবারাধনা করে। বড় ভয়ে ভয়ে এসেছি। কিন্তু ঘোড়ার ওপর বসে দূর থেকে যখন পাটালিপুত্র নগরীর দৃশ্য দেখি, প্রথমে একে দেবতা জিউসের স্বপ্নপুরী বলে মনে হলো। পরে ভেতরে ঢুকে এত অবাক হই যে নিজের বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার জন্য লজ্জিত বোধ করি। সত্যিই ভারতবর্ষের তুলনা হয় না।
সবশেষে সম্রাজ্ঞী বলবেন, বলে নিকোমেডেস বলল, আমি ইজিপ্টের কিছু মজার কথা বলি। এক দেবী আছেন ইজিপ্টে। নাম আইএসআইএস। উচ্চারণ করা হয় আইসিস। তিনি জাদুর দেবতা। তাঁর উপাসকেরা সবাই জাদুকর। ওরা ওদের দেবীকেই নানা জাদুতে নানা অবয়বে রূপান্তর ঘটায়। একদিন রূপান্তরিত দেবীকে দেখে তাঁর পুত্র রোয়াস ও দেবতা স্বামী ওরিসিস চিনতেই পারলেন না। ভাবলেন, অন্য কোনো নারী। দেবী অত্যন্ত শক্তিশালী। দৈবশক্তিতে তাঁর কোনো জুড়ি নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, তিনি তাঁর নিজের জন্য এ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারেন না। স্বামী ও ছেলের কাছে অপরিচিতই রয়ে গেলেন।
হেলেন বুঝতে পারলেন, এ গল্পের রূপকের আড়ালে রয়েছেন তিনি। বললেন, সম্রাট, নিকো যা বলল তার একটা সুন্দর ব্যাখ্যা আছে। দেবী কেন তাঁর নিজের শক্তিকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করবেন? আইসিস ঠিক কাজটি করেছেন, অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। দেবতাদের স্বীয় স্বার্থ নিয়ে হানাহানি করে ট্রয়ের যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার চেয়ে অন্যের হিব্রত পালনে আত্মনিয়োগ করা শ্রেয়। সম্রাট, এরপর কর্মসূচিটা কী?
সেটা নিকোমেডেস বলবে, বলো নিকো।
নিকোমেডেস বলল, সম্রাজ্ঞী এখন কিছু করে দেখাবেন।
সম্রাজ্ঞী হেসে দিয়ে বললেন, আমি যদি সেলুসিয়ায় থাকতাম, তাহলে যুদ্ধে আমিও অংশ নিতাম। এখন আমি মৌর্য সম্রাটের প্রাসাদে। আমি যুদ্ধের একটা অভিনয় করে দেখাতে চাই। অভিনয়টা হবে ইলিয়াডের হেলেনের। নিকো, তুই প্যারিসের ভূমিকায় অভিনয় করবি।
নিকোমেডেস বলল, না না, এখন এ অভিনয় মহামান্য সম্রাটের করার কথা। তার কথায় সবাই উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন I