৮১
স্থুলভদ্র ভদ্ৰবাহুকে কথাটা বললেন।
তুমি ঠিক দেখেছ?
আচার্য, আমি ঠিক দেখেছি।
এ তো আশঙ্কার কথা। তার অতৃপ্ত আত্মা ঘুরেফিরে আসছে। একেবারে তাড়ানো গেল না। আবার সে মন্ত্রের আয়োজন করতে হবে। তবে মনে হয় তার আত্মা লোকালয়ে আসতে পারবে না। আচার্য চাণক্যকে তা বলার দরকার নেই।
কিন্তু আচার্য মিহিরের সাক্ষাৎ পেয়ে গেছেন। তিনি মাঝেমধ্যে বৃক্ষ উদ্যানে প্রাতভ্রমণ শেষে কিছুক্ষণ পাথরে বসে পদ্মাসনে ধ্যান করেন। এটি অবশ্য আধ্যাত্মিক লাভের জন্য নয়, ব্যায়ামের অংশ হিসেবে। হঠাৎ চোখ খুলে তিনি মিহিরের ভয়ংকর উপস্থিতি দেখতে পান। মিহির বললেন, আমার বঞ্চনার বিচার হলো না, আচার্য।
আচার্য বহুদিন পর আবার ব্রাহ্মণ্য মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করলেন। মিহির বিদ্রূপের হাসি হেসে মিলিয়ে গেলেন। আচার্য খুব ঘেমে গেলেন এবং তাঁর বুক খুব ধড়ফড় করতে লাগল। তিনি আস্তে আস্তে উঠে এলেন এবং নিজের কক্ষে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলেন।
আজকে মেগাস্থিনিসের তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা। মেগাস্থিনিস এসে বসে আছেন দোভাষীকে সঙ্গে নিয়ে। মেগাস্থিনিস ক্রমে ক্রমে বিরক্ত হচ্ছেন। একসময় দোভাষীকে বললেন, আমি এ জন্যই বলেছিলাম পণ্ডিত ব্যক্তিদের রাজকার্যে রাখতে নেই। এরা কোনো কিছুর গুরুত্ব বোঝেন না। নিজেদের অহংকারে মজে থাকেন, অন্যদের মর্যাদাও বুঝতে পারেন না। আমি সাক্ষাতে এমপারার সানন্দ্রোকোটসকে (চন্দ্রগুপ্ত) এ কথা বলব। চার দিন হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি না সমস্যা কোথায়।
দোভাষী বলল, চলুন আমরা আচার্য ভদ্রবাহুর কাছে যাই। তিনি নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।
জৈন মন্দিরে যাওয়ার কথা শুনে মেগাস্থিনিস আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তিনি এ চার দিনে দুবার সেখানে গেছেন। আগ্রহটা তাঁর সৃষ্টি হয়েছে আফ্রোদিতে দেবীপ্রতিম শর্মিলাকে দেখে। যত দেখেন, আগ্রহ তত বেড়ে যায়। আজকে সেখানে যাওয়ার একটা কারণ পাওয়া গেল বটে।
আচার্য ভদ্ৰবাহু চিন্তিত। স্থলভদ্র এবং অন্য শিষ্যরা সামনে বসে আছেন। ভদ্রবাহু বললেন, সামনে বসন্ত উৎসব। মিহির উৎপাত শুরু করলে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে।
সুলভদ্র বললেন, আচার্য, আবার সেই ২৩ম তীর্থাঙ্কর পরশ্বেনাথ মন্ত্রের দ্বারা উপাসনাসূত্র শুরু করি?
এতে তো সম্পূর্ণ কাজ হলো না। কোথাও কোনো ত্রুটি ছিল হয়তো।
বসন্ত উৎসবের সময়টায় যাতে উৎপাত না করে, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, আচার্য।
তুমি আয়োজন করো।
মেগাস্থিনিস এ সময় উপস্থিত হলেন।
মেগাস্থিনিসকে স্বাগত জানালেন আচার্য। মেগাস্থিনিস ধন্যবাদ জানিয়ে এদিক-সেদিক তাকালেন, যেন কাউকে খুঁজছেন। একপর্যায়ে বললেন, আমি খুব চিন্তিত। মহামন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হচ্ছে না। আমি আপনার সাহায্য চাইছি।
আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, আচার্য খুবই ব্যস্ত মানুষ। সাক্ষাৎ নিশ্চয়ই দেবেন আপনাকে, একটু সময় লাগছে, এই যা। এ ছাড়া সম্রাট না ফিরে আসা পর্যন্ত তো তাঁর সাক্ষাতের জন্যও আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। এখানে কি আপনার অন্য কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
না, তা হচ্ছে না। আমি ভালো আছি। তবে রাজপুরুষদের সঙ্গে তো কথা বলা দরকার। আমি কাজ না করে বসে থাকতে পারি না। আমার কথা বলার জন্য গ্রিক জানে, এ রকম মানুষ দরকার।
তা ঠিক আছে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। বসন্ত উৎসব নিয়ে মনে হয় আচার্য ব্যস্ত আছেন। এ সময় হন্তদন্ত হয়ে আচার্য চাণক্য ছুটে এলেন ভদ্রবাহুর কাছে। এখানে মেগাস্থিনিসকে দেখে বিরক্ত হলেন। কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না। ভদ্রবাহু মহামন্ত্রীর সঙ্গে মেগাস্থিনিসের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মহামন্ত্রী তেমন সৌজন্য প্রকাশ করলেন না। তারপরও মেগাস্থিনিস বললেন, আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এখানে এলাম।
বেশ তো, সাক্ষাৎ হয়ে গেল।
আপনার সঙ্গে কথা ছিল। সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার।
সম্রাটের আসার আগেই আমি আপনার কথা শুনে নেব। এখন আমি খুবই ব্যস্ত।
মহামন্ত্রী এবার ভদ্রবাহুকে উদ্দেশ করে বললেন, জরুরি কথা আছে আপনার সঙ্গে।
আপনাকে কেমন যেন উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।
আপনার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই।
আপনি বসুন, মেগাস্থিনিস। আমরা একটু কথা বলে আসি, বললেন ভদ্ৰবাহু।
মহামন্ত্রীর কথা শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ভদ্রবাহু। বললেন, ভয় পাবেন না, সে প্রাসাদে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে বৃক্ষ উদ্যানে যাওয়া কিছুকাল বন্ধ রাখতে হবে।
আপনি কিছু একটা করুন, আচার্য।
ভদ্রবাহু হেসে দিয়ে বললেন, অত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, আচার্য, আমি ব্যাপারটা দেখছি। সে তো আমার বিচারই চাচ্ছে।
এবার হালকা হেসে চাণক্য বললেন, এখন হয়তো আমার বিচারও চাইবে।
তা চাইতে পারে। কিন্তু সম্রাটের কাছে বিচার চাইতে হবে।
তার আগেই আপনি ব্যবস্থা নিন।
নিচ্ছি, নিচ্ছি। আপনি অনুগ্রহ করে মেগাস্থিনিসকে সাক্ষাৎ দিয়ে শান্ত করুন।
ফিরে যাওয়ার সময় মহামন্ত্রী চাণক্য মেগাস্থিনিসকে বললেন, আসুন আপনি।
মেগাস্থিনিস তাঁকে অনুসরণ ন এবং মহামন্ত্রীর কক্ষে পৌঁছে নিজের পরিচয়পত্র তাঁর হাতে তুলে দিলেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের কাছে লেখাপত্র, সম্রাট সেলুকাস লিখেছেন। একটু চিন্তা করলেন চাণক্য পত্রটি খুলবেন কি না। না, খুলবেন না। বলুন, আপনার কী হেতু আগমন?
মেগাস্থিনিস তাঁর আগমনের হেতু বিস্তারিত জানালেন।
মহামন্ত্রী মাথা নেড়ে বললেন, সম্রাট না পৌঁছা পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। তিনি ফিরে এলে আমি আপনাকে সংবাদ দেব। সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। এখানে কোনো অসুবিধা নেই তো?
দোভাষী নিজে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, চাণক্য হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। মেগাস্থিনিস বললেন, না, সব ঠিক আছে।
.
লাউডিস দিদাইমেইয়া ও তার মেয়েকে নিয়ে গল্প করছিলেন। একপর্যায়ে বললেন, পিসি, আমরা বসন্ত উৎসবের কথা শুনে আবার চলে এলাম, মনে হয় ঠিক হলো না।
এ কথা কেন?
দিদাইমেইয়ার প্রশ্নের জবাবে লাউডিস বললেন, সেলুসিয়ায় যুদ্ধের দামামা বাজছে। ওদের এ সময় ফেলে চলে আসা ঠিক হয় নি।
যুদ্ধের সময় তো আমরা এভাবেই কাটাই। সেটা সেলুসিয়ায় যেমন, ভারতেও তেমনি। সব রাজা কিংবা সম্রাটের বেলায়ই তা ঘটে। ওঁরাও যেন কেমন, যুদ্ধ ছাড়া কোথাও তাদের শান্তি নেই। মরো কিংবা মারো। এভাবেই চলবে। যদি সেলুকাস যুদ্ধে হেরে যায়, আমরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। অসহায়ভাবে ঘুরে বেড়াব। কেউ তখন ঠাঁই দেনে না, এটাই হচ্ছে চরম সত্য। সেলুকাস জয়ী হলে আমরা রাজকীয় সম্মানের সঙ্গে বাঁচব। তা-ই তো দেখে এসেছি। এখন উৎকণ্ঠায় থাকতে হবে। তার চেয়ে ভালো বসন্ত উৎসবে মেতে থাকা।
হারমিজ বলল, মা, বাবাও কি যুদ্ধে যাবে?
লাউডিস কিছু বলার আগে দিদাইমেইয়া বললেন, জেনারেল যুদ্ধে যাবে না?
যে জেনারেল যুদ্ধে হেরে যায়, তাকে আমি পুনরায় যুদ্ধে পাঠাতাম না, বলল হারমিজ।
তার কথা শুনে দুজনই উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়ল।
তোমরা হাসছ কেন? ঠিক বলি নি?
হাসতে হাসতেই দিদাইমেইয়া বললেন, ঠিক বলেছ, একেবারেই ঠিক।
.
মহামন্ত্রী চাণক্যের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বেশ উৎফুল্ল চিত্তে মেগাস্থিনিস দিদাইমেইয়ার কাছে রাজকীয় অতিথিশালায় হাজির হলেন। এই অতিথিশালার ঐশ্বর্য ও শান-শওকত দেখে খুবই অবাক হলেন তিনি। পশ্চিমের লোকজন, বিশেষ করে আত্ম-অহংকারী গ্রিকরা এতকাল ভারতীয়দের সম্পর্কে যে উন্নাসিকভাব দেখাত, মৌর্যদের পাটালিপুত্র নগরী ও জীবনযাত্রার ধরন দেখে মেগাস্থিনিস সে ভাব পাল্টালেন এবং মনে মনে বললেন, আমরা মিথ্যে অহংকার নিয়েই এতকাল ভারতবর্ষকে সম্মান জানাইনি। এরা মানবসভ্যতায় অনেক দূর গেছে।
দিদাইমেইয়া বললেন, মেগাস্থিনিসকে বেশ উৎফুল্ল দেখা যাচ্ছে। ভালো খবর আছে নিশ্চয়।
আজ সাক্ষাৎ মিলেছে। কেন জানি না মহামন্ত্রীকে খুবই অস্থির ও বিধ্বস্ত মনে হয়েছে।
কারণ জানতে পারো নি?
সে চেষ্টা করি নি।
যাক, সাক্ষাৎ তো মিলল। সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতে সমস্যা হবে না। তুমি আমার সঙ্গে যাবে।
তা বোধ হয় সম্ভব নয়, মহামন্ত্রী বলেছেন তাঁর সঙ্গে যেতে। এটাই নাকি এখানকার রীতি।
বেশ তা-ই করো। এখন বলো কর্নেলিয়ার শ্বশুরবাড়ি কেমন দেখলে?
তাঁর জবাব দেওয়ার আগে হারমিজ বলল, এটা শ্বশুরবাড়ি হতে যাবে কেন? এটা তো রাজবাড়ি।
আপনি কি রাজবধূ সম্পর্কে ধারণা রাখেন, মাই সুইট?
তুমি কী বলতে চাইছ?
রাজবধূই রাজরানি এবং এটা তার শ্বশুরবাড়ি।
শ্বশুর তো নেই, না নানু? যে নেই, তার বাড়ি থাকবে কেন? এ বাড়িটি তো কর্নি আন্টির শ্বশুর নির্মাণ করে নি।
আর পাকামি করবি না তো, হারমিজ, বললেন লাউডিস।
পাকামি করলাম কোথায়? ঠিক বলি নি, নানু?
একদম ঠিক বলেছ। আমি তোমার কথা সমর্থন করি। মেগাস্থিনিস, এবার তুমি বলো এ রাজপ্রাসাদ, এ নগরী তোমার কাছে কেমন লাগছে?
আমি কল্পনাও করি নি প্রাচ্যে এত সুন্দর ও নান্দনিক নগরী আর রাজপ্রাসাদ আছে। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে সবটাই সুপরিকল্পিত ও কাষ্ঠনির্মিত। নির্মাতা শিল্পীদের দক্ষতার অন্ত নেই।
প্রাচীরের স্তম্ভগুলোয় বসানো পাখিগুলো কি আসল স্বর্ণের
খাঁটি স্বর্ণের। লতাগুলো রুপোর।
প্রাচীরের কাঠগুলো বেশ মজবুত। এগুলোকে এরা আয়রনউড বলে।
তাদের দেওয়া একটা নামও আছে। লোহা কাঠ।
বেশ পরিপাটি নগরী।
আমি একটা ব্যাপারে অভিভূত।
কী ব্যাপারে?
প্রধান ফটকে ব্যবহৃত স্থাপত্যরীতির সঙ্গে গ্রিক রীতির মিল রয়েছে।
কী রকম মিল?
আমাদের হেলেনিস্টিক ফ্লেমপালমিটসের সঙ্গে এদের প্রধান ফটকের ওপর নকশাকাটা পালমিটসের হুবহু মিল রয়েছে।
অদ্ভুত ব্যাপার তো!
আপনি লক্ষ করলে দেখবেন, তালপত্রের উজ্জ্বল নকশায় যেন ভেতর থেকে একটি মশাল জ্বলে উঠেছে।
তাহলে এটা গ্রিক প্রভাব?
তা বলা শক্ত কে কাকে প্রভাবিত করেছে। প্রভাবটা ভারতীয়ও হতে পারে। তবে লায়ন- কেপিটাল একেবারে এদের নিজস্ব।
তুমি তো বেশ কিছুদিন আছ, মেগাস্থিনিস, আমি তোমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখব এদের কীর্তিগুলো। আমি এখন খুব টেনশনে আছি, জানি না সেলুকাসরা যুদ্ধে কী করছে।