৮০
সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের কাছে একটি পত্র লিখলেন। এতে বললেন, সন্ধিচুক্তির শর্তমতে একশত যুদ্ধহস্তী এখনো পাওয়া যায় নি। তিনি এন্টিগোনাসের রাজ্য আক্রমণের সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছেন। শুধু এ হাতিগুলোর জন্য অপেক্ষা। হাতিগুলো পাওয়া গেলে পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ করা যাবে। কারণ, শত্রুকে তিনি দুর্বল ভাবতে চান না।
পত্র পেয়ে চন্দ্রগুপ্ত মহামন্ত্রী চাণক্যের ওপর খুবই বিরক্ত হলেন। গান্ধারা প্রাসাদে থাকলে হয়তো তিরস্কার করতেও ভুলতেন না।
তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন হেলেন। বললেন, এত উত্তেজিত হবেন না, সম্রাট। আচার্য নিশ্চয়ই ভালোটা চিন্তা করেছেন। আপনি শান্তভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। হস্তী না পাঠানোর কারণ নিশ্চয়ই তিনি জানাবেন।
তাহলে আমাদের শীঘ্রই পাটালিপুত্রে যাওয়া উচিত। প্রস্তুতি নিন, সম্রাজ্ঞী।
পত্রের এক জায়গায় লিখেছেন, ভারতীয় ওষুধ সেবন করে এই আটাত্তর বছর বয়সেও নিজেকে ত্রিশ বছরের যুবক মনে করছেন। তাঁর রাজচিকিৎসক ওষুধটির প্রস্তুতপ্রণালি জানতে চেয়েছেন। তাহলে আর চন্দ্রগুপ্তকে ক্লেশ করতে হবে না।
এ অংশ পাঠ করে চন্দ্রগুপ্ত হাসলেন।
হেলেন বললেন, হাসছেন কেন?
ওষুধে কাজ হয়েছে। এখন গাছটাই চাইছেন, শুধু ফল নয়।
সম্রাটের প্রতি সম্রাটের দায়িত্ববোধ আছে। গাছটাই পাঠিয়ে দেবেন নাকি?
ফরমুলা বলে দেওয়া ঠিক হবে না, রাজবৈদ্যকে বলে আরও ওষুধ পাঠানোর ব্যবস্থা করি।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত শ্বশুরের জন্য কাম উত্তেজক বটিকা পাঠিয়েছিলেন।
চিঠির শেষে সেলুকাস লিখেছেন, বসন্ত উৎসবের পর যেন গ্রিকরা সবাই সেলুসিয়ায় চলে আসে। সম্ভব হলে কর্নেলিয়াও যুদ্ধের আগে একবার বেড়িয়ে যায়। যুদ্ধের সময় পরিবারের লোকজন সঙ্গে থাকা উচিত।
চন্দ্রগুপ্ত হেলেনকে বললেন, যাবে নাকি?
আপনি যাবেন না?
সম্রাট কি শ্বশুরবাড়িতে যায়? তবে হ্যাঁ, যদি যুদ্ধে সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে শ্বশুরের পক্ষে যুদ্ধ করতে যেতে পারি, বলে চন্দ্রগুপ্ত হাসলেন।
পত্রের জবাবে আশ্বস্ত করতে বাধা কী?
বাধা নেই, তা লিখে জানিয়ে দিচ্ছি।
.
এদিকে এন্টিগোনাসের মিত্রদের সঙ্গে এক সভায় যোগ দিলেন স্বয়ং এন্টিওকাসপত্নী স্ট্রেটোনিস। এন্টিগোনাসের পুত্র দিমিত্রিয়াস তাঁকে ডেকেছেন। সভায় এন্টিগোনাস সভাপতিত্ব করছেন। বললেন, স্পষ্ট যে, টলেমি, কাসান্দার ও লাইসিমেকাসকে আমরা সঙ্গে পাচ্ছি না। রোদেস, এখন আপনি আপনার অবস্থান পরিষ্কার করুন।
রোদেস বললেন, আমি টলেমি ছাড়া বাকি সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। দিমিত্রিয়াস বললেন, টলেমি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না বলেছিলেন। অর্থাৎ তাঁর জোটবদ্ধ মিত্রদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবেন না।
রোদেস বললেন, ব্যাপারটা সে রকমই।
ঠিক আছে। এবার এন্টিওকাসের পক্ষ থেকে কী বার্তা এনেছেন, তা বলুন, প্রিন্সেস।
মহামান্য এন্টিগোনাস, আমি বেশ কিছুদিন যাবৎ দিমিত্রিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছি। সেলুসিয়া আমাদের, অর্থাৎ এন্টিওকাসের অধীনে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে থাকবে-এই শর্তে আমরা যেকোনো সাহায্য করতে প্রস্তুত।
জেনারেল এন্টিগোনাস বললেন, এত বড় সাম্রাজ্য এককভাবে আপনাদের দিয়ে দেওয়া যাবে না। আপনারা যেখানে আছেন, সেখানেই স্বাধীনভাবে থাকবেন। বাকি রাজ্য মিত্রদের মধ্যে ভাগাভাগি হবে।
স্ট্রেটোনিস বললেন, আমরা তাহলে আর কোনো ভাগ পাব না, আমাদের অংশ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব? এ রকম ইচ্ছার কথা দিমিত্রিয়াস আগেই আমাকে বলেছেন। এন্টিওকাসকে জানানোর পর সে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, সেলুসিয়া সে কাউকে দেবে না। আমারও ইচ্ছা তাই।
কৌশলগত কারণে আমাদের তা নিয়ে ভাবতে হবে, বললেন এন্টিগোনাস।
আমরা পরে তা জানাব, দিমিত্রিয়াস এ কথা বললেন। পরে যোগ করলেন, এন্টিওকাসের উচিত ছিল নিজে সভায় যোগদান করা।
স্ট্রেটোনিস বললেন, এখন একটা বহুমাত্রিক যুদ্ধ আমাদের সামনে। আগে আমাদের অনুরোধ ছিল সেলুকাসের কাছ থেকে সেলুসিয়া মুক্ত করে এন্টিওকাসকে সম্রাটের সিংহাসনে বসানো। এখন এ যুদ্ধকালে আমরা অংশীদারত্বমূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা আমাদের সাম্রাজ্যটাই চাচ্ছি, অন্য রাজ্যের ভাগ চাই না। পূর্বের অন্য সব শর্ত বহাল থাকবে।
যুদ্ধে আমরা পরাজিত হলে?
যুদ্ধক্ষেত্রে জয়-পরাজয় নিশ্চিত হবে এবং অনিবার্য ভাগ্যকে বরণ করে নিতে হবে।
স্ট্রেটোনিস চলে গেলে এন্টিগোনাস বললেন, আমি তাদের বিশ্বাস করতে পারছি না।
কেন বাবা?
সে তো তার পূর্বস্বামী সেলুকাসের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
তা ঠিক। এই বিশ্বাসঘাতকতা এন্টিওকাসের সঙ্গেও করতে পারে।
কী বলতে চাও তুমি?
এন্টিওকাসকে বাদ দিয়ে শুধু তাকেই আমরা সিংহাসনের লোভ দেখাই না কেন?
তাতে কাজ হবে?
সে উচ্চাভিলাষী, সন্দেহ নেই।
এটাই কাজে লাগাতে হবে। তুমি চেষ্টা করে দেখো। আমি বাইরে নেতিবাচক মনোভাব দেখাব।
দিমিত্রিয়াস বলল, আইডিয়াটা চমৎকার।
.
সেলুকাস মিসরে চাচা টলেমির কাছেও একটা পত্র লিখলেন। পত্রে তিনি জানালেন এন্টিগোনাস ও তার সন্ত্রাসী পুত্র দিমিত্রিয়াসকে শাস্তি দেওয়ার সময় এসে গেছে। চার বছর আগে মিসরে আক্রমণ করে এরা টলেমির যে ক্ষতি করেছে, তা এবার কড়ায় গন্ডায় আদায় করা হবে। এখনই সেলুকাস টলেমির কাছে কোনো সামরিক সাহায্য চাইছেন না, প্রয়োজন হলে হাত বাড়াবেন তবে তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। কারণ, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের কাছ থেকে পাঁচশ যুদ্ধহস্তী এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক গজারোহী সৈন্য পাওয়া যাচ্ছে। চারশ ইতিমধ্যেই এসে গেছে। চন্দ্রগুপ্ত বলেছেন, প্রয়োজন হলে তিনি তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনী দিয়ে আরও সাহায্য করবেন এবং এ ব্যাপারে তিনি বেশ আশাবাদী।
পত্র পাঠ করে এন্টিগোনাসকে শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগে টলেমি বেশ খুশি হলেন। কিন্তু তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না কেন ভারতীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে যুদ্ধহস্তী এবং সৈন্য দিয়ে সাহায্য করবেন। তাঁর মনে হলো, মৌর্য সম্রাট যুদ্ধে পরাজিত হয়েই এ রকম সন্ধি করেছেন। তিনি সেলুকাসকে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে গ্রিক বিজয়ের গৌরবময় পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য অভিনন্দন জানালেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। ব্যাপারটা যে আসলে তা ছিল না, টলেমি তা জেনেছেন অনেক পরে।
সেলুকাস তাঁর জেনারেলদের নিয়ে সভা করছিলেন। এ সময় তাঁর এক সামরিক গোয়েন্দা উপস্থিত হলো। জরুরি ব্যাপারে কথা বলতে চায়।
সভাস্থল থেকে বের হয়ে নিজের কামরায় এসে সেলুকাস বললেন, বলো, কী বলতে চাও?
গোয়েন্দা লোকটি বলল, মহামান্য সম্রাট, সংবাদ অতি খারাপ। এন্টিগোনাস পুত্র দিমিত্রিয়াস আজ-কালের মধ্যেই সেলুসিয়া আক্রমণ করবে এবং এন্টিওকাসের তাঁর সঙ্গে যোগদানের সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আপনার শক্তি পরখ করে ঝাঁপিয়ে পড়বেন বলে মনে হচ্ছে।
এন্টিওকাসের কথা তুমি কীভাবে জানলে?
প্রিন্সের স্ত্রী এন্টিগোনাসের মন্ত্রণাসভায় যোগ দিয়েছিলেন।
তুমি নিশ্চিত?
গোয়েন্দাটি মাথা নাড়ল।
সেলুকাস তাঁর সিনিয়র জেনারেলদের তাঁর কক্ষে ডাকলেন। জেনারেল মোলন ও জেনারেল ফিলেকাস উপস্থিত হলে গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া সংবাদ জানিয়ে বললেন, আমাদের এখনই আক্রমণ করা উচিত।
মোলন একটু চিন্তা করে বললেন, তা ঠিক আছে। আমিও মনে করি আমরাই আগে আক্রমণ করব। কিন্তু সম্রাট, মিত্রদের সঙ্গেও কথা বলা দরকার।
তা না হলে ভুল-বোঝাবুঝি হতে পারে, যোগ করলেন ফিলেকাস।
তোমরা ঠিক বলেছ। এখনই তাঁদের কাছে পত্র দিয়ে দূত প্রেরণ করো।
সম্রাটের কথামতো জরুরিভাবে দূত পাঠানো হলো লাইসিমেকাস, কাসান্দার প্রিপেলাস ও প্লেইস্টারকাসের কাছে।
এঁরা দ্রুত মিলিত হলেন এক সমরসভায়। মনোপথালমাস, দিমিত্রিয়াস ও এন্টিগোনাসের শক্তি নিয়ে কথা উঠল। সেলুকাস তাঁর গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া গোপন তথ্য পেশ করলেন সবার কাছে। ওদের আছে সত্তর হাজার পদাতিক, দশ হাজার অশ্বারোহী এবং পঁচাত্তরটি গজারোহী সৈন্য।
লাইসিমেকাস বললেন, আমাদের শক্তি বেশি থাকারই কথা।
সেলুকাস বললেন, এখনকার হিসাবটা এ রকম: চৌষট্টি হাজার পদাতিক, পনেরো হাজার অশ্বারোহী, চারশ গজারোহী এবং একশত বিশ রথী সৈন্য। আরও একশ গজারোহী আসার সম্ভাবনা আছে।
আমরা আরও শক্তির জোগান দিতে পারব। কারণ, আমরা প্রতিরক্ষার জন্য এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য মজুত রেখেছি। তবে একটি সংবাদ আমাকে চিন্তিত করে তুলেছে। এন্টিওকাস দিমিত্রিয়াসের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছে, বললেন কাসান্দার
তা আমি জানি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অপেক্ষাকৃত দুর্বল জায়গায় তাকে অশ্বারোহী কিছু সৈন্য দিয়ে নিয়োজিত রাখব। সে আমার চোখে চোখে থাকবে। তাকে যুদ্ধের বাইরে রাখা যাবে না এ জন্য যে সেটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেলুকাসের কথার মাথায় লাইসিমেকাস বললেন, আমি জানি না তাদের যোগাযোগটা বাণিজ্যিক না সামরিক
প্রিপেলাস বললেন, স্ট্রেটোনিসের যোগাযোগ হয়তো বাণিজ্যিক কারণেই। যা-ই হোক, আমরা ব্যাপারটার ওপর নজর রাখব
আমাদের গজারোহী সৈন্যরাই ওদের পরাজয় নিশ্চিত করবে। এবার এলাকা নির্ধারণ করা যাক। যুদ্ধকৌশল ও আঘাতের প্রকৃতি নির্ভর করছে ভৌগোলিক এবং শত্রুপক্ষের কৌশলের ওপর, বললেন সেলুকাস।
কাসান্দার বললেন, আমাদের যার যার এলাকা থেকে চতুর্মুখী আক্রমণ শানাতে হবে। শত্রুদের আমরা মাছের ঝাঁকের মতো ঘিরে ফেলব এবং তিমির মতো ধরে ধরে খাব।
জেনারেল মোলন একটা যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করেছে। তার মুখ থেকে পরিকল্পনাটা শুনি। মোলন, তুমি প্ল্যানটা বলো।
মোলন কাপড়ে আঁকা একটা মানচিত্র দেয়ালে আটকালেন। তারপর লম্বা একটা কাঠি নিয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে মানচিত্রে তাদের এবং শত্রুদের অবস্থান দেখালেন। তারপর বললেন, আমরা মূল যুদ্ধটা করতে চাই ইপসাসে এবং আদতে তা-ই হবে। শত্রুরা এখানেই আসবে। আমরা এখানে জড়ো হতে তাদের সুযোগ দেব। মহামতি আলেকজান্ডার এবং ফিলিপ যে যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করতেন, আলেকজান্ডার-পরবর্তী ডায়াডোচিরা (সমরনায়ক) একই কৌশল অবলম্বন করছেন। আমরা যা করছি, শত্রুরাও তা করছে। যেসব যুদ্ধাস্ত্র আমরা ব্যবহার করছি, ওরাও তা-ই করছে। কৌশলে কিংবা অস্ত্রে পরিবর্তন আসছে না। তবে আমরা যুক্ত করছি একটি নতুন বাহিনী, যা আমরা দেখেছি ভারতীয় বাহিনীতে, তা হচ্ছে রথী বাহিনী—এটি অত্যন্ত কার্যকর মনে হয়েছে। আর আমাদের কাছে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের কাছ থেকে পাওয়া চারশ যুদ্ধহস্তী রয়েছে, যে শক্তির তুলনা নেই। ওদের শক্তি অশ্বারোহী বাহিনী। ওরা গতানুগতিকভাবেই ডান দিক থেকে আক্রমণ করবে। সেখানে আমরা অশ্বারোহী নয়, গজারোহীদের পাঠাব। ভারতীয়রা সিন্ধু অববাহিকার যুদ্ধে জয়লাভ করেছে গজারোহী সৈন্যদের দিয়ে, ইপসাসের যুদ্ধেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
মিত্রবাহিনীর সব সমরনায়কই এ জন্য সেলুকাসকে ধন্যবাদ দিলেন এবং তাঁর প্রশংসা করলেন।
মোলন সেলুসিড যুদ্ধকৌশল এবং নতুন উদ্ভাবিত অস্ত্রের কথা কিছুই বললেন না। মিত্ররা চলে গেলে সেলুকাস বললেন, তুমি সেলুসিড আর্মির যুদ্ধকৌশল এবং নতুন উদ্ভাবিত অস্ত্রশস্ত্রের কথা না বলে ভালো করেছ। আমি চাই না ওরা অস্ত্ররহস্য জেনে যাক।