মৌর্য – ৭৯

৭৯

মেগাস্থিনিসকে পাটালিপুত্রের কথা বলা হয়েছিল। তাই তিনি পাটালিপুত্রে এসে পড়েছেন। যদিও সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী তক্ষশীলার গান্ধারা রাজপ্রাসাদে তখনো অবস্থান করছেন।

পাটালিপুত্র নগরী দূর থেকে স্বপ্নপুরীর মতো মনে হয়। দূর থেকে মেগাস্থিনিসের কাছে মনে হলো নগরীটি অপূর্ব এক চিত্রকর্ম। নানা রং আর ভাবনার সংমিশ্রণ তাঁকে কাছে আসতেই যেন নিয়ে গেল কবিতার রাজ্যে। অর্ধেক বোঝা যায়, অর্ধেক বোঝা যায় না। মেগাস্থিনিস ঘোড়া ঘুরিয়ে একটু পেছনে গেলেন। তাঁর সঙ্গী দোভাষী ঘোড়ায় তাঁর পেছনে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন, কোনো কিছু কি পড়ে গেছে?

না। কী অসাধারণ শিল্পকর্ম, একটু পিছিয়ে গিয়ে আবার দেখতে চাই। আমার দেখা আশ্চর্য এক নগরী এটি।

রাজপ্রাসাদ দেখলে তো আপনার মাথা ঘুরে যাবে।

নিশ্চয়ই তা দেখার সুযোগ হবে। আমি আজ তোমাকে নিয়ে শুধু নগরীটা ঘুরে ঘুরে দেখব। একটি তোরণে এসে তাঁর আরও বেশি অবাক হওয়ার পালা। সঙ্গীটি বলল, এখানে নয়, আপনাকে চারটি প্রধান ফটকের একটিতে যেতে হবে।

চারটি প্রধান ফটক? কেন?

তা আমি বলতে পারব না। এখানে চারটি প্রধান ফটকের পাশাপাশি আরও ষাটটি ফটক বা তোরণ আছে।

এগুলোর একটি আমি দেখছি।

হ্যাঁ, তাই।

চৌষট্টি তোরণ বা ফটক এ নগরীর?

হ্যাঁ, তাই।

অবাক করলে তুমি। চৌষট্টিটা কেন?

ভারতবর্ষে চৌষট্টি একটা গৌরবময় শব্দ। যেমন চৌষট্টি কলা, চৌষট্টি কামকলা, চৌষট্টি পাপড়ি, চৌষট্টি পাখরি (পদ্মপাপড়ি) এসব আরকি।

তার রহস্য কী?

আমি বলতে পারব না, পণ্ডিত আচার্য চাণক্য বলতে পারবেন।

তিনি আবার কে?

মহামন্ত্ৰী।

আচ্ছা। মহামন্ত্রী পণ্ডিত হলে তো এই সাম্রাজ্য ভালো চলছে না। পণ্ডিতেরা ভালো প্ৰশাসক হয় না। তা ছাড়া পণ্ডিতদের আমি কম পছন্দ করি। এরা বেশি কথা বলে। কিন্তু সম্রাটের শিল্পরুচি আছে। তাঁকে আমি পছন্দ করলাম। গগনস্পর্শী বড় বড় টাওয়ার দেখছি। এগুলো কী?

এ রকম পাঁচশ সত্তরটা টাওয়ার আছে। কাছে না গেলে আপনি ভাবতেই পারবেন না এগুলো কীভাবে এত সুন্দর করে সাজানো হলো।

দেখব, নিশ্চয়ই দেখব। চলো প্রধান ফটকে যাই।

প্রধান ফটকে দোভাষী দৌবারিককে বুঝিয়ে বলল, ইনি গ্রিক রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূত তখন কষ্টি পাথরের প্রধান ফটক দেখছিলেন।

দৌবারিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল তাঁকে। পরে বলল, সম্রাটের কোনো ফরমান আছে? দোভাষী কথাটি বুঝিয়ে দিল মেগাস্থিনিসকে। তিনি সেলুসিড সম্রাটের ফরমান, যা গ্রিক ও ভারতীয় সংস্কৃতে লেখা, তা বের করে দেখালেন।

দৌবারিক ফরমানটা নিতে চাইল। মেগাস্থিনিস তা দিলেন না, বললেন, আমি তা সম্রাটকে দেখাব!

দৌবারিক বলল, তাহলে অপেক্ষাকক্ষে বসতে হবে।

দোভাষী মেগাস্থিনিসকে নিয়ে ফটকের পাশেই উত্তমরূপে সজ্জিত কারুকাজ করা কাষ্ঠনির্মিত অপেক্ষাকক্ষে গেল। কক্ষটি কাঠের প্রাচীরের একটি অংশ। মেগাস্থিনিস দৌবারিকের কথায় বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করে তাঁর বিরক্তি ভাবটা কেটে গেল। কাঠে এত কারুকাজ তিনি জীবনেও দেখেন নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলেন।

দোভাষী বলল, এখানে নিয়ম হলো, বাইরে থেকে কোনো রাজ্যের দূত এলে তাঁকে প্রথমে মহামন্ত্রীর কাছে নিয়ে যেতে হয়।

মন্ত্রী? পণ্ডিত চাণক্য?

তিনি অনুমতি দিলেই তবে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব। তবে আপনার অনুমতি হয়ে যাবে। সম্রাট সেলুকাসের সঙ্গে এখন আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক।

এঁরা বসে আছেন অনেকক্ষণ হলো। দৌবারিক ফিরে আসছে না। এখন মেগাস্থিনিস আবার বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু তা দোভাষীকে বুঝতে না দিয়ে বললেন, এসব স্থাপত্যকর্ম আমাকে অবাক করছে। তুমি বলতে পারো ফটকের কষ্টি পাথরের এ কাজটা কে করেছেন?

দোভাষী বলল, এটা আমার জানা উচিত ছিল, কিন্তু আমি জানি না।

আমার কী মনে হয়, জানো, যে এ কাজটি করেছে, তার গ্রিক শিল্পস্থাপত্য সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে।

হতে পারে।

হতে পারে কেন? আমি একেবারে নিশ্চিত। দৌবারিক আসছে না কেন?

মনে হয় পণ্ডিতাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে নি। পণ্ডিত সব সময় ব্যস্ত থাকেন, কাউকে সহজে সাক্ষাৎ দেন না।

পণ্ডিতেরা বাস্তববর্জিত অহংকারী মানুষ হয়। তাদের আমি পছন্দ করি না।

এ সময় দৌবারিক ফিরে এসে সংবাদ দিল যে আজকে মহামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না। তিনি খুব ব্যস্ত আছেন। গ্রিক দূত পঞ্চবটি অতিথিশালায় থাকবেন। সেখানে তাঁকে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এ কথা শুনে দোভাষীর চেহারায় পরিবর্তন এল। এটি তৃতীয় সারির একটি অতিথিশালা। মহামন্ত্রী কেন এখানে তাঁকে রাখতে চাইলেন, বুঝতে পারা গেল না। তাই দোভাষীর চেহারায় চিন্তার ঢেউ খেলে গেছে।

দোভাষীর মন খারাপ হলেও মেগাস্থিনিসের অতিথিশালাটি পছন্দ হলো। এত সুসজ্জিত অতিথিশালায় তিনি আগে কখনো ছিলেন না। এ ছাড়া পাঁচটি বটবৃক্ষের মাঝখানে নির্মিত বলে পরিবেশটাও তাঁর ভালো লেগে গেল। এই ভালো লাগা নিয়ে মেগাস্থিনিস গুনগুন করতে করতে দোভাষীকে জিজ্ঞেস করলেন, সম্রাটের সঙ্গে কি কালই সাক্ষাৎ সম্ভব? আগে তো মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।

দোভাষী বলল, সম্রাট তো পাটালিপুত্রে নেই, তিনি এখন তক্ষশীলার গান্ধারা প্রাসাদে আছেন।

মনে হলো মেগাস্থিনিস আহত হয়েছেন। বললেন, আমার উচিত ছিল জেনে আসা সম্রাট এখন কোথায় আছেন। আমার কি এখন গান্ধারা প্রাসাদে যাওয়া উচিত?

সম্রাট দুয়েক দিনের মধ্যেই এখানে চলে আসবেন।

তাহলে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। অসুবিধে নেই। এখানকার পরিবেশ আমার ভালো লেগেছে।

.

দিদাইমেইয়া এসেছেন এক দিন আগে। এখন ভদ্রবাহুর সঙ্গে গল্প করছেন রাজকীয় জৈন মন্দিরে। ভদ্রবাহুকে তাঁদের খুব পছন্দ। ঋষিপুরুষ অথচ সবাইকে মাতিয়ে রাখেন। পাটালিপুত্রের সৌন্দর্য তাঁদের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে। ভদ্রবাহু বললেন, নগরীর সৌন্দর্য সৃষ্টির সব কৃতিত্ব আচার্য চাণক্যের। সম্রাজ্ঞীর আগমনকে তিনি সৌন্দর্যে আর সুবাসে ভরিয়ে দিতে চান। একসময় চন্দ্রের অভিভাবক ছিলেন তো, তাই সে মনোভাবটা এখনো রয়ে গেছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে পুত্রবধূ বরণের একটি দীর্ঘ ঐশ্বর্যময় ঐতিহ্য রয়েছে। আচার্যের মাথায় বোধ হয় তা-ও ঘুরপাক খাচ্ছে।

দিদাইমেইয়া বললেন, তাঁর কিছু রূপ গান্ধারা প্রাসাদেও দেখেছি।

নিকোমেডেস বলল, তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তাঁর একটি ছিল কৌশলে কর্নেলিয়াকে জব্দ করা। এটি সে রকম কোনো কৌশলের অংশ কি না কে জানে।

ভদ্রবাহু বললেন, মনে হয় তাঁর মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। তিনি সম্রাট-সম্রাজ্ঞীকে খুশি রাখতেই চাইবেন। প্রিন্সেসের ব্যাপারটা তাঁকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে।

তিনি সংসারী নন? তাঁর স্ত্রী-সন্তানরা কোথায়?

তিনি সংসারী। আমার মতো সংসারবিরাগী নন। স্ত্রী আছেন। কন্যাও আছে। তবে পণ্ডিতদের বেলায় যা হয়, স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের মতো সম্পর্ক নেই। উচ্চ পরিবারের সন্তান ব্রাহ্মণীর সঙ্গে খটমট লেগেই থাকে। তাঁকে জব্দ করার জন্য কিছু দুষ্ট লোক তাঁর কিশোরী কন্যাকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এ নিয়েও দুশ্চিন্তা আছে তাঁর।

দিদাইমেইয়া লাউডিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের সক্রেটিস। ঘরে শান্তি নেই, বাইরে বিশাল দার্শনিক।

সক্রেটিসের কথা আমি শুনেছি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নয়, দর্শনের কথা জানি।

নিকোমেডেস ভাবল, এখন দর্শন নিয়েই কথা হবে। উঠে পড়া উত্তম। ফাওলিনকে চোখে ইশারা করল এবং উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা একটু মন্দির এলাকাটা ঘুরেফিরে দেখি।

হারমিজ বলল সে-ও যাবে।

ভদ্ৰবাহু শর্মিলাকে ডেকে তাঁদের সঙ্গে পাঠালেন।

হারমিজের কাছে শর্মিলাকে বিদঘুটে লাগলেও ক্রমে ভাব হয়ে গেল। মন্দিরের সৌন্দর্য তাঁদের আকৃষ্ট করল। ভবদানব একেও তার হাতের ছোঁয়ায় স্বর্গীয় করে তুলেছে। সেলুসিয়া কিংবা গ্রিসে এ রকম নান্দনিক স্থাপত্যশিল্প চোখে পড়ে না। ভাস্কর্য আছে জগদ্বিখ্যাত। নিকোমেডেস মিসরে দেখে এসেছে ফারাওদের কীর্তি। সে তুলনা করতে পারে। স্থাপত্যে দুটি দেশ বেশ এগিয়ে। মিসরের পিরামিডকে সে এগিয়ে রাখে।

তবু নান্দনিক এ মন্দির তাঁদের এখানে আটকে রাখতে পারল না, নিকোমেডেস ও ফাওলিন বের হয়ে বাইরে ঘুরতে চায়। নিকোমেডেস বলল, শর্মিলা, চলুন বাইরে বাগানে বেড়াই।

শর্মিলাকে দেখলেই ফাওলিনের ভেতর এক অজানা ভয় কাজ করে। মন্দিরেই তো ভালো ছিল। সেখানে অনেকেই আছে। ঋষিতুল্য সন্ন্যাসীরা আছে। লোকজনের অনেক সমাগম। কোথায় যেন ভরসা কাজ করে।

বাগানে বেড়াতে বেড়াতে শর্মিলা বললেন, ফাওলিন দিদিকে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেছে। আমি যা কল্পনা করেছিলাম, তার চেয়েও সুন্দর তিনি।

নিকোমেডেস মজা করে বলল, তাই নাকি?

শর্মিলা বললেন, দিদি দেখো, তোমার সৌন্দর্যে আস্থা নেই দাদার।

ফাওলিন সিরিয়াস। মজা বুঝবার মতো অবস্থা তার নেই। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে হাসল। বলল, তোমার পাশে চাঁদও হার মানে। তাই আমার সৌন্দর্য নিকোর দেখার কথা নয়।

একটা কাজ করো, দিদি, তুমি আর দাদা বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখো। আমি হারমিজকে নিয়ে তার ভালো লাগবে, এমন কিছু জিনিস দেখাই। কি হারমিজ, রাজি তো?

বাগানটি সুদৃশ্য গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। আচার্য ভদ্রবাহু দূরদূরান্ত, বিশেষ করে পুণ্ড্রবর্ধন থেকে চারা এনে এই বাগান সৃজন করেছেন। রাজকীয় বাগানটি তার পাশেই। এ বাগানের সঙ্গে সংগতি রেখে তা সৃজন করা হয়েছে। ঔষধি বৃক্ষ থেকে শুরু করে সব রকম ফুল-ফলের গাছ রয়েছে। তবে এখানে গোপন একটি ব্যাপার আছে, কেউ লক্ষ করলে দেখবে, ‘কল্পসূত্রে’ ক্ষত্রিয়াণী ত্রিশূলা স্বপ্নে যেসব বৃক্ষ ও ফুল-ফলের গাছ দেখেছেন, এখানে সেসব বৃক্ষেরই বাগান সৃজিত হয়েছে। তিনি যদি এ বাগানের নাম ‘কল্পসূত্র বৃক্ষ উদ্যান’ দিতেন, তাহলে তা যথার্থ হতো।

বৃক্ষ উদ্যানে হাঁটতে হাঁটতে নিকোমেডেস ফাওলিনের হাত ধরল। ফাওলিন হাত ছাড়িয়ে নিল। নিকোমেডেস আবার হাত ধরে পাশ থেকে সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল, তুমি কথাটা কি ঠিক বলেছ? কেন ওকে সহ্য করতে পারো না? সে খুবই বুদ্ধিমতী সন্ন্যাসিনী। ওর সঙ্গে এমনটা করা উচিত হয় নি।

আমি সবাইকে ছেড়েছুড়ে এখানে এসেছি তোমার কাছে। আমি কেন তোমাকে অন্য কারও হাতে তুলে দেব, আমি এতটা মহৎ নই।

তোমাকে কেউ বলেছে তুলে দিতে?

বলে নি, তবে বলবে, তার পূর্বাভাস আমি পেয়েছি। মেয়েরা সব বুঝতে পারে।

ফাওলিনের কথা শুনে নিকোমেডেস হেসে দিয়ে বলল, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?

বিশ্বাস না করলে এত দূর কেন এলাম? তবে আচার্য কৌটিল্য যে অর্থশাস্ত্রে বলেছেন, জিহ্বার নিচে মিষ্টি রেখে কেউ যদি বলে, আমি মিষ্টির স্বাদ পাই নি, তা বিশ্বাস করতে হবে?

নিকোমেডেস উচ্চ একটা হাসি হেসে বলল, এ কথা। এরপর চিবুক ধরে মুখটা ওপরে তুলে বলল, দেখো তো, এ চোখে কাকে দেখা যায়?

মনে তো দেখা যায় না, সেখানে কবরস্থান।

দেখাতে হবে?

না দেখলে বুঝব কেমন করে?

তুমি না মাঝেমধ্যে একদম ছেলেমানুষ হয়ে যাও। চলো বসি কোথাও।

পাথর দিয়ে মাঝেমধ্যে বসার এবং ধ্যান করার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় পদ্মাসনের ভঙ্গিতে দুজনই মুখোমুখি বসে পড়ল। নিকোমেডেস বলল, এবার চোখ বন্ধ করো। শুনেছি ভারতীয় সন্ন্যাসীরা নাকি চোখ বেঁধে রাখে, ক্রেজি কেউ কেউ চোখ অন্ধ করে দেয় মনের চোখে দেখার জন্য। মনের চোখে মন দেখা যায়। তুমিও চেষ্টা করো। আমিও করছি।

তুমি কেন? আমি তো পাশেই আছি। কাকে দেখার জন্য তোমার ধ্যান?

আমিও তো তোমার পাশে আছি, আছি না?

শর্মিলা হারমিজকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরসীমানা পার হয়ে রাজ উদ্যানে চলে এলেন। এ উদ্যানটি রাজপ্রাসাদ-সংলগ্ন। এ উদ্যানে একটি জলধারা বহমান রয়েছে। বহু প্রাচীন এটি।

উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি। এটি প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট। উদ্দেশ্য, গ্রীষ্মে রাজপ্রাসাদকে শীতল এবং শীতে উষ্ম রাখা। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী এখানে নিরিবিলি সময় কাটাতে আসেন গ্রীষ্ম বা শীতে। এখন বসন্তকাল, প্রায় সব গাছেই ফুল ফুটেছে, স্নিগ্ধ বাতাস প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে।

এই জলের ধারার কাছে এসে শর্মিলা হারমিজকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বিব্রত হওয়ার মতো ফাওলিনের কথাটা মনে ঘুরপাক খেলেও ছোট্ট হারমিজকে বেশ মানিয়ে নিয়েছেন। এ ফুল দেখাচ্ছেন, ও ফুলের নাম জিজ্ঞেস করছেন, গ্রিসে পাওয়া যায় যেসব ফুল, এগুলোর নাম জিজ্ঞেস করছেন। পাখিদের উড়াল, কিচিরমিচির উপভোগ করছেন। পাখিদের নাম জিজ্ঞেস করছেন। এতে বেশ মজা পাচ্ছে হারমিজ।

.

অতিথিশালা থেকে দোভাষীকে নিয়ে রাজকীয় বৃক্ষ উদ্যানে বের হয়েছেন মেগাস্থিনিস। জলধারার ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা সাদা বককে অনেকক্ষণ যাবৎ দেখছেন। দোভাষী বকটির নাম বলল। মেগাস্থিনিস তা উচ্চারণের চেষ্টা করলেন কয়েকবার। শেষবার তাঁর চোখ গেল কিছুটা দূরে প্রবহমান জলের ভেতর একটি প্রতিবিম্বের ওপর। প্রথমে তাঁর মনে হলো এটি দেবী আফ্রোদিতের মূর্তি। প্রতিবিম্ব অনুসরণ করে চোখ একেবারে কপালে উঠে গেল। একজন জীবিত মানবী দাঁড়িয়ে ঠিক ভেনাস বা আফ্রোদিতের ভঙ্গিতে, দিগম্বর দেহসৌষ্ঠব। মাথার চুলের অগ্রভাগ দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকা। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর হারমিজের ওপর চোখ গেল তাঁর। হারমিজকে তিনি চেনেন। সে এখানে কেমন করে এল? আর এই বিবস্ত্র ভেনাসের সঙ্গে করছেই-বা কী? তিনি আবার মানবীর দিকে তাকালেন। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা একই রকম। ত্রিভঙ্গমাত্রার। জলের ওপরের দাঁড়ানো মানুষটা ভাস্কর্যপ্রতিম হলেও জলের নিচের ছবিটা কাব্যিক। মৃদুমন্দ বাতাস জলে যে ঢেউ তুলছে, তাতে ছবিটার আলাদা একটা প্রবৃত্তি প্রকাশ পাচ্ছে। তবে তার সবটা বোঝা যাচ্ছে না, তার অশেষ আবেদনটা সেখানে।

মেগাস্থিনিস ওই নারীমূর্তির কাছে যাবেন। দোভাষী বাধা দিয়ে বলল, ওরা সন্ন্যাসিনী। ওদের সঙ্গে কথা না বলা ভালো।

আমি ওই ছোট্ট মেয়েটির কাছে যাব। মনে হয় ওকে আমি আগে কোথাও দেখেছি। দোভাষী মেগাস্থিনিসের পেছন পেছন গেল। মেগাস্থিনিস জানেন না এ নারীর সঙ্গে কীভাবে কথা বলবেন অথবা তাঁর বলা উচিত। তাঁর কথা বলতে হলো না। হারমিজই প্রথমে বলল, তুমি মেগাস্থিনিস না? আমাদের আগে চলে এসেছ?

তুমি এখানে কেন? তুমি তো সেলুসিয়ায় ছিলে।

এখানে বসন্ত উৎসব হবে। তাই আমরা আবার এলাম। নানা আসে নি, আমরা সবাই এসেছি।

মেগাস্থিনিস লক্ষ করলেন, আফ্রোদিতেপ্রতিম নারীর চেহারায় কোনো সংকোচ নেই। একটা সপ্রতিভ ভাব। মনে হয় তাঁর সঙ্গে কথা বলবেন। তার আগেই হারমিজ বলল, তিনি শর্মিলা। এখানকার মন্দিরে থাকেন। আমরা এ মন্দিরে এসেছি।

আমরা?

আমরা মানে জানো না? আমরা মানে আমি, আম্মু, নানু দিদাইমেইয়া, নিকো মামা আর ফাওলিন আন্টি।

শর্মিলা বিশুদ্ধ গ্রিকে মেগাস্থিনিসকে স্বাগত জানালেন। মেগাস্থিনিসের বিশ্বাস হচ্ছে না, তিনি আসলেই কি দিগম্বর এ নারীর মুখ থেকে গ্রিক ভাষায় স্বাগত শব্দ শুনছেন? তারপরও নিজের পরিচয় দিলেন।

শর্মিলা বললেন, আমরা আপনার আগমনবার্তা আগেই পেয়েছি। আচার্য ভদ্রবাহু আপনার আগমনের কথা আমাদের জানিয়েছেন। তবে তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয় নি।

আমি আচার্যের সঙ্গে দেখা করতে যাব। সেলুকাস আমাকে আচার্যের কথা খুব করে বলেছেন।

কিন্তু এখন নয়।

কেন?

মহামান্য সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে তা সম্ভব নয়, সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই তা সম্ভব।

আমি তো শুনেছি প্রথমে মহামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে, তারপর সম্রাট।

আপনি ঠিক শুনেছেন। এটাই এখানে নিয়ম।

আপনাকে পেয়ে ভালো লাগল। আরও ভালো লাগছে যে আমার কথা বলার মানুষ পাওয়া গেল।

মেগাস্থিনিসের কথা শুনে শর্মিলা মৃদু হাসলেন।

হারমিজ বলল, তুমি এখানকার ভাষা শিখতে চাইলে তাঁর সাহায্য নিতে পারো।

তোমার পরামর্শ আমার মনে থাকবে।

তাঁদের বৃক্ষ উদ্যানে বিলম্ব দেখে ভদ্রবাহুর টেনশন হচ্ছে। তিনি স্থুলভদ্রকে ডেকে বললেন, তুমি অতিথিদের একটু খোঁজখবর নাও। মনে হয় এরা মন্দির থেকে বের হয়ে বৃক্ষ উদ্যানে গেছে।

নিকোমেডেস ফাওলিনকে বোঝানোর চেষ্টা করল, তার মনে ফাওলিন ছাড়া আর কেউ নেই। শর্মিলাকে সে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, এই যা। বলল, তোমারও উচিত হবে ভদ্রবাহুর মতো শর্মিলাকেও সম্মান করা, বন্ধু বলে মনে করা

এই বৃক্ষ উদ্যানে আরেকজন ব্যক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় হলো। লোকটি নিজের নাম বরাহ মিহির বলে পরিচয় দিল। বলল, চলুন উদ্যানটি ঘুরেফিরে দেখাই। রাজকীয় উদ্যানে বাইরের কেউ আসার কথা নয়। সম্রাটের লোকই মনে হলো তাদের। এরা তাকে অনুসরণ করল। হঠাৎ করেই উদ্যানটিকে তাদের কুয়াশাচ্ছন্ন মরুভূমি মনে হলো এবং এরা অসুস্থ বোধ করল।

এ সময় স্থুলভদ্র এসে উপস্থিত হলেন। তিনি বরাহ মিহিরকে দেখে চমকে উঠলেন। সমস্যা আঁচ করতে পেরে তাদের বরাহ মিহিরের কবল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন। পেছনের দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। সংস্কার রয়েছে, তাতে অমঙ্গল হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *