৭৮
মহামন্ত্রী চাণক্য ও আচার্য ভদ্ৰবাহু আগেভাগে পাটালিপুত্রে এসে পৌঁছেছেন। তাঁদের সম্রাটই অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন এই বলে যে সম্রাটের প্রাসাদ যেন সম্রাজ্ঞীর আগমনে উত্তমরূপে সাজানো হয় এবং মনে রাখা হয়, এই প্রাসাদে একজন গ্রিক রাজকুমারী সম্রাজ্ঞী হয়ে আসছেন।
ভদ্ৰবাহু চিত্রশিল্পী, মঞ্চ নির্মাতা ও বাঁশিওয়ালাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। চাণক্য বললেন, এদের বুদ্ধি কিংবা শিল্পরুচিতে প্রাসাদ সজ্জিত করা চলবে না, করলে সম্রাজ্ঞীর ভালো লাগা স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
কেন কেন? সম্রাজ্ঞী তো তাদের খুবই পছন্দ করেন।
তা করেন। কিন্তু আবেগ থেকে করেছেন, যখন আবেগ চলে যাবে, তিনি আর ভারতীয় কিছু পছন্দ করবেন না।
ভদ্রবাহু তর্ক করে বললেন, উল্টোটাও হতে পারে। তাঁকে যত দূর জেনেছি, মনে হয় না তিনি আবেগতাড়িত। তারপরও ভালো না লাগলে আমরা গ্রিক সাজসজ্জার ব্যবস্থা করব। স্থপতি বা সাজসজ্জাকারীদের গ্রিস থেকে আনিয়ে নেব।
কাজটা আপনাকে দুবার করতে হবে।
তবু আচার্য, আমি ভারতীয় সাজসজ্জার সঙ্গেই সম্রাজ্ঞীর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। গ্রিক সংস্কৃতির কথা বললেও চাণক্য খাঁটি ভারতীয় অলংকরণে রাজপ্রাসাদ ও পাটালিপুত্র নগরীকে সাজালেন উত্তমরূপে। এটি সাজানোর জন্য তিনি পৌরাণিক জ্ঞান ও স্বর্গীয় ধারণাকে কাজে লাগালেন। মাথায় তাঁর ভারতীয় ঐতিহ্যের চৌষট্টি কলাই কাজ করেছে। স্থাপত্যশিল্পের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার রেওয়াজ এবং শিক্ষার কথা পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয়ই রয়েছে। তবে তিনি তা করতে গিয়ে আচার্য ভদ্রবাহুর সৃষ্টির শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু তাঁকে এ সম্পর্কে কিছুই বললেন না। কাজ শেষ হলে একদিন ভদ্রবাহুকে দেখাতে নিয়ে গেলেন। ভদ্রবাহু অবাক হয়ে দেখলেন দিব্যসুন্দর, স্বর্গীয় সেই প্রাসাদ যেন এটি, যা তিনি কল্পসূত্রে কল্পনা করেছেন। উৎকর্ষ, দীপ্তিময়, উদ্ভাসিত, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বিস্তৃত সৃষ্টির সংতাপক সৌন্দর্য মন-চোখ-হৃদয় ভরিয়ে দেয়। এক হাজার আটটি চমৎকার কলাম অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা—স্বর্ণে আবৃত, তাতে নানা দামি পাথর ও মণি বসানো। সেখানে জ্বলছে অদ্ভুত সব বাতি। যেন স্বর্গ থেকে দ্যুতি বের হয়ে আসছে। মুক্তো বসানো জানালার পর্দাগুলো ঝলমল করছে। এগুলো টাঙানো হয়েছে স্বর্গীয় ফুলমাল্যপ্রতিম দুর্লভ সুতা যুক্ত করে করে। সুতিবস্ত্রে তৈরি পর্দার ওপর অঙ্কন করা হয়েছে নানা চিত্র। ভবদানবের কীর্তি ছিল প্রাসাদ অলংকরণ ও মসৃণ করে তোলা। ছবি অঙ্কনের কীর্তি সরোজ পটুয়ার। সে পর্দাগুলোয় অবিকল ঘাড় কাত করা ষাঁড়, ধাবমান ঘোড়া, চিৎকার করতে থাকা উলফ, সন্তরণ ও জলকেলিরত ডলফিন, নানা জাতের উড়ন্ত পাখি, সর্প, হরিণ, কিন্নর, ষড়ভ, ইয়ক, হাতি এবং নানা রকম ফল, লতাপাতা আর বৃক্ষের ছবি এঁকেছে। মানুষের ছবি এঁকেছে এসবের সঙ্গে সংগতি রেখে। জীবন্ত ছবিগুলো দেখে মনে হবে মানুষের ছবিগুলোর অনুষঙ্গ যেন অন্য ছবিগুলো। কোনো ছবি পেশিবহুল এস এম সুলতানের ছবির মতো। কোনো কোনোটি রুগ্ণ ঠিক যেন জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবি। ধাবমান ঘোড়াগুলোই শুধু গতি ও শক্তিমত্তার পরিচয় দিচ্ছে, যেন ফিদা হুসেনের ছবি। বাইরে কাঠের যে প্রাচীর, তাতেও রং করেছে সে। প্রচুর রঙের প্রয়োজন ছিল। বাঁশিওয়ালার সহযোগিতায় লতা-পাতা গাঙের মাটির সঙ্গে আরও কী সব মিশিয়ে স্থায়ী একটা রং বানিয়ে নিয়েছে সে।
আচার্য ভদ্ৰবাহু অবাক হয়ে বললেন, এত কিছু করতে পারল সে?
আমাদের লোকজনও সাহায্য করেছে। এই যে মসৃণ মেঝেটা, ভবদানব করে দিয়েছে মঞ্চের ধারণা থেকে।
মনে হয় জল ঢেলে রেখেছে। স্ফটিক পাথর ব্যবহার করেছে সে।
তার আরও কাজ আছে। এতগুলো স্তম্ভে স্বর্গীয় আভাটিও এনে দিয়েছে সে। সেখান থেকে
দ্যুতি বের হয়! রুপোর মসৃণ লতায় সোনার পাখিও সেই এনে বসিয়েছে। জ্যোৎস্নারাতে মশাল নিভিয়ে দিলে মনে হবে স্বর্গে বসে আছি আমরা। প্রবেশ তোরণের সামনেটা মনে হবে জলাশয়ের সম্মুখভাগ, ক্রমাগত চলমান সৌন্দর্যের রুপোলি মিছিল।
চাণক্য বললেন, ভবদানব বলছিল বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজালে তাদের সৃষ্টিশীলতা বেড়ে যায়।
মিথ্যে বলে নি। আচার্য, শিল্পটা তাদের সন্দেহ নেই, কিন্তু পরিকল্পনাটা কার?
আপনার। আপনার কল্পনার কল্পসূত্র তার উৎস। আপনাকে শ্রদ্ধা করেন নতুন গ্রিক সম্রাজ্ঞী, এবার আপনার কল্পনার জগতে এঁরা ভাসবেন। মুগ্ধ হবেন। ভারতীয় ঐতিহ্যে অবগাহন করবেন—এই তো।
ভদ্রবাহু যে বুঝতে পারেন নি, তা নয়। যতই দেখছিলেন, ফিরে যাচ্ছিলেন কল্পসূত্রে। নিজে কিছু না বলে চাণক্যের মুখ থেকে তা শুনতে চাচ্ছিলেন। তিনি আরও উপলব্ধি করেন, চাণক্য তিনজনকে এর মাধ্যমে খুশি করতে চাচ্ছেন। সম্রাটের সঙ্গে তাঁর যে দূরত্ব, তা যদি কেটে যায়, মন্দ কী, সে চেষ্টা তো তিনিও করে যাচ্ছেন।
ভদ্রবাহুকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে চাণক্য আবার বললেন, আচার্য, আপনার কল্পসূত্রের সবটা তখন আমি বুঝতে পারি নি। ভবদানব আর সরোজ পটুয়া গভীরে ডুব দিয়ে মণি-মাণিক্য তুলে এনে বুঝিয়ে দিল, আপনি কী বলতে চেয়েছেন।
ভদ্ৰবাহু হেসে দিয়ে বললেন, আপনি আমাকে সব সময় বড়ভাবে দেখেন বলে এমনটি মনে হয়। ছোটকে বড় করে দেখা মহৎ মানুষের স্বভাব। আপনার মহত্ত্বের প্রকাশ সর্বত্র।
অন্য বিষয়ের কথা জানি না, এবার কিন্তু যথার্থ বলেছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
ভদ্রবাহু জানেন, চাণক্য কোনো কাজই উদ্দেশ্য ছাড়া করেন না। তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। আপাতত তা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে তাঁর নৈকট্য বাড়াবে বলে মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও কী ফল বয়ে আনবে, কে জানে। তবে কাজটি সুন্দর হয়েছে।
চাণক্য আবার বললেন, শুধু সম্রাটের প্রাসাদ ও নগরতোরণ নয়, নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও এদের কাজে লাগাতে চাই।
একটা সূত্রে সবকিছুর সংস্কার হয়ে গেলে মন্দ হয় না। সম্রাটের ফিরে আসার আগে তা সম্পন্ন করতে পারলে ভালো হয়।
নকশাটা আমি আপনাকেও দেখাতে চাই। সুবন্ধু নকশাটা আপনাকে দেখাবে। পরে আপনার পরামর্শ জেনে নেব। আরেকটি বিষয়, যুদ্ধে রাজকোষ প্রায় শূন্য।
তাহলে নগর সংস্কারে অর্থ আসবে কোথা থেকে? আর একজন সম্রাজ্ঞী আসবেন শূন্য হওয়া রাজকোষের রাজধানীতে?
রাজস্ব বাড়াতে হবে।
তা কি ঠিক হবে?
সৈন্যরা লুটপাট করার সুযোগ পায় নি, এদেরও বিজয়ভাতা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে হবে।
বিষয়গুলো নিয়ে আপনি সম্রাটের সঙ্গে কথা বলুন। এককভাবে দায়িত্ব নেওয়ার মধ্যে ঝুঁকি আছে। সুন্দর কিছু দেখতে কার না ভালো লাগে।
কিন্তু নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি আমি করবই।
বেশ, তা-ই করুন।
আমি জানি, সম্রাজ্ঞী আপনার মন্দিরে একবার হলেও আসবেন। তাই এ মন্দিরের সংস্কার হবে।
সম্রাটের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
এখানে আপনার অনুমতি দরকার, সম্রাটের নয়।
তবু।
আমি বুঝতে পেরেছি, আচার্য। নগরের সৌন্দর্য বাড়াবে, নিশ্চয় জৈন মন্দিরটি নগরের বাইরে নয়।
তা বলতে পারেন।
তাহলে আপনার অনুমতি মিলল।
এক শর্তে।
কী শর্তে?
অপরাপর ধর্মীয় মন্দিরগুলোও সংস্কারের আওতায় আনতে হবে।
চাণক্য বললেন, শর্তে আমি রাজি। বলে দুজনেই বেশ হাসলেন।
.
নিকোমেডেস মিসরে ফিরে যেতে চাইছিল। কর্নেলিয়া বললেন, পাটালিপুত্রে না গিয়ে ইজিপ্ট কিংবা সেলুসিয়ায় যাওয়া যাবে না।
নিকোমেডেস বলল, সম্রাজ্ঞীর আদেশ বলে কথা!
তোরা দুজন কি আগে পাটালিপুত্রে চলে যাবি? এখানে অস্বস্তি বোধ করলে সেখানে রাজধানীতে ভালো লাগবে।
এখানে তো খারাপ লাগছে না। বেশ মজা হচ্ছে, বলল ফাওলিন!
বলছিলাম, তোরা আগেভাগে গেলে আমার জন্য সুবিধে হয়।
এখনো কি আশঙ্কার মধ্যে আছিস? নিকোমেডেসের কথার জবাবে কর্নেলিয়া বললেন, না, সে রকম না। আমার অবর্তমানে পাটালিপুত্রটা দেখে নিলি।
এতে তোর সুবিধে কী হবে?
প্রাসাদের ওরা কে কী মনে করছে, তা জানা যেত।
এ কথা? ঠিক আছে, ব্যবস্থা কর।
সেখানে আচার্য দুজনই আছেন। তোদের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। আমি চন্দ্রকে বলে দোভাষীর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তাঁর লোকজনই তোদের যাওয়ার ব্যবস্থা করবে।
তোমরা কবে যাচ্ছ, তা-ই বুঝতে পারছি না, বলল ফাওলিন।
এখানকার পাট চুকিয়ে তবে যাওয়া। প্রস্তুতি চলছে।
নিকোমেডেস বলল, তা তো দেখছি দীর্ঘদিন যাবৎ।
তোরা মিলিটারি মানুষ, ঝটপট সবকিছু করে নিতে পারিস। আমরা তা পারি না!
এ সময় লাউডিস তার মেয়েকে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
ওরা যাচ্ছে, বললেন কর্নেলিয়া।
ওরা মানে? কারা?
নিকো আর ফাওলিন।
কোথায় যাচ্ছে, ইজিপ্ট?
ফাওলিন হাসি দিয়ে বলল, না, পাটালিপুত্রে। সেখানে বসন্ত উৎসব হবে।
মা, আমরাও যাব, প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল হারমিজ।
ওরা আগে গিয়ে কী করবে, লাউডিস প্রশ্ন করেন।
ফাওলিন বলল, গুপ্তচরবৃত্তি করব।
না না, ম্যাডভান্স পার্টি হিসেবে যাবে।
আমি তোর বড় বোন না হলে আমিও আগে যেতাম।
বড়রা যেতে পারবে না, কে বলল? আমিও যাব। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে দিতে দিদাইমেইয়া আরও বললেন, আমরা পর্যটক হিসেবে যাব আর রাজকীয় অতিথি হয়ে থাকব। সবাই মিলে বসন্ত উৎসব করব।
লাউডিস বললেন, পিসি, তুমি ছেলেমানুষই রয়ে গেলে।
দেখ লাউডিস, তুই যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিয়ে এখানে এসেছিলি। ধর, ওরা তোর কাছে পরাজিত হয়েছে, তুই পাটালিপুত্র দখল করে নিয়েছিস, তাহলে যেতি না?
দুটো বিষয় কি এক হলো?
দুটো বিষয়ের মধ্যে একটা কমন এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো পাটালিপুত্রে যাওয়া। অবস্থা বা পরিস্থিতি যা অনুমোদন করে, তা-ই তো বিবেচনা করতে হবে। এখন মৌর্যরা আমাদের পরম আত্মীয়, কাজেই…
হারমিজ কিছু না বুঝেই দিদাইমেইয়াকে সমর্থন করে বলল, একদম ঠিক।
সবাই তা শুনে উচ্চ স্বরে হেসে উঠল।