মৌর্য – ৭৭

৭৭

পাটালিপুত্রে যাওয়ার আগে হেলেনের ইচ্ছাতে চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে নিয়ে ঝিলামের বিনোদন প্রাসাদে গেলেন। সেলুসিড শাসনের অবসানে বিনোদন প্রাসাদটি অবহেলার শিকার হয়ে আছে। তবু সম্রাজ্ঞী আসবেন শুনে তাৎক্ষণিক ধোয়ামোছা এবং কিঞ্চিৎ সংস্কারও করা হয়েছে।

প্রাসাদের একদিকে প্রমোদ উদ্যান এবং অন্যদিকে ঝিলামের বিলাসবহুল ঘাট। চন্দ্রগুপ্ত প্রথম হেলেনকে দেখেছিলেন এই প্রমোদ উদ্যানে। দুজন প্রথমে প্রমোদ উদ্যানে ঢুকলেন। উদ্যানটিও পরিচর্যার অভাবে সৌন্দর্য হারিয়ে আছে। একে তড়িঘড়ি করে সাফসোফ করা হয়েছে বোঝা যায়।

তবে বসন্তের বাতাস এবং নানা ফুলের সমাহার সবকিছুকে ছাড়িয়ে যেন প্রকৃতির এক উৎসব শুরু করেছে। এমন উৎসবে আত্মহারা দুজনই।

একটা রাজকীয় দোলনায় বসলেন দুজন। চন্দ্রগুপ্ত হেলেনের একটি হাত টেনে নিয়ে বসেছেন। হেলেন এক অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললেন, এখানেই একজন সম্রাট ঘোড়ার ব্যবসায়ী সেজে আমাকে ধোঁকা দিতে এসেছিলেন। আমি একটুও বুঝতে পারি নি। তিনি তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন, আমার বোঝা উচিত ছিল, লোকটি কেন এভাবে আমার দিকে তাকায়।

আমি সত্যিই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আচার্য বারবার ডাকছিলেন, আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিচ্ছিলাম না। তাঁর ভয় ছিল, পাছে ধরা পড়ে যাই। ব্যাপারটা অদ্ভুত ধরনের রোমাঞ্চকর।

আমার এক সহচরী বলেছিল, ঘোড়া বিক্রেতাদের সুবিধের মনে হচ্ছে না। আমি তার কথায় পাত্তা দিই নি। কিন্তু পরে যখন সত্যিই আরবীয় ঘোড়া আর পাওয়া যায় নি, তখন সে তার ধারণা সত্য বলে চেঁচাতে থাকল। আমি নিজেকে সত্যি সত্যিই বোকা ভাবতে শুরু করলাম এবং অবশেষে আমার ভুল সত্যে পরিণত হলো, যখন হাতে এক পাগল প্রেমিকের পত্র এল।

আমি কিন্তু সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম, বলে খুব হাসলেন চন্দ্রগুপ্ত।

উদ্যানে মারবেল পাথরের টেবিল এবং আসন বসানো আছে। দাস-দাসীরা এর ওপর নানা ফলাহার, পানীয় ও শুকনা খাবার সাজিয়ে রেখেছে।

ফলের রসে চুমুক দিয়ে হেলেন বললেন, কী অদ্ভুত ব্যাপার, এই প্রাসাদ উদ্যানে সহচরীদের নিয়ে কত দৌড়ঝাঁপ, হইচই করেছি আমি। এরা এখন কেউ নেই। একান্তভাবে শুধু একজনের সান্নিধ্যে আছি। দিন বদলায়, জীবনও বদলায়, ভাগ্যেরও বদল হয়।

তুমি সুখী নও, হেলেন?

এ কথা কেন বলছেন?

ভাগ্যের কথা বললে যে?

সব আশা কি পূর্ণ হয়? যাদের মধ্যে জন্মেছি, আশপাশে তো এরা কেউ নেই।

নিকোরা এলে বোধ হয় ভালো হতো।

নিকো ভালোই করেছে, আসে নি। আমি একান্তে এই বসন্তে আপনাকে চেয়েছি। যখন কাছে পেলাম, মনে হচ্ছে কোথায় যেন অপূর্ণতা রয়ে গেছে। সহচরী, সাথি-সঙ্গীদের কথা উপলক্ষমাত্র, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, অপূর্ণতাটাই পূর্ণতার দিকে সতত ধাবমান রাখে। এই যে আমার পাশে আছেন, তবু মনে হয় কী যেন নেই। যখন কাছে ছিলেন না, তখন নির্দিষ্ট করে জানতাম কাছে নেই বলেই যত শূন্যতা, অপূর্ণতা। অথচ এখন…।

তোমার জগৎ অনেক বড়, হেলেন। এই বসন্তে এখানে সবকিছুই আছে। কোকিলের কুহুতান শুধু নেই। প্রকৃতির এই শূন্যতা বসন্তের সব সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে যেন তোমার মনের কথাই বলছে।

ফলের রস পান শেষ হলে হেলেন বললেন, চলুন বাগানে হাঁটি।

বাসন্তী রঙে সাজ করেছে প্রকৃতি। বৈষয়িক বিষয়গুলো যেন একেবারেই মন থেকে বিদায় হয়ে যায় এ রকম পরিবেশে। আবেগ, ভাবালুতা মনের ওপর ভর করে। কথা হয় কম। মাঝেমধ্যে মন হারিয়ে যায়। পাশাপাশি হাঁটছেন এঁরা বাগানের শানবাঁধানো পথে। সান্নিধ্যটাই ভালো লাগছে। ফুলের গন্ধ এবং ভ্রমরের গুঞ্জন ভালো লাগায় বাড়তি কিছু যোগ করেছে।

এ রকম পরিবেশে কবিতার জন্ম হয়। এঁদের কেউ কবি নন। প্রকাশের ভাষা নেই তাঁদের। কিন্তু কবিত্ব জন্মেছে তাঁদের মধ্যেও। চন্দ্রগুপ্ত আবৃত্তি করছেন ‘কল্পসূত্রে’র মোহময় শ্লোক। হেলেন আবৃত্তি করছেন হোমারের মহাকাব্য থেকে বিশেষ কোনো শ্লোক, যেখানে হেলেন পেরিসকে বলছে, প্রেম হচ্ছে সে জিনিস, যা একজন নারীকে ঘর-সংসার থেকে বের করে আনে এবং পালিয়ে নিয়ে যায় প্রেমিকের কাছে। মহাকাব্য হলেও ইলিয়াড গীত হতো, বললেন হেলেন। স্পার্টার রাজা ম্যানিলাসের রানি ছিলেন হেলেন। ভালোবেসে ট্রয়ের কনিষ্ঠ রাজপুত্র পেরিসের সঙ্গে পালিয়ে যান, যোগ করলেন তিনি।

রামায়ণে আছে সীতা অপহরণের কাহিনি।

তা জানি আমি। আচার্য ভদ্রবাহু আমাকে বলেছেন।

ভারতীয় ঐতিহ্যে প্রেম নয়, সতিত্বই বড় কথা

আমাদের ঐতিহ্যে প্রেম। আমি যদি আপনাকে ভালো না বাসতাম, তাহলে যুদ্ধ করেও আমাকে পেতেন না, আমরা পরাজিত হলে আমি আত্মহত্যা করতাম। আপনার প্রেম আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

কী সৌভাগ্য আমার, বলে হাসলেন চন্দ্রগুপ্ত।

আমার একটা ইচ্ছা এখন পূর্ণ করতে হবে। বলুন করবেন?

ইচ্ছাটা কী?

আপনি আপনার সব নিরাপত্তা প্রহরীদের বাগান ছেড়ে চলে যেতে বলুন।

তারপর?

আমরা পোশাক খুলে রেখে এই বাগানে হাঁটব, স্বর্গের দেবদেবীর মতো!

ভারি অদ্ভুত ইচ্ছা তো!

ওদের চলে যেতে বলুন।

উদ্দেশ্য আর কিছু নয় তো?

নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ কতখানি, তারও পরীক্ষা হয়ে যাবে।

সম্রাট সব নারী ও পুরুষ প্রহরীকে বাগানের বাইরে চলে যেতে বললেন। ওরা চলে গেলে এঁরা বিবস্ত্র হয়ে গেলেন।

হেলেন বললেন, প্রকৃতিতে এখন আমরা প্রাকৃতজন। শর্মিলা একটা কথা বলেছিল। কী বলেছিল?

আত্মাটাই মূল্যবান। শরীর দিয়ে তাকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। আর পরিচ্ছদের প্রয়োজন কী। অবশ্য এটা আচার্যের কথা। সে আমাদের দেবী আফ্রোদিতের মতো দাঁড়ায়। মাথার চুল দিয়ে লজ্জার স্থান ঢেকে রাখে। আর ডান বাহু লম্বালম্বি করে বক্ষযুগলকে আড়াল করে।

চন্দ্রগুপ্ত মজা করে বললেন, আমাদের সম্রাজ্ঞীর তো লম্বা চুল নেই, গ্রিককাট চুল, তিনি কী করবেন?

লজ্জা পাচ্ছেন, সম্রাট?

তা না, ভাবছি অদ্ভুত সব খেয়াল কোথা থেকে আসে।

আরও অদ্ভুত সব পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে আপনাকে। ভয় নেই, আপনার মর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখব। এখন কেমন লাগছে আপনার?

ভাবছি রামায়ণের ক্রৌঞ্চ মিথুনের মতো অবস্থা সৃষ্টি হলে নিয়ন্ত্রণ হারাতে হবে।

স্বর্গীয় দেবদেবীদের কথা ভাবুন। দেখার, উপলব্ধি করার, উপভোগ করার নানা দিক আছে। ভোগাকাঙ্ক্ষার মধ্যে তা হারিয়ে যায়। ধরুন আমরা আজ সন্ন্যাসী, কৃচ্ছ্রতা সাধন করছি।

একটু ভেবে হেলেন আবার বললেন, না না, সন্ন্যাসী না, দেবদেবীও না, সাধারণ অরণ্যচারী মানব-মানবী। এর মধ্যেই প্রকৃতিকে উপভোগ করতে হবে।

বসন্তের বাতাস সারা শরীরে পরশ বোলাচ্ছে। কিছুক্ষণ হেঁটে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, সত্যিই ভালো লাগছে, বাতাসটা অসাধারণ।

বাতাস না থাকলে আরও একটা অসাধারণ ব্যাপারের সঙ্গে আমরা পরিচিত হতাম।

সেটা কী?

স্তব্ধতা, যার মধ্যে শুকনো পাতা পতনের শব্দও উপভোগ করা যায়।

তাহলে সেটা পাওনা থাকল। গভীর অরণ্যে তা ভালো উপভোগ করা যায়। জ্যোৎস্নারাত হলে আরও ভালো হয়।

বেশ, আমরা একবার গভীর অরণ্যে যাব, বললেন চন্দ্রগুপ্ত। বাগানের ভেতরে একটি ঝরনা আছে। ঝরনার পানি পতিত হয়ে একটি ছোট জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। হাঁটতে গিয়ে এই জলাশয়ের কাছে এসে থামলেন হেলেন। বললেন, জলে নামতে হবে, চলুন।

জল মোছার বস্ত্র তো নেই।

আরে, আসুন তো।

জলাশয়টির জল বেশ স্বচ্ছ। এই জলে হেলেনকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। যেন তিনি নীল সলিলবাস পরিধান করেছেন। আফ্রোদিতেকে স্বচ্ছ জলে নামলে যা হতো, তাই হয়েছে। মৃদু ঢেউয়ে দুলছে বক্ষযুগল। ভেঙে যাচ্ছে নিতম্ব, যেন কোনো ভাস্কর্যশিল্পীর চতুরতায় সৃষ্টি হচ্ছে নানা ভঙ্গির বহুমাত্রিক শিল্প।

কী অসাধারণ!

স্পর্শ করবেন না, শুধু দেখে যাবেন। দেখার মধ্যে মুগ্ধতা আছে, আপনাকে দেখে তা উপভোগ করছি আমি।

বেশ কিছুক্ষণ জলকেলি করে হেলেন বললেন, চলুন এবার ওঠা যাক।

উঠতে ইচ্ছা করছে না, বললেন চন্দ্রগুপ্ত।

তাহলে আরও কিছুক্ষণ থাকুন।

ঝিলামে সাঁতার কাটতে পারলে খুব মজা হতো।

এভাবে?

না, এভাবে না।

বিকেলে আমরা শানবাঁধানো ঘাটে বসব। আপনি চাইলে নৌবিহারও হতে পারে।

নৌকা ঘাটে বাঁধা আছে। আমরা নৌকায় চড়ব।

বেশ, তাহলে ওঠা যাক। কিন্তু সাঁতারেই বেশি মজা।

ঝিলামে নৌবিহার হেলেনকে অনেক স্মৃতির ভেতর নিয়ে গেল। উৎপাত করা প্রেমিক জেনারেল আর্কিমেডেসের কথা মনে হলো। বিশাল আকাশ আর ঝিলামের কলকলতান মুখরিত পড়ন্ত বিকেলে সে তাঁর হাত ধরেছিল। সবই এখন অর্থবহ হয়ে উঠেছে, যা আগে অর্থহীন পাগলামি মনে হতো। জেনারেলের প্রতি তাঁর একরকম মমতার উদ্রেক হলো। বেপরোয়াভাবে যুদ্ধে প্রাণ দিল সে। হয়তো তাঁর জন্যই দিয়েছে। একটি দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল হেলেনের ভেতর থেকে।

চন্দ্রগুপ্তের তা দৃষ্টি এড়াল না। হেলেনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, নদী স্রোতের বহতা মানুষের অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। অনেক অনাবশ্যক স্মৃতিও মনের মধ্যে ভিড় করে। তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে নেই।

হেলেন বললেন, চলুন ফিরে যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *