৭৬
মৌর্য সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর পাঠানো উপহারসামগ্রী সেলুকাসের সামনে রাখা হয়েছে। তিনি এসবের প্রতি মোটেই উৎসাহিত নন।
তুমি কি খুব ব্যস্ত, সেলুকাস? দিদাইমেইয়ার প্রশ্নের জবাবে সম্রাট সেলুকাস বললেন, দিদি, বড় ঝামেলা যাচ্ছে, সবই তোমাকে বলব। এখন কর্নেলিয়ার কথা বলো। কেমন আছে সে?
কর্নেলিয়া এখন হেলেন হয়ে গেছে, সেলুকাস। চন্দ্রগুপ্ত এ নাম দিয়েছে। এরা খুব সুখে আছে। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি কর্নির আকর্ষণ ও মুগ্ধতা ওদের কাছে তার সম্মান ও মর্যাদার আসন সুদৃঢ় করে দিয়েছে।
তা আমি জানি, ও মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু বোন, এ হৃদয় তো সে শূন্যতা মানছে না, মেয়েটি আমার চোখের সামনে নেই, একটি বিজাতীয় সমাজে ঢুকে পড়েছে আমাদের ছেড়েছুড়ে। আপস মানছে না মন।
গ্রিকরা বৈচিত্র্যপ্রয়াসী জাতি। ইউরোপের বাইরে আফ্রিকা-এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। যে সৈনিকটি সেসব দেশের মাটিতে কবরস্থ হয়েছে, সে দেশের মাটি চিরকালের জন্য গ্রিস হয়ে গেছে। গ্রিকরা এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোয় আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। মিসরে টলেমি, সিরিয়া- আফগানিস্তানে তুমি, এন্টিগোনাস উপসাগরীয় দেশসমূহে শাসন চালাচ্ছে। তুমি তোমার সাম্রাজ্যের নাম রেখেছ সেলুসিড সাম্রাজ্য। পরিবর্তন তো এসেছে। তোমরা এখানকার মেয়েদের বিয়ে করছ, তাদের সংস্কৃতি আমাদের পরিবার পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা ব্যাপকভাবে খোলামনে ভাবো একবার। বহুমাত্রিক মানবসমাজের সূচনা তো গ্রিকদের মাধ্যমেই ঘটছে। ইতিবাচকটাই ভাবো। দেখবে আমাদের কর্নি শুধু চন্দ্রগুপ্ত নয়, সব ভারতীয়ের হৃদয় জয় করবে। ভূমি দখল করে রাখা যায় না, হৃদয় জয় করা গেলে তা আর হারায় না। এবার তোমার কথা বলো।
এন্টিওকাসরা ঝামেলা পাকাচ্ছে। তার স্ত্রী এন্টিগোনাসের মিত্রদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এ সংবাদ পাওয়ার পরই আমাকে দ্রুত সেলুসিয়ায় চলে আসতে হলো।
কী চায় ওরা?
আমার উচ্ছেদ। আমার পতন।
তুমি কি নিশ্চিত হয়ে বলছ?
এন্টিগোনাসের সঙ্গে হাত মেলানোর ঘটনা সত্য। তা থেকে ধরে নেওয়া যায় তাদের উদ্দেশ্য কী।
তোমাকে সাবধানী হতে হবে, তা ঠিক আছে। আমার পরামর্শ হচ্ছে, তুমি পারলে এন্টিগোনাসকে পরাজিত করো। দরজায় শত্রু রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
এন্টিওকাস?
সে আগে পারে নি, এখনো পরবে না। তুমি তাকে হাতে রাখো, চোখে চোখে রাখো। আমি ও ব্যাপারটা দেখছি।
এ সময় লাউডিস এবং তার মেয়ে হারমিজকে নিয়ে জেনারেল কিউকেকাস উপস্থিত হলেন।
মাই সুইট, এত দিন পর আমাকে মনে পড়ল, হারমিজকে জড়িয়ে ধরে বললেন সেলুকাস!
তুমি কেন ছিলে না, যা মজা হয়েছে, তুমি একটা বোকা গ্র্যান্ডফা, আমরা খুব মজা করেছি সেখানে। ওরা খুব ভালো, সম্রাট কত আদর করেছে!
তাই বুঝি?
তুমি আমাদের না বলে চলে এসেছ।
তা ঠিক হয় নি, কিন্তু এসে পড়াটাও যে খুব প্রয়োজন ছিল। এখন তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। তুমি ভারতীয় পোশাক পরেছ, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
ভদ্ৰবাহু দাদু দিয়েছেন। সবাইকে দিয়েছেন। তোমাকেও দিয়েছেন।
তোমার সে পোশাকে আচার্য মন্ত্র পড়ে দিয়েছেন। বলেছেন, এ পোশাক পরিধান করলে তুমি সহজে যুদ্ধ জয় করতে পারবে, বললেন দিদাইমেইয়া।
এই পোশাক পরিধান করে যুদ্ধ?
তুমি তো তা দেখোই নি। তিনি আধ্যাত্মিক গুরু।
তা আমি মানছি, কোনো ভারতীয়কে যদি আমি সম্মান করি, তবে তিনি আচার্য ভদ্রবাহু। কর্নির জন্য ভরসা তিনিই।
লাউডিস এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন, বাবা, আসলেই এরা ভিন্ন রকম মানুষ। আন্তরিকতায় ভারতীয়দের তুলনা নেই। এককথায় আমি মুগ্ধ।
কাছে আয়, লাউডিস। তুই নাকি আমার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলি? আমার সেনানায়ক পুত্র এন্টিওকাস আমাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে নি। তুই যুদ্ধ না জেনেও দৌড়ে গেছিস। আমার মায়ের নামে তোর নাম রাখাটা সার্থক হয়েছে, লাউডিস।
বাবা, মৌর্যদের সঙ্গে আমাদের সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। আত্মীয় বলে তো বটেই, জাতি হিসেবেও ভারতীয়রা সেরা।
তুইও বলছিস।
হ্যাঁ বাবা, বলছি।
কিউকেকাস, আমি তোমার অনুপস্থিতি খুব উপলব্ধি করেছি। এখানে যে সমস্যা, তা মোকাবিলা করতে তোমারও প্রয়োজন। তুমি তোমার বাহিনীর কমান্ড আজই বুঝে নেবে। জেনারেল মোলন ও জেনারেল ফিলেকাসের সঙ্গে কথা বলবে। ওরা যুদ্ধে তোমার ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা দেবে।
দিদাইমেইয়া বললেন, তুমি কি শীঘ্রই যুদ্ধে যাচ্ছ?
শত্রুকে সুযোগ ও সময় কোনোটাই দিতে নেই। এ ছাড়া আমাদের সৈন্যরা পরাজয়ের যে গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে, তা দূর করতে হবে। আরেকটি যুদ্ধে জয়লাভই এ গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র পথ।
তুমি ঠিকই বলেছ। আমি তা সমর্থন করি। আমাদের সৈন্যরা হতাশার মধ্যে থাকুক, তা আমি চাই না।
নিকোরা এল না?
ওরা আরও কিছুদিন সেখানে থাকবে।
একজন বার্তাবাহক এ সময় এসে বলল, মহামান্য সম্রাট, মেগাস্থিনিস এসেছেন। তিনি অপেক্ষা করছেন।
আসতে বলো।
কোন মেগাস্থিনিস?
দিদাইমেইয়ার প্রশ্নের জবাবে সেলুকাস বললেন, তার কথা মনে হয় তোমাদের বলেছিলাম। তাকে আমি চন্দ্রগুপ্তের রাজদরবারে পাঠাচ্ছি। কূটনীতি ভালো জানে। তার মাধ্যমেই আমি কর্নেলিয়ার নিয়মিত খোঁজখবরও পেয়ে যাব।
কৌতূহল নিয়ে উদ্বেলিত সেলুকাস পরিবারের মধ্যে উপস্থিত হলেন মেগাস্থিনিস। তাঁর আগমনটা এমন যে মনে হলো একটা নির্বাচনী বোর্ডের সামনে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। দিদাইমেইয়া জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি কোথায়?
আনাতোলিয়ায়।
বয়স কত?
পঁয়তাল্লিশ বছর।
কী করা হয়?
এ কথার জবাব দিলেন সেলুকাস, নানা কাজে ব্যুৎপত্তি রয়েছে তার। আমি তাকে কূটনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী মনে করি।
লাউডিস বললেন, ভারতবর্ষ সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে?
ভারতবর্ষ সম্পর্কে নেই, এশিয়া মাইনরে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছি আমি।
এখন কোথা থেকে এসেছেন?
সিবাইরতিয়াস থেকে।
কোথায় এটি?
আরচোশিয়া সত্রাপে।
লেখাপড়া কিসে?
মানববিদ্যা, ইতিহাস—এসব বিষয়ে।
তুমি যে ইন্ডিয়া যাবে, ভাষা জানো?
এই চমৎকার প্রশ্নটি করে হারমিজ। আরও বলে, আমি ওদের ভাষা না জানায় অনেক জিনিস বুঝিনি। ভাষা না জানলে গিয়ে কী করবে?
মেগাস্থিনিস যেন এই ছোট্ট মেয়েটির কাছে দারুণ জব্দ হয়ে গেছেন। কাঁচুমাচু করে বললেন, জানি না, তবে ঠিক শিখে নেব।
হারমিজ বিজ্ঞের মতো বলল, আগে শিখে নাও, নইলে বড় সমস্যায় পড়বে।
তার কথায় সবাই হেসে দিল। মেগাস্থিনিসও সবার দেখাদেখি হাসলেন।
সেলুকাস বললেন, যা শিখতে হয় শিখে নাও, করতে হয় করো, এক মাস পর তুমি সোজা পাটালিপুত্রে যাবে।
মেগাস্থিনিস স্থানের নামটি নোটবুকে টুকে নিলেন।
সেলুকাস আবার বললেন, ভাষা শেখাটা জরুরি, যদিও ভাষা জানে, এমন কাউকে তোমার সঙ্গে পাঠাব। কিউকেকাস, তুমি এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারো। আবার মেগাস্থিনিসের উদ্দেশে বললেন, জেনারেল কিউকেকাস এইমাত্র ভারতবর্ষে ঘুরে এসেছে। তোমাকে খুব গাইড করতে পারবে। তোমার নিয়োগ চূড়ান্ত। নিজেকে তৈরি করে নাও। বাকি কথা হবে যাওয়ার আগে। মেগাস্থিনিস কিউকেকাসের সঙ্গে বের হয়ে গেলেন। দিদাইমেইয়া বললেন, সে গিয়ে আবার কোনো ঝামেলা বাধাবে না তো?
না না, এ নিয়ে একদম ভেবো না। আমি ওকে ভালোভাবে চিনি। আলেকজান্ডারের সময় থেকে সে আমার জানাশোনা। অনেক কাজে সাহায্য করেছে।
লাউডিস বললেন, দেখো বাবা, আমাদের সম্পর্কটা এখন স্পর্শকাতর।
আমার মনে আছে। তোমরা তাকে দেখে যা মনে করছ, সে এত বোকা নয়। কূটনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী।
হারমিজ মাথা নাড়ে আরও বিজ্ঞের মতো। বলে, না না, গ্র্যান্ডফা, সে বোকার হদ্দ। আবার সবাই হেসে ওঠে।
সেলুকাসের কক্ষ থেকে সবাই চলে গেলে তিনি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন। মনে হবে সিন্ধু অববাহিকায় পরাজয়ের কথাই হয়তো ভাবছেন। একসময় উঠে গিয়ে নিজেই উপহারের বাক্সটা খুললেন। মেয়ের হাতে পাঠানো জিনিসগুলো দুহাতে তুলে বুকে স্থাপন করে শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদলেন।