মৌর্য – ৭৫

৭৫

পরদিন গান্ধারা প্রাসাদে ডাক পড়ল বাঁশিওয়ালা নিখিল, মঞ্চ নির্মাতা ভবদানব ও চিত্রকর সরোজ পটুয়ার।

তিনজনই চিন্তিত। নিখিল আর ভবদানবের কাজ শেষ। তাদের ভুল হয়ে থাকলে সংশোধনের সুযোগ নেই। সরোজ পটুয়ার রঙের কাজ শেষ হয় নি। এত স্কেচ এঁকেছে যে কম সময়ে তা শেষ করা সম্ভব নয়। ছয়টিতে রং করতে পেরেছে। এগুলো অবশ্য সে সরাসরি তুলি দিয়ে এঁকেছে। এগুলো সঙ্গে নিয়েছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে সম্রাটের, বিশেষ করে বিদেশি সম্রাজ্ঞীর পছন্দ হবে কি না। সম্রাটের পছন্দ হলেও সম্রাজ্ঞীর পছন্দ না হলে সবই গেছে।

অপেক্ষমাণদের কক্ষে বসে আছে এরা। প্রথমে নীরবতা ভাঙল নিখিল, আপনাদের কাজ আমাকে পাগল করে দিয়েছে। যে মঞ্চ বানিয়েছেন, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম স্বচ্ছ স্ফটিক জলের ওপর বানিয়েছেন। জুতো খুলতে গেছি, এক ভদ্রলোক বললেন, জল নয়, জল নয়, স্ফটিক পাথর। দামি দামি পাথর আর মণিরত্নগুলো বসানোও হয়েছে ঠিকঠাক। আর পটুয়া, আপনি কি জাদুকর? সাতজনমেও আমি এ রকম আঁকতে পারব না। বাপ রে বাপ! কাপড়ে বটে আনা এগুলো কি চিত্র? দেখি দেখি।

সরোজ একটি চিত্র খুলে মেলে ধরল। বিস্মিত হয়ে নিখিল বলল, অবিশ্বাস্য, এত জীবন্ত! আপনাকে সম্রাট আজ পুরস্কার দেবেনই দেবেন।

ভবদানব বলল, প্রতিটা জিনিসের রং ঠিকঠাক হয়েছে। সম্রাজ্ঞীর গয়নাগুলো, মাথার পুষ্পচক্র অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে, গায়ের রং, নাক-মুখ একেবারেই নিখুঁত।

আপনারা যে চোখে দেখছেন, সম্রাজ্ঞী সে চোখে যদি দেখেন, তাহলেই রক্ষে। আমরা কিন্তু গত রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আপনার বাঁশি শুনেছি। কী করে এমন হৃদয় হরণ করা সুর বাজান। পুরো সময়টাই আমি কোথায় ছিলাম, জানি না।

মদ্যপানের পর যে অবস্থা হয়, আমারও সে অবস্থা হয়েছিল। সুরের এত মাদকতা! হাওয়ায় উড়ছিলাম যেন। ভবদানবের কথায় নিখিল নাগার্সি বলল, এত প্রশংসা করছেন যে ভয় হচ্ছে, কারণ ভুল কিছু আপনারা দেখছেন না, সম্রাট-সম্রাজ্ঞী নিশ্চয় ভুল ঠিক বের করবেন।

সম্রাট সম্রাজ্ঞীসহ আচার্য, মন্ত্রী ও অমাত্যদের নিয়ে দরবারকক্ষে সভা করছেন। বিশাল আয়োজন এবং সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার জন্য মহামন্ত্রীসহ সবাইকে তিনি ধন্যবাদ দিলেন। আচার্য ভদ্রবাহু মহামন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। একপর্যায়ে সম্রাট বললেন, আমাদের এখন পাটালিপুত্রে ফিরে যেতে হবে। রাজধানী দীর্ঘদিন খালি। ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। নগরী ও প্রাসাদকে নবরূপে সাজাতে হবে। নতুনভাবে সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত এলাকাগুলোর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও শাসন সংহত করতে হবে।

মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমরা আমাদের সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই।

সম্রাট সম্রাজ্ঞীর দিকে তাকালেন। সম্রাজ্ঞী মাথা নাড়লেন, অর্থাৎ তিনি কথা বলতে চান। শুরু করলেন এভাবে, ভারতবর্ষের কিছু কিছু দিক আমাকে অভিভূত করেছে এবং জয় করে নিয়েছে। গ্রিকদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, গৌরব করি। গৌরব ও গর্বের বিষয় শিল্প-সাহিত্য-নাটক, দর্শন, জ্ঞান, রাষ্ট্রচিন্তা—এসব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমি দেখেছি, ভারতবর্ষ অনেক এগিয়ে আছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পড়েছি আমি, ভদ্রবাহুর কল্পসূত্রও পড়েছি, (মন্দাকিনী পড়েও অনুবাদ শুনিয়েছে) রামায়ণ-মহাভারতের নাম শুনেছি, কিছু গল্প শুনেছি, যুদ্ধবিদ্যায় দক্ষতা তো নিজের চোখেই দেখেছি। এ জাতির সম্রাজ্ঞী হতে পেরে আমিও গৌরাবান্বিত। আমি আরও গর্বিত এ জন্য যে কৌটিল্য ও ভদ্রবাহুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে আরও কিছুকাল এখানে কাটবে আমার। আমি তিনজন শিল্পীর কাজে অত্যন্ত অভিভূত। মঞ্চ-মণ্ডপ ও তাৎক্ষণিক চিত্রাঙ্কন দেখে এবং বাঁশি শুনে আমি বুঝতে পেরেছি, শিল্পেও ভারতবর্ষ কতটা উচ্চতায় অবস্থান করছে। মহামান্য সম্রাট, আপনি তিনজন শিল্পীকে পুরস্কৃত করুন এবং দরবারে ডেকে সম্মাননা জানান, আপনার কাছে আমার এটাই প্রথম আবেদন।

মহামন্ত্রী বললেন, এরা এসেছেন, সম্রাজ্ঞী। সম্রাট আগেই তাদের ডেকে পাঠিয়েছেন।

তাদের এখনই দরবারে ডাকুন। তাদের সম্মান জানিয়ে আমি আমার কর্তব্য শেষ করি। আপনাদের সহযোগিতা ও প্রদত্ত সম্মানের কথা মনে রেখে আমি এখানকার দিনগুলো কাটাতে চাই। সম্রাটের কাছে যা চেয়েছি, তা পেয়ে গেছি। আরও যদি কিছু দিতে চান, তা হবে আমার যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া।

বাহ্, বাহ্! আমরা আমাদের উপযুক্ত সম্রাজ্ঞী পেয়ে গেছি। মৌর্য সাম্রাজ্যে তিনি মুকুট হয়ে এসেছেন। এমন একজন সম্রাজ্ঞী উপহার দেওয়ার জন্য মহামান্য সম্রাটকে আমরা অভিনন্দন জানাই, কথাগুলো বললেন আচার্য ভদ্ৰবাহু।

সম্রাট কিছু বললেন না, শুধু হাসলেন এবং শিল্পীদের দরবারে ডেকে পাঠালেন।

শিল্পীরা ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে কুর্নিশ করে দাঁড়াল। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বললেন, তোমরা বসো। এরা দাঁড়িয়েই রইল। সম্রাট আবার বললেন, গুণী মানুষদের আমরা সম্মান করি, তোমরা নির্ভয়ে বসো।

এরা আমতা আমতা করে বসল। সম্রাজ্ঞী বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন, সম্রাট, আমি আপনার আগেই কিছু বলতে চাই।

বলুন, সম্রাজ্ঞী।

মহামান্য সম্রাট, রাজকুলেই আমার জন্ম। তাই গ্রিক ঐশ্বর্য আর গর্ব করার বিষয়গুলোর সঙ্গে শৈশব থেকে পরিচিত। সেলুসিয়ায় রাজধানী স্থাপনের পর সেলুসিয়াকে সাজানো হয়েছিল উত্তমরূপে। যে মঞ্চ থেকে সম্রাট সেলুকাস রাজধানী ঘোষণা করেছেন, তা-ও উত্তমরূপে সাজানো হয়েছিল। কিন্তু গতকাল যে মঞ্চ দেখেছি, তার কাছে সেলুসিয়ার সে রাজধানী-ঘোষণা মঞ্চ এখন বড়ই দীনহীন মনে হয়। গ্রিসেও এটি নেই যে একজন শিল্পী বিয়ের অনুষ্ঠান এবং বর-কনের ছবি তাৎক্ষণিকভাবে আঁকে। সম্রাট গত রাতে আমাকে বলেছেন জনকরাজা তাঁর মেয়ে সীতার বিয়েতে নাকি এ রকম চিত্র আঁকার রীতি চালু করে দিয়েছিলেন। আমরা গ্রিকরা ভারতীয় মহাকাব্যের রাম ও সীতার কথা শুনেছি। তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি এঁকে দেওয়া আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। বাঁশিটা আমি প্রথম শুনেছিলাম যুদ্ধের সময়। তারপরই যুদ্ধ, ধ্বংসলীলা, হাজার হাজার সৈন্য এবং সাধারণ মানুষের মৃত্যু। যুদ্ধে জয়লাভ হয় বটে, কিন্তু মানবতার পরাজয় ঘটে। মরুভূমিতে বাঁশিটা কত সুন্দর, জীবন কত মধুর, বোধ হয় কাল সবাই তা দেখেছেন। আমি, আমি এ খবরও রেখেছি কারা কারা গোপনে বাঁশি শুনতে গিয়েছিলেন, বলে হাসলেন সম্রাজ্ঞী। পরে আবার বললেন, অথচ এখানেই গ্রিক-ভারতীয় যুদ্ধে জ্বলেছে হাজার হাজার চিতা। এখানে নিরো যেমন ধ্বংসের বাঁশি বাজায়, নিখিলও তেমনি সৃষ্টির, বলতে পারেন ভালোভাবে বেঁচে থেকে জীবন উপভোগের বাঁশি বাজায়। সম্রাট নিশ্চয়ই তাদের পুরস্কৃত করবেন। আমি অনুরোধ করব তাদের পাটালিপুত্রে নিয়ে গিয়ে রাজকীয় পদে নিয়োগ করতে।

সরোজ চিত্র এনেছ মনে হয়। সম্রাটকে দেখাও। চাণক্যের কথায় সরোজ পটুয়া এগিয়ে গেল সম্রাটের কাছে। খুলে ধরল পটচিত্র। বিয়ের অনুষ্ঠানের চিত্র। দুই রীতির বিয়ের চিত্রই রং করে এনেছে সে। একটি শোভাযাত্রার চিত্রও আছে।

সম্রাট অভিভূত। সরোজ এত সুন্দর এঁকেছে যে চিত্রকর্মগুলো অসাধারণ হয়েছে, বললেন সম্রাট।

হেলেন এই প্রথম নিজের ছবি দেখলেন চিত্রিত অবস্থায়। ছবিগুলো দুই রীতির বিয়ের বলে গ্রিক ও ভারতীয় উভয় আঙ্গিকে আঁকা। গ্রিসে বিয়ের ছবি আঁকা হয় কি না, তার জানা নেই। ব্যাপারটা এ কারণেও তার কাছে বিস্ময়কর। গ্রিক ও মিসরীয় চিত্রশিল্পের প্রায় সবটা দখল করে আছে ভাস্কর্য। চিত্রশিল্প সেখানে শিল্পের অনুজপ্রতিম ভগিনীস্বরূপ। মাধ্যমগুলোও বড় বিচিত্র। বললেন, এ সময়কার (খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) পার্সিফানি অপহরণ চিত্রটি অসামান্য। হোমারের ইলিয়াডে আছে, জিউসের কন্যা গোপন জগতের এই সুন্দরী প্রিন্সেসকে অপহরণ করেছিলেন দেবতা হেইডেস। একে হেলেনিস্টিক চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মনে করা হয়। চিত্রে আছে, বাঁ হাতে পাঁজায় তুলে অর্ধবসনা পার্সিফানিকে নিয়ে পালাচ্ছেন হেইডেস।

নিকোমেডেস সম্রাটের দরবারের কেউ নয়, তবু আমন্ত্রণে এসেছে। সে বলল, মিসরে চিত্রশিল্পের চর্চা আছে এবং একটা ধারার নাম দেওয়া হয়েছে টলেমির চিত্রকলা। তবে এসব চিত্রের মধ্যে টলেমির থিরিয়োফোরোস সোলজার চিত্রটি বিখ্যাত হয়ে গেছে। এটিও সময়ের চিত্র। তবে মিসরীয় চিত্রকলার ইতিহাস গ্রিক চিত্রকলার চেয়ে প্রাচীন। প্রিন্সেস নেফার তাবির দেয়ালচিত্র কত আগের, বলা মুশকিল।

ভদ্রবাহু বললেন, নেফারতিতি, না নেফারতারি?

নিকোমেডেস হেসে দিয়ে বলল, দুজনেরই দেয়ালচিত্র রয়েছে। তবে কে যে এঁকেছে, তা জানা যায় নি।

সরোজ এবার শোভাযাত্রার চিত্রটি তুলে ধরল। এতে প্রতিকৃতির স্পষ্টতা নেই চেহারায়। মোটিভগুলোয় মুনশিয়ানা আছে। তবে ভালো বোঝা যায়, শোভাযাত্রাটি বিয়ের উৎসবের। নর- নারী, শিশু-কিশোরের নানা ভাবভঙ্গি ফুটে আছে তাতে।

সম্রাট মজা করার জন্য বললেন, সরোজ, তুমি বাঁশিওয়ালাকে একটা চিত্র এঁকে দেবে। লম্বা লম্বা চুল থাকবে। কাল সে যা বাজাল না, কী আর বলব!

আমি বলি, সম্রাট? বলে সম্রাটের দিকে তাকালেন হেলেন।

আপনার অবস্থা তো স্বচক্ষে দেখেছি, সম্রাজ্ঞী।

আমাকে সে এ বিশ্ব ছাড়িয়ে অন্য লোকে পৌঁছে দিয়েছিল। কী শক্তি এ বাঁশির।

সম্রাট তিনজনকেই পুরস্কৃত এবং রাজকীয় মর্যাদায় অভিসিক্ত করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *