মৌর্য – ৭৩

৭৩

চাণক্য ভদ্ৰবাহুকে বলছিলেন বিয়ের অনুষ্ঠানটা অনাড়ম্বর হওয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে চন্দ্রগুপ্ত তা চাচ্ছেন না।

আমিও চাচ্ছি না। পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে একটা সম্পর্ক হতে যাচ্ছে, তার আনুষ্ঠানিকতা বড় হবে না, তা হয় না। আচার্য, আপনি যাঁর মহামন্ত্রী, তাঁর বিয়ে সাদামাটা হোক, এটা কী করে হয়? বিশ্ব তাকিয়ে দেখুক ভারতীয়রা কতটা জৌলুশপ্রিয় ও উৎসবপ্রবণ জাতি, বললেন ভদ্ৰবাহু।

মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের রাজ-অভিষেকের মতো সব প্রতিবেশী আর করদরাজাদের উপহার নিয়ে আসতে নিশ্চয়ই নিমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হবে।

এতে কিন্তু বেশি লাভবান হয়েছিলেন ব্রাহ্মণেরা। এঁরা দক্ষিণা হিসেবে শুধু স্বর্ণমুদ্রাই নয়, অসংখ্য দাসীও লাভ করেছিলেন। পূর্বদেশের দাসীদের সুনাম আছে।

লোভ দেখাচ্ছেন কেন, আচার্য, ব্রাহ্মণ্যকাল তো পার হয়ে এসেছি, এখন কোনো দক্ষিণাই লোভনীয় মনে হয় না। আজীবিক ধর্মটা ত্যাগ আর কৃচ্ছ্রতার। তা-ই আমি অনুশীলন করছি। তবে আংশিক। একসময় নিশ্চয়ই তা পূর্ণতা পাবে

চাণক্য এখন আসলেই অনাড়ম্বর এবং কৃচ্ছ্রতার জীবন যাপন করছেন। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়ও তার বাস্তবায়ন চাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে আচার্য ভদ্রবাহু তা লক্ষ করছেন। যুদ্ধে প্রচুর খরচ হয়েছে। জয়লাভের পরও শত্রুপক্ষ থেকে কোনো সম্পদ পাওয়া যায় নি। সিন্ধু অববাহিকায় শুধু শোষণ চালিয়েছে গ্রিকরা। সেখান থেকে এখনই রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে না। বরং যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনে অর্থ ব্যয় করতে হবে রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়নে। উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনে রাজকোষাগার থেকে মুদ্রা ব্যয় করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনের জন্য মহামন্ত্রী সে চেষ্টাই করছেন। তাঁর ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে জৌলুশ আর রাজকীয় গৌরবে বিয়ের মহোৎসব পালনের আয়োজন করা হলো। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজা-মহারাজারা নিমন্ত্রণ পেলেন। সারা মৌর্য সাম্রাজ্যে জৌলুশের সঙ্গে বিবাহ উৎসব পালনের জন্য নির্দেশ জারি করা হলো। উৎসবের এমন একটা আমেজ তৈরি করা হলো যে এ যেন যুদ্ধজয়ের উৎসবের সঙ্গে বিয়ের উৎসব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

এ তো গেল বাইরের আয়োজন। ভেতরের আয়োজনও দুই রীতির। মূল পর্ব ‘গামোস’, অর্থাৎ বিয়ের দিন। প্রত্যুষে বর এবং কনেকে ধর্মীয় আচারসিদ্ধ প্রথাগত স্নান লৌত্রা সম্পন্ন করতে হলো। তার আগে কর্নেলিয়ার কিছু চুল কেটে নেওয়া হয়। সুগন্ধি জলের সাহায্যে পবিত্র স্নান সম্পন্নের পর গ্রিক পোশাক পরিধান করানো হলো উত্তমরূপে। সুগন্ধি মাখানো হলো কয়েক দফা। সাজে যুক্ত হলো গ্রিক গয়না। দিদাইমেইয়ার নির্দেশনা মেনে লাউডিস ও ফাওলিন যথাসাধ্য উত্তমরূপে সাজালেন কর্নেলিয়াকে। ফাওলিন বউ সাজানোর সময় মিসরীয় রীতির বিয়ের গান গেয়ে শোনাল এবং উপস্থিত সবাইকে এ গানের অর্থ বুঝিয়ে দিল। সবাই খুব মজা পেল, যখন শুনল, এ গানে বলা হচ্ছে, বিয়ের মাধ্যমে কন্যা বরের নাকে রশি বেঁধে দিচ্ছে। পোশাকটা ধর্মীয় রীতিসিদ্ধ। তাই এতে রয়েছে গ্রিক ঐতিহ্যের ছোঁয়া।

এদিকে বরকেও প্রত্যুষে উঠে স্নানাগারে যেতে হবে। সম্রাট ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, ভদ্রবাহুর কল্পসূত্রে বর্ণিত রাজকীয় রীতির স্নান সম্পন্ন করবেন তিনি। কল্পসূত্রে আছে, মহাবীরের পিতা রাজা ক্ষত্রিয় সিদ্ধার্থ বিছানা ছেড়ে ব্যায়ামাগারে প্রবেশ করলেন। চন্দ্রগুপ্তও তা-ই করলেন। পরিশ্রান্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত লম্ফঝম্ফ, ওঠ-বস, কাত-চিত, হস্ত প্রসারণ, ঘাড় বাঁকানো, পদপ্রক্ষেপণ প্রভৃতি করেই চললেন। এতে প্রচুর ঘর্মাক্ত হয়ে গেলেন। দুজন দাসী সম্রাটের জন্য নরম তোয়ালে নিয়ে এসে শরীরের ঘাম মুছে দিল। অতঃপর দুজন তৈলমর্দনে নিপুণা দাসী হাজারবার পরিশোধিত নানা রকম তৈল নিয়ে এল সম্রাটের শরীরে মর্দনার্থে। এ তৈল দেহের তেজদীপ্তি, সৌন্দর্য, পরিপুষ্টি, শক্তি, সব বুদ্ধি ও মেধা বৃদ্ধি করে। দুজন দাসী সম্রাটের মাথা থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত সর্বত্র এ তৈল মর্দন করে দিল নৈপুণ্যসহকারে। নাক, চোখের পাতা, কানের গোড়া, হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল, দুই আঙুলের মধ্যবর্তী স্থান, নাভিমূল—সর্বত্র মালিশ করে হাতের বগলে হাত চালাল। সম্রাট এতে কাতুকুতু অনুভব করে হেসে দিলেন। বললেন, তৈল মর্দনে তোমরা নিপুণ, কিন্তু নিষ্ঠুর। একজন দাসী বলল, মহামান্য, এ তৈল শুধু ত্বক নয়, হাড় পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। সে জন্য আমাদের এ কসরত।

বেশ ভালো, বেশ ভালো, বললেন সম্রাট। তবে আজকের উৎসবের কথা মনে রেখো। যোগ করলেন তিনি।

দাসী দুজন সরে গেলে একজন চৌকস দাস শ্যাম্পুজাতীয় সুগন্ধি পদার্থ নিয়ে এল। সারা শরীরে এই দক্ষ লোকটি তা মেখে দিল। সাধারণত অনুষ্ঠানাদির পূর্বে খুব দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেহে স্নানের পূর্বে তা দলাইমলাই করতে হয়। কাজটা শ্রমসাধ্য ও ক্লান্তিকর হলেও এই দাস কৌশলে শরীরের প্রতিটি অংশে এই সেবা পৌঁছে দিল।

ব্যায়ামাগার থেকে সম্রাট স্নানাগারে গেলেন। সেখানে কয়েকজন দাসী অপেক্ষা করছে। স্নানাগারটি চমৎকার। মণিমুক্তা ও দামি পাথর বসানো। মেঝেটা মোজাইকের, তবে নানা রত্নখচিত। বসার আসনটিও নানা রকম রত্নশোভিত। দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, রাজ্যের সব মণিমুক্তা এখানে জড়ো করার সৌন্দর্যরুচি ও ঐশ্বর্যবোধ সম্রাটের নিজস্ব। সম্রাট এখানে বসলেন। তাঁর শরীরে সুগন্ধিযুক্ত ফুলের পাপড়ি ছড়ানো সুগন্ধি জল ঢেলে দিল একজন দাসী। স্ফটিকপ্রতিম জলের ফোঁটা হিরের টুকরোর মতো সারা শরীর বেয়ে নিচে নেমে এল। একজন দাসী নরম একটি বস্ত্র দিয়ে সম্রাটের মাথা এবং দুজন দাসী দুই হাত দুই পা ও শরীর উত্তমরূপে ডলে দিল। সম্রাটের শরীরের সৌন্দর্য দেখে এরা মুগ্ধ। তাই সসংকোচে কাজ করছে। স্নানাগারের অনেকগুলো জানালা। জানালা দিয়ে আলো এসে পড়েছে সর্বত্র। প্রতিফলিত ও প্রতিসরিত আলো, মণিমুক্তা, মোজাইক, স্ফটিকজল, নারী সংসর্গ প্রভৃতি, সম্রাটের শরীরের ওপর পড়ে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। সম্রাট সরোবরের মতো একটি ছোট্ট জলাধারে নামলেন। এই জলেও সুগন্ধি মেশানো। দাসীরা নামল কেউ কেউ। সম্রাটের মাথায় জল ঢেলে দিল। কেউ কেউ হাত ধুয়ে দিল, পা ধুয়ে দিল। একসময় সম্রাট জলাধার থেকে উঠে এলেন। হিরের টুকরো যেন ঝরে পড়ছে শরীর থেকে, তেমনি ঝরে পড়ল জলের ফোঁটা। মোলায়েম সুতা দ্বারা তৈরি দুটি তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে দেওয়া হলো আলতোভাবে।

শরীর শুকিয়ে গেলে সম্রাটের জন্য রাজকীয় পোশাক আনা হলো। সম্রাট হেসে দিয়ে বললেন, তোমরা গ্রিক সম্রাটের উপহার হিসেবে দেওয়া গ্রিক পোশাকটা নিয়ে এসো। পোশাকের সঙ্গে মানানসই জুতো আর দামি গয়না আনবে।

সম্রাট সেলুকাস মেয়ে-জামাইয়ের জন্য গ্রিক প্রথামতো পোশাক পাঠিয়েছিলেন। গ্রিক রাজকীয় গয়না ও মুকুটও ছিল পোশাকের সঙ্গে। ছিল ঐতিহ্যবাহী জুতো। এসব পোশাক পরিধানের পর একজন দাসী একটা স্বচ্ছ জলপাত্র সামনে এনে রাখল। গ্রিক নৌশার পোশাকে নিজেকে দেখে হাসলেন তিনি। দাস-দাসীদের বললেন, কেমন লাগছে?

ওরা কিছু না বলে শুধু স্মিত হাসল। সম্রাট আবার বললেন, নতুন সম্রাজ্ঞীর সম্মানে এ সাজপোশাক। দেখে খুব খুশি হবে, তাই না? সবাই আবার হাসল। নানা সুগন্ধি মাখা হলো পোশাকে।

বাইরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন আধ্যাত্মিক গুরু আচার্য ভদ্রবাহু, মহামন্ত্রী চাণক্য, মন্ত্রী, রাজন্যবর্গ, রাজপারিষদবৃন্দ, অমাত্য-মহামাত্য, সেনাপ্রধান, সেনাপতিগণ, নর্তকী দলের প্রধান, বাদ্যকর, সম্মুখ প্রহরী নারী দল, পুরুষ দল, ব্যবসায়ী, মার্কেট, নাগরিকা, সমনিধার্ত, অস্তপাল, দৌবারিক প্রশাসত্রি, সান্নিয়াপাল, পৌরব্যবাহারিকা, কর্মিক, গোপ, করণিক নায়েক, প্রদেশত্ৰী, অধ্যক্ষ, গোয়েন্দা, নগরপাল, প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীগণ ও পতাকাবাহী দণ্ডধরবৃন্দ।

সম্রাট বের হয়ে আসার পর সবাই অবাক হলেন। ফিসফিসেয়ে কথা বলছিলেন কেউ কেউ। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় সম্রাট অসন্তুষ্ট হলেন না। সবার উদ্দেশে বললেন, আজকের দিনটি গ্রিক রাজকুমারীর জন্য উৎসর্গীকৃত। এ পোশাক সে ভাষায়ই কথা বলছে।

সবাই উপভোগ করলেন সম্রাটের কথা। সম্রাটের মাথার ওপর ছত্রধর রাজকীয় ছত্র ধরে আছে। সম্রাট প্রথমে যাবেন দরবার হলে। সেখানে অতিথি রাজা-মহারাজা, বিশিষ্ট নাগরিকগণ অপেক্ষা করছেন। দরবার হল থেকে বের হবে শোভাযাত্রা। দরবার হলের কাছে সাজানো আছে শোভাযাত্রার সব আয়োজন। হস্তীযান, অশ্বযান, হাতি-ঘোড়া—সবই সুসজ্জিত করে রাখা আছে। আছে বাঘ ও সিংহও। অবশ্য এরা পোষা প্রাণী। আর আছে বিশাল দুই বৃক্ষ।

দরবার হলে উপস্থিত হলে সম্রাটকে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন। সম্রাট সবার অভিবাদন গ্রহণ করে সিংহাসনে বসলেন পূর্ব দিকে মুখ করে। মহামন্ত্রী সম্রাটের স্তুতির পাশাপাশি সব অতিথিকে স্বাগত জানালেন। এ বিয়ে যে ভারতীয় রাজা-মহারাজা এবং প্রজাকুলের জন্য গৌরবজনক, তা বলতেও ভুললেন না।

সম্রাটের বিয়ে উপলক্ষে রাজা-মহারাজা এবং বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ উপহারসামগ্রী নিয়ে এসেছেন। কম্বোজ, ত্রিগতরাজ, কিরাত, দরদ, বাহ্নীক, কেবল, অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গ-রাজগণ স্বর্ণখচিত মেষলোম নির্মিত নানা বস্ত্রাদি, শ্বেতপীতলোহিত বর্ণের অমূল্য শিঙ্গা, মাণিক্য, বৈদুর্য মণি, মরকত নীলা, প্রবাল, মুক্তা, হীরা এবং নানা বর্ণের শাল উপহারস্বরূপ সম্রাটের হাতে তুলে দিলেন। প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা লৌহময় ঐতিহ্যবাহী রাজগয়না এবং হস্তীদন্তের মুষ্টিযুক্ত অসি উপহার দিলেন। পুণ্ড্ররাজ সম্রাট এবং আচার্য ভদ্রবাহুকে মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে দুকুলবস্ত্রের রাজকীয় পোশাক এবং পৌণ্ড্রিকা উপহার দিলেন। মেরু ও মন্দর পর্বতের মধ্যে শৈলদা নদীর তীরে বসবাসকারী খস, পারদ, কুলিঙ্গ প্রভৃতি উপজাতির রাজাগণ রাশি রাশি পিপিলিক স্বর্ণ সম্রাটের হস্তে তুলে দিতে গিয়ে ভক্তি জানালেন। তক্ষশীলার নাগরিক ও ব্যবসায়ীবৃন্দ পারসিক, মিসরীয় ও শ্যামদেশীয় উপহারসামগ্রী দিয়ে সম্রাটকে চমকে দিলেন। গান্ধাররাজ ও জনকরাজের অধস্তন পুরুষগণও উপহারাদি নিয়ে এলেন আমন্ত্রণ রক্ষার্থে। বঙ্গরাজ মণিস্নিগ্ধোদকবান বাঙ্গক সিল্ক ও হস্তীদন্তমূল উৎপন্ন হীরার গয়না উপহার দিয়ে তৃপ্তবোধ করলেন। চাণক্য তাঁদের অনেক সমাদর করলেন। রাজা ভরতের উত্তরপুরুষ এলেন খানিকটা বিলম্বে। তাঁদের সবাইকে নিয়ে শোভাযাত্রা করে চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক মন্দিরগুলোর পাশে তৈরি মঞ্চে উপস্থিত হলেন। সম্রাট হাতিতে না চড়ে পদব্রজে গেলেন। আচার্য ভদ্রবাহুকে বললেন, ভারতে বেশ কটি ধর্মমন্দির আছে, যেখানে দেবতার কাছে গড়িয়ে যেতে হয়, আমি না হয় হেঁটেই গেলাম, বলে হাসলেন।

ভদ্রবাহু বললেন, আমাদের এই দেশে এ নিয়ম আছে যে খুব দরিদ্র লোকদেরও বিয়ের দিনে রাজা-মহারাজা-সম্রাটের মর্যাদা দেওয়া হয়।

তাহলে আচার্য, আমি আজ দুজন সম্রাটের মর্যাদার অধিকারী।

তা দাবি করতে পারো, বলে হাসলেন আচার্য।

গ্রিকমন্দিরের সামনে মঞ্চে অন্যদের মধ্যে অপেক্ষা করছিলেন প্রিন্সেস কর্নেলিয়া গ্রিক বধূর সাজে। চন্দ্রগুপ্তকে গ্রিক রাজকীয় (বরের) পোশাকে দেখে অভিভূত হলেন। বাকি গ্রিকদেরও বিস্ময়ের সীমা রইল না। ফাওলিন বলল, বেশ মানিয়েছে কিন্তু। নিকোমেডেস বলল, এই পোশাক কোথায় পেলেন, সম্রাট? কর্নি, তুই একবারও বললি না? ফিসফিসিয়ে কর্নি বললেন, আমিও জানি না, বিশ্বাস কর।

দিদাইমেইয়া, লাউডিস, লাউডিসের স্বামী জেনারেল কিউকেকাস, কন্যা হারমিজ ও নিকোমেডেস এগিয়ে গিয়ে সম্রাটকে বরণ করে নিলেন। মঞ্চটা অতি সাধারণ সাদামাটা। শুধু গ্রিক আচারাদি সম্পাদনের জন্য এটি নির্মিত। মঞ্চের সামনে আরামকেদারায় উপবেশনরত কেউ কেউ বলেই ফেললেন, দুই জগতের দুই সম্রাটের মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে এ রকম সাদামাটা মঞ্চে। তাঁদের জন্য অবশ্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।

দিদাইমেইয়া গ্রিক পুরোহিতকে বললেন, শুরু করুন ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানাদি। পুরোহিত বর- কনের হাতে দুটো পুতুল তুলে দিয়ে বললেন, বর দেবতা আর্টেমিস এবং কনে অ্যাপোলোর উদ্দেশে মন্দিরে পুতুল দুটি উৎসর্গ করবেন। তারপর ভালোবাসা ও সুখশান্তির জন্য আরাধনা করতে হবে।

বিরাট সাম্রাজ্যের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত কর্নেলিয়াকে অনুসরণ করে দেবতাদের মন্দিরে গেলেন এবং সব ধর্মীয় আচার পালন করলেন। মাঝেমধ্যে কর্নেলিয়া সম্রাটকে নিতান্ত বুদ্ধ মনে করে হাসলেন। উপাসনাটা চন্দ্রগুপ্ত ঠিকই উপভোগ করলেন। শ্রদ্ধাভক্তিতেও উপভোগের ব্যাপার আছে। তবে ভালোবাসা সেখানে থাকতে হয়।

এরা যখন গ্রিক দেবমন্দিরে দেবতাদের ভক্তি ও উপহার দিচ্ছেন, তখন ভদ্রবাহুকে উদ্দেশ করে চাণক্য বললেন, এখন আপনার বিবাহমণ্ডপে চলে যাওয়া উচিত। আমিও আপনার সঙ্গে যাব। ভারতীয় বিয়ের পোশাক সেখানে প্রস্তুত আছে কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এখানে গ্রিক আহার্য গ্রহণ করব না?

চাণক্য বললেন, তা মনে হয় আমাদের ভাগ্যে নেই। ভারতীয় রীতির বিয়ের পরই আপনাকে আহার্য গ্রহণ করতে হবে।

এখানে সব অতিথিকে আপ্যায়ন করা হবে, সেখানে তো আপনার ব্যবস্থা নেই।

দেখুন, ব্রাহ্মণ্য ভোজের ঐতিহ্য ছেড়ে আসি নি। সুবন্ধু ব্যবস্থা করেছে। সম্রাটের বিয়ের ভোজ বলে কথা, এ কথা বলে চাণক্য খুব হাসলেন!

মৌর্য সেনাপ্রধান ও গ্রিক জেনারেল লাউডিসের স্বামীকে অতিথিদের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে দুই আচার্য বিবাহমণ্ডপের দিকে গেলেন। মঞ্চ ও মণ্ডপ যেভাবে সাজানো হয়েছে, তা দেখে তাঁদের বিস্ময়ের সীমা রইল না।

যে শিল্পীর তত্ত্বাবধানে মঞ্চ ও মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছে, তাঁকে ডাকালেন চাণক্য। তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলেন। শিল্পী বললেন, তাঁর নাম ভবদানব।

ময়দানবের সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক আছে?

তিনি আমাদের পূর্বপুরুষ, আচার্য।

নামের শেষে দানব কথাটা রেখেই দিলে। ভদ্রবাহুর কথার জবাবে ভবদানব বললেন, তা গৌরবের, আচার্য।

তুমি একি করেছ, ভব?

ভবদানব কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ভুল কিছু কি করেছি, আচার্য?

না না, তুমি ভুল কিছু করো নি, অবাক করে দিয়েছ। মহাভারতে পড়েছি, ময়দানব ছিলেন বিশ্বকর্মা, মহাশিল্পী। স্বর্গের যে বর্ণনা আছে, পুরাণগুলোতে তাই মাথায় রেখে মর্তের এযাবৎকালের সেরা সভামঞ্চ তৈরি করেছিলেন।

আপনি তো জানেন, মহামন্ত্রী খাণ্ডব প্রস্থের বনে ছিল আচার্যদের বাস। অনার্য মানেই তো রাক্ষস বা অসুর অথবা দানব। কৃষ্ণ আর অর্জুন মিলে ওই বনে আগুন লাগিয়ে দিলেন। আগুনে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মানুষ তো বটেই, একটি প্রাণীও রক্ষা পেল না। যারা পালাতে চেয়েছিল, তাদেরও কৃষ্ণের চক্র আর অর্জুনের বাণে নিহত হতে হলো। শুধু রক্ষা পেল তক্ষকের শিশুপুত্র অশ্বসেন ও ময়দানব। ময়দানব কেন রক্ষা পেয়েছিলেন, তা আমরা জানি। স্বয়ং যুধিষ্ঠির বললেন, না না, ওকে মেরো না, ওকে আমরা এমন কাজে লাগাব, যে কাজের গৌরব আমাদের মুকুটে পালক হয়ে শোভা পাবে।

তুমি বলতে চাইছ যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের সভা মঞ্চ সেই পালক?

ভবদানব বিনম্র শ্রদ্ধায় শুধু মাথা নোয়াল। তোমার এ কীর্তি ভুবনভোলানো, ভবদানব, বললেন ভদ্রবাহু। তুমি কী বানিয়েছ, তা তুমি জানো না। সম্রাট দেখে খুব খুশি হবেন। তোমার কীর্তি ময়দানবের চেয়ে কম কিছু নয়।

ক্ষমা করবেন, আচার্য। কান স্পর্শ করে ভবদানব বললেন, তাঁর সঙ্গে আমার তুলনা করবেন না, আচার্য। আমি তাঁর নখের যোগ্যও নই। তিনি যেসব মণিরত্ন ব্যবহার করেছিলেন, তা আমি কোথায় পাব।

চাণক্য বললেন, তা জানি। অসুররাজ বৃষপর্বা হিমালয়কে দেখে মনে করেছিলেন, এই হিমালয় বিশ্বসৌন্দর্যের সব ঐশ্বর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। তিনি বিন্দু সরোবরতীরে মণিমুক্তা আর ধনরত্নের সমাহার ঘটিয়ে শিল্পিত বিন্যাসে দেবতাদেরও চমকে দিতে চেয়েছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র বোধ হয় তা সহ্য করতে পারলেন না। তাই পাণ্ডব সন্তানদের দিয়ে এসব মণিরত্ন লুট করালেন এবং ময়দানবের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, এসব দিয়ে সভামঞ্চ সাজাবে।

ভদ্রবাহু বললেন, সে সময় বোধ হয় ময়দানবের চোখে জল এসেছিল।

ময়দানব বিদ্রোহ করলেন না। শিল্পী-ঋষি। এসব মণিমুক্তা আর পাথররত্ন বসিয়ে ত্রিলোকবিখ্যাত মণিময় এমন এক সভামঞ্চ নির্মাণ করলেন, যা দেখে সবাই অভিভূত। আর দুর্যোধন তো ভেবেই বসলেন, সভামঞ্চের মেঝেতে জল। তাই ধুতিটা ওপরে টেনে তুললেন। তা দেখে অর্জুন আর ভীম খুব হাসাহাসি করলেন। ময়দানব মেঝেটা নির্মাণ করেছিলেন স্ফটিক পাথর দিয়ে, বলে একটা নিঃশ্বাসই ফেললেন আচার্য চাণক্য। পরে বললেন, তোমার এ কীর্তিও অসামান্য, ভবদানব। আচার্য ভদ্ৰবাহু একজন ঋষি-কবি, তিনি ভুল বলতে পারেন না।

আমি আপনাদের আশীর্বাদপ্রার্থী, আচার্য।

ভদ্রবাহু মঞ্চটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। চাণক্য পাশের প্রাসাদে ঢুকলেন বিবাহ পোশাকাদির খোঁজখবর নিতে। সেখানে বর-কনে ভারতীয় পোশাক পরে সভামঞ্চে আসবেন।

মঞ্চের সামনে অতিথিদের বসার জন্য বিরাট এক প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। ফুল আর মণিমুক্তা বসানো সর্বত্র। আহার্য আর সাজসজ্জায় বোধ হয় প্রাচীনকালে গৌরব করার রীতি ছিল। এদিকে গ্রিক দেবমন্দিরে দেবতাদের উদ্দেশে বর-কনে উভয়েই উদাচার প্রদান করে ধ্যানমগ্ন হলেন। এ আরাধনার চিত্রপট এঁকেছেন আরেক পটশিল্পী সরোজ পটুয়া। সেকালে ফটো তুলে রাখার ব্যবস্থা ছিল না। তা তখনো আবিষ্কৃত হয় নি। পটশিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান, ব্যক্তি ও স্থাপনার ছবি এঁকে রাখতেন বস্ত্রখণ্ডে। এ রকম চিত্রের পরিচয় রয়েছে মেগাস্থিনিসের বিবরণেও। কল্পসূত্রেও আছে। বিয়ের চিত্র এঁকে রাখার ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে রামায়ণ যুগ থেকে। জনক রাজার কন্যা জানকীর (সীতা) বিয়ের চিত্রপট প্রাচীনকালে একটি শিল্পধারার সৃষ্টি করেছিল। একে বলা হয় মধুবনী চিত্রকলা। জনকরাজ স্বয়ং এর প্রবর্তন করেন। বিহারের মিথিলায় এর জন্ম। শ্ৰী রামের জন্মস্থান অযোধ্যা হয়ে তা ভারতবর্ষের সর্বত্র বিস্তার লাভ করে এবং ব্যাপক জনপ্ৰিয়তা পায়। সরোজ পটুয়া মিথিলার সন্তান। ঐতেহ্যের সেই শিল্পচেতনা তাঁর রক্তে রয়েছে। তাই তাঁর সুনাম সর্বত্র। এ বিয়ের চিত্র আঁকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে।

সরোজ অসংখ্য ছবি এঁকে যাচ্ছেন। তাঁর রঙের কাজ একেবারেই হচ্ছে। মোটিভগুলো ফুটিয়ে তুলছেন তুলির দুয়েক টানে। অরিয়েন্টাল আর্টের সব চরিত্র স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে চিত্রগুলোয়। বর-বধূর নানা ভাবভঙ্গি, আনন্দ-লজ্জা-সংকোচ সবই ফুটে উঠছে তাতে। কোনো কোনো চিত্রে শুধু স্কেচে কাজ ধরে রাখছেন, পরে হয়তো রং করবেন, ভাষা দেবেন।

সব উপাচার প্রদান শেষে কর্নেলিয়া নিজের দুই গুচ্ছ চুল দুই দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করে এলেন।

চন্দ্রগুপ্ত অবাক হয়ে বললেন, এটা কেন?

কর্নেলিয়া হেসে দিয়ে বললেন, সম্রাট, হৃদয়-যৌবন সবই তো আপনাকে দিয়েছি, দেবতাদের শুধু একগুচ্ছ কেশাগ্র উৎসর্গ করলাম, এখানে যে আমার কৈশোর আর শৈশব বাঁধা পড়ে আছে।

জৈন বিয়ের লগ্ন হতে বেশ দেরি। গ্রিক রীতির নানা অনুষ্ঠান শেষে বর-কনে ফিরে এসেছেন মণ্ডপ-সংলগ্ন একটি প্রাসাদে। এখানে বর-কনেকে সাজানো হবে ভারতীয় বিয়ের সাজে। কনে কর্নেলিয়ার ইচ্ছেমতো কল্পসূত্রের দেবীর সাজে সাজানোর জন্য সম্রাজ্ঞীর সাজসজ্জার সাজনেদার উপস্থিত হয়েছেন। সম্রাট স্বয়ং নিজেই রাজকীয় সাজসজ্জায় পটু, দাস-দাসীরা তাঁকে সাহায্য করছে মাত্র।

প্রাসাদের একটি কক্ষে সম্রাট গ্রিক পোশাক খুলে ভারতীয় পোশাক পরছেন। পোশাকটায় নানা মণিমুক্তা এমনভাবে বসানো যে মনে হবে বয়নটা একেবারেই স্বাভাবিক কিন্তু আভিজাত্যে ভরপুর। যে দরজি এটি বানিয়েছে, তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। গলায় মানানসই আঠারো, নয়, তিন ও বড় দানার এক নলি মুক্তার প্রকাশ ঘটেছে তাতে। তিনি কলাররিংটা পরিধান করলেন নিজেই। চুলের অলংকারটা পরিয়ে দিল একজন নিপুণ দাসী। হাতে ব্রেসলেট পরিয়ে দিল দুজনে। স্বর্ণনির্মিত ব্রেসলেটে বসানো আছে নানা মণিমুক্তা এবং দামি পাথর। কণ্ঠে পরলেন দামি পাথর বসানো রাজকীয় হার। আঙুলে অঙ্গুরীয়। কর্ণে দৃষ্টিনন্দন কর্ণালংকার। বাহুবন্ধনীতে বসানো হয়েছে হীরা, জহরত, চুনি, পান্না আরও কত কী।

.

সম্রাট কনের সাজকে মাথায় রেখে নিজে সেজেছেন। পোশাক তৈরি, গয়নার নির্বাচন ও বিন্যাস হয়েছে সেভাবে। বড় পাত্রে জল এনে তাঁর সামনে রাখা হলো। সম্রাট তাঁর সাজপোশাক দেখলেন জলের মধ্যে। বিসদৃশ কিছু গয়না বদলে দিতে বললেন। তাই করা হলো। সুচতুর বানিয়া এমনভাবে প্রতিটা পাথর বসিয়েছেন যে ত্রুটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কম্বিনেশনও চমৎকার তারপরও সম্রাটের চোখে দু-একটি ত্রুটি ধরা পড়ে গেল। তিনি সেগুলো বদলে নিলেন। অতঃপর স্বস্তির হাসি হাসলেন এবং সবশেষে কুরিন্তা ফুলের মালা পরলেন। তাঁর সারা শরীর ও পোশাকে সুগন্ধি ছড়িয়ে দেওয়া হলো। একজন দাসী একজোড়া গসিরশা জুতো এনে পরিয়ে দিল সম্রাটকে। সম্রাট এখন মণ্ডপে যেতে প্রস্তুত।

এদিকে কনের সাজ হচ্ছে অপর একটি কক্ষে। কল্পসূত্রের দেবীর সাজ। সম্রাজ্ঞী দুরধরার প্রধান সাজসজ্জাকারী তার সঙ্গীসাথিদের নিয়ে কনে সাজাচ্ছে। দোভাষী হিসেবে কাজ করছে দাসী মন্দাকিনী।

কনে বসবেন বিশাল পদ্মপ্রতিম একটি আসনে। বলা হয়েছে, পদ্মাসনে উপবেশনরত অবস্থায় প্রকাশিত পদাংশসমূহে অলংকার বৃদ্ধি ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তাই সাজসজ্জাটা শুরু করা হয়েছে পা থেকে। পায়ের পাতার উপরিভাগ দুটি স্বর্ণের কচ্ছপের মতো উত্তল। পাতলা লাল ও মসৃণ নখগুলো যেন মাসুলে বসিয়ে দিয়েছেন দুষ্টু অলংকারশিল্পী। তার ওপর জড়ানো হলো স্বর্ণের পাথর বসানো হালকা-পাতলা অলংকার। মন্দাকিনী বলল, কুরুবিন্দবার্তা, সৌন্দর্যময়, সুন্দর, সুন্দর। মল পরিয়ে দেওয়ার পর পাগুলো যেন চিরন্তন সৌন্দর্যের কাছে বন্দী হয়ে গেল।

কর্নেলিয়া উৎসুক্য হয়ে তাকালেন তার দিকে। মন্দাকিনী গ্রিক ভাষায় ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল। প্রিন্সেস মৃদু হাসলেন।

পায়ের পাতার ওপর থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশটা উন্মুক্ত রাখা হলো কোনো গয়না ছাড়া। তার অর্থ ব্যাখ্যা করা হলো এভাবে—এ অংশে নারীদেহের অলংকারহীন সৌন্দর্যের প্রকাশ রয়েছে। সে সৌন্দর্যের চূড়া হচ্ছে হাঁটুতে অভাবনীয় সৌন্দর্যের দৃষ্টিনন্দন টোল পরা দৃশ্য।

মাংসল ঊরু মসৃণ পেলব হস্তীশুঁড় কিংবা কদলীবৃক্ষসম, পদ্মাসনে তার ওপর দিকটায় জ্যামিতিক প্রকাশ ঘটবে। প্রাচীন ভারতের পাশা খেলার জন্য উন্মুক্ত হাঁটুর বিভঙ্গরূপ দুটি কৌণিক ময়দান যেন। তার ওপরাংশে থাকবে পরিধেয় বস্ত্রের সংক্ষিপ্ত সংস্থান

কটিদেশে সুবর্ণ অঞ্চল রচনার্থে পরিয়ে দেওয়া হলো হেম কোমরবন্ধনী। তার ওপরাংশ শুভ্র সুন্দর বক্ষনিম্নদেশ নাভিকুণ্ডকে আশ্রয় করে বৃত্তাকার সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। নাভিমূলে বসানো হলো একটি রূপায় বাঁধানো বড় মুক্তামণি। হাতে মুঠোবদ্ধ হয়, এমন কটিদেশে প্রকাশিত রাখা আছে তিনটি ভাঁজ, যেন কোনো ঝানু শিল্পীর তুলিতে এঁকে দেওয়া বক্ররেখার নাচন।

হীরা ও নানা দামি পাথর বসানো সাদা পাতলা অঙ্গুরির মধ্য দিয়ে অনায়াশে আনা-নেওয়া করা যায়, এমন পোশাকটি ভদ্রবাহু এনে দিয়েছিলেন পুণ্ড্রবর্ধন থেকে। এটি পরিধানের পর দ্যুতিময় দেহের ঔজ্জ্বল্য আকাশে উড়ছে যেন। বৃত্তাকারে শোভমান কুন্দফুলের মালায় ঢেকে রাখা পবিত্র বাটির মতো একজোড়া আদিম পাথর পক্ব আমে দুধ মেশানোর রঙে উঁকিঝুঁকি মারছে। দেহে যেন অলংকারের পসরা সাজানো হয়েছে। ফুটে আছে নক্ষত্ররাজি সুবর্ণ, লাল, রুপালি, হলদে, সবুজ, নীল ও মিশ্ররঙের দামি পাথর। রত্নহার গলদেশ ও কর্ণরত্নফুল স্কন্ধদেশ স্পর্শ করে আছে। কিন্তু তাঁর কপোলের সৌন্দর্য এসব গয়নাকে যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, বলছে, আমিই অলংকার, তোমরা নও। কারণ, সবটা মিলিয়ে এমন এক সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে, মনে হবে, এসব অলংকার সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ মাত্র, আসল সৌন্দর্যটা কনের চোখ ও পদ্মপাপড়ির মতো ঠোঁটে। তাঁর ডাগর ডাগর চোখ এত নিষ্পাপ যে মনে হবে পদ্ম সরোবরে এইমাত্র ডুব দিয়ে উঠে এসেছে। মাথায় শিরস্ত্রাণজাতীয় গয়না পরাতে গেলে কর্নেলিয়া বাধা দিয়ে বললেন, মাথায় শুধু দেবীর পুষ্পচক্র শোভা পাবে।

প্রধান সাজনেদার বলল, সম্রাজ্ঞীর খোঁপায় দামি পাথরের তারাফুল ফুটবে না?

কর্নেলিয়া বললেন, না, তার দরকার নেই।

কর্নেলিয়া কালো মসৃণ রেশমি চুল স্কন্ধদেশ আবৃত করে নিতম্ব বরাবর ঝুলে আছে। কী মহিমা সে চুলে কে জানে! চুলে সুগন্ধি দিতে চাইলে কর্নেলিয়া তা হাতের ইঙ্গিতে নিষেধ করে দিলেন।

হাতের আঙুলগুলো পরিষ্কার করা হলো, নখে লাগানো হলো নানা রকম রং, এগুলো বর্ণিল হয়ে ফুটল চমৎকারভাবে। আঙুলগুলোয় পরিয়ে দেওয়া হলো মূল্যবান পাথরখচিত অঙ্গুরীয়। পদ্মভাটার মতো মসৃণ বাহু দুটি পদ্মপাপড়ির বর্ণ যেন। বাহুবন্ধ পরানো হলো তাতে। দুর্লভ মণির সমাহার বাহুবন্ধে। কিন্তু কনের সৌন্দর্যের কাছে তা-ও হার মেনে গেল।

হাতের কবজিতে শুধু স্বর্ণের একটি ব্রেসলেট পরানো সম্ভব হলো, যাতে আঙুলের অঙ্গুরীয়ের সঙ্গে স্বর্ণসূত্রের সুদৃঢ় বন্ধন নিশ্চিত হয়। অন্য সব অলংকার ফিরিয়ে দিয়ে কর্নেলিয়া বললেন, হাতের কবজিতে শুধু পুষ্প শোভা পাবে।

স্বর্গীয় এক পুষ্পচক্র মর্তের বিচিত্র ফুলে সাজানো। এতে আছে সদ্য ফোটা তাজা মান্দার, অকাল কদম্ব, চম্পা, অশোক, নাগ, পুন্নাগা, প্রিয়াংশু, শিরীষ, মদগরা, মল্লিকা, গাতি, যূথিকা, আনকোলা, ফুরানতাতাক, ধর্মানক, নবমল্লিকা, বকুল, তিলকা, বসন্তিকা, কুন্দ, নুফুর, অতিমুক্তা ও আম্রমুকুল। ফুলগুলো বিচিত্র গন্ধ ছড়াচ্ছে। সে মনোমুগ্ধকর সুগন্ধে ছুটে আসছে মৌমাছি। মৌপাখিদের আনাগোনাও আছে। তবে ভয়ে এরা কাছে ভিড়ছে না।

পুষ্পচক্রটি কর্নেলিয়ার মাথায় পরিয়ে দেওয়া হলো। কয়েকটি মৌমাছি এমনভাবে উড়ে গেল যে কর্নেলিয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তাঁর চেহারায় ফুটে উঠল এমন এক ভাব যে রাজা দুষ্মন্ত এ সময় উপস্থিত থাকলে শকুন্তলার মতোই আরেকটি প্রতিকৃতি আঁকতেন, যাতে প্রকাশ পেত দুর্দান্ত এক প্রকাশবাদী শিল্প।

ফাওলিন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাজসজ্জা দেখছিল। কর্নেলিয়া জিজ্ঞেস করলেন, সাজটা কেমন হয়েছে? দেবীর মতো লাগছে না?

তুমি অনুমতি দিলে আমি একটু হাত লাগাতে চাই, বলল ফাওলিন।

তাদের সাজানো ঠিক হয় নি?

চমৎকার হয়েছে। সামান্য একটু হাত লাগাব।

বেশ তো।

ফাওলিন মন্দাকিনীকে বলল, আমি যদি একটু হাত লাগাই, ওরা রাগ করবে না তো? কেন করবে? সম্রাজ্ঞীর ইচ্ছাতেই এ সাজ হচ্ছে। তিনি অনুমতি দিয়েছেন, কার কী বলার আছে?

পোশাক ও গয়নার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ফাওলিন কর্নির চোখের পাতায় বিভিন্ন রঙের আঁচড় কাটল তুলি দিয়ে। হাতের পিঠে ফুল এঁকে দিল। গয়নায় কিছু পরিবর্তন এনে গ্রিক দেবীদের একটা প্রচ্ছন্ন প্রতীকীভাব এনে দিল। কিন্তু মূল দেবীর সাজে কোনো পরিবর্তন আনল না। তার তুলির অতি সামান্য স্পর্শই সাজে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করে দিল।

এবারে বিশাল এক জলপাত্র রাখা হলো কর্নেলিয়ার সামনে। কর্নেলিয়া নিজেকে দেবীর সাজে দেখে মৃদু মৃদু হাসলেন। ফাওলিনের দিকে তাকিয়ে হাসিটা প্রশস্ত করে বললেন, গ্রিক ঐতিহ্য আনার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তোমাদেরও ধন্যবাদ। শেষের কথাটা সাজসজ্জাকারীদের উদ্দেশ করে।

মন্দাকিনী মহামূল্যবান একজোড়া জুতো পরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলল। সম্রাটের খুব পছন্দ হবে, মন্তব্য করল সে।

কর্নেলিয়া এ কথায়ও ফাওলিনের দিকে চেয়ে হাসলেন। পরে বললেন, লাউডিস আর পিসি কী বলো?

এঁরা এতক্ষণ চুপচাপ সব দেখছিলেন। তাঁদের চোখেমুখে মুগ্ধতা। দিদাইমেইয়া বললেন, চমৎকার লাগছে তোকে। তুই একেবারে ভারতীয় দেবী হয়ে গেছিস।

লাউডিস কপালে একটা টোকা দিয়ে বললেন, এটাই তো তুই চেয়েছিলি, তোর মনের মতোই হয়েছে। তোকে খুশি দেখে ভালো লাগছে। এ্যাই ফাওলিন, তুই নিকোকে ডাক। ও কাছে থেকে দেখুক।

লাউডিসের মেয়ের আনন্দ যেন আর ধরে না। সে-ও এই পোশাকে সাজতে চায়। আচার্য ভদ্রবাহু অন্যদেরও এক সেট করে পুণ্ড্রবর্ধনের রেশমি পোশাক দিয়েছিলেন। তাকে সে পোশাক পরানো হলো।

মেয়ে বলল, গয়না?

নিকোমেডেসও এল ভারতীয় পোশাকে। সবাই বিস্ময়ে তাকাল তার দিকে।

মজা করে লাউডিস বলল, চন্দ্রগুপ্ত নয়, তোর সঙ্গেই কর্নির বিয়ে দিয়ে দিই।

ফাওলিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, দাও, তাহলে ভালোই হয়, ওর একসঙ্গে দুটো স্বামী হবে।

পাশাপাশি বস তো একটু দেখি।

লাউডিসের এ কথায় ফাওলিন জোর করে ধরে নিয়ে নিকোমেডেসকে কর্নেলিয়ার পাশে বসিয়ে দিল।

লাউডিসের মেয়ে বলল, আমিও বসব।

এ সময় সরোজ পটুয়া উপস্থিত ছিল। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখা তার কাজ। খসখস করে কতগুলো স্কেচ এঁকে নিল। রং করার সময় নেই। রংটা পরে করতে হবে।

বিয়ের লগ্নটা মধ্যাহ্নে নির্ধারণ করা আছে। পঞ্জিকা দেখে ঠিক করে দিয়েছিলেন ভদ্রবাহু (পুরোহিত)।

বিয়ের আগে বরকে বিয়ের পোশাকে ‘বিনয়াক্ষত্র’ পূজা করতে হলো। পুরোহিত তাতে সহায়তা করলেন। মাদমণ্ডপে আসার আগে একটা ঐতিহ্যগত ‘সাগাই’ অনুষ্ঠান সারতে হয়। কনের আপন ভাই অনুপস্থিত। তাই নিকোমেডেসকে রীতি অনুসারে বরের কপালে তিলক এঁকে দিতে হলো। সে বরকে স্বর্ণালংকার, গ্রিক বস্ত্র, মিষ্টান্ন এবং প্রতীকী অর্থ প্রদান করল। চন্দ্রগুপ্ত এ নিয়ে খুব মজা করলেন। নিকোমেডেসকে বললেন, তোমার বিয়েতে এ অর্থ ফেরত দেব, জমা থাকল।

ভদ্রবাহু মাদমণ্ডপে এসে বসেছেন। সাথে মহামন্ত্রীকেও মণ্ডপে বসালেন। মণ্ডপের সামনে বিশাল প্যান্ডেলে অতিথিরা আসন গ্রহণ করেছেন। বর-কনের আসতে বাকি। প্রথমে বর এলেন, পরে এলেন কনে। সবাই দাঁড়িয়ে তাঁদের অভিবাদন জানাল। বর কনের দিকে তাকিয়ে হতবাক। কী অসাধারণ লাগছে হেলেনকে। তিনি কল্পনায় যা দেখেছিলেন, বাস্তবে তার চেয়ে বেশি কিছু

শুরু হলো ‘ভারতী আরতি’। আরতিতে মঙ্গলগীত গাইতে হয় কনেপক্ষের নারীদের। মঙ্গলগীত গাইতে হলো লাউডিস ও ফাওলিনকে। এরা গ্রিক সংগীত পরিবেশন করল। অতিথিরা তার অর্থ না বুঝেই হাততালি দিলেন এবং বেশ মজা পেলেন। আগে যেটা ছিল সামাজিক আচার, এবার তা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মাচারে পালিত হলো। নিকোমেডেস বরের কপালে চন্দনের তিলক এঁকে দিল, সঙ্গে উপহার। বরও কনের ভাইয়ের কপালে তিলক এঁকে দিলেন। চন্দ্রগুপ্ত বরাবরই মজা করতে পছন্দ করেন। নিকোমেডেসের দিকে একটি নারকেল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটি দাঁত দিয়ে ছুলে খেতে হবে।

নিকোমেডেস বলল, আমি একা, নাকি বর-কনেসহ। শুনে সবাই হেসে দিল।

এবারে শুরু হলো ‘ফেয়ার’। বরকনে ঘন হয়ে বসলেন। পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করছেন। চাণক্য দিদাইমেইয়াকে ইঙ্গিত করতেই দিদাইমেইয়া এক টাকা চার আনা (স্বর্ণমুদ্রা) এবং কিছু চাল কনের হাতে তুলে দিলেন। কনে তা আবার বরের হাতে তুলে দিলেন। পুরোহিত কন্যাদানের মন্ত্র পাঠ করতে করতেই তিনবার জল ছিটালেন। গ্রন্থিবন্ধন পর্বে মন্দাকিনী এগিয়ে এল। বর-কনের পোশাকের মধ্যে গিঁট বেঁধে দিল

যাবতীয় মঙ্গলাচরণের পর বর-কনে উঠে দাঁড়ালেন এবং অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে চারবার ঘুরপাক খেলেন। পুরোহিত এবার মন্ত্র নয়, মহাবীরস্তক শ্লোক পাঠ করলেন সুর করে। শ্লোক পাঠ শেষ হলে গ্রিক মঙ্গলগীত গাইতে শুরু করেন গ্রিক মহিলারা। এবার দিদাইমেইয়াও অংশ নেন। মঙ্গলগীতের মধ্যেই ঘটে মালাবদল। এ সময় মুহুর্মুহু হাততালিতে চারদিক প্রকম্পিত হলো।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা দেখতে দেখতে চাণক্য হারিয়ে গেলেন দূর অতীতে। ব্রাহ্মণ হিসেবে তখন দুরধরার বিয়ের পুরোহিত ছিলেন তিনি। হিন্দু রীতির সে বিয়ে ছিল সাত পাকে বাঁধা। আনুষ্ঠানিকতাও কম ছিল না। সবকিছুতেই ছিল তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী একক প্রভাব। দিন বদলে যায়। এ দিনও বদলায়।

আচার্য ভদ্রবাহুর মৃদু ধাক্কায় চাণক্য সংবিৎ ফিরে পেলেন। ভদ্রবাহু বললেন, কী ভাবছিলেন?

না, কিছু না।

এবার আপনার পালা। বরের বাড়ির সব আনুষ্ঠানিকতা আপনার।

আমার কেন?

ভুলে গেছেন, সেখানে অভিভাবক আপনি।

চাণক্য বললেন, আপনার একটি কাজ বাকি আছে। বর-কনেকে জৈন মন্দিরে স্বাগত জানানো।

আপনাকেও জানানো হবে, মশাই, আপনি তো বরের চলনদার।

বিয়ের পর প্রবীণেরা এসে বর-কনেকে আশীর্বাদ জানালেন। প্রথমে আশীর্বাদ করেন ভদ্রবাহু ও চাণক্য। চাণক্যের মধ্যে অভিভাবকসুলভ মনোভাব এখনো আছে। নানা বিপত্তির মধ্যেও চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে সমীহ করেন, আচার্য বলে সমাধান করেন।

বিভিন্ন দেশের রাজা-মহারাজা, অমাত্যবর্গ, নাগরিকবৃন্দ, পারিষদবর্গ, কর্মচারীবৃন্দ সবাই ফুল উপহার দিয়ে বর-কনেকে শুভেচ্ছা জানান। সরোজ পটুয়া অনুষ্ঠানের সব পর্বের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলো স্কেচের মাধ্যমে ধরে রাখতে চাইছেন।

রীতি মোতাবেক সবাই আহার্য গ্রহণ শেষে শোভাযাত্রা করে ফিরছেন বরের বাড়ি, অর্থাৎ গান্ধারা প্রাসাদে। সেখানে আগেই চলে গেছেন চাণক্য। বর-কনেকে স্বাগত জানাতে হবে। নিয়ম হচ্ছে, বরের মাতা কনেকে বরণ করবেন এবং বর কনেকে কোলে করে প্রাসাদে নিয়ে যাবেন।

কিন্তু সেনাপ্রধান এসে বললেন, মহামান্য সম্রাট, রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতা, অর্থাৎ বর-কনেকে স্যালুট করার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত।

সম্রাট তাঁর বধূকে কোলে করে নেওয়ার প্রথা বাদ দিয়ে তাঁকে নিয়ে সুসজ্জিত হস্তী থেকে নেমে স্যালুটিং মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর সুসজ্জিত সেনাবাহিনী স্যালুট জানিয়ে কুচকাওয়াজ করতে করতে মঞ্চের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল।

স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় বধূর অবগুণ্ঠন বাধ্যতামূলক : মঞ্চে উঠে গ্রিক জেনারেল-কন্যা সে কথা ভুলে গিয়ে সম্রাজ্ঞীরূপেই সেখানে সম্রাট স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। সরোজ পটুয়া এ মুহূর্তটিকে ধরে রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। তাঁর চেষ্টায় সৃষ্টি হলো অনন্য এক শিল্পকর্ম।

দিদাইমেইয়া শোভাযাত্রাকালে আরেকটি কাজ করতে করতে প্রাসাদ পর্যন্ত এলেন। ডাইনি- ডাকিনীসহ সব অশুভ শক্তির হাত থেকে বর-কনেকে রক্ষার জন্য রাস্তার দুপাশে ফলাহার ছিটিয়ে দিলেন।

ভদ্রবাহু মৃদু হেসে বললেন, ডাইনি-ডাকিনীরা কি এই ফলাহারে সন্তুষ্ট হবে?

হবে না হয়তো। আপনারা কী করেন?

এ সংস্কার এখানেও আছে। আমরা তেপথায় খিচুড়ি, মাছ-মুরগি প্রভৃতি ভালো খাবারের ভোগ দিয়ে থাকি

ওরা খায়?

তা তো জানি না।

এখান থেকে তাঁদের সোজা নিয়ে যাওয়া হলো জৈন মন্দিরে। সেখানে দিদাইমেইয়া এবং ভদ্ৰবাহু আগে ভাগে উপস্থিত হয়েছেন। সেনা সংবর্ধনায় তাঁদের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। মন্দিরে বর-কনের মঙ্গলার্থে ‘জিনাগৃহে ধান্য অর্পণ’ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করলেন এরা। একে কৃতজ্ঞতার অনুষ্ঠান মনে করা হয়।

এখানে এসে হেলেনের সঙ্গে শর্মিলার দেখা হয়ে গেল। শর্মিলা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীকে কুর্নিশ করে দাঁড়ালেন। হেলেন এগিয়ে গিয়ে তাঁকে বুকে টেনে ধরে বললেন, তোমার স্থান এখানে। তুমি এই মন্দিরে নয়, প্রাসাদের মন্দিরে থাকবে আমার কাছে। ভদ্রবাহুকে উদ্দেশ করে বললেন, আচার্য, আমার প্রার্থনা কি মঞ্জুর করা সম্ভব?

নিশ্চয়ই সম্ভব, শর্মিলা আপনার কাছেই থাকবে, সম্রাজ্ঞী।

শর্মিলা বললেন, আমি বলেছিলাম না, আপনি আমাদের সম্রাজ্ঞী হবেনই হবেন।

তোমার কথাই সত্য হলো, শর্মিলা।

না, আমার কথা না, এ ছিল আচার্যের কথা।

মন্দির থেকে প্রাসাদে পৌঁছলেন বর-কনে। এখানে মহামন্ত্রী চাণক্য সত্যি সত্যিই অভিভাবকের দায়িত্ব নিলেন। চন্দ্রগুপ্তের বাবা-মায়ের অবর্তমানে পারিবারিক রীতি-রেওয়াজ ও সংস্কারে যা আছে, সবই করলেন। কনেকে একটি আপেল এনে দিলেন কামড়ানোর জন্য। হেলেন তা-ই করলেন। তাঁকে শূকরের শুকনা মাংস, বাদাম প্রভৃতি খেতে দেওয়া হলো। হেলেন এসবও খেলেন হাসিমুখে।

দিদাইমেইয়াকে চাণক্য বললেন, শুনেছি স্পার্টায় নবদম্পতির মধ্যে কৃত্রিম যুদ্ধও হয়। আমাদের বর কিন্তু শক্তিশালী যোদ্ধা।

আমাদের কনেও কিন্তু জেনারেল সেলুকাসের মেয়ে, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ আছে, সুনামও আছে। এ কথা শুনে সবাই হাসলেন। দিদাইমেইয়া আবার বললেন, আমাদের অবাক করে দিয়েছেন আপনি। এগুলো তো গ্রিক রীতি। ভারতীয় রীতি কোথায়?

কতশত আচার মানতে হয় এখানে! আমরা আপনাদের সম্মানে সবকিছু সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছি।

সংক্ষিপ্ত রূপটাই দেখে আমরা অভিভূত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *