মৌর্য – ৭২

৭২

সেলুকাস একটি চিরকুট লিখে রেখে কাউকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে গান্ধারা প্রাসাদ ত্যাগ করে তাঁর এপিলেকটোই বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ঝিলাম নদী তীরের প্রমোদপ্রাসাদে উপনীত হলেন।

চিরকুটটা লিখেছেন চন্দ্রগুপ্তকে। তাতে লিখেছেন,

চন্দ্ৰ,

অনিবার্য কারণে আমাকে সেলুসিয়ায় চলে যেতে হচ্ছে। আমার অনুপস্থিতি সেলুসিয়াকে মারাত্মক এক চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছে। ভারতীয় রীতিমতে কন্যাদান করতে পারি নি বলে দুঃখিত। কিন্তু বিয়েটা ভারতীয় রীতিতেই হবে। কন্যাদান করবেন আমার বোন দিদাইমেইয়া। তাঁর ওপর আমার আস্থা রয়েছে।

ইতি

সেলুকাস।

পুনশ্চ : আমার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত ভয়াবহ রকম চ্যালেঞ্জিং। আপনার সহযোগিতার প্রয়োজন হতে পারে।

সেলুকাস দূত মারফত মোলনের বার্তা পেয়ে মুহূর্ত বিলম্ব না করে ছুটে বের হয়ে যান। পত্রের ভাষাতেই অস্থিরতার পরিচয় রয়েছে।

চন্দ্রগুপ্ত পত্রটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন এবং অস্ফুটে বললেন, তিনি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন। মনে মনে স্থির করলেন, এই দায়িত্বও তিনি নেবেন এবং সবার উদ্দেশে বলবেন, সম্রাট তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে সেলুসিয়ায় গেছেন

একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেলে সামনে কতগুলো প্রশ্ন ও সমস্যা দেখা দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। চন্দ্রগুপ্তকে প্রথমেই মিথ্যে বলার জন্য প্রস্তুতি নিতে হলো। তিনি অবশ্য চিরকুটের কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তা শোভন হতো না। চাণক্য একে কোনো অবস্থায়ই ভালোভাবে নেবেন না। তিনি গ্রিকদের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা বলবেন। ওই যে প্রতিশ্রুত আরও একশ যুদ্ধহস্তী হস্তান্তরের কথা রয়েছে, তা আর করবেন না। সম্রাট আরও ভাবলেন, একই রকম চিরকুট যদি তাঁর বোনকেও লিখে গিয়ে থাকেন তো ভালো, না হয় গ্রিক পক্ষ থেকে এখানে তাঁর বিরুদ্ধে সেলুকাসকে গুম বা হত্যার অভিযোগ আনা হবে। ব্যাপারটা তখন এমন পর্যায়ে যাবে, যেখান থেকে উঠে আসা কষ্টকর হয়ে পড়বে।

সম্রাট সিদ্ধান্ত নিলেন, সকালবেলায়ই সবাইকে ডেকে তিনি সম্রাট সেলুকাসের কথা জানাবেন। চিরকুটের কথা গোপন থাকবে।

.

এদিকে স্ট্রেটোনিস এন্টিগোনাস-পুত্র দিমিত্রিয়াসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করলেন। রোদেস দূত মারফত পূর্বেই প্রিন্সেসের আগমনবার্তা জানিয়ে দিয়েছিলেন। সবকিছু শুনে দিমিত্রিয়াস বললেন, সেলুকাসের বয়স হয়েছে। তিনি বয়স ও বার্ধক্যজনিত কারণে এমনিতেই মারা যাবেন। তাঁকে উৎখাত করতে আপনি এত মরিয়া কেন?

সম্রাট সেলুকাসের সঙ্গে স্ট্রেটোনিসের সম্পর্কের কথা দিমিত্রিয়াস জানেন না। প্রিন্সেস সে দিকে গেলেন না, বললেন, তিনি বয়সের কারণে মানসিকভাবে অস্থির। যদি প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে বঞ্চিত করে বসেন, করতেও পারেন, তাহলে আমাদের ক্ষতি হয়ে যাবে।

এন্টিওকাস এলেন না কেন, রকম প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলেন দিমিত্রিয়াস। কারণ, তার আগেই প্রিন্সেস আবার বললেন, এই অবস্থায় প্রিন্স আসতে পারছেন না। জরুরি সব সামরিক প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে তাঁকে।

দিমিত্রিয়াস একটু ভেবে নিয়ে বললেন, তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে হবে, আপনি কি সব বিষয়ে কথা বলতে কিংবা চুক্তি করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত?

আমি সে ক্ষমতাতেই এসেছি।

তাহলে বলুন কী চান আপনি।

এন্টিওকাস বিদ্রোহ করবে। আপনি তাকে সহযোগিতা করবেন।

আমি কী পাব তা থেকে?

যদি আমরা সেলুসিড সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিকারী হই, তাহলে আপনার সব যুদ্ধে সহযোগিতা করব এবং আপনার সব জোটে অংশীদার হব। মিত্র হিসেবে সব সময় ছায়ার মতো অনুসরণ করব।

কিন্তু আমার বাবার ইচ্ছা হচ্ছে সেলুসিড সাম্রাজ্য দখল করে নেওয়া। আলেকজান্ডারের পর থেকে তাঁর এ অভিযান চলছে। আমরা আপনাদের প্রদেশ ছাড়া আর সবটুকু সেলুসিড সাম্রাজ্য চাই। আপনারা স্বাধীন রাজ্য চালাবেন, এ প্রতিশ্রুতি দিতে পারি।

সেলুসিড আমাদের সাম্রাজ্য। আমরা সামান্য একটা প্রদেশের জন্য তা আপনাদের ছেড়ে দিতে পারি না।

আপনার জন্ম তো সেলুসিয়ায় নয়, সিরিয়ায়। সেটিও আমরা ভাগ করে নিয়েছি। রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে, সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজা ও সম্রাটদের এত ছোট অভিলাষ কখনোই বড় উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে না। এন্টিগোনাস এ অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি হবেন, আমি আমার সময়ে সাম্রাজ্যের আরও বিস্তার ঘটাব, এটাই কাঙ্ক্ষিত। আর একটা কথা, আমি সাম্রাজ্য লাভের জন্য আমার বাবাকে হত্যা করব না, এটা এন্টিওকাসকে জানাবেন। বাবার একজন সেনানায়ক হিসেবে তাঁর আদেশ-নির্দেশ মেনে রাজ্যবিস্তার ঘটাব। আপনারা যদি কোনো কারণে সম্রাট সেলুকাসের বিরাগভাজন হয়ে থাকেন এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান, গ্রিক হিসেবে এন্টিওকাস এবং তাঁর স্ত্রী হিসেবে আপনি তা পাবেন। বিনিময়ে আপনাদের সমুদ্র উপকূলে আমাদের বাণিজ্য জাহাজ বিনা বাধায় গমনাগমন করবে এবং মিত্র হিসেবে আপনারা আমাদের সব অভিযানে সৈন্য পাঠিয়ে সহযোগিতা দেবেন। যদি সম্মত হন, তাহলে আমি সম্রাট এন্টিগোনাসের সঙ্গে কথা বলতে পারি।

আমাদের এ নিয়ে ভাবতে হবে। তার আগে আপনার প্রস্তাব নিয়ে এন্টিওকাসের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

বেশ, তাই করুন।

আপনার বাবার সঙ্গে কথা বললে হয়তো তিনি ভিন্ন মত দেবেন।

আপনি এ রকম মনে করতেই পারেন। বাবা মনে হয় না আমার মতামতের বাইরে কিছু করবেন।

প্রিন্সেস স্ট্রেটোনিসের এই সাক্ষাতের বিষয়টি গোয়েন্দা মারফত মোলন আগেই জেনে যান এবং তার ফলাফল কী দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য সামরিক গোয়েন্দাদের আরও তৎপর হতে বলেন।

.

এরই মধ্যে সেলুকাস সেলুসিয়ায় পৌঁছে গেছেন। মোলনসহ সব জেনারেলকে নিয়ে বসলেন তিনি। পুরোনো মিত্রদের কাছে দূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলো। জেনারেল মোলনকে এন্টিওকাসের অবস্থান সম্পর্কে বলতে বলা হলো।

মোলন ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং গোয়েন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে সম্রাটকে যা বললেন, তা রীতিমতো ভয়াবহ। শুনে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সেলুকাস বললেন, মোলন, তুমি যা বলছ, তা শুনে আস্থার সংকটে আছি। অতীতও ভুলে যাই নি আমি। ঠিক আছে, আমরা তাকে বাদ দিয়েই এন্টিগোনাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করব।

মহামান্য সম্রাট, আপনার অনুমতি নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই।

জেনারেল সারিকাসের প্রতি তাকিয়ে সেলুকাস বললেন, কী বলতে চাও তুমি?

আমার অনুরোধ, এন্টিওকাসকে যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে বাদ দেবেন না, তিনি এপিলেকটোই বাহিনী নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকবেন, এতে তিনি মনে করতে পারবেন না যে তাঁকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া তিনি তাঁর শক্তিশালী অশ্ববাহিনী নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকলে তাঁর গতিবিধি ও মনোভাবের ওপর দৃষ্টি রাখা যাবে। আমরা তাঁকে যুদ্ধের বাইরে রাখতে চাই না। তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে।

সেলুকাস বললেন, সে চাইলে তো যুদ্ধক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করতে পারে।

ফিলেকাস বললেন, আপনার আশঙ্কাও ঠিক আছে, মহামান্য সম্রাট। তবে ঝুঁকিটা বেশি থাকে যুদ্ধের বাইরে রাখলে।

জেনারেল কিউকেকাস বললেন, ভারতীয় হস্তীবাহিনী এবং চার মিত্ররাজ্যের সৈন্যরা আমাদের সঙ্গে থাকবে। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র করতে চাইবেন না প্রিন্স।

বেশ, তাই হবে। তার কাছে পত্র পাঠানোর ব্যবস্থা নাও। আর গোয়েন্দাগিরি শাণিত করো। সৈন্যদের ছুটিছাটা বাতিল করো। যার যার ইউনিটে যোগ দিতে বলো। ভারতীয় হাতিদের প্রশিক্ষণ কেমন হচ্ছে? আমি কাল নিজেই প্রশিক্ষণ দেখব। প্রশিক্ষক এবং অপরাপর ভারতীয়দের যত্ন-আত্তির কমতি যেন না হয়।

চার পুরোনো মিত্র টলেমি, লাইসিমেকাস, কাসান্দার ও রোদেসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। টলেমি ও কাসান্দার বার্তা পাঠালেন এই বলে যে তারা বন্ধুত্বের মূল্য অবশ্যই দেবেন। তবে সরাসরি যুদ্ধ করতে হবে সেলুকাস ও লাইসিমেকাসকে। কারণ, এঁরা দুজনই এন্টিগোনাসের প্রতিবেশী ও শত্রু। নানা সময়ে তাদের নাজেহাল করা হয়েছে। এ ছাড়া এন্টিগোনাস পরাজিত হলে তাঁর রাজ্য এঁরা দুজনই ভাগ করে নেবেন। ওঁরা ভাগ বসাতে আসবেন না। যুদ্ধের জন্য তাঁদের প্রস্তুতি থাকবে। প্রয়োজনে এঁরা ছুটে আসবেন। রোদেস পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, এই যুদ্ধে তাঁর নিরপেক্ষ থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণটাও ব্যাখ্যা করে জানালেন।

সেলুসিড বাহিনীকে আবার একটি যুদ্ধে লিপ্ত হতে সময়ের প্রয়োজন ছিল। জেনারেল মোলন ও সারিকাস গুরুত্ব দিয়ে তা সম্রাটকে বোঝালেন। এরা পরাজয়ের গ্লানি আর মানসিক ক্লান্তিতে কিছুটা অবসন্ন। তাদের চাঙা করে তোলার নানা কার্যক্রম চলছে। সারিকাস বললেন, একরা আর্মিতে কোনো সমস্যা নেই, সমস্যাগ্রস্ত হচ্ছে কাতুইকোই আর্মি।

তাদের বাদ দিলে হয় না?

ফিলেকাস বললেন, যুদ্ধের মাঠে তাদের প্রয়োজন আছে। একরার ‘বি’ টিম হয়ে কাজ করবে এরা। এ ছাড়া গত তিন বছরে তাদের অভিজ্ঞ করে তোলা গেছে। এখন ক্লান্তি ও বিষণ্ণতা দূর করতে পারলে চাঙা হয়ে উঠবে।

বেশ, তাই করো।

সম্রাটের কথার মধ্যেও ক্লান্তির ছাপ আছে। দুই জেনারেল পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তাই যেন বোঝালেন।

.

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত গান্ধারা প্রাসাদে সবাইকে ডেকে পাঠালেন। গ্রিকদেরও আসতে আমন্ত্রণ জানানো হলো। সবাই উপস্থিত হলে সম্রাট যোগ দিলেন।

তাঁকে বেশ খোশমেজাজে দেখা গেল। ম্রাটের এক পাশে বসেছেন আধ্যাত্মিক গুরু ভদ্রবাহু এবং অন্য পাশে মহামন্ত্রী চাণক্য। সবার মধ্যে দারুণ উৎসুক্য, চাণক্য ছাড়া। কারণ, তিনি তাঁর নিজস্ব গোয়েন্দাদের মাধ্যমে আগেই জেনে গেছেন সেলুকাস রাতের অন্ধকারে চলে গেছেন। তবে একেবারেই যে উৎসাহী নন, তা নয়। সম্রাট কী বলবেন, তাঁর প্রতিক্রিয়া কী এখন, তা জানা যাবে।

সম্রাট বললেন, সম্রাট সেলুকাস তাঁর সাম্রাজ্যের জরুরি কাজে গত রাতে সেলুসিয়ায় চলে গেছেন। ব্যাপারটা এত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি যে তিনি আমাকে ছাড়া আর কাউকে জানানোর সময় ও সুযোগ পান নি। তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমি তাঁকে কথা দিয়েছি, মৌর্য সাম্রাজ্য সব সময় তাঁর পাশে থাকবে। আচার্য মহামন্ত্রী, আমাদের প্রতিশ্রুত বাকি একশত হস্তী সম্রাটের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনে কিছু সৈন্যকে প্রস্তুত রাখুন, যারা গজারোহী ও চৌকস। আচার্য ভদ্রবাহু, প্রিন্সেসের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে তাঁর (সেলুকাসের) অভিমত হচ্ছে, বিয়েটা ভারতীয় রীতিতে হতে হবে, কন্যাদানের আনুষ্ঠানিকতা পালন করবেন তাঁর বোন দিদাইমেইয়া। মহামন্ত্রী বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করবেন, আনুষ্ঠানিকতায় উৎসবের কমতি হবে না।

আমি এখন দিদাইমেইয়া এবং তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই। আচার্যগণ, সভাসদগণ, ধন্যবাদ আপনাদের।

দিদাইমেইয়া সম্রাটের ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত আছেন। কেন জানালেন না তাদের, না জানিয়েই বা গেলেন কেন, এ নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।

চন্দ্রগুপ্ত দিদাইমেইয়ার কাছে পত্রটি দিয়ে বললেন, পড়ে দেখুন। আপনাকে কোনো কিছু না জানিয়ে গেছেন কি না, আমার জানা নেই।

দিদাইমেইয়া পত্রে চোখ বুলিয়ে তা কর্নেলিয়ার হাতে দিলেন এবং কর্নেলিয়ার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় থাকলেন।

কর্নেলিয়া বললেন, ভয়াবহ রকম চ্যালেঞ্জটা কার কাছ থেকে এল?

এন্টিওকাস নয় তো, বললেন লাউডিস।

নিকোমেডেস বলল, আমাদের কিছুটা ধৈর্য ধরতে হবে। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের উৎকণ্ঠায় রাখবেন না, সবকিছু এখন অবহিত করবেন। পত্র লিখবেন বা দূত পাঠাবেন।

যা-ই ঘটুক, আমরা সহায়তা করব, বললেন সম্রাট। আপনাদের চিন্তামুক্ত রাখা আমাদের কাজ।

মহামান্য সম্রাট, আপনি কি কাউকে পাঠাবেন সংবাদ আনার জন্য?

সম্রাট জানেন না চাণক্যের পাঠানো গোয়েন্দারা প্রতিদিনই সংবাদ সংগ্রহ করছে এবং তাঁর কাছে পাঠাচ্ছে। বললেন, আপনারা যদি চান এক্ষুনি পাঠাতে পারি।

অনুগ্রহ করে তাই করুন, বললেন দিদাইমেইয়া। তিনি অসহায়বোধ করছেন।

এরা সবাই উঠে যাওয়ার সময় সম্রাট বললেন, পত্রের ব্যাপারটা গোপন রাখা একান্ত কাম্য। যাওয়ার কালে কর্নেলিয়ার সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের দুবার দৃষ্টি বিনিময় হলো। ফাওলিনের তা দৃষ্টি এড়াল না। সে ফিক করে হেসে দিল। সম্রাট বললেন, নিকো, তুমি ফাওলিনকে নিয়ে বেড়াতে আসবে।

মহামান্য সম্রাট, আর কেউ আসবে না? বলে ফোড়ন কাটল ফাওলিন।

এরা চলে গেলে সম্রাট আবার দুই আচার্যকে নিয়ে বসলেন। পরিস্থিতির ওপর নজর ও নিয়ন্ত্রণ রাখার দায়িত্ব পড়ল মহামন্ত্রী চাণক্যের ওপর। তিনি দূত পাঠিয়ে দ্রুত সংবাদ সংগ্রহের জন্য মহামন্ত্রীকে অনুরোধ করলেন। চাণক্যের কাছে গোয়েন্দা বার্তা এমনিতেই আসত। তিনি সম্রাটকে আশ্বস্ত করলেন। তবে ভেতরে ভেতরে তাঁর নিজের মতো করে একটা পরিকল্পনা করে নিলেন।

চাণক্যের সঙ্গে কথা বলে চন্দ্রগুপ্ত ভদ্রবাহুর দিকে তাকালেন। ভদ্রবাহু বললেন, এসব রাজকীয় সমস্যা থাকবেই। আমি গ্রিক পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলেছি। এই পূর্ণিমাতেই বিয়ের দিন ধার্য করা যায়। শেষ রাতে শীত পড়তে শুরু করেছে।

আচার্য চাণক্য বললেন, শীতের মর্মার্থ শেষ রাতের শীত নয়, শীতকাল।

শেষ রাতে শীত দিয়েই শীতকাল তার আগমনবার্তা জানায়, আচার্য।

মহামন্ত্রী চাণক্যের প্রতিক্রিয়ার প্রতি অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন চন্দ্রগুপ্ত। বললেন, আচার্য, আমি যতটুকু বুঝি, তক্ষশীলার মহাশিক্ষালয় পুরোনো সব সংস্কারকে নাইয়ে দেয়। আপনি সে পর্ব পার করে এসেছেন। গ্রিকদের সংস্কার কেউ পরিশুদ্ধ করে দেয় নি, আমরা দুয়েকটাকে পাখির ঠোঁটের মতো স্পর্শ করে উড়ে গেলে তেমন কিছু ক্ষতি হবে না। সংস্কারটা যাদের, এরা তো আপত্তি করছে না।

আমি সেভাবে বলি নি, সম্রাট, আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে মজা করছিলাম। আপনি একজন প্রিন্সেসের জন্য ধর্মান্তরিত হবেন, সেটাও মনে করি না!

সম্রাট বলতে যাচ্ছিলেন, আচার্য, আপনি তো একদিন আজীবিকের বেশ ধরে পালিয়েছিলেন, কিন্তু বললেন না। বরং শ্রদ্ধা দেখিয়ে বললেন, আপনার সব পরামর্শ এখনো আমার মনে আছে। এ সময় দ্বারবারিক এসে জানাল, একজন গ্রিক দূত এসেছেন, সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। সম্রাট মহামন্ত্রীর দিকে তাকালেন। মহামন্ত্রী বললেন, সম্রাট সেলুকাসের কোনো জরুরি বার্তা নিয়ে আসে নি তো?

সম্রাট দ্বারবারিককে বললেন, আসতে দাও।

গ্রিক দূত বার্তা হস্তান্তর করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। চন্দ্রগুপ্ত পত্রের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেলেন। সেলুকাস যা লিখেছেন, তা হলো এই :

সম্রাট, আমি জেনারেল মোলনের বার্তা পেয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি। আমার নিকটজন আমাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ঘটনা সত্য। এখানে আমার উপস্থিতি ষড়যন্ত্রকারীদের কিছুটা হলেও হতাশ করবে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপনার দেওয়া হাতিগুলোকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। আপনার কাছ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার কর্নেলিয়া আপনার কাছে। তাকে সব সময় আনন্দ দেবেন, এটাই আপনার কাছে আমার চাওয়া। আপনাদের বিয়ে সুন্দরভাবে হবে, আমি নিশ্চিত। সাম্রাজ্যের এই দুঃসময়ে ষড়যন্ত্রকারী শত্রুদের কাছে সিংহাসন ঝুঁকিতে রেখে আমি বিয়েতে থাকতে পারছি না বলে আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি। অতীতে যতই ভুল-বোঝাবুঝি হয়ে থাক, এখন সম্পর্ক এগিয়ে যাবে, এ কথা আমি দিতে পারি। দূতের কাছে আমি একটি গ্রিক পোশাক, মণিমুক্তাখচিত একটি স্বর্ণমুকুট এবং ঢালসহ রয়াল গ্রিসের একটি রাজকীয় তরবারি পাঠালাম। আপনি মাঝেমধ্যে এ পোশাক পরিধান করলে আমার মেয়ে গ্রিক ঐতিহ্যকে তার মধ্যে খুঁজে পাবে। এগুলো আগেই তৈরি করে রাখা ছিল বিয়ের অনুষ্ঠানে দেব বলে। দিদাইমেইয়াকেও আমি বিস্তারিত লিখে জানিয়েছি। তিনি নিজে থেকে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন। কর্নেলিয়াকে ছোট্ট একটা পত্র লিখেছি, এটি পাঠ করে বাবার ওপর তার আর ক্ষোভ-অভিমান থাকার কথা নয়। আপনারা ভালো থাকুন।

ইতি
সেলুকাস।

সবার দৃষ্টি সম্রাটের দিকে। সম্রাট পত্র থেকে চোখ তুলে বললেন, যাক, চিন্তামুক্ত হওয়া গেছে। দূত উপহারগুলো হস্তান্তর করল অলংকৃত তিনটি বাক্সসহ।

মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, আমাদের জন্য কিছু বলবেন, সম্রাট।

বাকি হস্তীগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা নিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *