৭০
সৈন্য প্রত্যাহারের সঙ্গে আরও দুটো কাজ সম্পন্ন করা হলো। চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাস ও তাঁর বোন দিদাইমেইয়াকে বললেন, অ্যাপোলো, আফ্রোদিতে আর আর্টেমিসের ত্রিমাত্রিক মন্দির নির্মাণ করা হয়ে গেছে। নকশা করে দিয়েছিলেন এক গ্রিক স্থপতি। প্রতিমা ভাস্কর্য আনিয়ে নিতে হবে গ্রিক সম্রাটকে। গ্রিক পুরোহিত সেলুসিয়া থেকে এসে গেছেন। এখন পূর্ণিমারাতের জন্য প্রতীক্ষা। বিয়ের জন্য গান্ধারা প্রাসাদ প্রস্তুত।
সম্রাট সেলুকাস কোনো মন্তব্যই করলেন না। দিদাইমেইয়া ভাইয়ের দিকে নিষ্ফল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অবশেষে নিজেই বললেন, প্রতিমা ভাস্কর্য স্থাপন এবং মন্দির দর্শন একসঙ্গে হবে। আমি গ্রিক পুরোহিতকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। ভারতীয় পৌরহিত্য কে করবেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের পুরোহিতের আলাপ-পরিচয় হওয়া দরকার।
আচার্য চাণক্য বললেন, এর জন্য আচার্য ভদ্রবাহু আছেন।
ভদ্রবাহু এখানে উপস্থিত আছেন। তাঁর চোখেমুখে স্বর্গীয় আভা বয়ে গেল। যেন তিনি স্বর্গীয় দ্যুতি নিয়ে হাসছেন। দুরধরার সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিয়েটা হয়েছিল হিন্দু রীতিতে, চাণক্য তাতে পৌরহিত্য করেন। জৈন রীতির বিয়েতে পুরোহিত ভদ্রবাহু। এতে গ্রিক পক্ষের লোকজন সন্তুষ্ট হলো।
সম্রাট সেলুকাসও একধরনের স্বস্তিবোধ করছেন, যদিও অন্য পুরোহিত আর ভদ্রবাহুর পৌরহিত্যে কোনো পার্থক্য নেই।
বিয়েতে কনের পোশাক নিয়ে কথা তুললেন দিদাইমেইয়া। গ্রিক নাকি ভারতীয়, এ নিয়েই তাঁর কৌতূহল।
ভদ্রবাহু বললেন, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে, কন্যার বিয়ের পোশাকটা ভারতীয় অভিজাত, অর্থাৎ সম্রাজ্ঞীর পোশাকের অনুরূপ হবে। চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, মূল বস্ত্র দুকুল এবং হিরের গয়না আসবে পুণ্ড্রনগর থেকে।
দুকুল, প্রশ্ন করে দিদাইমেইয়া তাকালেন ভদ্রবাহুর দিকে।
এটা পত্রানৌক-জাতীয় একধরনের রেশমি কীটের লালা থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি বস্ত্র। আপনাকেও এক সেট উপহার দেওয়া হবে। লাউডিস চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললেন, আচার্য, আমি বাদ যাব কেন? শুনে খুব লোভ হচ্ছে।
ভারতীয় রীতি মতে আপনারা সবাই পাবেন, বললেন ভদ্রবাহু। লাউডিস কেন, তাঁর মেয়েকেও সাজিয়ে দেব, বলে হা হা করে হাসলেন।
বস্তুত দুকুল বস্ত্র এবং হিরের গয়না পুণ্ড্রনগর থেকে সংগ্রহ করে আনিয়েছেন ভদ্রবাহু নিজে। তাঁর পক্ষ থেকে শিষ্যের জন্য এ উপহার।
সেলুকাস চুপ করে বসে ছিলেন এবং চাণক্যও প্রায় চুপের কাছাকাছি। এবার দুজন কথা বলতে উঠে গেলেন নিজেদের মধ্যে। চাণক্য বললেন, মহামান্য সম্রাট সেলুকাস, আমাদের প্রতিশ্রুত যুদ্ধহস্তীর সর্বশেষ দলটি আপনার সঙ্গে যাবে। সর্বশেষ দলের সঙ্গে প্রশিক্ষকেরা যাবে।
আগে হস্তীর সঙ্গে যারা গেছে, এরা কারা?
এরা হস্তীসেবক ও মাহুত।
আচ্ছা।
চাণক্য একটি বিষয় গোপন করলেন। আসলে হাতিগুলোর সঙ্গে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক ও গুপ্তচরেরাও আছে। সম্রাটের মুখে ‘আচ্ছা’ শুনে নিশ্চিত হলেন, সম্রাট প্রকৃত সত্য জানেন না। জানেন না চন্দ্রগুপ্তও। এটি চন্দ্রগুপ্তের কাছেও গোপন করা হয়েছে।
আরেকটি কাজ আছে, বললেন চাণক্য। সম্রাট জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। সিন্ধু এলাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে তক্ষশীলায় আপনাকে বিদায় সংবর্ধনা জানানো হবে।
এ কথা শুনে সম্রাট বললেন, বেশ ভালো কথা। আমাকে কী করতে হবে? কিন্তু মনে মনে বললেন, অপমানের এখনো আর কী বাকি আছে? সম্রাট যেন কল্পনার চোখে দেখছেন তাঁকে ঘাড়ে ধরে সিন্ধু অঞ্চল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টালেন, প্রতিশ্রুতি মতো আমাদের সৈনিকেরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই সিন্ধু অঞ্চল ছেড়ে গেছে।
তা এক অনন্য সাফল্য আপনার।
এ কথা শুনে সেলুকাস মনে মনে ভাবলেন, পরাজিত সৈন্যদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সাফল্য। সাফল্যের (!) আরও কিছু পর্ব যে সাঙ্গ হতে চলেছে। মুখে বললেন, এসব কাজে আপনাদের সহযোগিতা ছিল, তাই সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। সম্রাটকেও তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি আর আমার জেনারেল পূর্ণিমারাতের জন্য অপেক্ষা করছি।
এটা একটা শুভ কাজ। এ ছাড়া দুটো জাতিরই এক বিরাট রাজনৈতিক অর্জন।
সেলুকাস মনে মনে বললেন, যা কিছু অর্জন, তো তোমাদেরই, আমার তো সবই গেছে— রাজ্য-কন্যা সব। কিন্তু মুখে বললেন, পরাজিত সম্রাটকে সসম্মানে (?) মুক্তি এবং অর্ধসহস্র হস্তীদানের কথা নিশ্চয়ই ইতিহাস খুব মনে রাখবে।
সৌভাগ্যক্রমে এ বছর শীতের আগাম আগমনবার্তা পাওয়া গেছে। সকালে ঘাসে শিশির দেখা গেছে। বাতাসেও কেমন যেন হিম হিম ভাব। সকালের সে কথা মনে করে সেলুকাস আবার বললেন, প্রকৃতি বলে দিচ্ছে, আপনাদের আতিথেয়তার কাল শেষ হতে চলেছে।
আমাদের আতিথেয়তায় কোনো ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন।
না, কোনো ত্রুটি নেই। আমার সেনাবাহিনী গেছে, আমিও যেতে চাই। সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, ভাবাই যায় না।
তিনি হয়তো ভেবেছেন, সেই রূপকথার রাজকুমারের কথা, যে রাক্ষসের লুকিয়ে রাখা প্রাণ খুঁজে পেলে রাক্ষসের মৃত্যু হয়েছিল। সেলুকাসের লুকানো প্রাণটা সেনাবাহিনীর হাতে। এরা বিদ্রোহ করলে কিংবা তাঁকে ছেড়ে গেলে, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। তিনি তা প্রকাশ না করে আবার বললেন, আচার্য, যুদ্ধের সাধ এবার পূরণ হলো না, কিন্তু তা আমি অপূর্ণ রাখতে চাই না। আমি সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করে এন্টিগোনাসকে আক্রমণ করতে চাই, সে আক্রমণের জন্য আমি অস্থির হয়ে আছি।
এখন কি আপনার সেনাবাহিনী যুদ্ধ করতে চাইবে?
যুদ্ধে তাদের সম্পৃক্ত করতেই হবে। জেনারেল ফিলেকাস সে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সৈন্যরা আপনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে যা পায় নি, তাদের তার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। এরা শূন্যহস্ত, তাই প্রলুব্ধ। আমাদের কাজ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা। আর সৈন্যদের পরাজয়ের গ্লানিকর মনোভাবকে প্রতিশোধে রূপান্তর করা। জেনারেল সারিকাস সে কাজ করছে। সৈন্যরা তিরবিদ্ধ সিংহ। প্রচণ্ড ক্ষোভ তাদের মধ্যে। সে তা কাজে লাগাবে। আমার এখন সেখানে থাকা খুব প্রয়োজন।
কী করতে চান আপনি?
আমি চলে যেতে চাই যত দ্রুত সম্ভব।
আপনাকে কি মেয়ে যেতে দেবে?
দেবে না জানি, তবু চেষ্টা করতে হবে। আপনি চন্দ্রগুপ্তকে সামলাবেন।
আপনি ভদ্ৰবাহুকে বলছেন না কেন?
তিনি চাইবেন আমি বিয়েতে থাকি।
ভারতীয় রীতি মতে বাবাকে কন্যাদান করতে হয়। তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে বাবাকে উপস্থিত থাকতেই হবে। আপনার উপস্থিতি আমিও চাইছি।
এ কারণেই?
না, এ কারণে নয়।
তাহলে?
এখনই নয়, সময় হলে তা জানাব।
সেলুকাস চাণক্যের কথার মধ্যে কিসের যেন এক গন্ধ আবিষ্কার করলেন। ভাবলেন, চন্দ্রগুপ্তের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র নয় তো। মহামন্ত্রীকে কেমন যেন সম্রাটের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে দেখা যাচ্ছে। সম্রাট তাঁর কথার গুরুত্ব দিচ্ছেন না, প্রথম থেকেই তিনি তা দেখে আসছেন। সেলুকাস সিদ্ধান্ত নিলেন, ভদ্রবাহু নয়, তিনি চাণক্যের সঙ্গেই একটা সম্পর্ক তৈরি করে তাঁর ওপর নির্ভর করবেন।
কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলেন এঁরা। তখন দিদাইমেইয়া বলছিলেন, আমরাও আপনাদের গ্রিক পোশাক উপহার দেব, যদিও তা গ্রিক রীতিতে উল্লেখ নেই। সেখানে আছে কনের ভাইকে শুধু নারকেল দেওয়া হবে আর বরপক্ষকে দেওয়া হবে একটা সুন্দরী বউ, বলে খুব হাসলেন সবাই। হাসি থামলে তিনি আবার বললেন, আমরা দুই পুরোহিতকে একসঙ্গে বসতে দেখতে চাই।
চাণক্য বললেন, জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী জেনে নেওয়া আবশ্যক মনে করলে তা-ও জেনে নেওয়া যায়। অবশ্য আমাদের আচার্য ভদ্রবাহু জ্যোতিষশ্রেষ্ঠ।
দিদাইমেইয়া বললেন, ঠিক কথা বলেছেন। সেলুকাস, তুমি সে ব্যবস্থা করো।
সেনাবাহিনীর জ্যোতিষীরা তো চলে গেছে। সেলুকাসের কথার পিঠে দিদাইমেইয়া বললেন, সেনাবাহিনীর জ্যোতিষীরা অপদার্থ। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে তুমি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছ, যার ফল ভালো হয় নি। সেলুসিয়া থেকে রাজজ্যোতিষীকে ডেকে পাঠাও।
সেলুকাস তাঁর এই বোনকে খুব মান্য করেন। মা-বাবা, ভাইবোন আর কেউ নেই, তার একটি কারণ বটে, তবে বড় কারণ হচ্ছে, তাঁর একটি অন্ধ বিশ্বাস এই যে, দিদাইমেইয়া নাম রাখা হয়েছে একটি অ্যাপোলো মন্দিরের নামানুসারে। সেলুকাস বিশ্বাস করেন, দিদাইমেইয়াকে খুশি রাখার মধ্যে দেবতা অ্যাপোলোর খুশি কিংবা সন্তুষ্টি নিহিত রয়েছে। সেলুকাস বললেন, বেশ, লোক পাঠাচ্ছি।
এদিকে অবকাশকেন্দ্রে অপেক্ষা করছেন কর্নেলিয়া ও ফাওলিন। হায়, কেউ আসছেন না, না চন্দ্রগুপ্ত, না নিকোমেডেস। সময় যেন কাটছে না তাঁদের। পাথর সময়।
সব প্রতীক্ষার শেষ হয় না, বললেন কর্নেলিয়া।
শেষ হয় এবং হবে। তোমার প্রতীক্ষার শেষ হবে। কিন্তু তোমার বন্ধু নিকো আসবে না। সম্রাট হয়েও চন্দ্রগুপ্ত অনেক সচেতন। নিকো কখনো মানুষ হবে না। সে একটা ইয়ে।
ইয়ে মানে?
ইয়ে মানে ইয়ে, বলে খুব হাসল ফাওলিন। আবার বলল, কর্নি, তোমার বন্ধুটা আসলেই হাঁদারাম। দায়িত্ববোধ নেই।
তুমি এ কথা বলছ? আমার কী মনে হয়, জানো? নিকো বিশ্বে সবচেয়ে দায়িত্বশীল ছেলে। সে আমার দুঃসময়ে যা করেছে, এতেই বোঝা যায় সে কতটা দায়িত্বশীল। আমি তোমার কাছে ঋণী, কারণ, তোমার ত্যাগস্বীকারই আমার কাছে থাকতে তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তুমি বাধ্য করলে নিশ্চয়ই সে ছুটে যেত তোমার কাছে।
তাতে তার প্রতি সুবিচার হতো না, তোমার প্রতিও না, নিশ্চয়ই তা হতো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া একটা চাপ, যা তার মহত্ত্বকে, দায়িত্ববোধকে খাটো করত। তার সম্মানে আঘাত করা হতো।
তুমি যে খুব বুদ্ধিমতী, তোমার এ কথাও তা প্রমাণ করে। করে বুঝি?
মজা করছ?
তুমি বলো একজন সম্রাটকে জালে আটকালে কী করে?
ও যখন আমাকে প্রথম দেখে, হাঁ করে তাকিয়ে ছিল, বলে খুব হাসলেন কর্নেলিয়া।
তুমি যা সুন্দর রাজকুমারী, আমিই তো প্রেমে পড়ে গেছি। নিকোটা আসলে একটা গাধা। তোমার মতো সুন্দরীকে পটাতে পারল না। রাজকুমারী পেত, রাজ্যেরও অর্ধেক।
আমি যদি কোনো গ্রিককে বিয়ে করতাম, তাহলে নিকোকে।
তাহলে আমি?
আরে এটা কথার কথা। সে তো তোমার জন্য উন্মাদ।
একদম সত্য নয়। তাকে আমি বুঝতে পারি না।
তোমাকে সে বুঝতে পারে, এটা বড় নয় কি?
এখন বুঝতে পেরেছি, এত বড় সম্রাট কী করে তোমার কাছে কুপোকাত হয়ে গেলেন।
এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে কর্নেলিয়া ফাওলিনের গাল টিপে দিলেন। তুমি খুব সুখী হবে। নিকোর মতো ছেলে হয় না, বললেন শেষে।
কর্নি, তোমার বিয়ের সাজটা আমি করব।
গ্রিক কনের সাজ?
নয় তো কী।
না, আমার বিয়ে হবে ভারতীয় এক দেবীর সাজে। আচার্য ভদ্রবাহুর ‘কল্পসূত্র’ গ্রন্থে সে দেবীর বর্ণনা আছে।
তোমাকে কে বলল?
চন্দ্রগুপ্তই দেবীর বর্ণনাটা আবৃত্তি করে শুনিয়েছে।
সম্রাট কী বললেন, এ সাজে বিয়ে হবে?
না, আমি বলেছি।
আশ্চর্য!
আশ্চর্যই বটে। তুমি ওই বর্ণনা শুনলে তুমিও এ সাজে সাজতে চাইতে।
আমি অবাক হয়েছি অন্য কারণে। এখনই তুমি গ্রিক রীতি-ঐতিহ্য বিসর্জন দিলে?
না, দিইনি। প্রাক্-বিবাহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে গ্রিক দেবতাদের সামনে ভারতীয় দেবীর সাজে যাব না, সেখানে সাজসজ্জায় তুমি অবদান রাখতে পারো।
সে সময় তো কেউ বিয়ের সাজে সজ্জিত হয় না, ভক্তের রীতিসিদ্ধ পোশাকে দেবালয়ে যায়।
বেশ, এটুকুই গ্রিক।
একটু ভেবে ফাওলিন বলল, মন্দ ভাবো নি, যাদের সঙ্গে বাকি জীবন কাটাবে, আগেভাগে তাদের কৃষ্টি গ্রহণ করে নেওয়াই ভালো।
এ্যাই ফাওলিন, তুমি কিন্তু বিজ্ঞের মতো কথা বলছ। হালকাভাবে বলি, শোনো, ওই সাজটা দেখলে তুমিও বলবে, কর্নি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরও বলি, শোনো, যে পূর্ণিমারাতে আমাদের বিয়ে হবে, সে রাতটা কাটাব আমরা থর মরুভূমিতে এক নাম না জানা বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুর শুনে।
সম্রাট এ রকম ইচ্ছার কথা বলেছেন?
না, ইচ্ছাটা আমার।
অদ্ভুত! সুসজ্জিত বাসরঘর ছেড়ে একবারে উন্মুক্ত মরুভূমিতে। যাক্, তাহলে বাসরঘরের বাইরে বসে নিকোকে আর প্রহরা দিতে হবে না।
নিকোকে এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় নি, সঙ্গে যুক্ত হয়েছ তুমিও। তোমরা সে রাতে থর মরুভূমিতে থাকবে। তবে আমাদের থেকে দূরে। চন্দ্রগুপ্ত সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।
শাস্তি দিচ্ছ?
না, অভিসারে পাঠাচ্ছি। দেখো, খুব ভালো লাগবে। স্মরণীয় হবে ব্যাপারটা!
তাহলে তোমাকে সাজাবে কে?
চন্দ্রগুপ্তের প্রয়াত সম্রাজ্ঞীকে সাজাত যারা।
সেখানে দর্শকেরও তো দরকার হবে, আমি আগাম বুকিং দিয়ে রাখলাম।
দেবীর বর্ণনাটা শুনলে তুমি নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সাজসজ্জার কাজে।
আমি চন্দ্রগুপ্তের প্রেমে পড়ি নি।
ভদ্রবাহুর দেবীর প্রেমে পড়বে নিশ্চিত।
তুমি এখনই ভারতীয় হয়ে যেতে চাচ্ছ?
না, ভারত-সুন্দরকে অন্তরে জড়াতে চাচ্ছি।
বহিরাভরণ কি অন্তরের সুন্দরকে প্রকাশ করবে?
না, তা করবে না, তবে অন্তরের প্রেমকে বাইরে প্রকাশ করবে।
ফাওলিন আর কিছু বলল না, শুধু হাসল।
কর্নেলিয়া বললেন, গ্রিকরা দিগ্বিজয়ে বের হয়ে বিজিত রাজ্যের নারীদের জোর করে ভোগ করেছে এবং তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে। তার পরিণাম ভয়াবহ। তুমি আমাদের পরিবারটিকে দেখো। মিসরীয় প্রিন্স আপামাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে আসেন আমার বাবা। তাঁর প্রথম সন্তান এন্টিওকাস ওই অবস্থার সন্তান। এই সন্তান তাঁর সঙ্গে কী ব্যবহার করেছেন!
পরে তিনি তো আপামাকে বিয়ে করেছেন।
এই পুত্রসন্তান জন্মানোর পর। তাঁকে তিনি ভালোও বেসেছেন। সে ভালোবাসা পর্বের সন্তান লাউডিস। তাকেও দেখো। গ্রিকরা সারা মধ্যপ্রাচ্য, মিসর ও সিন্ধু এলাকা দখল করেছে বটে, সে দখল এমন কোনো জনগোষ্ঠীর জন্ম দেবে না, যারা গ্রিক বলে পরিচয় দেবে কিংবা গ্রিকদের প্রশস্তি গাইবে। সব মুছে যাবে। শুধু থাকবে আমাদের ভালোবাসা।
মৌর্যরা না জয়ী হলে কি তোমার ভালোবাসা জয়ী হতো?
ভালোবাসার জয় সর্বত্র। ভালোবাসা কোথাও পরাজিত হয় না। কোনোটায় পূর্ণতা আসে মিলনে, কোনোটায় সমাপ্তি ঘটে ত্যাগে-ট্র্যাজেডিতে। দুটোতে প্রেম-ভালোবাসা বিজয়ী হয়।
নিকো আমাকে এক চিঠিতে জানিয়েছে, তুমি চন্দ্রগুপ্তের বিজয়ই চেয়েছিলে।
সে তার মতো করে ভেবেছে, হয়তো ঠিকই ভেবেছে। চন্দ্রগুপ্তের পরাজয় আমি কেমন করে মানব? তুমি কি নিকোদের পরাজয় চাইবে, না মানতে পারবে? চন্দ্রগুপ্তের পরাজয় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাত, পরিণাম কী হতো, তা বলা শক্ত। গ্রিকরা হেরে যাওয়ায় কষ্ট পাই নি, তা তো নয়। এই পরাজয়ও মেনে নেওয়া যায় না। গ্রিকরা পরাজিত হয়েছে নিজেদের পাপের জন্য। এই পাপের শাস্তি আমাকে কেন আগে ভোগ করতে হবে?
তুমি একজন গ্রিক, তাই।
হ্যাঁ, আমি একজন গ্রিক, বাবা গ্রিক বলে। সিরীয়ও হতে পারতাম, যদি সমাজে মায়ের পরিচয়টা বাবার পরিচয়ের ওপরে হতো। জাতিগত অহমিকা আমাদের গ্রিকদের এত অন্ধ করে দিয়েছে যে আমরা জয় আর বিজিতদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারি না। এই মনোভাবই একসময় গ্রিকদের ডোবাবে।