মৌর্য – ৭

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর দপ্তরে কাজ করছিলেন। দপ্তরেও নারী রক্ষীরা তাঁকে ঘিরে আছে। গ্রিক রাষ্ট্রদূতের বিবরণ মতে, এরা মা-বাবা কর্তৃক বিক্রয় হওয়া দাসী। একটি ষাঁড়ের বিনিময়ে কিনে নেওয়া যায় তাদের। রাজার স্বর্ণমুদ্রা তো আরও বেশি মূল্যবান। স্বর্ণমুদ্রা পেলে বাবা-মায়েরা বেশি খুশি হয়। তবে এসব দাসী রক্ষী অনেক বিশ্বস্ত হয়। সম্রাট তাদের গোয়েন্দা কাজেও ব্যবহার করেন।

সম্রাজ্ঞীর গতিবিধি দেখার জন্য অজন্তা নামের এক দাসীকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। অজন্তাকে আনা হয়েছে অবন্তী থেকে। সম্রাট তাকে ডেকে পাঠালেন। অজন্তা সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তোমাদের মধ্যে গ্রিক জানে এমন কেউ কি আছে?

একজন জানে, মহামান্য সম্রাট, গোয়েন্দার কাজ করানোর জন্য তাকে গ্রিক শেখানো হয়েছিল।

ওকে ডেকে নিয়ে এসো।

গ্রিক জানা দাসীকে নিয়ে আসার পর অজন্তাকে চলে যেতে ইশারা দিলেন সম্রাট। তুমি গ্রিক ভাষা জানো?

জি, মহামান্য সম্রাট।

লিখতে পারো?

পারি।

তুমি একটি চিঠি লিখবে গ্রিক ভাষায়। কিন্তু এ চিঠির কথা তুমি আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না।

জি, মহামান্য সম্রাট।

আমি সংস্কৃত ভাষায় লিখে দিচ্ছি, তুমি গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করবে। সম্রাট লিখলেন :

রাজকুমারী,

আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। নিশ্চয়ই আপনার কৌতূহল জাগবে কে এই পত্রলেখক। আমার পরিচয় খুবই সামান্য। সে পরিচয় নিয়ে এখনই আপনার মুখোমুখি দাঁড়ানোর অবস্থা নেই বলে পরিচয়টা না হয় আজ গোপনই থাক।

শুনেছি সৌন্দর্যে গ্রিক রমণীরা দেবীদেরও হার মানায়, আপনাকে দেখে তা স্থায়ী বিশ্বাসে পরিণত হলো। এমন সুন্দরী রমণী আমি কখনোই দেখি নি। হিন্দু পুরাণের স্বর্গীয় দেবীদের অপরূপ রূপের মহিমা প্রতিমায় ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি। ভগবানের সৃষ্টির কাছে মানুষের সৃষ্টি যে কত নগণ্য, তা আপনাকে না দেখলে কখনো মনে হতো না।

আপনাকে দেখেই আমি ভালোবেসে ফেলেছি। অপরাধ নেবেন না, এর জন্য আমি মোটেও দায়ী নই। মনের ওপর কী কারও নিয়ন্ত্রণ থাকে? যদি কেউ তাকে হরণ করে নেয়, বিচারে তারই তো দায়ী হওয়ার কথা।

আজ আর নয়। আপনার পত্রের প্রত্যাশায় রইলাম।

ইতি
আপনার রূপমুগ্ধ
প্ৰণয়প্রার্থী

দূত মারফত পত্র পাঠানো নিরাপদ ছিল না, তাই উত্তমভাবে প্রশিক্ষিত এক কবুতরের মাধ্যমে পত্রটা প্রেরণ করা হলো। সম্রাট প্রতীক্ষায় রইলেন পত্রের উত্তরের জন্য। দাসী অপেক্ষা করল পত্র পাঠ করে দেওয়ার জন্য।

এই দাসীর নাম মন্দাকিনী। মন্দাকিনী স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কল্পনায় কত কিছু যে ভাবে। কল্পনার চোখে দেখতে পায় সে গ্রিক রাজকুমারী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পত্রের জবাবে নিজেই রাজদরবারে এসেছেন। তখন দোভাষী হিসেবে তার ডাক পড়েছে। রাজকুমারী সম্রাটের অতিথিশালায় উঠেছেন—তাঁর সব যত্ন-আত্তির ভার পড়েছে তার ওপর। এই রাজকুমারীর জন্য সম্রাটের অন্তঃপুরীতে তার একচ্ছত্র প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়েছে। তার মনে প্রশ্ন, সম্রাট কি রাজকুমারীর আগমন প্রতীক্ষায় আছেন, না তার পত্রের উত্তরের অপেক্ষায়?

অজন্তা দাসী পত্রের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুই জানে না। মন্দাকিনীকে জিজ্ঞেস করেছিল, সে কিছু বলে নি। চিঠির কথাও বলে নি, বলেছে, সম্রাট গ্রিক ভাষা শিখতে চাইছেন।

তুই শেখাতে রাজি হলি?

রাজি হব না মানে? শূলে চড়ব?

সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করলেও অজন্তা গোয়েন্দা নয়। তবে একজন গোয়েন্দা সব খোঁজখবরই রাখছে। সম্রাটের বিরুদ্ধেও গোয়েন্দাগিরি! সে সাহস একজনেরই আছে, তিনি চাণক্য। তাঁর গোয়েন্দা হচ্ছে নির্জলা। নির্জলা মন্দাকিনীর গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। নির্জলার প্রভাব সব মহলেই অপ্রতিরোধ্য। দাসী মহলে প্রতাপ সবচেয়ে বেশি। নির্জলার শখ সেজেগুজে থাকা। গহনা তার খুব পছন্দ। স্বর্ণ, দামি পাথর, হীরা—সবই তার অঙ্গে শোভা পায়। ফুলের নকশা করা মসলিনও তার সংগ্রহে আছে। তাম্বুল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। তাম্বুলপাত্রটি খাঁটি রুপা দিয়ে তৈরি, মুক্তা বানানো।

নির্জলা মন্দাকিনীকে ডেকে নিয়ে এসেছে। নানা কথার ফুলঝুরি। ফাঁকে পানের পিচকি ফেলে বলল, মন্দাকিনী, কবুতরের পা সুন্দর, ঠোঁটও সুন্দর। চোখ তো আরও সুন্দর। এই সুন্দর পাখিটা কী নিয়ে কোথায় উড়ে গেল?

দিদি, কোন কবুতরের কথা বলছ?

তুমি জানো না?

না তো, দিদি।

আচ্ছা, আচ্ছা। না জানাই ভালো, তবে জানেটা কে?

দিদি, আমি জানি না, তুমি ঠিকই বের করতে পারবে।

তা পারব। পৌরব্য বাহরিকের কাজ করি না? আমার কাছে কোনো কিছু গোপন থাকে না।

পৌরব্য বাহরিক হচ্ছে নগর পরিদর্শক। এ পদে অনেকেই কাজ করে, নির্জলা তাদের একজন। তাদের সর্বত্র যাতায়াতের সুযোগ রয়েছে। নির্জলা কার গোয়েন্দা, এটা কেউ জানে না। তার পেটে সব খবর থাকে, এটাই সবাই জানে। প্রভাব বিস্তারের জন্য সব রকম তথ্য জানা গুরুত্বপূর্ণ।

কবুতরের কণ্ঠ থেকে পত্রটি উদ্ধার করে রাজকুমারী কর্নেলিয়ার সহচরী দিমিত্রি। সে কবুতরটিকে ধরে রেখে পত্রটি রাজকুমারীকে দেয়। রাজকুমারী পত্র পাঠ করে খুব কৌতুক বোধ করেন। কিছুক্ষণ পর তিনি উপলব্ধি করেন, যে ভারতীয় গ্রিক জানে এবং রাজকুমারীকে পত্ৰ লেখে, তাকে নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করা উচিত নয়। তবে তাকে নিয়ে মজা করা যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পত্রের উত্তর দেবেন।

কবুতরটি কোথায়?

দিমিত্রি বলল, আমার হেফাজতে আছে প্রিন্সেস।

ধরে রাখো, পত্রের জবাব আমি পাঠাব।

অচেনা মানুষের পত্রের জবাব দেবেন, প্রিন্সেস?

তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? ইন্ডিয়া তো একসময় অচেনাই ছিল। এখন আমরা এখানে আছি। ভেবো না, শুধু মজা করার জন্য পত্রের জবাব দেব।

রাজকুমারী নিজের হাতে পত্রের জবাব লিখলেন। পত্রটি এ রকম:

হে আমার অজানা প্রণয়প্রার্থী,

কর্নেলিয়া আর ঝিলামের নির্মল শুভেচ্ছা। পত্রপাঠে আমি অভিভূত। যে এত সুন্দর পত্র লিখতে পারে, সে সামান্য নয়, অনেক বড় হৃদয়ের অধিকারী। আমি আপনাকে দেখি নি, কিন্তু অনুমান করতে পারি, আপনিও গ্রিক দেবতাদের মতো সুন্দর এবং সুঠাম দেহের অধিকারী। হিন্দু পুরাণের স্বর্গীয় দেবীদের কথা আমি জানি না, এদের সম্পর্কে জানতে পারলে ভালো হতো, দেবতাদের কথাও।

আমি তো আপনাকে দেখি নি, তাই আপনার হস্তে লিখিত পত্রের প্রেমেই পড়েছি। মন হরণের দায় স্বীকার করছি, অপহরণের নয়।

ইতি
প্রিন্সেস

নিতান্ত দুষ্টুমি করেই প্রিন্সেস কয়েকটি গোলাপপাপড়ি পত্রের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে কবুতরের গলায় পত্রটি ঝুলিয়ে দিলেন। অতঃপর প্রাসাদের ছাদে উঠলেন। সহচরীদের নিয়ে বিকেলের ঝলমলে রোদে আকাশে উড়িয়ে দিলেন কবুতরটিকে। উদ্দেশ্য, কবুতরটি কোন দিকে যায়, তা দেখা। কবুতর কাত হয়ে, চিত হয়ে, ডিগবাজি খেয়ে গন্তব্যপথে উড়ে গেল। বিকেলের সোনালি রোদ তার পাখায় সোনালি পরশ বুলিয়ে দিল। রাজকুমারী এবং তার সহচরীগণ সমস্বরে চিৎকার করে উল্লাস প্রকাশ করলেন—যেন সবাই মিলে উৎসবের পায়রা উড়াচ্ছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *