মৌর্য – ৬৯

৬৯

প্রত্যাবর্তনের আদেশ পেয়ে সেলুসিড আর্মি নির্ধারিত সময়েই সেলুসিয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। প্রথমে যাচ্ছে কিউকেকাসের দোরি ও সারিসাধারী পদাতিক সৈন্যরা। কিউকেকাস যাচ্ছেন না। এ দুটি বাহিনীকে কমান্ড দিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব টুআইসি বা সেকেন্ড ইন কমান্ডের। সৈন্যরা হতাশাগ্রস্ত। গ্রিকরা সুশৃঙ্খল হলেও এখন সে অবস্থা নেই। পরাজয়ের গ্লানিতে ডুবে আছে। এ ছাড়া সেকেন্ড ইন কমান্ডকে মানতে চাইছে না। বিশৃঙ্খলভাবে এলোমেলো পা ফেলছে আর গালিগালাজ করছে। ব্রুটাস বরাবরই বিদ্রোহপ্রবণ। সে প্রায় চিৎকার করেই বলছে, শালির বিয়ে। তিনি রয়ে গেলেন আমোদ-ফুর্তি করবেন, আর আমরা হেঁটে হেঁটে সেলুসিয়ায় যাব।

তোমার মুখে কোনো কিছুই আটকায় না দেখছি, থামো, বলল সহযোদ্ধা কিউলিস।

ভুল কিছু বললাম?

ঠিকও কিছু বলো নি। এখন চুপ করে হাঁটো, অনেক দূর যেতে হবে।

হাঁটতে ইচ্ছা হচ্ছে না।

সমস্যা কোথায়?

তৃতীয় একজন সৈন্য বলল, যুদ্ধজয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে পথে অগ্রসর হওয়া এক, অন্তত পলাতক হওয়াও শক্তি জোগায়, পরাজিতের পা চলতে চায় না। ব্রুটাস অনেকের মনের কথাই বলেছে।

কিউলিস প্রবীণ যোদ্ধা। বলল, তোমরা বন্দীর মতো যাচ্ছ না। মুক্ত সৈন্য হিসেবে সমরাস্ত্র এবং সামরিক পোশাকে যাচ্ছ, মনে করো পরাজিত নও, এক এলাকা থেকে প্রত্যাহার করে অন্য এলাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

তৃতীয় সৈন্যটি বলল, কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু আমাদের মনমানসিকতা এ যুক্তি গ্রহণের জন্য অনুকূল নয়, সত্যটা হচ্ছে এই, আমরা পরাজিত হয়েছি, আমাদের রাজকন্যাকে শত্রু সম্রাটের হাতে তুলে দিয়ে তবে এসেছি।

এভাবে বলছ কেন? আমরা একটা সম্মানজনক সমঝোতা চুক্তির আওতায় এসব করেছি।

কিউলিসের কথায় তৃতীয় সৈন্যটি বলল, সবই সত্য, অবস্থা এর চেয়ে আরও খারাপ হতে পারত। কিন্তু যা হারিয়েছি, তাকে ছোট করে দেখা চলে না। সে গ্লানি মনে ক্লান্তি হয়ে পা অবধি বিস্তৃত হয়েছে, তাই পা চলছে না!

তাদের পেছনে পদাতিক বাহিনীর মালবাহী গাড়ি। কিছু সৈন্য এগুলোকে পাহারা দিয়ে চলেছে। রাস্তার দুপাশে দুই সারিতে চলেছে মূল দুটি বাহিনী, শুধু মালামাল পরিবহনের প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যরাই পথজুড়ে চতুষ্কোণাকৃতির ব্যূহ রচনা করে আছে এবং সামনে অগ্রসর হচ্ছে। মালবাহী গাড়িবহরের মধ্যে খাদ্য ও পানীয়ের গাড়ি রয়েছে।

শীত আসার পূর্বে প্রখর রোদ। দুপুরে তার তেজ অনেক বেড়ে গেছে। রুক্ষ ও বন্ধুর রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এরা। আজকের গন্তব্য ঝিলাম নদীর বিলাসকেন্দ্র। অবশ্য বিলাস বা বিনোদনকেন্দ্রে এদের স্থান হবে না, এটি রাজকীয় অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট। এর আশপাশে তাঁবু খাটিয়ে এদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা কাছে নয়, বেশ দূরে। তাদের স্কটের নামে প্রহরা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মৌর্য বাহিনীর কিছু সদস্য। উপহারের কিছুসংখ্যক যুদ্ধহস্তী ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে পদাতিক বাহিনীগুলোর ভেতরে। হস্তীগুলোর গতিবিধি এবং শুঁড় ও কান নাড়াচাড়ার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এরা বেশ বিরক্ত। তবে ক্ষুব্ধ নয়। এরা মৌর্য সওয়ারি নিয়ে মাঝপথ দিয়ে রাজকীয় চালে হাঁটছে।

সেলুসিড বাহিনীর মধ্যে এপিলেকটোই (অশ্বারোহী) রয়েছে একশ জন, পরপর। এরা নিরাপত্তার দিকটা দেখছে, প্রাথমিকভাবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান করা এদের কাজ। শৃঙ্খলাও তারাই দেখছে। শুধু বাইরে আক্রমণ, লুটপাট কিংবা পালিয়ে যাওয়া রোধ করার দায়িত্ব মৌর্য সৈন্যদের। মৌর্য সৈন্যদের হাতে মৌর্য পতাকা এবং সেলুসিড আর্মির হাতে রয়েছে সেলুসিড পতাকা।

একরা (জায়গির রীতির সৈন্য) বাহিনী বেশ সুশৃঙ্খল। এরা বনেদি হেলেনিস্টিক আর্মি। সমস্যা হচ্ছে, কাতুইকোই (শুধু যুদ্ধের জন্য সাময়িক সৈন্য)। এরা গোলমাল বাধাবেই। রাস্তার পাশে গ্রীষ্মের তরমুজ ধরে আছে কৃষকদের খেতগুলোতে। এরা লোভ সামলাতে পারল না। লাইন ভেঙে ছুটে গেল কেউ কেউ তরমুজ খেতে। আর তখনই বিপত্তি দেখা দিল। মৌর্য সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। কাতুইকোইয়ের অপরাধ খুব বড় নয়, মৌর্যদের বাড়িঘরে লুটতরাজের চাইতে অনেক ছোট। তবু এরা সাজা পেল সেলুসিড কমান্ডের কাছ থেকে। অপরাধীদের একরা বাহিনীর কিছু মালামাল বহন করতে হবে। এগুলো কাতুইকোইদের মালামালের অতিরিক্ত।

এখানে গোলযোগের সংবাদ পেয়ে পেছনে থাকা এপিলেকটোই বাহিনীর দুই সদস্য ঘোড়ার পিঠে চাবুক বসাল। কয়েক মুহূর্তেই ছুটে এল ঘটনাস্থলে। শুনতে পেল একরা সদস্যরাই কম শাস্তিতে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলেছে।

ব্রুটাস কাছেই ছিল। সে-ও সারি ভেঙে এগিয়ে এল। তার হাতে ছিল আনাদোল অস্ত্র। এটা দেখতে শিবের ত্রিশূলের মতো। মৌর্যদের হস্তীতে আরোহী সৈন্যদের হাতে প্রথম সে ত্রিশূল দেখতে পেল। এতে তার প্রচণ্ড ঘৃণার উদ্রেক হলো। সারিতে ফিরে গিয়ে সে অস্ত্রটি রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলে দিল। একরা বাহিনীর সদস্য সে। তার কোর্ট মার্শাল হতে পারে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে বলল, এই অস্ত্রের ভার বহন করা এখন তার পক্ষে সম্ভব নয়।

তাহলে অন্য কারও কাছে দিয়ে দিতে। তুমি জানো, এটি একটি আধ্যাত্মিক অস্ত্র।

এই অস্ত্র যখন আমার কাঁধে, আধ্যাত্মিক কোনো শক্তি আমাকে সহায়তা করে নি, ওই দেখো তাদের (মৌর্য) সহায়তা করেছে, আমাকে দিয়েছে তীব্র ঘৃণা করার ক্ষমতা। আমি তাই করেছি।

সেলুসিয়ায় পৌঁছে এ অপরাধের বিচার হবে। এখন কোনো ঝামেলা ছাড়াই হাঁটছে এরা। পথচারীরা দূর থেকে এ বাহিনীকে হেঁটে যেতে দেখে নিজেরা আত্মগোপন করে এদের যাওয়ার পথ করে দিচ্ছে।

এ রকম দুই আত্মগোপনকারী হচ্ছে তক্ষশীলার উদ্বাস্তু। আলেকজান্ডারের কালে গ্রিকরা এদের বাস্তুচ্যুত করে। গ্রিকদের পরাজয়ের কথা এরা জানে। অস্ত্র নিয়ে স্বপোশাকে ফিরে যাচ্ছে বলে এদের মনে প্রচুর ক্ষোভ। একটি জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে একজন আরেকজনের উদ্দেশে বলছে, পরাজিত সৈন্যদের তো বেঁধে নিয়ে যাওয়া উচিত। আমি হলে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে টেনেহেঁচড়ে নিতাম।

চোখ উপড়ে ফেলতাম আমি, হাতির পায়ের নিচে পিষে মারতাম। চাণক্য একি দয়া দেখাল তাদের প্রতি।

বেটা কূটমন্ত্রী, বলল আরেকজন। তার ভাব বোঝা যায় না। আমাদের সহজ-সরল সম্রাটকে ভুল বুঝিয়ে এ কাজ করেছে।

সম্রাজ্ঞী দুরধরাকে সেই হত্যা করেছে গ্রিক মেয়েটাকে গছাবে বলে। ভগবানই জানেন সে আবার কী চাল শুরু করেছে। সারি তো দেখছি অনেক লম্বা। মাঝেমধ্যে আমাদের সৈন্যরাও আছে।

মন্ত্রী এদের বিনা শাস্তিতে প্রহরা দিয়ে পাঠাচ্ছে। রাজকীয় অতিথি! ইচ্ছা হচ্ছে এদের ওপর পাথর ছুড়ে মারি।

তা ঠিক হবে না।

এরা আমাদের ভিটেছাড়া করেছে।

পরাজিত তো হয়েছে। আমরা আবার আমাদের ভিটেমাটিতে ফিরে যাব।

কিছু কি সেখানে আছে?

তা নেই, বাড়িঘরের চিহ্ন হয়তো নেই, ভিটে তো আছে। নিজের বাড়ি। ফলের গাছ, পুকুর, তুলসী ভিটে—এসব তো ফিরে পাব। আমরা বড় হয়েছি সেসব ভিটেমাটিতে, তা ফিরে পেলেই যথেষ্ট। এখন বোধ হয় আম-কাঁঠালের গাছে পাখিরা বাসা করেছে।

তুমি স্বপ্ন দেখছ? আমার স্বপ্ন মরে গেছে। তাদের আক্রমণে আমি আমার আপনজনদের হারিয়েছি। শূন্য ভিটায় গেলে আমি সে হাহাকারই শুনব। তবু যাব। স্মৃতিভরা সে ভিটা।

অসুস্থ ও চলনশক্তিহীন সৈন্যদের নেওয়া হচ্ছে গরু, খচ্চর ও গাধাটানা শকটে করে। কিন্তু পথে যারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, তাদের নেওয়ার জন্য পূর্বপরিকল্পনা বলতে কিছু নেই। জওয়ানেরা সবলে দাপটে সেলুসিয়ায় ফিরে যাবে, এ রকম প্রত্যাশা ছিল সেলুকাসের। কিন্তু পথিমধ্যে বেশ বিপত্তি দেখা দিল। অসুস্থদের নিয়ে বিশৃঙ্খলা প্রায় চরমে। কাঁধে করে অসুস্থ বা আহত সৈন্যদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া যায়, শত মাইল অতিক্রম করা যায় না। পথিমধ্যে কিছু বিশ্রামঘাঁটি আছে, সিদ্ধান্ত হলো, তাদের এখানে রেখে যাওয়া হবে। এরা সুস্থ হয়ে পরবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দেবে।

প্রথম সেনাদলটির প্রত্যাবর্তনের আগে কিছু আনুষ্ঠানিকতা ছিল। ডিপার্চার প্যারেড ছিল তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্যারেডে নিয়মানুযায়ী পরাজিত বাহিনী হিসেবে সেলুসিড আর্মিকে মৌর্য সর্বাধিনায়ক চন্দ্রগুপ্তকে আর্মি স্যালুট করতে হয়েছে। সেখানে অবশ্য একটি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে, সেলুকাসকে পরাজিত সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্যালুট প্রদানের পরিবর্তে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে স্যালুট গ্রহণ করেছেন। মহামন্ত্রী চাণক্য তার বিরোধিতা করে মত প্রকাশ করেছিলেন চন্দ্রগুপ্তের কাছে। চন্দ্রগুপ্ত তা না শুনে বলেছেন, অর্থশাস্ত্রের বিধিসম্মত আচরণ এখানে পালিতব্য নয়, কারণ, প্রতিবেশী বা পরাজিত দেশীয় রাজন্যবর্গের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হতে পারে, পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্ত থেকে আসা কোনো সম্রাটের ক্ষেত্রে তা ক্ষমার যোগ্য। এ ছাড়া আমরা একটা নতুন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছি। কাউকে সম্মান দিলে সম্মানের হানি ঘটে না, বরং সম্মান বৃদ্ধি পায় আচার্য ভদ্রবাহু তাতে সমর্থন দিয়েছেন। বলেছেন, ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ। আরও বলেছেন, বিজিত রাজা এবং রাজ-অমাত্য ও প্রজাদের প্রতি বিজয়ী রাজার আচরণ সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রে যা যা বলা হয়েছে, তা-ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এখানে নতুনভাবে ভাবতে হবে। কথাটি যে মহামন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয় নি। শেষ পর্যন্ত উভয় সম্রাটকে অভিবাদন জানিয়ে সেলুসিড আর্মির সদস্যরা প্রীতিবোধ করেছে। কোনো রকম হিংসা বা বিদ্রোহের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়েছে।

এটা ছিল বিজয়ী মৌর্য সেনাদের জন্য অধিকতর নিরাপদ। সেলুসিড আর্মিকে নিরাপদে তাদের সীমানায় পৌঁছে দেওয়ার ঝুঁকি মোকাবিলায় চন্দ্রগুপ্তের ঔদার্য বড় ফলদায়ক হয়েছে। যেটুকু বিশৃঙ্খলা হয়েছে, তা শুধু নিজেদের মধ্যে এবং বেশির ভাগ প্রাকৃতিক কারণে। শুষ্ক মরুভূমি, বন্ধুর পথ এবং বৈরী আবহাওয়ার কারণে বহু সৈন্য আহত কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। পায়ে ঘায়ের সৃষ্টি হয়।

চলতে চলতে দুপায়ে একরকম ব্যথা অনুভব করে ব্রুটাস। ক্রমে তা যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। আর চলতে পারছে না সে। তাকে একটি আশ্রয়ঘাঁটিতে ফেলে রেখে যায় ওরা। এ রকম আরও দুয়েকজন আছে। তাদের সমস্যাও একই প্রকৃতির। একটি পরিত্যক্ত চালাঘরে আছে এরা। পায়ের ক্ষত থেকে ক্রমেই দুর্গন্ধ নাকে আসছিল তার। সে ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী একটা মনোভাব নিয়ে আছে। নিজের সঙ্গেও আপস করতে পারছে না। তাদের সম্রাটকে মৌর্যরা যে সম্মানটুকু দিয়েছে, তা-ও এখানে ক্ষুব্ধ কিংবা বিদ্রোহী মনোভাবের নিরাময় হয়ে আসে নি।

সে পা দুটি ছড়িয়ে দিয়ে নিতম্বের ওপর বসে পড়েছে। সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ক্ষতের মধ্যে কিছু একটা লাগাতে দিয়ে গিয়েছিল। এটা তার হাতে আছে। অন্যরাও একই ওষুধ পেয়েছে এবং আগে থেকে আছে বলে তা ক্ষতস্থানে লাগাচ্ছে। ব্রুটাসের মেজাজ তুঙ্গে। সে উপলব্ধি করে, তার পরাজয় দুভাবে হয়েছে। প্রথমটা যুদ্ধে মৌর্যদের কাছে, দ্বিতীয়টা এই ক্ষতের কাছে। অন্যেরা যাচ্ছে, সে যেতে পারছে না। সান্ত্বনার ব্যাপার ছিল, আরও কয়েকজন সহযোদ্ধা তার সঙ্গে আছে, কিন্তু সে তা গ্রাহ্য করছে না, ভাবছে, ওরা যাচ্ছে, আমি নই কেন

আহতদের মধ্যে একজন হচ্ছে পেরিপ্লাস। শারীরিক সমস্যা, অর্থাৎ জ্বর নিয়েই সে পদব্রজে পদাতিক বাহিনীর সাথে যাত্রা করেছে। জ্বর তাকে দুর্বল করে ফেলেছিল। সঙ্গে যোগ হয়েছে পাতলা পায়খানা। তারপরও অসুস্থদের সঙ্গে সে শকটে চড়ে যেতে চায় নি। চায় নি, কারণ, জীবন সম্পর্কে তার একরকম দার্শনিক ভাবের উদ্রেক হয়েছে। সে বলল, ব্রুটাস, আমি জানি তুমি খেপে আছ, লাভ নেই, তুমি নিজের যত্ন করো। ওষুধ লাগাও আর দেবতাদের কথা ভাবো, সবই নশ্বর। মানুষ তার নিয়তির ঊর্ধ্বে নয়।

বিরক্ত লাগছে, পেরিপ্লাস। এসব শুনতে মন চাইছে না।

তৃতীয় একজন ঘায়ে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বলল, পেরিপ্লাস, ওকে তার মতো থাকতে দাও। সে তার শান্তি নিজেই খোঁজ করুক। মানুষের সৃষ্টি হয়েছে সুখের জন্য। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বিপত্তি সেখানে বাধার সৃষ্টি করে।

এ যুদ্ধে পরাজয় পেরিপ্লাসকে দার্শনিক বানিয়ে দিয়েছে। সে ভাবল, সত্যিই তো, মানুষের সৃষ্টি হয়েছে সুখের জন্য। সুখটা অন্তরের ভেতরই কোথাও আত্মগোপন করে আছে। তার সাক্ষাৎ মেলে সহজ-সরল প্রয়োজনের পরিপূর্তিতে। দুঃখও মনের ভেতরই লুকিয়ে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগাকাঙ্ক্ষা তাকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। তার নিশ্বাসে বিষ।

থর মরুভূমির উত্তপ্ত একটি চালাঘরে থাকাকালেই শারীরিক কষ্টকে সে জয় করেছিল। বুদ্ধি দিয়ে নয়, সমস্ত সত্তা দিয়ে সে উপলব্ধি করেছিল, এ পৃথিবীতে ভয়ংকর বলে কিছু নেই, যুদ্ধের ভয়াবহতায় মৃত্যু আছে, যন্ত্রণা আছে, তবে তার সীমাও আছে। আবার এই যে মুক্তি এবং এর পরম আনন্দ, তার সীমা আছে। তাই কোনোটাকে চূড়ান্ত ভেবে কষ্ট কিংবা উৎফুল্ল হওয়ার কারণ নেই। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, এ পা দুটোই এখন অসহ্য, আর কিছু নয়। তবু আমি হেঁটেই সেলুসিয়ায় যাব। কোনো বাধা মানব না।

কেউই বাধা মানে নি, আদেশ পেয়েই সবাই ছুটে গেছে স্বদেশের দিকে। ক্লান্ত হয়েছে, অসুস্থ হয়েছে, কেউ কেউ উত্তেজিত হয়েছে, কিন্তু সেলুসিয়ায় পৌঁছে সব কষ্ট আর গ্লানি ভুলে গেছে।

বড় বিশৃঙ্খলা কিংবা লুটপাটের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, শেষে কোনো উল্লেখযোগ্য গোলযোগ ছাড়াই পর্যায়ক্রমে সৈন্য প্রত্যাহার হয়ে গেল। সম্রাট সেলুকাস এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও নিরাপত্তাকর্মীরা এখানে থেকে গেছে। চন্দ্রগুপ্ত এদের সবাইকে রাজকীয় অতিথি করে রেখেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *