মৌর্য – ৬৮

৬৮

সেলুসিড সেনাবাহিনীর পুরোহিত দিদাইমেইয়ার সামনে উপস্থিত হয়েছেন। ভারতের মতোই বহু ঈশ্বরবাদী একটি ধর্মের পুরোহিত তিনি। সেলুসিড সাম্রাজ্যের মূলে যে দেবতার পিতৃপ্রতিম অবস্থান, সেই অ্যাপোলো দেবতার বড় ভক্ত তিনি। দিদাইমেইয়া এ সংবাদ জেনে আনন্দে আপ্লুত। কর্নেলিয়ার বিয়ের জন্য তিনি এ রকম একজন পুরোহিতকেই খুঁজছিলেন।

তবে সমস্যা একটি আছে। দিদাইমেইয়া এই সমস্যার কথা জানেন না। এই পুরোহিত কখনোই বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন নি।

পুরোহিত বেকায়দায় পড়ে যাওয়ার আগেই সংবাদ এল যে সেলুসিড সৈন্যরা তিন দিনের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করছে। এ সংবাদে বেশি আহত হলেন লাউডিস। তিনি অসহায়ের মতো দিদাইয়েইয়ার দিকে তাকালেন। দিদাইমেইয়া ভেবে পেলেন না কী বলবেন। তিনি অ্যাপোলো মন্দিরের একটি নকশা চেয়ে পুরোহিতকে বিদায় করলেন। পরে লাউডিসকে বললেন, চলো সেলুকাসের কাছে যাই। সেখানেই বিষয়গুলোর মীমাংসা করতে হবে।

আমিও তাই চাই। বলে সেলুকাস দিদাইমেইয়াকে আরও বললেন, এখানে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে, বীর্যবত্তা হারাচ্ছে, পেশাদারত্ব নষ্ট হচ্ছে এবং অনিষ্টকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। তাই দ্রুত এদের সেলুসিড সাম্রাজ্যে নিয়ে যেতে চাই। সেখানে এরা সংঘবদ্ধ হবে। আমরা এন্টিগোনাসের রাজ্য আক্রমণ করব।

এখন আবার যুদ্ধ করতে চাইছ?

যুদ্ধজয় ছাড়া এ পরাজয়ের গ্লানি মুছে যাওয়ার নয়।

বিয়ের অনুষ্ঠান?

খুব সংক্ষিপ্তভাবে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

অনুষ্ঠানে জেনারেল কিউকেকাস থাকবে না? তুমি কি তাকে সৈন্যদের সঙ্গে সেলুসিয়ায় পাঠাচ্ছ?

নিয়ম তো তাই। তবে সে থাকতে চাইলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।

তাকে বিয়েতে থাকতে হবে। তুমি সে ব্যবস্থা করো। আরেকটা ব্যাপার, বিয়েটা হবে গ্রিক ও ভারতীয় উভয় রীতিতে। তাই আমাদের পুরোহিতের প্রয়োজন। আমি আর্মির পুরোহিতকে ডেকেছিলাম, কিন্তু আমার মনে হয় সে তার জন্য উপযুক্ত নয়, সেলুসিয়া থেকে পুরোহিত ডেকে পাঠাও। এখানে এবং রাজধানী পাটালিপুত্রে দুটি অ্যাপোলো মন্দির হবে, চন্দ্রগুপ্তের তা-ই ইচ্ছা। তাতে মনে হয় স্ব স্ব ধর্ম পালনে স্বাধীনতা থাকবে।

চন্দ্রগুপ্ত তা বলল? ওদের আমি বিশ্বাস করি না। ওরা বলে একটা, করে অন্যটা।

অবিশ্বাস করা যায় এখনো এমন কোনো কাজ ওরা করে নি, বরং বিশ্বাসভাজনতার পরিচয়ই দিয়েছে। তোমাকে, আমাদের, গ্রিকদের সম্মান-মর্যাদা দিয়েছে। তোমার সৈন্যদের সমরাস্ত্র আর সামরিক পোশাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তুমি যা-ই করো, এ ব্যাপারগুলো মাথায় রেখো। অথচ তোমার সন্তান তোমার জন্য কী করেছে তুমি জানো?

সে আর কী করেছে?

তুমি বন্দী হয়েছ জেনে সে জেনারেল মোলনকে ডেকে পাঠিয়ে তার আনুগত্য চেয়েছে।

তা স্বাভাবিক, সে ভেবেছে মোলন এ সংবাদে বিদ্রোহ করতে পারে।

তা স্বাভাবিক নয়, তার উচিত ছিল মোলনকে সঙ্গে নিয়ে তোমাকে উদ্ধারের জন্য মৌর্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করা। তুমি তো জানো না, তোমার মেয়ে লাউডিস মোলন আর সেলুসিড ডিফেন্স ফোর্সকে নিয়ে কী পরিকল্পনা করেছিল। সে তোমাদের উদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়ে এখানে এসেছে। তুমি এবং সবাই মুক্ত জেনে যুদ্ধের পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে।

আমার এই চুপচাপ মেয়েটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল, তা শুনে সৈনিক হিসেবে, বাবা হিসেবে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠেছে।

যাক, বিয়েটা এখানে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হতে দাও। এটা আমাদের সবার ইচ্ছা।

দুই রীতিতে কি দুবার বিয়ে হবে?

না, কনের বাড়ির বিবাহপর্ব আয়োজন গ্রিক মতে হবে। বরের বাড়ির আয়োজন, অর্থাৎ বিবাহ-পরবর্তী অনুষ্ঠানাদি হবে ওদের মতো করে।

প্রৌলিয়ার কথা জানলাম, গামোসের কী হবে?

পামোস দুই ৱীতিতেই হবে। সে জন্যই তো এখানে অ্যাপোলো মন্দির বানানো হচ্ছে।

প্রৌলিয়ায় দুই দেবতা— আর্টেমিস আর আফ্রোদিতের জন্য কী করা হবে?

একটি দ্বিমাত্রিক মন্দির, আমি ভুলে গিয়েছিলাম বলতে।

আমার পক্ষে এখন এসব কিছুই করা সম্ভব নয়, যা করার মৌর্যদেরই করতে হবে।

আমি মৌর্য সম্রাটের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিশ্রুতি পেয়েছি, তোমাকে কিছুই করতে হবে না।

কর্নেলিয়ার ইশারায় নিকোমেডেস বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কর্নেলিয়া এসে মিলিত হলেন বেশ কিছুক্ষণ পর।

তুই আমাকে শুধু শুধু এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলি?

আমি দুঃখিত, নিকো। কথা শুনবার জন্য অপেক্ষা করতে হলো। তুই আমার সঙ্গে চল।

কোথায়?

অবকাশ কেন্দ্রে।

অবকাশ কেন্দ্র? ঝিলাম নদীর পাশে?

সেটি অবকাশ কেন্দ্ৰ নয়,

তাহলে?

বিনোদনকেন্দ্র।

তোকে আমাকে মহামন্ত্রী যেখানে রেখেছিলেন, সে জায়গায়।

কেন?

গেলেই দেখতে পাবি।

অবকাশ কেন্দ্রে গিয়ে নিকোমেসে সত্যিই অবাক হলো। তাকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হলো একটি কক্ষে।

যাওয়ার আগে সে মৌর্যরক্ষীদের উদ্দেশে বলল, প্রিন্সেস

মৌর্যরক্ষী কিছু বলার আগেই স্মিত হেসে কর্নেলিয়া বললেন, তুই যা।

কক্ষে পৌঁছেই অবাক হলো নিকোমেডেস। সেখানে ফাওলিন বসে আছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই মনে হলো, কর্নেলিয়া দেখা হওয়ার পর যেতে পারত। যাই হোক, সে সবকিছু সামলে নিয়ে বলল, লিন, আমার হৃদয়, তুমি কেমন আছ?

ফাওলিন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। প্রবল আবেগানুভূতি তাকে এতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, সে কোনো ভাষা খুঁজে পেল না কী বলবে। শুধু দাঁড়িয়ে নিকোমেডেসের চোখে দৃষ্টি ফেলে অতল সমুদ্রের কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

এভাবে কতক্ষণ ছিল এ শূন্য কক্ষে বলার উপায় নেই। বাতায়ন থেকে দূরে বহু দূরে পাহাড়- পর্বত, বন-জঙ্গল মাড়িয়ে পাখির উড়াল কিংবা নদীর বহতা যত দূর দৃষ্টি যায়, সবই যেন থেমে গেছে। আটকে গেছে থর মরুর শোভা। তার কোনো বিকাশ নেই। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো থেকে হাজার হাজার বছরের পুরোনো কোনো প্রেম ভেসে এল পরম পাওয়ায় অথবা উদাস খেয়ায় ভেসে বেড়ানোর মতো দখিনা হাওয়ায়।

হঠাৎ যেন থর মরুভূমিতে হারিয়ে থাকা স্বর্গের সরস্বতী নদী ফাওলিনের চোখ বেয়ে নেমে এল নিষ্পাপ, নীরব, নিরুত্তাপ ও নির্মল বেগে। নিকোমেডেস সে স্রোতোধারা মুছে দিতে গেল না। সে বোধ হয় চাইছিল শুষ্ক ঊষর মরুভূমি পবিত্র জলে সিক্ত হোক।

নিকোমেডেস যে ব্যাপারটি জানে না তা হলো, এই অবকাশ কেন্দ্রে ছদ্মবেশে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তও এসেছেন প্রেয়সীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সম্রাট ছদ্মবেশে এসেছেন। কারণ, গ্রিক কিংবা ভারতীয় রীতিতে বর-কনের বিবাহপূর্ব সাক্ষাৎ অনুমোদিত নয়। মন তো রীতির অনুশাসন মানতে বাধ্য নয়, তাই এই গোপন অভিসার। হৃদয়ের কাছে পরাক্রমশীল সম্রাট এবং পথের ভিখিরির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

সম্রাট অবাক হয়ে দেখছেন তাঁর প্রিয়তমাকে। এতটা কাছাকাছি, একাকী ও একান্তভাবে আগে কখনো দেখেন নি তাঁকে। তিনি শিহরিত। অদ্ভুত এক অনুভূতি তাঁর ভেতর আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে। তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

কর্নেলিয়া, অর্থাৎ হেলেন স্তম্ভিত, নির্বাক কিন্তু ধীরস্থির।

সম্রাটই প্রথম কথা বললেন, হেলেন, আমার স্বপ্নসম্রাজ্ঞী, দেবী আফ্রোদিতে, বিশ্বাসই হয় না, আপনি আমার সামনে উপস্থিত। দেবী আফ্রোদিতেকে আমি আমি কখনো দেখি নি, আপনার চিঠিতে তাঁর নাম শুনেছি। এক দেবীর বর্ণনা আছে আচার্য ভদ্রবাহুর ‘কল্পসূত্রে’। নাম নেই সে দেবীর। তিনি যে ভাষায় বর্ণনা দিয়েছেন, তা বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই, তবু নিজের ভাষায় বলছি।

প্রাকৃত পদ্যে দেবীর বর্ণনা শুনে মৃদু মৃদু হাসছিলেন হেলেন। শেষে বললেন, চমৎকার, অসাধারণ।

আচার্য যে দেবীকে কল্পনা করেছেন, তিনি আজ আমার সামনে। কী সৌভাগ্যবান আমি।

সম্রাট, সৌভাগ্যবতী আমিও, একজন পরম পরাক্রান্ত সম্রাটের হৃদয়ের স্পর্শ পেয়েছি আমি। আরেকটা বিষয়, আচার্য সম্পর্কে যতটা জানছি, নতুন করে বিস্ময়াভিভূত হচ্ছি। একজন সাধু সন্ন্যাসী এ রকম দেবীর কল্পনা করতে পারেন, তা ভাবা যায়? কিন্তু আরও অবাক হচ্ছি কী করে এত বড় কবিতা আপনি মনে রেখেছেন?

তিনি গ্রিক পুরাণের কথাও জানেন। কল্পসূত্রেই চাঁদ আর সমুদ্রের প্রতীকে বলেছেন, প্রেমের (গ্রিক) দেবতা কিউপিডের ধনুকের তির যেন বিদ্ধ করছে হৃদয়, টানছে সাগরের জোয়ার।

তাহলে সময়টা আমার ভালোই কাটবে সম্রাটের প্রাসাদে।

কিন্তু আমার হৃদয়ের কথাই যে বলে দিয়েছেন তিনি।

হেলেন হেসে বললেন, তিনি তো অন্তর্যামী।

তাহলে তিনি নিশ্চয়ই জানেন আমরা এখানে আছি।

না জানলেও জেনে নেবেন। এতে আপনার ভাবনার কিছু নেই।

কেন? সম্রাট বলে?

না, সে জন্য নয়। আপনার মনে আছে উত্তর থর দুর্গে তিনি আপনাকে আমাদের সঙ্গে আরও কিছু সময় অতিবাহিত করতে বলেছিলেন।

সবাই ছিল বলে বলেছিলেন।

সবার জন্য বলেন নি, আপনার মনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন।

আপনি কীভাবে বুঝলেন?

তিনি আপনাকে খুব ভালোবাসেন। তার ভাগ মনে হয় আমিও পাচ্ছি।

আচার্য চাণক্য আমার মাথা থেকে আশীর্বাদের হাত তুলে নিয়েছেন, বোধ হয় সে জন্য এ আচার্যের আশীর্বাদ পাচ্ছি।

এভাবে বলছেন কেন, সম্রাট। নিশ্চয়ই কোথাও একটা ভুল হচ্ছে, তাঁকে আপনি দূরে সরিয়ে দেবেন না, মস্ত একটা ক্ষতি হয়ে যাবে।

এ কথা বলছেন কেন?

আচার্য চাণক্য আপনার মহামন্ত্রী, আপনার জীবনে তাঁর কী অবদান আছে, আমি ঠিক জানি না, কিন্তু তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং ক্রূর প্রকৃতির মানুষ। এ ধরনের মানুষেরা আত্মকেন্দ্রিক এবং ধ্বংসাত্মক হয়, স্বার্থের জন্য সবই করতে পারে। তাদের হাতে রাখলে অনেক কাজ আদায় করা যায়।

সম্রাট হেলেনের মুখে এসব কথা শুনে মিটিমিটি হাসছেন।

হেলেন বললেন, আপনি হাসছেন কেন? আমি কি ভুল বলেছি?

একদম না, আপনি ঠিক বলেছেন। আমার মনে হয় আমি একজন পরম শুভার্থী বিচক্ষণ বন্ধুকে পাশে পেয়েছি। আমার হাসার কারণ এটাই।

ধ্যাৎ, তাহলে আর কিছুই বলব না।

পরামর্শ দেবেন না?

অনধিকার চর্চা মনে করলে কখনোই না।

তাহলে দিলাম স্বাক্ষর দেওয়া মহা অঙ্গীকার চির অধিকার লিপি। বলে তাঁর হাতে থাকা মোহর আঁকা অঙ্গুরীয় হেলেনের হাতে পরিয়ে দিলেন।

হেলেন সম্রাটের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন না। কুলায় প্রবেশকারী পক্ষীর মতোই যেন সম্রাটের দুহাতের মুঠোর মধ্যে স্বস্তির বন্দিত্ব বরণ করলেন এবং সম্রাটের চোখের দিকে তাকিয়ে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো সভ্যতার দূর অতীতের গহিনে হারিয়ে গেলেন।

সম্রাট বললেন, হেলেন, কিছু বলবেন না?

হেলেনের চুপ থাকার মধ্য দিয়ে কত কথা যে বলা হয়ে গেছে, সম্রাট তা টের পেলেন না।

একটা অনুরোধ আছে, রাখবেন? হঠাৎই বললেন হেলেন।

কী অনুরোধ, বলুন।

আমাদের বিয়ের রাতটা হবে পূর্ণিমার। সে রাতটা আপনি আর আমি থর মরুভূমিতে কাটাব। আপনি ওই ব্যক্তিটিকে আনাবেন, যে যুদ্ধের আগে বাঁশি বাজিয়েছিল। সে রাতে আমরা মরুভূমিতে তাঁর বাঁশি শুনব।

ওই বাঁশিওয়ালা তো যুদ্ধের সময় হারিয়ে গেছে। তার মৃত্যুও হতে পারে, তাকে আমি কোথায় পাব?

তার প্রয়োজন তো ফুরিয়ে যায় নি, সম্রাট, নিশ্চয়ই আপনি চাইলে তাঁর সন্ধান পাওয়া যাবে। বেশ, তা-ই হবে, আমার হৃদয়। আমার জানতে ইচ্ছা হচ্ছে, কেন আপনার মনে এ সাধ জেগেছে?

তার জবাব আমারও জানা নেই, তবে আমি তার জবাব খুঁজে বের করব এবং সেদিনই তা আপনাকে জানাব। আর একটি কথা, আচার্য ভদ্রবাহু দেবীর যে বর্ণনা দিয়েছেন, আমার বিয়ের সাজটা হবে ঠিক সে রকম। কিন্তু তা আচার্যকে আগে জানানো যাবে না।

শুনে সম্রাটের বিস্ময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। অদ্ভুত তো!

.

আচার্য চাণক্য ভদ্রবাহুর কক্ষে উপস্থিত হলেন। হঠাৎই তিনি মিহিরকে স্বপ্নে দেখেছেন। মিহির তাঁর শয়নকক্ষে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু তার মুণ্ড নেই। মুণ্ডহীন মিহির আগের মতোই বিচারপ্রার্থী। তা দেখে আচার্যের দুপুরের আয়েশের ঘুমটা ভেঙে যায়। তিনি ভদ্রবাহুর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ভদ্ৰবাহু আচার্যকে পেয়ে খুশিই হলেন। বললেন, আপনার কথা ভাবছিলাম। শুনলাম বিয়ের আগেই সৈন্য প্রত্যাহার হচ্ছে। আপনার দায়িত্ব বেড়ে গেল।

চাণক্য বললেন, তা বেড়েছে বৈকি। কিন্তু পুরোনো সমস্যা নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে।

কী সমস্যা?

বলছি আচার্য, তা বলতেই এলাম। মিহির আবার যন্ত্রণা শুরু করেছে।

ভদ্রবাহু অবাক হয়ে বললেন, আবার এসেছিল? তার তো আর ফিরে আসার কথা নয়।

সে এবার স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। মুণ্ড নেই, আগের মতোই আপনার বিরুদ্ধে নালিশ।

এবার ভদ্রবাহু হেসে দিলেন। বললেন, বড় চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। তার আত্মাকে পরকালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফিরে এলে বড় সমস্যা ছিল। মানুষের মস্তিষ্কে স্মৃতিগুলো সঞ্চিত থাকে। স্মৃতি রোমন্থনের মতো ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে তা বিচরণ করতে পারে।

তাহলে আপনি যে স্বপ্নবিশারদ হিসেবে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করেন।

স্মৃতি রোমন্থন ও স্বপ্ন দেখার মধ্যে স্বপ্নতাৎপর্যের কোনো বিরোধ নেই। স্বপ্নটা প্রতীকী। প্রতীকের অর্থ বা তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করি আমরা।

প্রায়ই তো ব্যাখ্যা সঠিক হয়ে যায়।

বলতে পারেন আনুপাতিক হারে পাল্লা ভারী।

তাহলে আমার এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা কী?

খুব সহজ, আপনার শত্রু এখন মস্তকহীন, মস্তকটা প্রতীকী, যার অর্থ মেধাশূন্য।

আমার তো কোনো শত্ৰু নেই।

আপনার মতো পণ্ডিত এবং বিচক্ষণ মহামন্ত্রীর শত্রু নেই, তা ঠিক নয়, আপনি নিশ্চয়ই কিছু লুকোচ্ছেন অথবা শত্রু সম্পর্কে অবহিত নন।

চাণক্য ভদ্রবাহুর কথায় এবার হাসলেন। বললেন, আপনাদের ভাষায় আমার ‘পাণ্ডিত্য ও বিচক্ষণতাই’ আমার শত্রু, কোনো মানুষ নয়।

তবু মানুষ সম্পর্কে সচেতন থাকুন। এবার গ্রিক সৈন্যদের প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে কিছু বলুন।

গোয়েন্দারা যা বলেছে, তা গ্রিক সৈন্যদের একমুহূর্ত থাকার জন্যও নিরাপদ নয়।

কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে নাকি?

না, সে রকম কিছু নয়, তাস্কর্যবৃত্তির প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে এরা।

কিন্তু সম্রাট সেলুকাসকে কি বিশ্বাস করা যায়?

যায় না, তবে সম্রাট এখনই কিছু করে বসবেন না। কারণ, তাঁর দুই কন্যা, জেনারেল জামাতা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁকে নতুনভাবে ঝামেলা তৈরি করা থেকে বিরত রাখবেন।

তা ঠিক বলেছেন। আমারও তা-ই মনে হচ্ছে। এরা কি সশস্ত্র অবস্থায় যাচ্ছে?

সম্রাটের তা-ই ইচ্ছা।

তাহলে তো প্রত্যাহারের সময় চোখকান খোলা রেখে সতর্ক থাকতে হবে।

এ এক বাড়তি ঝামেলা। প্রধান সেনাপতিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের সৈন্য প্রত্যাহার পরিকল্পনা শৃঙ্খলাসহায়ক। একেবারে প্রত্যাহার হচ্ছে না, নানা দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন সময়ে যাচ্ছে। এতে বিশৃঙ্খলার সুযোগ থাকবে কম।

পরাজিত সৈন্যরা হতাশ ও ক্রুদ্ধ থাকে। কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

আপনার আশঙ্কা অমূলক নয়। তবে তাদের মনে রাখা উচিত, একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতা চুক্তির আওতায় আমরা তাদের সসম্মানে যেতে দিচ্ছি।

আপনার হস্তীরা কখন যাচ্ছে, বলে হাসলেন।

অধিকাংশ তাদের সঙ্গেই যাচ্ছে। এটাও একটা নিরাপত্তা ভারসাম্য রক্ষা করবে।

সব কটিই কি যুদ্ধহস্তী?

না, ভারবাহী হস্তীও আছে। তাদের প্রত্যাশা ছিল সবই যুদ্ধহস্তী হবে। আসার (মিত্র সৈন্য) বলে কথা! বলে হাসলেন চাণক্য।

প্ৰশিক্ষণ?

আমাদের প্রশিক্ষকেরা সেলুসিয়ায় যাবে। এতে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে, এটা সম্রাটের ইচ্ছা। চলুন আমরা সম্রাটের কাছে যাই।

ভদ্রবাহু এ কথায় হাসলেন।

হাসছেন কেন, প্রশিক্ষকেরা সেলুসিয়ায় যাবে, তা আপনার পছন্দ নয়?

তা নয়। সম্রাটের কাছে এখন যাওয়া যাবে না। তিনি এখানে নেই।

কোথায়?

আন্দাজ করুন, আচার্য।

কী বলছেন আপনি? অভিসার!

সমস্যা কোথায়?

গ্রিক, ভারতীয় কোনো রীতিই তো তা অনুমোদন করে না। সম্রাট সামাজিক রীতি পরিবর্তন করতে পারেন না, রাষ্ট্রীয় আইন পরিবর্তন করতে পারেন।

আমি আপনি তা জানি। প্রেমিকের হৃদয় তা জানে না, জানলেও মানে না।

ভদ্রবাহুর কথা শুনে চাণক্য গম্ভীর হয়ে গেলেন। কী যেন ভাবছেন। আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে, বললেন ভদ্ৰবাহু।

এ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছি, আবেগের ওপর সব ছেড়ে দেওয়া যায় না। চাণক্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, এ সাম্রাজ্য তিল তিল করে গড়েছি। কিসের যেন অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি। আপনি কোনো সংকেত পাচ্ছেন না?

সে রকম তো মনে হচ্ছে না।

কেন মনে হবে না, ব্যত্যয় রোগ এক জায়গায় শুরু হলে সর্বত্র ছড়ায়। পরাজিত রাজকন্যাদের ভোগ ইতিহাসে নজিরবিহীন নয়। তাই বলে প্রেমাবেগ, রীতিনীতির ব্যত্যয়, রাজকার্যে উদাসীনতা, শত্রুপক্ষকে অনাকাঙ্ক্ষিত সুবিধা প্রদান—এসব নেতিবাচক কাজ কী প্রমাণ করে? দেখুন, পরাজিত গ্রিকদের সঙ্গে সন্ধিটাই আমার পছন্দ নয়।

ভদ্রবাহু বললেন, আচার্য, আপনার অর্থশাস্ত্রের দশম অধিকরণের তৃতীয় অধ্যায়েই আছে, ‘অধিক বলশালী শত্রুকে পরাভূত করার পর রাজা স্ব-উদ্যোগে তার সঙ্গে সন্ধিতে আবদ্ধ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন’।

একেবারে অধিকরণ অধ্যায় সবই মনে রেখেছেন।

আপনি যখন সন্ধিতে শক্ত আপত্তি করেন নি, তখন অর্থশাস্ত্রের এই তথ্যটা আমি খুঁজে বের করি। নিতান্তই কৌতূহলবশত।

সন্ধিতে তো উল্লেখ নেই যে বিজিত রাজের সম্পদ লুণ্ঠন করা যাবে না বা আমাদের সৈন্যরা এর ন্যায্য অংশ প্রাপ্য হবে না। এদের বঞ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘোষিত পুরস্কারের প্রথাগত রীতি উপেক্ষা করা হয়েছে। সৈন্যরা আশা করে যুদ্ধ জয়ে এরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। ব্যবসায়ীরা বসে থাকে এ সময়ের ব্যবসায় আর্থিক মুনাফার জন্য। এই ব্যবসা থেকে সরকারের কর বাবদ আয় আসে, এবার সে আয়ের কোঠাও শূন্য। দেখবেন দেশ আর্থিক সংকটে পড়ে যাবে এবং বাধ্য হয়ে সম্রাটকে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপাতে হবে।

আপনার কথা খুবই যৌক্তিক, আচার্য। খাদ্যশস্য, মাংসের পশু, তেল-লবণ—সবই তো তাদের ফেলে যাওয়ার কথা।

কিছুই ফেলে যাবে না, নিয়ে যাবে। অথচ এসব খাদ্যসামগ্রী এরা সংগ্রহ করেছে উর্বর সিন্ধু অববাহিকা থেকে, সেলুসিয়া থেকে কিছুই আনে নি।

সম্রাটের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন নি?

করেছিলাম। তিনি বললেন, ওদের পরাজয়টাই আমরা চেয়েছি, কোনো সম্পদ নয়। এদের শান্তিমতো যেতে দিন।

সম্ভবত সম্পর্কটা আত্মীয়তার বলেই সম্রাট অপ্রিয় বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন।

এক ব্যাপারে মৌর্যদের কত মূল্য দিতে হবে, বলুন।

আমরা যা নিয়ে ভাবছি, সম্রাট হয়তো ভাবছেন অন্য কিছু নিয়ে। তাঁর চিন্তার মধ্যে নিশ্চয়ই ভালো কিছু আছে, যা আমরা দেখছি না। এখন নয়, অনুকূল পরিবেশে বিষয়গুলো উত্থাপন করুন। এখন তাঁকে তাঁর মতো সময়টা উপভোগ করতে দিন।

এবারে মহামন্ত্রী চাণক্য হাসলেন। বললেন, আপনার রসবোধের বাধা দেখছি বার্ধক্য নয়, নয় শাস্ত্রের অনুশাসনও।

আমোদে নিয়মনাস্তি, বললেন ভদ্রবাহু।

.

গোপন অভিসার শেষে ফিরে যাবেন যে যার জায়গায়। হেলেন মাথা নত করে বসে আছেন। চন্দ্রগুপ্ত বললেন, উঠতে হয়। হেলেন চোখ তুলে তাকালেন। চন্দ্রগুপ্ত সহসা হাত রাখলেন হেলেনের হাতে। চোখে চোখ রাখলেন ‘সহজিয়া অনুরাগে’। হেলেনের আনত দৃষ্টি। একালের কবির বর্ণনামতেই যেন চন্দ্রগুপ্ত ‘অনাদি যুগের যত চাওয়া যত পাওয়ার মানে’ খুঁজছেন সে আনত দৃষ্টিতে। এত কাছে পেয়েও মনে হচ্ছে কী যেন পান নি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরও যেন দুজনেরই হারাই হারাই ভাব। বিচ্ছিন্ন হতে মন চাইছে না।

এবারে চন্দ্রগুপ্ত হেলেনের দিকে না তাকিয়েই ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন এবং বিদায় বলে ঝড়ের বেগে বের হয়ে এলেন।

হেলেন কক্ষের দ্বার পর্যন্ত ছুটে এলেন। চন্দ্রগুপ্ত ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকালেন। তাঁর চোখে মুখে বিচ্ছেদের করুণ চাহনি। ছেড়ে যেতে যেন হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে, এই চাহনি সে বার্তাই দিচ্ছে।

হেলেন কক্ষে ফিরে গিয়ে নিকোমেডেসদের জন্য অপেক্ষা করবেন। এ রকম ভাবতেই দেখলেন দুজন জোড়া কবুতরের মতো রেলিং ধরে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে কী সব বলছে। চোখে মুখে আনন্দ। ভাবভঙ্গিতে প্রাণের উচ্ছ্বাস-হাসাহাসির ফল্গুধারায় বর্ষার সিন্ধু যেন তরঙ্গায়িত।

হেলেন কি সেখানে যাবেন? না, যাবেন না যতক্ষণ না ওরা তার কাছে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *