মৌর্য – ৬৬

৬৬

নিকোমেডেস ফাওলিনকে একটা পত্র লিখবে। তার আগে ফাওলিনের পাঠানো পত্রটা আরেকবার পাঠ করে নিল। অভিমানে ভরা সে পত্র। নিকোমেডেস ভাবল, ফাওলিন অন্যায় কিছু লেখে নি। অনুযোগগুলো সবই সত্যি। এতকাল কেউ বন্ধুর জন্য বাইরে থাকে? তাই পত্রের শুরুতেই লিখল:

প্ৰিয়তমা,

তোমার সব অনুযোগই সত্য। মানছি ভুলগুলো একান্তই আমার। কিন্তু কী করি বলো? কর্নিকে কী করে মহা এক সংকটে ফেলে চলে আসি। এখানে তার কেউ নেই, তার এ দুঃসময়ে পাশে থাকা খুবই জরুরি। ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। সে হয়ে যাচ্ছে দিশেহারা। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কী করবে। কার সঙ্গে পরামর্শ করবে, তাকে ফেলে এ অবস্থায় চলে আসা একেবারেই সম্ভব হয় নি। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছিল, কত দিন তা স্থায়ী হবে, বোঝা যাচ্ছিল না, এ যুদ্ধের সঙ্গে ছিল কর্নির ভাগ্য জড়িত। পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা তার। বাইরে কাউকে কিছু বুঝতে দিত না। শুধু আমার সঙ্গে প্রতিটি বিষয় নিয়ে কথা বলত। তাই একবার তো বলেই বসল, নিকো, তুই পাশে না থাকলে যে কী হতো। ভাগ্যিস, পিসি তোকে জোর করে পাঠিয়েছিল। আর তোমার জন্য সে খুব ফিল করে। বলে, আমি ফাওলিনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। এ জনমে তাকে যে কষ্ট দিয়েছি, জিউস তা কখনো ক্ষমা করবে না। কিন্তু আমি জানি, সে ক্ষমা করবে।

এখন সে সংকট কেটে গেছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সেলুসিড সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে। এই পরাজয় গ্রিকদের জন্য অসম্মানের, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এতে কর্নি খুশিই হয়েছে। চন্দ্রগুপ্তের পরাজয় সে মানতে পারত না।

বিয়ে এবং বিবাহ-উত্তর জীবন সম্পর্কে চমৎকার সব বিষয় সে চিন্তা করে রেখেছে। কিছু কিছু আমাকে বলেছেও। এগুলো তোমাকেও আমি জানাতে চাই। চন্দ্রগুপ্তের প্রতি ভালোবাসাকে সে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিতে চায়। প্রথমে শিখতে চায় ভারতীয় ভাষা, যদিও কিছু কিছু সে ইতিমধ্যেই আয়ত্ত করেছে। শিখতে চায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত। প্রবেশ করতে চায় ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনে। আচার্য ভদ্রবাহু আর শর্মিলা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তাকেই-বা বলি কেন, আমি যদি নিজেও সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করি, এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমিও এতটা মুগ্ধ। গ্রিক দর্শনের সঙ্গে এখানকার দর্শনের অনেক পার্থক্য। কী অদ্ভুত মানুষ ভারতীয়রা, কাছে না এলে বোঝার উপায় নেই। আমিও ভারতীয় ভাষা শিখেছি। ভয় পেয়ো না, আমি সৈনিক মানুষ, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করব না, তুমি পাশে থাকলে তো কখনোই না।

এবার আসল কথায় আসি। যুদ্ধ শেষ, তাই বিয়ের আয়োজন ও প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। যদিও সম্রাট সেলুকাস এ বিয়েতে কোনো আনুষ্ঠানিকতা চান না। তিনি মনে করেন, এ বিয়ে গ্রিকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে। তাই বিয়েটা চুপেচাপেই হয়ে যাক। চন্দ্রগুপ্ত কী চাইছেন, জানতে পারি নি। কর্নি চাইছে বিয়ে হবে ধুমধাম করে। বিয়ে তো একবারই হয়। তাতে জৌলুশ থাকবে না, তা কী করে হয়। এ বিয়েতে তোমাকে অবশ্যই থাকতে হবে, এ হচ্ছে কর্নির ইচ্ছা। ইচ্ছা বললে কম বলা হয়, একান্ত কামনা। তার আরও ইচ্ছা ভারতীয় বিয়ের সাজসজ্জার সঙ্গে গ্রিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। আর এ কাজটা করতে হবে তোমাকে ও লাউডিসকে। লাউডিসও এল বলে।

সম্রাট সেলুকাস দাদু টলেমিকে বিয়ের সংবাদটা জানাতে চান না। তার কারণ আগেই আমি বলেছি। কিন্তু এ সংবাদ কি কখনো গোপন থাকবে? থাকবে না। আমার মনে হয় সংবাদটা তুমি তাকে জানিয়ে দিতে পারো। দাদু সভ্যতার বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাসী, না হয় মিসরে ‘ফারাও’ খেতাব নিতেন না। উদার এই মানুষটির সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললে তাঁর মন হালকা হয়ে যেত। তা বুঝলেন না সেলুকাস। আসলে সংকটকে নিজের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করলে অন্য কোনো চিন্তা আসার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। ভাগাভাগি করলে ভারমুক্ত হওয়া যায়। নতুন কোনো দিগন্ত উন্মোচিত হয়।

এবারে তোমার অনুযোগের উত্তর দিই। শর্মিলাকে নিয়ে তোমার আশঙ্কা একেবারেই অমূলক। তার সঙ্গে আমাদের আর দেখা হয় নি, হবে বলেও মনে হয় না, সন্ন্যাসী মানুষ, কোথায় থাকে, তার কি ঠিকঠিকানা আছে? নেই। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি, তার বেশি কিছু নয়।

কর্নির প্রতি তুমি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল। সে আমার কাজিন, তার চেয়েও বড় একজন পরম বন্ধু। তারপরও সে আমাকে আটকে রাখে নি। ওই যে বললাম, তাকে এভাবে ফেলে চলে এলে কি তার প্রতি সুবিচার করা হতো? হতো না। আমি আমার কর্তব্য করেছি। আমি জানি, তোমার প্রতিও আমার দায়িত্ব আছে। আমাকে তুমি বুঝবে না এ কথা কখনোই আমার মনে হয় না। আমি তো তোমারই আছি।

সেলুসিড আর্মিরা ফিরে যেতে শুরু করবে দুয়েক দিনের মধ্যে। অবশ্য এদের ফিরে যেতে সময় লাগবে। বিয়েটা এ সময়ে হবে, নাকি চলে যাওয়ার পরে হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। তুমি চলে এসো খুব দ্রুত। তারপরও জাহাজে তোমার সময় লেগে যাবে বেশ কিছুদিন। সেলুসিয়া হয়ে এসো। ভাগ্য ভালো হলে লাউডিসকে পেয়ে যেতে পারো। লাউডিসের সঙ্গে এলে ঝামেলা কম হবে। মা-ও আসতে পারেন। তাহলে তোমার যাত্রাটা আনন্দের হবে। আজ আর নয়।

এবার চিঠি নয়, তোমার প্রতীক্ষায় রইলাম।

ইতি
তোমারই নিকো।

বিশ্বস্ত একজন দূত পত্রটা মিসরে ফাওলিনের কাছে পৌঁছে দেবে। পত্র পেয়ে ফাওলিন ছুটে আসবে, এমনটাই মনে করছে নিকোমেডেস। ফাওলিন মিসর থেকে সমুদ্রপথে জাহাজে চড়ে সেলুসিয়ায় আসবে, সেখান থেকে লাউডিসের সঙ্গে এখানে আসবে, এই তার আশা।

কিন্তু পত্র প্রেরণের পরপরই তার আশা ভঙ্গ হলো। লাউডিস আর তার মাতা এসে গেছেন। এদের দুশ্চিন্তা ও ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত মনে হলো। বেশি কাহিল হয়েছে লাউডিসের মেয়ে হারমিজ। সে সব বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। লাউডিসও বেশ ক্লান্ত। তিনি শুধু বলতে পারলেন, আমরা কি সিন্ধু নদের অববাহিকায়? তারপরই পানি চাইলেন। যে উৎসাহ নিয়ে এসেছেন, এতে যেন ভাটা পড়ে গেছে।

দিদাইমেইয়ার বয়স হয়েছে। তাই তাঁদের চাইতে তাঁর বেশি ক্লান্ত হওয়ার কথা। অবাক হলেও সত্য যে তিনি অতটা ক্লান্ত বা বিধ্বস্ত নন। শান্ত গলায় নিকোমেডেসকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, সেলুকাস কোথায়? তার অবস্থা কী?

নিকোমেডেস স্মিত হেসে বলল, উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, মা, সবকিছু নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

কী রকম নিষ্পত্তি?

নিকোমেডেন্স সবকিছু বুঝিয়ে বলল। পরে হারমিজকে ডেকে বলল, তুমি কত শান্ত হয়ে গেছ?

.

যে কথাটা বলার সাহস পাচ্ছিলেন না দিদাইমেইয়া এবং লাউডিস, সে কথাটাই প্রশ্ন আকারে বলল হারমিজ, আমার বাবা কোথায়?

লাউডিস ও দিদাইমেইয়াও ভয় ও উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকালেন নিকোমেডেসের দিকে। নিকোমেডেস সহজভাবে বলল, সম্রাট সেলুকাসের সঙ্গে বৈঠক করছেন। লাউডিস খুঁজে পেলেন না কীভাবে তাঁর অনুভূতি বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন। তাই কেঁদে ফেললেন। সুখের এই কান্নাকে কষ্ট ভেবে হারমিজও কাঁদল। দিদাইমেইয়া মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে আনন্দাশ্রু গোপন করলেন। পরে অভিযোগের সুরে বললেন, তোকে এখানে পাঠালাম, অথচ তুই আমাদের একটি খবরও দিলি না।

মা, তোমরা নিশ্চয়ই খবর পেয়েই ছুটে এসেছ।

খবরটা কী?

তুই আমাদের কোনো খবর জানাবি না, আবার আমাদের প্রাপ্ত খবর জানতে চাইবি, তা হবে না, বললেন লাউডিস। তাঁর চোখেমুখে এখন হাসি হাসি ভাব। বোধ হয় ক্লান্তিও কেটে গেছে। গলার স্বরে ব্যঞ্জনা। বললেন, এখন আমাদের কর্নির কাছে নিয়ে চল।

দুই বোনের মিলনটা ছিল অদ্ভুত রকমের। দুজন মধুর আলিঙ্গনে জড়িয়ে আছেন, যেন যুদ্ধে জয় হয়েছে কর্নেলিয়ার, আলিঙ্গন করে তাঁকে অভিনন্দন জানালেন লাউডিস। মুখেও বিজয়ের হাসি। একটু দূরে থেকে এ দৃশ্য দেখছেন দিদাইমেইয়া। মা-মাসিকে উৎফুল্ল দেখে নিকোমেডেসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হারমিজ দৌড়ে গিয়ে কর্নেলিয়াকে জড়িয়ে ধরল মাকেসুদ্ধ। দিদাইমেইয়া বললেন, এ দৃশ্যটা দেখার জন্যই আমি এতকাল অপেক্ষা করেছি। আমার মন ভরে দিয়েছেন অ্যাপোলো। অ্যাপোলো, তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। বলে ওপরের দিকে হাত তুললেন তিনি।

.

পরে এরা গেলেন সেলুকাসের কাছে। সেখানকার দৃশ্যটা সম্পূর্ণ বিপরীত। সেলুকাস বললেন, পরাজিত ভাইকে দেখতে এসেছ? যুদ্ধে মৃত ভাইকে দেখার মধ্যেও গৌরব আছে, আমাকে দেখে কি তোমার কোনো কষ্ট হয় না?

দিদাইমেইয়া চুপ করে আছেন। সেলুকাস আবার বললেন, এ পরাজয় শুধু যুদ্ধে নয় বোন, যুদ্ধে হেরেছে সেলুসিড সম্রাট এবং তাঁর বাহিনী, কিন্তু এর চেয়ে বড় পরাজয় একজন গ্রিক পিতার, যে তার কন্যাকে এক ভারতীয়ের হাতে তুলে দিচ্ছে। বলে ইলিয়াডের হেক্টর-পিতা প্রায়ামের মতো কাঁদলেন তিনি।

দিদাইমেইয়া এগিয়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। পরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, শান্ত হও, সেলুকাস। মানুষ কখনো তার ভাগ্যের ওপরে উঠতে পারে না। যে যুদ্ধে তোমার পরাজিত হওয়ার কথা নয়, তাতেই তুমি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হেরে গেছ। যে যুদ্ধে গ্রিকদের বিজয়গৌরব পতাকা উড়বার কথা, সেখানে বাতাসে উড়ছে এখন ভারতীয় পতাকা। সবই ভাগ্য, সেলুকাস

দিদাই, আমি কি আপামার প্রতি অন্যায় করেছিলাম? নিষ্পাপ রাজকন্যাকে যখন ছিনিয়ে আনি, নিষ্পলক অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সে। জিউস মনে হয় সহ্য করেন নি।

সান্ত্বনা দিয়ে দিদাইমেইয়া বললেন, তুমি তো তাকে বিয়ে করে সম্রাজ্ঞীর মর্যাদা দিয়েছিলে। সে কোনো অভিশাপ দেয় নি তোমাকে। এত ভালো মেয়ে ছিল যে সে কাউকে অভিশাপ দিতে পারে না।

তাহলে কর্নেলিয়াকে হারালাম কেন? সবই দৈব। জিউস আমার ভাগ্যে এ শাস্তি রেখেছিল। সেলুকাস, প্রাণপ্রিয় ভাই আমার। তুমি একে এভাবে দেখছ কেন? জিউস যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন। তোমার উচিত এখন কর্নেলিয়ার যাতে মঙ্গল হয়, সে জন্য আশীর্বাদ করা। তার সুখের জন্য যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। এরা পরস্পরকে জেনেছে। কর্নেলিয়া সম্মতি দিয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় তো যে এখানে জোরজবরদস্তি হচ্ছে। দেবতা অ্যাপোলো এগিয়ে এসেছেন। এতকাল বংশপরম্পরা যাঁর আরাধনা করে এসেছি, তিনি এবার মুখ তুলে তাকিয়েছেন। চন্দ্রগুপ্তের অন্তরে প্রেম না জাগালে ভয়াবহ রকম কিছু ঘটে যেতে পারত। ধন্যবাদ তাঁকে। তিনি তাঁর ভক্তদের কখনো দুর্গতির দিকে ঠেলে দেন নি।

দিদাইমেইয়া, ভুল বলছ তুমি। বৃথাই আমি এতকাল তাঁর আরাধনা করেছি। তিনি আমাকে ক্ষমা করেন নি, তাই এই শাস্তি। আমি তাঁর এই শাস্তি মাথা পেতে নেব না। চাই আমার জীবনে আরও দুর্ভাগ্য নেমে আসুক। আমি সে দুর্ভাগ্যকেই বরণ করে নেব।

এখন শান্ত হও, সেলুকাস। কর্নির মুখের দিকে তাকাও। তোমার এই মনোভাব তাকে কষ্ট দিচ্ছে। তাকে অসহায় করে তোলো না। তার পাশে দাঁড়াও। দেখো সে কী করতে চায়। তাকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে তোলো।

লাউডিস এবার বাবার কাছে এলেন। বললেন, জয়-পরাজয় মানুষের ভাগ্যেই থাকে, বাবা। বহু যুদ্ধ জয় করেছেন আপনি। ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চল শাসন করেছেন। যার কাছে আপনার পরাজয়, সে একবার আপনাকে বাঁচিয়েছিল। সে ভারতবর্ষের প্রথম সম্রাট। এত বড় বীরের সঙ্গে পরাজয়েও গৌরব আছে। আর এই বীর-সম্রাট আলোচনার মাধ্যমেই আপনার জামাতা হতে যাচ্ছে। জামাতা মানেই তো পুত্র। এ ছাড়া এই সম্রাট আপনাকে যে সম্মান দেখিয়েছে, কোনো পরাজিতকে কেউ কখনো তা দেখায় না। তার ব্যবহারে আমরা সবাই মুগ্ধ এবং সম্মানিত।

তোমরা সবাই তার পক্ষ নিলে?

পক্ষ-বিপক্ষের কথা নয়, বাবা, যা ঘটে গেছে এবং যা ঘটতে যাচ্ছে, তা মাথায় রেখে কথা বলছি। বাস্তবতাকে মেনে তাকে পক্ষে টানাই এখন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। বাবা, আপনি আর কিছু মনে রাখবেন না। এখন থেকে চন্দ্রগুপ্তকে আমাদের মতোই ভাবতে শুরু করুন। দেখবেন, তার দ্বারাও সেলুসিড সাম্রাজ্যের উপকার হবে। ব্যক্তিগতভাবে আপনিও লাভবান হবেন।

কর্নেলিয়া কিছু বলতে গিয়েও আর বললেন না। নিকোমেডেস বলল, মহামান্য সম্রাট, যা ঘটার ঘটে গেছে, আমরা সামনে দেখতে চাই। আপনার কষ্ট একজন গ্রিক হিসেবে আমার না বোঝার কথা নয়। তবু অনুরোধ করছি, নতুন সম্পর্কের সেতুবন্ধনকে আপনি স্বাগত জানান।

টলেমি কি আমাকে ক্ষমা করবেন, নিকোমেডেস? আমি যখন কোনো এক সময় ফিরে যাব গ্রিসে, গ্রিসের আভিজাত্যসচেতন মানুষ কি আমায় ক্ষমা করবে? শুধু জাত্যভিমানে হেলেনকে উদ্ধারের জন্য ট্রজান আর একিয়ানরা বছরের পর বছর যুদ্ধ করে নি? সে রক্ত তো তোমার আর আমার মধ্যেও বহমান। কী করে হজম করি, বলো?

আপনি শুধু সম্রাট বা গ্রিকই নন, একজন বাবাও। কন্যার কল্যাণ যদি এতেই নিহিত আছে বলে কন্যা মনে করে, কন্যা-বৎসল পিতা হিসেবে আপনার বিবেচনা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে, বললেন আচার্য ভদ্রবাহু। তিনি কখন এসে এখানে দাঁড়িয়েছেন, তা সম্রাট টের পান নি। তিনি আরও বললেন, জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে কম হানাহানি হয় নি এই পৃথিবীতে। তবু মানুষে মানুষে সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই। হিংসা আর হানাহানির অবসান হয়েছে পরস্পরের আত্মোপলব্ধি এবং নতুন সম্পর্কের ভিত্তিতে। গ্রিকদের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্ক নতুন যুগের সূচনা করবে। ভারতের বাল্মীকি আর গ্রিসের হোমার পরস্পরকে জেনে গ্রিক আর ভারতীয়রা গৌরববোধ করবে। ঐতিহ্যগতভাবে দুটি মহান জাতি পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বন্ধনে বিশ্ব ঐতিহ্যকে সমুন্নত করে তুলবে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সম্রাট। আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনাদের পারিবারিক সভায় অনাহূতভাবে কথা বলছি বলে।

আচার্য ভদ্রবাহুর এই ভারী ধরনের কথায় হেসে দিয়ে সেলুকাস বললেন, আচার্য, আপনি একজন দেবদূত। তাই আপনার কথায় থাকে আশার বাণী, আমরা সাধারণ মানুষ আশঙ্কা থেকে মুক্ত হতে পারি না। আপনি আশ্বস্ত করার পরও শঙ্কা কাটে না। দেবদূতের সঙ্গে মানুষের এ হচ্ছে পার্থক্য। যা-ই হোক, হঠাৎ করে আপনার আসার মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে। আমরা সবাই আছি, কারণ থাকলে জানান।

ঠিক ধরেছেন, সম্রাট। একটু আগে গিয়ে ফিরে আসার মধ্যে অবশ্যই হেতু আছে। ভদ্রবাহুর এ উপক্রমণিকায় সবাই উৎকর্ণ হলেন তাঁর দিকে। তিনি আবার বললেন, বিয়েতে ভারতীয় রীতি- পদ্ধতি বড় দীর্ঘ। এখানে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয় পঞ্জিকা গণনা করে। আনুষ্ঠানিকতা হয় বেশ দীর্ঘ। গ্রিক রীতি ও পদ্ধতির কথা আমার জানা নেই। নিশ্চয়ই রাজকীয় বিয়েতে শানশওকত, জৌলুশ একই পর্যায়ের হবে। এখানে ধর্মীয় রীতি-নীতি সব ধর্মের বিয়েতেই অনুসৃত। গ্রিকদেরও ধর্মীয় রীতি নিশ্চয়ই আছে। এ বিয়েতে ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতি-রেওয়াজ অবশ্যই পালনীয়। আপনাদের পক্ষ হতে কোনো পরামর্শ-প্রস্তাব থাকলে তা জানার জন্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন এবং দুই রীতির মেলবন্ধনে বিয়ে সম্পন্ন করতে তাঁর আপত্তি নেই।

সেলুকাস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আর গ্রিক রীতি! বিয়ের রীতি-রেওয়াজ পালনের আবশ্যকতা দেখি না। আনুষ্ঠানিকতাও হবে অতি সংক্ষিপ্ত।

লাউডিস ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, বাবা, এ আপনি কী বলছেন? বিয়ে হবে পূর্ণ-উৎসব আর আনুষ্ঠানিকতাসহকারে।

দিদাইমেইয়া আরও শক্তভাবে বললেন, বিয়ে দুই রীতিতেই হবে এবং ঘটা করে হবে। আচার্য, আপনি তা সম্রাটকে জানিয়ে দিতে পারেন।

তোমরা এত ঝামেলা করতে চাইছ কেন? বিয়েটা তো আর গ্রিক রাজপুত্রের সঙ্গে হচ্ছে না। গ্রিক রাজপুত্র না হোক, এক বিজয়ী সম্রাটের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। এ বিয়েও উৎসবমুখর হবে, বললেন দিদাইমেইয়া।

বেশ, তোমরা যা করতে চাও, করো।

দিদাইমেইয়া প্রাচীন গ্রিক রীতির বিয়ে সম্পর্কে আচার্যকে একটা ধারণা দিলেন। গ্রিক রীতিগুলো এ রকম: প্রাচীন গ্রিসে বিয়ে হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বন্ধন, পারিবারিক এবং সামাজিক স্বীকৃতি। তবে এ বন্ধন সৃষ্টির দায় পাত্র-পাত্রীর কাইরিয়স বা অভিভাবকদের। পিতার দায়িত্ব হচ্ছে কন্যাকে সুপাত্রের হাতে তুলে দেওয়া। হেলেনিস্টিক রীতিতে কৌরিদাই এলোচোস বা আইনসংগত স্ত্রীর বিধান এক স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এতে বহু স্ত্রী নিষিদ্ধ। এই রীতিনির্ভর সোলন শুধু পারিবারিকই নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিয়েকেও অনুমোদন করে।

আচার্য বললেন, হেলেনিস্টিক রীতি তো আমাদের এ বিয়েকে অনুমোদন করে।

দিদাইমেইয়া বললেন, তা করে।

আনুষ্ঠানিকতা কী রকম?

অনুষ্ঠান থাকে তিন ভাগে। প্রৌলিয়া বা বিবাহপূর্ব-অনুষ্ঠান, গামোস বা মূল বিয়ে এবং এপাউলিয়া বা বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান। বিবাহপূর্ব আনুষ্ঠানিকতাটা এত গুরুত্বপূর্ণ নয়। বর-কনে যে যার মতো তা পালন করে।

এপর্বে বর-কনের যোগাযোগ হয়?

আমাদের সামাজিক পর্যায়ে এর কোনো সুযোগ নেই।

যা বলছিলেন, বলুন।

মূল পর্ব ‘গামোস’ বিয়ের দিন। এদিন বেশ কতগুলো আনুষ্ঠানিকতা আছে। কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি অবধি এসব অনুষ্ঠানাদির বিস্তার। দিনের শুরু হয় বর-কনের ধর্মীয় আচারসিদ্ধ একটি প্রথাগত পবিত্র স্নানের (লৌত্রা) মাধ্যমে। স্নানের আগে কনের মাথার চুল কাটতে হয়। স্নানটি পবিত্রতার প্রতীক। এরপরই বর-কনেকে মন্দিরে যেতে হয় প্রার্থনায়, উদ্দেশ্য দাম্পত্য জীবনের ফলদায়ক ও সুখী ভবিষ্যৎ লাভ। ফিরে এসে কনের বাড়িতে উভয় পরিবারের ভূরিভোজ। পুরুষ-মহিলা আলাদা আলাদা টেবিলে বসবে। পুরুষেরা শেষ না করা পর্যন্ত নারীরা বসে থাকবে। পুরুষদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটবে। ভোজের পর বিকেলে শোভাযাত্রা করে কনেকে নিয়ে যাওয়া হবে স্বামীর বাড়িতে। এ সময় কনের জন্য অবগুণ্ঠন বাধ্যতামূলক। স্বামীকে কনের বাবা প্রচলিত নিয়মে সাধ্যমতো উপঢৌকন দেবেন। শোভাযাত্রায় কনের মা-বাবা ডাইনি- ডাকিনীসহ সব দুষ্টচক্রের দৃষ্টি থেকে কনেকে বাঁচানোর জন্য ঝুড়িভর্তি ফলাহার ছিটাবেন।

বরের বাবা কিছু দেবেন না?

বাবা এখানে বিবেচ্য নয়, বরই গুরুত্বপূর্ণ। কনের বাবার বাড়িতে অনুষ্ঠান চলাকালে কনে দেবতা আর্টেমিস এবং আফ্রোদিতের উদ্দেশে পুতুলসহ নানা উপাচার উৎসর্গ করবে। একগুচ্ছ চুলও কেটে দিয়ে যাবে।

কেন, কেন?

কারণ, সে তার বাল্যকাল ও কৈশোরকে এখানে ফেলে যাচ্ছে। স্বামীর বাড়ি গমনেই বিয়ের পূর্ণতা এবং আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি। আর একটি ব্যাপার। বিয়ে হবে শীতকালে, পূর্ণচন্দ্ররাতে।

কেন?

এটা আমার জানা নেই, এ রহস্য জানেন দেবতা হেরা।

বরের বাড়িতে আনুষ্ঠানিকতা নেই?

আছে, সেটি আপনাদের নিয়মে হবে।

গ্রিক নিয়মটা বলুন না।

সেখানেই তো মহোৎসব।

কী রকম?

বাহন থেকে বর কনেকে কোলে করে ঘরে নিয়ে যাবে। বরের মাতা পুত্রবধূকে বরণ করে আপেল খেতে দেবেন। কনে আপেল কামড়ে বুঝিয়ে দেবে যে সে এখন স্বামীর ওপর নির্ভরশীল | স্পার্টায় অবশ্য নবদম্পতির মধ্যে কৃত্রিম যুদ্ধও হয়। এখানে কনেকে গাজর পোড়াতে দেওয়া হয়। কনেকে শুকনো শূকরের মাংস, বাদাম প্রভৃতি খেতে দেওয়া হয়। তার মঙ্গলার্থে সব অশুভ ও অপশক্তিকে বিতাড়নের গান করা হয়। পুত্রসন্তানের জন্য আরাধনা করা হয়। ভোগ দেওয়া হয়।

বরের বন্ধুরা যাতে বাসরঘরে ঢুকতে না পারে, সে জন্য পালা করে দরজায় প্রহরা দেওয়া হয়, সারা রাত জেগে এরা গান করে। ভোরবেলায় বর-কনেকে নিয়ে কৌতুক করা হয়। এসব আরকি। এবার বলুন ভারতীয় রীতিতে কী আছে?

ভদ্রবাহু বললেন, প্রহরা দিতে হলে তো নিকোমেডেসকে প্রহরায় বসাতে হবে, বলে খুব হাসলেন।

বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান আপনাদের। ভারতীয় বিবাহরীতিতে তা হবে।

ভারতীয় রীতিতে বিয়ে আট রকম। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনটি অনুসরণ করা হবে।

আট রকম?

শুধু হিন্দু বিয়ের ক্ষেত্রে আট রকম। এর বাইরে আছে জৈন বিয়ে, বৌদ্ধ বিয়ে, আজীবিক বিয়ে এবং অন্য সম্প্রদায়ের বিয়ে। সম্রাটের বিয়েটি হবে জৈন বিয়ের রীতিতে।

রীতিটি কী?

দেখার মধ্যেই চমৎকারিত্ব, দেখার মধ্যে আনন্দ পাবেন। তবু সামান্য আলোকপাত করছি। বিয়ের লগ্ন ও তারিখ পঞ্জিকা দেখে ঠিক করে দেন পুরোহিত, বিবাহপূর্ব ধর্মীয় কর্মকাণ্ড শুরু হয় এভাবে। পুরোহিত কাজটা করেন কনের বাড়িতে। তারপর পুরোহিত তা নিয়ে যান বরের বাড়িতে। বিয়ের লগ্ন ও তারিখ জেনে বরপক্ষ একটি পূজার আয়োজন করে, তাকে বলা হয় বিনয়াক্ষত্র পূজা। তারপর ‘সাগাই’ অনুষ্ঠান। বরের বাড়িতে এ অনুষ্ঠানে কনের ভাই বরের কপালে তিলক এঁকে দেয় এবং বরকে স্বর্ণালংকার প্রদান করে। বচনমতে মাদমণ্ডপে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিচালনা করেন পুরোহিত বর-কনের উভয় পরিবারে। একে ভারতী ও আরতি বলে। এ অনুষ্ঠানেও কনের ভাই বরের কপালে তিলক এঁকে দেয়। সঙ্গে দেয় উপহার। এ সময় বরও কনের ভাইয়ের কপালে তিলক এঁকে দেয় এবং নারকেল উপহার দেয়। পুরো সময়টাতে কনেপক্ষের বিবাহিত নারীরা আরতি এবং মঙ্গলগীত গায়।

বিয়ের মূল অনুষ্ঠানটাও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় ভরপুর। একে ফেয়ার বলা হয়। বর-কনে এ সময় বিয়ের মণ্ডপে বসে। কনের বাবা এক টাকা চার আনা এবং কিছু চাল কনের ডান হাতে প্রদান করেন। কন্যা বরকে আবার তা প্রদান করে। একে কন্যাদান বলা হয়। পুরোহিত এ সময় মন্ত্রপাঠ করতে করতে তিনবার জল ছিটান, এরপর আসে গ্রন্থিবন্ধন। এতে একজন বিবাহিত মহিলা বর-কনের শাল এবং শাড়ির মধ্যে গিঁট বেঁধে দেয়; এই মঙ্গলাচরণের পর অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে বর-কনেকে চার পাক দিতে হয়। এ সময়টায় মহাবীরস্তক শ্লোক পাঠ করা হয় সুর করে। এ পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় শান্তিপথ ও বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।

বিয়ের পর প্রবীণেরা এসে বর-কনেকে আশীর্বাদ করেন। এটা আশীর্বাদ অনুষ্ঠান। এরপরই কনের স্বগৃহে আগমন। এখানে বরের মাতা এবং অন্যরা তাদের স্বাগত জানান। তাদের একসময় কৃতজ্ঞতা জানাতে জৈন মন্দিরে যেতে হয়। জিনা গৃহে ধান অর্পণ অনুষ্ঠান বলে একে। বরগৃহে একটি পরিচিতি অনুষ্ঠান হয়, যাতে বর-কনের উভয় পক্ষের লোকজনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।

দিদাইমেইয়া বললেন, অনুষ্ঠান পর্বগুলো আমাদের মতোই। তবে এতে লৌকিকতার চেয়ে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বেশি।

লৌকিকতা নেই, তা নয়। তবে আপনাদের মতো নয়।

লাউডিস বললেন, বিয়ের সব পর্বেই উভয় রীতির উদযাপন চাই, বলে নিকোমেডেসকে উদ্দেশ করে বললেন, তুই জরুরিভাবে ফাওলিনকে আসতে বল।

ব্যস্ত হয়ে সেলুকাস বললেন, ফাওলিনের কাছে খবর গেলে তা ফারাও টলেমির কানে যাবে।

একসময় তো তা যাবেই, বাবা। আপনি কী যে বলেন!

আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, শীত আসতে দেড় মাস বাকি। অবশ্য আমি চেষ্টা করব প্রথম পূর্ণিমাতেই লগ্ন ঠিক করতে।

নিকোমেডেস বলল, আমি কি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে পারি?

আচার্য কিছু বলার আগেই সেলুকাস বললেন, তুমি কেন যাবে?

লাউডিস বললেন, আমরা তিনজনই যাব। আমি, পিসি ও নিকো।

দিদাইমেইয়া বললেন, একটি পারিবারিক সম্পর্ক হতে যাচ্ছে, পারিবারিকভাবে আমাদের যোগাযোগ হওয়া দরকার। লাউডিস ঠিকই বলেছে। তুমি আপত্তি করো না, সেলুকাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *