৬৫
অবশেষে দিদাইমেইয়ার কাছে সন্ধির চুক্তির সংবাদ পৌঁছাল। বার্তাবাহক বলল, চুক্তির শর্তমতো ওরা মুক্ত। অন্য শর্তগুলো কী, সে তা জানে না। লাউডিস জেনারেলদের খবর নিলেন। অর্ধেক জানা বার্তাবাহক বলল, দুজন জেনারেলের মৃত্যু হয়েছে।
কোন দুজন? সংবিৎ হারানোর অবস্থা লাউডিসের।
আমি ঠিক জানি না।
কী জানো তুমি, বলে চিৎকার করে উঠলেন দিদাইমেইয়া। আবার বললেন, তুমি এখনই যাবে। সঠিক সংবাদ নিয়ে আসবে। উজবুক কোথাকার!
লাউডিস বললেন, তার সংবাদ আনার প্রয়োজন নেই, পিসি, আমরাই যাব।
প্রস্তাবটা সঠিক মনে হলো তার কাছে। তিনি দ্রুত তৈরি হতে বলে নিজেও যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
জেনারেল মোলন এ সময় উপস্থিত হলেন। তিনি খুব চিন্তাগ্রস্ত। দিদাইমেইয়া বললেন, মোলন, সংবাদ কিছু পেয়েছ?
কার সংবাদ?
কার আবার? এখন তো সংবাদ একটাই, সেলুকাস কোথায়, কীভাবে আছে। তাঁর বাহিনীর কী অবস্থা? সে সংবাদ আমি চাই।
আমি তা জানি, মাননীয়া, আমি একটা দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছি।
দিদাইমেইয়া অবাক হয়ে বললেন, কী দুঃসংবাদ, মোলন?
প্রিন্স এন্টিওকাস আমার আনুগত্য চাইছেন। উদ্দেশ্য, নিজেকে সেলুসিড সাম্রাজ্যের সম্রাট ঘোষণা করবেন।
সে জানে না সম্রাট জীবিত আছেন এবং মুক্ত।
মুক্ত?
হ্যাঁ, সন্ধিচুক্তি হয়েছে, আমি জানি না চুক্তিতে কী আছে, তবে সম্রাট মুক্ত।
আমাকে বাঁচালেন মাননীয়া, হয় আমাকে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে হতো, অন্যথায় তাঁর
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হতো।
আমি বলেছিলাম না, সে লোভী। আচাইয়াস কোথায়?
তাঁর সংবাদ আমি জানি না, তবে সংবাদ সংগ্রহ করে আনা সম্ভব।
তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নাও। আমি শুনে যেতে চাই তার কী অবস্থা।
আপনি কোথাও যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, আমি লাউডিসকে নিয়ে সিন্ধু এলাকায় যাব। সেখানকার সব সংবাদ স্পষ্ট নয়।
কোনো দুঃসংবাদ?
শুনলাম দুজন জেনারেল নিহত হয়েছে। এরা কারা, এখনো জানা যায় নি।
আপনি উৎকণ্ঠিত হবেন না।
তুমি কি জানো না লাউডিসের স্বামী একজন জেনারেল, উৎকণ্ঠিত হব না কেন?
নিশ্চয়ই সে সুস্থ আছে। আমি তাকে ভালোভাবেই চিনি।
নিশ্চিত করে বলতে পারো না, তবু তোমার কথা যেন ঠিক হয়। তুমি আমাদের যাওয়ার প্রস্তুতিটা দেখো, অশ্বযানে যাব আমরা। নিরাপত্তা যেন ঠিক থাকে। আর লোক পাঠাও। এখনই আচাইয়াসের সংবাদের জন্য লোক পাঠাও।
আচাইয়াস যখন দেখতে পেলেন এন্টিওকাস তাঁকে আটক করতে চাচ্ছেন, তিনি কৌশল করে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দর-কষাকষিতে গেলেন। বললেন, তোমার সাম্রাজ্য অধিগ্রহণে আমি বাধা দেব না। আমি বাবাকে উদ্ধার করে আনার জন্যও কারও কাছে যাব না, তুমি শুধু বলো যে আমার ব্যবসায়ের কোনো ক্ষতি হবে না।
এন্টিওকাস বলল, তা ঠিক আছে। এখন সম্রাটের রাজকোষ শূন্য। আমি অর্থশূন্য সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে অর্থকষ্টে পড়ে যাব। তোমাকে রাজধানী সুরক্ষায় নিয়োজিত ও যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা (যদি আসে) সৈন্যদের ভরণপোষণের ভার নিতে হবে এবং সম্রাট ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের ভাগ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
ওরা তোমারও রক্তসম্পর্কীয়। তাদের ক্ষতি হয়, এমন কিছু নিশ্চয়ই তুমি চাইবে না।
সেটি অবস্থার ওপর নির্ভর করছে। তাদের ভূমিকা দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ওদের অনেকেই আমাকে আর স্ট্রেটোনিসকে পছন্দ করে না। আমাদের প্রতি তাদের আনুগত্য না থাকলে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে।
তুমি কি তাদের মৃত্যুদণ্ড দেবে?
নির্বাসন আর কারাবাসও হতে পারে। এখন তুমি রাজকোষ ভর্তি করে দেওয়ার কথা বলো।
তোমার যত অর্থের প্রয়োজন, আমার কাছে তত নগদ অর্থ নেই। আমি তোমাকে অর্থ সংস্থানের পথ বলে দিতে পারি।
কোথা থেকে আসবে অর্থ?
আমাকে ভাবতে দাও। প্রজাদের কাছ থেকে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আদায়ের দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে।
তুমি জনবল নিয়োগ করবে। আমি সহযোগিতা করব।
একজন দূত এসে এ সময় এন্টিওকাসের কানের কাছে গিয়ে কী যেন বলল। এন্টিওকাস রাগে-ক্ষোভে তাকে লাথি মেরে ফেলে দিল। গড়গড় করে বলল, মুক্তি পেয়েছে তো কী হয়েছে। কদিন সে বাঁচবে, এ সাম্রাজ্য আমার। আমি তার উত্তরাধিকারী, আর কেউ না।
তার চিৎকার-চেঁচামেচিতে স্ট্রেটোনিস ছুটে এলেন, বললেন, শান্ত হও, কী হয়েছে, এত চিৎকার করছ কেন?
সম্রাট মুক্তি পেয়ে গেছে।
মুক্তি পেয়ে গেছে তো ভালো কথা। তোমাকে কোনো ঝামেলায় যেতে হলো না। তোমাকে এমনিতেই সাম্রাজ্যের দায়িত্ব দিয়ে দেবে। অন্য কারও কথা ভাবলে বুড়োর কপালে দুঃখ আছে।
আচাইয়াস এসব কথা শুনলেন। বাবার বিরুদ্ধে কী সব বলছে মহিলাটা। সম্মান করে কথা বলছে না। সেলুকাস এখনো সেলুসিড সাম্রাজ্যের সম্রাট। বুকটায় তাঁর ব্যথা। প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারছেন না। শুধু বললেন, এন্টিওকাস, আমি তাহলে আসি?
আমি যা বললাম, যদি ভালো চাও, কাউকে বলবে না।
.
লাউডিস আর দিদাইমেইয়ার মাঝখানে বসেছে লাউডিসের মেয়ে হারমিজ। লাউডিস একদম কথা বলছেন না। চতুরাশ্ব যানটা ছুটে চলেছে যেন তাঁর বুকের ওপর দিয়ে। কী সংবাদ শুনতে হয় তাঁকে, কে জানে। হারমিজেরও মন খারাপ। আগের চঞ্চলতা নেই। সে বুঝতে পারছে না কী বলবে। কিছু বললে যদি মা কেঁদে ফেলে। তাই সে কিছু বলছে না।
দিদাইমেইয়া বললেন, সংবাদ ভালো-মন্দ দুই-ই হতে পারে। ভালোটা মনে করে সহজ হওয়ার চেষ্টা করো। হারমিজও মনভার করে আছে।
পিসি চেষ্টা করছি। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সবকিছু।
কিউকেকাস অত্যন্ত চৌকস অফিসার। নিজেকে রক্ষা করার কৌশল তার জানা আছে।
হারমিজ বলল, তুমি ঠিক বলছ না। কর্নি আন্টি বলেছে, আমার বাবা বোকার হদ্দ।
সে তো মজা করে বলেছে, মন থেকে বলে নি।
বারবার বলেছে। বোকা মানুষেরাই বিপদে পড়ে। এ কথা দাদুর মুখে শুনেছি আমি।
তোমার বাবা বোকা নয়, আবার বললেন দিদাইমেইয়া।
মা, বাবা কি আসলেই বোকা?
জানি না, মা। দেবতাদের কাছে বলো তার যেন কিছু না হয়।
হারমিজ চোখ বুঝে দেবতাদের উদ্দেশে বিড়বিড় করছে। অশ্বখুরের শব্দে বোঝা যাচ্ছে না সে কী বলছে।
.
পরাজিত সৈন্যরা অস্ত্রহীনভাবে যাবে, না অস্ত্রসহ যাবে, এ নিয়ে মহামন্ত্রী চাণক্য সম্রাটের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে গেছেন। সম্রাট গ্রিক সৈন্যদের সসম্মানে তাদের অস্ত্রসহ ফেরত পাঠাতে চান। চাণক্য বলছেন, আত্মসমর্পণকারীরা অস্ত্র নিতে পারবে না, যুদ্ধের পোশাক-পরিচ্ছদও না।
সম্রাট বললেন, এসব পোশাক আর অস্ত্র দিয়ে আমরা কী করব? এগুলো আমাদের যুদ্ধের কাজে লাগবে না!
চাণক্য বললেন, আমরা এগুলো দিয়ে একটা জাদুঘর বানাব। ভবিষ্যতের ভারতীয়রা তা দেখে গর্ব করবে।
আচার্য, আপনার কথায় যুক্তি আছে বটে। কিন্তু আমরা তাদের মুক্ত করে দিয়েছি। এরা সামরিক পোশাকে, সামরিক কায়দায় স্বদেশে ফিরে যাক।
পথে এরা অঘটন কিছু করে বসলে? পরাজিত সৈনিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা বলতে কিছু থাকে না। তারা লুটপাটে প্রবৃত্ত হয়ে যেতে পারে।
আপনার আশঙ্কার কথা মানছি। তার ব্যবস্থাও আছে। স্থানে স্থানে অবস্থান করা আমাদের সৈন্যরা তাদের ওপর নজর রাখবে। এ নিয়ে আপনি আর আপত্তি করবেন না।
আমাদের বিজয়ী সৈন্যরা অর্থকড়ি, সোনাদানা নিয়ে নিতে চাইবে, তখন সংঘাত হবে। আপনি ঘোষণা করে দিন, আমাদের সৈন্যদের যুদ্ধজয়ের জন্য রাজকোষ থেকে স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করা হবে, এরা যেন গ্রিকদের কাছ থেকে জোর করে কিছু আদায় না করে।
চাণক্য ক্রূর হাসি হেসে বললেন, মহামান্য সম্রাট, তাহলে প্রজাদের ওপর নতুন করে কর ধার্য করতে হবে।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত প্রজাদের ভালোবাসেন। কর ধার্য করতে চান না। মহামন্ত্রীর প্রস্তাবে বড় বেকায়দায় পড়ে গেলেন।
সুবন্ধু এগিয়ে এলেন। বললেন, কর ধার্য বা বাড়ানোর বোধ হয় প্রয়োজন হবে না। সিন্ধু অববাহিকা সমৃদ্ধ অঞ্চল। সেখানে প্রচুর ফসল ফলে। বাণিজ্যের জন্যও বিখ্যাত। সেখানকার কর এখন থেকে রাজকোষে আসবে। যুদ্ধটাও হয়েছে থর মরু এলাকায়, ফসলের হানি কিংবা ব্যবসার তেমন কোনো ক্ষতি হয় নি।
তবু মানুষ আতঙ্কে ছিল। এরা তো এ অবস্থায়ও গ্রিকদের কর দিয়েছে। দেয় নি?
সুবন্ধু চাণক্যের প্রশ্নের জবাবে বললেন, দিয়েছে। এখনো দেবে। তাদের পছন্দের সম্রাটকে দেবে।
যা-ই হোক, মহামান্য সম্রাট, অস্ত্র আর পোশাকের ব্যাপারটা এখনো অমীমাংসিত।
আচার্য, আমি আমার সিদ্ধান্ত বলেছি। ওরা সম্মানের সঙ্গেই সবকিছু নিয়ে ফেরত যাবে। পথে কেউ সমস্যা করলে, সে গ্রিক বা মৌর্য, যে-ই হোক না কেন, তার শাস্তি হবে।
এখানেও ব্যর্থ হলেন মহামন্ত্রী। উঠে গেলেন তিনি। যাওয়ার সময়ই আবার মনে হলো ভদ্রবাহুর কথা। তিনি বলেছিলেন দূরে সরে যাবেন না, তাহলে অন্যরা সুযোগ পাবে। ভুল- বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। তাই আবার ফিরে এলেন। বললেন, একটা কথা সম্রাট, হস্তী প্রদানের সঙ্গে প্রশিক্ষক পাঠানো হবে কি না, গ্রিক সৈন্যদের সঙ্গে হস্তীর বহর যাবে কিন্তু, (গেলে মন্দ হয় না) এ ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
আচার্য, এ সিদ্ধান্তটি আপনি নিন। আমার মনে হয়, আপনি ভালোটাই বিবেচনায় আনবেন আর একটি বিষয়, বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে পরামর্শ করা দরকার।
এই পরামর্শ সভায় আচার্য ভদ্রবাহুর উপস্থিতির প্রয়োজন আছে।
আমিও তা অনুভব করি। আপনি বিষয়টি নিয়ে ভাবুন।
এ দায়িত্বটা কিছুটা স্বস্তি দিল মহামন্ত্রী চাণক্যকে। বিষয়ও উপলবন্ধি করলেন তিনি, তিনি যত বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোন না কেন, সম্রাট চাইলে মুহূর্তেই শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে দিতে পারেন। ক্ষমতাটা যে আসলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এ নিয়ে করনে তাঁর পাণ্ডিত্য, এতে কারও ভাগ নেই। আরও উপলব্ধি করলেন, সম্রাট ছাড়া আর সবার ক্ষমতাই আরোপিত ও ক্ষণস্থায়ী। সম্রাট চাইলেই যে কাউকে ক্ষমতাহীন করে দিতে পারেন। এ উপলব্ধি পিঠে তাঁর আর একটা চিন্তা এসে বসল। সে হলো বৈরাগ্য। এ নিয়ে এখনই কিছু ভাবতে চান না তিনি। কিন্তু মাঝেমধ্যে তা তাঁকে পেয়ে বসে।
একদিন ভদ্রবাহুকে বলেছিলেন, সংসার বিরাগী হওয়ার কথা আপনার, অথচ আপনি পুরোদস্তুর একজন সামাজিক ও বাস্তববাদী মানুষ। আমার ভেতরটা আপনার বাইরের মতো। জানি না কবে সংসার ছেড়ে পলাতক হই।
ভদ্রবাহু হেসে দিয়ে বলেছিলেন, ভুল বলেন নি, আচার্য। মানুষের ভেতর একজন সন্ন্যাসী সব সময়ই বাস করেন, যিনি ঘর থেকে মানুষকে বাইরে নিয়ে যেতে চান। সংসারের নানা অভিঘাত কাজটি সহজ করে দেয়।
আপনার বেলায় সে ব্যর্থ।
ব্যর্থ কোথায়, বাইরেটা তো সে পরিবর্তন করতে পেরেছে। ভেতরটাও পেরেছে। তবে মানুষের পরিচয় সন্ন্যাসীপনায় নয়। সমাজে, সংসারে। তার সঙ্গে দ্বন্দ্বটা সেখানে।
কিন্তু সে আমাকে টানছে। একদিন হয়তো হেরে যেতে হবে তার কাছে।
আপনাকে সে কাবু করতে পারবে না, বলে খুব জোরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ভদ্ৰবাহু।
আপনার মতো যদি এত প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারতাম।
চাণক্য ফিরে এলেন স্মৃতি থেকে। অস্ফুটে বললেন, ভুল বলেছেন, ভদ্রবাহু। আমাকে বোধ হয় সব ছেড়েছুড়ে সন্ন্যাসীই হতে হবে।
সুবন্ধুকে ডাকলেন তিনি। তার আগে ভাবলেন, এখন সুবন্ধুর সঙ্গে আচরণের ধরনটা কেমন হবে? আগে যেভাবে শক্ত কথা বলতেন, সেভাবে, নাকি সম্মান করে?
এখানে তাঁকে নমনীয় বা কৌশলী হতে হবে কেন? যুক্তি হলো সময়টা ভালো যাচ্ছে না, ছাড়া সুবন্ধু এখন সম্রাটের লোক। সম্রাটের লোক? নিজেকেই প্রশ্ন করলেন চাণক্য।
সুবন্ধু এলেন। শক্ত ভাষায়ই বললেন, তোমাকে আজকাল কাছে দেখি না, ডেকে আনতে হয়।
সুবন্ধু এর কৈফিয়ত দিলেন না। বললেন, মহামান্য সম্রাট বলেছেন আপনি এবং ভদ্রবাহুকে নিয়ে এখনই যেতে
তোমাকে বলবেন কেন তিনি?
এ কথার জবাব দিলেন না সুবন্ধু।
তোমাকে ডেকেছিলাম বিয়ের আয়োজন সম্পর্কে জানতে।
আচার্য, আপনারা আয়োজন-পরিকল্পনা করে বলবেন আমাকে কী করতে হবে। কাজ করাটা আমার দায়িত্ব, আয়োজন-পরিকল্পনা নয়।
চাণক্য বলতে যাচ্ছিলেন সম্রাটের সঙ্গে যখন ‘ঘুচুর ঘুচুর করো, তখন তো আচার্যের কথা মনে থাকে না। তা না বলে বললেন, সম্রাট কি আয়োজনের কোনো আভাস দিয়েছেন?
সুবন্ধু আভাস পান নি, তা নয়, কিন্তু বললেন না। বললেন, আমি সংবাদটা ভদ্রবাহুকে জানিয়ে আসি।
আমরা একসঙ্গে বের হব। বিড়বিড় করে বললেন, এইমাত্র এলাম। আবার কী এমন জরুরি ব্যাপার ঘটে গেল।
চাণক্য তৈরি হতে কিছুটা সময় নিলেন। মাথাটাও এ ফাঁকে হালকা করে নিলেন। সুবন্ধু বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। এ যুদ্ধের বিজয়ে যাঁরা আনন্দিত এবং জয়ের আনন্দ উপভোগ করছেন, এঁদের সবার সঙ্গে আছেন সুবন্ধু। শুধু একজন তাঁদের মধ্যে নেই, তিনি মহামন্ত্রী চাণক্য। গ্রিকদের তাড়িয়ে ভারতবর্ষের সিন্ধু উপত্যকা অধিকার তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, এ যুদ্ধে তাঁর সে স্বপ্ন সফল হয়েছে, অথচ তিনি তা উপভোগ করতে পারছেন না। চাণক্য যখন তার জন্য নিজের ভাগ্যকে দুষছেন, তখন বাইরে দাঁড়িয়ে তাঁরই শিষ্য সুবন্ধু আনন্দে আর মহাসুখে শুধু বিজয়ের আনন্দ নয়, আরেক স্বপ্ন দেখছেন, সোনালি স্বপ্ন। তাঁর বিশ্বাস, সে স্বপ্ন খুব দূরে নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং সম্রাটের মনোভাব যেন সে কথাই বলছে তাঁকে। তাঁর এই বিশ্বাসে দক্ষিণের উতলা বাতাস অজানা এক সুখের হাওয়া দিচ্ছে।
চাণক্য তৈরি হয়ে বের হলেন। তাঁর মনে শান্তি নেই। মাথাটা হালকা হলেও রুক্ষ ভাবটা কেটে যায় নি। কণ্ঠেও রুক্ষ মেজাজ, চলো ভদ্রবাহুর কাছে আগে যাই।
সুবন্ধু তাঁকে অনুসরণ করলেন।
.
আসুন আচার্য, কী সৌভাগ্য আমার, বলে ভদ্রবাহু তাঁদের স্বাগত জানালেন। সব সময় হাসিখুশি মানুষটিকে দেখে চাণক্যের মনটা যেন হালকা হয়ে গেল। ভদ্রবাহু আবার বললেন, দুটিই মস্ত বড় আনন্দের খবর—একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত গ্রিকদের বিরুদ্ধে জয়, অপরটি সম্রাটের বিয়ে। যে-সে বিয়ে নয়, একেবারে গ্রিক সম্রাট-তনয়ার সঙ্গে বিয়ে। দুটির জন্যই আপনাকে অভিনন্দন।
আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, আচার্য। এ অভিনন্দন শুধু আপনি পেতে পারেন। চাণক্য এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। কারণ, সুবন্ধু উপস্থিত আছেন। সুবন্ধু বললেন, আচার্য, আপনাদের সম্রাট স্মরণ করেছেন। আমাকে বলেছেন, খুবই জরুরি।
চাণক্য কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত জরুরি জরুরি করছ কেন? তুমি যাও, আমরা আসছি।
সুবন্ধু বের হয়ে গেলেন। বিরক্তি নিয়ে সেদিকে তাকালেন চাণক্য এবং বললেন, আচার্য, ওর পরিবর্তনটা লক্ষ করেছেন?
ভদ্রবাহু হেসে বললেন, অনেকের মধ্যেই তো পরিবর্তন দেখছি। জোয়ারের পানি যখন আসে, ছোট পুঁটি-বোয়াল-রুই-কাতল সবাই লাফায়। বুদ্ধিমান বড় মাছেরা তখন গভীর জলেই থাকে।
বিয়ের অনুষ্ঠান মনে হয় বড়সড় রকমের হবে। বিজয়ের উৎসব আর বিয়ের উৎসব একাকার হয়ে যাবে।
দুই উৎসবই তো বড় করে উদ্যাপন করার কথা। তবে আমার মনে হয় না সম্রাট সে রকম বড় কোনো উৎসবে লিপ্ত হবেন।
কেন, আপনার যুক্তি কী, বলে চাণক্য ভদ্রবাহুর জবাব দেওয়ার আগেই আবার বললেন, রাজকোষে অর্থসংকট আছে বটে, কিন্তু উৎসবের জন্য তা সমস্যা নয়।
বিয়েটা কি এখনই হচ্ছে, চমকে দেওয়ার মতো করে বললেন ভদ্ৰবাহু।
আপনার সন্দেহ আছে?
বিয়ে হবে, সন্দেহ নেই, কিন্তু এখনই হবে কি না, বলা যাচ্ছে না।
আপনার শিষ্য এত অপেক্ষার পাত্র নয়।
চলুন দেখি কী বলতে চায়। কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট নয়, সৈন্য প্রত্যাহারের আগে গ্রিক সম্রাট এ বিয়ে অনুষ্ঠানে রাজি হবেন কি না।
বিয়ে পর্যন্ত তাঁকে তো এখানে অবস্থান করতেই হবে। সামরিক আমেজে বিয়ে হতে সমস্যা কোথায়?
দশ লাখ সৈন্যকে বিয়ের ভোজ খাওয়াতে হবে আপনাকে, বলে মজা করে হাসলেন ভদ্রবাহু।
রাজকোষের অবস্থা ভালো নয়, তবু একবেলা খাবে বর-কনেপক্ষ, এটা তাদের অধিকার।
যুদ্ধে আর যে প্রাণীগুলো অংশ নিয়েছে, তাদের? যুদ্ধজয়ে তাদের অবদানও কম নয়।
ওরা তো আপনার মতো তৃণভোজী, আপনার সঙ্গে খাবে, বলে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন চাণক্য। পরে আপ্তবাক্যে বললেন, মনে হয় জীবনে এত প্রাণ খুলে হাসি নি। ক্ষমা করবেন আমায়, আচার্য।