৬৪
বিকেলে বিদায় নেওয়ার আগে দুর্গটি ছেড়ে দেওয়া হলো সম্রাট সেলুকাস আর তাঁর লোকজনদের জন্য। প্রহরার দায়িত্ব থাকল মৌর্য সেনাদেরই।
যাওয়ার সময় সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত হেলেন আর সম্রাটের কাছ থেকে বিদায় নিলেন বটে, কিন্তু মনটা এখানেই পড়ে থাকল। বারবার তাকাচ্ছিলেন হেলেনের দিকে। ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছিল।
আচার্য ভদ্ৰবাহু তা লক্ষ করে কাছে গিয়ে আস্তে করে বললেন, চন্দ্র, তুমি আরও কিছুক্ষণ থেকে যাও। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
এ কথা শুনে মনে হলো চন্দ্রগুপ্ত লজ্জা পেয়েছেন। নম্রভাবে বললেন, না আচার্য, অনেক কাজ এখন, তার আগে কর্মপরিকল্পনা।
মহামন্ত্রী আছেন না?
সবকিছু তাঁর ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। এ ছাড়া এসব কাজ আমারই ব্যক্তিগতভাবে দেখা দরকার। গ্রিকদের প্রত্যাহারে কোনো ভুল হোক, আমি তা চাই না।
আমি কিছুক্ষণ থাকব তাদের সঙ্গে।
আমার মনে হয় তা ভালো হবে। ওরা আপনাকে খুব পছন্দ করে।
তোমাকেও পছন্দ করে। তুমি শুধু রাজ্য জয় করো নি, অনেকের হৃদয়ও জয় করে নিয়েছ। তোমার ব্যবহারে এরা সবাই মুগ্ধ।
আধ্যাত্মিক গুরুর কথায় চন্দ্রগুপ্তের মুখমণ্ডলে স্নিগ্ধ এক স্মিতহাস্য খেলা করে গেল।
দুর্গের ফটকের বাইরে সম্রাটকে বিদায় জানানোর জন্য মৌর্য এবং গ্রিক সৈন্যরা দুপাশে আলাদা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। সন্ধির আওতায় গ্রিকরা এখন মুক্ত। মিত্র সম্রাটকে বিদায় জানানো এখন রাজকীয় আনুষ্ঠানিকতা।
সম্রাটের জয়ধ্বনি দিচ্ছে মৌর্য সৈন্যরা। সম্রাট এগিয়ে যাচ্ছেন। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত দুর্গ থেকে হেলেন, আচার্য ভদ্রবাহু ও নিকোমেডেস দেখছেন সে দৃশ্য। গ্রিক সৈন্যরা হাস্যোজ্জ্বল প্রিন্সেসকে দেখে স্বস্তিবোধ করছে, যদিও এরা অ্যাটেনশন অবস্থায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরাও গ্রিক ভাষায় কিছু একটা বলছে, এর অর্থ বোঝা যাচ্ছে না।
যাতে কোনো অঘটন না ঘটে, সে জন্য প্রচুর সতর্কতা আছে। তাদের (গ্রিকদের) পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক সারি মৌর্য সেনা। গ্রিকদের যুদ্ধাস্ত্র আগেই জমা নেওয়া হয়েছে।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত নিজেও সতর্ক। তাঁর পেছনে আছেন মৌর্য সেনাপ্রধান এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নারী প্রহরী এবং সেনাসদস্যরা।
নারী নিরাপত্তা প্রহরীদের দেখে অবাক হলেন হেলেন। ভাবলেন, এরা কী নিরাপত্তা দিচ্ছে! সম্রাট গিয়ে হস্তীতে চড়লেন। এখন কোনো তাড়া নেই। তাই গজেন্দ্রগমনেই প্রশান্তি।
সম্রাটের বহর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে হেলেন বাঁ দিকে ঘুরে আচার্য ভদ্ৰবাহুকে প্রশ্ন করলেন, আচার্য, এরা কী নিরাপত্তা দেবে?
দিচ্ছে তো প্রিন্সেস। প্রথম থেকেই দিচ্ছে। পরিকল্পনাটা মহামন্ত্রী চাণক্যের। সম্রাটের অধিক নিরাপত্তার জন্য এ ব্যবস্থা। নারীরা পুরুষদের চাইতে বেশি বিশ্বস্ত।
কিন্তু শক্তিতে দুর্বল, বললেন হেলেন।
দেহের শক্তির চেয়ে নৈতিক শক্তি এ ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।
নিকোমেডেস হেলেনকে খেপানোর জন্যই বলল, আচার্য, এরা কি নৈশকালীন নিরাপত্তার দায়িত্বও পালন করে?
আচার্য বুঝলেন, বললেন, কেন নয়, সম্রাটের সেবাযত্নও এরাই করে।
দাস-দাসী নেই? হেলেনের উৎকণ্ঠা।
আছে। তবে খুব কম। আপনার উৎকণ্ঠিত হওয়ার দরকার নেই, প্রিন্সেস, আমি চন্দ্ৰকে চিনি।
এবার হেলেনের চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠল। ভদ্রবাহু আবার বললেন, ওর নিরাপত্তার আরও অনেক কৌশল করে রেখেছেন মহামন্ত্রী।
কী কৌশল, নিকোমেডেস প্রশ্ন করে। আর তাতে উৎকর্ণ হন হেলেন। আচার্য ভদ্রবাহু বিষ বৃত্তান্ত বয়ান করলেন এবং সম্রাজ্ঞী দুরধরার অকালপ্রয়াণের কথা বললেন।
মহামন্ত্রী চাণক্য কি সম্রাটকে খুব পছন্দ করেন?
তিনিই তাকে সম্রাট বানিয়েছেন। যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন।
তাঁর ওপর সম্রাট সন্তুষ্ট নন কেন, জানতে চায় নিকোমেডেস।
রাজা যদি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হন, তাহলে মন্ত্রীরা হয় কুটিল প্রকৃতির। আর কোনো অধ্যাপক যখন এ দায়িত্ব পান, তখন ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে ওঠে। সম্রাট জটিলতা এড়িয়ে চলতে চান। তিনি নেহাতই একজন ভালো মানুষ।
আমার মনে হয় আপনার সংস্পর্শে এসে তিনি ভালো মানুষ হয়েছেন, বললেন হেলেন।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যে সু এবং কুপ্রবৃত্তি থাকে। আপনি যেটি লালন করবেন, সেটিই বিকশিত হবে। তবে চন্দ্র প্রবৃত্তিগতভাবেই একজন সৎমানুষ।
মহামন্ত্রীর প্রভাব নেই?
নিকোমেডেসের এই প্রশ্নের জবাবে আচার্য বললেন, রাজনীতি বড় অদ্ভুত জিনিস। প্রধান পরামর্শকের পরামর্শ সম্রাটকে মানতে হয়, কারণ, সব ব্যাপার সহজ নয়।
ব্যক্তিজীবনে, প্রশ্ন করে আবার বললেন, না, বলছিলাম ব্যক্তিজীবনে সম্রাটের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেছেন?
প্রভাব কতটা, তা বলা শক্ত। তবে চন্দ্র একটা স্বতন্ত্র এবং তার পছন্দের জীবন যাপন করে। তার জীবন একান্তই তার নিজের। আর যদি আচার্য চাণক্যের কথা বলেন, তাঁর গভীর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রয়েছে। কোনো কোনো ব্যাপারে আমি তাঁর অনুরক্ত। ভালো বন্ধুও বলতে পারেন।
আপনি? ভীষণ অবাক হন হেলেন, কীভাবে সম্ভব?
আমি জানি, আপনার তাঁর ওপর দারুণ বিরক্ত। সম্রাটও মাঝেমধ্যে ক্ষুব্ধ হন। ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো সে রকম আচরণ আচার্য করে ফেলেন। ভুল করে করেন তা নয়, পরিকল্পিতভাবে এবং চিন্তা করেই করেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানেন, এর জন্য তাঁর কোনো অনুতাপ বা অনুশোচনা–কোনোটাই নেই।
তারপরও আপনি তাঁর বন্ধু?
তিনি একজন পণ্ডিত মানুষ, একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, হেন শাস্ত্র নেই, যা তিনি জানেন না, একজন আত্মসচেতন ব্যক্তিও।
এগুলো বন্ধুত্বের জন্য কোনো যোগ্যতা নয়। বন্ধুত্বের জন্য কিছু ত্যাগ করতে হয়, সে ত্যাগের মানসিকতা কি তাঁর আছে?
তা নেই। বন্ধুত্বের প্রয়োজনটা যদি আপনার হয়, তাহলে ছাড়টা আপনাকেই দিতে হবে।
ব্যাপারটা একতরফা হয়ে গেল না?
হওয়ারই কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটে নি। তিনি আমাকে প্রচুর সময় দেন। মনে হয় আমরা উভয়ে সময়টা বেশ উপভোগও করি। আর একে অন্যের দোষ নয়, গুণের চর্চা করি। মনে হয় এটাই বন্ধুত্বকে মজবুত করেছে।
আমার মনে হয় স্বার্থের কোনো ক্লেশ নেই।
থাকলে তা এড়িয়ে চলি।
তা চলেন। না হয় এ রকম একজন মানুষকে হেলেনকে থামিয়ে দিয়ে ভদ্রবাহু বললেন, আপনারও তাঁকে প্রয়োজন হবে।
কী রকম?
এখন তো বলতে পারছি না। তবে এখন আপনাকে পরামর্শ দিতে পারি, কখনো প্রয়োজন হলে তাঁকে এড়িয়ে যাবেন না, নিজের কাজে লাগাবেন।
ভদ্রবাহুর এ কথায় হেলেন হেসে দিলেন। বললেন, আচার্য, আপনি এত বাস্তববাদী যে বুঝতে পারছি না তা কী করে সম্ভব।
এবার হাসার পালা আচার্য ভদ্রবাহুর। তিনি হো হো করে হাসলেন।
.
সেলুকাস তাঁর জেনারেলদের নিয়ে বসেছেন। এখন তাঁর সামনে দুজন জেনারেল। একজন ফিলেকাস, অপরজন কিউকেকাস। জেনারেল সারিকাস যুদ্ধক্ষেত্রে, সৈন্যদের সঙ্গে। সেলুকাস বললেন, এ পরাজয়ের প্রতিশোধ আমি নেব।
অবাক হলেন কিউকেকাস। বললেন, একি বলছেন, সম্রাট! আমরা সম্মত হয়েই তো সন্ধিচুক্তি করলাম। মৈত্রীবন্ধনে, আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হলাম, কেউ কাউকে আক্রমণ নয়, সহযোগিতা করব মর্মে অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম।
তোমার সমস্যা একটাই, তুমি রাজনীতি বোঝো না। যাক, সেটা এখনই হচ্ছে না, যখন প্রতিশোধ নেওয়ার সময় হবে, তখন তোমারও মতের পরিবর্তন হবে—সবকিছু বুঝতে পারবে। এখন সেলুসিয়ায় প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে কথা বলি।
আমরা কয়েকটি দফায় সৈন্য প্রত্যাহার করব, সম্রাট, বলে ফিলেকাস হাত থেকে যুদ্ধের মানচিত্রটি মাটিতে বিছিয়ে রাখলেন। একটি লম্বা কাঠি দিয়ে দেখালেন, প্রথমে এ অগ্রবর্তী রেজিমেন্টটি সিন্ধু নদ অতিক্রম করে যাবে। দ্বিতীয় রেজিমেন্টটি তাদের, অর্থাৎ প্রথম রেজিমেন্টের ছাউনিতে অবস্থান নেবে এবং কয়েক দিন থাকবে। এভাবে এক মাসের মধ্যে আমরা সিন্ধু অঞ্চল ছেড়ে যাব।
সম্রাট বললেন, এখানকার মানুষের মনে বেশ ক্ষোভ আছে, বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের মধ্যে। মন্ত্রী চাণক্য এদের নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করে কি না, এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন আছি।
আমিও তা-ই ভাবছি, বলে ফিলেকাস কিউকেকাসের দিকে তাকালেন। কিউকেকাস তা মনে করেন না, স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন এবং বললেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে উদ্বাস্তুদের কিছু সহায়তা করা, যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে দেওয়া।
মৌর্যরা তো আমাদের কাছে কোনো ক্ষতিপূরণ চায় নি, তুমি বলছ কেন?
চায় নি বলেই দেবেন, সম্রাট, ওরা চাইলে সন্ধির প্রকৃতি হতো ‘আত্মামিষ’।
মানে কী?
মৌর্যরা নির্ধারণ করে দিত নির্ধারিত কোষ, সেনাসদস্য আর উপহারসামগ্রী নিয়ে তাদের কাছে মাথা নত করে দাঁড়াতে হতো। কিন্তু তা করে নি। নিজেকে সমর্পণ না করে অন্য কাউকে সেবাকর্মে নিযুক্ত করে আত্মরক্ষণ সন্ধি করতে বাধ্য করতে পারত, তা-ও করে নি। উদ্বাস্তুদের সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ চাইতে পারত, যুদ্ধের সমস্ত ক্ষতিপূরণ চাইতে পারত, তা-ও চায় নি। আমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মহত্ত্বের পরিচয় হবে।
আমাদের রাজকোষ শূন্য। ওসব মাথা থেকে দূর করো। আগে ভালোয় ভালোয় পার হয়ে যেতে দাও। সৈন্যদের ভরণপোষণই এখন জরুরি। ওরা যাতে বিদ্রোহ না করে, সেদিকে তোমরা গভীর মনোযোগ রাখো। যা বলছিলে ফিলেকাস, বলে যাও।
ফিলেকাস বললেন, একসঙ্গে সব সৈন্য প্রত্যাবর্তন করলে নানা বিপত্তি উপস্থিত হতে পারে। একত্রে থাকতে গেলে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে এবং তা দমন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বিভিন্ন দুর্গ ও শিবির থেকে দু-চারটি বের হয়ে গেলে এক রেজিমেন্ট থেকে অন্য রেজিমেন্টের বেশ দূরত্ব থাকবে। কোনো রেজিমেন্টে অসন্তোষ দেখা দিলে অন্যগুলো দিয়ে তাদের দমন করা যাবে।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা, বললেন সম্রাট।
ফিলেকাস আবার বললেন, যুদ্ধজয়ের পর সব সৈন্যের কাছেই ধনসম্পদ থাকে। তখন এরা থাকে শান্ত এবং লুণ্ঠিত সম্পদ রক্ষায় ব্যস্ত। এখন অবস্থা ঠিক তার বিপরীত। তাই ধনসম্পদের জন্য গ্রামগুলোতে হানা দিতে পারে। আমাদের কঠোরভাবে তাদের নিবৃত্ত করতে হবে। তাই প্রতি রেজিমেন্টেই বিশ্বস্ত একটা ইউনিট থাকবে, যারা এদের প্রতিরোধ করবে।
ভালো পরামর্শ। আর কিছু বলবে?
না। জেনারেল কিউকেকাস এবারে চাইলে তাঁর পরামর্শ দিতে পারেন।
আমার পরামর্শ গ্রহণ করা হয় না, তাই কোনো পরামর্শ নেই।
আহা, অভিমান করছ কেন? মহামান্য সম্রাট সব সময় তোমার মঙ্গল চান।
নেই, আমার পরামর্শ নেই।
সম্রাট বললেন, বেশ। আমার একটা নির্বাচন আছে, তোমরা এখানে মতামত দাও। আমি ঠিক করেছি, কর্নেলিয়ার আগে শর্তে উল্লেখ করা দূত চন্দ্রগুপ্তের দরবারে যাবে।
আগে কেন যাবে, মহামান্য সম্রাট?
যাবে পরিস্থিতি বোঝার জন্য। আর দেখবে প্রিন্সেসের থাকার মতো প্রাসাদ এবং ব্যবস্থা আছে কি না?
কিউকেকাস আগের কথার রেশ ধরে বললেন, মানছি আশঙ্কা আছে, আশঙ্কার সব বিষয় চুক্তি মেনে চলে না। আপনি জানেন সে চন্দ্রগুপ্তকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা নিয়ে থর মরুভূমিতে থাকলে অসুবিধা কোথায়?
ফিলেকাস, ওকে বোঝাও, ও যা বলছে, নিতান্তই তা ছেলেমানুষি। যে লোকটিকে আমি ঠিক করেছি, তাকে পাঠাও।
কে? কে যাবে সেখানে
নাম মেগাস্থিনিস।
কোথায় থাকে সে? কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না।
তোমাদের চেনার কথা নয়। টলেমির নৌকমান্ডার থাকতে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আরাচোশিয়ার সিবাইরতিয়াস জায়গাটার নাম। খুবই চৌকস মনে হয়েছে।
আপনার নির্বাচন নির্ভুল হবে, এতে সন্দেহ নেই।
ফিলেকাস বিশ্বাস স্থাপন করলেও কিউকেকাস পারছেন না। ভারতবর্ষের জীবনধারা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা না থাকলে তিনি ভালো ফল বয়ে আনতে পারবেন না। এ ছাড়া চন্দ্রগুপ্তের রাজদরবারে গ্রিকদের মর্যাদা কতটা বজায় রাখতে পারবেন, তা-ও দেখতে হবে। আমার পরামর্শ, আপনি এসব বিষয়ে তার একটা সাক্ষাৎকার নিন। প্রয়োজনে কর্নেলিয়াকেও রাখুন।
কিউকেকাস, আমি তাকে উপযুক্ত মনে করে নির্বাচন করে ফেলেছি। এখন ওসবের প্রয়োজন নেই।
তার মতামত নিন। সে অমত করবে না।
কিউকেকাস সংশয়মুক্ত হতে পারছেন না, ভাবলেন, সম্রাট তাহলে আরেকটা সমস্যা তৈরি করতে যাচ্ছেন। ভারতীয় আবহাওয়া ও সংস্কৃতিতে নিজেকে বেশ মানিয়ে নেবে। আর আমার কাছে তাকে কূটনীতিতে দক্ষ মনে হয়েছে, বললেন সেলুকাস।
কিউকেকাস এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চাইলেন না। সৈন্যদের প্রত্যাবর্তনে মনোযোগ দিলেন। তাঁর বাহিনী দোরি অস্ত্রধারী। এখন নতুন করে তাঁকে সারিসাধারীদের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। এরা আর্কিমেডেসের কমান্ডে ছিল। শেষটায় এ নতুন জেনারেলের দূরদর্শিতার অভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং বেশ কিছু সৈন্য আহত ও নিহত হয়। ক্লদিয়াসের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফিলেকাসকে। অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে তাঁর এ দায়িত্ব চতুরশ্বযান, রথসহ পরিবহনের সব দিকে বিস্তৃত। সম্রাটের গজারোহী বাহিনীরও ‘টুআইসি’ করে রাখা হয়েছে তাকে
সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে দুই জেনারেল নতুন দায়িত্ব বুঝে নিয়ে স্ব স্ব সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হতে গেলেন।
সম্রাট সেলুকাস ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। উত্তর দিকটায় সিন্ধু নদ বয়ে চলেছে। দুই কূলে সবুজ ফসল। কৃষকেরা জলসেচ দিচ্ছে। কোথাও কোথাও বাঁশ, বনজ বৃক্ষ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীষ্মকাল। তাই বরফ নেই। এলোমেলো করে দেওয়া বাতাস বইছে। আকাশে মেঘ আছে, উড়ন্ত মেঘ। পাহাড়ের সঙ্গে মিতালি করছে। ভাবলেন, এ জায়গাটা তাঁকে ছেড়ে যেতে হবে। তবে ইচ্ছার বাইরে হলেও একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, কত দিন টিকবে কে জানে। অবাক ব্যাপার, মেয়েটা এ সম্পর্কে রাজি হয়ে গেল। সে কী ভেবেছে, কে জানে। তার মনের ভেতর প্রবেশ করা কঠিন। বুদ্ধিমতী, কিন্তু এ রকম ঝুঁকি কেন নেবে? চন্দ্রগুপ্ত যা বলেছে, তা সত্য হলেও প্রিন্সেস এত বড় ঝুঁকি নিতে পারে না। হেলেন এ সময় সেলুকাসের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আস্তে করে ডাকলেন, বাবা।
সেলুকাস একটু চমকে উঠলেন।
কী ভাবছেন, বাবা?
আচ্ছা, কর্নি, তুমি কি সত্যি সত্যিই চন্দ্রগুপ্তকে পছন্দ করো? নাকি কোনো প্রতিশোধ নিতে চাও?
না, বাবা, প্রতিশোধ না। আপনি জানেন, আমি কোনো গ্রিক ছেলেকে বিয়ে করব না, কেন করব না, তা-ও জানেন। চন্দ্রগুপ্তকে আমি পছন্দ করি। তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু আচার্য ভদ্ৰবাহুকে শ্রদ্ধা করি। মৌর্য রাজদরবারে অবস্থান করার মতো আমার অনুকূল একটা পরিবেশ পেয়ে গেছি। সেখানে আমার ভাগ্যকে আমি নতুনভাবে আবিষ্কার করতে চাই।
অনেক বড় ঝুঁকি আছে, জীবনটা তোমার, কর্নি, বুঝবার বয়সও হয়েছে, তা সত্ত্বেও পিতৃহৃদয় তো, কেমন করে নিশ্চিত থাকি, ইলিয়াড পাঠ করেছ, রাজা প্রায়ামের কথা ভাবো। সন্তানের জন্য কত নতজানু হয়েছেন। শাশ্বত কালের পিতৃহৃদয় বর্ণনা করেছেন অন্ধ কবি হোমার। চোখে দেখতেন না, অন্তরচোখে দেখেছেন।
আপনার দুশ্চিন্তা করার কারণ আছে, বাবা। তারপরও আস্থা রাখতে পারেন।
তোমার জন্য আমি পছন্দ করে রেখেছিলাম জেনারেল আর্কিমেডেসকে, অকালে সে মারা গেল।
একটি ভুল আপনি করেছিলেন, শুধু কম বয়স নয়, পরিণত হওয়ার আগেই তাকে জেনারেল বানিয়েছেন। নিজেকে বুঝতে না পারার জন্যই তার মৃত্যু হলো।
আমি আমার কাজিন সাইরাসকে কী বলব? কী জবাব দেব, হায় জিউস! সে যখন বলবে, আমার পুত্রকে যারা হত্যা করেছে, সেই হন্তাদেরই একজনের সঙ্গে তুমি প্রিন্সেসকে বিয়ে দিয়ে আমার পুত্রের অমর্যাদা করেছ? আমার পুত্রও তো একজন প্রিন্স।
এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই, বাবা, আমার কাছে। তোমরা চাইলেও আর্কিমেডেসকে আমি বিয়ে করতাম না।
এ সময় উপস্থিত হলেন আচার্য ভদ্রবাহু, সঙ্গে তাঁর নিকোমেডেস। আচার্য বললেন, মহামান্য সম্রাট, ভারতবর্ষে ভাগ্য আর নিয়তি বলে দুটো কথা আছে। মানুষ তা অতিক্রম করতে পারে না। একটি ভুলকে কেন্দ্র করে মানুষ মাকড়সার জালে জড়াতে থাকে, ক্রমে আরও ভুলের মধ্যে জড়ায়, কদাচিৎ দু-একজন ছুটতে পারে জাল ছিঁড়ে। বাকিরা পারে না, নির্মম পরিণতি লাভ করে।
সেলুকাস বললেন, গ্রিক পুরাণেও নিয়তির কথা আছে। আমাদের ট্র্যাজেডিগুলো এভাবেই মহাকাব্য আর নাটকে রূপায়িত। কিন্তু আমি নিয়তি মানি না। এসব কবি-নাট্যকারদের কল্পনা, মিথ্যে ট্র্যাজেডি রচনা করে ওরা।
এসব ট্র্যাজেডিতে মানুষকেই তো বড় করা হয়েছে, মহামান্য সম্রাট, নিয়তিকে নয়।
বাবা, আচার্য ভদ্ৰবাহু নিজেও কবি ও লেখক। কত চমৎকার তাঁর স্বপ্ন বর্ণনা, স্বর্গও বোধ হয় তত সুন্দর নয়।
কবিরা কল্পনায় কত কিছু দেখেন, বাস্তবের সত্য বড় কঠিন।
তিনি আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ হলেও অবিশ্বাস্য রকম এক বাস্তববাদী মানুষ। তাই তাঁকে আমার ভালো লাগে।
আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা করি, কর্নেলিয়া। তিনি আমার ভরসা, আমি বিশ্বাস করি, তিনি থাকতে তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না।
মহামান্য সম্রাট, আমি যত দূর বুঝতে পারি, পূর্ব-পশ্চিমে একটা গৌরবজনক সম্পর্ক স্থাপন হতে যাচ্ছে। এ বৈবাহিক সম্পর্ককে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। একে ‘অত্যয় সন্ধি’ চুক্তির মতো মনে হলেও তা কিন্তু নয়। চুক্তি না হলেও এ বিয়ে হতো। কারণ, সম্রাট এবং প্রিন্সেস পরস্পরের কাছে এসেছেন অন্তরের টানে। চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শুধু ইতিহাসের প্রয়োজনে।
ভদ্রবাহুর কথায় দ্বিমত করার সুযোগ নেই। উভয় সম্রাটের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের যে বাসনা, তাতে স্থান করেছে একটা প্রেম। এই প্রেম দেশ-কাল-পাত্রকে অতিক্রম করেছে। সন্ধিচুক্তি আসলেই একটা আনুষ্ঠানিকতামাত্র। সেলুকাস প্রেমকে উপেক্ষা করেছেন, কারণ, সে ধাতুতে তিনি তৈরি নন, বিশ্বাসীও নন। নারীর প্রতি প্রেম, মানবিকবোধ — এসব সাম্রাজ্যবাদে চরম বাধা। তাই তিনি সুযোগ পেলেই আবার আক্রমণ করে ভারতীয় ভূখণ্ড অধিকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে চাণক্য চিন্তিত ছিলেন এ ভেবে যে শুধু প্রেমের জন্য যদি চন্দ্রগুপ্ত ভারতীয় অংশ ছেড়ে দেন, তাহলে তা হবে বড় রকমের রাজনৈতিক ভুল। তিনি চন্দ্রগুপ্তকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সব সময় এদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন। গ্রিকরা তাঁকে বিশ্বাস করে না, এ কথা তিনি জানেন, তাঁর কূটচাল গ্রিকদের সব সময়ই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। আস্থাভাজন হলেও চাণক্যকে চন্দ্রগুপ্তও নির্ভরতার ভেতর রাখেন নি। আচার্য ভদ্রবাহুর ওপর বিশ্বাস রেখেছেন সবাই। শ্রদ্ধা থেকে এ বিশ্বস্ততা। তিনি যা বলেন, স্পষ্টভাবেই বলেন।
সেলুকাস তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বললেন, আমরা পরাজিত না হলে, আচার্য, সবকিছুই অন্য রকম ঘটত। প্রেম-ভালোবাসার মতো মানবিক দুর্বলতাগুলোর আমার কাছে কোনো মূল্য নেই। আমরা গ্রিকরা যোদ্ধা, বাহুবলে সব জয় করতে চাই।
আপনি সমস্ত গ্রিকের কথা বলছেন কেন, বাবা, দু-চারজনের কথা বলুন, যারা হৃদয় ভেঙে দিতে পছন্দ করে। গ্রিকদেরই প্রেমের দেবতা আছে, আবেগের দেবতা আছে, সৌন্দর্যের দেবতা আছে। এ কথা বোধ হয় আপনি ভুলে গেছেন
ভদ্রবাহু দেখলেন, বাবার প্রতি কন্যার শক্ত কথা হয়ে গেছে। তিনি বললেন, একজন শক্তিশালী সম্রাট এবং বাবা কন্যার মঙ্গলের কথা ভেবে এসব বলতেই পারেন। বাবা এবং সম্রাটদের আবেগ প্রশ্রয় দিলে চলে না। মনে করা হয়, এসব তাঁদের দুর্বলতা। শুধু সম্রাট কেন, মন্ত্রীরাও তা-ই মনে করেন। যেমন আমাদের মহামন্ত্রী, বলে তিনি হাসলেন।
সেলুকাস বললেন, তিনি কূটরাজনীতিক বটে কিন্তু বাস্তববাদী মানুষ। শত্রু হলেও আমার পছন্দের মানুষ।
ভদ্রবাহু বললেন, আপনার পছন্দের প্রশংসা করতে হয়। মন্ত্রী হিসেবে তিনি বেশ দক্ষ। ভদ্রবাহুর উদ্দেশ্য ছিল বিয়ের প্রসঙ্গটা পরিবর্তন করা। তিনি সফলও হলেন।