৬২
মোহরাঙ্কিত ডান হাতের অঙ্গুরি দিয়ে সন্ধিচুক্তিতে প্রথম সিলমোহর এঁকে দিলেন সম্রাট সেলুকাস। তা করে ডান বাহুতে কপাল স্থাপন করে আবেগ সংবরণ করলেন। কোনো আবেগ ছাড়াই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তাঁর অঙ্গুরি স্থাপন করে সন্ধিচুক্তি মোহরাঙ্কিত করলেন এবং অঙ্গুরি ডান হাতের মধ্যমায় পরে নিলেন। সুবন্ধুকে উদ্দেশ করে বললেন, সান্ধিবিগ্রহিক নেই, তুমি এ কাজ করবে এবং আমাদেরটি সংরক্ষণ করবে, অপরটি এখনই মহামান্য সম্রাটকে দিয়ে দেবে।
সুবন্ধু তা-ই করলেন। সম্রাট সেলুকাসের পক্ষ থেকে চুক্তির কপি গ্রহণ করলেন জেনারেল কিউকেকাস। গ্রহণকালে অর্থপূর্ণভাবে কর্নেলিয়ার দিকে তাকালেন, যেন তিনি কর্নেলিয়ার বিয়ের দলিল গ্রহণ করছেন।
একজন মৌর্য সেনাপতি মহামন্ত্রী চাণক্যের কানের কাছে এসে বললেন, মধ্যাহ্নভোজ প্রস্তুত, আচার্য।
তুমি যাও। সেনাপতি চলে গেল। তবু মনে হয় রাগে আচার্য তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। হয়তো বিড়বিড়ও করেছেন। কিন্তু তা অস্ফুটে। আজকে মহামন্ত্রীর বেশ কিছু বিষয়ই পছন্দ হয় নি। খারাপ লাগার একটি দুষ্টচক্র আছে। কোনো একটি কারণে মন খারাপ হলে অন্য বিষয়গুলো তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে এবং একসময় বিমর্ষ রূপ ধারণ করে। তাঁর এখন সে অবস্থা। তিনি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন বটে কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এই যে সুবন্ধু, তার ভূমিকাটা ভালো লাগছে না। অবশ্য সন্ধিপত্রের সঙ্গে সুবন্ধুকে তিনিই যুক্ত করেছেন। এর সঙ্গে একে একে যুক্ত হচ্ছে গ্রিকদের ছাড় দেওয়া বিষয়গুলো। ক্রমে সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু।
আচার্য ভদ্রবাহু তা লক্ষ করেছেন। পরিস্থিতিটাও তিনি ভালোই বুঝতে পারেন। তাই মহামন্ত্রী চাণক্যকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে বললেন, আচার্য, সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরের পর তা বাস্তবায়ন এক কঠিন কাজ। আমার মনে হয় এ কঠিন কাজে আপনার হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। আমার বিবেচনায় তিন লক্ষের কাছাকাছি গ্রিক সৈন্যের প্রত্যাবর্তন চাট্টিখানি কথা নয়।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এ কথার সমর্থনে বললেন, ঠিক বলেছেন, আচার্য, মহামন্ত্রীই এখন সব চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত পাত্র।
মহামন্ত্রী চাণক্য মনে মনে ভাবলেন, এতক্ষণ এসব তো মনে হয় নি, মুখে হেসে দিয়ে বললেন, দ্বিপ্রহরের আহার্য গ্রহণের পর এ নিয়ে পরামর্শ হবে। আচার্য ভদ্রবাহুর পরামর্শ, প্রিন্সেসের পরামর্শ মতে এবং আপনাদের নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা সব কর্ম সম্পাদন করব।
কর্নেলিয়া ও চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে প্রায়ই চোখাচোখি হচ্ছে। তাদের চোখের দৃষ্টি যেন কিছু বলছে। চন্দ্রগুপ্ত চোখ নামালেন, কিন্তু মুহূর্তের জন্য। কারণ, বেশিক্ষণ চোখ নামিয়ে রাখা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে, এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে তিনি। এত দিন মনে হয়েছিল অনেক দূরের সুন্দরী হেলেনকে তিনি অন্তরের মধ্যেই দেখবেন। এ মুহূর্তের আগে পর্যন্ত সেভাবেই দেখেছেন। এখন সেভাবে অনুভূতি আর কল্পনায় নয়, হেলেন যে বাস্তবে তাঁর বড় বেশি কাছে এসে গেছে, যেন তিনি স্পর্শ পাচ্ছেন, সুখানুভূতিময় সে স্পর্শ।
হেলেন তাঁকে অভিভূত করেছেন। হেলেন যেন কী বলতে চাইছেন। কী বলবেন তিনি? এখন ভালোবাসার সেতুবন্ধন ছাড়া তাঁদের মধ্যে বাসনার কোনো প্রাচীর নেই। যুদ্ধের বৈরিতা নেই। কিন্তু হেলেন হঠাৎই আবিষ্কার করেন, চন্দ্রগুপ্ত কাছে থেকেও যেন দূরে। এত পথ পাড়ি দেওয়ার পরও যেন পথ ফুরোচ্ছে না।
চন্দ্ৰগুপ্ত এতটা নিমগ্ন যে ভদ্ৰবাহু বলছিলেন আমরা কি মধ্যাহ্নভোজে যাব, তা শুনতে পেলেন না। তখন মহামন্ত্রীকে জোরে বলতে হলো, মহামান্য সম্রাট, মধ্যাহ্নভোজ প্রস্তুত, আমরা কি যেতে পারি?
চন্দ্রগুপ্ত হাসি দিয়ে বললেন, নিশ্চয়ই আচার্য, অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে চলুন।
বন্দীরাও এখন রাজকীয় অতিথি। তা বলার অপেক্ষা রইল না।
মধ্যাহ্নভোজের বিশাল আয়োজন। যুদ্ধক্ষেত্রে এত বড় রাজকীয় ভোজের আয়োজন দেখে সেলুকাস অবাক হলেন। চন্দ্রগুপ্ত বললেন, ভারতীয়রা অতিথিপরায়ণ, তাই এই আয়োজন। ফিলেকাসের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হচ্ছে। কারণ, তাদের যুদ্ধবন্দী অবস্থায় কারাগারে থাকার কথা। সেখানে মিলত বন্দীদের জন্য নির্ধারিত সাধারণ আহার্য। আচার্য ভদ্রবাহু এবার প্রটোকল ভেঙে নিকোমেডেসের পাশে বসলেন। বললেন, সব ঠিক আছে তো?
নিকোমেডেস প্রীত বোধ করল এবং বলল, আচার্য, আপনার উপস্থিতি আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা মনে করছি আমাদের প্রতি কোনো অন্যায় হবে না।
এমনিতেও হবে না। কারণ, সবকিছু আপনাদের অনুকূলে আছে, বলে হাসলেন তিনি।
আপনার সঙ্গে আমি দীর্ঘকাল কথা বলতে চাই, যদি আপনি সম্মত হন।
কেন নয়, সে সুযোগ তো তৈরি হয়েছে।
চাণক্য দূর থেকে মজা করে বললেন, আমরা মনে হয় আচার্যকে হারিয়ে ফেলছি, তিনি পক্ষ ত্যাগ করেছেন।
আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, অবস্থাটা এ রকমই। সম্রাট সেলুকাস তো এই রাজদরবারে থাকবেন না, এখন থেকে প্রিন্সেসকে তাঁর পক্ষে দেখভাল করার দায়িত্ব আমার। ঠিক বলি নি, মহামান্য সম্রাট?
শেষের কথাটা সেলুকাসকে উদ্দেশ করে। তিনি মুগ্ধ হাসি হেসে বললেন, আপনার কথায় আমি খুব ভরসা পাচ্ছি, আচার্য।
খাবার টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি বসেছেন দুই সম্রাট। গ্রিক সম্রাটের দুপাশে দুজন রাজপরিবারের সদস্য। ডান দিকে কর্নেলিয়া, তাঁর পাশে কিউকেকাস, বাম দিকে নিকোমেডেলস, তার পাশে আচার্য ভদ্রবাহু ও ফিলেকাস। মৌর্য সম্রাটের ডান দিকে মহামন্ত্রী চাণক্য, তাঁর পাশে সুবন্ধু এবং বাম দিকে প্রধান সেনাপতি। প্রটোকল মেনে বসলে চন্দ্রগুপ্তের পাশে বসার কথা ছিল আচার্য ভদ্রবাহুর। তবে আজকের এই মধ্যাহ্নভোজ সভায় দুই সম্রাটের কেউ কিংবা আচার্যদ্বয় নন, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছেন কর্নেলিয়া। প্রায় সবার চোখ বা মনোদৃষ্টি তাঁর দিকে।
কর্নেলিয়া মনে মনে ভাবছেন, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের বাম পাশের আসনটিতে সম্রাজ্ঞী হয়ে তাঁর বসবার কথা, কবে বসবেন তিনি। সেখানে বসে আছে যে মানুষটি, তাঁকে খুব বেমানান লাগছে।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবার সবাইকে আহার্য গ্রহণে আহ্বান জানালেন। আহ্বান জানিয়ে তিনি হেলেনের দিকে তাকালেন। অর্থাৎ বাড়তি একটা অনুরোধ তাঁকে। চোখ ফেরাতেই মনে হলো হেলেন সম্পর্কে যা কিছু শুনেছেন, তার চেয়ে বেশি তাঁর মনের কোণে হেলেনের যে নারীমূর্তি অবস্থান করছে, তার সৌন্দর্য প্রতিমা, সর্বাংশে এক ও অনন্য।
সম্রাট সেলুকাস ভেবেছিলেন আহার্য গ্রহণের জন্য আহ্বানের আগে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত কিছু বলবেন এবং তাঁকেও কিছু বলতে হবে। মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন কী বলবেন। তবে তা খুব ভালো বক্তব্য হতো না। যা-ই হোক, বাঁচা গেল।
কিন্তু মহামন্ত্রী চাণক্য হঠাৎ করেই চুক্তিতে উল্লিখিত পাঁচশত হাতি সম্পর্কে কথা তুলে বললেন, মহামান্য সম্রাট সেলুকাস, আপনাকে যে পাঁচশত হস্তী প্রদান করা হবে, সেগুলো দিয়ে কী করা হবে, তা জানতে পারলে কিছু পরামর্শ দেওয়ার ছিল
মহামন্ত্রীর কথায় সবাই তাঁর দিকে তাকালেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত খুব বিরক্ত হলেন। খাওয়ার সময় খোশগল্প করতে হয়। আর মহামন্ত্রী কিনা সিরিয়াস সব বিষয়ের অবতারণা করেন। প্রথমেই তাঁকে থামালেন না। সম্রাট সেলুকাস উটের গ্রীবার মাংসে কামড় দিয়েছিলেন। হাড় থেকে মাংস আলাদা না করেই পাত্রে রেখে বললেন, হস্তী তো যুদ্ধবিগ্রহেই ব্যবহার করার কথা। তার বাইরেও ব্যবহৃত হলে বলুন আপনার পরামর্শ কী?
তাহলে শুনুন, কার্যকলাপ অনুযায়ী হাতিরা চার ভাগে বিভাজনযোগ্য। প্রশিক্ষণ নিয়ন্ত্রিত হাতিদের বলা হয় দম্য। যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত বিবেচ্য হাতি হচ্ছে সান্নাহ্য। মানুষ আর ভারবহনকারীরা হচ্ছে উপবাহ্য এবং হন্তারক বা হিংস্র স্বভাবের হাতিরা হচ্ছে ব্যাল।
এসব নাম মুখস্থ রাখতে সময় লাগবে। আপনি বরং যুদ্ধবিগ্রহে ব্যবহারযোগ্য হাতির কথাই বলুন, মহামন্ত্ৰী।
যুদ্ধের জন্য সান্নাহ্য প্রকৃতির হাতিদের সাত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হয়। যেমন, বলে আচার্য এদিক-সেদিক তাকালেন, পরে বললেন, দেহ ঝুঁকিয়ে প্রাচীরভাঙা বা প্রতিবন্ধকতা উপড়ে ফেলা, খানাখন্দ অতিক্রম, ঋজু-বৃত্তাকার-গোমূত্রিকা চলাচল।
এই তো বিপদে ফেললেন, বললেন সেলুকাস। সবাই এ কথা শুনে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন। হাসতে গিয়ে জেনারেল কিউকেকাসের নাকে-মুখে উঠে গেল। আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, জলপান করুন, জেনারেল।
চাণক্য বললেন, বধাবধ প্রশিক্ষণ সম্পর্কে শুনবার আগেই জেনারেল সমস্যায় পড়ে গেলেন?
ফিলেকাস বললেন, আপনি বলুন, মহামন্ত্রী, সব ঠিক হয়ে যাবে। লাউডিস বোধ হয় নাম নিয়েছেন।
লাউডিস কে, প্রশ্ন করলেন মহামন্ত্রী। হেলেন বললেন, আমার বোন। বলুন আপনি, আমরা শুনছি।
হাতি শুঁড়, দাঁত, পা বা শরীর দিয়ে আঘাত করে কীভাবে শত্রুসৈন্য বা পশু হত্যা করতে হয়, তার কৌশল জানা। তারপর আছে হস্তীর সঙ্গে হস্তীর যুদ্ধ, প্রাচীর, প্রাসাদ, তোরণ ও অন্যান্য স্থাপনা ধ্বংস এবং সাংগ্রামিক যুদ্ধ প্রশিক্ষণ।
চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আচার্য, আহার্য গ্রহণে ব্যত্যয় ঘটছে, আপনাকে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ভার দেওয়া হবে। আমাদের আহার্য গ্রহণ করতে দিন।
প্রশিক্ষক আছে এর জন্য। আমি শুধু ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারণা দিতে চাচ্ছিলাম।
সেলুকাস বললেন, ধন্যবাদ আপনাকে।
এরা দুজনই সিরিয়াস প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু গুরুজন বলে কেউই মজা করছে না তাদের কথায়। শুধু ভদ্রবাহু চাণক্যের সঙ্গে মজা করতে ছাড়েন না। নতুন সম্পর্কের কারণে সেলুকাসও এখন তাঁর কৌতুকসীমায় এসে গেছেন। তাই বললেন, আচার্য, এখন প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল গ্রিকদের কীভাবে ভারতীয় আহার্য গ্রহণ করতে হবে, এ বিষয়ে। আপনার খাবার টেবিলে হাতিদের নিয়ে এলেন। ভাগ্যিস বাস্তবের প্রশিক্ষণ নয়, না হলে হাতি এ ভোজটাকেই পণ্ড করে দিত।
চাণক্যও কম যান না। বললেন, তাহলে ওদের লক্ষ্য হতেন আপনি। হাতিদের ঘাসপাতা তো আপনি সাবাড় করছেন, আমরা নই।
এ কথা শুনে প্রায় সবাই উচ্চ স্বরে হেসে দিলেন। হাসলেন না হেলেন ও নিকোমেডেস। চন্দ্রগুপ্ত তা লক্ষ করলেন। বললেন, আমার আধ্যাত্মিক গুরু এমন এক মজাদার মানুষ, তাঁকে নিয়ে মজা করাটাও তিনি পছন্দ করেন।
তা শুনে হেলেন বিনয়ের ভাব নিয়ে চন্দ্রগুপ্তের দিকে তাকালেন। তার অর্থ, তাঁর সামনে ভদ্রবাহুকে নিয়ে কেউ মজা করুক, তা তিনি চান না।