৬১
দুর্গটায় যখন সন্ধিচুক্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বাইরে তখন সৈনিকদের মধ্যে চলছে নানা কৌতূহল। ভেতরে কী হচ্ছে, এরা কেউ জানে না। সেলুসিড সৈন্যরা তাদের ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত। আরজিরেসপাইড, অর্থাৎ সিলভার শিল্ড আর্মির সদস্য ডায়াডোটাস। স্থায়ী সৈনিক। গ্রিকরা এত সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করায় উদ্ভ্রান্ত। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। সহযোদ্ধা ডেফনেকাসকে উদ্দেশ করে শ্লেষের সঙ্গে বলল, ফ্যালানক্স ফরমেশন, থু, এই সারিসা দিয়ে নিজেকে বিদ্ধ করতে ইচ্ছা হচ্ছে। বাবারা কেন যে মিলিটারি সেটেলার হতে গেল।
সহযোদ্ধাটির তখন কিছুই ভালো লাগছিল না। সে বিরক্ত। বলল, সেলুসিড সাম্রাজ্যের পতন হলেও বাপের বন্দোবস্তী পাওয়া জায়গায় বসে বসে খেয়ো, সিলভার শিল্ড। এখন অস্থির হয়ো না, জমিদারের ছেলে।
এ সামান্য জমিদারি নিয়ে তোমার স্বস্তি আছে, আমার নেই।
আরেক সহযোদ্ধা বিদ্রূপের হাসি হেসে বলল, আগে নিজের মাথাটা নিয়ে ভাবো। ভারতীয়রা মানুষের মাংস খায়। ওরা এক এক করে সবার মাথা চিবিয়ে খাবে। আমরা তিন লাখ। ওরা ছয় লাখ। দুজনের ভাগে একজন। আর পাবলিককে ভাগ দিলে মাংসখণ্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যাবে।
এখন মজা করার সময় নয়, ব্রুটাস। বলল পাশের আরেকজন সৈনিক। সে কাঁধে সারিসা নিয়ে তিন মাথাওয়ালার মতো বসে আছে। পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করো। স্ত্রী-পুত্রের কথা ভাবো। আমার স্ত্রী-সন্তানেরা নিশ্চয়ই এ সময় দুপুরের খাবার খাচ্ছে। আর আমার কথা ভাবছে। বলাবলি করছে, যুদ্ধ জয় করে কার জন্য কী নিয়ে ফিরছি আমি। হায় ভাগ্য!
ব্রুটাস বলল, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে আমি পরাজিত ও অক্ষত। সৈনিক হয় জয়ী হবে, না হয় যুদ্ধ করে মরবে। পরাজিতের মাংস শকুনে খাবে, মানুষে না। কমান্ডারকে বলো আমরা অবরোধের জাল ছিন্ন করে যুদ্ধ করব।
বয়স কম তো, বুঝতে পারছ না। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে দেবতা জিউসের কাছে প্রার্থনা করো সন্ধিটা যেন মাথাটা রক্ষা করে।
সন্ধি? কিসের সন্ধি?
মৌর্যদের সঙ্গে সন্ধি হচ্ছে আমাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার। ভারত ছেড়ে যাব আমরা। সেলুসিয়ায় যাব। আমি মেসোপটেমিয়ায় যাব। সেখানে আমার বাবার জমিদারি।
যুদ্ধ শেষ হয় নি, জনাব। মৌর্যদের সঙ্গে সন্ধি তো এন্টিগোনাস রয়ে গেছে। জেনারেল মোলন পথ আগলে রাখবেন। যেতে দেবেন না। তবু এ সিন্ধু এলাকায় এক দিনও না।
কয়েকজনের মুন্ডুপাত করে গেলে হতো না।
কী যে আবদার করছ তুমি, যেন খাওয়াদাওয়া করতে সাধছ। যা-ই বলো, যুদ্ধটা আর ভালো লাগছে না। পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়া দরকার।
খালি হাতে যাবে? আমার সে চিন্তা নেই। সংসারে কেউ নেই। খালি হাত সব সময়ই আমার সঙ্গে যায়।
যুদ্ধজয়ের পরবর্তীকালে নিজের ভাগের ধনসম্পদ দিয়ে কী করো?
গরিব-দুঃখীদের দিয়ে দিই।
কিছু কিছু জমাও, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। আর এখন তো সমস্যায় পড়ে যেতে পারো। ধরো তোমাকে ছাঁটাই করে দিল। অনিয়মিত সৈন্যদের ওই এক দুরবস্থা।
আমি এ নিয়ে ভাবছি না। আমি ভাবছি, তাহলে গ্রিকরা মাথা নত করল? বড় বাজে অভিজ্ঞতা। চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে।
যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছে। একটিতে পরাজিত হয়েছি, অন্যটিতে জিতব।
কিন্তু ভারতীয়দের কাছে এ পরাজয়। স্বর্গে আলেকজান্ডার খুব কষ্ট পেয়েছেন।
তাদেরই পরাজিত করব একসময়। আমরা না পারলে আমাদেরই হয়ে অন্য কেউ। এ প্রজন্মে না পারলে পরবর্তী প্রজন্মে অথবা আরও পরে ভবিষ্যতে কোনো এক শুভ সময়ে। আমি আমাদের দুঃসময়টা, ক্লেশটা, গ্লানিটা তাদের উৎসর্গ করছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গৌরব বয়ে বেড়ায় আর এরা…? এরা আমাদের ক্ষমা করবে।
মানুষ অর্জন বা গৌরব কাউকে উৎসর্গ করে, আপনি উৎসর্গ করছেন গ্লানি—তা-ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
পলায়নপর আর পরাজিত সৈন্যদের কী দেওয়ার আছে?
একজন সৈন্য দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছিল। তাকে কেন্দ্র করে ছোটখাটো একটা জটলা বেঁধে গেল। ক্রমে জটলাটা বাড়তে থাকল। সবার মধ্যে কৌতূহল। সে এখনো হাঁপাচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। মনে হয় পানি খেতে পারলে ভালো হতো। একটু বিশ্রাম নিয়ে বলল, সন্ধিচুক্তির শর্তে বিয়ে নিয়ে দর-কষাকষি চলছে। প্রিন্সেসকে মৌর্যদের কারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
ব্রুটাস বলল, সম্রাট সেলুকাস তা মানলেন?
আমি জানি না। এখনো হাঁপাচ্ছে সৈনিকটি। তাহলে যুদ্ধ। কোনো আপস নয়, চুক্তি নয়। তৈরি হও সবাই।
ডায়োডোটাস বলল, তুমি তো কমান্ডারের মতো কথা বলছ।
কমান্ডারও তা-ই বলবেন। এতগুলো সৈনিক এত বড় অপমান নিয়ে আত্মসমর্পণ করবে? আসল ঘটনা আমরা জানি না। সে কী বলছে, সূত্রটা কী, নিশ্চিত হওয়া দরকার। তুমি কোথা থেকে জানলে এসব?
মৌর্য সৈন্যরা বলাবলি করছিল।
তাদের কথা তুমি বুঝতে পারলে?
বুঝতে পারি। এ এলাকায় দীর্ঘদিন আছি আমি।
কমান্ডারকে জানিয়েছ?
না।
তাকে আগে জানাও, যাও।
সাহস পাচ্ছি না।
তাহলে অপেক্ষা করো। গুজব রটিয়ো না। সম্রাট না বুঝে চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন না। ব্রুটাসসহ অন্যরা তা মানতে চাইল না। এরা হইচই ও বিশৃঙ্খলা শুরু করে দিল। কর্নেল পদমর্যাদার একজন কমান্ডার ছুটে এল। বলল, থামো তোমরা, কী হয়েছে?
ব্রুটাস প্রায় ক্রুদ্ধ মনোভাব দেখিয়ে বলল, অপমানজনক চুক্তি আমরা মানব না। যুদ্ধেই সব কিছুর মীমাংসা হবে।
তোমাকে অপমানজনক চুক্তির কথা কে বলল?
ব্রুটাস কিছু বলার আগেই বার্তাবাহক সৈনিকটি বৃত্তান্ত বলল।
তোমরা ওসবে একদম কান দেবে না। বিশৃঙ্খল সৈন্যরা তাদের অধিনায়কের কথা শুনল না। তারা অবিরাম চিৎকার, ক্রুদ্ধ, বিকৃত, রক্তাভ মুখচ্ছবি, হাতের কোষমুক্ত উদ্যত তরবারি— সব উপেক্ষা করে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হাতের অস্ত্র, মাথার শিরস্ত্রাণ, পায়ের জুতো—সবকিছু ওপরে ছুড়ে মারতে লাগল। কেউ কেউ নিজের গায়ের পোশাক খুলে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে হইহল্লা এবং নাচানাচি শুরু করে দিল।
জেনারেল সারিকাসের কাছে সংবাদ পৌঁছাতে একটু সময় লাগল। তাঁর ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় হলো। ফলে ঘটনাটা রক্তারক্তিতে পৌছে গেল। পরাজিত সৈন্যদের মধ্যে জমাকৃত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের সলিতায় লাগানো আগুন ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। কর্নেল চাইছিল শক্তি প্রয়োগ করে তাদের দমন করতে। জেনারেল বললেন, না, ধৈর্য ধরো। নিজেদের মধ্যে হানাহানি থামাতে হবে, বাড়াতে কাজ কোরো না। তিনি সৈন্যদের উদ্দেশ করে বললেন, তোমরা যা শুনেছ, তা সত্য নয়, আমার কাছে সংবাদ আছে, আমরা শুধু ভারতীয় অংশ ছাড়ছি, আর কিছু নয়।
বিশৃঙ্খল সৈনিকেরা তাদের নাশকতা থামিয়ে উৎকর্ণ হলো জেনারেলের বক্তব্যে। জেনারেল আবার বললেন, শোনো, কোনো অপমানজনক চুক্তির চাইতে আমরা যুদ্ধকেই বেছে নেব। তোমরা আমার সঙ্গে একমত তো?
জেনারেলের কাছ থেকে এ কথাই শুনতে চাইছিল পদাতিক সৈন্যরা। জেনারেল আরও বললেন, আমাদের একজন সৈন্য বেঁচে থাকলেও যুদ্ধ চলবে। এ যুদ্ধ মর্যাদার লড়াই। তোমরা আমাদের সম্রাটকে আসতে দাও। আর শোনো, এখন আমাদের ঐক্যের প্রয়োজন, যা ঘটে গেছে, তা দুঃখজনক। আহতদের আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। তোমরা যার যার ইউনিটে ফিরে যাও। যেকোনো আদেশের জন্য তৈরি থাকো।
জেনারেল কথা শেষ করে কর্নেলকে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, এপিলেকটোই বাহিনীর কর্নেলকে ডাকার জন্য লোক পাঠাও। জলদি। আর লক্ষ রাখো কেউ যাতে কোনো গুজব না ছড়ায়।
এপিলেকটোই কর্নেল এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্য পাঠালেন। গতি ও গতিবিধির দিক থেকে শ্রেষ্ঠ এ গ্রিক বাহিনী বিশৃঙ্খলার স্থলে দ্রুত পৌঁছে গেল। পার্থিয়ান কায়দায় এরা ইউনিটগুলোকে ঘিরে ফেলল এবং বলল যে আর কোনো বিশৃঙ্খলা নয়। এখন আনুগত্য আর ঐক্য অপরিহার্য।
.
মৌর্য শিবিরে তখন থমথমে ভাব। নতুন চুক্তিটা কী হচ্ছে, এ নিয়ে কৌতূহল সবার মধ্যে। প্ৰায় অর্ধেকটা থর মরুভূমিজুড়ে এদের অবস্থান। উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধু উপকূলস্থ পাহাড়-জঙ্গল সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এরা। পাহাড়-জঙ্গল এলাকার যুদ্ধহস্তীগুলো এ সময়ে জঙ্গলের গাছপালা খেয়ে উদরপূর্তি করছে। এদের মধ্যে স্বস্তির ভাব এবং আয়েশি মাদনা লক্ষ করার মতো।
সৈনিকেরাও দুপুরের খাবার খাচ্ছে ঝটপট। এটা ওয়ার্কিং লাঞ্চ। পেটভরে খাবার সুযোগ নেই, তারপরও যুদ্ধজয়ের আনন্দে উদরপূর্তি করেই খাচ্ছে সবাই। পানির কিছুটা সংকট আছে বটে, যত ছোটাছুটি পানি নিয়ে। যুদ্ধের সময় আহার্য এবং পানীয় জলের জন্য সৈন্যরা সবাই কৃপণতা দেখায়। এখন বেশ উদার। যুদ্ধজয়ই তাদের উদার করে দিয়েছে। আন্ত-ইউনিট কিংবা ইউনিটের ভেতর বৈরীভাব কারও মধ্যে নেই। খাওয়াদাওয়া করে সবাই তৈরি হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষর হলেই উল্লাসে ফেটে পড়বে। ব্যতিক্রম শুধু উত্তর থর। এখানে সর্বশেষ যুদ্ধটা সংঘটিত হয়। জরুরি অবস্থার মতো দুপক্ষই এখানে খুব সতর্ক আছে। গতিবিধি নেই। যে যার জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে। শুধু দুয়েকজন চলাচল করছে লাশের সৎকার ও আহতদের চিকিৎসার জন্য। এ ফাঁকে এরা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজও সেরে নিচ্ছে। মৃতদেহ রয়েছে উভয় পক্ষে। গ্রিক সৈন্যদের মৃতদেহ আলাদা করে রাখা আছে। এগুলো গ্রিকদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। মৌর্য সৈন্যদের মরদেহ সৎকারের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
এসব কাজের মধ্যেও উৎকর্ণ সবাই, কী সংবাদ আসছে দুর্গ থেকে। সেনাপতি সদাচার এখানে সবকিছু দেখভাল ও নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁকে সাহায্য করছে নিম্ন পর্যায়ের দুজন সামরিক কর্মকর্তা এবং কিছু পর্বতসেনা। উত্তর থরে বেষ্টনীর বাইরে যেসব গ্রিক সেনা আটক হয়েছে, এদের অস্ত্রহীন অবস্থায় ঘিরে রেখেছে কিছু মৌর্য সেনা। গ্রিক সেনারা যে যার মতো মুখ ভার করে বসে আছে।
অন্যদিকে ফুটবল খেলায় জয়লাভের জন্য যেন উল্লাস করছে মৌর্য সেনারা। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছে। এ সময় এদেরও দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। খাবারে যুদ্ধজয়ের জন্য প্রচুর ছাগলের মাংস পরিবেশন করা হয়। ছোটখাটো অধিনায়কেরাও এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। দূর থেকে ক্ষুধার্ত গ্রিক সেনারা মৌর্য সেনাদের এই উল্লাস-ভোজ দেখছিল।
নিজেদের বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন বন্দী গ্রিক সেনাদের খাবারের ব্যবস্থা ছিল পরে। তবে মৌর্যদের মতো ছাগলের মাংসের ভূরিভোজ ছিল না। ছাগলের মাংসের ঘ্রাণ এদের ক্ষুধার মাত্রা বাড়িয়ে দিল।
জেনারেল ক্লদিয়াসের কমান্ডে অনিয়মিত কাতুইকোই সৈন্যরাই ছিল সংখ্যায় বেশি। খাবারের সুঘ্রাণে এরা বেপরোয়া হয়ে উঠল। নিয়মিত দু-চারজন সৈন্যের বাধা এবং বেষ্টনী তৈরি করা মৌর্য সৈন্যদের অবরোধ ভেদ করে খাবারের উদ্দেশ্যে আহাররত মৌর্য সৈন্যদের ওপর এরা হামলে পড়ল। একজন কনিষ্ঠ অধিনায়ক একটি ছাগলের হাড় চিবুচ্ছিল চোখ বুজে। হামলার প্রথম ধাক্কাটা সে খেলো। ছিটকে গেল তার হাড়ের টুকরো। সে কাত হয়ে পড়ে গেল। আহাররত মৌর্য সৈন্যরা হুড়মুড় করে দাঁড়িয়ে গেল। বাঁ হাতে তখনো তাদের মাটির বাসন। ব্যাপারটাকে এরা ভাবল খাবার সুযোগ বুঝে গ্রিকরা তাদের আক্রমণ করেছে। লেগে গেল মারামারি। ওদের হাতে অস্ত্র ছিল না, তাদেরও নেই। তাই হাতাহাতি, মল্লযুদ্ধ, গড়াগড়ি এবং প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি। মনে হলো আদিম মানুষের কুস্তিযুদ্ধ এটি।
যারা কুস্তির বাইরে সুযোগ পেল, ঝপাঝপ মাংসের টুকরো কেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করে দিল। দৃশ্যটা দূর থেকে দেখছিলেন সেনাপতি সদাচার। তিনি ছুটে এলেন এবং গ্রিক-ভারতীয় দুই ভাষাতেই যুদ্ধ থামাতে বললেন, সবাই থামল না বটে, তবে বেশির ভাগই মল্লযুদ্ধ ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। খাবার যাদের হাতে ছিল, সেসব গ্রিক ভ্রুক্ষেপহীনভাবে মাংস চিবুতে থাকল। তাদের দেখে সদাচারের হাসি পেল। তিনি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বললেন, আমরা মৈত্রী চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছি। খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি বা মল্লযুদ্ধ এখন অর্থহীন। সবারই খাবারের ব্যবস্থা আছে। চলো ভাগাভাগি করে খাই। যারা লুট করে খাচ্ছিল, এরা তার কথা তেমন আমল দিল না। কয়েকজন ভারতীয় জওয়ান বলল, আমরা জোর করি?
সেনাপতি এবার হেসে দিয়ে বললেন, না, ওদের খেতে দাও, ওরা ক্ষুধার্ত।
কিন্তু ওরা ভাবল দয়া করে দেওয়া খাবারে সম্মান নেই, লুট করে খাওয়ার মধ্যে বীরত্ব নিহিত
খাবার শেষ করে যে যার জায়গায় চলে গেল। এ ঘটনার জন্য গ্রিক কাতুইকোই সৈন্যরা অনুতপ্ত, তা মনে হলো না। নিয়মিত দু-চারজন যেন লজ্জিত। এরা আহার্য গ্রহণে বিরত থাকল। কাড়াকাড়ি করে নিয়ে আসা অতিরিক্ত মাংস এবং হাড্ডি পকেটে পুরে রেখেছিল ওরা। এসবের গন্ধে নিয়মিত সৈন্যদের ক্ষুধা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু এরা নিজেরা বনেদি বিবেচনায় এ কষ্টও হজম করল।
মল্লযুদ্ধের রটনা ছিল খুনোখুনি পর্যায়ের। বেষ্টনীর ভেতর সে খবর পৌছাল। গ্রিকদের একজন কর্নেল সংবাদ পেয়ে বেষ্টনীর বাইরে বন্দী সৈন্যদের কাছে আসতে চাইল। শুধু তাকে একা আসতে অনুমতি দেওয়া হলো। অবস্থাটা এ রকম যে কর্নেল নিজেও বিভ্রান্ত হলো। কর্নেল তাদের সাজা দিতে চেয়েছিল। আর সেটা করতে না পারায় সে এত বেশি দুঃখিত এবং মর্মাহত হলো যে, ভাবল, এটা দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। ওদের শাস্তি না দিয়ে তার মনে হলো ঠিক কাজটিই সে করতে পেরেছে। তার মনে হলো সত্যি সত্যিই কি তা ঘটেছিল। কী কী ঘটেছিল, কী কী ঘটেনি, অথচ ঘটতে পারত—এসবের মধ্যে যেন হারিয়ে গেল। নিয়মিত একরা সৈন্যরা বলতে গিয়েও বাধাপ্রাপ্ত হলো। কর্নেল বাম হাতের আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে হাতটা ওপরে তুলে ধরে তাদের থামাল।