৬
সম্রাটের পছন্দের ধর্ম জৈনধর্ম। তাই স্বাভাবিক কারণেই জৈন মঠে এখন লোকসমাগম অপেক্ষাকৃত বেশি। নগর জৈন মঠের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। এই মঠে অবস্থান করেন আচার্য ভদ্রবাহুস্বামী। তবে সম্রাটের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে রাজপ্রাসাদেও তাঁর একটি আবাসিক কক্ষ রয়েছে। এখানে দুজন সহকারী সার্বক্ষণিকভাবে তাঁকে সহায়তা করেন।
নগর মঠে একসময় তিনি শ্রমণ হিসেবে আসেন। সে সময় মহামুনি গোবর্ধন আচার্য ছিলেন শ্রুতকেবলী। মেধা ও অধ্যবসায়ের কারণে এবং গোবর্ধন আচার্যের পছন্দের কারণে সবার কাছে আনুকূল্য পেয়েছেন। একসময় ধ্যান-জ্ঞান ও তপস্যায় দিগম্বর মুনি এবং সবার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। আচার্য, স্বামী, শ্রুতকেবলী প্রভৃতি উপাধি লাভ করেন।
মাঝেমধ্যে পেছনে ফিরে তাকান। পুণ্ড্রবর্ধন তখন তাঁর শৈশবস্মৃতিতে হামাগুড়ি দেয়। কৈশোর উন্মুক্ত মাঠে দৌড়ায়। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর কৃষ্টির মধ্যে জন্ম নিয়ে শৈশব-কৈশোর কেটেছে। বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে সাত বছর বয়স পর্যন্ত কেটেছে।
জৈনধর্মের পরিবেশ ও শিক্ষা ভিন্ন রকম। শ্রমণ ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর জৈন নীতি- অহিংসা, অন-একান্তবাদ, অপরিগ্রহ প্রভৃতি রপ্ত করতে হয়েছে। সত্য-অসত্য, ব্রহ্মচারিত্ব, ব্যক্তিগত শৃঙ্খলার জীবনাচার, খাদ্যাভ্যাস, উপবাস—এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। উপাসনা করেছেন আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের জন্য, বস্তুগত কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়। আত্মার মুক্তির জন্য ধ্যান, নামোকার, মন্ত্র উচ্চারণ, মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছে।
প্রথম দিনেই বলা হয়েছে জৈন শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘জিনা’ থেকে। তার অর্থ বিজয়ী। কার বিরুদ্ধে বিজয়? তাহলে একটা যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে নিজের বিরুদ্ধেই। ভেতরে যেসব রিপু বাস করে—অতৃপ্ত বাসনা, ক্রোধ, গর্ব, লোভ—এসবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। সে যুদ্ধেই বিজয়ী হতে হবে। বিজয় লাভ করে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই—তার চেয়ে বড় কাজ তৈরি করতে হবে অন্তরে অন্তরে আধ্যাত্মিক সম্পর্কের সেতু। এ কাজে স্বার্থপরতা নয়, পরার্থপরতার পরিচয়ই মুখ্য। পঞ্চকল্যাণকের এটি মাত্র একটি।
রাজপ্রাসাদে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবছিলেন ভদ্রবাহু। এ সময় আচার্য চাণক্য এসে উপস্থিত হলেন। মাঝেমধ্যে এখানেই আসেন চাণক্য। দুই মেরুর দুই আচার্যের মধ্যে ভাবটা কম নয়। ভদ্রবাহুর জীবনযাপন, সৌন্দর্যবোধ তাঁর ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে জৈন কল্পসূত্রের শ্লোক শোনেন তাঁর মুখ থেকে। অসাধারণ আবৃত্তি করেন তিনি। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর আচার্যের। শুনে চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
কুশলাদি জানার পর চাণক্য বললেন, আচার্য কল্পসূত্রের নতুন কী লিখেছেন?
ভদ্রবাহু হেসে দিয়ে বললেন, জানেন, যখন কল্পসূত্রের শ্লোক রচনা করি, আমার সামনে কারও কথা মনেই আসে না। আজ মহাবীরের তৃতীয় ভাষণের কতগুলো শ্লোক সম্পন্ন করেছি, শুনবেন?
অবশ্যই, বলে নড়েচড়ে বসলেন চাণক্য। ভদ্রবাহু কল্পসূত্র থেকে পাঠ করতে শুরু করলেন। সংস্কৃত শ্লোকের বাংলা গদ্য অনুবাদ এ রকম:
‘অতঃপর তিনি (মহাবীরের মা রানি ত্রিশূলা) একটি সরোবর দেখতে পেলেন, পদ্মের সরোবর। জলপদ্ম ফুটে আছে অপরূপ সৌন্দর্যে। ভোরের সূর্যালোকে পদ্ম ফোটার সুবাস চারদিকে। হলদেটে জল। পদ্মের তীব্র গন্ধে মাতাল জলপতঙ্গেরা উড়ে আসছে সঙ্গিনীর খোঁজে। মধু সংগ্রহের জন্য ওরা ইতিমধ্যেই এসে গেছে। আহা, বেসামাল পতঙ্গেরা জলের কাছে যেতেই শিকারি দুরন্ত মৎস্যগুলো ধরে খেয়ে ফেলছে তাদের। বেরসিক মৎস্যকুল। তারপরও মাতাল পুরুষ মৌমাছি এবং তাদের উৎফুল্ল সঙ্গীগণ পদ্মের পাপড়িতে বসে গভীর প্রেমের চুম্বনে মধু পান করছে।
সরোবরটা বেশ বড়সড়। গৌরবময় সৌন্দর্য ছড়িয়ে ফুটে থাকা নানা রঙের পদ্মগুলোর নিচে জোড়ায় জোড়ায় রাজহাঁস, সারস, কাঁকড়াবক, ডাহুকসহ অজস্র কামাতুর পাখি একটি আরেকটিকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের ডানার ঝাপটায় পদ্মপাপড়িতে জলফোঁটা পড়ে মুক্তোর মতো ঝলমল করছে। আহা, কী সুন্দর!
এটা এমনই এক দৃশ্য, দারুণ মনোগ্রাহী। মন ভরে ওঠে, চক্ষু জুড়িয়ে যায় (জেকোবির ইংরেজি থেকে অনূদিত)।
আবৃত্তি করে ভদ্রবাহু চাণক্যের দিকে তাকালেন। চাণক্য উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, চমৎকার, আচার্য! মানুষ ভাববে এটি একটি ধর্মসূত্র। অথচ কী রসময় উপস্থাপনা, প্রাণময় বর্ণনা। প্রাকৃতিক দৃশ্য বর্ণনায় এ শ্লোকগুলোর তুলনা হয় না। ভক্তিভাজন তাপস মহাবীরের মাতা ক্ষত্রিয়াণী ত্রিশূলা পিতা রাজা ক্ষত্রিয় সিদ্ধার্থের কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করছেন কী চমৎকার কাব্যময় ভাষায়।
চাণক্যের জন্ম ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি তক্ষশীলায় আচার্য ছিলেন ব্রাহ্মণ পরিচয়ে। অর্থশাস্ত্রে তাই বেদস্তুতি যত্রতত্র। কিন্তু তিনি কিছুকাল হলো আজীবিক ধর্মে বিশ্বাসী। মগধের রাজা ধন নন্দের নিমন্ত্রণে অসম্মানিত হয়ে আজীবিকের ছদ্মবেশে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন। সম্ভবত সেই থেকে এই ধর্মের প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়ে থাকবে, থাকবে কৃতজ্ঞতাবোধও।
আজীবিক কৃচ্ছ্রব্রতী, নাস্তিক, ব্রাহ্মণ্যবিরোধী হতাশাপ্রবণ এক ধর্মসম্প্রদায়—যাদের সঙ্গে জৈনধর্মের দূরসম্পর্ক রয়েছে। এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গোশালা (৪৮৪ খ্রি.পূ.) জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের বন্ধু ছিলেন। শ্রমণ আন্দোলন থেকে এ ধর্মের জন্ম। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম। এরা পক্ষত্যাগী লোক। একসময় আজীবিক ধর্মদর্শনের লিপি ছিল। এখন পাওয়া যায় না। তাদের দার্শনিক তত্ত্বগুলো তাদের মূল সূত্র থেকে নয়, দ্বিতীয় পক্ষের সূত্র থেকে পাওয়া বৌদ্ধ ও জৈনসূত্রগুলো আজীবিক সূত্রের সন্ধান দিচ্ছে। পণ্ডিতদের মধ্যে সংশয়, আসলে কি আজীবিক ধর্মের দর্শন অক্ষত বা নিষ্কলুষভাবে পাওয়া গেছে? বৌদ্ধ ও জৈনসূত্রগুলো আজীবিক ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই তাদের এ সংশয় অমূলক নয়। অবশ্য চাণক্যের সময় আজীবিক ধর্মের মূল সূত্রগুলো না থাকার কথা নয়। চাণক্য ‘অর্থশাস্ত্র’ লিখেছেন কৌটিল্য নামের আড়ালে, ‘চাণক্যনীতি’ সংকলন করেছেন স্বনামেই। কিন্তু আজীবিক ধর্ম বিষয়ে লিখেছেন বলে কোথাও সামান্য নিদর্শন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। ধর্ম বিষয়ে তিনি বরাবরই নিরপেক্ষ থেকেছেন। অথবা তাঁর ধর্মের প্রতি অনুরাগ বা লিপ্ত হওয়ার মাত্রাবোধ ছিল প্রখর। সব বিষয়ে ছিল সমান আগ্রহ ও উদরতা। চৌদ্দ-পনেরো শ বছর পর দুই বাঙালি পণ্ডিত ও মন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র কিংবা ভট্ট ভবদেবের মধ্যে যা ছিল না।
ভদ্রবাহুর চাণক্যকে পছন্দের কারণ সম্ভবত তাঁর দৃষ্টিতে এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি। আর সব বিষয়ে সমান আগ্রহ। অন্য কারণও থাকতে পারে।
একসময় চাণক্য ভদ্রবাহুর কাছে ঘন হয়ে এলেন। বললেন, প্রশাসনিক সংস্কার প্রস্তাবটা দেখেছেন?
হ্যাঁ, দেখেছি। সম্রাটের সঙ্গে এ নিয়ে কথাও হয়েছে।
কী বললেন তিনি?
নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন।
আপনি কী বললেন?
আমি বলেছি অনুমোদন করে দিতে। এতে তাঁর শাসন সংহত হবে। আর হ্যাঁ, আপনাদের সামাজিক ঐক্য এবং প্রজাস্বার্থ বিবেচনায় আনতে হবে।
আমিও সে কথাই ভাবছি।
সমস্যা নেই, সমাজ একটা চলমান প্রতিষ্ঠান। নদীর মতো ভাঙবে-গড়বে। এ প্রক্রিয়ায় চালকের ভূমিকা যাতে ভুল পথে পরিচালিত না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, এই যা।
আচার্য, নির্ভার করে দিলেন আপনি।
এই সংস্কারের জন্য আপনি অমর হয়ে যাবেন, আচার্য, আমি নিশ্চিত করে বলে দিলাম।