মৌর্য – ৫৯

৫৯

দূত মারফতই সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত জানতে পারলেন সম্রাট সেলুকাস আত্মসমর্পণ করেছেন। তাঁকে উত্তর থর দুর্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এক দিন আগে এ দুর্গটি মৌর্যদের দখলে আসে। তাই তিনি তাড়াহুড়ো না করে একটি চিরকুটের মাধ্যমে সেনাপতি সদাচারকে জানিয়ে দিয়েছেন বন্দীদের প্রতি যেন ভালো ব্যবহার করা হয় এবং সম্রাট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তিনি অতঃপর চাণক্যকে নিয়ে বসলেন। সমঝোতা স্মারকটিকে আত্মসমর্পণের পর্যায়ে না রেখে একটি সন্ধিচুক্তিতে রূপান্তর করতে বললেন।

চাণক্য পণ্ডিত মানুষ। নানা ধরনের সন্ধিচুক্তির কথা তাঁর মাথায় ঘুরছে। ‘অর্থশাস্ত্রে’ বর্ণিত সন্ধিচুক্তির সঙ্গে এগুলো মিলিয়ে দেখলেন। রাজা বা সম্রাটেরা সমশক্তি বা তার চেয়ে শক্তিমানের সঙ্গে সন্ধি করেন। এ শাস্ত্রে সন্ধিরও রকমফের আছে। দুর্বল রাজারা ধন-সম্পদ ও সৈন্য দিয়ে করেন ‘আত্মামিষ সন্ধি’, সেনাপতি ও রাজকুমারকে শক্তিমান রাজার সেবায় নিযুক্ত করে হয় ‘পুরুষান্তর সন্ধি’, নিজেকে সমর্পণ না করে হয় ‘আত্মরক্ষণ সন্ধি’, পরোক্ষ সেবার জন্য হয় ‘অদৃষ্টপুরুষ সন্ধি’, সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের স্বার্থে হয় ‘পরিক্রয় সন্ধি’, কিস্তিতে দায় পরিশোধ সন্ধি হচ্ছে ‘উপগ্রহ সন্ধি’, কন্যাদান তথা বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ‘অত্যয় সন্ধি’, স্বর্ণের বিনিময়ে ‘সুবর্ণসন্ধি’, তার বিপরীত ‘কপাল সন্ধি’, এ ছাড়া উপহারসামগ্রীর মাধ্যমে সন্ধি হচ্ছে ‘অকৃতচিকীর্ষা সন্ধি’। কিন্তু বন্দী বিদেশি রাজার সঙ্গে সন্ধি কেন? তাঁর সবকিছু লুট করে নিয়ে তাঁকে ফাঁসির দণ্ডে ঝোলানোর পক্ষপাতী চাণক্য। তাই চাণক্য প্রশ্ন করলেন, সম্রাট সেলুকাস বন্দী, তাঁর সঙ্গে সন্ধিচুক্তি কেন? চূড়ান্তভাবে পরাজিত শত্রুর সঙ্গে চুক্তি হওয়ার কথা নয়।

আমাদের ভাষ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না। বিষয়গুলো এক রেখে ভাষায় কিছুটা পরিবর্তন আসবে। ‘অত্যয় সন্ধি’ চুক্তিতে কন্যাদানের সুযোগ আছে।

যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাঁর বিচার হবে না?

না, হবে না। ‘অত্যয় সন্ধি’ সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটায়।

আমাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন, তাঁর ও তাঁর জেনারেলদের শাস্তি হওয়া উচিত।

আচার্য, আপনার কথা ঠিক আছে, তারপরও আমি যা বলেছি, তা-ই করুন, আমাদের পূর্বের সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন হবে না।

সম্রাটের ইচ্ছাতে তা-ই করা হলো।

খসড়া সম্পন্ন করে তিনি চাণক্য, সুবন্ধু ও প্রধান সেনাপতিকে নিয়ে উত্তর থরের যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করতে গেলেন। সবই এখন মৌর্যদের নিয়ন্ত্রণে।

চাণক্য এখনো সন্ধি নিয়ে ভাবিত। তাঁর মনে হলো, ভদ্রবাহু এখানে থাকলে ভালো হতো। তিনি শক্তি পেতেন।

হাতি নয়, ঘোড়ায় চড়ে গেলেন চন্দ্রগুপ্ত। মৌর্য সৈন্যরা তাঁকে স্যালুট করল। গ্রিক সৈন্যরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হাত বাঁধা হয় নি। যদি জানা যেত যে মূল কমান্ডের কমান্ড না মেনে তাদের জেনারেলরা তাদের নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন, তাহলে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হতো। তাদের অবশ্য অস্ত্রহীন অবস্থায় রাখা হয়েছে। সম্রাটের দৃষ্টি তাদের কারও প্রতি নয়, যারা নিহত কিংবা আহত হয়েছে, তাদের প্রতি। সেনাপতি সদাচারের নির্দেশে নিহত ও আহত সৈন্যদের আলাদা করা হচ্ছে। গ্রিক ও মৌর্য আলাদাভাবে রাখা হচ্ছে। ক্ষতিটা বেশি হয়েছে গ্রিকদের। মৌর্যদের ক্ষতি সামান্যই। সারিসার আঘাতে যে কজন মারা গেছে, সম্রাট তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেন। বললেন, বাহাদুর সৈনিক এরা। আচার্য, দেখুন, এদের আঘাতগুলো বুকে, পিঠে নয়। এদের রক্তে সাহসিকতা ও বীরত্বের দুর্বার বহতা।

তাদের উদ্দেশে সামরিক কায়দায় সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সবাই। প্রধান সেনাপতি এবং অন্যরা তাদের অভিবাদন জানালেন। শেষে সম্রাট মন্তব্য করলেন, বড় চমৎকার মৃত্যু। এ মৃত্যুই বীরের কাঙ্ক্ষিত।

গ্রিক সৈন্যদের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়েও সম্মান জানালেন সম্রাট। বললেন, এরা নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য মরেছেন। এই মৃত্যুও মর্যাদার।

প্রচুর গ্রিক সৈন্য বন্দী হয়েছে। মূল থরে যাদের ঘিরে রাখা হয়েছে, তাদের তুলনায় অবশ্য এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। তারপরও সম্রাট এ সংখ্যায় অভিভূত। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ভালো ব্যবহারের জন্য নির্দেশ এবং আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন। গন্তব্য উত্তর থর দুর্গ।

যেতে যেতে অনেক কথাই মনে হলো তাঁর। ভাবলেন, অবশেষে প্রিন্সেসের সঙ্গে কি এখানেই সাক্ষাৎ হবে? যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি কেন আসবেন? সেলুকাস? অনেক আগে দেখেছিলেন, আলেকজান্ডারের সময়ে। কিন্তু কী ভেবেছিলেন, সম্রাট হিসেবে আবার দুজন মুখোমুখি হবেন? অনেক যুদ্ধেই তিনি জয়ী হয়েছেন। এ যুদ্ধজয়ের অনুভূতিটা ভিন্ন রকম, ভিন্নমাত্রার। তাঁর জন্য কোনো বিস্ময় অপেক্ষা করছে কি না, কে জানে? এসব ভাবতে ভাবতে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দুর্গে পৌঁছে গেলেন। একজন হাঁক দিয়ে বলল, সাবধান, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দুর্গে প্রবেশ করছেন।

সম্রাটের দেহরক্ষী ও অপেক্ষমাণ মৌর্য সৈন্যদের মধ্যে তৎপরতা বেড়ে গেল। ছোটাছুটি, হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকি। দুর্গে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সব স্তব্ধ। সেনাপতি সদাচার বিজয়ী সম্রাটকে বরণ করে নিয়ে পাহাড়ের ওপর এ অস্থায়ী দুর্গে প্রবেশ করলেন।

সম্রাট সেলুকাস, কর্নেলিয়া ও নিকোমেডেস একটা কক্ষে অবস্থান করছেন। বাইরে তাঁদের প্রহরা। সম্রাট আসছেন শুনে কর্নেলিয়া আচম্বিতে নিকোমেডেসের দিকে তাকালেন। চোখ বড় বড় করে তাকানোর অর্থটা নিকোমেডেস বোঝে। কর্নেলিয়ার ভেতর নতুন এক মরুঝড় বইতে শুরু করেছে। আজ তিনি তাহলে চন্দ্রগুপ্তের সাক্ষাৎ পাবেন। মনে মনে বললেন, দুর্ভাগ্য আমার, এভাবে দেখা হলো? যেভাবে দেখা হোক, আজ তাঁকে দেখবেন। চক্ষু জুড়াবেন। এটুকুই-বা কম কী? বন্দীর ভাগ্যে যা ঘটার ঘটবে। তার আগে তাঁকে মন ভরে দেখবেন। নিজের ভেতর এত সমারোহ যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। সম্রাট তাঁকে দেখে কী মনে করবেন, এটা কোনো বিষয় নয়, প্রিন্সেস মৃত্যুর আগে তাঁকে অন্তত একবার দেখতে পাচ্ছেন, তা-ই বড় কথা।

সম্রাটের জন্য তাঁর কক্ষই সাজানো ছিল আলাদাভাবে। কিন্তু সম্রাট সরাসরি রাজকীয় বন্দীর কক্ষে চলে গেলেন। তাঁর পেছন পেছন মহামন্ত্রী, সুবন্ধু ও প্রধান সেনাপতি।

সম্রাট সেলুকাস দাঁড়িয়ে সম্রাটকে অভিবাদন জানালেন। কর্নেলিয়া এবং নিকোমেডেসও একইভাবে মাথা নত করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত জানতেন না প্রিন্সেস এখানেই আছেন। তাই খুবই অভিভূত হলেন এবং নিজেকে সামলাতে একটু সময় নিলেন। এ সময় সম্রাট সেলুকাস-কন্যা ও নিকোমেডেসের পরিচয় দিলেন। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত প্রিন্সেসের নাম শুনে মাথা নত করে অভিবাদন জানালেন। মহামন্ত্রী চাণক্য এবং উপস্থিত অন্যেরা অবাক হলেন। তাঁদের সঙ্গে সম্রাট সেলুকাসও।

কথা বললেন চন্দ্রগুপ্তই, যা ঘটে গেছে, এ ঘটনার জন্য আমি বিব্রত, মহামান্য সম্রাট। আমি আশা করেছিলাম আমরা সমঝোতার মাধ্যমে যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণ করব। তাই দূত পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু গ্রিকরা প্রস্তাবের জবাব দিয়েছে আক্রমণ করে।

তার জন্য আমি দুঃখিত, মহামান্য সম্রাট। আমার দুজন ক্ষুব্ধ জেনারেল আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই অগোচরে এ ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছে। আমিও আলোচনার পক্ষপাতী ছিলাম।

কী বলছেন আপনি?

সেনাপতি সদাচার বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমার মনে হয় গ্রিক সম্রাটের কথা সঠিক, কারণ, উত্তর থরের যুদ্ধ তিনিই থামিয়ে নিজে সাদা পতাকা উত্তোলন করে আত্মসমর্পণ করেন।

চন্দ্রগুপ্ত সুবন্ধুর উদ্দেশে বললেন, আমার কক্ষটা প্রস্তুত করতে বলো। আমরা সেখানে কথাবার্তা বলব। দুর্গের প্রধান জানাল, কক্ষ প্রস্তুত আছে, মহামান্য সম্রাট।

বেশ, সেখানেই চলুন, মহামান্য সম্রাট। আপনার সঙ্গে যাদের রাখতে চান, নিয়ে চলুন। চন্দ্রগুপ্তের কথায় তাঁকে অনুসরণ করলেন গ্রিক সম্রাট, কর্নেলিয়া ও নিকোমেডেস। কক্ষে হালকা পানাহারের ব্যবস্থা করা আছে। চন্দ্রগুপ্ত তাঁদের আপ্যায়নের আহ্বান জানালেন।

কর্নেলিয়া দেবতা জিউসের কথা স্মরণ করে মনে মনে বলছেন, যেন মৌর্য সম্রাট এমন কিছু না করেন, যাতে তাঁদের অসম্মানিত হতে হয়। এখন এটিই তাঁর চাওয়া। এত যে কথা হচ্ছে, তিনি সামনে থেকেও কোনো কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না।

নাটকীয়ভাবে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আমরা কি আলোচনা শুরু করতে পারি, যদি সম্রাট সদয় সম্মত হন?

বন্দীর সঙ্গে আলোচনা? অবাকই হলেন সেলুকাস। অদ্ভুত এই ভারতীয় মানুষগুলো। বললেন, আমি জানি না আপনি কী আলোচনা করতে চাইছেন। যদি সিরিয়া পর্যন্ত আপনার সাম্রাজ্য বাড়াতে চান, আমার কী বলার থাকতে পারে। তবে আপনার ব্যবহারে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি এখন আপনার বন্দী। আমি আমার মুক্তি চাইব না। তবে প্রিন্সেস ও নিকোমেডেস, এরা যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত নয়, এদের আপনি ছেড়ে দিতে পারেন।

সম্রাট এ কথা শুনে হেসে দিয়ে বললেন, আলোচনার জন্য যদি আপনি আপনার কোনো জেনারেলকে ডাকতে চান, ডাকতে পারেন। দূত মারফত আপনার কাছে যে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম, সে সম্পর্কেই আলোচনা করতে চাই।

সম্রাটের ইচ্ছায় জেনারেল ফিলেকাস ও জেনারেল কিউকেকাসকে ডেকে আনা হলো। চন্দ্রগুপ্ত বললেন, খুবই সুদর্শন ও চৌকস আপনার এ দুই জেনারেল। বসুন আপনারা। আমাদের জন্য আজকের দিনটা ঐতিহাসিক, সন্দেহ নেই। আরও বেশি স্মরণীয় করে রাখতে চাই একটি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে। মহামন্ত্রী, আপনি চুক্তির শর্তগুলো উত্থাপন করুন।

কর্নেলিয়া ভাবলেন, এই বুঝি জিউস আর তাঁর আবেদন শুনছেন না। তাঁর বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। কী শর্ত চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন সম্রাট। তিনি কি মজা করছেন? বন্দীদের সঙ্গে কৌতুক- মজা কোনোটাই ঠিক নয়। বলবেন নাকি একবার?

না, তিনি কিছু বললেন না। চাণক্য সমঝোতা চুক্তির শর্তগুলো উত্থাপন করলেন। প্রথমেই বললেন, মহামান্য সম্রাট, আজকে আমার একটি স্বপ্ন পূর্ণ হলো। আমি আলেকজান্ডারের সময় থেকে চেয়েছিলাম গ্রিকরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করুক, সিন্ধু অঞ্চল আমাদের অধিকারে আসুক।

চন্দ্রগুপ্ত বাধা দিয়ে বললেন, আচার্য, আপনি শর্তগুলো পাঠ করুন।

পাঠ করছি। তার আগে পরাজিত সম্রাট সেলুকাসকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম।

না, আপনার আর কিছু বলার দরকার নেই, আপনি শর্তগুলো শুধু পাঠ করুন।

মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, গ্রিক অধিকৃত ভারতীয় এলাকার রাজ্যগুলো সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে ফেরত দিতে হবে। সৌজন্যস্বরূপ তিনি সম্রাট সেলুকাসকে পাঁচশত যুদ্ধহস্তী উপঢৌকন দেবেন। তা শুনে সেলুকাসের চোখে-মুখে একধরনের আশার আলো প্রতিফলিত হলো, তাহলে কি তাঁর বন্দিত্বের অবসান হতে চলেছে?

চাণক্য এবার তৃতীয় শর্তটি পাঠ করলেন, যেখানে লেখা আছে, প্রিন্সেস হেলেনকে (কর্নেলিয়া) সম্রাটের সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে।

প্রথমে সম্রাট সেলুকাস বুঝতে পারেন নি, মুখে অস্ফুট উচ্চারণ করলেন, হেলেন? পরে তাঁকে বলা হলো, প্রিন্সেস কর্নেলিয়ার কথাই বলা হয়েছে।

কর্নেলিয়ার সঙ্গে সম্রাটের বিয়ে? একি বলছেন মহামন্ত্রী? সেলুকাসের রক্ত যেন মাথায় উঠে গেছে। ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বললেন, না, মহামন্ত্রী, তা হয় না। আপনি অন্য যেকোনো শর্ত দিন। প্রয়োজনে আমাদের মৃত্যুদণ্ড দিন। এমন শর্ত দেবেন না। আমার পুরো সাম্রাজ্যের অধিকার নিয়ে নিন, এ হতে পারে না।

চন্দ্রগুপ্তও উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনি শান্ত হোন, সম্রাট, উত্তেজিত হবেন না। বসুন, বসে শান্ত হয়ে কথা বলুন।

সম্রাট বসলেন। কিন্তু উত্তেজিত। বয়সের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। কর্নেলিয়া এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। এবারে বললেন, আপনি শান্ত হোন, বাবা। এটি একটি শর্ত। আপনি না মানলে তা বাদ যাবে অথবা বন্দীদের প্রতি আপনি যে আচরণ করেছেন, তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। চাণক্যকে উদ্দেশ করে বললেন, আচার্য, আপনি সমঝোতা চুক্তির একটি কপি আমাদের দিন। সম্রাটকে উদ্দেশ করে বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমাদের কিছু সময় দিন। আমরা শর্তগুলো নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে চাই। অনুমতি দিলে অন্য কক্ষে বসে একান্তে আলোচনা করব।

বেশ, তা-ই করুন। আচার্য, তাঁদের খসড়া এক ফর্দ চুক্তিপত্র দিয়ে দিন।

মহামন্ত্রী চাণক্য গ্রিক ও ভারতীয় ভাষায়—আলাদা আলাদাভাবে কপি করে নিয়ে এসেছেন। একটি কপি দিয়ে দিলেন।

সেলুকাস কপি গ্রহণ করতে গিয়ে বললেন, অপমানজনক এই চুক্তি। অপমান।

পূর্বের কক্ষে ফিরে যেতে যেতে কর্নেলিয়া বললেন, বাবা, এটি একটি খসড়া। উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আসুন আমরা ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করে ঠিক করি আমাদের কী করা উচিত? জেনারেল সারিকাসকেও ডেকে নিয়ে আসি, কী বলেন?

না, একজন জেনারেল সৈন্যদের সঙ্গে থাক, এরা সাহস পাবে। নিকোমেডেস তুমি চুক্তির শর্তগুলো পাঠ করো। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনবে।

নিকোমেডেস চুক্তির শর্তগুলো একে একে পড়ে গেল। সেলুকাস চোখ বন্ধ করে শুনলেন। প্রথম শর্ত সম্পর্কে সবাই একমত যে ভারতীয় ভূখণ্ডের অধিকার চাওয়া মৌর্যদের যৌক্তিক দাবি এ শর্ত মেনে নেওয়া যায়। দ্বিতীয় শর্ত গ্রিকদের পক্ষে। পাঁচশত যুদ্ধহস্তী দেওয়ার পেছনে মৌর্যদের কোনো ফন্দি আছে কি না, এ নিয়ে কিউকেকাস প্রশ্ন তুললেন।

সেলুকাস বললেন, আমি নিশ্চিত, তৃতীয় শর্তের সঙ্গে এই শর্তের সম্পর্ক রয়েছে। নিকো, তুমি তৃতীয় শর্তটি আবার পাঠ করো।

নিকোমেডেস শর্তটি আবার পাঠ করল। সম্রাট বললেন, এটিই কারণ। ব্রাইভ দিতে চাইছে? এ শর্ত আমি কখনো মানব না। চায় তো মৃত্যুদণ্ড দিক। মানুষ একবারই মরে, বারবার নয়, আমি বারবার মরতে চাই না, মৃত্যুর আগে মৃত্যু আমার কাম্য নয়।

সম্রাটের এমন মনোভাব দেখে কেউ আর এটি নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছে না। কর্নেলিয়া নিকোমেডেসের দিকে তাকালেন। দুজনের মধ্যে ইশারা-ইঙ্গিতে কী যেন বলাবলি হলো। কর্নেলিয়া বললেন, আমরা পারিবারিকভাবে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাই। জেনারেল ফিলেকাস উঠে গেলেন, কিউকেকাস উঠে যাচ্ছিলেন। কর্নেলিয়া বললেন, আপনি আমাদের পরিবারের সদস্য, আপনি বসুন।

কিউকেকাস বসলেন। কর্নেলিয়া আবার বললেন, জেনারেল, আপনি বলুন মৌর্যরা কি আপনাদের সঙ্গে সম্মানহানিকর কোনো ব্যবহার করেছে, সচরাচর যুদ্ধবন্দীদের প্রতি যা করা হয়?

না, করা হয় নি, প্রিন্সেস। আমি কিন্তু অবাক হচ্ছি, কেন হয় নি তা ভেবে।

আপনি কোনো ধারণা করতে পারেন এ ব্যাপারে?

সম্পর্কের প্রস্তাবের কারণেই কি এ রকম ব্যবহার?

নিকোমেডেস বলল, মহামান্য সম্রাট নিজেই সন্দেহ করছিলেন দ্বিতীয় শর্তের সঙ্গে তৃতীয় শর্তের সম্পর্ক রয়েছে।

সম্রাট বললেন, আমি এখনো তা মনে করি। আমরা শুধু একটি শর্ত মানব, ভারতীয় ভূখণ্ড তাদের ফিরিয়ে দিয়ে সেলুসিয়ায় চলে যাব।

সকদিয়ানা (মিসর) ও সিরিয়া জয় করে গ্রিক বাহিনী কী করেছিল, বাবা? এরা কিন্তু তা করে নি। এরা থরের যুদ্ধ জয়ের পর জোর করে সব গ্রিক নারীদের সুসাওয়াইভস বানিয়ে নেয় নি। চাইলে তক্ষশীলা, সিন্ধু প্রদেশের সর্বত্র যা করেছিলেন গ্রেট আলেকজান্ডার এবং আপনার বাহিনী তার বদলা নিতে পারত। কিন্তু নেয় নি, কোথাও থেকে তাদের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র অভিযোগ আসে নি।

আসে নি তো কী হয়েছে? সবচেয়ে বড় অপরাধ করার জন্য যাদের পরিকল্পনা, ছোটখাটো অপরাধ তারা না করলেই-বা কী। আর করলেই-বা কী? আমরা দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখব, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।

তাহলে কী করতে চান, বাবা?

এ রকম শর্ত আরোপ করা হলে আমরা আমরণ অনশন করব। সারা বিশ্ব জানবে মৌর্যদের অন্যায় দাবির মুখে আমরা নতি স্বীকার করি নি।

সেলুকাসের ন্যায়-অন্যায়বোধ অন্যদের খুশি করতে পারলেও কর্নেলিয়াকে পারে নি। তিনি বললেন, বাবা, অনশন করে মৃত্যুর মধ্যে কোনো গৌরব নেই। যারা জীবনকে ভালোবাসে, এরা স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে না, মৃত্যু সমন্যার সমাধান নয়।

গ্রিক বীরেরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেই পছন্দ করে।

তা করেন, কিন্তু অনশন করে মৃত্যু নয়।

কী বলতে চাও তুমি?

আমি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং তা একান্তে।

তার অর্থ কী?

আমি তাঁর কাছে জানতে চাইব কেন তিনি এ রকম শর্ত দিয়েছেন?

তিনি তোমাকে তার জবাব দেবেন কেন?

জবাব তো আমাকেই দেবেন। কারণ, উদ্ভূত সমস্যাটা আমাকে কেন্দ্র করে।

কথাটার যুক্তি আছে বটে, তারপরও তুমি তাঁর সঙ্গে এখনই সাক্ষাৎ করো, তা আমি চাই না।

বাবা, অনুরোধ করছি, অবস্থাটা আমাকে বুঝতে দিন।

বেশ, তুমি একা যাবে না, কিউকেকাস সঙ্গে যাবে।

বাবা, কিউকেকাস নয়। আমি একাই যাব, আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন। তোমাকে সম্রাটের কাছে একা যেতে দিতে পারি না, আমি ভারতীয়দের বিশ্বাস করি না। তুমি নিকোমেডেসকে সঙ্গে নিয়ে যাও।

বেশ, তা-ই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *