৫৮
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও মহামন্ত্রী চাণক্য সেলুসিড আর্মির আত্মসমর্পণের শর্তসংবলিত যে সন্ধি দলিলের খসড়া তৈরি করেছেন, সুবন্ধু তা পড়ে শোনাচ্ছেন। উদ্দেশ্য দলিলটির অধিকতর পরিমার্জনা ও কার্যকারিতায় শাণ দেওয়া। দলিলটি এ রকম :
ভূমিকা : মৌর্য বাহিনীর সঙ্গে গ্রিক বাহিনীর দুই বছরব্যাপী যুদ্ধের শেষ অঙ্ক সমাপ্ত হতে চলেছে। এ যুদ্ধটা ছিল দখলদার বাহিনীকে উচ্ছেদের যুদ্ধ। মৌর্য বাহিনীর জন্য অনিবার্য এক যুদ্ধ। এ যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নোক্ত সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হলো :
শর্ত ১ : যেহেতু গ্রিক বাহিনী সম্রাট আলেকজান্ডারের সময় থেকে সিন্ধু অববাহিকার রাজ্যসমূহ দখল করে রেখেছে, মহামান্য সম্রাট সেলুকাস সেসব রাজ্য, অর্থাৎ হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে এবং পূর্বে সমস্ত বিজিত রাজ্য মহামান্য মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে ফেরত দেবেন। দখলীয় এলাকা হতে এখনই গ্রিক সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে।
শর্ত ২: গ্রিক বাহিনী স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করায় মৌর্য সম্রাটের হস্তীবাহিনী হতে তিনশত প্রশিক্ষিত রাজকীয় হস্তী উপহারস্বরূপ গ্রিক সম্রাটকে প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। এ উপহার গ্রিকদের সঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বাড়াবে।
শর্ত ৩ : গ্রিকদের সঙ্গে আন্তরিক ও পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে মহামান্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্রাট সেলুকাস-কন্যা কর্নেলিয়ার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। উভয় পক্ষের সম্মতিতে রাজকীয়ভাবে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। বিয়ের স্থান ও সময় উভয় পক্ষ আলোচনা করে স্থির করবেন। নিচে উভয় সম্রাটের স্বাক্ষর থাকবে। সমঝোতা স্মারক শেষ করে বললেন সুবন্ধু।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বললেন, শর্তগুলো ঠিক আছে। শুধু হস্তীর সংখ্যা তিন শ থেকে পাঁচ শ করে দাও। আমার দেওয়া উপহার তো কম হতে পারে না, কী বলেন, আচার্য?
চাণক্য মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে। তাঁর কণ্ঠস্বরে মনে হলো না তিনি কথাটা অন্তর থেকে বলেছেন।
সুবন্ধু বললেন, মহামান্য সম্রাট, এ শর্তগুলো কি গ্রিকরা মানবে বলে মনে হয়?
সুবন্ধুর কথা শুনে সম্রাট হাসলেন। তাঁর কাছে সুবন্ধু এখনো বাচ্চা মানুষ। চাণক্য বললেন, সেলুকাস এখন ফাটা বাঁশে আটকে গেছে, পালানোর পথ নেই, শর্তগুলো না মেনে তার উপায় ও নেই। আমরা বরং রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে পাঁচ শ হাতি উপঢৌকন দেওয়ার কথা বলে মহত্ত ও সৌজন্য প্রকাশ করেছি। তা তাঁর গ্রহণ করা উচিত।
ঠিক এ সময়ই এক দূত হন্তদন্ত হয়ে এসে সম্রাটকে কুর্নিশ করে দাঁড়াল। চাণক্য তাতে বিরক্ত হলেন। বিরক্তিটা দুই কারণে। প্রথমত, এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও সময়ে অনাহূতভাবে দূতের উপস্থিতি। দ্বিতীয়ত, চাণক্যের অহংবোধ। তাঁর নিয়মে একজন দূত সরাসরি সম্রাটের কাছে আসবে কেন? প্রথমে তাঁর কাছে যাবে। প্রয়োজন হলে তিনি দূতকে সম্রাটের কাছে নিয়ে আসবেন। তাই রুষ্ট স্বরে বললেন, বলো, কী জন্য এসেছ?
দূত হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মহামান্য সম্রাট, উত্তর থর এলাকায় প্রতিরক্ষাবেষ্টনী-ব্যূহ ভেদ করে গ্রিক সৈন্যরা আমাদের বাহিনীকে আক্রমণ করেছে। সেখানে তুমুল যুদ্ধ চলছে। কোনো রণভেরি ছাড়াই এ আক্রমণ।
মহামন্ত্রীকে নিয়ে সম্রাট রওনা হয়ে গেলেন উত্তর থরের উদ্দেশে।
আসল ঘটনাটা এই, সমর পরিষদ সভা শেষে ফেরার পথে জেনারেল আর্কিমেডেস এবং জেনারেল ক্লদিয়াসের মধ্যে কথা হয়। জেনারেল আর্কিমেডেস কিউকেকাস ও সম্রাটের কথায় খেপে আছেন। কর্নেলিয়া তাঁকে সমর্থন না দেওয়ায় তাঁর মেজাজ এখন তুঙ্গে। তিনি ক্লদিয়াসকে বললেন, ভাগ্যে যা আছে ঘটবে, আমি ওদের আক্রমণ করে ব্যূহভেদ করবই। আপনি আমাকে সহায়তা দিন।
কিউকেকাসের কথায় আমারও মাথা গরম হয়ে আছে, বললেন ক্লদিয়াস। আমরা আত্মসমর্পণ করব না। জাল কেটে বের হয়ে যাব। রাতটা কোনোভাবে কাটাতে হবে।
যে কথা, সেই কাজ। ভোরের দিকে আর্কিমেডেস তাঁর সারিসা এবং ক্লদিয়াস তাঁর খচ্চর আর গাধা বাহিনী নিয়ে মৌর্য বাহিনীকে আক্রমণ করে বসলেন। তুমুল যুদ্ধ বেধে গেল। উত্তর থরের এই জায়গাটার কাছেই সিন্ধু অববাহিকার দৃষ্টিনন্দন পাহাড় ও ঘন জঙ্গল। আর্কিমেডেস ও ক্লদিয়াসের উদ্দেশ্য, এরা এ বন্ধুর পাবর্ত্য ভূমিতে পালিয়ে যাবেন। যুদ্ধের ভাগ্য কী, তা তাঁদের না ভাবলেও চলবে।
মরুভূমি এলাকায় ভোরে কুয়াশা থাকে। কারণ, দিনে প্রচণ্ড গরম হলেও শেষ রাতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। আক্রমণের আসল সময়টাই বেছে নিয়েছেন এঁরা। তাঁদের হাতে গ্রিক পতাকা নেই। কারণ, এঁরা পতাকার জন্য লড়ছেন না। জেদ ও নিজেদের জীবনের জন্য লড়ছেন।
ঘন কুয়াশায় সকালবেলায় গুল্মের ওপরে জমাট বাঁধা হিমানীকণাগুলো শিশিরে পরিণত হয়েছিল। দূরে পাহাড়ে কুয়াশাগুলোকে দেখাচ্ছিল দুগ্ধশুভ্র ঢেউখেলানো এক সমুদ্রের মতো। সেখান থেকে নেমে আসে হস্তীবাহিনী আর পদাতিক সেনারা। প্রচণ্ড আঘাত করে আর্কিেেডস ও তার সেনাদলকে। কুয়াশায় সারিসা ভালো কাজ করছিল না। আন্দাজ করা কঠিন ছিল মৌর্যদের কত সৈন্য সেখানে ব্যূহ তৈরি করে আছে। এ ছাড়া হাতিরা কিছুই মানছিল না। বন-পাহাড়ে কিংবা জঙ্গলে যাদের জন্ম, বন্য সংস্কৃতি তাদের সহায়। তাই কুয়াশা এদের বাধা নয়, বদান্য।
আকাশ পরিষ্কার। পূর্ব দিকের সূর্যটা যেন লাল এক প্রকাণ্ড বৃত্ত। রক্তের রং ধরে আছে। এদিকে এখানে চলছে রক্তের খেলা। আর্কিমেডেসের সারিসা দূর থেকে আঘাত করেই চলেছে। পদাতিক সৈন্যরা ঢাল দিয়ে তা ফিরিয়ে দিচ্ছে অনায়াসে। দুয়েকটা ঢাল বিচ্যুত হলে বুকে লাগছে ঠিক বর্মের ওপর। তা তরবারি দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে সজোরে আঘাত করে।
ক্লদিয়াসের বাহিনী পেছনে। রাগের চেয়ে তিনি বেশি কৌশলী। দুদিকই এখন রক্ষা করে চলেন। সারিসাধারীরা পেরে উঠছে না ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী দেব-অস্ত্রের সঙ্গে। ক্লদিয়াসের এক যুদ্ধপ্রবণ সৈনিক তাড়া দিচ্ছিল পেছন থেকে। ক্লদিয়াস তাকে প্রায় থামিয়েই দিলেন। কিন্তু ক্লদিয়াস বুঝতে পারেন নি বেষ্টনী ভেদ করে তিনিও বাইরে অবস্থানরত শত্রুসৈন্যের মুখোমুখি। আঘাতের পর আঘাতে যখন তাঁর সৈন্যরা নাস্তানাবুদ, সরবরাহ বিভাগের এই জেনারেল তখন নিরুপায়। চিৎকার করে বলছেন, মারো, এদের মারো, আঘাত করো। এগিয়ে যাও।
সামনে প্রচণ্ড বাধা। আর্কিমেডেসের বাহিনীকে অতিক্রম করে কয়েকটি হাতি ও অশ্বারোহী বাহিনীর কতিপয় সদস্য পাথর ভাঙার মতো মুদগর দিয়ে ভাঙছে সারিসাধারী সৈন্যদের মাথা। কেউ ভূপাতিত, কেউবা রক্তাক্ত মাথা চেপে ধরে পালাতে চাইছে। পলায়নপর সৈন্যদের দেখে ক্লদিয়াস বুঝতে পারছেন না অগ্রসর হবেন, নাকি পালাবেন। পাশাপাশি মনে হলো তাঁর আর্কিমেডেসের কী অবস্থা? হয়তো বেঁচে নেই। এটা ভেবেই ক্লদিয়াস দুর্বল হয়ে পড়লেন, সিদ্ধান্ত নিলেন, সামনে গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু তাঁর সৈন্যদের বললেন, বাছারা, এগিয়ে যাও। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।
একজন সৈন্য বলল, জেনারেল, আপনি কি আমাদের পেছনে আসতে চান? কথা বলতে বলতে হাঁপাচ্ছে সে। মৌর্যদের অশ্বারোহী বাহিনীর একটি তির সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিদ্ধ করল। সে শুধু বহু কষ্টে বলতে পারল, জেনারেল।
অবস্থা খুবই ভয়াবহ। যেসব সৈন্য মাটিতে পড়ে গেছে—আহত, নিহত বা সুস্থ, হাতিগুলো তাদের সবাইকে নৃশংসভাবে পদদলিত করছে। তাই ক্লদিয়াস দৌড়াচ্ছেন, এবার দৌড়ে গিয়ে একেবারে সম্রাট সেলুকাসের সামনে পড়ে গেলেন।
তাহলে তুমি কাপুরুষের মতো দৌড়াচ্ছ? ওই আহম্মকটা কোথায়, যাকে তুমি কুবুদ্ধি দিয়ে এ পথে নামিয়েছ?
সম্রাটের এ কথা শুনে কয়েকবার কেঁপে উঠলেন ক্লদিয়াস। সম্রাটের সঙ্গে থাকা ফিলেকাসকে উদ্দেশ করে বহু কষ্টে বললেন, জেনারেল, আমার কী হলো? আমি পড়ে যাচ্ছি কেন? পা দুটো খাড়া রাখে পারছি না, বলে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন।
সম্রাট সেলুকাস দেখলেন তাঁর জেনারেলের পেছনে পিঠে একটি তির বিদ্ধ হয়ে আছে। শুনেছেন তির অর্জুনের অস্ত্র। সে কথা মনে করতে করতে নিজের হাতেই তিরটি টেনে তুললেন। বললেন, কাপুরুষ! পেছনে তির লেগেছে। বীরের গৌরব ভাগ্যে ছিল না।
সেলুসিড সৈন্যরা, থামো তোমরা, বলে প্রচণ্ড হাঁক ছাড়লেন সেলুকাস। যুদ্ধ বন্ধ, বলে তিনি নিজে সাদা পতাকা হাতে তুলে ধরলেন।
সাদা পতাকা দেখে মৌর্য সৈন্যরা অস্ত্র সংবরণ করল। সম্রাট এগিয়ে এলেন। মৌর্য পক্ষের সেনাপতি সদাচারকে দেখে বললেন, আমি মনে হয় তোমাকে চিনি। আমরা সমঝোতা স্মারক সই করতে প্রস্তুত। ভুল-বোঝাবুঝিতে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। আমাদের এক জেনারেলকে খুঁজে পাচ্ছি না। সে একজন প্রিন্সও।
সম্রাট নিজেই খুঁজছেন তাঁকে। অনেক সৈন্য পড়ে আছে। কারও মাথা নেই, কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও রক্ত ঝরছে, কারও সবকিছুই আছে, প্রাণ নেই। হতাশাগ্রস্ত কয়েকজন সৈন্যকে পাওয়া গেল, যারা যুদ্ধের আগে প্রচুর মদ খেয়েছে। এদের একজন মাতাল অবস্থায় বলল, আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজছেন, মহামান্য সম্রাট। আমি ভালো আছি, নিহত হই নাই। আকাশ দেখছিলাম, আকাশ। অসীম আকাশ। সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে, শান্ত, স্তব্ধ, গম্ভীর, হাত দিয়ে নাগাল পেলাম না। জেনারেল বললেন, সম্রাটের আদেশে খুব ভোরে যুদ্ধে যেতে হবে। রাতে ঘুমাই নি। দেখুন, রাতে পান শেষ না হতেই ভোর হয়ে গেল।
কেন সম্রাট তার এত কথা শুনতে গেলেন, বোঝা গেল না। সামনে গেলেন। নিহতদের বেশির ভাগই হস্তীতে পদদলিত। বড় বীভৎস। একইভাবে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন জেনারেল আর্কিমেডেস। মুখমণ্ডল ঠিক আছে। বুকটা থেঁতলে গেছে। একজন ভারতীয় মৃত সৈন্যের বুকে বিদ্ধ হয়ে আছে তাঁর সারিসা।
সম্রাট সেলুকাসের মদ্যপায়ী সৈনিকটির কথাই মনে হলো, আকাশটা শান্ত, স্তব্ধ, হাতে নাগাল পাওয়া যায় না। সব সুন্দর স্পর্শের বাইরে থাকে। মুখে বললেন, তাদের সামরিক মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সদাচার মাথা নাড়লেন এবং তাঁর সৈন্যদের বললেন, মৃতদেহগুলো আলাদাভাবে সৎকারের ব্যবস্থা করো। আহতদের চিকিৎসা দিতে হবে। তাদের দ্রুত উদ্ধার করে নিয়ে যাও।
সেলুকাসের আত্মসমর্পণের সংবাদ গ্রিক শিবিরে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। সংবাদ শুনে কর্নেলিয়া ছুটে এলেন। আর্কিমেডেসের মৃত্যুসংবাদ তাঁকে খুবই ব্যথিত করল। তাঁর অনেকগুলো স্মৃতি আর্কিমেডেসের সঙ্গে। ঝিলাম প্রমোদপ্রাসাদের কথা খুব মনে পড়ল। ঝিলাম নদীতে নৌবিহারের কথা মনে হলো। আর্কিমেডেসের মৃতদেহ আলাদাভাবে রাখা হয়েছে। কী সুন্দরভাবে ঘুমিয়ে আছেন। কর্নেলিয়া তাঁর পাশে এলেন। হাঁটু গেড়ে বসলেন। আর্কিমেডেসের কপালে হাত রাখলেন। দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এল। চেষ্টা করেও তা গোপন করতে পারলেন না। মনে মনে বললেন, আর্কিমেডেস, কোনো গ্রিককে যদি বিয়ে করতাম, তাহলে তুমি হতে সে ব্যক্তি। আমি আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পারি না। স্বর্গে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। কিন্তু তুমি একি ছেলেমানুষি করলে? নিজের জীবন দিলে? ভালোই করেছ। গ্রিক দেবতারা নিশ্চয়ই তোমার ত্যাগ ও বীরত্বে গর্বিত। আমরাও গর্ববোধ করি, করে যাব। তোমার অতৃপ্ত আত্মা শান্তি পাক। তুমি ঘুমাও আর্কিমেডেস, ঘুমাও, কত শান্ত আর স্বস্তির ঘুম। কী ভাগ্য তোমার!
সম্রাট কাছে এসে সরিয়ে নিলেন তাঁকে। বললেন, প্রিন্স আর্কিমেডেস তাঁর কাজিন। একসঙ্গে বড় হয়েছে। তাই কষ্টটা বেশি। সেনাপতি, চলুন, আমাদের কোথায় যেতে হবে।
সেনাপতি সদাচার তাঁদের একটি দুর্গে নিয়ে চললেন। দুর্গটি অস্থায়ী। সেলুকাসই নির্মাণ করিয়েছিলেন নয় মাস আগে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। তাই এ ব্যবস্থা। থর এলাকায় জনবসতি খুবই কম। তারপরও শত শত মানুষ এসেছে। গ্রিক সম্রাট সেলুকাস আর তাঁর কন্যাকে দেখছে। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের কাছে এঁরা আত্মসমর্পণ করেছেন। তাই চন্দ্রগুপ্তের মঙ্গল কামনা করে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। গ্রিকদের নিন্দা করছে। মৌর্য বাহিনী জনগণকে সামাল দিচ্ছে, যাতে কেউ কাছে না ঘেঁষতে পারে, সে ব্যবস্থাও করছে।
বড় ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে সেলুকাস ও তাঁর সঙ্গীদের। কেউ কথা বলছে না। সেলুকাস নিজে একটি গ্রিক (সেলুসিড) পতাকা বহন করে চলেছেন। তাঁর জেনারেল ফিলেকাস নিতে চেয়েছিলেন, দেন নি। এ পতাকার জন্ম দিয়েছেন তিনি। শেষও দেখতে চান তাঁর হাতে। হয়তো ভাবছেন, এখানেই তাঁর সম্রাটত্ব শেষ। এন্টিওকাস পারলে বাকি সাম্রাজ্য টিকে থাকবে। কর্নেলিয়া আহত হরিণীর মতো। পিতার ভাগ্য জেনে গেছেন। নিজের ভাগ্যটা কী, জানেন না। তাঁকে কি বন্দী অবস্থায় সম্রাটের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে? কী হবে তখন? এ কথা ভাবতে ভাবতে সম্রাটের একদম কাছে চলে এলেন। হাঁটছেন একটি ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে, যা একদিন আগেও তাঁদের অধিকারে ছিল। কিছুক্ষণ আগেও স্বাধীন ছিলেন, এখন নেই। এখন তাঁর কাছে সবই তুচ্ছ ও অর্থহীন মনে হচ্ছে।
ঠিক একই বিষয় ভাবছেন সেলুকাস। সবকিছু অর্থহীন ও তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আত্মসমর্পণ না করলেও পারতেন। সময় নেওয়া যেত। কিন্তু কীভাবে কী হয়ে গেল, বুঝতে পারছেন না। মৃত্যুর চেয়েও খারাপ অবস্থায় আছেন। মহত্ত্বের অর্থহীনতা, বুদ্ধির অতীত জীবনের অর্থহীনতা এবং মৃত্যুর অর্থ যদি জীবিত মানুষের বুদ্ধি ও ব্যাখ্যার অতীত গুরুত্বহীনতা হয়, এখন তাঁর জীবিত থাকার মধ্যে মৃত মানুষের সে অবস্থাকেই দেখতে পাচ্ছেন। বিশাল বাহিনীর যে ভাগ্য তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, এটি বোধ হয় ঠিক হলো না। যুদ্ধ করে এরা এদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারত। সুযোগ হলে ক্ষমা চেয়ে নেবেন। কিন্তু এ অপরাধ অমার্জনীয়। তারা কি ক্ষমা করবে?
এসব ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলেন দুর্গে। এ দুর্গে একসময় তাঁকে ঘিরে থাকত সব রকমের কর্মকাণ্ড। আজও তাঁকে ঘিরে সব কর্মকাণ্ড, কিন্তু চিত্রপট ভিন্ন। সেদিন তিনি আদেশ করতেন, আজ আদেশ শুনছেন। আসবাবগুলো, দুর্গের দেয়াল, পানপাত্র—এসবের যদি ভাষা থাকত, তাহলে এরা আজ অন্য রকম কিছু বলত। সেলুকাস নিজেই প্রশ্ন করলেন, কী বলত?