মৌর্য – ৫৭

৫৭

থর মরুভূমির বালি উত্তপ্ত হচ্ছে বেলা বাড়ার সাথে সাথে। যুদ্ধের উত্তেজনাও বাড়ছে উভয় পক্ষে। সে উত্তেজনা ঘোড়া, হাতি, গাধা, খচ্চর, ষাঁড়—সবকিছুর মধ্যেই। তবে উটের মধ্যে একটা শান্তভাব। জাবর কাটছে নির্লিপ্তভাবে। নানা অস্ত্রের ঝলকানিতেও এরা নির্বিকার।

অধীর অপেক্ষা। আগে আক্রমণটা কে করবে? সৈন্যদের মধ্যে যেমন অস্থিরতা, পশুদের মধ্যেও তাই। ইঙ্গিত পেলেই ছুটে যাবে শত্রুর দিকে। যুদ্ধ একটা খেলাও বটে। মৃত্যুখেলা। ভয়ডরহীন। এ খেলা একবার পেয়ে বসলে সবকিছু ভুলে শুধু তাতেই মত্ত হতে হয়।

থর এলাকায় একটা পাগলা আছে। সে শুধু বাঁশি বাজায়। পাতার বাঁশি। ছেঁড়া কাপড়ের মালকোঁচায় নানা রকম কাঁচা পাতা ভিজিয়ে যত্ন করে রাখে। একটার পর একটা বের করে বাজাতে থাকে। দুটো বাঁশের বাঁশিও আছে। বহু দূর থেকে তার বাঁশির শব্দ শোনা যায়। পানি রাখে সে মাজায় বেঁধে রাখা একটা বাঁশের চোঙায়।

এখন রণভেরি বন্ধ আছে। বাজছে না। দুই পক্ষেরই বাদক দল চুপচাপ আছে। তবে তাদের হাত আর ঠোঁট যেন কোনো বাধা মানতে চাইছে না। তারপরও ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষা। রণভেরিতে সৈন্যদের রক্ত গরম হয়।

পাগলা নিরুর পাতার বাঁশি বেজেই চলেছে। কেমন একটা করুণ সুর। সুরের একটা সর্বজনীনতা আছে। বিশেষ করে এ তপ্ত মরুভূমির উত্তেজনাকর অবস্থায়। কান পেতে সবাই শুনছে এ সুর। কী অদ্ভুত এ বাঁশির সুর। স্বর্গ-মর্ত যেন এক করে ফেলছে।

সেলুকাস তার সৈন্যদের দিকে দৃষ্টি দিলেন। দেখলেন, এরা বিভোর হয়ে আছে বাঁশির সুরে। ভাবলেন, তার ফল কী! মৌর্যরা কোনো ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে না তো? যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসৈন্য ছাড়া অন্য কাউকে হত্যা করা যায় না। এ ছাড়া তাঁর (সেলুকাসের) বংশগত বিশ্বাস আছে, দেবতারা বাঁশিওয়ালা ও অন্যরূপে আবির্ভূত হন ভক্তদের সাহায্য করার জন্য। অবশ্য এ বাঁশিওয়ালা মৌর্যদের পক্ষের দেবতাও হতে পারেন।

দূরে মৌর্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনী দেখা যাচ্ছে। এ বাহিনী নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত তাদের সঙ্গে লড়বেন? গোয়েন্দারা একটা খবর এনেছিল সম্রাট-মন্ত্রী ও সৈন্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। তিনি তা বিশ্বাস করেন নি। তাহলে কি ঘটনা সত্য? না হয় মৌর্যদের বিশাল বাহিনী কোথায়? একদিকে তার সৈন্যরা পাগলের বাঁশির সুরে আকণ্ঠ নিমগ্ন, অন্যদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌর্য বাহিনী। আক্রমণের আদেশ দিয়ে ফেলবেন নাকি?

ঠিক এ সময় দেখলেন নিজের বাহিনীর মধ্যে মৃদু আলোড়ন। কে যেন কয়েকজন সৈন্য পরিবৃত হয়ে সম্রাটের দিকে ছুটে আসছে। ক্রমে ক্রমে কাছে এলে তাকে চিনতে পারলেন। জেনারেল কিউকেকাস। সঙ্গে কর্নেলিয়া ও নিকোমেডেস। জেনারেল কিউকেকাস বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমি যুদ্ধ করতে চাই, আপনি আমার কমান্ড ফিরিয়ে দিন।

সম্রাটের বুঝতে অসুবিধে হলো না কর্নেলিয়া তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে এসেছেন। একজন জেনারেলের মর্যাদা নির্ভর করে যুদ্ধজয় কিংবা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করার মধ্যে, ঘরে বসে থেকে নয়, পুনরায় বললেন কিউকেকাস!

সম্রাট কর্নেলিয়ার দিকে তাকালেন। দেখলেন তাঁর কন্যাও যুদ্ধসাজে এসেছেন। কর্নেলিয়া বললেন, সেলুসিড সাম্রাজ্যের কঠিন সময়ে একজন জেনারেল বসে থাকতে পারেন না। পিতা, আপনি তাঁকে তাঁর দোরি কমান্ডে নিযুক্ত করুন।

সম্রাটের মধ্যে এই জেনারেল সম্পর্কে যে আস্থার অভাব ছিল, তা কেটে যেতে থাকল। এ ছাড়া তিনি ভাবলেন, সারিসা আর দোরি—এ দুই অস্ত্রেই মৌর্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনীকে নিঃশেষ করে দেওয়া সম্ভব। নতুন এ শক্তি যুক্ত হলে মৌর্যদের বিরুদ্ধে প্রথমেই আক্রমণ করতে বাধা নেই। আর এটাই উপযুক্ত সময় শত্রুদের আক্রমণ করে ঘায়েল করে দেওয়ার। তিনি ফিলেকাসকে ডেকে বললেন, জেনারেল, তুমি নিজে গিয়ে কমান্ড বুঝিয়ে দিয়ে এসো। ক্লদিয়াসকে তার বাহিনীর কমান্ডে ফিরে যেতে বলবে। সেখানেই সে ভালো করবে।

জেনারেল ফিলেকাসের সঙ্গে জেনারেল কিউকেকাসকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখে সেলুসিড বাহিনীর মধ্যে আনন্দঘন এক উত্তেজনার ঢেউ খেলে গেল। শুধু বিমর্ষ হতে দেখা গেল জেনারেল আর্কিমেডেসকে, হয়তো ক্লদিয়াসকেও। কিন্তু ক্লদিয়াসকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই। জেনারেল আর্কিমেডেস তা গোপন করতে পারলেন না। সবাই তা লক্ষ করল। কিউকেকাস যেন পুরো ফর্ম নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছেন। তাঁর চোখ-মুখ এবং শরীরের ভাষা সে কথা বলছে।

কমান্ড বুঝিয়ে দিয়ে ফিরে আসতেই জেনারেল ফিলেকাসকে সেলুকাস আক্রমণের আদেশ দিলেন। এ আদেশে ছুটে গেল হাজার হাজার সেলুসিড সৈন্য। সারিসা ও দোরিধারী সহস্র সহস্র পদাতিক সেনা অস্ত্র উঁচিয়ে দৌড়াচ্ছে। পেছনে অশ্ব ও উটের বাহিনী, সম্রাট সেলুকাসও তাদের সঙ্গে আছেন। তেজি একটা অশ্বপৃষ্ঠে তাঁকে ছিয়াত্তর বছরের তরুণ বলে মনে হচ্ছে। মাথায় সুবর্ণ হেলমেট, সুবর্ণ জালি স্কন্ধ অবধি, এক হাতে সারিসা, অন্য হাতে সুবর্ণ ঢাল। বনেদি গ্রিক সেনাদের হেলেনিস্টিক প্লাস সেলুসিড মুড। এপিলেকটোই বাহিনী তাঁর পেছন পেছন। পূর্ব দিকে ধেয়ে আসছেন বলে সূর্যের আলো ঝলমল করছে সুবর্ণ শিরস্ত্রাণে।

রণভেরি বাজছে। তার মধ্যেও নিরু তার বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছে। সুরটা এখন আর করুণ নয়, তারও সুরের পরিবর্তন হয়েছে। বেসুরো, তবে অসুরপুরে যেন সুর উঠেছে, বেসামাল, নিয়ন্ত্রণহীন। থর মরুভূমির ধুলোর রাজ্যে ভীষণ ঝড়। বাতাসটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে বইছে। সেলুকাস আগে বিষয়টা ভাবলেন না কেন, ঝড়ের বালি তাঁর সৈন্যদেরই নাজেহাল করছে। তবে থামছে না তাঁর বাহিনী। ছুটছে তো ছুটছেই। এরা মৌর্য এলাকায় এসে গেছে। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তা-ই চাইছিলেন। চোখে বালি পড়ে বেদিশা গ্রিকরা। মৌর্য বাহিনী এ অবস্থার সুযোগ নিল।

এরা পূর্বপ্রস্তুতিমতো পুরো সেলুসিড বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। মাছের ঝাঁক যেন ঘিরে ফেলা হলো জাল দিয়ে। চারদিক থেকে হাঁকডাক দিয়ে সেলুসিড বাহিনীকে থামিয়ে দেওয়া হলো। জাল ছিন্ন করে বেরোনোর চেষ্টা করবে নাকি চারদিকে যুদ্ধের মুখোমুখি হবে সেলুসিড বাহিনী, এ নিয়ে জেনারেলদের সঙ্গে পরামর্শ শুরু করলেন সম্রাট সেলুকাস। জেনারেলরা ঘটনার আকস্মিকতায় চুপ করে রইলেন।

কর্নেলিয়া বললেন, মৌর্যদের কৌশলের কাছে আমরা বোকা হয়ে গেছি। যুদ্ধ এখনো শেষ হয়ে যায় নি। যুদ্ধে আমরা পরাজয় বরণ করব না। জাল ছিন্ন করে একদিক থেকে বের হওয়ার অর্থ পালিয়ে যাওয়া। এটি কোনো কৌশল হতে পারে না। আমাদের উচিত হবে অমর্যাদার পথ পরিহার করে মুখোমুখি যুদ্ধে তাদের পরাজিত করা।

জেনারেল কিউকেকাস বললেন, মহামান্য সম্রাট, প্রিন্সেসের সঙ্গে আমি একমত। জাল কেটে বের হয়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। যুদ্ধ করে এদের পরাজিত করার পক্ষপাতী আমি। এতেই গ্রিকদের গৌরব নিহিত।

জেনারেল ক্লদিয়াস বললেন, সার্বিক যুদ্ধে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। একদিক দিয়ে বের হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি কম হবে। এখানে আমরা সর্বশক্তি প্রয়োগ করব। ওরা আমাদের আটকে রাখতে পারবে না।

জেনারেল আর্কিমেডেস তাঁকেই সমর্থন করে বললেন, আমাদের ক্লদিয়াসের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। কারণ, ওরা এখন আমাদের আত্মসমর্পণ করতে বলবে। আত্মসমর্পণ না করলে চারদিক থেকে আমাদের কচুকাটা করবে। অথবা হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়ে একটি পথ খুলে দেবে, যাতে করে আমরা বের হতে গেলে একে একে হত্যা অথবা বন্দী করা যায়।

ফিলেকাস কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। সেলুকাস তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সারিকাসকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমার মতামত দাও, ফিলেকাস সবার শেষে বলবে।

সারিকাস বললেন, আমাদের পরিকল্পনায় কোনো ভুল ছিল না। গোয়েন্দা রিপোর্টও ছিল ওরা আগে আক্রমণ করবে। তাদের বিশাল বাহিনীর সংবাদও আমাদের জানা। কিন্তু ওরা যে এভাবে আমাদের ফাঁদে ফেলবে, তা বুঝতে পারি নি। আমার মনে হয় না এখনই ওরা আমাদের আক্রমণ করবে। ওরা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠাবে। সমুদ্রে জেলেরা মাছেদের যখন ঘিরে ফেলে, তখন মাছেরা একত্র হয়ে যায়। এরা মনে করে এই ঐক্য তাদের রক্ষা করবে। প্রাকৃতিক এই উপলব্ধি থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। আমরা প্রশিক্ষিত যোদ্ধা, আমাদের অস্ত্র আছে, কৌশলগত বুদ্ধি ও প্রশিক্ষণ আছে। এখনই তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আত্মঘাতী। আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। আমাদের সঙ্গে পর্যাপ্ত খাদ্য আর পানীয় রয়েছে। তাদের অবরোধ আমাদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না, বলে তিনি সরবরাহ ও লজিস্টিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেনারেল ক্লদিয়াসের দিকে তাকালেন।

ক্লদিয়াস বললেন, আমাদের কিছু রসদ সরবরাহ যান ও পানীয় অবরোধের বাইরে আটকে গেছে।

সারিকাস বললেন, আপনার এখন পরিমাণটা নির্ণয় করা জরুরি, জেনারেল। তাহলে আমরা পরিকল্পনা করতে পারি কত দিনের খাদ্য আমাদের আছে।

ফিলেকাস সম্রাটের দিকে তাকালেন। তিনি এবার কথা বলতে চান।

ফিলেকাস বললেন, রসদের পরিকল্পনার আগে আরও অনেক কিছু ভাববার আছে, জেনারেল সারিকাস। মহামান্য সম্রাট, সবার বক্তব্যের মধ্যেই যুক্তি আছে। তবে কোনটা বেশি যৌক্তিক এ পরিস্থিতিতে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। আমরা যুদ্ধ করতে এসেছি, বিজয় আমাদের লক্ষ্য। ছলে-বলে-কৌশলে আমাদের জয়লাভ করতে হবে। প্রিন্সেস কর্নেলিয়ার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নি, আমরা পরাজিত নই, অবরুদ্ধমাত্র। এখান থেকে বের হওয়ার পথ দুটি, একটি কৌশলের, অপরটি যুদ্ধের। সমরকৌশল ও যুদ্ধজয়ে অতীতে আমরা অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। পরাজয় আমাদের ইতিহাসে নেই। ভবিষ্যতেও থাকবে না। আমরা বীরের জাতি। আমরা যদি এখনই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত না নিই, অপেক্ষা করি, শত্রুরা আমাদের ওপর চড়াও হবে। হয় চারদিক থেকে আক্রমণ করবে অথবা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠাবে। এ অবস্থায় আমাদের উচিত হবে আক্রমণ করা। তবে আক্রমণের লক্ষ্য কী হবে—বিজয় অর্জন, না জাল ছিঁড়ে পলায়ন, তা-ই এখন বিবেচ্য।

এরই মধ্যে মৌর্য পতাকা হাতে একজন দূত এসে উপস্থিত হলো। তাকে দুজন গ্রিক সৈন্য স্কট করে নিয়ে এসেছে। সামরিক অভিবাদন শেষে দূত সেলুকাসের কাছে একটি পত্র হস্তান্তর করল।

পত্রটি আত্মসমর্পণের আহ্বানসংবলিত। তাতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের স্বাক্ষর রয়েছে। লেখা হয়েছে সেলুকাসের উদ্দেশে। পত্রটি এ রকম :

মহান সম্রাট সেলুকাস,

পত্রে আমার শুভেচ্ছা নেবেন। আপনি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন মৌর্য বাহিনী সেলুসিড বাহিনীকে পুরোপুরিভাবে ঘিরে ফেলেছে। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি পরিহারের লক্ষ্যে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যুদ্ধ না করে একটা চুক্তিতে আসার। আপনি আমার প্রস্তাবে সম্মত হলে দলিলের খসড়া নিয়ে আমাদের মহামন্ত্রী আপনার কাছে যাবেন। আপনি সম্মত না হলে যুদ্ধ অনিবার্য। নয় হাজার হস্তীর এক অভূতপূর্ব বাহিনীসহ ছয় লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে চারদিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ করে সেলুসিড বাহিনীকে থরের ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হবে। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না আপনার বাহিনীসহ আপনি এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। আপনি যুদ্ধ না চাইলে আমাদের দূতের মাধ্যমেই পত্র মারফত জানাতে পারেন। আর যদি মনে করেন কিছু সময় নেবেন, আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আমি দুদিন সময় দেব। প্রয়োজনবোধে আমার দূত দুদিন আপনার শিবিরে অপেক্ষা করবে। তার বেশি নয়। আশা করি শুভবোধের পরিচয় দিয়ে সমঝোতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাবেন।

ইতি
আপনার শুভ কামনায়
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

সেলুকাস জানেন এ সন্ধির অর্থ কী? পত্রটি পাঠ করে দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। প্রিন্সেস, জেনারেল, অধস্তন সেনাপতি—সবার দৃষ্টি সম্রাটের দিকে। কিছুক্ষণ পর সেলুকাস বললেন, দূতকে বিশ্রামের স্থানে নিয়ে যাও। বলে থামলেন তিনি। সবার অধীর আগ্রহ পত্রে কী লেখা আছে, তার প্রতি। উৎকণ্ঠিত কেউ কেউ। দূত চলে গেলে সেলুকাস কর্নেলিয়ার কাছে পত্রটি হস্তান্তর করলেন। কর্নেলিয়ার চন্দ্রগুপ্তের স্বাক্ষরটিতেই প্রথমে চোখ গেল। খুবই পরিচিত এ স্বাক্ষর এবং এ নাম। খুব সতর্কতার সঙ্গে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন তিনি। সেলুকাস বললেন, একটু জোরে পড়ো, যাতে সবাই শুনতে পায়।

কর্নেলিয়া পত্রটি পাঠ করলেন। পত্র লেখকের নাম আর পড়লেন না। শুধু বললেন, পত্র লেখক মৌর্য সম্রাট। কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত মরুভূমিতে নিস্তব্ধতা নেমে এল। সবাই ভাবিত, চিন্তিত। পরে গুঞ্জন শুরু হলো। পাশাপাশি থাকা একে অন্যের সঙ্গে মৃদু আলাপ করল কিছুক্ষণ। সম্রাট গুঞ্জন থামিয়ে দিয়ে বললেন, এবার পত্রের বিষয়ে তোমাদের মতামত দাও।

প্রথমেই কথা বললেন জেনারেল ক্লদিয়াস। বললেন, কোনো সমঝোতা-সন্ধিতে না গিয়ে আমাদের উচিত জাল কেটে বের হয়ে যাওয়া। এতে কিছু ক্ষতি হবে বটে, কিন্তু বিশাল পরাজয় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আমরা আবার সংঘটিত হয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করব।

জেনারেল কিউকেকাস যুদ্ধ করার পক্ষপাতী। বললেন, শেষ রক্তবিন্দু থাকতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের শক্তি কম নয়। আমার সৈন্য আদেশের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার আরেকটি পরামর্শ আছে। এ যুদ্ধ দীর্ঘ হতে পারে। পশ্চিম ফ্রন্টের এন্টিগোনাসের সীমান্ত থেকে জেনারেল মোলনকে তাঁর বাহিনীসমেত ফেরত এনে বাইরে থেকে মৌর্যদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। নিকোমেডেসের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রয়োজনবোধে ফারাও টলেমির কাছ থেকেও সৈন্য আনা যেতে পারে। সমুদ্রপথে মিসর থেকে রিজার্ভ সৈন্য আনা সম্ভব না হলে আমাদের পাশের এলাকা থেকে আনা যায়।

টলেমির দিকে আশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভুল করা হতে পারে। আর্কিমেডেস এভাবে তাঁর মতামত দিতে শুরু করলেন। পশ্চিম সীমান্ত অরক্ষিত রেখে এন্টিগোনাসকে সুযোগ করে দেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ক্লদিয়াসের প্রস্তাবই অনুমোদন করা উচিত।

আর্কিমেডেসের কথা শুনে কিউকেকাস কটমটিয়ে তাকালেন তাঁর দিকে এবং বললেন, আমার বক্তব্য (যুক্তি) খণ্ডনের দায়িত্ব তোমাকে কেউ দেয় নি, ইয়ংম্যান। তুমি তোমার কথা বলো। লেজুড়বৃত্তি কোনো জেনারেলের কাজ নয়।

আর্কিমেডেস ভবেছিলেন এ পর্যায়ে কর্নেলিয়া কিছু একটা বলবেন, যা তাঁর পক্ষে যাবে। কর্নেলিয়া কিছুই বললেন না। তাই নিজেই বললেন, কারও মত যুক্তিযুক্ত মনে হলে তাকে সমর্থন করা লেজুড়বৃত্তি নয়। এ কথা বলে একজন জেনারেলকে অপমান করা হচ্ছে।

তোমরা থামো, ধমকে উঠলেন সেলুকাস। এটা তোমাদের বিরোধ দেখার সময় নয়। আমি অবাক হচ্ছি তোমাদের দায়িত্বজ্ঞান দেখে।

জেনারেল ফিলেকাস সম্রাটকে শান্ত করার উদ্দেশে বললেন, মহামান্য সম্রাট, মৌর্যদের মতামত জানাতে আমরা সময় নেব। এখনই কিছু জানানোর দরকার নেই। এ সময়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব কী বলা যায় বা কী করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *