৫৬
গ্রিকোমেসিডোনিয়ান যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করে গ্রিসের হেলেনিস্টিক আর্মি। তাদের ভিত্তি ফ্যালনক্স রীতি। সে রীতির আধুনিকায়ন করে একরা বাহিনীকে সেলুসিড আর্মি প্রতিরক্ষামূলক ব্যূহ রচনায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়েছে। এখন উত্তর-দক্ষিণ নেই, থর মরুভূমির মধ্য বরাবর সৈন্যসমাবেশ ঘটেছে। জায়গির রীতির একরা ফ্যালনক্স সিদ্ধ। সেলুসিড বাহিনীর মূল শক্তি এরাই। সারিসা তাদের হাতেই শোভমান।
কাতুইকোই গত যুদ্ধে খুব সুবিধে করতে পারে নি, অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। এ বাহিনী গঠনে সেলুকাস টলেমির ক্লোবোচোই বাহিনীকে অনুসরণ করেছেন। ক্লোবোচোই গঠনকালে সেলুকাস টলেমির নৌ জেনারেল বা অ্যাডমিরাল ছিলেন। কিন্তু তাঁর এ বাহিনী থরের প্রথম যুদ্ধে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অবশ্য তাদের ক্ষুরধার করে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা হয়েছে। বলা হয়েছে, সেলুসিড আর্মি মৌর্য আর্মির প্রায় অর্ধেক, তাই কৌশলী হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। সেলুকাস নিজে একটি গল্প বলেছেন ওদের উদ্দেশে। একজন কসাই মাংস কাটার আগে তার ছুরিতে শাণ (ধার) দেয়। ছুরির সর্বত্র কিন্তু শাণ দেওয়া হয় না, যে জায়গা দিয়ে মাংস কাটা হয়, শাণ দেওয়া হয় সে নির্দিষ্ট স্থানে। তাই কৌশলী হলেই শুধু যুদ্ধ জয় করা সম্ভব। এবার এপিলেকটোই এর সামনে থাকবে এরা। সারিসা কভারেজও পাবে। তাদের শোভা পাবে এক হাতে ব্যবহারযোগ্য জিকোস এবং দ্রুত মুভমেন্ট করা যায়, এ রকম ঢাল।
জেনারেলের এক ধাপ নিচের একজন সামরিক কর্মকর্তাকে কাতুইকোই বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে। এই অফিসারের নাম ডেমিকাস। ডেমিকাস সেলুকাসের সঙ্গে টলেমির বাহিনীতে কাজ করেছে। ক্লোবোচোই সম্পর্কে তার ধারণা রয়েছে।
এপিলেকটোই বাহিনীর অধিনায়ক বরাবরের মতোই আছেন ফিলেকাস। তাদের উটের একটি বহর রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আনা। থর বা রাজস্থানে মরুভূমির উটদের তুলনায় এসব উট বেশ শক্তিশালী এবং সামরিকভাবে প্রশিক্ষিত। উটের সংখ্যা এবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। কয়েকটা হাতি সংগ্রহ করে উট দ্বারা হাতিদের মোকাবিলার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে সেলুসিড সৈন্যদের। উট দিয়ে হাতিদের মোকাবিলা রীতিমতো কৌতূহলোদ্দীপক। তবু গ্রিকদের বিশ্বাস, মরুভূমিতে উট খুব কাজে আসবে। উট তো মরুভূমির জাহাজ, হাতি কী? তাদের প্রশ্ন।
কৌশলগতভাবে পরিখা খনন এবারও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। হাতিদের ভয় দেখানোর জন্য অগ্নিগোলক ও মশালের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথম পরাজয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে সেলুকাস এবার তাঁর বাহিনীকে বেশ শক্তভাবে দাঁড় করিয়েছেন। প্রাথমিক সাফল্যটাও এসেছে উত্তর থরের যুদ্ধে। এতে আস্থা বেড়েছে তার বাহিনীর মধ্যে। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকে একটা শিক্ষা দিতে চান। এ শিক্ষাটা হবে প্রথম যুদ্ধে হারের প্রতিশোধ। কিন্তু মাঝখানে একটা সমস্যা হয়ে গেছে। জামাতা জেনারেলের ক্রোধ। অন্ধকার কারাগার থেকে তাকে বের করে আনা হয়েছে বটে। কিন্তু যুদ্ধে নিয়োজিত করা হয় নি। সেলুকাস আস্থার সংকটে ভুগছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে একটা থমথমে ভাব। থেকে থেকে শুধু অশ্বের হেষা, ষাঁড়ের হাম্বা, গাধাদের ঘোঘা শোনা যাচ্ছে। হাতি ও উটেরা চুপচাপ আছে।
এমনাবস্থায়ই ফিলেকাস ঘোড়ার পিঠে চড়ে সম্রাট সেলুকাসের কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে স্যালুট করে দাঁড়ালেন।
তুমি জরুরি কিছু বলতে চাও, ফিলেকাস?
জেনারেল কিউকেকাসকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখছি না।
তাকে এখনো নিয়োজিত করা হয় নি।
কারণ কি জানতে পারি, মহামান্য সম্রাট? আপনি তাকে যুদ্ধে দায়িত্ব দেবেন বলেছিলেন।
বলেছিলাম। পরে ভাবলাম, যেটুকু মানসিক ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে, তা সামাল দিয়ে সে স্বাভাবিক যুদ্ধ চালাতে সক্ষম হবে কি না। এ ছাড়া আমি তাকে বুঝে উঠতে পারছি না। মহামান্য সম্রাট, আমাদের শক্তি শত্রুদের তুলনায় অর্ধেক। আমার দৃষ্টিতে কিউকেকাস উচ্চাভিলাষী নয়।
আমরা তাদের চাইতে যুদ্ধবিদ্যায় অনেক পারদর্শী। ভুল না করলে আমরা জিতবই। আর তুমি যা বলতে চাইছ, তা আমি বুঝতে পারি। তাকে আমি ভয়ংকর কিছু মনে করি। ভয়ংকর এন্টিওকাস, তাকে যেখানে রাখার রেখেছি।
ফিলেকাস ভাবলেন, রাজা-বাদশাহরা নিজেদের পুত্রদেরই ভয় করেন, অন্য কাউকে নয়। মুখে বললেন, ব্যাপারটা ভেবে দেখুন, সম্রাট, আর অনুমতি দিন এপিলেকটোইয়ের কাছে যাই।
.
পরিকল্পনা মোতাবেক ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে মৌর্য বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে আনা হয়েছে। উদ্দেশ্য দুটি: আগে আক্রমণ করা হবে না। ছোট সৈন্যবাহিনী দেখে ওরা আগে আক্রমণ করবে। যুদ্ধটা হবে মৌর্য এলাকায়। সেলুসিড আর্মিকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে পরিখায় পড়ে আটকে যাওয়ার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, এবার সম্পূর্ণ সেলুসিড বাহিনীকে ঘিরে ফেলা হবে। বড়জালে মাছের ঝাঁক যেভাবে আটকে ফেলা হয়, ঠিক সেভাবে।
মহামন্ত্রী চাণক্যের এই কৌশলটা সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পছন্দ হয়েছে। তিনি যেদিন থেকে জানলেন যে চাণক্যই আসলে কৌটিল্য, সেদিন থেকে চাণক্যের প্রতি শ্রদ্ধা, নির্ভরতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে গেছে। তবে সম্রাটের রাজকীয় মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসে নি। তিনি চাণক্যের হাবভাব ও কাজকর্মে একেবারে চোখ বুজে থাকেন নি। কারণ, অর্থশাস্ত্রের কৌটিল্য আর বাস্তবের মহামন্ত্রী চাণক্যের মধ্যে ঢের পার্থক্য রয়েছে। চাণক্যের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে সুবন্ধুকে অনেকটা সামনে নিয়ে এসেছিলেন। এখন তাকে দূরে সরাতে চাইলেন না এ জন্য যে তিনি যুদ্ধের মাঠে আর কাউকে শত্রু তৈরি করতে চান না। দূরে সরানোর কথা না ভেবে বরং একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা ভাবলেন। সুবন্ধুকে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার দায়িত্ব এখন আরও বেড়ে গেল। সব ব্যাপারে চোখ-কান খোলা রাখবে। কোথাও কোনো ব্যত্যয় দেখলে সরাসরি আমাকে জানাবে।
সুবন্ধু সবকিছু বুঝেও সম্রাটের কথায় সায় দেন। বলেন, মহামান্য সম্রাট, এ যুদ্ধ জয়ের জন্য মহামন্ত্রীকে আপনার পাশে রাখতেই হবে।
.
সুবন্ধুর অন্তরের কথা নয় এটি। তাঁর অন্তরে একটি ছায়া বিস্তার করে আছে দুঃখ ও ক্ষোভ ক্ষোভটা ক্রমে বিদ্বেষে রূপ নিচ্ছে মহামন্ত্রী চাণক্যের বিরুদ্ধে। চাণক্য তাঁকে খাটিয়েছেন প্রচুর। নন্দরাজ একটা ভুল করেছিলেন বটে। চাণক্যকে বাদ দিয়ে তাঁকে ব্রাহ্মণদের নেতা করা ঠিক হয় নি। এ ঘটনা নন্দরাজের বিনাশ ডেকে এনেছে। তাঁর সর্বনাশ হতে হতে রক্ষা পাওয়া। তবে চাণক্য কেন যেন তাঁকে বাদ দেন নি। সঙ্গে সঙ্গেই রেখেছেন। তিনি কৌশলী মানুষ, শত্রুকে চোখের সামনে রাখতে চান। পশ্চাতের পাতার শব্দও তাঁর কানাবধি পৌঁছে যায় গোয়েন্দার মাধ্যমে। শত্রুর ব্যাপারে চাণক্য মনে করেন পচা-বাসি পানিও কাজে লাগে, কাজে লাগাতে জানতে হয়, এই যা। শত্রুকে দূরে রাখলে ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ে। অবশ্য তিনি সুবন্ধুকে শত্রু মনে করেন না। তাঁর ওপর এক রকম ক্ষোভ থাকলেও তার প্রকাশ দেখান নি।
সুবন্ধু তা বুঝতে পারেন। তাঁর মাঝেমধ্যেই মনে হয় সম্রাটের কাছে এক নম্বর হতে তাঁর সামনে শুধু একজন মানুষ। এ মানুষটি হিমালয়ের বিশালতা নিয়ে অনড় অবস্থায় দাঁড়িয়ে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে সম্রাটের কান ভারী করতে যান নি কখনো। সুবন্ধু বুদ্ধিমান। এত বড় মহামন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলা বা বলতে যাওয়া বোকামি। কারণ, সম্রাট তাঁর ওপর যত ক্ষুব্ধই হোন না কেন, ক্ষোভটা ধরে রাখতে পারেন না। অতীত তাঁকে চাণক্যের প্রতি সহজ করে তোলে। এ কথা সুবন্ধু ভালো করে জানেন। এবার মনে হয়েছিল বড় মাছ ছিপে আটকে গেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, এবারও সহজে ছাড়া পেয়ে গেল। কারণটা সুবন্ধুর জানা নেই। ভুল এবার সুবন্ধুরই বেশি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সম্রাটের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। সাতপাঁচ ভেবে মহামন্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি। কাজটা ভালোই করেছেন। ভাবলেন সুযোগ আবার আসবে। মহামন্ত্রী ভুল করবেন না, তা হয় না। সে পর্যন্ত তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে। সম্রাটের সুনজরে থাকতে হবে। আর মহামন্ত্রীর হুঁক্কা সাজাতে হবে আগের মতোই।
কাজটি তিনি শুরু করেছেনও। মহামন্ত্রী চাণক্যকে বললেন, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, আচার্য। সম্রাট মহা ভুল করতে যাচ্ছিলেন। আপনাকে দূরে রেখে যুদ্ধ? হেরে একেবারে মাটিতে মিশে যেতেন। আমরাও কোথায় যেতাম, কে জানে। এখন শক্তি-সাহস দুটোই ফিরে পেয়েছি। সৈন্যদের মধ্যেও নতুন উদ্দীপনা।
প্রধান সেনাপতি কাছেই ছিলেন। বললেন, সুবন্ধু ঠিকই বলেছেন, আচার্য। সৈন্যদের মধ্যে হতাশা চেপে বসেছিল। আমি কোনো ভরসাই পাচ্ছিলাম না। রাতে আমার ঘুম হয় নি। আপনাকে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে পেয়ে প্রাণশক্তি ফিরে এসেছে।
মহামন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কোনো কথা বললেন না। প্রধান সেনাপতিকে বললেন, তুমি সম্রাটের কাছাকাছি থাকবে। যাও, সেখানেই তোমার অবস্থান। সেনাপতি সদাচারকে এখানে পাঠিয়ে দাও। সুবন্ধু, আমার কাছাকাছি থেকো। আমার মনে হয় না বর্তমান পরিকল্পনায় বড় আকারের যুদ্ধ হবে। তবু সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের লড়ে যেতে হবে।