মৌর্য – ৫৫

৫৫

বন্দিশালার সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রিন্সেস কর্নেলিয়া। সঙ্গে নিকোমেডেস। দ্বাররক্ষীরা তাঁদের অভিবাদন জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দ্বাররক্ষীদের উদ্দেশে বললেন, দ্বার খুলে দাও, ভেতরে যাব।

এরা ইতস্তত করছিল। প্রিন্সেস ধমক দিয়ে উঠলেন, কে তোমাদের বাধা দিতে বলেছে?

জেনারেল আর্কিমেডোস।

নিকোমেডেস ধমক দিয়ে বলল, প্রিন্সেসকে তোমরা চেনো না? তার আদেশ না মানার পরিণাম জানো?

ভয়ে দরজা খুলে দিল দ্বাররক্ষীরা। কর্নেলিয়া নিকোমেডেসকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। কিউকেকাস ছোট্ট কারাকক্ষটায় নিজের হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে আছেন। কর্নেলিয়াদের দেখে তাঁর কোনো ভাবান্তর হলো না। এখন তিনি দুলছেন।

কর্নেলিয়া হাসলেন। বললেন, সেলুসিড আর্মির সেকেন্ড ইন কমান্ডের এ দশা কেন?

তুমি কি মজা করার জন্য এখানে এসেছ?

আপনার-আমার সম্পর্কটা মজা করারই।

এটা কি মজা করার সময়? তুমি আমার সঙ্গে বিদ্রূপ করতে এসেছ?

না, জেনারেল, আপনার সঙ্গে আমি বিদ্রূপ করতে আসি নি। আপনাকে দেখে আপনার অবস্থা লাউডিসকে জানাব বলে এসেছি। না দেখে তো লোকমুখে শুনে অথবা বানিয়ে বোনকে পত্র লেখা যায় না।

এই সংবাদ তুমি লাউডিসকে জানাতে চাইছ? তুমি পাগল হলে নাকি?

আরে, এ সংবাদ না পেলে লাউডিস আপনাকে ছাড়াতে আসবে কী করে?

লাউডিস কেন আমাকে ছাড়াতে আসবে?

তাহলে কে আপনাকে ছাড়ানোর জন্য সুপারিশ করবে? সম্রাট এমন খেপেছেন যে কন্যার কান্নাকাটি ছাড়া ছাড়বেন বলে মনে হয় না।

তুমিও তো তাঁর কন্যা, তুমিই কান্নাকাটি করো।

আমি প্রক্সি দিতে পারব না, যার কাজ তাকেই মানায়। এ ছাড়া আপনি তো কখনোই আমাকে ‘ছোট গিন্নির’ মর্যাদা দেন নি, কেবল লাউডিস। লাউডিসের মধ্যে কী পেয়েছেন?

তুমি তার নখেরও যোগ্য নও। তুমি কী দেখেছ আর্কিমেডেসের মধ্যে? অপদার্থ একটা।

সে আপনাকে এই বন্দিখানা বরাদ্দ করেছে?

আমি বের হতে পারলেই দেখো কী কঠিন পরিণাম তার জন্য অপেক্ষা করছে।

হায় জিউস! কী জেলাস? এখন বুঝতে পারলাম আপনি কতটা ভালোবাসেন আপনার ছোট গিন্নিকে। মারামারির মধ্যে যাইয়েন না, ভাই। এমনিতেই খুব বিপদে আছেন।

এতক্ষণ শ্যালিকা আর দুলাভাইয়ের মজার কথা শুনছিল নিকোমেডেস। এবারে বলল, বলুন তো জেনারেল আসলে কী ঘটেছিল?

তোমাদের শুনে কী হবে?

কী হবে বলা শক্ত। শুনলে কাজেও আসতে পারে।

নিকো খুব বুদ্ধিমান অফিসার। বলল, আপনি আমাকে বলার দরকার নেই, ওকে বলুন। সে আপনাকে অনেক সুবুদ্ধি দিতে পারবে।

নিকো, তুমি এর পেছনে ঘুরছ কেন? ও তোমাকে এমন ধোঁকা দেবে না, বাকি জীবনেও ভুলতে পারবে না।

লাউডিস কিছু বলে নি আপনাকে, বলে হাসল নিকোমেডেস।

লাউডিস কী বলবে?

নিকো বলল, ওসব থাক, আপনি বলুন আসলে সমস্যাটা কী হয়েছিল?

নিকো, ওসব বাদ দাও। আমাকে এভাবেই থাকতে দাও। আমাকে নিয়ে আমাকেই ভাবতে দাও।

কর্নেলিয়া বলল, আপনাকে নিয়ে ভাবছেটা কে? আমরা হারমিজকে নিয়ে ভাবছি।

এবার নিজের অজান্তেই কিউকেকাসের ভেতর থেকে একটি উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বের হয়ে এল।

বেশ, আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা পরে আবার আসব, বলল নিকোমেডেস!

নিকোমেডেস আর কর্নেলিয়া যুদ্ধ ফ্রন্টে উপস্থিত হলো সেলুকাসের কাছে। সেলুকাস তখন তাঁর সৈন্যদের উদ্দেশে এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছেন: সৈন্যগণ! মৌর্য বাহিনী পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তোমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। উত্তর থরে ওদের মর্মান্তিক পরাজয় তোমাদের যে গৌরব এনে দিয়েছিল, তা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। আমাদের ঘাঁটি খুবই শক্তিশালী, আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত সমরকৌশল রয়েছে। এরা যখন আক্রমণ করতে দক্ষিণ থেকে উত্তর থরের দিকে আসবে, তাদের অগ্রবর্তী দল আমার সামনেই পড়বে। আমি স্বয়ং তোমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকব! আমি নিজে এ যুদ্ধ পরিচালনা করব। তোমরা স্বাভাবিক শৌর্য ও বীর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে ওদের নাস্তানাবুদ করে দেবে। তাদের নিজেদের মধ্যে গোলযোগ বাঁধিয়ে দেবে। নতুনভাবে উদ্ভাবিত সেলুসিড সমরকৌশল তোমাদের কাজে লাগাতে হবে। বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগে এ কৌশল খুবই কাজে লাগবে। তারপরও জয় সম্পর্কে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে দেখতে পাবে তোমাদের সম্রাট শত্রুর প্রথম আঘাতেই সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছে। সেলুসিড সেনাবাহিনী থেকে না না শব্দ উচ্চারিত হতে শুরু করল। একজন সারিসাধারী সৈন্য উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সবাইকে থামিয়ে উচ্চ স্বরে বলল, মহামান্য সম্রাট, তা হয় না। সেলুসিড বাহিনীর একটি সৈন্য বেঁচে থাকলেও সম্রাটের কিছু হতে দেব না। আমরা আমাদের গ্রিক জাতির সম্মান রক্ষার জন্য সবকিছুই করব।

তা আমি জানি আমার বীর সৈনিকেরা, বলে থামলেন সম্রাট। আবার বললেন, সম্মানবোধ নিয়েই গ্রিকরা বাঁচে। এ সম্মানের উচ্চশির প্রতিটি সেলুসিড সৈন্যের শিরস্ত্রাণে অহংকার হয়ে আছে। তোমরা এ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ থাকো যে আমাদের জাতির প্রতি যারা ঘৃণা ও ক্রোধ ঢেলে দেবে, এরা যে জাতিগোষ্ঠীর মানুষই হোক না কেন, আমরা তাদের পরাজিত করে সমুচিত জবাব দেব। আর একটা কথা, আমরা প্রথমে আক্রমণ করব না, শত্রুদের আক্রমণ করতে দেব। কৌশলে এদের মোকাবিলা করতে হবে। আহত সৈন্য সরিয়ে আনা কিংবা উত্তেজনার বসে বিশৃঙ্খল হয়ে তোমাদের নিজেদের ব্যূহ ভেঙে ফেল না। মনোবল হারাবে না। মনে রেখো, তোমাদের পেছনে আরও সৈন্য আছে। আমি আছি। নিশ্চয়ই আমরা এই চূড়ান্ত লড়াইয়েও জয়ী হব। এখন তোমরা যার যার অবস্থানে চলে যাও।

সম্রাটের বক্তৃতা শেষ হলে কর্নেলিয়া এগিয়ে গিয়ে সম্রাটের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলেন। এ সময় সেলুসিড সৈন্যরা উচ্চ স্বরে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল।

সৈন্যরা যার যার অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে। সম্রাটও নিকটস্থ একটি সেনাছাউনিতে অবস্থান নিলেন। আপনার সঙ্গে কথা ছিল, বাবা, কর্নেলিয়ার কণ্ঠ শুনে সম্রাট পাশে ফিরে তাকালেন, বলো, কী বলতে চাও।

বলছিলাম কিউকেকাসের কথা। লাউডিস এখানে থাকলে সে-ই বলত।

কী বলতে চাও তার সম্পর্কে? সম্রাটের কণ্ঠে ঝাঁজালো স্বর।

বন্দিশালায় দেখতে গিয়েছিলাম। সম্রাটের জামাতা একজন জেনারেলকে এভাবে ছোট্ট একটি কক্ষে কেউ ফেলে রাখে?

এভাবে রাখবে কেন? কে রেখেছে?

এখানে সম্রাটের পরিবারকে কেউ হেয় করতে চাইছে, তা স্পষ্ট। আমি শুনেছি, অভিযোগের কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই তাকে বন্দী করা হয়েছে।

সে তার নিজের দোষ স্বীকার করেছে। নির্বোধ গোঁয়ার একটা। তদন্তের প্রয়োজন নেই।

গোঁয়ার, ঠিক আছে। কিন্তু আত্মাভিমান থেকেও তো তা করতে পারে।

তোমাকে বলেছে?

না, বলে নি।

নিকোমেডেস বলল, মহামান্য সম্রাট, আমিও কর্নির সঙ্গে ছিলাম। ব্যাপারটা রহস্যজনক মনে হয়।

তোমাদের কিছু বলেছে?

না, অনেক চেষ্টা করেও কিছু জানতে পারি নি। মনে হয়, অভিমান করে আছে। শাস্তিটা নিচ্ছে আমাদের অনেককে শাস্তি দেওয়ার জন্য।

কী বলতে চাও তোমরা?

কর্নেলিয়া বলল, আপনি নিজে তার বক্তব্য শুনুন, তারপর ব্যবস্থা নিন।

তার জন্য দক্ষিণ থরে আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি। তার নির্লিপ্ততা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।

তার কথা শুনুন, এটি আমাদের অনুরোধ। তার নির্লিপ্ততার জন্য যদি পরাজয় হয়ে থাকে, তার সক্রিয়তাও জয় নিশ্চিত করতে পারে। একজন জেনারেল একটি মহাশক্তি। তার অংশগ্রহণ সেলুসিড আর্মিকে শক্তি জোগাবে। কেন সেলুসিড আর্মি তার সেবা থেকে বঞ্চিত হবে?

নিকোমেডেস বলল, মহামান্য সম্রাট, গ্রিক আর্মি গোটা পশ্চিম এশিয়াজুড়ে অবস্থান করছে। মিসরে আছেন টলেমি। নিজেকে ফারাও বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আমি তাঁর আর্মিতে আছি। এতে আমি গৌরববোধ করি। তিনি আমার আত্মীয় বলে নয়, আলেকজান্ডারের একজন জেনারেল হিসেবে খুবই বিচক্ষণ। ভুল তো আমরাও করি, অধিকার নিয়ে অনেক কিছু আশাও করি। ভুল করার অধিকারও চাই।

তুমি তো খুব সুন্দর করে কথা বলো, নিােমেডেস, ঠিক আমার বোনের মতো।

তাঁর পুত্র, হয়তো তাই। তিনি লাউডিস আর তার মেয়ে হারমিজকে নিয়ে চিন্তায় আছেন।

তিনি না থাকলে লাউডিস বড় সমস্যায় পড়ত, বললেন কর্নেলিয়া। যোগ করলেন, লাউডিসের স্বামীর অনুপস্থিতির জন্য তার ত্যাগ, সেলুসিড সাম্রাজ্য তার কতটা মূল্য দেবে? শেষে কি হৃদয়টা ভেঙে দেবে?

সম্রাট বললেন, কর্নেলিয়া, তুমি এভাবে বলছ কেন?

আমি জানি, জেনারেল কিউকেকাসের অনেক দোষত্রুটি আছে। সিরিয়ার যুদ্ধে কি তার অবদান নেই? এন্টিওকাসের সমস্যা সৃষ্টির দিনগুলোয় সে কি আপনার পাশে দাঁড়ায়নি, আমাদের সান্ত্বনার কারণ হয় নি? সে সময়কার সেলুসিড পরিবারের কথা একবার ভাবুন। আগলে রেখেছিল কারা? নিকোর মা, আপনার বোন, আমার ফুফু ভেতরে, আর কিউকেকাস বাইরেটা সামলেছিল কত নিষ্ঠায়। সে সময় লাউডিসের ভূমিকা কী ছিল, একবার ভাবুন। ভাইয়ের মুখ সে আজ পর্যন্ত দেখে না। কিউকেকাসের আজকের সংবাদ তাকে কী দেবে? কত হারাবে সে এ জীবনে?

কর্নেলিয়া, থামো, থামো। আমি তোমার আবেগ বুঝতে পারি। কিন্তু সেলুসিড আইন তো সবার জন্যই সমান!

জিউস কি সবাইকে সমান করে সৃষ্টি করেছেন? একজন সাধারণ সৈনিক কি জেনারেলের সুযোগ-সুবিধা পান?

তা পান না। কিন্তু যার মর্যাদা বেশি, তার দায়িত্বও বেশি। দায়ও বেশি।

তাই বলে তাকে এ অবস্থায় রাখা হবে? আপনি কি শুধুই সম্রাট? লাউডিসের পিতা নন? তার বিচার করুন, কিন্তু তার যুদ্ধ করার অধিকার ফিরিয়ে দিন।

তুমি কি চাও আবার সে নিষ্ক্রিয় থেকে যুদ্ধে আমাদের পরাজয়কে নিশ্চিত করুক?

পাগলও তা চাইবে না, আমি তা চাইব কেন? আপনি যদি পরিবারের সম্মানের চাইতে অন্য কিছুকে বড় করে দেখেন, তাহলে জেনারেলের বিচার করে শাড়ি দিয়ে এখনই তাকে বিদায় করুন। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে সে নরকে যাক।

তুমি শান্ত হও, কর্নেলিয়া। আমি ব্যাপারটা দেখছি।

আমার যা বলার বলে গেলাম। যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়ে প্রাণ দেওয়ার গৌরবভোগের পরিবর্তে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত স্বামীর জন্য লজ্জাজন মন্তিক বেদনা যেন লাউডিসকে সারা জীবন পুড়িয়ে না মারে, সে দিকে লক্ষ রাখার দায়িত্বও আপনার। আয় নিকো, আমরা ফিরে যাই।

কন্যার কথা শুনে সেলুকাস প্রথমটায় বিরক্তবোধ করেছিলেন। পরে চিন্তা করে দেখলেন, সে অযৌক্তিক কিছু বলে নি। তিনি জেনারেল ফিলেকাসকে ডাকলেন। সেদিন ক্রুদ্ধ সম্রাটের সম্মুখে কিছু না বললেও ফিলেকাস আজ বললেন, মহামান্য সম্রাট, দোরি বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা (বলতে চেয়েছিলেন যোগ্যতা, ভদ্রতা করে বললেন না) ক্লদিয়াসের নেই। তার বাহিনী কাজ করে সরবরাহ বিভাগে। এ অভিজ্ঞতা তার যথেষ্ট আছে। এ ছাড়া এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে একজন জেনারেলের ভূমিকা অনেক। তাকে বন্দী করে রাখা সেলুসিড বাহিনীরই ক্ষতি।

সম্রাট বললেন, তার ব্যবহার দেখো নি তুমি?

কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে, সম্রাট। আমাকে যদি দায়িত্ব দেন, আলোচনা করে দেখতে পারি।

বেশ তুমি দায়িত্ব নিতে চাও, নাও। কিন্তু দ্বিতীয়বার এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমি যুদ্ধক্ষেত্রেই তার শিরশ্ছেদ করব।

.

এদিকে মহামন্ত্রী চাণক্য সকালের সমর-পরিষদ সভায় উপস্থিত হলেন। সম্রাট তাঁকে স্বাভাবিকভাবে সৌজন্য দেখালেন। পূর্ব রাতের যুদ্ধ পরিকল্পনা অবহিত করলেন। বললেন, আচার্য, আপনার যদি কোনো পরামর্শ থাকে, তা চূড়ান্ত করার আগে বলতে পারেন।

প্রধান সেনাপতি বললেন, পুরো পরিকল্পনাটিই কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে নেওয়া। মহামন্ত্রীর এ ব্যাপারে দ্বিমত করার কথা নয়। অর্থশাস্ত্র তাঁর খুবই জানা।

চাণক্য বললেন, পদাতিক বাহিনীর আরেকটা দল সামনে মোতায়েন রাখা যেতে পারে, ঠিক মিশ্র ব্যূহের মতো।

আমিও একমত, বলে সম্রাট যোগ করলেন, অগ্রভাগে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

সম্রাটের রাত আর দিনের ব্যবহারের এ পার্থক্য মহামন্ত্রী বুঝতে পারলেন না। শুধু কৌতূহলোদ্দীপক হয়ে থাকল ভদ্রবাহুর ভূমিকা। সম্রাটকে তিনি গত রাতে কী কথা বলে গিয়েছিলেন, তা জানা হলো না। এসব ভুলে গিয়ে আগের মতো খুব স্বাভাবিকভাবেই গুপ্তচরের কাছ থেকে পাওয়া গ্রিকদের যাবতীয় তথ্য সম্রাটকে অবহিত করলেন চাণক্য। শুধু কর্নেলিয়ার কথা গোপন থাকল।

গ্রিক সেনাবাহিনীতে অস্থিরতার কথা শুনে সম্রাট বিস্ময় প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এটা আমাদের জন্য ভালো খবর। সেই জেনারেলের বাহিনী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুযোগ বুঝে আঘাতটা সেখানেই করতে হবে। গুপ্তচর পাঠান। প্রয়োজনবোধে আমরা যুদ্ধকৌশল পরিবর্তন করব।

সম্রাটের কাছ থেকে ফিরে গিয়ে নিকোমেডেস ফাওলিনকে পত্র লিখতে বসল :

প্রাণপ্রিয় ফাওলিন,

অনেক দিন হলো তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তুমি নিশ্চয়ই খুব খেপে আছ। মাকে দেখতে এসে দারুণ এক ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি। অনিয়মিত নৌ অফিসার না হলে দাদা টলেমিও চাকরিটা নট করে দিতেন। এত দিন চাকরি কিংবা প্রেমিকার কাছ থেকে দূরে থাকার রেকর্ডটি বোধ হয় আমারই। আমার অবশ্য কোনোটিই হারানোর ভয় নেই। আমি তোমাকে চিনি, ফারাও টলেমির আস্থা অর্জন করেছি। একটি লম্বা ছুটির দরখাস্ত পাঠিয়েছি তাঁর কাছে।

ঝামেলাটা মাকে নিয়ে নয়, কর্নিকে নিয়ে। গতকাল সে আমাকে নিয়ে থর মরুভূমির যুদ্ধময়দানে গিয়েছিল। কেন গিয়েছিল জানো? সেখানে যুদ্ধ হচ্ছে মৌর্য বাহিনী আর সেলুসিড বাহিনীর মধ্যে। এরই মধ্যে রটে গেছে মৌর্য সম্রাট যুদ্ধে নিহত অথবা বন্দী হয়েছেন। কর্নি গিয়েছিল বন্দী অথবা নিহত সম্রাটকে দেখার জন্য। যাওয়ার আগে বলেছিল, নিহত হলে তাঁকে সামরিক কায়দায় স্যালুট করবে আর যদি বন্দী হয়, তাহলে কষে একটা চড় লাগাবে তাঁর গালে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করছ, কেন?

এত বড় ভূমিকা দিলাম তার জবাব দেওয়ার জন্য। সে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে দেখা করার জন্য গেছে কদিন আগে আমাকে সঙ্গে নিয়ে। মৌর্য শিবিরে যেতে বাধ্য করল সে আমাকে। শুনে তোমার বুক কাঁপছে না? আমার ভয় হয়েছিল। কিন্তু নির্ভীক সে। যাবেই। গেলাম আমরা বন্ধুর পথ অতিক্রম করে। সিন্ধু অববাহিকার সে কী মনোরম দৃশ্য। এত সুন্দর প্রকৃতি আমি জীবনেও দেখি নি। মৌর্য এলাকায় পৌঁছার পরই আমরা বন্দী হলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মৌর্য শিবিরে। সংবাদ পেয়ে মহামন্ত্ৰী চাণক্য এলেন। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মৃত্যু অনিবার্য। কর্নি মোটেও ভয় পায় নি। সে সাহসিকতার সঙ্গে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি সেলুকাস কন্যা কর্নেলিয়া, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। আপনি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিন।

অবাক ব্যাপার, চাণক্য তাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে থাকা-খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে দিল। নিরাপত্তার জন্য সব রকম ব্যবস্থা করে বলল, প্রিন্সেস, আমার লোকজন সার্বক্ষণিকভাবে আপনার সেবায় নিয়োজিত থাকবে। কোনো অসুবিধা হলে বলবেন। আর সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতে আপনার কিছু সময় লাগবে। তিনি এখন তক্ষশীলায় গান্ধারা প্রাসাদে আছেন। সম্রাজ্ঞী অসুস্থ, তাঁকে সময় দিচ্ছেন। আমাকেও তিনি প্রিন্স ভেবে উপযুক্ত সম্মান ও আতিথেয়তা দেখালেন।

কর্নি সম্রাটের সঙ্গে কেন সাক্ষাৎ করবে, তোমার মনে সে রকম প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। প্রথমে সে চেয়েছিল যুদ্ধ করে তাঁকে পরাজিত করে মনের খেদ মেটাবে। ওই সময়টায় সে সম্রাটের ওপর অসম্ভব ক্ষুব্ধ ছিল। সে মনে করেছিল, সম্রাট তাকে প্রতারণা করেছেন। মনের খেদ মেটানোর একটা চমৎকার পরিকল্পনাও সে তৈরি করে। প্রথম ওকে সে বন্দী করবে। তারপর কারাগারে রেখে একে একে নানা শাস্তির আওতায় প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু হঠাৎ করে জানলাম, সে এ পরিকল্পনাটা একেবারে বাদ দিয়েছে। আমাকে কবুতরের একটি শূন্য সোনার খাঁচা দেখিয়ে বলল, পাখি উড়ে গেছে, আর ফিরে আসবে না, এখন শূন্য খাঁচাটি তার একমাত্র সম্বল। বলল, না রে, নিকো, প্রতিশোধ নিয়ে কী হবে? সে তো জেনেশুনে কোনো অপরাধ করে নি, তাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। এরপর সে জানতে পারে, সম্রাটের নবজাতক পুত্র মারা গেছে। কিছুদিন আগে জানল সম্রাজ্ঞীও মারা গেছেন। সহানুভূতিতে-শোকে তার অন্তর বিদীর্ণ। পুত্র বিয়োগে শোকগ্রস্ত সম্রাটকে দুঃখ প্রকাশ করে পত্র লিখেছিল। অতিসম্প্রতি সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে সম্রাটকে কোনো পত্র লেখে নি। কী লিখবে বুঝে উঠতে পারছে না। এ মৃত্যুসংবাদটা পেয়েছিল মৌর্য শিবির থেকে ফেরার পর। না হয় সে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে ফিরে আসত না।

মানবহৃদয় এক অদ্ভুত জিনিস। তাকে বোঝার উপায় নেই। যে নারী বা সম্রাজ্ঞীর কথা শুনে কর্নি খেপে গিয়ে সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে বন্দী করে এনে শাস্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে সে খুব কাঁদল। কার জন্য কাঁদল জানি না, হয়তো সম্রাটের কষ্টের কথা মনে করে অথবা হবু সতিনের বিয়োগবেদনায়। এত দিনে সে পরিকল্পনা করে নিয়েছিল কীভাবে সে এই ভারতীয় সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে সম্রাটকে ভাগাভাগি করবে।

অবাক হচ্ছ? অবাক হওয়ারই কথা। সে যদি কাউকে বিয়ে করে, তবে এই সম্রাটকেই। কোনো গ্রিককে সে বিয়ে করবে না, প্রয়োজনে সারা জীবন বিয়ে না করে থাকবে। আমি বললাম, আমাকে বিয়ে কর। সে বলল, তুই তো গ্রিক!

সম্রাট নাকি ঝিলামে তাকে দেখেছেন। সে-ও সম্রাটকে দেখেছে কিন্তু ছদ্মবেশী সম্রাটকে চিনতে পারে নি। তারপর পত্র যোগাযোগ ও গভীর…।

অদ্ভুত এক প্রেমকাহিনি! যে কবুতর তাদের পত্র বিনিময় করত, তার জন্য এই সোনার খাঁচাটি তৈরি করায় কর্নেলিয়া। কবুতরটি অনেক দিন আসে না। মনে হয় এ জন্যই সাক্ষাৎ করতে যাওয়া। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু এ সাক্ষাৎ আবার আবশ্যকীয় করে দিলেও তুমুল যুদ্ধের মধ্যে মৌর্য শিবিরে যাওয়া নিরাপদ মনে করছে না সে। তার যৌক্তিক কারণও আছে।

আমাদের নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল মন্ত্রী চাণক্য। আমাদের আদর- আপ্যায়ন কিংবা মজার মজার কথা শোনালেও ধূর্ত লোকটি কর্নি ও আমাকে জিম্মি হিসেবে আটকে রেখে অপমানজনক এক আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায় সম্রাট সেলুকাসের কাছে। আমি জানি না এতে মৌর্য সম্রাটের সম্মতি ছিল কি না। কর্নি সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের ব্যক্তিত্বের যে পরিচয় দিয়েছে, তাতে মনে হয় না সম্রাট তা জানেন। আমার বিশ্বাস, এটি ধূর্ত মন্ত্রীটিরই কাজ।

সেখান থেকে এই অবস্থায় আমাদের ফেরত পাঠান আচার্য ভদ্রবাহু। তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আধ্যাত্মিক গুরু। ভগবানের অবতার যেন, সৌম্য- সুন্দর এক ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় চাণক্যই। সেদিন ভারতীয় নারীদের অধিকার-আইন নিয়ে কথা হচ্ছিল এদের সঙ্গে। এসব আইনের কথা শুনলে তুমি যেমন হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাবে, তেমনি গভীরভাবে উপলব্ধি করবে, যাদের আমরা তুচ্ছ জ্ঞান করি, সভ্যতার দিক থেকে এরা আমাদের থেকে কতটা এগিয়ে আছে। খুব ইচ্ছা হচ্ছে এসব আইন সম্পর্কে তোমাকে লিখি, কিন্তু পত্রের কলেবর বেড়ে যাবে, পরে এ বিষয়েই তোমাকে পত্র লিখব। কৌটিল্য নামে এক ব্যক্তি ‘অর্থশাস্ত্রে’ অনেক বিষয়ের সঙ্গে আইনগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।

ভদ্রবাহুকে প্রথম দর্শনেই আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। আমার আস্থা অর্জন করেছিলেন তিনি। তিনি চাণক্যের ষড়যন্ত্রটা অপছন্দ করেন। মনে হয় সে জন্যই কর্নির ইচ্ছার বাইরেও তাকে গ্রিক শিবিরে ফেরত পাঠান। এরা দিগম্বর সন্ন্যাসী। কিন্তু বাস্তববাদী এবং দুনিয়ার জ্ঞানভান্ডারের অধিকারী। তাই তাঁকে বলা হয় ‘শ্রুতকেবলী’।

তিনি আমাদের ফেরত পাঠান তাঁর এক নারী শিষ্য শর্মিলাকে দিয়ে। শর্মিলাকে কর্নি দিগম্বর অবস্থায় আসতে দেয় নি। সে তার গ্রিক পোশাক পরিয়ে তবে আসতে দিয়েছিল। শর্মিলা ভদ্রবাহুর শিষ্যই নয়, কার্বনকপি। এমন ভদ্র, শিষ্ট বুদ্ধিমতী, সুন্দরী নারী আমি কখনো দেখি নি। এ কথা শুনে ঈর্ষা হচ্ছে? তাহলে আরও শোনো, কর্নি একসময় বলছিল, নিকো, তোর সঙ্গে যদি ফাওলিনের সম্পর্ক না থাকত, আমি তোর সঙ্গে এই মেয়ের বিয়ে দিতাম। এটি কথার কথা, হয়তো আবেগেরও। মৌর্য সাম্রাজ্যের সবকিছুই তার ভালো লাগে। আর দিগম্বর জৈন্য সন্ন্যাসীরা কখনো বিয়ে করে না। তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো।

আমাদের গ্রিক শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার পর শর্মিলা কয়েক দিন ছিল আমাদের সঙ্গে। সে সবারই হৃদয় জয় করেছিল। ফিরে যাওয়ার দিন আমার ওপরই দায়িত্ব পড়ে তাকে সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার। তোমার সম্পর্কে কত কথা জানতে চাইল সে। তোমার প্রসঙ্গে কথা শোনার সময় ভারতীয় এক সন্ন্যাসী এই নারীর চোখেমুখে মুগ্ধতার যে ছবি আমি দেখেছি, তার মুখে যে ঋদ্ধ অথচ প্রাণবন্ত ও সুললিত কথা আমি শুনেছি, তা যেন তোমার সঙ্গে আমার নৈকট্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। তার বিশ্বাস, তোমার সঙ্গে তার দেখা হবেই। সে আরও বিশ্বাস করে, কর্নি তাদের সম্রাজ্ঞী হবেই।

এদিকে এখানে এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সম্রাট তাঁর জামাতা জেনারেল কিউকেকাসকে বন্দী করেছেন। এই জেনারেল লাউডিসের স্বামী। তুমি যা ভাবছ তা নয়, জেনারেল কিউকেকাস সম্রাটকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে নি। অভিমান করে যুদ্ধে নির্লিপ্ত থেকেছে। তাতে একটি যুদ্ধে সেলুসিড বাহিনী হেরে গেছে। কর্নি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সম্রাটের কাছে। সম্রাটকে সে যা শোনাল, এককথায় অবিশ্বাস্য। তার তেজি আর বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক আমি। তারপরও জানি না সম্রাট কিউকেকাসের বিরুদ্ধে কী সিদ্ধান্ত নেবেন। চিন্তা হচ্ছে, মা আর লাউডিসকে নিয়েও। এ সংবাদ জানার পর সেলুসিয়ায় মা লাউডিসকে কীভাবে সামলাবেন? একটি মজার কথা শোনো, কর্নি যখন যুদ্ধক্ষেত্রে আসতে চাইল, লাউডিস প্রচণ্ড বাধা দিল। কিন্তু মা কর্নির আসার পক্ষে মত দিলেন এবং অশ্বযান পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। মা সবকিছুই জানেন। কর্নির সব কাজে তাঁর সমর্থন রয়েছে। আমাকে পর্যন্ত আসতে বাধ্য করলেন। ভেবো না আবার মা কর্নিকে তাঁর পুত্রবধূ করবেন

আরও কিছুদিন এখানে থাকতে হবে বলে মনে হচ্ছে। কবে আসতে পারব, বলা মুশকিল। কর্নি সেদিন কী বলল, জানো? বলল, সে যখন সম্রাজ্ঞী হবে, তোমাকে-আমাকে তার সাম্রাজ্যে নিয়ে এসে আমাকে জেনারেল বানাবে। হাস্যকর না সবকিছু? চন্দ্রগুপ্ত কেন আমাকে তাঁর জেনারেল বানাবেন? আরেক দিন বলল, সে আমাদের জন্য সিন্ধু অববাহিকায় পাহাড়ের ওপর একটি বাংলো করে দেবে, এখান থেকে সিন্ধুর চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। আর দেখা যায় আদিম আদিবাসী মানুষদের প্রকাশ্য মিলন। সে জায়গায়ই (মৌর্য এলাকায়) আমরা ছিলাম। বন্যরা বনে সুন্দর। আদিম বন্যতাও বনেই মানায়। কর্নি কি চায় আমরা শুধু বন্যতায় ডুবে থাকি?

এখানে সামনের দিনগুলো বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটবে। কখন কী হয়, বলা শক্ত। কর্নিকে এভাবে ফেলে রেখে চলে আসাও শোভনীয় নয়। সম্রাট আমার মামা হলেও আমাদের দূরত্ব অনেক। কর্নিও সে রকম দূরত্ব বজায় রাখে তার বাবার সঙ্গে। সম্রাট বোধ হয় সম্রাটই, বাবা বা মামা নয়। সবই ফরমাল। সম্রাজ্ঞীরাও দেখেছি তাই। ভাগ্য ভালো আমার মা সম্রাজ্ঞী নয়। তাই তাঁকে কাছে পেয়েছি। তাঁর গল্প অনেকবার বলেছি তোমাকে।

পত্রটা এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। কর্নি খুব ডাকাডাকি করছে। কে জানে নতুন কী পরিকল্পনা তার মাথায় এসেছে। তুমি তোমার কথা জানিয়ে মস্ত বড় একটা পত্র লিখবে। ভালো থেকো।

ইতি

তোমারই নিকো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *