মৌর্য – ৫৪

৫৪

সমর-পরিষদের সভা বসেছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভীষণ ক্ষুব্ধ। উত্তর থর মরুভূমিতে পরাজয়টা অপ্রত্যাশিতই নয়, সাংঘাতিক বাজে রকমের পরাজয়। হাতিগুলো খাদে পড়ে আছে। অসংখ্য সৈন্য মারা গেছে। বন্দী হয়েছে কয়েকজন। মৌর্যদের শাসন কায়েমের আগে নন্দরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও এ রকমটি ঘটে নি। এত ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। মহামন্ত্রী চাণক্য দক্ষিণ থরের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য বুক ফুলিয়ে কথা বললেও এখন মাথা নত করে আছেন। স্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রধান সেনাপতি ভয়ে ভয়ে বললেন, মহামন্ত্রী পরিকল্পনাটা ঠিকই নিয়েছিলেন, মহামান্য সম্রাট।

কী পরিকল্পনা করেছিলেন? আক্রমণটা কে আগে করেছিল? গোয়েন্দা তথ্যে কী বলা হয়েছিল?

উচ্চ ও তেজি কণ্ঠের এতগুলো প্রশ্ন শুনে চুপসে গেলেন প্রধান সেনাপতি বিজয়গুপ্ত।

নির্বিকারভাবে উঠে দাঁড়ালেন সেনাপতি সদাচার ভট্ট। তিনি এই ফ্রন্টে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে সম্রাট সেখান থেকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বললেন, ক্ষমা করবেন, মহামান্য সম্রাট, যা ঘটে গেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। দুটি বিষয় এখন আমাদের সামনে। হাতিগুলোকে উদ্ধার করে আনা এবং আটককৃত সৈন্যদের ফেরত আনা। দক্ষিণ ফ্রন্টে আমাদের হাতে আটক হওয়া গ্রিক সৈন্যদের বিনিময়ে আমরা আমাদের আটক হওয়া সৈন্যদের ফেরত আনতে পারি।

তুমি আমাকে সন্ধি করতে বলছ, প্রায় চেঁচিয়ে বললেন সম্রাট।

সদাচার আগের মতোই নির্ভীকভাবে বললেন, যুদ্ধবন্দী বিনিময়ে কোনো চুক্তি বা সন্ধির প্রয়োজন হয় না। সন্ধি করতে হয় পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নতজানু হয়ে। সেটা গ্রিকরাই করবে। তারাই নিজেদের সৈন্য ফেরত চাইবে। আমরা সে সুযোগ কাজে লাগাতে চাই।

তুমি ভুল বলছ, সদাচার। মহামান্য সম্রাটের কথা তুমি বুঝতেই পারো নি। আমরা যুদ্ধ করে গ্রিকদের পরাজিত করে আমাদের হাতি আর সৈন্যদের উদ্ধার করে আনব, অনেক ভেবে কথাটা বললেন চাণক্য। তাঁর উদ্দেশ্য দুটি: তিনি চান তাঁর প্রথম আক্রমণের কথাটা চাপা পড়ে থাক; দ্বিতীয়ত, ক্ষুব্ধ হোন আর যা-ই হোন, সম্রাট যেন যুদ্ধে ব্যস্ত থাকেন

গোয়েন্দাদের সংবাদ ছাড়া আক্রমণের কারণ কী, আচার্য? সম্রাটের ক্ষুব্ধ মনোভাব এখনো অটুট আছে।

মহামন্ত্রী চাণক্য বললেন, আক্রমণটা ওরাই আগে করেছে। আমাদের সৈন্যরা তাড়িয়ে নিয়ে গেছে কাপুরুষদের।

আমি গোয়েন্দাদের কথা বলছি। আপনি ওদের আমার সামনে হাজির করবেন। গজারোহী সৈন্যদের অধিনায়ক, এবার তুমি বলো এত বড় বিপর্যয় কেন হয়েছে?

এই অধিনায়ক তক্ষশীলার বাসিন্দা। বড় হয়েছে অযোধ্যায়। নাম লক্ষ্মণ রাও। ভদ্র স্বভাবের। দাঁড়িয়ে মাথা নত করে বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমাদের পদাতিক, রথী ও অশ্ববাহিনী যখন পেরে উঠছিল না, তখন হস্তীবাহিনীকে আক্রমণভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্তর্ভেদী ব্যূহ রচনা করেছিলাম আমরা। হস্তীবাহিনী ছিল সব বাহিনীর পেছনে।

প্রথম যুদ্ধে কী ধরনের ব্যূহ ছিল, আচার্য?

মিশ্র ব্যূহ।

এবার পরিবর্তন হলো কেন?

প্রথমে মধ্যভেদী ব্যূহ রচনা করতে চেয়েছিলাম। আপনার অনুপস্থিতির কারণেই সম্রাট হস্তীবাহিনী সামনে দিতে চাই নি। এ ছাড়া এবারের যুদ্ধে কৌশল পরিবর্তন করা হয়েছে।

তার অর্থ পদাতিকদের ব্যবহার করা হয় নি?

ওরা পরিখা খনন করেছিল হস্তীবাহিনীকে লক্ষ্য করে।

মন্ত্রীর কথায় সম্রাট শ্লেষের সঙ্গে বললেন, আপনি তাদের লক্ষ্য সফল করে দিলেন। আজকে আর সভা নয়। কাল সকালে আবার সভা বসবে। প্রধান সেনাপতি, তুমি যুদ্ধের সবগুলো কৌশল নিয়ে রাতেই আমার সঙ্গে কথা বলবে। পদাতিক, অশ্বারোহী, রথারোহী ও গজারোহী বাহিনীর অধিনায়কেরা থাকবে। আচার্য আগামীকাল সভায় যোগ দেবেন।

এদিকে দক্ষিণাঞ্চলে পরাজয় সত্ত্বেও উত্তর থরের যুদ্ধে বিরাট জয় গ্রিক শিবিরে উল্লাস এনে দিয়েছে। উৎসব-উল্লাস শেষে এরাও সমর-পরিষদের সভা আহ্বান করেছেন। উদ্দেশ্য, ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা। আলোচনার মধ্যেই হঠাৎ রাজ্যের নীরবতা নেমে এল। দক্ষিণ থরের যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ খতিয়ে দেখার পর এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জেনারেল আর্কিেেডস স্পষ্টই জানালেন, জেনারেল কিউকেকাসের দোরি বাহিনী যুদ্ধে অংশ নেয় নি। কিউকেকাস বিজয় উৎসবেও আসে নি, এখানেও নয়।

এই জেনারেল সম্রাটের জামাতা। সম্রাট আর্কিমেডেসের উদ্দেশে বললেন, তুমি কি কিছু অনুমান করতে পারো?

সেদিন সমর-পরিষদের সভা শেষে ফিরে যাওয়ার সময় তিনি আমার সঙ্গে রাগারাগি করেন। একপর্যায়ে বলেন, আমি কেন তার মত সমর্থন করি নি।

সে তো কোনো মতামতই রাখে নি, বললেন সেলুকাস। জেনারেল ফিলেকাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ওকে খবর দাও। সভায় আসে নি কেন? এটি ভালো লক্ষণ নয়, উত্তর থরে পাঠালে তো সর্বনাশ হয়ে যেত।

জেনারেল ক্লদিয়াস সম্রাটকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন, হয়তো কোনো সমস্যা ছিল, যুদ্ধে কেউ ইচ্ছা করে হারে না। মহামান্য সম্রাট, একান্তে তা জেনে নিলে উত্তম হয়।

এটি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়, ক্লদিয়াস। সবার সামনেই তাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে। প্রয়োজনে বাহিনীকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হবে।

জেনারেল ফিলেকাস উত্তর থরে বিজয়ী জেনারেল। এখন তাঁর গুরুত্ব অনেক। এমনিতেও সম্রাট তাঁকে পছন্দ করেন। বললেন, মহামান্য সম্রাট, যেকোনো মানাভিমান, বিরোধ যুদ্ধের জন্য ক্ষতিকর। একিলাসের ক্রোধ ট্রয়ের যুদ্ধে একিয়ানদের পরাজয়ের মুখোমুখি করেছে। আমরা জেনারেল কিউকেকাসের কথা শুনি। তারও তো বক্তব্য থাকতে পারে।

তুমি ঠিক বলেছ। ডাকাও তাকে।

.

মহামন্ত্রী চাণক্য সমর-পরিষদ সভা থেকে উঠে সরাসরি চলে গেলেন ভদ্রবাহুর কাছে। যাওয়ার সময় তাঁর মনে হলো অর্থশাস্ত্রে যে কথা বলেছিলেন, তা-ই এখন প্রযোজ্য হতে যাচ্ছে তাঁর নিজের বেলায়। তিনি পঞ্চম অধিকরণের ৯৩ নম্বর প্রকরণে বলেছিলেন, রাজা যদি কাউকে দেখামাত্র ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, তার দিকে না তাকান, দর্শনমাত্র মুখাবয়ব ও কণ্ঠস্বর বদল করেন, তার কাজের নিন্দা করেন, এসব লক্ষণ দেখে বুঝতে হবে রাজা উক্ত ব্যক্তির প্রতি প্রসন্ন নন।

ভাবলেন তাঁকে রাজা বানিয়েছেন তিনি। ভুল করেছেন তাঁর সমান্তরাল দ্বিতীয় কাউকে তৈরি না করে। এখন চাইলেও কাউকে রাজার আসনে বসাতে পারবেন না। তবে তিনি চন্দ্রগুপ্তকে পছন্দ করেন। চন্দ্রগুপ্ত অযথাই মাঝেমধ্যে তাঁকে ভুল বোঝেন। তিনি অবশ্য চন্দ্রগুপ্তকে যন্ত্রণা কম দেন না। মাঝেমধ্যে মনে হয় এরূপ যন্ত্রণা দেওয়া তাঁর এখতিয়ারে আছে।

এ রকম ভাবতে ভাবতে ভদ্রবাহুর কাছে উপস্থিত হলেন। ভদ্রবাহু হাস্যসহকারে তাঁকে বরণ করে বললেন, কী সৌভাগ্য! মহামন্ত্রীর আগমন ঘটেছে। তিনি শর্মিলাসহ অপরাপর শিষ্যদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। স্থূলভদ্রকে উদ্দেশ করে বললেন, স্থূল, তুমি ওদের নিয়ে যাও। আমি আচার্যের সঙ্গে কথা বলছি।

মনটা ভালো নেই, আচার্য, ওরা চলে গেলে প্রথম কথা বললেন চাণক্য

কেন? আবার কী হয়েছে?

উত্তর থরের যুদ্ধে আমরা হেরে গেছি। সম্রাট এর জন্য দায়ী করছেন আমাকেই।

যুদ্ধ করেছে সেনাবাহিনী, আপনি দায়ী হবেন কেন?

এ কথা তাঁকে কে বলবে?

আমিই বলব, আমার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হচ্ছে। রাতে কথা বলব।

পুরো ব্যাপারটা না জেনে বলবেন কী করে?

আগ্রহ দেখিয়ে ভদ্রবাহু বললেন, বেশ, বলুন তাহলে।

দক্ষিণ থরের যুদ্ধে জয়লাভ করায় সম্রাট বেশ উৎফুল্ল ছিলেন। হঠাৎ সংবাদ পাওয়া গেল উত্তরের অবস্থা খারাপ। কৌশলগতভাবে মধ্য মিশ্র ব্যূহ রচনা করা হয়েছিল।

আক্রমণের জন্য?

হস্তীবাহিনীর আক্রমণ দ্বিতীয় সারিতে ছিল। সামনে ছিল অশ্ব।

পদাতিক?

ছিল না। আমি সম্রাটকে অন্তর্ভেদী বূহ্যের কথা বলেছি।

পদাতিক বাহিনী ছিলই না?

নামমাত্র ছিল।

উদ্দেশ্য কী ছিল, বলুন তো?

উত্তর থর পাহাড়, উচ্চভূমি, আর ঘন বনাঞ্চলসংলগ্ন। আমার মনে হয়েছে, এখানে আক্রমণের জন্য অশ্ব ও হস্তীবাহিনীই উপযুক্ত।

আগে নিশ্চয়ই ওরা আক্রমণ করে নি?

আমরাই করেছি, তবে তা সম্রাটের কাছে গোপন রাখা হয়েছে।

সম্রাট দুটো বিষয়ই জানবেন। তাকে কেন ভুল বোঝানোর সুযোগ করে দিলেন? রাতেই তিনি ব্যাপারটা জেনে যাবেন। চিন্তা হচ্ছে সে জন্য। ভুলের নিজস্ব একটা চক্র আছে। একবার ভুল হতে শুরু করলে বারবার হয়, বলে হাসলেন ভদ্রবাহু। পরে আবার বললেন, রাতের বৈঠকে আমিও যাচ্ছি। দেখি কী বলা যায়।

আপনার কাছে তিনি আশীর্বাদ চাইবেন।

পরামর্শও চাইতে পারেন। কিন্তু আমি একটা বিষয়ে অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে আপনি অর্থশাস্ত্রে যে কথা বলেছেন, বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্রে তা প্রতিপালন করা হয় নি

আমি সেখানে কী বলেছিলাম, আচার্য?

মনে করে দেখুন।

বলেছিলাম, যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক, অশ্ব, রথ ও হস্তীবাহিনীকে আঘাত করার ক্ষেত্রে রাজাকে ক্রমানুযায়ী পরেরটি দিয়ে প্রথমটিকে আঘাত করতে হবে। পদাতিক সেনাদের অশ্বারোহী সেনাদের মাধ্যমে, অশ্বারোহীদের রথারোহীদের মাধ্যমে এবং রথারোহীদের গজারোহীদের মাধ্যমে প্রতিঘাত করবেন। বাস্তবে তা মানা হয় নি।

বাস্তব বড় কঠিন, আচার্য, বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে কথাটা বললেন চাণক্য। বাস্তবের যুদ্ধক্ষেত্র কল্পনা-পরিকল্পনা থেকে আলাদা।

আমার মনে হয় মিশ্র ব্যূহ তৈরি করে আক্রমণ করাই শ্রেয় ছিল। পদাতিক বাহিনীকে কোনো অবস্থায়ই গুরুত্বহীন মনে করা ঠিক নয়।

এখন তো তাই মনে হচ্ছে।

মন খারাপ করবেন না, আচার্য। এ যুদ্ধটায় আমাদের জয়লাভ করতেই হবে। আমাদের জয়লাভই সব সমস্যার সমাধান।

এ কথায় চাণক্য শুধু মাথা নাড়লেন।

.

জেনারেল কিউকেকাস ন্যূনতম মাথা নিচু করেই সম্রাট সেলুকাসের সামনে দাঁড়ালেন। সম্রাট ইশারায় তাঁকে বসতে বললেন। তোমার কি কোনো শারীরিক অসুস্থতা বোধ হচ্ছে?

না সম্রাট, আমি ভালো আছি।

তাহলে তুমি সমর-পরিষদের সভায় এলে না কেন?

ক্ষমা করবেন সম্রাট, যে পরিষদে পরিকল্পনা ঠিক হয় না, সিদ্ধান্ত ঠিক হয় না, সে পরিষদ সভায় এসে কী হবে?

সম্রাট উত্তেজিত, তারপরও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, তুমি সব সমর-পরিষদ সভায় উপস্থিত থাকো। তুমি কি কোনো পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত দিয়েছ?

আমি ওসবের বিরুদ্ধে বলেছি, আমার কথা রাখা হয় না।

শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করলে চলবে কেন? গঠনতান্ত্রিক মতামত বা পরিকল্পনাটাও তো দিতে হবে।

কিউকেকাস এর প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না। সেলুকাস আবার বললেন, তুমি তোমার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নির্লিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন?

আক্রমণ করার প্রয়োজন মনে করি নি, তাই।

এবার সম্রাট ফেটে পড়লেন, যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাকে কি তামাশা দেখার জন্য পাঠানো হয়েছে? কে আছ, ওকে নিয়ে যাও, বন্দী করে রাখো। সামরিক আদালতে তার বিচার হবে।

আর্কিমেডেস, আমিও তোমাকে দেখে নেব। কোনো প্রিন্সকে আমি সামান্যই হিসাব করি। আমি দেখে নেব, যেতে যেতে উচ্চ স্বরে বলছিলেন কিউকেকাস।

সভায় সবাই চুপ করে আছেন। পিনপতন নীরবতা। সম্রাট নিজেকে সামলে নিতে কিছু সময় নিলেন। পরে ধীরস্থিরভাবে বললেন, দোরি বাহিনীর দায়িত্ব নেবে জেনারেল ক্লদিয়াস।

সম্মানজনক ও আক্রমণাত্মক এই বাহিনীর দায়িত্ব পেয়ে ক্লদিয়াস দাঁড়িয়ে সম্রাটের উদ্দেশে মাথা নত করলেন।

জেনারেল সারিকাস বললেন, সম্রাটের দূরদর্শিতাকে শ্রদ্ধা জানাই। নির্বাচন অসাধারণ হয়েছে।

এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে, জেনারেল। গ্রিকরা ভারতীয়দের কাছে হারবে, তা হয় না। আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করব। সব রকম রণকৌশল কাজে লাগাব। সেলুসিড বাহিনী আগামীতে আরও বীরবিক্রমে লড়ে যাবে। আমি সব সময়ই তোমাদের সঙ্গে থাকব। আর একটি কথা, কোনো রকম গাফিলতি আমি সহ্য করব না, আপনজন হলেও না। কিউকেকাস যে কাজ করেছে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। যুদ্ধ পরিকল্পনা আগের মতোই থাকবে। পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।

.

মৌর্য শিবিরে প্রায় মধ্যরাত, বিশেষ সভা চলছে চাণক্যকে বাদ দিয়ে। তাঁর কথা এখানে কেউ উচ্চারণও করল না। না নিন্দায়, না প্রশংসায়। আচার্য ভদ্ৰবাহু এদিকে মনোযোগ রাখছিলেন। প্রসঙ্গ উঠলেই কথা বলবেন। সুযোগ হচ্ছে না। প্রচুর আলোচনা-পর্যালোচনার পর সম্রাট নতুন যুদ্ধ পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন। ধনুকধারী সৈন্যদের পাঁচ হাত ব্যবধানে অবস্থান করাতে হবে। অশ্বসেনারা অবস্থান করবে পনেরো হাত ব্যবধানে। পঁচিশ হাত ব্যবধানে অবস্থান করবে রথ ও হস্তীবাহিনীর সেনাসদস্যরা। অশ্বারোহী সৈন্যদের সম্মুখে তিনজন করে প্রতিযোদ্ধা অবস্থান করবে। রথ ও হস্তীসেনার সম্মুখে পনেরো জন করে প্রতিযোদ্ধা অবস্থান করবে। অশ্ব, রথ ও হস্তীসেনা সেবাকার্যের জন্য যথাক্রমে তিনজন এবং পনেরো জন করে পাদগোপ উপস্থিত থাকবে। উরস্যের মধ্যভাগে তিন কাতারে তিনজন করে নয়জন রথসেনা পদায়িত থাকবে। একইভাবে সেনাবিন্যাসের অগ্রভাগের দুপাশে এবং পশ্চাতে নয়জন করে রথসেনা মোতায়েন থাকবে। এই পদ্ধতিতে একটি রথসেনা ব্যূহের পাঁচটি অবস্থানে নয়জন করে পঁয়তাল্লিশ জন রথসেনা মোতায়েন হবে!

প্রতিটি রথের অগ্রভাগে পাঁচজন করে অশ্বারোহী সেনা অবস্থান করায় সর্বমোট ২২৫ জন অশ্বসেনা অবস্থান করবে। প্রতিটি রথের অগ্রভাগে পনেরো জন করে প্রতিযোদ্ধার উপস্থিতিতে মোট প্রতিযোদ্ধার সংখ্যা হবে ছয় শ পঁচাত্তর জন। এভাবে প্রতি অশ্বারোহীর সঙ্গে তিনজন করে ৬৭৫ জন পাদগোপ অবস্থান নেবে। একইভাবে রথ এবং হস্তীসেনার সঙ্গে একই অনুপাতে সেনা এবং পাদগোপ মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি বাহিনীর শেষ সৈন্য পর্যন্ত এ বিন্যাস চলবে এবং কার্যকর থাকবে।

সম্রাটের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার পর অধিনায়কেরা একে একে উঠে গেলেন। ভদ্রবাহু বসে রইলেন। এবার চন্দ্রগুপ্ত ভদ্রবাহুর সঙ্গে কথা বললেন, আচার্য, আশীর্বাদ করবেন যুদ্ধে যেন জয়লাভ করি। পরিকল্পনাটা শুনেছেন নিশ্চয়ই।

জানি সমর আচার্যরা একে সমব্যূহ বিন্যাস বলেছেন। শুক্লাচার্য, বৃহস্পতি, কৌটিল্য—সবাই এই সমব্যূহের প্রবক্তা। প্রথম যুদ্ধটা এ রকম সমব্যূহ বিন্যাসেই হয়েছে।

তাই বিজয় সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু এতে রক্তপাতের সম্ভাবনা বেশি।

যুদ্ধে রক্তপাত হবে চন্দ্র, একে বন্ধ করতে হয় কৌশলে।

আমি রক্তপাত চাই না, যুদ্ধে জয়ী হতে চাই।

কীভাবে?

যেমন করেই হোক, যত কূটকৌশলেই হোক।

কী কী কৌশলের কথা ভাবছ তুমি?

ভেদনীতি, বিভেদনীতি, শত্রুদের বিরুদ্ধে বিবাদ সৃষ্টি, অর্থ প্রণোদনা; রাজকুমার, সেনানায়ক, অমাত্য সবাইকে কার্তান্তিক গুণকীর্তনসহ নারীসুখ প্রদান, তাদের পক্ষত্যাগীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ওদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া, ইন্দ্রজালের মাধ্যমে শত্রুদের বিভ্রান্ত বা মতিভ্রম ঘটানো, হাতে না আসা শত্রুদের বিষ প্রয়োগে হত্যা করা, নানা রটনা সৃষ্টি করে মনোবল ভেঙে দেওয়া—এসব আরকি?

কারা করবে এসব কাজ?

গুপ্তচরেরা করবে। নানা বেশ ধরে যাবে এরা।

চন্দ্রগুপ্তের এসব কথা শুনে হেসে দিলেন ভদ্রবাহু, বললেন, চন্দ্র, এসব তোমার কাজ নয়, এসব মহামন্ত্রী চাণক্যের কাজ।

আচার্যের কথা শুনতে চাই না আমি। অনেক সহ্য করেছি। একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে চলেছেন তিনি। এত বড় পরাজয় শুধু তাঁরই জন্য। তাঁকে আগে আক্রমণ করতে বলেছে কে? আমার অনুপস্থিতির সুযোগে তিনি কী না করেছেন? গ্রিক রাজকন্যা এলেন সাক্ষাৎ করতে, তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন, সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর জন্য তিনিই দায়ী। অতীতেও অনেক অঘটন ঘটিয়েছেন। কত সহ্য করা যায়?

তুমি শান্ত হও, চন্দ্র। চলো, আমরা একটু বাইরে হাঁটি।

বাইরে চাঁদের আলো। খুব তীব্র নয়। বিলম্বে উদিত হওয়া চাঁদের আলোয় স্বচ্ছতা বা ফুটফুটে ভাব কম থাকে। আলোটা মিষ্টি না হলেও মন্দ না। মৃদুমন্দ বাতাসও আছে। বসন্তের বাতাস।

ভদ্রবাহু বললেন, চন্দ্র, তুমি আচার্য চাণক্যকে দোষ দিয়ো না, প্রিন্সেসকে আমিই ফেরত পাঠিয়েছি।

আপনি? চন্দ্রগুপ্তের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।

সে সময় এটাই ছিল উত্তম সিদ্ধান্ত।

বলেন কী, আচার্য! চন্দ্রগুপ্তের কণ্ঠ যেন গলে যাচ্ছে।

আমার কার্তান্তিক ভাবনায় প্রিন্সেসের মারাত্মক ক্ষতি দেখেছিলাম। তোমাদের সাক্ষাটাও শুভ হতো না। তুমি যুদ্ধের যে পরিকল্পনা করেছ, তাই তোমার জন্য জয় বয়ে আনবে। আর পুরো পরিকল্পনার প্রায় সবটাই মহামন্ত্রীর।

আমি তো কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে এ পরিকল্পনা নিয়েছি।

তিনিই কৌটিল্য।

কৌটিল্য?

নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছেন। হয়তো ভেবেছেন শাস্ত্রপাঠে সম্রাট ও রাজাগণ তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হবেন। কথাটা তুমিও তোমার ভেতরে রাখো, প্রকাশ করার দরকার নেই। তিনি তোমার সবচেয়ে বড় শুভার্থী, চন্দ্র, তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা বা অবিচার কোরো না। একসময় নিশ্চয়ই আমি বলব কেন প্রিন্সেসকে চলে যেতে বলেছি এবং তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া সহজও ছিল না।

কেন তিনি আমার অবর্তমানে আক্রমণ করতে গেলেন?

যুদ্ধের দিকে তোমার মনোযোগ সৃষ্টির জন্য, তুমি যেন শোকে পাথর হয়ে না যাও, সে জন্য, তুমি যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসো, সে জন্য।

সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী নন?

না, দায়ী নন, রাজপুত্রকে বাঁচানোর কোনো বিকল্প ছিল না। তুমি ব্যাপারগুলো এভাবে দেখো, দেখবে স্বস্তি আসবে, শান্তি আসছে। এ ছাড়া এ যুদ্ধ জয়ের জন্য চাণক্যের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। তিনি এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। এ শক্তির প্রতি অবজ্ঞা হবে আত্মঘাতী।

আমাকে ভাবতে দিন, আচার্য।

হ্যাঁ, ভেবেই সিদ্ধান্ত নাও। আমিও চাইছি তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে।

.

মহামন্ত্রী চাণক্য রাতে ঘুমোতে পারছেন না। ঘুমোতে তিনি চেষ্টা করছেন বলে মনে হয় না। অনিদ্রা নিয়ে হাঁটছেন, ভাবছেন ও পায়চারি করছেন। মানবজীবনে নানা ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন ঘটে, এটাই তাঁর এখনকার ভাবনা। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, সকালের সমর-পরিষদ সভায় তিনি যাবেন না। যুদ্ধ এখন সম্রাটই করুন। যুদ্ধবিদ্যা তিনি চন্দ্রগুপ্তকে কম শেখান নি। এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সব যুদ্ধেই তিনি ছিলেন। নেতৃত্ব তো তিনি দিয়েছেন। সে দিনের রাস্তার ছেলে চন্দ্রগুপ্ত, এখন চোখ রাঙায়। সহ্যের তো সীমা আছে। সব ছেড়ে বনবাসে চলে যাবেন। আজীবিকরা তাই করেন। বিদ্রোহ করেই এ ধর্মের জন্ম। যা পূর্বনির্ধারিত, তা ঘটবে। সুতরাং যা ইচ্ছা করো। আগে ভাবো কেন একই ঘটনা বারবার ঘটে। মনে হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো এক অনুঘটক বারবার একই ঘটনা ঘটাচ্ছে। জলের পিপাসা পাচ্ছে। জল পান করলেন তিনি। জল পানের কালেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হঠাৎই আবিষ্কার করলেন যেন। আবার এক গ্লাস জল পান করলেন। ঘটনাটা একই রকম। পৃথিবীতে ঘটনার পুনরাবৃত্তি অস্বাভাবিক কিছু নয়। সম্রাট বারবার একই ঘটনার জন্ম দেবেন, তা-ই স্বাভাবিক। আমিও ঘটনার শিকার হব, তা স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাপারটা আগে বুঝতে পারার মধ্যে সমস্যা কোথায়? কোশল দেশের রাজা পরন্তপ। এই রাজার মন্ত্রী কনিষ্কের বাম দিক দিয়ে টৌঞ্চ পাখি অস্বাভাবিকভাবে উড়ে গেলে তিনি রাজাকে পরিত্যাগ করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। আমিও তা-ই করব। আমার কিন্তু এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। সম্রাট রুষ্ট হয়েছেন, আমার কিছু হয় নি। রাজা-বাদশাহদের অবশ্য বুক-পিঠ নেই, একবার কিছু হয় নি তো কী হয়েছে, এবার কিছু একটা ঘটিয়ে দেবে। ঘাতক ডেকে এনে শূলে চড়াবে। বিদ্রোহ করলে কেমন হয়?

কিছু সৈন্য তো অনুগত আছেই। না, তার ফল ভালো হবে না। অযথা অনেকের প্রাণ যাবে। আমি আমার অবস্থানেই থাকব, দেখি নিয়তি কোথায় নিয়ে যায়। যা অনিবার্য, সেদিকেই যেতে হবে। আত্মবিশ্বাস রাখো হে চাণকপুত্র। আত্মবিশ্বাস হারালে তুমি একেবারে শূন্য। এক পণ ও দাম নেই।

.

ভোর হচ্ছে। পূর্ব আকাশ ক্রমে উঠে আসছে অন্ধকারের খোলস ছেড়ে। চাণক্য সেদিকে তাকিয়ে আছেন। ব্যাপারটা আজ তাঁর কাছে ভালো লাগছে না। অন্ধকারে ডুবে থাকতে ইচ্ছা করছে। একসময় কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ ডুবে যেতে দেখেছেন। সব আশা-ভরসাই যেন ডুবে যাওয়া। ডুবে যাওয়া অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকতেই ভালো লাগছিল। আলোর আবির্ভাব বিরক্তি উৎপাদন করছে। ঘুমোতে পারলে ভালো লাগত। হঠাৎ দেখা গেল কে যেন দূর থেকে আসছে। ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে ছবিটি। নিরাপত্তা রক্ষীরা তাকে ঘিরে ধরেছে বহিরতোরণের কাছে। একজন মনে হয় চেনে তাকে। ভেতরে প্রবেশ করতে দিল।

লোকটি চাণক্যের সামনে এসে দাঁড়াল।

তুমি এত ভোরে কোথা থেকে এলে?

আচার্য, একটা সংবাদ নিয়ে এসেছি।

তুমি ভেতরে ছিলে?

ছিলাম। সংবাদ পেয়েই ছুটে এলাম।

কী সংবাদ, বলো।

গ্রিকদের এক জেনারেলকে বন্দী করা হয়েছে। নাম কিউকেকাস, সেলুকাসের জামাতা।

কারণ কী?

দক্ষিণ থরের যুদ্ধে গ্রিকদের পরাজয়ের জন্য তাকে দায়ী করা হয়েছে।

সংবাদটা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে গেছ মনে হয়।

ক্ষমা করবেন, আচার্য, গ্রিক শিবিরে এটাই এখন সবচেয়ে আলোচিত খবর।

উত্তর থরে আটক যোদ্ধা ও হাতিদের কী অবস্থা, বলো?

যোদ্ধাদের বন্দিশালায় রাখা হয়েছে। তবে মর্যাদার সঙ্গে। আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাতিগুলো এখনো পরিখায় পড়ে আছে। ওরা তুলতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু হাতিগুলো গোঁ ধরে আছে।

এগুলোকে মারধর করে নি তো?

না, করে নি। কে বা কারা রটিয়েছে যে এখানে সম্রাটের হাতি রয়েছে। সম্রাটের মাহুত ধরা পড়েছে। এতে প্রিন্সেস এসে এগুলো দেখে আদেশ দিয়ে গেছেন, হাতিগুলোকে যেন যত্ন করা হয় এবং ভালো খাবার দেওয়া হয়। কোনো অবস্থাতেই যেন মারধর না করা হয়। বন্দী সৈন্যদের বেলায়ও তিনি একই আদেশ দিয়েছেন।

অবাক করলে তুমি, গুপ্তচর। আচ্ছা, তুমি যাও।

সম্রাটের সঙ্গে মহামন্ত্রীর কী চলছে, ভদ্রবাহু, দু-এক জন সেনাপতি এবং নিকট অমাত্য ছাড়া আর কেউ জানেন না। গোয়েন্দারাও সে খবর পায় নি। তাই চাণক্য এ গোয়েন্দার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করলেন। গোয়েন্দাকে বিদায় করে নতুনভাবে ভাবনার সংকটে পড়ে গেলেন। এ দুটো সংবাদ সম্রাটকে জানানো দরকার। কিন্তু তিনি যেতে চান না। এ দুটো সংবাদ যুদ্ধের বিজয়ে নতুন দ্বার খুলে দিতে পারে। এক. ওদের শক্তি বিভক্ত হচ্ছে। দুই. একটি দুর্বল দিক জানা গেছে। চাণক্য মনে করেন, শত্রুর প্রতি সহানুভূতি কিংবা ভাবাবেগের ব্যবহার দুর্বলতার পরিচয় বহন করে। তখনই শত্রুকে চেপে ধরতে হয়। সম্রাটের কাছে গোয়েন্দাকে কি পাঠাবেন? না, আরও ভুল বুঝতে পারেন। প্রিন্সেস একটা স্পর্শকাতর বিষয়। চাণক্যের কাছে খুবই অদ্ভুত লাগছে, যেখানে রক্তগঙ্গা বইছে, সেখানকার বাতাসে রক্তের ঘ্রাণ ভেসে বেড়ানোর কথা, অথচ সেখানে ভাসছে বেলিফুলের গন্ধ

সূর্যের আবির্ভাব না ঘটলেও আলো ফুটছে। অন্ধকার নেই বললেই চলে।

দূরে একটা শকট দেখা যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ কেউ আসছেন মনে হয়। চাণক্যের দৃষ্টি নিবদ্ধ সেদিকে। ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে, এই প্রত্যুষে কে আসছেন। শকট থেকে নেমে এলেন ভদ্ৰবাহু নিজে। মুখে স্মিত হাসি। এ হাসিতে তাঁর সৌম্যভাবটি ভোরের প্রস্ফুটিত পুষ্পের মতো আরও বিকশিত হয়। কিন্তু নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি তাতেও ছায়া বিস্তার করে আছে।

চাণক্য তাঁকে দেখে স্মিত হাসলেন। বললেন, আচার্য, মনে হয় আমার মৃত্যুদণ্ডের চিন্তায় রাতে ঘুমোতে পারেন নি।

আপনি যে সমস্যায় ফেলেছেন নিজেকে, বলুন তো কী করে ঘুমোই, আপনার সমস্যাটা কি আপনার একার, আমার তো বটেই, পুরো মৌর্য সাম্রাজ্যেরও। চলুন বসি কোথাও, নাকি দাঁড়িয়ে কথা বলব?

না না, আসুন আঙিনার দোলনায় বসি। বসতে বসতে চাণক্য আবার বললেন, দোলনা আর ফাঁসির মঞ্চে পার্থক্য কোথায়? উত্তরটাও নিজেই দিলেন, দোলনায় বসে দোল খাওয়া হয়, আর ওখানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে। দুটোই দোলায়, একটা আনন্দ দেয়, আরেকটা প্রাণ কেড়ে নেয়। বলে উচ্চ স্বরে হাসলেন। এবার বলুন কী হেতু আগমন?

কারণটা খুব ছোট। সকালের সমর-পরিষদ সভায় যাচ্ছেন তো?

না, যাচ্ছি না।

কেন?

এ অপমানটা কি আপনি সহ্য করতেন?

আপনি খুবই জেদি, আচার্য। এমনও তো হতে পারে, এর দ্বারা আপনাকে পরীক্ষা করছেন সম্রাট?

এখনো আমাকে পরীক্ষা দিতে হবে?

তা আপনার মনে হতেই পারে। কিন্তু আমি আপনাকে বলেছিলাম দূরে থাকা যাবে না, কোনো দূরত্ব সৃষ্টি করা যাবে না। সে সময় তা আপনি উপলব্ধি করেছিলেন। এখন কেন তা বুঝতে চাইছেন না?

এ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় আমার কি কোনো ভূমিকা নেই?

অর্ধেক বলছেন কেন? সম্রাট চন্দ্রগুপ্তকেও সৃষ্টি করেছেন।

তাহলে?

তাহলে কি এ সাম্রাজ্য ও সম্রাটের পতন চেয়ে চেয়ে দেখবেন? আমি আপনার অভিমানের কথা জানি। সেখানে সভায় যান, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। আপনার চন্দ্রগুপ্ত আগের মতোই আছে।

আপনি কি রাতে সম্রাটের কাছে গিয়েছিলেন? কী বললেন তিনি?

গিয়েছিলাম, আপনি যাকে বলেন আধ্যাত্মিক পরামর্শদান (কাউন্সেলিং), সে কাজ করেছি। তখন মাথাটা গরম ছিল। আশা করি এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে।

কী বললেন তিনি?

যে কথা আপনাকে বলেছেন, তাই। একজন সদ্য বিপত্নীক স্বামীর কষ্ট যার মধ্যে, তার যন্ত্রণার প্রকাশ তো থাকবেই। আমাদের সহ্য করতে হবে।

সে স্থান তো পূরণ হতে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক সংবাদ শুনুন, প্রিন্সেস উত্তর থরের যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। এক গুপ্তচর এসে বলল, তিনি নাকি শুনেছেন, পরিখায় পড়ে যাওয়া হাতিগুলোর মধ্যে সম্রাটের হাতিও রয়েছে। বোঝার উপায় নেই কোনটি সেই হাতি। তাই আদেশ দিয়ে এসেছেন, বন্দী হাতিদের সঙ্গে যেন ভালো ব্যবহার করা হয় এবং ভালো খাবারদাবারের ব্যবস্থাসহ যত্ন-আত্তির কোনো অভাব না হয়। সে সঙ্গে বন্দীরাও সব সুবিধা পাবে।

অদ্ভুত কথা শোনালেন তো।

সংবাদটা অদ্ভুতই।

এ সংবাদটা কি সম্রাটকে দেবেন, বলে অর্থপূর্ণভাবে হাসলেন ভদ্রবাহু।

দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আমি তো সভায় যাচ্ছি না।

ভদ্রবাহু আবার হাসলেন। বললেন, গুরু-শিষ্যের মানাভিমান আর কতক্ষণ? এবার উঠুন, স্নান করে তৈরি হয়ে নিন। আপনাকে সেখানে পৌছে দিয়ে আমার বিদায়।

বিদায়! বিদায় অর্থ কী?

আমি পাটালিপুত্রে চলে যাব। সেখানে অনেক কাজ জমে আছে।

অবাক করলেন। যুদ্ধের শেষ তো দেখে যেতে হবে।

তার প্রয়োজন হবে না। যুদ্ধে আপনাদেরই জয় হবে। দুঃসময় থাকবে না, কেটে যাবে।

সে সময় আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

তার আর প্রয়োজন কী? তার আগে বলুন ঈশ্বর কোথায় থাকেন?

আমরা তো কেউ আর ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। একসময় আমি করতাম। যখন দুঃসময় আসত, ঈশ্বরের কথা বেশি মনে পড়ত।

দুঃসময় কেটে গেলে?

আবার ভুলে যেতাম।

ভদ্রবাহু হেসে দিয়ে বললেন, আপনাদেরও আমাকে ভুলে যাওয়ার সময় এসেছে। যান, তৈরি হয়ে নিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *