মৌর্য – ৫৩

৫৩

আগের যুদ্ধটায় বিভিন্ন সেনাদলের সৈন্যদের আক্রমণ ও অবস্থান সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিল না। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়েছে। এ ছাড়া উভয় পক্ষ প্রতিপক্ষের অস্ত্র ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন রেজিমেন্টের নাম জানলেও সাক্ষাৎ পরিচয়লাভ ঘটে যুদ্ধক্ষেত্রে। এবার যুদ্ধ পরিকল্পনায় উভয় পক্ষই অতীত অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে অগ্রসর হয়েছে।

যুদ্ধক্ষেত্রে উভয় সম্রাট, মন্ত্রী পদমর্যাদার রাজন্যবর্গ, সেনাপ্রধান ও জেনারেলরা উপস্থিত হয়েছেন। আগের মতো সবাইকে এবার সামনে নিয়ে আসা হয় নি। এঁরা এবার প্রথমেই যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন না, যুদ্ধে কমান্ড দিচ্ছেন এবং তত্ত্বাবধান করছেন নানা জায়গায় অবস্থান করে।

থর মরুভূমি বিশাল। স্থানীয়ভাবে কোনো লোকবসতি নেই। তাই স্থানীয় কোনো নাম নেই জায়গাগুলোর। উভয় পক্ষের কমান্ড নিজেদের বাহিনীর নামে অথবা সেনাবাহিনীর সেনাপতির নামে জায়গাগুলোর আলাদা আলাদাভাবে নামকরণ করেছে। নামগুলো অস্থায়ী। নাম খুঁজে না পেয়ে কেউ কেউ নম্বর ব্যবহার করেছে। গ্রিকরা যেমন ১ নম্বর ব্লক, ২ নম্বর ব্লক ইত্যাদি নামকরণ করেছে।

গ্রিকরা ১ ও ২ নম্বর ব্লক বলে যে স্থানগুলোকে নির্ধারণ করেছে, এ স্থান দুটি এখন মৌর্যদের টার্গেট। বিশাল এক সেনাবাহিনী দুদিনের পথ অতিক্রম করে সেখানে পৌঁছে গেছে। তাদের প্রত্যাশা ছিল গ্রিক বাহিনী ভয়ে পিছিয়ে যাবে। কিন্তু ওরা যায় নি। মৌর্য বাহিনী আগের যুদ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দূত পাঠাল না। কারণ, কোনো কোনো ফ্রন্টে যুদ্ধ চলছে ছোটখাটোভাবে। এরা দৌড়ে গিয়ে অশ্ববাহিনী, রথারোহী ও হস্তীবাহিনী নিয়ে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে বসল। গ্রিকরা সারিসা নিয়ে তৈরি ছিল। দূর থেকেই ঘোড়াদের টার্গেট করল। অসংখ্য ঘোড়া সারিসার আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল। কোনো কোনোটি দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিল। অশ্বারোহী সৈন্যরা মাটিতে পড়ে গেল বিপুল সংখ্যায়।

সারিসা বহনকারী সৈন্যদের পেছনের সারিতেই ছিল গ্রিক দোরি ও জিফোস বহনকারী সৈন্যরা। এরা অশ্বারোহী বাহিনীর পড়ে যাওয়া সৈন্যদের আক্রমণ করতে এগিয়ে এল। মৌর্য সৈন্যদের হাতে শিবের অস্ত্র ত্রিশূল, বিষ্ণু বা কৃষ্ণের সুদর্শন ও গদা, নন্দক ও তরবারি। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বেঁধে গেল।

মৌর্য পদাতিক বাহিনী দৌড়ে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে বেশ সময় লেগে গেল। তাদের পেছনে যে হস্তীবাহিনী, পদাতিক বাহিনীকে অতিক্রম করে হয়তো আগে যেতে পারত কিন্তু কৌশলগত কারণে যায় নি। পেছনেই রইল।

মৌর্য অশ্বারোহী বাহিনী প্রাণপণ যুদ্ধ করল। গ্রিক পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরাই প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিল। পেছনে তাদের সাহায্য করল অশ্বারোহী বাহিনী। গ্রিক অশ্বারোহী বাহিনী বেশ শক্তিশালী। সংখ্যায়ও অনেক। মৌর্য পদাতিক বাহিনী এসে এই বাহিনীর সামনে পড়ে গেল। খুব ক্ষয়ক্ষতি হলো তাদের।

একসময় হস্তীবাহিনীও এল। তা দেখে গ্রিকরা পেছনে সরে যেতে থাকল। এরা বিভিন্ন জায়গায় পরিখা খনন করে ওপরে বাঁশ-কাঠ ও লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। পশ্চাতে গিয়ে এরা মৌর্য হস্তীবাহিনীকে অগ্রসর হয়ে পরিখা পর্যন্ত যেতে দিল। আর তখনই দু-তিন টন ওজনের হাতিগুলোর বেশির ভাগই পরিখায় পড়ে গেল। হস্তীবাহিনীর হাতে ছিল তিনবাণ অস্ত্র, ইন্দ্ৰাস্ত্ৰ, মহেশাস্ত্র এবং রুদ্রাস্ত্র। ইন্দ্ৰাস্ত মূলত আগ্নেয়াস্ত্র। এই অস্ত্রবহনকারীদের অনেকেই নিজের অস্ত্রের শিকার হলো। কেউ কেউ অস্ত্র ছুড়তে পারল বটে কিন্তু দূরে গেল না, নিজেদের পদাতিক সৈন্যরাই তার শিকার হলো। অবশিষ্ট গোটা কতক হাতি তুমুল বিক্রমে লড়ে গেল এবং মৌর্য অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীকে পেছনে সরে যেতে সাহায্য করল। নিজেরাও সারিসা ও বিষাক্ত তিরের আঘাতে আহত, ক্ষতবিক্ষত ও বিধ্বস্ত হলো। বিষক্রিয়ায় প্রায় পাগল হয়ে কোনো কোনোটি মাহুতদের নিয়ন্ত্রণ মানছিল না। পায়ে দলে গ্রিক-মৌর্য সবাইকে নিধন করছিল।

মৌর্য বাহিনী পরাজিত হয়ে পেছনে সরে এল। কিন্তু গ্রিকরা অজানা কারণে তাদের পেছনে ধাওয়া করল না। শুধু পরিখায় পড়ে যাওয়া হস্তীবাহিনীকে ঘিরে রাখল। তাদের আরোহী সৈন্যদের একে একে বন্দী করে নিয়ে গেল।

যুদ্ধের আরেক গুরুত্বপূর্ণ ফ্রন্ট থর মরুভূমির দক্ষিণাংশে। গ্রিকরা আগে থেকে সেখানে অবস্থান করছিল। উদ্দেশ্য ছিল নতুনভাবে প্রলম্বিত সারিসে বাঁকিয়ে পূর্ব দিকে ঘুরে মৌর্য বাহিনীকে ঘিরে ফেলা। সেমতো সামনের সারি সারিকা-অস্ত্র কাঁধে নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে গেল। এ বাহিনীর কমান্ডে থাকা জেনারেল আর্কিমেডেস পরিকল্পনা মোতাবেক বেশ দক্ষতার সঙ্গেই যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন সামনে থেকে। পেছনের সারি থেকে উপজাতিদের বাঁশ-নৃত্যের মতো সামনের সারিতে সৈন্যরা যুক্ত হচ্ছিল।

ঐতিহ্যবাহী দোরি অস্ত্র হাতে জেনারেল কিউকেকাসের বাহিনী তাদের অনুসরণ করছিল। পরিকল্পনা ছিল আর্কিমেডেসের বাহিনী মৌর্য সৈন্যদের ঘিরে ফেলার পর দোরি অস্ত্রধারী কিউকেকাসের সৈন্যরা মৌর্যদের ওপর হামলে পড়বে।

আর্কিমেডেসের বাহিনী মৌর্যদের ঘিরে ফেলার পরও কিউকেকাসের দোরি অস্ত্রধারীরা রহস্যজনক কারণে মৌর্যদের হামলা না করে পেছনে সরে আসে। কমান্ডারের আদেশটা সে রকমই ছিল। ফলে সারিসা নিয়ে নবীন জেনারেল আর্কিমেডেস প্রাণপণ যুদ্ধ করে পরাজিত হলেন এবং কোনো প্রকারে জীবন রক্ষা করে পালিয়ে এলেন। গ্রিকদের শৌর্য-বীর্যের নতুন উদ্ভাবন দীর্ঘ লম্বা সারিকা অস্ত্রধারী সৈন্যদের অনেকেই আহত ও নিহত হলো। তবে তাদের ক্ষয়ক্ষতি হলো কম। কারণ, এরা শুরু থেকেই পলায়নপর ছিল।

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর বাঁ দিকের, অর্থাৎ দক্ষিণ দিকের যুদ্ধক্ষেত্র প্রথমে পরিদর্শন করতে গেলেন। যুদ্ধে তাঁর বাহিনীর জয় হয়েছে। মহামন্ত্রী চাণক্য বেশ উল্লসিত। বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমাদের যুদ্ধকৌশল খুব কাজে এসেছে। আমরা খুব কম সময়েই গ্রিকদের পরাজিত করব। আপনি যুদ্ধক্ষেত্রে আসাতে সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্রাট চাণক্যের এই তোষামোদঘন কথায় খুব একটা বিগলিত হলেন না, তবে জয়ে আনন্দিতবোধ করলেন। জয়ে আনন্দ থাকলেও সম্রাটের মনে শান্তি নেই। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুটা মানতে পারছেন না এখনো। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে যারা হতাহত হয়েছে, তাদের মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। একজন মৌর্য আহত হয়ে পড়ে আছে। তার হাতে তখনো সুদর্শনচক্র। চোখ বন্ধ করে কাতরাচ্ছে। সম্রাট তার কাছে গিয়ে সুদর্শনচক্রবদ্ধ হাতটা স্পর্শ করতেই সে ঝাড়া মেরে লাফিয়ে উঠে সম্রাটকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। পরক্ষণেই সম্রাটকে দেখে শুয়ে থেকেই বিনম্র শ্রদ্ধা জানাল। সে ভাবতে পারে নি স্বয়ং সম্রাট তাদের দেখতে এই যুদ্ধ-ময়দানে আসবেন। সম্রাট বললেন, আমার বীর সৈনিক। আমাদের জয় হয়েছে এ যুদ্ধে। তোমরা বীরদর্পে ওদের হারিয়ে দিয়েছ। আমার গর্ব হচ্ছে তোমাদের নিয়ে। সৈন্যটি জল চাইল। সম্রাট নিজের থলে থেকে জল পান করালেন এবং মহামন্ত্রীকে বললেন, আহতদের দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আরও একটু অগ্রসর হয়ে দেখলেন, শিব অস্ত্র ত্রিশূলের আঘাতে একজন গ্রিক সৈন্য মরে পড়ে আছে। তার হাতের সারিসাটা বেশ কিছু দূরে একটি অশ্বের শরীরে বিদ্ধ হয়ে আছে। মৌর্য অশ্বটা মৃতপ্রায়। সম্রাট হস্তী থেকে নেমে এলেন। মহামন্ত্রীও অশ্ব থেকে নামলেন। গ্রিক সৈন্যটির চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলেন সম্রাট। তার মনে হলো হেলেনের কথা। হেলেনের রক্ত তার শরীরে বইছে। এ কথা মনে হতেই শিউরে উঠলেন তিনি। ভাবলেন, কেন এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। চাণক্য তাঁর সঙ্গী এক সৈন্যকে কাছে ডাকলেন বললেন, অশ্বটা আবার যুদ্ধে ব্যবহৃত না হলে সম্রাট পৌছার আগেই মেরে ফেল, যাও। সম্রাটের উদ্দেশে বললেন, মহামান্য সম্রাট, চলুন সামনে যাই। সম্রাট বললেন, মৃত সৈন্যদের সৎকারের ব্যবস্থা করুন, তার আগে আহতদের সরিয়ে নিয়ে চিকিৎসা করান। গ্রিক-মৌর্য সব সৈনিকের ব্যাপারে এ নির্দেশ যেন পালন করা হয়। এ স্থান ত্যাগের আগে তিনি গ্রিক সৈন্যটির উন্মীলিত চোখ দুটির পাতা টেনে বন্ধ করে দিয়ে অস্ফুটে বললেন, বাঘের বাচ্চা, বীরের মতো যুদ্ধ করে মরেছে।

মহামন্ত্রী বুঝতে পারলেন না, পরাজিত মৃত শত্রুসৈন্যকে এভাবে বাহবা দেওয়ার কী আছে। তিনি সম্রাটকে সামনে এগোনোর অনুরোধ করে ঘোড়ায় উঠছিলেন। সম্রাট হস্তীতে আরোহণ করলেন না। নিজ দেহরক্ষীদের নিয়ে পদব্রজে অগ্রসর হলেন। মহামন্ত্রী আবার অশ্ব থেকে নামলেন, রাগত তাঁর অনুচর এক সহসেননায়ককে কাছে ডেকে আস্তে আস্তে বললেন, আহত গ্রিক সৈন্য একটাকেও বাঁচিয়ে রাখবে না। আর আগের মতো এদের অস্ত্র-শস্ত্র, পোশাক-আশাক সংগ্রহ করে রাখবে। সৈন্যদের জড়ো করে পুড়িয়ে দেবে।

এক জায়গায় গিয়ে সম্রাট থামলেন। মূল যুদ্ধটা এখানেই হয়েছে। উভয় পক্ষের অজস্ত্র সৈন্য পড়ে আছে। তবে গ্রিকদের সংখ্যাই বেশি। কারও মাথা নেই, কেউ কেউ হাত-পা হারিয়েছে, কেউবা বুকে আমূল বিদ্ধ হয়েছে ত্রিশূল বা তরবারি দ্বারা। যারা আহত, এরা আর্তচিৎকার করছে, আর জল চাইছে। এই ঊষর মরুভূমিতে কতজনকে জলপান করাবেন? তাই তাদের দ্রুত উদ্ধার করে নিতে নির্দেশ দিলেন। স্ট্রেচারে করে আহত সৈনিকদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। একজন মৌর্য সৈন্যকে স্ট্রেচারে তোলার সময় সে আর্তনাদ করে উঠল।

আস্তে, আস্তে। একটু আস্তে তুলতে পারো না। সম্রাট কথাটা এমনভাবে বললেন যেন সৈন্যটির চেয়ে তাঁরই ব্যথাটা বেশি লেগেছে। পরে অস্ফুট উচ্চারণ করলেন, ভয়ংকর, ভয়াবহ।

হাতিতে উঠতে যাবেন, এ সময় এক ভগ্নদূত ছুটে এল অশ্ব হাঁকিয়ে। অশ্বের নিশ্বাসের সঙ্গে যেন তার নিঃশ্বাস মিলে যাচ্ছিল। উভয়ে হাঁপাচ্ছিল। অশ্ব হাঁপাচ্ছিল দ্রুতগামিতার জন্য। ভগ্নদূত হাঁপাচ্ছে ‘ইলেকট্রা নাটকে ভগ্নদূতের মতো। সে ভাবছিল সামনে যাবে, না পেছনে যাবে। কারণ, দুটিই তার মৃত্যু বয়ে আনবে। ভগ্নদূত কাঁপতে কাঁপতে শুকনো কণ্ঠে জানাল, উত্তর থর মরুভূমিতে মৌর্য বাহিনীর পরাজয় ঘটেছে।

সম্রাট কিছু বলার আগেই মহামন্ত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন কেন, কীভাবে?

আমি সব জানি না, মহামন্ত্রী, তবে এটুকু শুনেছি, হাতিরা সব গর্তে পড়ে গেছে। সৈন্যরা বেশির ভাগ অক্কা পেয়ে পড়ে আছে। অনেকে বন্দী হয়েছে।

সম্রাট কিছু না বলেই হস্তী ছেড়ে একটি অশ্বে চেপে বসলেন এবং আগ-পাছ কিছু না ভেবে অশ্বের পেটে দুপায়ে বারবার আঘাত করে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ছুটে চললেন। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে বিশাল থর মরুভূমি তাঁকে পাড়ি দিতে হবে। মহামন্ত্রী চাণক্য সঙ্গীদের নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করলেন। মুখে তাঁর আগের বিজয়ের হাসি নেই।

.

সম্রাট সেলুকাস স্বয়ং উত্তর থরের যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন। পরিকল্পনামতো যুদ্ধে জয়লাভ হয়ে গেছে, তাই খুব উল্লসিত। বৃদ্ধ বয়সে আনন্দ-বেদনা দুটোই মনে হয় একটু বেশি হয়। সম্রাট তাই উচ্ছ্বাসময়। বিজয়ী সৈন্যদের পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তাই সৈন্যদের মধ্যে বেশ মাতামাতি, হইচই।

এ আনন্দের ঢেউ ও কোলাহল সিন্ধু উপত্যকার গ্রিক ছাউনিতেও গিয়ে লেগেছে। এক গ্রিক সৈন্য ঘোড়া হাঁকিয়ে সেখানে গিয়ে উৎফুল্ল বদনে বলল, প্রিন্সেস, যুদ্ধে আমাদের জয় হয়েছে।

প্রিন্সেস তাৎক্ষণিক বললেন, সম্রাটের কী অবস্থা?

আমাদের সম্রাট ভালো আছেন, প্রিন্সেস।

আরে আমি মৌর্য সম্রাটের কথা বলছি। তিনি ধরা পড়েছেন, নাকি মারা গেছেন?

থতমত খেয়ে সৈন্যটি বলল, তা আমি জানি না, প্রিন্সেস।

তুমি এখনই যাবে। সম্রাট সম্পর্কে জানবে। দ্রুত এসে আমাকে বিস্তারিত জানাবে।

সৈন্যটি চলে যাচ্ছে। দারুণ অস্থির কর্নেলিয়া।

নিকোমেডেস বলল, এত অস্থির হোস না কর্নি, অস্থির হওয়ার কিছু নেই।

অস্থির হব না? এ তুই কী বলছিস? তোর মাথা ঠিক আছে?

আমার মাথা ঠিক আছে। সম্রাট মারা গেলে কিংবা ধরা পড়লে সেটাই হতো বড় খবর। এক দিনে সব যুদ্ধ শেষ হয় না। একটা ফ্রন্টে হয়তো আমরা জিতেছি। সম্রাট সেখানে না-ও থাকতে পারেন।

প্রিন্সেসের অবস্থা এমন যে এ যৌক্তিক কথাটাও তাঁর কাছে গ্রাহ্য হচ্ছে না। তাঁকে আগের মতোই অস্থির দেখাচ্ছে। তিনি বললেন, এমনও তো হতে পারে, মৃত সম্রাটকে ওর লোকজন গোপনে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এ-ও তো হতে পারে, আমরা কোনো এক কৌশল বা রহস্যময় কারণে সংবাদটা গোপন রেখেছি!

সবই হতে পারে, বলে থামল নিকোমেডেস। পরে বলল, সৈন্যটি ফিরে এলে সবই জানা যাবে। নিকো, তুই দ্রুত তৈরি হয়ে নে, আমি পোশাকটা বদলে আসি।

কেন?

কোনো প্রশ্ন করবি না। এটা প্রশ্ন করার সময় নয়। চটজলদি।

আরে, সৈন্যটি খবর নিয়ে আগে আসুক।

না, তা হয় না। আমাদের লোকজন তার কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে।

যুদ্ধের মাঠে তুই কী করবি?

আমি সৈনিককের পোশাকে যাচ্ছি। তুইও এ পোশাক পরবি।

নিকোমেডেস শুধু উচ্চারণ করল, পাগল!

উভয়ে দ্রুত সৈনিকের পোশাক পরে নিল। কর্নেলিয়া পরলেন সেলুসিড আর্মির নতুন স্যুট- কোর্ট পোশাক। পিতলের পাত বসানো চামড়ার বুট এবং নাক অবধি কপাল ঢাকে এমন হেলমেট। শুধু চোখ দেখা যায়। কান-গলা সবই এই সুবর্ণ হেলমেটে ঢাকা পড়েছে। কাঁধে চাপানো হয়েছে স্বর্ণের শক্ত নেট। বক্ষে বর্ম। সারিসা হাতে।

নিকোমেডেস দেখে বলল, অতি চমৎকার, বীরসেনা সুদর্শন।

তুই কী পরেছিস?

কেন? মূল গ্রিক। টলেমির সৈন্যরা তাই পরিধান করে।

কর্নেলিয়া বললেন, না, পার্থক্য আছে।

তা আছে, কিন্তু সামান্যই। ফারাওদের অনুসরণ করে শিরস্ত্রাণে এই সংযোজন। জানিস তো দাদা টলেমি নিজেকে ফারাও বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

বুঝলাম, কিন্তু সেলুসিড আর্মিরা তোকে কীভাবে নেবে?

তুই আছিস না?

ঘোড়ায় চড়ার আগে কর্নেলিয়া এদিক-সেদিক তাকালেন। পরে বললেন, তোকে বেশি স্মার্ট লাগছে।

তোকেও, বলে নিকোমেডেস বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করল, পরে আবার বলল, চন্দ্রগুপ্তকে যদি বন্দী অবস্থায় দেখিস, তাহলে কী করবি? আনন্দে আত্মহারা হবি?

না, সে কেন পরাজিত হলো এবং কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করল, তা জানতে চাইব। ভারি অদ্ভুত তো, কেন?

আমি যাকে ভালোবাসি, সে পরাজিত হতে পারে না। আমি তাকে সব সময় বিজয়ী দেখতে চাই।

আর যদি মৃত অবস্থায় দেখিস?

এই সামরিক পোশাকে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট করব। তাকে আমার এই হবে উচ্চ নিবেদন অর্ঘ্য।

তার আগে তুই দাঁড়া, তোকে আমি একটা স্যালুট করি। তুই আমার ফাওলিনকেও হারিয়ে দিলি। চল, এবার যাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *