৫২
সম্রাজ্ঞী দুরধরার ছেলে বড় হচ্ছে। চাণক্যের অপারেশন করার সময় তার কপালে বিন্দুর মতো একটি ক্ষত তৈরি হয়। এ জন্য সম্রাট তার নাম রেখেছেন বিন্দুসার। স্ত্রীর শোক কাটছে আর সন্তানের প্রতি তাঁর স্নেহ ও দায়িত্ব বাড়ছে। সঙ্গে রাজকার্যেও মনোযোগী হচ্ছেন। কিন্তু পুত্রস্নেহ ও বাৎসল্য রাজকার্যের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ এ পুত্র নয়। এখনো তিনি মহামন্ত্রী চাণক্যকে স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করছেন। তাঁর জীবনে চাণক্যের অবদান অনেক, কিন্তু ক্ষতিও কম করেন নি। চন্দ্রগুপ্ত মাঝেমধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবেন। আবার সাতপাঁচ ভেবে নমনীয় হন। এবার মনে হয়েছিল কঠিন সিদ্ধান্ত শুধু নয়, বাস্তবায়নও করে ফেলবেন। বাদ সেধেছেন ভদ্ৰবাহু। অদ্ভুত সব যুক্তি দিয়ে সম্রাটের ক্রোধকে প্রশমিত করে দিলেন। ক্রোধ গেছে বটে, রাগ এখনো যায় নি।
ঠিক এ সময় এবার একাই উপস্থিত হয়েছেন মহামন্ত্রী। গান্ধারা প্রাসাদের অতিথিকক্ষে অপেক্ষা করছেন। দ্বারবারিককে সংবাদ পাঠিয়েও সম্রাটের অনুমতি মিলছে না সাক্ষাতের জন্য। একবার ভাবলেন তিনি কি মহামন্ত্রী, না অতিথি। পরদেশি দূতেরা এভাবে অপেক্ষা করে। ইচ্ছা হলে সম্রাট সাক্ষাৎ দেন, অথবা দেন না। চাণক্যের জন্য তা বড় অসম্মানের। রাজকর্মচারী, পারিষদদের কেউ কেউ এবং দাস-দাসীরা দেখছে। তাদের কাছে তাঁকে ছোট হতে হচ্ছে।
চাণক্য উঠে দাঁড়ালেন। নিজেই দৃঢ় পদক্ষেপে সম্রাটের দপ্তরে উপস্থিত হলেন। দ্বারবারিককে ঠেলে ভেতরে গেলেন।
সম্রাট দোলনায় শিশুপুত্রকে নিয়ে খেলা করছেন। একটি খেলায় শিশুটি খটখটিয়ে হাসছে। সম্রাটের মন ভালো। তারপরও চোখ বাঁকিয়ে দেখলেন তিনি, আচার্য কি কিছু বলতে চান?
আমি দুঃখিত সম্রাট, এ সময়ে বিরক্ত করছি। ব্যাপারটা খুবই জরুরি।
আসলেই সম্রাট বিরক্ত। তারপরও বিরক্তি চাপা দিয়ে বললেন, কী জরুরি সংবাদ, বলুন। বলে নিরাপত্তাকর্মীদের শিশুপুত্রকে নিয়ে বাইরে যেতে ইশারা করলেন।
চাণক্য আসল কথায় যাওয়ার আগে কুশলবার্তা জানতে চাইলেন। সম্রাট কিছুই বললেন না। চাণক্য এবার বললেন, দুটি ব্যাপার মহামান্য সম্রাট, একটি যুদ্ধসংক্রান্ত এবং অপরটি প্রিন্সেস- সংক্রান্ত।
এবারও সম্রাট কিছু বললেন না। চাণক্য বললেন, গ্রিকরা দীপ জ্বালানোর রাতে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে থর মরুভূমি অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করেছে। আমিও তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের সৈন্যবাহিনীকে থর অভিমুখে যাত্রার নির্দেশ দিয়েছি। ক্ষমা করবেন, সেনা মোতায়েন অত্যন্ত জরুরি ছিল বিধায় আপনার অনুমতি নিতে পারি নি। আমি জানি, সর্বাধিনায়কের অনুমতি না নিয়ে সেনা মোতায়েন অথবা যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া অন্যায়।
দ্বিতীয়টি কী, সম্রাট নির্লিপ্তভাবে প্রশ্ন করলেন। ব্যাপারটি চাণক্যের দৃষ্টি এড়াল না। তবু তিনি সবকিছুকে স্বীকার করে নিয়ে বললেন, সম্রাট, গ্রিক প্রিন্সেস কর্নেলিয়া আমাদের শিবিরে এসেছিলেন।
এবারে সম্রাট চমকে উঠলেন, তারপর? কোথায় তিনি?
চাণক্য একটু অপ্রস্তুত হলেন, কিন্তু নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে শক্ত হয়ে বললেন, তিনি চলে গেছেন।
তাকে যেতে দিলেন? আগে জানান নি কেন?
মহামান্য সম্রাট, আপনাকে জানাতে এসেছিলাম। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আপনি শোকাচ্ছন্ন ছিলেন, তাই বলতে পারি নি।
আপনি কি কথা বলেছেন তার সঙ্গে?
কী বিষয়ে?
কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নয়, শুধু কথা বা দেখা?
কথা বলেছি। তিনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। অনুমতি নিয়ে আপনার কাছে আনতে চেয়েছিলাম।
অনুমতি না নিয়ে এত কাজ করেন, এটি করতে পারলেন না? গেলেন কীভাবে?
কাউকে না জানিয়েই তিনি চলে গেছেন।
কী জন্য এসেছিলেন, জানেন কিছু?
না, মহামান্য সম্রাট।
থর মরুভূমিতে কত সৈন্য গেছে?
আমাদের প্রায় অর্ধেক। আপনার ব্যক্তিগত বাহিনীর কোনো সৈন্য যায় নি। আপনার সঙ্গে যাবে। আরেকটি বিষয়, আমরা শত্রুদের ঘিরে ফেলার পরিকল্পনাও করেছি।
সম্মুখযুদ্ধের আগে তার কী প্রয়োজন?
যাতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তাতে যুদ্ধে হতাহতসহ ক্ষয়ক্ষতি কমবে।
আমি আজই যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি। আপনি অপেক্ষা করুন, আমি তৈরি হয়ে নিই, একসঙ্গে যাব।
মহামন্ত্রী চাণক্য সম্রাটের কথায় বিস্মিত হলেন না, তবে চিন্তিত হলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সেনা মোতায়েন কিংবা যুদ্ধ শুরু করে এক ঢিলে দুই পাখি মারবেন, দেখলেন পাখি দুটির একটিও মারা যায় নি, দুটিই বেঁচে আছে আহত হয়ে। সম্রাট এখন মানসিকভাবে আহত। আহত ব্যাঘ্রকে ঘাঁটাতে নেই। কিন্তু অবস্থাকে তো তাঁর অনুকূলে আনতে হবে। সম্রাটের কাছ থেকে বের হয়ে চাণক্য তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচরকে ডেকে কানে কানে যা বললেন তার সারমর্ম হলো এই, গ্রিক সৈন্যদের পোশাক ও মুখোশ পরে তাদের অস্ত্র নিয়ে বিশ জনের মতো মৌর্য সৈন্য থর মরুভূমিতে যাবে এবং মৌর্যদেরই আক্রমণ করবে।
বিশ্বস্ত অনুচরটি বলল, বুঝলাম না, আচার্য। আমাদের সৈন্যরা ওদের পোশাক আর মুখোশ পরে আমাদেরই-বা আক্রমণ কেন করবে?
তা বুঝে তোমার কাজ নেই, ঘোড়া নিয়ে দ্রুত যাও। আমাদের পৌছার আগে যুদ্ধ শুরু হতে হবে।
অনুচরটি দ্রুত চলে গেল। চাণক্যের পরামর্শমতো কাজ হলো। উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত থর ফ্রন্টে পৌঁছে দেখলেন, যুদ্ধ চলছে। মহামন্ত্রী নেই, সম্রাটও নেই, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সম্রাট প্রধান সেনাপতির কাছ থেকে কৈফিয়ত চাইলেন। প্রধান সেনাপতি বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমরা মহামন্ত্রীর নির্দেশে উত্তেজনার মুখে সৈন্যসমাবেশ করেছিলাম মাত্র। তা ছিল প্রতিরক্ষামূলক। কিন্তু গ্রিকরা আপনাদের অনুপস্থিতি ও সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর কথা জানতে পেরে প্রথমে আমাদের আকস্মিক আক্রমণ করে বসে। আমরা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে বাধ্য হয়েছি।
বেশ, তুমি এখন আমার ব্যক্তিগত বাহিনীকে দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাও, আমার সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
থর ফ্রন্টে আবার তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। চাণক্যের এ যাত্রায় উদ্দেশ্য সফল হলো। সম্রাটের দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে এককেন্দ্রিক, অর্থাৎ যুদ্ধে নিবদ্ধ হলো। সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু কিংবা কর্নেলিয়ার ফিরে যাওয়া এখন গৌণ বিষয়, তাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে কৌশলগত কারণে চাণক্যের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করল।
আগের মতো ঘোষণা দিয়ে যুদ্ধটা শুরু হয় নি। তাই বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ হচ্ছে। সেলুকাস যখন জানতে পারলেন যে মৌর্য সম্রাট ও মহামন্ত্রী যুদ্ধক্ষেত্রে নেই, তিনি মাঠে এলেন না। জেনারেল ফিলেকাসকে পাঠালেন। নিজে অপরাপর জেনারেল ও পরামর্শকদের নিয়ে বসলেন।
যুদ্ধক্ষেত্র এলাকায় হলঘরের মতো করে তৈরি একটা বড় তাঁবুতে সমর-পরিষদের সভাটা হচ্ছে। গ্রিক রুচিতে ভেতরটা সাজানো। কারুকাজ করা আসবাবের সঙ্গে কয়েকটা পাথরের ভাস্কর্যও আছে। পানপাত্র, গ্লাসেও দারুণ কাজ করা। সামরিক পরিকল্পনা, যুদ্ধকৌশল, অস্ত্র- রসদ, সৈন্যদের পোশাক-আশাক—এসব নিয়ে মাঝেমধ্যেই সম্রাটকে আলাপ করতে হয়। সেলুকাসের সমর-পরিষদ আকারে ছোট। আলেকজান্ডার থেকে শিখেছেন, কম লোকের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত ভালো হয়। তিনি বলেছেন, সবার কথা শুনবে, সিদ্ধান্ত নেবে একাই। এখানে অ্যারিস্টটলের গণতন্ত্রপন্থী হওয়ার দরকার নেই।
সংগত কারণেই আগের যুদ্ধের ভুলগুলো সামনে এল। যুদ্ধে পরাজয়ের পরপরই ব্যাপারগুলো নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। তবে সেখানে সেলুকাসের রাগারাগিই বেশি হয়েছে। তিনি এত উত্তেজিত ছিলেন যে আসলে গঠনতান্ত্রিক কোনো কিছুই কারও মাথায় আসে নি। গালি খেয়ে জেনারেলরা ভালো পরামর্শ দেবেন কি, আত্মপক্ষ সমর্থনে ব্যর্থ হয়ে পালাই পালাই করছিলেন। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেছে এরই মধ্যে। পরিস্থিতির কাছে বয়োবৃদ্ধ সেলুকাস কিছুটা ক্লান্ত ও সমর্পিত। তাই নির্ভর করতে হচ্ছে নিকটাত্মীয় জেনারেলদের ওপর। তবে তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ছাড়েন না। জেনারেল তো তিনিও ছিলেন। আলেকজান্ডারের জাঁদরেল জেনারেল। তাই ভালোভাবেই বোঝেন একবার দুর্বলতা টের পেলে সর্বনাশ ধরিয়ে দেবে। সম্রাটের আসলে কোনো আত্মীয় থাকতে নেই, পরম আত্মীয় হচ্ছে তরবারি। বাহুর জোর যতক্ষণ, ততক্ষণই ক্ষমতা, সিংহাসন। মস্তিষ্কটায় অতিরিক্ত কিছু, থাকলে ভালো, সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়, না থাকলেও ক্ষতি নেই, কিছু না ভেবেই তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
জেনারেল ক্লদিয়াস বলতে যাচ্ছিলেন, আমাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনার আগে আক্রমণ করতে কে আদেশ দিয়েছিল। ভাবলেন, আক্রমণের আদেশ সম্রাটই দেন, তাই সাজিয়ে-গুছিয়ে বললেন, মহামান্য সম্রাটের সব আদেশই অকাট্য ও যৌক্তিক। আমরা বরাবরই তাঁর আদেশের সুফল ভোগ করেছি। এবারও তা-ই হবে। সমর-পরিষদের সভাটা আগে হলে পরিকল্পনামতো আক্রমণ শানাতে সুবিধে হতো।
সম্রাট বললেন, তুমি কী বলতে চাও, আমি বুঝতে পেরেছি। ওরাই আক্রমণ করেছে, আমরা নই। হঠাৎ এ আক্রমণটা ছিল অপ্রত্যাশিত, যদিও আগে থেকেই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। এখন বলো, কৌশলটা তো তুমিই দেখো। বলো, ফ্যালনক্স-সারি কি মাত্রাগতভাবে বাড়ানো উচিত?
ক্লদিয়াস বললেন, গ্রিকোমেসিডোনিয়ান যুদ্ধকৌশলে গ্রিসের হেলেনিস্টিক আর্মি ফ্ল্যালনক্স রীতির আওতায় নতুন করে সৈন্য সাজানোর সুযোগ কম। তবে সেলুসিড আর্মি ভাবনায় ব্যাপারটা ফ্ল্যাক্সিবল করা হয়েছে। আমরা ওদের বিস্তৃত সেনাবহর দেখে তাৎক্ষণিক সারি দুপাশে বৃদ্ধি করেছিলাম বটে, তবে তা কাজে আসে নি। কারণ, আমরা প্রচলিত সারি ভেঙে এনে অপরিকল্পিতভাবে তা যুক্ত করেছিলাম।
কিউকেকাস ব্যাপারটা ভালোভাবে বোঝেন নি। কৌশল ফ্ল্যাক্সিবল করার সুযোগ থাকলে তাৎক্ষণিক সারি প্রলম্বিতকরণে সমস্যা কোথায় ছিল, তাঁর প্রশ্ন।
ক্লদিয়াস বললেন, আমাদের অশ্বখুরাকৃতির সম্মুখসৈন্য সাজানোর প্রধান শক্তি পেছনের সারিগুলোর দৃঢ় অবস্থান। পেছন থেকে সৈন্য এনে সামনে জোড়া দিলে পেছনটা দুর্বল হবেই। মাজা নড়বড়ে রেখে সটান সিনায় দাঁড়ানো যায় না। তাই বিপর্যয় ছিল অনিবার্য।
অভিজ্ঞতা তো সঞ্চয় করেছ, এবার কী করবে, বললেন সেলুকাস।
ফারাও টলেমির ফ্লেবোচোই সৈন্যদের আদলে মধ্যবর্তী স্থানে একটি পাঁচ স্তরের শক্ত প্রাচীর তৈরি করছি। শত্রুসেনারা এখন চাইলেই ঠেলে ঢুকে পড়তে পারবে না।
এ সৈন্যের জোগান হবে কোথা থেকে, জেনারেল?
সারিকাসের প্রশ্নের জবাবে ক্লদিয়াস বললেন, কাতুইকোই আর্মি থেকে জোগানটা এসে গেছে।
এরা তো যুদ্ধবিদ্যায় একেবারে রদ্দি।
তা ঠিক বলেছেন, যোগ করলেন কিউকেকাস।
ক্লদিয়াস বললেন, গত যুদ্ধে তা প্রমাণিত। তাই আমরা এদের সামনে নয়, পেছনে দেয়াল হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখব। এরা কাঁধে ঠেলবে, বুকে নয়। তবে থর যুদ্ধের পর এদের বেশ উন্নতি হয়েছে। নিয়মিত সেনারাই সামনে থাকবে।
সম্রাট বললেন, বড় সমস্যা আরেকটি আছে। এপিলেকটাইয়ের (অশ্ববাহিনী) সঙ্গে পদাতিক বাহিনী দৌড়ে সংযোগ রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল।
এবার সেটা আর হবে না। আমাদের সব যুদ্ধই হবে রক্ষণাত্মক। বলে দেওয়া হয়েছে, মাঝখানে গ্যাপ কোনো অবস্থায়ই তৈরি করা যাবে না।
এবার হাতি, বলে থামলেন সেলুকাস। পরে বললেন, এটিই আমাদের বড় সমস্যা। স্বয়ং সম্রাট এ বাহিনীর সঙ্গে থাকেন।
সারিকাস বললেন, এ সমস্যা নিয়েই আমরা বেশি ভেবেছি। যুদ্ধ বিলম্বিত করা ছিল আমাদের কৌশল, যাতে হাতির খাবারের ঘাটতি দেখা দেয়। তাহলে হাতিগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে। আরও বিলম্বিত করতে পারলে ভালো হতো। যা-ই হোক, সারিসার জোগান বাড়ানো হয়েছে, দূর হতেই এ অস্ত্রে হাতিদের ঘায়েল করা যাবে। এ ছাড়া তিরন্দাজদের এখন প্রধান কাজই হবে হাতির দিকে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করা। অগ্নিতিরও থাকবে। হাতিরা আগুনকে ভয় পায়।
কিউকেকাস স্বগতভাবে বললেন, দুর্বল, পরিকল্পনা বেশ দুর্বল।
জামাতা জেনারেলের দিকে তাকিয়ে সম্রাট বলেন, কোথায় কোথায় দুর্বলতা, বলো।
যুদ্ধের এ পর্যায়ে আরও দৃঢ় পদক্ষেপের দরকার ছিল। মনে হচ্ছে প্রথম পরাজয় আমাদের কোনো শিক্ষাই দেয় নি।
আহা, তুমি বলোই না কোথায় কোথায় সমস্যা দেখছ?
তাদের পরিকল্পনা, তারা মনে করছে এমন নিখুঁত যে চলমান যুদ্ধ এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল জয়লাভ করাকে এখন আর কেউ ভবিষ্যতের ব্যাপার মনে করছে না, সেটা যেন অতীতের ঘটনা। কেন এসব বলছ? সব রকম সুবিধাই তো এখন আমাদের পক্ষে। স্ত্রী বিয়োগের কারণে সম্রাট এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাদের সৈন্যদের তুলনায় সেলুসিড সৈন্য অনেক বেশি প্রশিক্ষিত। আমাদের নব-উদ্ভাবিত যুদ্ধাস্ত্রের সামনে ওরা দাঁড়াতেই পারবে না।
এসব অস্ত্রের ব্যবহার আগেও হয়েছিল, মহামান্য সম্রাট।
ধরে নাও সেটি একটি মহড়া ছিল। আসল যুদ্ধটা হবে এখন।
জামাতা জেনারেল থামলেন। কিন্তু নিজের পরিকল্পনার কথা কিছুই বললেন না। না দিলেন যুক্তিগ্রাহ্য কোনো পরামর্শ।
সম্রাট ভাবলেন, লাউডিস তাঁকে নিয়ে সংসার করে কী করে? পরে সব জেনারেলের উদ্দেশে বললেন, সেদিন আমরা পরাজিত হয়ে পিছিয়ে এসেছিলাম। এবার পিছিয়ে আসা হবে কৌশলগত। এদের বিশাল বাহিনী নিশ্চয়ই জয়ের অতি আশাবাদী হয়ে আমাদের পেছনে ছুটবে। তার আগেই পার্বত্য ভূমির নানা জায়গায় ওত পেতে থাকা আমাদের সৈন্যরা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। পাহাড়ের পাদদেশে যেসব পরিখা খনন করে রাখা হয়েছে, সেগুলো তখন বেশ কাজে দেবে। হাতিদের মহাবিপদ হবে। খন্দকে পড়ে আর উঠতে পারবে না। এখন সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে যাও। সব গোছাতে থাকো। মৌর্য সম্রাটের আগমনবার্তা পেলে আমি ঘোড়া ছুটিয়ে তৎক্ষণাৎ আসব।
সমর-পরিষদের সভা থেকে ফিরতে গিয়ে তরুণ জেনারেল আর্কিমেডেসকে কিউকেকাস বিদ্রূপের সুরে বললেন, তুমি কিছু বললে না কেন? নাকি ভেবেছ, আহা, কী যুদ্ধই না আমরা জয় করেছি। সৃষ্টিকর্তা তাই করুন, যেন এর ফলে যে যুদ্ধ হবে, তাতেও আমরা বিজয়ী হতে পারি। আজকের মতো এত অনুকূল পরিস্থিতি কোনো দিনও হবে না। মৌর্যরা পরাজয়ের জন্যই যেন অপেক্ষা করছে।
আর্কিমেডেস বললেন, এ কথা আমাকে বলছেন কেন, পরিষদ সভায় আপনার মত প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি, সে দায় কি আমার? আর আপনি তো আপনার মত কী, তা বলেনই নি।
যাও যাও, যুদ্ধ জয় করে ফিরে এসো, বলে ক্রুদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে গেলেন জেনারেল।