মৌর্য – ৫

দিগম্বর আচার্য ভদ্রবাহু (৪৩৩-৩৫৭ খ্রি.পূ.) সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সামনে বসে আছেন। তিনি সম্রাটের আধ্যাত্মিক গুরু ও জৈনধর্মের শেষ ‘শ্রুতকেবলী আচার্য’। জন্ম পুণ্ড্রবর্ধনের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে। শ্রুতকেবলী আচার্য গোবর্ধন মহামুনি সাত বছর বয়সে পুণ্ড্রবর্ধন থেকে তাঁকে এবং তাঁর ভাই বরাহ মিহিরকে পাটালিপুত্রে নিয়ে আসেন। তাঁর পুরো নাম যতীন্দ্র ভদ্রবাহু। তাঁর মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা দেখে তাঁকে ভবিষ্যৎ ‘শ্রুতকেবলী’ হিসেবে গড়ে তোলেন। অপরাজিতার পর তিনি ‘শ্রুতকেবলী’ হন। বরাহ মিহিরও আশা করেছিলেন ‘শ্রুতকেবলী’ হবেন। ভদ্রবাহুর যোগ্যতার কাছে তিনি হেরে যান। (এই বরাহ মিহির কিন্তু দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ বরাহ মিহির নন। তাঁর সময় ষষ্ঠ শতক। তিনি বিক্রমাদিত্যের রাজদরবারে নয় নবরত্নের এক নবরত্ন ছিলেন।)

একটু ভেবে নিয়ে ভদ্রবাহু বললেন, চন্দ্র, আচার্য চাণক্য আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের যে কাঠামো তৈরি করেছেন, তা আমি দেখেছি। তিনি রাজনীতিবিজ্ঞানে দক্ষ মানুষ। যেকোনো নতুন কাজেই তোমাকে ঝুঁকি নিতে হবে। ঝুঁকি এখানে আছে। তার পরও আমি তোমাকে পরামর্শ দেব, তুমি এটি প্রবর্তন করো। সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান করে নেবে। এই প্রশাসনিক সংস্কার তোমার শাসনকে সংহত করবে এবং তোমার রাজ্য বিস্তারের সময় অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে না।

প্রজাদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যাবে, বললেন সম্রাট।

তা যাবে। আচার্য চাণক্যকে বলো কৌশল বের করতে, যাতে প্রজারা না ভাবতে পারে যে সম্রাট তাদের শুধু শাসনই করছেন।

সামাজিক ঐক্য বিনষ্ট হবে।

সমাজ পরিবর্তনশীল। সে তার নিজস্ব গতিতে চলবে। পুরোনো সমাজ ভাঙবে, নতুন সমাজ গঠিত হবে। ঐক্য-সংহতিটা এখনকার মতো থাকবে না, কিন্তু নতুন জেগে ওঠা চরের মতো, পলি জমে জমে স্থলভাগ গঠনের নতুন সংহতি তৈরি হবে। সেখানে তুমি ও আচার্য চাণক্য মিলে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখতে পারো।

আচার্য বোধ হয় লক্ষ করেছেন এখানে প্রশাসনে একটি তৃতীয় মাত্রা যুক্ত হতে যাচ্ছে, যার ছায়া অন্ধকারময়।

ভদ্ৰবাহু হেসে দিয়ে বললেন, তা আমি বুঝতে পারি নি, তা নয়। দেখো, কোনো রাজ্য পরিচালনাই পঙ্কিলতামুক্ত নয়। সুশাসন মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে তা পরিচালনা ততটাই কঠিন।

রাজাকে শঠতার আশ্রয় নিতে হবে?

একে শঠতা বলছ কেন?

দুধকে দুধ, জলকে জল বলা যাচ্ছে না যে, সে জন্য। সেদিন তক্ষশীলায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বরাতে রাজার কর্তব্য বিষয়ে বক্তৃতা শুনছিলাম। না শুনলে এ প্রশ্ন জাগত না।

ভদ্রবাহু আবার হেসে দিলেন। বললেন, গ্রন্থের শাসন ও রাজার শাসন এক নয়। কোনো রাজা অর্থশাস্ত্র লেখেন নি, লিখলে এ রকমটি লিখতেন না।

তিনি তো ভালো কথা বলেছেন।

পুস্তকে লেখা হয় ভালো কথা বলার জন্য। যিনি লিখেছেন তাঁকে আমি চিনি। জগৎ, সমাজ, রাষ্ট্রে তাঁর ভূমিকা সে রকম নয়।

তাঁকে আপনি চেনেন, কে সে?

তা এখন জানতে চেয়ো না। তিনি নিজেকে ছদ্মনামে আড়াল করেছেন, আড়ালেই থাকুন, সময় হলে আমি নিজে থেকেই বলব।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থকে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আচার্য, আরেকটি বিষয়।

কোনো স্বপ্ন?

স্বপ্ন নয়, তবে স্বপ্নের মতোই। চন্দ্রগুপ্ত গ্রিক রাজকুমারীর কথা বললেন, নিজের অস্থিরতার কথা বললেন, চিত্তচাঞ্চল্যের কথা বললেন, করণীয় ও এর ফলাফল সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

এবারে ভদ্রবাহু মৃদু হাসলেন। বললেন, এ নিয়ে ভাবতে হবে। পরে একদিন এসে জানিয়ে যাব। আর হ্যাঁ, পুণ্ড্রবর্ধন থেকে আমার লোক এসেছিল। এই উপহারটা সম্রাজ্ঞীর জন্য নিয়ে এসেছে।

কী এটা, আচার্য?

দুকুল বস্ত্র। কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, বঙ্গদেশের (বাঙ্গক) দুকুল খুব নরম ও সাদা, পুণ্ড্রদেশের দুকুল শ্যামবর্ণ, দেখতে মণির মতো পেলব।

অসম্ভব সুন্দর, আচার্য, আপনি নিজ হাতে তাঁকে বস্ত্রটি প্রদান করুন, খুব খুশি হবে। এই, কে আছ, রানিকে খবর দাও।

আধ্যাত্মিক গুরুর সঙ্গে কথা বলার সময় সম্রাট তাঁর সহকারী দাসীদের কক্ষ থেকে বের করে দেন। সম্রাটকে এরা পর্যায়ক্রমে প্রহরা দিয়ে থাকে।

সম্রাজ্ঞী দুরধরা বেশ সাজসজ্জা করে দরবার হলে প্রবেশ করলেন। দিগম্বর মানুষ দেখে এরা অভ্যস্ত, তাই কোনো সংকোচের বালাই নেই। একদিন ভদ্রবাহু বলেছিলেন, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী বস্ত্র পরিধান করে না। আমরা তো কখনো কৌতূহলী হয়ে তাদের দিকে তাকাই না। দেহের আবরণ চামড়া ও লোম। প্রাণটাকে আড়াল করে রেখেছে সে। বস্ত্রের আর কী প্রয়োজন। এই পাটালিপুত্রেই বনে বহু মানুষ আছে, তাদের আমরা বন্য পশু বলি না, তারাও তো কোনো সমস্যা মনে করে না। আমি সভ্যতার প্রথম যুগের সে অসহায় মানুষটির দুর্দশার কথা ভাবি, যে প্রথম গাছের বাকল বা পত্রকে বস্ত্রের মতো পরিধান করেছিল।

সম্রাজ্ঞী ভদ্রবাহুকে নমস্কার জানাতেই তিনি বস্ত্রটি তাঁর হাতে তুলে দিলেন। সম্রাজ্ঞী খুলে দেখে একেবারে বিস্ময়াভিভূত। এত সুন্দর মসৃণ আর পেলব পোশাক হয়! আচার্য, এত সুন্দর উপহার কোথায় পেলেন?

এ-জাতীয় বস্ত্র আমার জন্মভূমিতে উৎপন্ন হয়, সম্রাজ্ঞী। সেখানে পুণ্ড্রবর্ধনিয়া, কৌটিবর্ষিয়া আর তাম্রলিপ্তিয়া নামে তিনটি জৈন সম্প্রদায় রয়েছে। সেখানকার লোকজন শিক্ষিত ও পরিমার্জিত এবং বিলাসী ও কৃচ্ছ্রতাসাধন-প্রিয়।

সম্রাজ্ঞী বললেন, আপনি এ বস্ত্রের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আমার অন্তরের সম্পর্ক সৃষ্টি করলেন।

ভদ্রবাহু চলে যাওয়ার পর বরাহ মিহির রাজার কাছে উপস্থিত হন। জৈন জ্যোতিষী হিসেবে তিনিও নাম কুড়িয়েছেন। ভদ্রবাহুর কারণে তাঁর রাজদরবারে আসা-যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সম্রাট তাঁকে অবশ্য স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন।

বরাহ মিহিরের হৃদয়ে একটি ক্ষোভ আছে। তিনি ‘শ্রুতকেবলী’ হওয়ার বাসনা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু আচার্য গোবর্ধন মহামুনি তা অনুমোদন করেন নি। বড় ভ্রাতাকে তাই তিনি ঈর্ষার চোখে দেখেন এবং তাঁকে ঘায়েল করার সব রকম ফন্দি আঁটেন

সম্রাজ্ঞীর বিশেষ প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য সব সময় চেষ্টিত থাকেন। সম্রাজ্ঞীর হস্তে দুকুল বস্ত্র দেখে বললেন, মহামান্যা সম্রাজ্ঞী, সুবর্ণ কোড্যা দেশের (কামরূপ) দুকুলের রং নবোদিত সূর্যের মতো। কীটবিশেষের জিহ্বারস কোনো কোনো বৃক্ষপত্রকে উর্ণায় রূপান্তরিত করে। সে উর্ণ দিয়ে এ ধরনের বস্ত্র তৈরি হয়।

সম্রাজ্ঞী বস্ত্র ও গহনার প্রতি বিশেষ দুর্বল। উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন, কোথায় পাওয়া যাবে?

সম্রাট বললেন, সম্রাজ্ঞী, আপনি ভাববেন না, আমি সংগ্রহ করে দেব।

বরাহ মিহির বললেন, কুড্যাদেশ তো আপনার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত নয়, মহামান্য সম্রাট। সম্রাজ্ঞীর প্রয়োজনে তা আমি সংগ্রহ করে নেব।

সম্রাজ্ঞী চলে যাওয়ার পর বরাহ মিহির অন্য প্রসঙ্গে কথা বললেন। তিনি চাণক্যপ্রণীত প্রশাসনিক কাঠামো ও সংস্কার প্রস্তাব দুই-ই দেখেছেন, তাতে ভদ্রবাহুর সম্মতির কথা জানতে পেরে বললেন, এই সংস্কার প্রজাদের মধ্যে বিপ্লব উৎপন্ন করবে, এরা বিদ্রোহ করবে। মহামান্য সম্রাট, আপনি কোনো অবস্থায়ই প্রজাদের কাছে অপ্রিয় হতে পারেন না।

সম্রাজ্ঞীকেও একই কথা বলবেন বলে স্থির করলেন। সম্রাট জানতে চাইলেন, সংস্কার প্রস্তাবের কথা মিহির কোথায় জানতে পেরেছেন।

মহামান্য সম্রাট, আপনি যে সমস্ত কথা আচার্য চাণক্যকে বলেছেন, চাণক্য নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা করছেন। তাঁর অনুসারী অমাত্যগণ রাজসভায় তাঁর পক্ষাবলম্বন করবেন বলে এক হয়েছেন। হলেই-বা কী, আপনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আপনি সংস্কার প্রস্তাবকে অনুমোদনই দেবেন না।

বরাহ মিহির, কথা শেষ হলে তুমি এখন এসো। আমাকে এ নিয়ে ভাবতে দাও।

বরাহ মিহির সম্রাটের কাছ থেকে বের হয়ে আচার্য চাণক্যের কাছে গেলেন। চাণক্য তখন সংস্কার প্রস্তাবের খুঁটিনাটি দিক নিয়ে কাজ করছিলেন। বরাহ মিহিরকে দেখে হাস্যমুখে বললেন, বরাহ, আপনি কি আমার সংস্কার প্রস্তাবটি দেখেছেন?

জি না, আচার্য।

একবার দেখুন, আমি চাই সব শ্রেণির মানুষের মতামত নিয়ে ব্যাপারটা সম্রাটের সভায় যাক।

আমি জানি, আপনি যে কাজ করেন, ভেবেচিন্তেই করেন। তাতে হাত দেওয়ার যোগ্যতা অন্য কারোরই নেই। আমার কথা অবশ্য ভিন্ন, আপনি যা করবেন, তাতেই আমার সমর্থন থাকবে। আপনি শুধু ভদ্রবাহুর দিকে লক্ষ রাখবেন। দ্বিমত কিংবা আপত্তি করার মতো নানা অজুহাত সেখান থেকেই সম্রাটের কানে তোলা হতে পারে।

আচার্য চাণক্য মিহিরের কথা শুনে মুখ চেপে হাসলেন। বললেন, আপনাকে আমি একটা দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছি।

মাননীয় মহামন্ত্রী, আপনিই শুধু আমার যোগ্যতা মূল্যায়ন করলেন। সম্রাটের পারিষদদের কেউই আমাকে বুঝতে পারলেন না।

গোবর্ধন আচার্যও বুঝতে পারলেন না, বললেন চাণক্য। বলে চোখ টিপে হাসলেন। আবার বললেন, মিহির, আপনি এ নিয়ে একদম ভাববেন না। আপনার মূল্য একসময় সবাই বুঝতে পারবে।

বুঝতে না পারলেও আমার দুঃখ নেই, আচার্য, আপনি বুঝতে পেরেছেন, তা-ই আমার অহংকার।

সম্রাট-সম্রাজ্ঞীকে সহজে বুঝতে পারা ঠিক নয়, এঁরা আপনাকে বুঝতে পারলেন কি না, সেটাই মুখ্য। এতক্ষণ কাজ করতে করতে কথা বলছিলেন চাণক্য, এবার মাথা তুলে তাকালেন বরাহ মিহিরের দিকে। তাকিয়ে একেবারে গভীরে চলে গেলেন। ভাবলেন, আজীবিক ধর্মে বিশ্বাস করলে তাঁকেও বরাহ মিহিরের মতো দিগম্বর অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে হবে। অবশ্য তাঁর জন্য বাধ্যবাধকতা নেই। পরে বললেন, কাজটা শেষ করেই ফেললাম, মিহির। বোঝাটা একটু হালকা হলো।

একেবারে শেষ করবেন না, আচার্য। ঘষেমেজে আরও পরিশীলিত করুন। আপনার সহকারী সুবন্ধুকে কাজে লাগান।

সুবন্ধুকে আপনার কেমন মনে হয়, মিহির?

আমি তাঁকে বুঝতে পারি না, আচার্য, তাঁর প্রতিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন।

কী ধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি?

চোখে চোখে রাখা আরকি।

আপনার পরামর্শ মনে থাকবে।

আরেকটা বিষয়, আচার্য।

বলুন।

সম্রাট কেন নারী রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকবেন। এই যে আপনার পুরুষ রক্ষীরা বল্লম উঁচিয়ে সদর্পে ঘুরে বেড়ায়, কত গৌরবজনক মনে হয়।

সম্রাটকে কি আপনি এ কথা বলেছেন?

না, তা বলি কী করে?

একদিন বলেই ফেলবেন। আবার আমার প্রসঙ্গ আনবেন না যেন!

না, আপনাকে জড়াব না। অন্যের সূত্রে বলব।

কার সূত্রে?

বলে দেব।

আপনি ভদ্রবাহুর বরাতে কিছু বলবেন না যেন।

কেন?

তাহলে সম্রাট আপনাকে আস্থার মধ্যেই রাখবেন না।

বেশ, তা-ই হবে, আচার্য। সম্রাজ্ঞীর সূত্রে বলি?

তা শুনে আচার্য চাণক্য অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *