৪৮
রাত্রি শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটছে। কোমল আলোয় ফুটছে পদ্ম ও শাপলাও। সূর্য উঠছে। রংটা টকটকে অশোকফুলের মতো। পায়রা কিংবা কোকিলের টকটকে লাল চোখ বললেও ভুল হয় না। চীনা গোলাপও বলা যায়। হাজার রশ্মি ছুটে যাচ্ছে আলোর ধারায়। বিদুরিত হচ্ছে ঘন অন্ধকার। পৃথিবীর ভোরে জাগা মানুষেরা যখন কমলা রঙের সূর্যের আলোয় স্নাত, সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তখন শয্যা ত্যাগ করে বিছানা ছেড়ে পালঙ্ক থেকে নেমে আসার জন্য ছোট টুলে পদস্থাপন করেছেন। ভোরের প্রাত্যহিক কর্ম সম্পাদন করে ব্যায়ামাগারে যাবেন তিনি। তাঁর জন্য ব্যায়ামের বিশেষ পোশাক সেখানে তৈরি করে রাখা হয়েছে। সেখানে গিয়ে পোশাক পরলেন। তারপর শাস্ত্রসম্মতভাবে লাফালাফি, হাত-পা ছুড়ে আস্ফালন, মল্লযুদ্ধ সবই করলেন। ঘাম ঝরালেন প্রচুর। ঘাম মুছে শরীরে নানা ধরনের তৈলমর্দন করালেন। লোকবিশ্বাস এ তৈলমর্দন বেদনা নাশ করে, সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, শক্তি বাড়ায়, তেজ বর্ধন করে, পরিপুষ্ট করে, উল্লসিত করে, চুলের সৌন্দর্য বাড়ায়, মানসিক শক্তি ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্প্রসারণ ও আন্দোলনে সাহায্য করে। নানাবিধ তৈল মর্দন শেষে তৈল ঢেকে দেওয়ার জন্য তৈল মর্দনকারী সম্রাটের হাতে-পায়ে, হাত-পায়ের তালুতে চূর্ণক মেখে দিল।
ব্যায়ামাগার ত্যাগ করে সম্রাট স্নানাগারে গেলেন। স্নানাগারটি বড়ই মনোহর ও চিত্তাকর্ষক। অনেকগুলো জানালা। মণিমুক্তাখচিত। মেঝেতে মোজাইক ও মূল্যবান পাথর বসানো। দেয়ালে নানা চিত্র। শিল্পীর নৃত্যপর অঙ্কনচিত্র।
দাসীরা নানা সুগন্ধযুক্ত ফুলের পাপড়ি জলে মেশাল। মুহূর্তের মধ্যে স্নানাগার ফুলের গন্ধে বিমোহিত হয়ে উঠল। আলাদা আলাদাভাবে মিশ্রিত সুগন্ধি জল বৃক্ষরসমাখা কাপড় দ্বারা শরীর মেজে দিল কেউ কেউ, অন্যেরা আবার সুগন্ধিযুক্ত জল ঢেলে দিল। সম্রাট যেন জলকেলি করছেন, এমনিভাবে জল ছিটালেন চারদিকে। দাস-দাসীগণ আনন্দশব্দ করে উল্লাস প্রকাশ করল। স্নান শেষে মাথার চুল ও শরীর থেকে নরম ও মোলায়েম বস্ত্র দিয়ে জল মুছে দিল। সম্রাট স্নান শেষে রাজকীয় পোশাক পরিধান করলেন আগের মতো। পোশাকে সুগন্ধি মাখলেন। চুলে সুগন্ধি তৈল মাখলেন স্বল্প পরিমাণে। অলংকার পরলেন।
এই সংক্ষিপ্ত স্নানে নিজেকে তাঁর সতেজ ও সজীব মনে হলো। বড় সুখ অনুভব করলেন তিনি (এ রকম একটি স্নানের বর্ণনা কল্পসূত্রে আছে)।
গান্ধারা প্রাসাদের একটি কক্ষে সম্রাটের সকালের নাশতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পদ অজস্র। কিন্তু সম্রাট শুধু আনারসের রস পান করলেন। সংবাদ নিয়ে জানলেন, সম্রাজ্ঞী এখনো শয্যা ত্যাগ করেন নি।
এখন বহিরাগতদের জন্য নির্ধারিত সম্মেলন কেন্দ্রে যাবেন সম্রাট। ভোজনকক্ষের বাইরে জড়ো হয়েছেন রাজ্যসরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, গান্ধারা অঞ্চলের পরিবারপ্রধান, বিশিষ্ট নাগরিক, নৃত্যগুরু, সংগীতগুরু, নাট্যগুরু, ব্যবসায়ী, সওদাগর, সংবাদবাহক এবং সম্রাটের নিরাপত্তা রক্ষী, গোয়েন্দা ও ব্যক্তিগত দাস-দাসীরা।
সুসজ্জিত হস্তী ও অশ্বযান প্রস্তুত রাখা আছে। সম্রাট বাইরে বের হতেই অলংকারসমৃদ্ধ একটি ছত্র সম্রাটের মাথার ওপর ধরল ছত্রধর। সম্রাটকে দেখে মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি তুলল সমবেত লোকজন, জয় হোক সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের, জয় হোক বিজয়ী সম্রাটের, সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন ইত্যাদি।
সম্রাট হস্তী কিংবা অশ্বযানে চড়লেন না, সম্মেলনকেন্দ্রে পদব্রজে যাত্রা করলেন। তাঁকে ঘিরে চলেছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী মেয়েরা, কিয়ৎ দূরে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তাদানকারী সদস্যরা।
সম্রাট পদব্ৰজে যাত্রাটা উপভোগ করছেন। বসন্ত বাতাসে যেন তাঁর প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে দারুণ সব ফুল ফুটে আছে। কোনো কোনো গাছে কচি পাতা, মনে মনে ভাবলেন, কবি হলে এত সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা দিতে পারতেন। তবে উপভোগশক্তি তাঁর আছে, প্রাণভরে নিশ্বাস নিলেন। সম্মেলনকেন্দ্রটি গান্ধারা রাজপ্রাসাদ অঙ্গনেই অবস্থিত। যাত্রাপথের দূরত্ব বেশি নয়।
সভাসদরা আগেই এসে আসন গ্রহণ করে বসে আছেন। সম্রাটের আগমনবার্তা শুনে উঠে দাঁড়ালেন। সম্রাটের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করে অভিবাদন জানালে সম্রাট বিভিন্ন প্রাণীর ছবিসংবলিত সুরক্ষিত একটি রাজকীয় আসনে উপবেশন করলেন। মন তাঁর বেশ প্রফুল্ল আজ। দরবারে তাই গাম্ভীর্যের পরিবর্তে হালকা প্রাণনার ভাব। সম্রাটের ইঙ্গিতে সভাসদরা আসন গ্রহণ করলেন।
গান্ধারা অঞ্চলের অমাত্য, রাজকর্মচারী, বিশিষ্ট নাগরিক ও ব্যবসায়ী সম্মেলনকেন্দ্রে উপস্থিত আছেন। সম্রাট এখানকার প্রজাদের কথা শুনবেন। অভিযোগ থাকলে, অনুযোগ থাকলে সবই শুনবেন। প্রজাদের সুখের কথা শুনে তাঁর আনন্দ হয়। কষ্টের কথা শুনে কষ্ট হয়, প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেন।
গান্ধারার বিশিষ্ট নাগরিকদের একজন বললেন, মহামান্য সম্রাট, গ্রিকদের বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য আপনাকে অভিনন্দন। আমরা ভারতীয়রা এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, বলে তিনি হাত জোড় করে সম্রাটকে নমস্কার জানালেন।
সম্রাট বললেন, প্রাথমিক যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি বটে। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের শেষ হয় নাই। আমরা শেষ পর্যন্ত এ যুদ্ধে জয়ী হতে চাই।
এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বললেন, সম্রাট, এ যুদ্ধ আমাদের ব্যবসার অনেক ক্ষতি করেছে, আমরা কর অব্যাহতি চাই।
সম্রাট বললেন, কথাটা খুব যৌক্তিক, কী বলো গোপ?
স্থানীয় গোপ বলল, মহামান্য সম্রাট, এ ব্যাপারে মাননীয় মহামন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া উত্তম হবে।
তুমি ঠিক বলেছ। আমি আচার্যের পরামর্শ নেব।
একজন মহিলা হাত উঁচু করে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলে এক অমাত্য তাকে শাসনের ভঙ্গিতে চোখের ইঙ্গিতে বসিয়ে দিতে চাইলেন। তা সম্রাটের দৃষ্টি এড়াল না। সম্রাট বললেন, ওই মহিলা কী বলতে চায়, তাকে কথা বলতে দাও!
মহিলা বলল, সম্রাট ধর্মাবতার, আমার স্বামী একজন স্বেচ্ছাচারী পুরুষ, দ্বিতীয়বার তিনি বিয়ে করে আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। স্ত্রীধনও পাই নাই। প্রদেশত্রির (ম্যাজিস্ট্রেট) কাছে অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পাই নাই।
প্রদেশত্রি উপস্থিত আছ। বলো, তার অভিযোগ কি সত্যি?
প্রদেশত্রি হাত জোড় করে প্রণাম করে জানাল, মহিলা যে অভিযোগ করেছেন, এ কথা সত্য, মহামান্য সম্রাট। কিন্তু তিনি অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রচলিত আইনটা কী, আমাকে বলো, বললেন সম্রাট। কেন প্রতিকার পাবে না, তা-ও বলো।
প্রদেশত্রি বললেন, পুত্রপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় পুরুষদের দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ। অর্থশাস্ত্রও সে কথা বলছে।
সেখানে শর্ত আছে। পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার করো। পুরুষদের স্বেচ্ছাচারিতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ ব্যবস্থা।
প্রদেশত্রি বললেন, মহামান্য সম্রাট, আপনার অনুমোদিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে, দ্বিতীয়বার স্ত্রী গ্রহণকালে প্রথম স্ত্রীকে প্রদেয় ধনের ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি একবার সন্তান জন্মদানের পর পুনর্বার আর গর্ভধারণ না করে, স্ত্রী যদি পুত্রসন্তানের জন্ম না দেয় এবং স্ত্রী যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের স্ত্রীর স্বামী পুত্রসন্তানের জন্য আট বছর অপেক্ষা করে স্ত্রী সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারবে।
প্রদেশত্রি এটুকু বলে থামলেন। সম্রাট নিজের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। ভাবলেন, তাঁর স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, আবার সন্তানসম্ভবা। তাহলে সাম্রাজ্যের আইন ভঙ্গ করে কেমন করে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রিক প্রিন্সেসকে গ্রহণ করবেন? আর যদি দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে তাকে গ্রহণই না করতে পারেন, তাহলে এ যুদ্ধ কেন? কেন এ রক্তক্ষয়?
প্রদেশত্রি আবার বললেন, এ ছাড়া স্বামী স্ত্রীধন প্রত্যর্পণসহ উপযুক্ত ভরণপোষণ প্রদান সাপেক্ষে সন্তান জন্মদানে অক্ষম প্রথমা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে পুত্রসন্তান লাভের ইচ্ছায় একাধিক্রমে বহু পত্নী গ্রহণ করতে পারবে। যেহেতু পুত্রসন্তানের জন্যই স্ত্রী গ্রহণ করা, সেহেতু, পুত্রসন্তান লাভের লক্ষ্যে সন্তানহীনা স্ত্রীকে উপেক্ষা করে অন্য স্ত্রী গ্রহণ অবৈধ নয়।
সম্রাট প্রায় রাগান্বিত হয়ে বললেন, আইনের ব্যত্যয় বা অবৈধ বিয়ে হলে শাস্তি কী হবে? প্রদেশত্রি প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেলেন। পরে আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, মহামান্য সম্রাট, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কেউ যদি দ্বিতীয় বিয়ে করে, সে ক্ষেত্রে উক্ত স্বামী প্রথম স্ত্রীকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য থাকবে এবং রাজদণ্ড হিসেবে চব্বিশ পণ জরিমানা প্রদান করবে।
এই মহিলার অভিযোগ প্রমাণ হয় নি কেন? তার স্বামী কি দ্বিতীয় বিয়ে করে নি?
দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, মহামান্য সম্রাট।
তাহলে?
কত বছর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেছে এবং এই নারী সন্তান ধারণে সক্ষম কি না, তা পরিষ্কার নয়।
তুমি সব শুনে আবার বিচার করবে এবং এর ফলাফল জানাবে। আজকে এ পর্যন্তই। বলে সম্রাট আসন ছেড়ে উঠে গান্ধারা রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা হলেন। সম্রাটের সহকারী এবং নিরাপত্তা রক্ষীরা তাঁকে অনুসরণ করল। ছত্রধর ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছত্রখানা সম্রাটের মাথায় তুলে ধরে অগ্রসর হতে লাগল।
অদ্ভুতভাবে একই বিষয় নিয়ে মহামন্ত্রী চাণক্য কর্নেলিয়ার সঙ্গে আলাপ করছিলেন। সদাচার ভট্টকে সেলুকাসের শিবিরে পাঠিয়ে তিনি এখানে এসেছেন খোশগল্প করার জন্য। উদ্দেশ্য, প্রিন্সেসকে তাঁর পদক্ষেপ সম্পর্কে কিছু বুঝতে না দেওয়া এবং মজা করা। সাথে করে তিনি ভদ্রবাহুকেও এখানে নিয়ে এসেছেন। ভদ্ৰবাহু প্রথমটায় আসতে চান নি। চাণক্য বললেন, অদ্ভুত তো, আচার্য? আপনি আপনার শিষ্যের পছন্দ করা পাত্রীকে দেখবেন না, তা কেমন কথা। আধ্যাত্মিক অভিভাবক হিসেবে আপনার দেখা আবশ্যক, বলে হাসলেনও।
ভদ্রবাহুও কম যান না। মজা করে বললেন, রাজনৈতিক গুরু যখন দেখছেন, আমি আমার অধিকার বাদ দেব কেন, বলে তিনিও হাসলেন।
চাণক্যের উত্থাপিত দ্বিতীয় বিয়েসম্পর্কিত আইনের কথা শুনে কর্নেলিয়া অবাক হয়ে বললেন, মানলাম পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত কিন্তু পুত্রসন্তানের অজুহাতে দ্বিতীয় বিয়ে, তা হবে কেন?
চাণক্য বললেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নারীদের অধিকার ও বিচরণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। নারীর অধিকার সমাজ বা রাষ্ট্রে স্বীকৃতই ছিল না। কৌটিল্য আইন করে অর্থশাস্ত্রে তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা মৌর্য সাম্রাজ্যে মেনে চলা হচ্ছে।
কর্নেলিয়া জিজ্ঞেস করলেন, এই কৌটিল্যটা কে?
চাণক্য বললেন, শুনেছি তিনি তক্ষশীলায় অধ্যাপক ছিলেন।
চাণক্যের কথা শুনে ভদ্রবাহু মিটিমিটি হাসলেন। চাণক্য আবার তাঁর কথায় ফিরে গেলেন। বললেন, দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটা সাম্রাজ্যের সবাইকে মানতে হয়, এমনকি সম্রাটকেও।
কর্নেলিয়া বললেন, সম্রাটেরই বেশি মানা উচিত, বলে নিকোমেডেসের দিকে তাকালেন। নিকোমেডেসের ব্যাপারগুলো ভালো লাগছে না। চাণক্যকে সে পছন্দ করতে পারছে না। কিন্তু আচার্য ভদ্ৰবাহুকে তার ভালো লেগেছে, যদিও তিনি দিগম্বর বেশেই এখানে এসেছেন। কর্নেলিয়া ও নিকোমেডেসের এ রকম দিগম্বর আচার্য দেখার অভিজ্ঞতা প্রথম। নিকোমেডেস ব্যাপারটাকে সহজভাবে মেনে নিলেও কর্নেলিয়ার জড়তা কাটছে না।
কর্নেলিয়া আবার বললেন, মহামন্ত্রী, আপনি বলছিলেন স্ত্রীধনের কথা। স্ত্রী কি সম্পদ পায় স্বামীর কাছ থেকে?
পিতামাতার কাছ থেকে নারীরা কিছু পায় না। স্বামীর কাছ থেকে পায়। বধূর প্রাপ্য স্ত্রীধন দুই প্রকার:
জীবনযাপনের জন্য উপযোগী ভূমি বা অর্থ এবং শরীর অলংকৃত করার ভূষণাদি। কোনো নারী যদি পুত্রহীন অবস্থায় মৃত স্বামীর প্রতি অনুরক্ত থেকে আজীবন বৈধব্য বরণ করে, সে ক্ষেত্রে গুরুজনদের সাথে অবস্থানকালে আমৃত্যু স্ত্রীধন ভোগের অধিকারী হয়। তার মৃত্যু হলে সপিণ্ডগণ সম্পদের অধিকারী হবে। স্বামীর জীবিত থাকা অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে পুত্ররা মাতৃ সম্পদের অধিকারী হবে, পুত্র না থাকলে কন্যারা।
কর্নেলিয়া অবাক হয়ে বললেন, একি কথা? এ তো বৈষম্য, ন্যায়বিচার নয়। তাহলে কন্যা কখনো রাজসিংহাসন পাবে না?
পাবে। আবশ্যক হলে পাবে।
কী রকম?
কোনো কারণে রাজকুমারের পরিবর্তে যদি রাজসিংহাসনে রাজকন্যাকে অভিষিক্ত করতে হয়, সে ক্ষেত্রে উক্ত রানির সঙ্গে সমজাতীয় পুরুষের বিবাহ সম্পন্ন করে তার গর্ভজাত পুত্রকে পরবর্তী সময়ে রাজাসনে বসানোর জন্য রাজদায়িত্ব পরিত্যাগের প্রতিশ্রুতি তাকে প্রদান করতে হবে।
এ সময় সুবন্ধু এসে উপস্থিত হলেন। চাণক্য ভদ্ৰবাহু সম্পর্কে কর্নেলিয়াকে বললেন, এই আচার্যের অর্থশাস্ত্র একেবারে মুখস্থ। আপনি কথা বলে আনন্দ পাবেন। আমি কয়েক দণ্ডের জন্য যাচ্ছি। এখনই ফিরে আসব।
ভদ্রবাহু বললেন, দেখুন প্রিন্সেস, ব্যত্যয় তো কিছু আছেই। আগে অবস্থাটা একেবারেই জটিল এবং পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার অধীন ছিল। অশিক্ষাই ছিল মূল কারণ। ক্ষেত্রবিশেষে স্ত্রীকে সদাচার শিক্ষাদানের প্রয়োজন দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রেও যাতে সীমা লঙ্ঘন না করা হয়, সে জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এদের স্ত্রীদের অর্ধনগ্ন, উলঙ্গ, অঙ্গহীন, পিতৃহীন, মাতৃহীন—এসব শব্দ প্রয়োগ করে শিক্ষা দেওয়া যাবে না। যদি স্ত্রীকে সদাচার বা বিনয়মূলক শিক্ষায় শিক্ষিত করা না যায়, তাহলে বাঁশের লাঠি বা দড়ি, এমনকি হাত দিয়ে স্ত্রীর পিঠে তিনবার আঘাত করা যাবে।
একেবারে মারধর?
শুনুন, শেষ করি। অকথ্য শব্দ প্রয়োগ, তিনবারের বেশি আঘাত অথবা পিঠের পরিবর্তে মাথা মুখ বা অন্যত্র আঘাত করা হলে স্বামীকে শাস্তি হিসেবে বক্ষ্যমসান বাকপারুষ্য ও দণ্ডপারুষ্যের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
দণ্ড কে দেবে, স্ত্রী?
না না, রাজকুমারী। রাজকর্মচারী, অর্থাৎ প্রদেশত্রি শাস্তি দেবেন। তবে স্ত্রীরও স্বামীকে শাসন করার সুযোগ আছে। তিনি স্বামীকে গণিকাসক্তির জন্য লাঠিপেটাও করতে পারবেন।
চমৎকার তো।
তবে তিনি গালমন্দ ও অধিক লাঠিপেটা করতে পারবেন না। তা করলে স্বামীর মতোই দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে একটা পারস্পরিক অধিকারও কর্তব্যের বিধান আইনে শক্তপোক্ত করা আছে।
কী রকম?
স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি যত বিদ্বেষপরায়ণ হোক না কেন, ছাড়াছাড়ি বা বিবাহবিচ্ছেদ এত সহজ নয়। কেউ চাইলেই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারবে না। উভয়ের সম্মতিতেই তা শুধু সম্ভব।
এতক্ষণ চুপ থেকে নিকোমেডেস হঠাৎ করেই বলল, প্রেম, পরকীয় ব্যভিচারের বিরুদ্ধে অনুশাসন কী?
নিকোমেডেসের কথা শুনে কর্নেলিয়া কটমট করে তাকালেন। তা ভদ্রবাহুর দৃষ্টি এড়াল না। তিনি স্মিত হেসে বললেন, সে কথায় পরে আসছি। নারীর আরেকটি অধিকারের কথা আগে বলি। কর্নেলিয়া তা শুনতে উৎকর্ণ হলেন। ভদ্রবাহু বললেন, নারীর জৈবিক অধিকার এখানে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। তিন বছরের মধ্যেও যদি কোনো ঋতুমতী কন্যার বিয়ে না হয়, তার সঙ্গে সমজাতীয় কোনো পুরুষের মিলন অবৈধ বলে গণ্য হয় না। তিন বছর পর তার অসবর্ণের পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশায়ও বাধা নেই। তবে খুব কম নারীই এ সুযোগ গ্ৰহণ করছে। কারণ, সতীচ্ছদ দোষণীয়। প্রমাণিত হলে অনেক পণ জরিমানা দিতে হয়। এ ছাড়া স্বামীর কাছে তা বড় অপরাধ। এ ক্ষেত্রে স্বামীর বিবাহ শুল্ক প্রত্যর্পণসহ পুনর্বিবাহের যাবতীয় ব্যয়ভার কন্যাপক্ষকে নির্বাহ করতে হয়।
নারীরা তো তাহলে এ অধিকার ভোগ করতে পারে না। এ অধিকারের অর্থ কী?
কর্নেলিয়ার প্রশ্নের জবাবে ভদ্রবাহু বললেন, অর্থ তো অবশ্যই আছে। এ অধিকার ভোগের সীমা চিহ্নিত করে দেওয়া। তিন ঋতুকালের আগে অনেকে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে, তাদের জন্য এ কঠোরতা। রাজকুমার যে জানতে চাইছিলেন, নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশা এখানকার সমাজে মোটেই স্বীকৃত নয়। এটি একটি গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য। নারী-পুরুষের অসংলগ্ন অবস্থায় দেখা গেলে অর্থদণ্ড তো বটেই, বেত্রাঘাতের পর্যন্ত বিধান রয়েছে। এ ছাড়া এ অপরাধের জন্য নানা পর্যায়ে নানা শাস্তি রয়েছে। তবে… এ সময় চাণক্য প্রত্যাবর্তন করেন। ভদ্রবাহুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, তবে কেউ যদি মাতা (পিতার অন্য স্ত্রীসহ), মাসি, মামি, পিসি, গুরুপত্নী, পুত্রবধূ, কন্যা বা বোনের সঙ্গে কোনো প্রকার ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাহলে উক্ত অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
নিকোমেডেস বললেন, কোনো নারী এই অপরাধ করলে?
তার দুই স্তন, ভগাঙ্কুর কর্তনসহ তাকেও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে আইনের অবস্থান বেশ কঠোর।
এ কথা শোনার পর কর্নেলিয়ার আর কিছু শুনতে ইচ্ছা হলো না। ভদ্রবাহুকে উদ্দেশ করে বললেন, এই গ্রন্থের আমার একটি কপি চাই।
আচার্য চাণক্য তার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।
চাণক্য বললেন, অনুলিপি করাতে হবে। সে জন্য সময় লাগবে। আপনি অনুলিপি পাবেন। বলে তিনি উঠলেন এবং ভদ্রবাহুকে বললেন, চলুন কথা আছে।
এরা চলে গেলে রাজকুমারীর মন খুব খারাপ হলো। মনে হলো তার মা এবং ভাই জঘন্য রকম এই মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ করে দিব্যি একসঙ্গে থাকছে। একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাসও বের হয়ে এল। আগুনের উত্তাপে ভরা এ নিঃশ্বাস।