মৌর্য – ৪৭

৪৭

চাণক্য প্রিন্সেসের কাছ থেকে ফিরে এসে সদাচার ভট্টকে ডাকলেন। থর মরুভূমির যুদ্ধে গ্রিকদের পরিত্যক্ত পোশাক, জুতা, শিরস্ত্রাণ ও সমরাস্ত্রের কিছু অংশ আনালেন। এগুলো পরিষ্কার করা হলো।

এ সময় তিনি সেলুকাসকে লেখা পত্র শেষ করলেন। পত্রটা নিজে আবার মনে মনে পাঠ করলেন। পত্রটা এ রকম:

মহামান্য সম্রাট সেলুকাস,

হে মহান গ্রিক গৌরব, দিগ্বিজয়ী বীর মহামতি আলেকজান্ডারের দক্ষিণ হস্ত, নবতর সেলুসিড সাম্রাজ্যের অধিপতি, সেলুসিড সেনাবাহিনীর বিজয়ী অধিনায়ক, পত্রে আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন। মহান মৌর্য সম্রাট চন্দ্ৰগুপ্ত মৌর্য অসুস্থ সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন বিধায় আমাকেই পত্রটি লিখতে হলো, তাই অপরাধ মার্জনা করবেন।

ভারতবর্ষ সম্পর্কে গ্রিকদের যে ধারণা, তার পরিচয় মহামতি আলেকজান্ডারের বক্তব্যে সুস্পষ্ট। কিন্তু ভারতবর্ষের যাঁরা অধিকর্তা, তাঁদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় ও আলাপ-আলোচনার অভাবে আমার মনে হয় ভারতবর্ষের সঙ্গে গ্রিসের একটি বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মহামতি আলেকজান্ডার ভারতের মাটি বা ভূমি জয় করতে চেয়েছিলেন, ভারতীয়দের মনমানসিকতা জানতে বা জয় চান নাই। এই উত্তরাধিকার আপনিও বহন করে চলেছেন। ভারতবর্ষ মিসর, সিরিয়া বা পারস্য নয়, এখানে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের একটি গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। রামায়ণ ও মহাভারত নামক দুটি মহাকাব্যে সে গৌরবময় কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে, আপনাদের যেমন আছে ইলিয়াড ও ওডেসি। আমরা ভারতবর্ষের মানুষেরা মর্যাদা ও সম্মানে বিশ্বাসী। পাশাপাশি অন্য দেশের মানুষের মর্যাদা ও স্বাধীনতায় অন্তঃপ্রাণ।

আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই না। সিন্ধু নদীর ওই পাড়ে আমাদের ভূমির অধিকার চাই। গ্রিস, মিসর, পারস্য কিংবা আরব ভূমির লোভ আমাদের নেই। আপনারা আমাদের জন্য যুদ্ধ অনিবার্য করে দিয়েছেন। আমরা রক্তপাত চাই না। তারপরও অনভিপ্রেতভাবে বহু রক্ত ঝরে থর মরুভূমির বালিতে স্রোত বয়ে গেছে। থর মরুভূমির শুষ্ক বালিও সব রক্ত চুষে নিতে পারে নি। এবার যুদ্ধ হলে সিন্ধু নদীতে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। আমরা তা অবশ্যই চাই না। কিন্তু অনিবার্য যুদ্ধে বাধ্য করলে আমাদের রক্তের হুলি খেলায় নামতে হবে। এবার কিন্তু আপনারা পালাতে পারবেন না। আমাদের বাহিনী আপনাদের ঘিরে রেখেছে।

এ অবস্থায় আমরা চাই আপনারা আমাদের ভূমির দখল ছেড়ে দিন। আত্মসমর্পণ করুন। কীভাবে আত্মসমর্পণ করবেন, তা নিয়ে আলোচনার জন্য আমি নিজেই আসতে চাই।

আর একটি বিষয়। আপনার প্রিয় কন্যা আমাদের এখানে রাজকীয় আতিথেয়তায় আছেন। তাঁকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। তিনি স্বেচ্ছায় এসেছেন এবং ভালো আছেন।

এখন আমার অনুরোধ, উপদেশও মনে করতে পারেন, আপনি অতি দ্রুত একজন দূত পাঠান অথবা আমাদের অগ্রবর্তী ও আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎকারী সৈন্যদের কাছে পত্র প্রেরণ করুন, যাতে সুন্দর ও রক্তপাতহীনভাবে বিশাল একটি ভয়াবহ যুদ্ধের অবসান ঘটে।

আমার ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করছি এবং অচিরেই আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করছি। অন্যথায় চারদিক থেকে আপনি আপনার বাহিনীর ওপর আমাদের বাহিনী হামলা করে বসবে। আপনার পালানোর পথ থাকবে না।

বিনীত ও বিনয়াবনত

চাণক্য।

পত্র লেখা শেষ করে চাণক্য সদাচার ভট্টকে বললেন, তুমি চটজলদি গ্রিকদের পোশাক পরে নাও, দেখি কেমন লাগে।

সদাচার ভট্ট স্তূপের মধ্য থেকে বাছাই করে তাঁর শরীরের মাপের পোশাক পরিধান করলেন। পায়ে বুটজুতো পরলেন। মাথায় শিরস্ত্রাণ লাগালেন। চাণক্য বসা থেকে উঠে এসে শিরস্ত্রাণটা ঠিকঠাক করে দিয়ে বললেন, গ্রিক সেনানায়ক আমাকে অভিবাদন জানাবে না?

সদাচার ভট্ট সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সুবন্ধু তাঁর হাতে একটি ঢাল ও ষোলো ফুট লম্বা সারিসা অস্ত্র তুলে দিলেন। দুটি সমরাভরণ পরিত্যক্ত পোশাক থেকে সংগ্রহ করে জামার পকেটে লাগালেন।

চাণক্য বললেন, কসরত করে দেখাও।

সদাচার তাই করলেন।

বেশ চমৎকার! এবার শোনো, তুমি গ্রিক শিবিরে যাবে। একা নয়, সঙ্গে আরও পছন্দমতো চারজনকে নেবে। তোমরা সম্রাট সেলুকাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ পত্রটি দেবে। পত্রের উত্তর কিংবা তাদের দূত পাঠানোর নিশ্চয়তা নিয়ে ফিরে আসবে। ভেতরে আমাদের গোয়েন্দা এবং তক্ষশীলা এলাকার উদ্বাস্তুরা আছে। এরা প্রয়োজনে তোমাদের সহায়তা দেবে। আমি এই অস্ত্র দিয়েছি বলে নয়, তোমাদের পছন্দমতো অস্ত্র নিয়ে যেয়ো। তোমার সঙ্গীদেরও একই পোশাক পরিয়ে নিয়ো। একটু চিন্তা করে বললেন, না, যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে দেখা করে যেয়ো, সেটাই ভালো হবে। আর হ্যাঁ, ওদের একটি পতাকাও সঙ্গে নিয়ো।

সদাচার চলে গেলে সুবন্ধু বললেন, আচার্য কী করছেন, তাঁকেই পাঠাচ্ছেন?

কেন, সমস্যা কোথায়?

সে বিদ্রোহ করবে আমি নিশ্চিত।

তুমি আগেও এ রকম বলেছিলে।

আচার্য, সেটা ছিল যুদ্ধক্ষেত্র, সেখানে আমরাও ছিলাম।

আচার্য হেসে দিয়ে বললেন, সে পক্ষ ত্যাগ করলেও আমাদের ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। তুমি বরং আমাদের গোয়েন্দাদের তাকে অনুসরণ করতে বলো।

জেনারেল কিউকেকাস সম্রাটের জামাতা। সেলুকাস তাঁকে নিয়ে একান্তে বসেছেন। বন্ধ- দরজা আলোচনা। কিউকেকাস গোবেচারা টাইপের জেনারেল। কিন্তু আজ তাঁকে বেশ বিক্ষুব্ধ মনে হলো। সম্রাট চিন্তিত। পূর্বকথার জের ধরে কিউকেকাস বললেন, ওর পাগলামি নতুন নয়, মহামান্য সম্রাট। যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকা উচিত ছিল। প্রিন্সেস যত্রতত্র ঘোরাফেরা করতে পারে না। যদি শত্রুর হাতে পড়ে, অবস্থাটা কী দাঁড়াবে।

আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। কিন্তু তুমি উত্তেজনা কমাও। অ্যাপোলোর কাছে প্রার্থনা করো যেন অমঙ্গল কিছু না হয়। আমাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। যদি সে মৌর্যদের দ্বারা অপহৃত হয়, তাহলে সমস্যাটা অনেক বড়। এখানে কিছু পাহাড়ি উপজাতি আছে। এরা তাকে আটকে রাখতে পারে।

নিকোমেডেস একটা বুদ্ধিমান নৌ অফিসার, তার উচিত ছিল কর্নেলিয়াকে রক্ষা করে চলা এবং নিরাপদে রাখা। ভারতবর্ষ গ্রিস কিংবা মিসর-সিরিয়া নয়। মৌর্যদের হাতে পড়ে কূলে যুদ্ধ করে উদ্ধার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই, বললেন সেলুকাস।

জেনারেল মোলনকে নিয়ে আসার কথা বলছিলেন।

তুমি কী বলো?

আমার মনে হয় নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে।

তা ঠিক বলেছ। ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে মাথায় রেখো।

সম্রাটের ছাউনি থেকে যাওয়ার পর কিউকেকাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন জেনারেল আর্কিমেডেস। তাঁকে বেশ বিপন্ন মনে হলো। তা দেখে স্বভাবের বাইরে গিয়ে কিউকেকাস স্বতেজে যেন জ্বলে উঠলেন, তুমি সবচেয়ে তরুণ জেনারেল। অথচ তোমাকে দেখলে মনে হয় আজ বা কাল অবসরে যাচ্ছ। কী হয়েছে তোমার?

আর্কিমেডেস বিপন্ন ভাব কাটিয়ে সপ্রতিভভাবে অবাক বিস্ময়ে তাকালেন কিউকেসাসের দিকে। বললেন, কিছু না। কর্নেলিয়ার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

তা তো জানি।

আমি খুঁজে পাচ্ছি না। গোয়েন্দাও ব্যর্থ।

তোমাকে কেউ দায়িত্ব দিয়েছে, অফিসার?

মহামান্য সম্রাট আদেশ করলেন, আমি আপনার সাহায্য চাচ্ছি।

আমি হাসতে পারলে ভালো হতো। সে তো তোমাকে পাত্তাই দেয় না। ব্যক্তিগতভাবে বিমর্ষ কিংবা বিপন্নবোধ করার কোনো কারণই নেই। সমস্যা তোমার একার নয়, এখন সেলুসিডদের জাতীয় সমস্যা। আর ভৌগোলিকভাবে চিন্তা করলে সমগ্র সেলুসিয়ার সমস্যা।

আর্কিমেডেস বুঝতে পারছেন না কর্নেলিয়ার নিকটাত্মীয় এই জেনারেলের সমস্যা কোথায়। তাঁরই বেশি উৎকণ্ঠিত হওয়ার কথা। অথচ তিনি উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলছেন। তিনি আবার বললেন, আমি আপনার সাহায্য চাচ্ছি, বুঝতে পারছি না কীভাবে আগাব।

আমার পরামর্শ হচ্ছে, তুমি চুপচাপ বসে থাকো। কর্নেলিয়া নিজের থেকে ফিরে না এলে, বুঝবে সে মৌর্যদের কাছে বন্দী। বন্দিত্ব থেকে তাকে তুমি একা ফিরিয়ে আনতে পারবে না, সেলুসিড পুরো কমান্ডকে সে দায়িত্ব নিতে হবে, ইলিয়াডের হেলেনকে উদ্ধারের মতো।

হতাশ হয়ে আর্কিমেডেস ফিরে গেলেন। ভাবলেন, এই জেনারেলের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যাবে না। জেনারেলের সমস্যা কোথায়, তা-ও বুঝতে পারছেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *