৪১
স্থুলভদ্রকে দায়িত্ব দিয়ে ভদ্রবাহু সিন্ধু উপত্যকায় এলেন। চাণক্য তাঁকে পেয়ে খুশি হলেন এবং বললেন, আচার্য, আপনি এসে আমার মাথা থেকে বড় একটি বোঝা নামিয়ে দিলেন।
ভদ্রবাহু স্বভাবসুলভ হাসি হেসে বললেন, কিছু কি সমস্যা হয়েছে?
আগে বলুন, ভ্রমণ কেমন হয়েছে?
কষ্টকর হলেও চমৎকার। অদ্ভুত সুন্দর এখানকার প্রকৃতি।
আজ পূর্ণিমা। পাহাড়চূড়ায় বসে রাতে পূর্ণচন্দ্রের আলো দেখব দুজনে। তখন সমস্যার কথা বলব। আর একটি বিষয়, আমি এখানে আপনাকে আসতে অনুরোধ করেছি সম্রাটের অগোচরে। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে, দেখা তো হবেই, ব্যাপারটা চেপে যেতে হবে।
শুনেছি যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আপনারা বেঁচে আছেন, এ আমার আনন্দ।
এঁরা যখন কথা বলছেন, তখনই সেনাপতি সদাচর উপস্থিত হলেন। ব্যাপারটা জরুরি, তাই তাঁকে ভেতরে আসতে দেওয়া হলো। চাণক্য জিজ্ঞেস করলেন, কী জরুরি সংবাদ, বলো।
সদাচার বললেন, মহামন্ত্রী, পার্বত্য এলাকায় কিছু ঝামেলা হয়েছে।
গ্রিকদের অবস্থান এলাকায়?
না, আমাদের এলাকায়ই। আদিবাসী কৌকাসেস যোদ্ধারা অরণ্যে অবস্থানরত গ্রিক সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালায়। গ্রিকরা প্রথমে এদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারে নি। বংশদণ্ডের মাথায় বিষমাখা শর সম্পর্কে তাদের পূর্বধারণা ছিল না। এরা এগিয়ে এলে প্রায় সবাই বিষমাখা শরবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এখন গ্রিকরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে ওদের আক্রমণ করতে। আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো।
বেশ তো, যাও। পার্বত্য সৈন্যদের নিয়ে তুমিই তাদের পাশে দাঁড়াও। সুবন্ধু, প্রধান সেনাপতিকে সংবাদ পাঠাও। জরুরি।
প্রধান সেনাপতি এলে চাণক্য তাঁকে বিষয়টি জানিয়ে দ্রুত সদাচারকে সাহায্য করতে বললেন। এ ছাড়া অরণ্যচারী এসব আদিবাসী সৈন্যের আহার্যের সুবন্দোবস্তের নিশ্চয়তা দিতেও আদেশ করলেন। পরে বললেন, ব্যাপারটার দিকে দৃষ্টি রাখো এবং সর্বশেষ অবস্থা আমাকে অবহিত করো। এখন যাও।
যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি প্রসঙ্গে ফিরে এসে চাণক্য ভদ্রবাহুকে বললেন, ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এত ক্ষতি আর কোনো যুদ্ধে হয় নি। জানেন বোধ হয়, এ যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি, গ্রিকরা পিছিয়ে পার্বত্য-অরণ্যে অবস্থান নিয়েছে। চূড়ান্ত বিজয় তাই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাটালিপুত্রের কী অবস্থা?
পাটালিপুত্রের অবস্থা ভালো। সম্রাট-মন্ত্রীহীন রাজধানী মন্দ নয়। তবে ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়।
যুদ্ধক্ষেত্র আর উদার প্রকৃতিতে সব দর্শন, শাস্ত্রকথা, নীতিকথা, রাজ্যশাসন থেমে যায়। এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
আমি এক দিগম্বর সন্ন্যাসী, এসব আমাকে বলার অর্থ কী?
আপনাকে যুদ্ধে যেতে হবে না, ভয় নেই।
এখানে যে খুব নিরাপদ, তা-ও মনে হচ্ছে না। অবশ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আমি এত ভাবি না। ভাববার কথা সম্রাট আর তাঁর মন্ত্রীর, ঠিক বলেছি?
একেবারে ঠিক। চাইলেই আপনি একা মনের আনন্দে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে পারেন, আমরা পারি না। আমাদের পৃথিবী একটা নিরপত্তাবলয়ে আবদ্ধ হয়ে গেছে। আজীবিক সন্ন্যাসীর বেশে বের হয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।
এ রকম বৈরাগ্য ভাব কেন হলো?
মাঝেমধ্যেই এ রকম মনে হয়। কিন্তু কি জানেন? আমরা এ রকম সংসারের মায়ার সুতোয় বাঁধা। যশ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা-এসব আমাদের মোহের মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছে। এর থেকে বের হতে পারি না।
যুদ্ধের ভয়াবহতা মনে হয় আপনার নিজের প্রতি আস্থার ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে।
না, ব্যাপারটা সে রকম নয়।
তাহলে?
বৈরাগ্যের ভাবটি মনে হয় মানুষের সহজাত। তার মূলে আছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ধর্মীয় মোক্ষলাভ নয়। এই মুক্তি নিতান্তই মানব প্রকৃতিজাত। উদার-উদাস প্রকৃতির মধ্যে এলে হৃদয়ের গভীর থেকে এ ভাবটি জেগে ওঠে।
চাণক্যের কথা শুনে ভদ্রবাহু মৃদু মৃদু হাসছেন। ভাবছেন, এসব কথা শোনানোর জন্যই কি এত দূর থেকে পত্র লিখে তাঁকে আনিয়েছেন।
চাণক্য বোধ হয় মনের কথা পড়তে পারেন। তাই বললেন, এত দূর থেকে এসে এসব শুনছেন কেন, তা আপনার মনে হতে পারে। বিশ্বাস করুন, আর যা-ই করুন, আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি, প্রাণ খুলে দু-একটি কথা বলতে পারি, সে রকম কথা শোনার মানুষটি কোথায়? আমার মতের সঙ্গে আপনার মতের কোনো মিল নেই, বিশ্বাসেও আছে বড় ফারাক। তবু আপনার ভেতর কোথায় যেন আমার জন্য একটু আশ্রয় আছে, জায়গা আছে, যার জন্য প্রাণ খুলে আপনাকে সব কথা বলতে পারি। সংসারের জটিল ও ক্লান্ত জীবনের বিশ্রামও বলতে পারেন একে। প্রখর রোদে কৃষক উন্মুক্ত প্রান্তরে বটবৃক্ষের নিচে আশ্রয় নেয়।
ভদ্রবাহু বললেন, আচার্য, আজ সন্ধ্যায় আমরা শুধু জ্যোৎস্না বিলাস করব। যে কথা বলার জন্য আমাকে এনেছেন, এখনই তা বলে ফেলুন।
‘অর্থশাস্ত্রে’ কথাটা আমি বলেছিলাম, প্রত্যেক রাজার একজন আধ্যাত্মিক পথ নির্দেশক (কাউন্সেলর) থাকবেন। তাহলে রাজার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হবে, তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
আমি তা পড়েছি, আচার্য।
লেখার উদ্দেশ্যটা জানা থাকলে আপনার করণীয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা জন্ম নেওয়ার কথা।
বুঝতে পারলাম না, আরও স্পষ্ট করুন।
চাণক্য হেসে দিয়ে বললেন, আপনার আধ্যাত্মিক শিষ্য স্থিরতায় নেই, মানসিক অস্থিরতায় আছেন।
কারণ কী?
বুঝতে পারছি না। যুদ্ধের ভয়াবহতা তার একটি কারণ হতে পারে। ইদানীং তিনি রক্তপাতটা এড়িয়ে চলতে চান। এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে রক্তপাত ছাড়া তা সম্ভব নয়। থর মরুভূমিতে হাজার হাজার চিতা জ্বলবার সময় তাঁকে অত্যন্ত বিচলিত দেখা গেছে।
আপনার ‘অর্থশাস্ত্রে’ রাজার ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনা রয়েছে নৈতিক ও সৎ শাসনের জন্য, যুদ্ধে মনোযোগী হওয়ার জন্য নয় কিংবা নিষ্ঠুরতা দেখানোর জন্য নয়।
আপনি নিশ্চয়ই চান এ যুদ্ধে আমরা জয়ী হই।
সন্দেহ নেই।
তাহলে এটাও স্বীকার করবেন যে যুদ্ধের সর্বাধিনায়কের অমনোযোগিতায় যুদ্ধ জয় করা সম্ভব নয়।
মানছি।
তাহলে আমি আপনার সহায়তা চাইতেই পারি, বলে প্রচুর হাসলেন চাণক্য। পরে আবার বললেন, আমি চিন্তা করে দেখেছি, সম্রাটকে পুনরুজ্জীবিত করা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়, এ ক্ষেত্রে আপনি ছাড়া গত্যন্তর নেই।
ভদ্রবাহু হেসে দিয়ে বললেন, আপনার পরামর্শ কী?
পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা, যৌবনদীপ্ত করে তোলা।
এটি গ্রিক রাজকুমারীর কাজ, আপনি বরং তাঁকে আনিয়ে নিন।
প্রয়োজনে আমি সে কাজও করব। এ যুদ্ধে আমাদের জিততে হবে। আমি কোনো চেষ্টাই বাদ দেব না।
মহামন্ত্রীর মতোই কথা
আজ জ্যোৎস্না বিলাসে আমি যাব না, যাবেন আপনি আর সম্রাট। মনোচিকিৎসায় জোৎস্নায় সাঁতার (থেরাপি) সহায়ক হতে পারে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা দেব। তার আগে চলুন দুজনই সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি।
সম্রাটের শিবির হাঁটার দূরত্বে অবস্থিত। পাহাড়ের চূড়ায়। চারদিকে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা। নারী নিরাপত্তাকর্মীদের পরে আর দুই স্তর নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। এগুলোয় পুরুষ রক্ষীরা অবস্থানরত। দুই আচার্য পাশাপাশি হেঁটে পাহাড়ে উঠছেন। অবশ্য পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি তৈরি করা আছে। তাঁদের বয়স হয়েছে। দুজনই ষাটোর্ধ্ব প্রায়। কিন্তু শারীরিক শক্তিতে কোনো টান ধরেছে বলে মনে হচ্ছে না।
ভদ্রবাহুকে দেখে খুবই অবাক হলেন চন্দ্রগুপ্ত। তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্ৰবাহু বললেন, শুনলাম তোমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছ, তাই আমি চলে এলাম। বিজয় উৎসবে শামিল হওয়ার আনন্দই আলাদা।
চন্দ্রগুপ্ত ভাবলেন, এটি কথার কথা, তাঁর গুরুর আগমনের কারণ ভিন্ন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর কোনো বিপদের পূর্বাভাস পেয়েছেন। সময়মতো হয়তো জানাবেন, অথবা জানাবেন না, গোপনে গোপনে কাজ করে যাবেন। মুখে বললেন, সে আপনার কৃপা, আচার্য। আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি এবং প্রাণিত বোধ করছি।
যুদ্ধজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ। তবে যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নি, আচার্য।
জানি। তোমাকে আমি বলেছিও, এ যুদ্ধ শেষ হতে সময় লাগবে। আমি যত দূর বুঝতে পারি, এই যুদ্ধের ফলাফল তোমাদের পক্ষে যাবে।
উভয় পক্ষের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, আচার্য। থর মরুভূমিতে জ্বলতে থাকা চিতাগুলোর কথা আমি এখনো ভুলতে পারছি না। হাজার হাজার চিতা একসঙ্গে জ্বলেছে। চিতার লেলিহান শিখা আরও মৃত্যুর আহ্বান জানাচ্ছে যেন। কিছু দুঃস্বপ্নও দেখেছি। আপনি এসে ভালোই করেছেন। আপনার কাছে স্বপ্নগুলোর মর্মার্থ জানতে চাইব।
নিশ্চয়ই মর্মার্থ জানবে। তোমার শরীরের দিকে একটু মনোযোগী হও। আজ রাতটা আমি তোমার সঙ্গে কাটাব, আপত্তি আছে কি?
আপত্তি থাকবে কেন, আচার্য? এ আমার সৌভাগ্য।
বেশ, তাহলে সে ব্যবস্থা করো।
আচার্য চাণক্যের দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন ভদ্রবাহু। চাণক্য সম্রাটের উদ্দেশে বললেন, মহামান্য সম্রাট, আপনাকে অবহিত করা প্রয়োজন, আদিবাসী কৌকাসেস সৈন্যরা পাহাড়ে অবস্থানরত গ্রিকদের অতর্কিতে আক্রমণ করে কয়েকজনকে হত্যা করেছে এবং গ্রিকদের দ্বারা প্রবলভাবে আক্রান্ত হয়েছে। আমি সেখানে পার্বত্য সেনাদের একটি দল পাঠিয়ে দিয়েছি।
ভালো করেছেন। কৌকাসেসদের রক্ষা করতে হবে। এরা বনভূমির মতোই উদার ও সহজ- সরল। আমাদের সৈন্যদের চিনতে পারবে তো?
তা পারবে। একটু ভেবে আবার বললেন, মহামান্য সম্রাট, সম্রাট আলেকজান্ডারের আক্রমণে সিন্ধু উপত্যকার ভারতীয় অধিবাসীরা বাসস্থান ত্যাগ করে উদ্বাস্তু হয়ে যায়।
তা আমি জানি। এখন কী হয়েছে?
বলছি। এদের তক্ষশীলায় কোনো ঝামেলা ছাড়াই বসতি দেওয়া হয়েছিল।
প্রথমে রাজা অম্বী অবশ্য আপত্তি করেছিলেন। প্রতিবেশী রাজারা এ বিপর্যয়ে সহায়তার আশ্বাস দিলে অম্বী তা মেনে নেন, বললেন ভদ্ৰবাহু।
একেবারেই ঠিক, বললেন চাণক্য। শেষে বললেন, এদের মারাত্মক ক্ষোভ রয়েছে গ্রিকদের বিরুদ্ধে। বাস্তুচ্যুতি তো সাধারণ কথা নয়।
দেখুন, এত বছর পরও তাদের আত্মপরিচয়ের সংকট রয়েছে। তক্ষশীলায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল পরিচয় যাচাই করে। ভদ্রবাহুর এ কথায় চাণক্য মাথা নেড়ে বললেন, তাদের বাস্তুহারা করেছিল।
সম্রাট বললেন, এদের দিয়ে কী করাতে চাচ্ছেন?
একটি অগ্রবর্তী বাহিনী, যারা গ্রিক অবস্থানের স্থানগুলো চেনে এবং সে জন্য স্থানগুলো তাদের দ্বারা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া এরা যুদ্ধও করবে। এত দিন পর নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পেয়ে এরা উত্তেজনায় ফেটে পড়বে এবং গ্রিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এদের কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠাবেন?
এরা পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। তারপরও প্রাথমিক একটা ধারণা দিয়ে তবেই পাঠানো হবে। সব রকম সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
চাণক্য চলে যাওয়ার পর ভদ্রবাহু বিশ্রামে গেলেন।
সম্রাট তখনো বুঝতে পারছেন না ভদ্রবাহুর অপ্রত্যাশিত আগমনটা অলৌকিক ঘটনা কি না।