মৌর্য – ৪

এত কিছুর মধ্যে ব্যস্ত থেকেও সম্রাট গ্রিক রাজকুমারীর কথা ভুলতে পারছেন না। প্রতিক্ষণেই মনে পড়ছে। তক্ষশীলা থেকে পাটালিপুত্রে যাত্রাকালে সারা পথেই ভাবলেন রাজকুমারীর কথা। প্রকৃতির সর্বত্র যেন সে মুখচ্ছবি। মাঝেমধ্যে ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।

আচার্য চাণক্য সবকিছু লক্ষ করছেন। কিন্তু নিজে থেকে কিছু বলছেন না। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের একজন সম্রাজ্ঞী রয়েছেন। নাম দুরধরা। দুরধরা ছিলেন তাঁর মামাতো বোন। রাজপরিবারে জন্মেছেন। রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে মা তাঁর ভাইয়ের কাছে চলে যান। এই দুরধরাকে এক রাজকুমার জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে উদ্ধার করে বিয়ে করেন। বেশি দিন হয় নি বিয়ে হয়েছে। এই অবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়ে যান আচার্য চাণক্য। অবশ্য রাজপরিবারে একাধিক রানি থাকার ঐতিহ্য ভারতবর্ষে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। চাণক্যের চিন্তার কারণ এটি নয়, চিন্তার কারণ, এই তরুণ সম্রাটের মনোযোগ ভোগের দিকে গেলে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার ও স্থিতি হুমকির মধ্যে পড়বে। তবে সম্রাটকে কোনো কাজে বাধা দেওয়া সমীচীন হবে না, ব্যক্তিগত ব্যাপারে তো নয়ই। চাণক্য স্থির করলেন, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং সম্রাটের সিদ্ধান্তকে সুবিধাজনক কাজে লাগাতে হবে।

পাটালিপুত্রে ফিরে এসে সাত দিনের মাথায় আচার্য চাণক্য একটি আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেললেন। কাজটি এত দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে ভাবেননি, শেষ করে বরং নিজেই আত্মশ্লাঘা বোধ করলেন। এটি বিশ্বের প্রথম আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামো। তার পরিচয় জানা যেতে পারে (মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকায়’ কাঠামোটির পরিচয় দেওয়া হয়েছে)।

চন্দ্রগুপ্ত খসড়া কাঠামোয় চোখ বুলিয়ে বললেন, চমৎকার কাজ করেছেন, আচার্য। তবে অমাত্যের সংখ্যা এত বেড়েছে যে প্রশাসনের মূল নিয়ন্ত্রণটা তাদের হাতে চলে যাবে। আমার মনে হয়, কর্মান্তিক আর অধ্যক্ষ বা তত্ত্বাবধায়কের পদ বাড়িয়ে দিন। রাজ্যের সেরা কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন, তাই বাঞ্ছিত। নগরের দায়িত্ব আলাদা করেছেন, খুব ভালো। ব্যবস্থাপকের নামটাও সুন্দর দিয়েছেন ‘নাগরিক’। নগর আধুনিক সৃষ্টি, এখানে সেবাটাও সে রকমই হওয়া উচিত। তবে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে সামরিক বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণের ওপর।

আচার্য চাণক্য বললেন, অন্ত পাল (সেনাপতি), দৌবারিক (প্রধান গার্ড) এবং অন্তর্বিংশক (অভ্যন্তরীণ প্রধান গার্ডদের) আলাদা করে দিয়েছি। নগর বিচারকের নির্দেশে একটা কর্তৃপক্ষ সামরিক বাহিনীকে চালাবে। কর্তৃপক্ষের অধীনে প্রতিটিতে পাঁচ সদস্যের সমন্বয়ে ছয়টি বিভাগ থাকবে। বিভাগগুলো যথাক্রমে নৌজাহাজ, স্থলে ষাঁড়টানা লরি ও অশ্বযান, সৈন্যবাহিনী ও পশুদের খাদ্যদ্রব্য, পদাতিক, অশ্বারোহী, রথী এবং গজারোহী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অশ্বারোহী ও গজারোহী সৈন্যদের একটা বিশেষ বাহিনী থাকবে মহামান্য সম্রাটের নিরাপত্তা (পদাতিক) বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত। রাজকীয় অস্ত্রাগারের কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণ সম্রাটের পক্ষে কোনো অমাত্যের হাতে থাকবে।

সম্রাট বললেন, অসাধারণ। বেসামরিক প্রশাসনের হাতে সামরিক ও অন্যান্য পোশাকধারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তা-ই যথার্থ।

লাঠির নিয়ন্ত্রণ লাঠির হাতে দেওয়া যায় না, মহামান্য সম্রাট, বললেন চাণক্য। এবার বেসামরিক প্রশাসনের রূপরেখাটায় লক্ষ করুন। অপরাধ প্রশাসনের প্রধান প্রদেশত্রি (ম্যাজিস্ট্রেট), তাঁর অধীনে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত অধ্যক্ষরা দায়িত্ব পালন করবেন, যেমন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নদী, পাহাড়, ভূমি প্রভৃতির পরিমাণ নির্ণয়, জল নিয়ন্ত্রণ, সেচবাঁধ, . জলবণ্টন নিশ্চিতকরণ প্রভৃতি। এসবের দায়িত্বে থাকবেন একজন অধ্যক্ষ। তাঁর অধীনে থাকবে নানা কর্মিক (কর্মচারী)। এরা ব্যাধদের দেখভালও করবে, স্থান ত্যাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখবে। তাদের উন্নয়নের কাজটিও এরা দেখবে।

আচার্য, রাজস্ব বিভাগের কথা বলুন। রাজা বা সম্রাটকে রাজস্ব বা কর নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত দেখিয়েছেন কেন?

এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়, মাননীয় সম্রাট।

তাহলেও এটি প্রধান উপদেষ্টা বা মহামন্ত্রী, অর্থাৎ আপনার অধীনে রাখুন। বিভাগীয় অধ্যক্ষ কে?

গোপ। এরা কর নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখবে না, কর নির্ধারণ রাজ্যের নীতিগত ব্যাপার। এরা শুধু কর আদায় করবে।

এখানে দেখছি সবচেয়ে বেশি কর্মিক।

তাদের কর্মপরিধিও বিশাল, মহামান্য সম্রাট।

হ্যাঁ, তা-ই তো দেখছি, কাঠুরে, মিস্ত্রি, কামার–কেউ বাদ যায় নি। সড়ক নির্মাণের কাজটা এরা কেন করবে?

দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর আদায়ের সুবিধার্থে এ কাজটি এখন এরাই করবে। পরে অন্য কাউকে এ দায়িত্ব দেওয়া যাবে।

নাগরিকের অধীনে একজন অধ্যক্ষ আছে।

এখানেও প্রতিটিতে পাঁচজন সদস্যের সমন্বয়ে ছয়টি দল শিল্প, বিদেশিদের দেখাশোনা, প্রজাদের জন্ম-মৃত্যু, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যবহার্য সামগ্রী উৎপাদন ও বিপণন এবং বাজার পর্যবেক্ষণ ও জনস্বার্থ রক্ষার কাজ করবে।

বিদেশিদের দেখাশোনার বিষয়টায় বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে হাসলেন সম্রাট। নিজেই আবার পড়লেন, তাদের আবাসনব্যবস্থা, গতিবিধি দেখা, সঙ্গে থেকে সহায়তা দেওয়া, অসুস্থ হলে সেবার ব্যবস্থা করা, মৃত বিদেশির সৎকার এবং এদের সম্পদ নিকটজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া—বেশ ভালো! কিন্তু আচার্য, সবই তো দেখলাম, ধর্মীয় লোকদের বেলায় কিছু বলা নেই কেন?

মহামান্য সম্রাট, ধর্ম নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্মের ওপর রাষ্ট্রের বা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয়, এ ছাড়া রাষ্ট্র বা সরকার কোনো ধর্মের নিয়ন্ত্রণ মানলে, অন্য ধর্মের প্রতি অবিচার করা হয়।

বলছেন কী আপনি, আচার্য?

আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের বাইরে থাকবে ধর্মীয় অনুশাসন। তার কারণও আছে।

কী কারণ?

মৌর্য সাম্রাজ্যের বৃহত্তর ঐক্য ও আদর্শ। পুরোহিত ব্রাহ্মণ, সিদ্ধাচার্য, শ্রুতকেবলী, আজীবিক আচার্য—সবাই নিজ নিজ অবস্থানে শক্তিশালী। ভূমিসহ নানা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতে। কাউকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। মর্যাদা সবাই পাবেন, গুরুত্ব পাবেন ধর্মস্থানে, আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনে নয়, তাহলে সাম্প্রদায়িক শক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে, রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইবে।

আপনি কি ভেবে দেখেছেন, সমাজ ক্রমশ ভূমি ও কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ছে? আমার মনে হয়, আমলাতন্ত্র রাজার সঙ্গে প্রজাদের আরও দূরত্ব বাড়িয়ে দেবে।

তা দেবে, সম্রাট। সামাজিক দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়ে আসবে। অমাত্য কিংবা সামন্ততন্ত্র ও আমলাতন্ত্র নতুন নতুন পদ ও কর্মচারীর নিয়োগ সামাজিক দৃষ্টি সংকীর্ণ করে দেবে। রাজপদোপজীবীর সংখ্যা বাড়লে চাকরিজীবী সম্প্রদায় (মধ্যবিত্ত) সৃষ্টি হবে। তাহলে ফল কী হবে, সময় অভাবে তক্ষশীলায় বক্তা বলতে পারে নি। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রের অধ্যক্ষ প্রচার অধ্যায়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। নেতিবাচক দিক হচ্ছে, প্রজাদের সঙ্গে রাজার সম্পর্ক এখনকার মতো সরাসরি থাকবে না। ভালো দিক হলো, রাজার সর্বময় কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাবে, রাজপরিবারের আভিজাত্য ও জৌলুশ বাড়বে এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ অধিকতর সংহত হবে।

প্রজার অধিকার নিশ্চয়ই হ্রাস পাবে। দায়দায়িত্ব বেড়ে যাবে। এই যন্ত্রায়ণে সবার ন্যায়বিচার কি সম্ভব হবে?

তা হবে না, সম্রাট।

তাহলে কৌটিল্য সে দিন কী শেখালেন?

পুস্তকের শিক্ষা আর বাস্তব একেবারে ভিন্ন, মহামান্য সম্রাট।

এমন সজ্ঞান সচেতন ও সর্বব্যাপী কর্তৃত্বপূর্ণ প্রশাসন কি সাম্রাজ্যে ঐক্য আর সুখ বয়ে আনবে?

এটা এখনই বলা শক্ত। তবে দেখবেন, এতে রাজবংশ, উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণির লোকেরা, বিশেষ করে নবসৃষ্ট রাজপদোপজীবী শ্রেণির লোকেরা তা পরিপূর্ণভাবে সমর্থন করছে। এরা ক্ষমতাশালী, তাই প্রভাবশালীও। রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রেও ব্যাপারটি স্বীকৃত। দেখবেন, অমাত্য, রাজপারিষদ সবাই এই কাঠামোগত পরিবর্তনকে সমর্থন করছে।

আচার্য, আমাকে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে দিন। আমি অমাত্য-রাজপারিষদের সঙ্গে এ নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে কথা বলি। এ তো দেখছি বিশাল সংস্কার।

এই প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্বিন্যাসের জন্যই আগামী দিনের মানুষ আপনাকে মনে রাখবে, সম্রাট।

তারা নিশ্চয়ই জানবে এর পেছনে কার মাথা কাজ করেছে।

সম্রাটের কথা শুনে আচার্য চাণক্য উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *